#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ১২
সাঈদ বন্ধুমহলের সবাইকে ইনভাইট করেছে তার বাসায়।মেহরান আগামীকাল ঢাকার বাইরে কিছু বিজনেসে কাজে যাবে।এদিকে রাউশিও আজকাল তাকে ইগনোর করছে বিধায় রাজি হয়েছে যেতে।নুজাইশ,তুষার, এহসান, আলভি সবাই পৌঁছে গেছে সাঈদের বাসায়।এখন বাকি শুধু মেহরান।তাদের এই বন্ধুমহলের সবাই বিদেশে একসাথে একই ভার্সিটিতেই পড়াশোনা করেছে।বাকিরা দেশে চলে আসলেও সাঈদ, মেহরান অনেক পড়ে দেশে এসেছে। মেহরান সাঈদ যে বিল্ডিং এ থাকে সেখানে গাড়ি থামায়।গাড়ি পার্কিং করে এসে লিফটের সামনে দাড়াতেই আলভি কল করে।যেহেতু পোঁছেই গেছে তাই আর কল রিসিভ করে না মেহরান।সোজা সাঈদ যেই ফ্ল্যাটে একা থাকে সেখানে চলে আসে।কলিংবেল বাজাতেই ভেতর থেকে সাঈদ এসে দরজা খুলে দেয়।সাঈদ হাসে মেহরানকে দেখে।
“ভেবেছিলাম তুই আসবি না।”
মেহরান ভেতরে প্রবেশ করে।ভেতরে সবগুলা কাছে এসে মেহরানকে জড়িয়ে ধরে।একেকজন এভাবে চেপে ধরাতে মেহরান বলে ওঠে,
“ছাড় এভাবে চিপকে ধরে আছিস কেন?”
সবগুলা হেসে ছেড়ে দেয়।নুজাইশ চেয়ারে বসে ওয়াইন খাচ্ছে।তুষার মেহরানকে খোঁচা মেরে বলে,
“মেয়ে হলে নিশ্চয় এভাবে বলতি না?”
সবাই হেসে ওঠে।নুজাইশ কাছে এসে বলে,
“আজকাল মেহরান বেশি বিজি থাকে।ওরে কল দিলেও পাওয়া যায় না।তোর কিসের এত ব্যস্ততা আমরা আসলে কেউ বুঝতে পারি না।”
মেহরান কিছু না বলে একটি চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে।পরনের শার্টের টপ দুইটা বোতাম খুলে দেয়।বাকিরাও কাছে এসে বসে।সাঈদ এবার মেহরানের সামনে এসে বসে বলে,
“সমস্যার সমাধান হয়েছে?”
“না।”
পাশে থেকে এহসান জিজ্ঞাসা করে,
“কিসের সমস্যা?”
সাঈদ মেহরানের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“আমাদের মেহরানের মন খারাপ।আজ অনেকদিন যাবৎ নাকি সে মেহরানের সাথে কথা বলছে না।”
সবাই কৌতূহলী হয়ে পড়ে।তুষার এগিয়ে এসে অতি উৎসাহিত হয়ে সাঈদের কাধে চাপড় মেরে বলে,
“এই এই আমাদেরও খুলে বল ভাই।সিক্রেট রাখছিস কেন? কিরে মেহরান? ভাবী হলো নাকি রে?”
মেহরান নিশ্চুপ।গম্ভীর মুখে বসে আছে। বন্ধুদের সাথেও সবসময় এভাবে মুখ গম্ভীর রেখেই থাকে।সবাই চঞ্চল স্বভাবের হলেও আলভি আর মেহরান অত্যন্ত শান্ত আর গম্ভীর ধাঁচের।নুজাইশ মেহরানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“কিরে বললিও তো না।”
সাঈদ হালকা কেশে বলল,
“ওর কাজিন রাউশির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে আমাদের মেহরান।”
মেহরান চোখ রাঙায় সাঈদকে।প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে মানে এসব কি কথা?মেজাজ দেখিয়ে বলে,
“প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার কি বয়স আমার?”
সাঈদ হো হো করে হাসে।বাকিরা যেন এবার অতি উৎসাহিত হয়।মেহরানকে ঘিরে ধরে একসাথে বলে,
“কিরে মেহরান সত্যিই?ছবি দেখা ব্যাটা।”
মেহরান টেবিলে থাকা একটা ওয়াইনের গ্লাস হাতে নেয়।এক চুমুক দিতেই বাকিরা আবারও রাউশিকে দেখানোর জন্য বলে। মেহরান মিথ্যা বলে,
“ছবি নেই।বিয়ের দিন দেখে নিস।”
হৈ হুল্লোড় পড়ে যায় বাকিদের মাঝে।একেকজন একেক বিষয়ে এবার আলোচনা শুরু করে।নুজাইশ মেহরানের পাশে এসে বসে।সাঈদের এই ফ্ল্যাটটা নিজের কেনা ভীষণ সুন্দর।সাঈদের বাবা একজন বিগ্রেডিয়ার।ছেলেকেও সেই প্যাশন বেছে নিতে বললে সাঈদ মানা করে তাইতো বাবা মায়ের থেকে আলাদা করে এভাবে একা থাকে।নিজের পছন্দের প্যাশন ডাক্তারিটা হেছে নিয়েছে সে।নুজাইশ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,
“আর ছয়দিন পর আমার বোনের বিয়ে। অবশ্যই সবাইকেই যেতে হবে।”
এহসান মজা করে বলে,
“ইশশ তোর এত্তো সুন্দর বোনটাকে আমার হাতে তুলে দিলি না।আমি যাব না।”
সাঈদ বলে,
“বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তুই কবে বিয়ে করবি?”
মেহরানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোর তো তাড়াতাড়ি বিয়ে করা উচিত মেহরান।পাত্রী পছন্দ আছে।অন্তত কেউ তো বিয়ে কর।শুধু আলভিই এতো তাড়াতাড়ি মেরে দিলো।শালা তুমি আমাদের থেকে অনেক বেশিই ফার্স্ট।”
আলভি চুপ করে বসে আছে।বছরখানেক আগেই বিয়ে করেছে বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রীকে।সুখের সংসার।স্ত্রী ছয়মাসের প্রেগন্যান্ট।এহসান বলে উঠলো,
“শুনেছি তোর নাকি বাচ্চা হবে?”
মেহরান ভ্রু কুচকে তাকায় এহসানের দিকে। নুজাইশ হো হো করে হেসে ওঠে।তার হাসির সাথে তাল মেলায় আবার তুষারও।আলভি হাতে গ্লাস নিয়ে তখনও চুপচাপভাবে ধীরে সুস্থে চুমুক দিচ্ছে।সাঈদ হাসতে হাসতে বলে,
“শালা ওর না ওর বউয়ের।”
“আমার কথাটাও এমনই ছিলো।বাট বলতে একটু মিসটেক হয়েছে।”
“এতো মিসটেক হলে চলে?নাকি তুইও কোথাও পিচলে গেছিস?”
মাথা চুলকে হাসে তুষার।সত্যি বলতে তার এক মেয়েকে পছন্দ হয়েছে।নাম অজানা তবে কিছুদিন আগে বাজারে দেখেছিলো মেয়েটাকে।একটা দোকানদারের সাথে ঝগড়া করতে।মেয়েটার তেজ দেখে প্রথমেই অনেক ভালো লেগেছে তুষারের।তবে মেয়েটার খোজ আর পায় নি।তবে তার মতে মেয়েটার সাথে পুনরায় দেখা হবে তুষারের। সবাই আবারও গল্পে মেতে ওঠে।মেহরান তাদের থেকে সড়ে সামনে যায়।এই ফ্ল্যাটের বারান্দা বিশাল বড়।ঠান্ডা বাতাস হচ্ছে। মেহরানের খুব করে রাউশিকে মনে পড়ছে। মেয়েটা তাকে ইগনোর কেন করছে এটা সে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে।তবে রাউশি কি বোঝে না মেহরানের কোনো সমস্যা নেই।মেহরানের কাধে হাত রেখে পাশে দাঁড়ায় আলভি।স্থিরদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে থেকে বলে,
“কিছু হয়েছে?”
“বুঝলাম না আমায় ইগনোর কেন করছে?”
“হয়তোবা মেয়েটার মাঝে কোনো জড়তা আছে আর নাহয় তোকে অপছন্দ।তবে অপছন্দ হওয়ার কোনো মানেই হয় না।”
‘অপছন্দ’ শব্দটা একবার মুখে আওড়ায় মেহরান।আলভি বুঝদার ছেলে।কথাগুলো খুব সুন্দর সাজিয়ে বলতে পারে ছেলেটা। আলভির সাথে দেখা হয়েছিলো একটি ইতালির একটি রেস্টুরেন্টে।মেহরান তখনও জানতো না এই ছেলে তারই মতো ইংল্যান্ডে থাকে।ভার্সিটিও একই।ডিপার্টমেন্ট আলাদা শুধু।তখন থেকেই আলভির সাথে ভালো একটা পরিচয় হয় তার।একটাসময় গিয়ে ভালো বন্ধুত্বের কাতারেও পড়ে যায়। মেহরান হাতে থাকা গ্লাসে একের পর এক চুমু দিতে থাকে।দুজনে ভেতরে চলে যায়। বাকিরা নুজাইশকে নিয়ে কি বিষয়ে যেন হাসাহাসি করছে।মেহরান সেখানে গিয়ে একটি বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খাওয়া শুরু করে।বাকিরা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।এই ছেলে আজ এতো ড্রিংকস করছে কেন বুঝলো না কেউ?
বন্ধুদের সাথে পার্টি শেষে বাড়িতে ফিরে আসে মেহরান।মাতাল হলেও নিজেকে কন্ট্রোলে রেখেছে।বাড়িতে এসে সোজা রাউশির রুমের সামনে যায় তবে রুমের দরজা খোলা দেখে সেই অবস্থাতেই মনে পড়ে সকালে তাজবিরকে বলেছিলো রাউশিকে মিথ্যা বলতে আজ মেহরান চলে যাবে কিছু কাজে।কাজ হয়েছে বুঝতে পেরে ম্লান হাসে মেহরান।ঢুলুঢুলু পায়ে এদিক ওদিক কিছুটা খুজে নেয়।এই রাতে মেয়েটা কোথায় যাবে বুঝতে না পারলেও পরক্ষণে ছাদের কথা মনে পড়ে।ছাদে যেতেই রাউশিকে বসে থাকতে দেখে পেছন থেকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।আজ অনেকদিন পর দেখা মেয়েটার।কাছে এগিয়ে গিয়ে গুনগুনে আওয়াজে গান শুনতে পায়।তখনই নিজের মনোভাব প্রকাশ করে ফেলে।
এদিকে রাউশি মেহরানের গলার আওয়াজ শুনে পিলে চমকে ওঠে।মেহরান তো ঢাকার বাইরে আজই চলে গিয়েছিলো।তবে এখানে কি করছে?তাজবির কি মিথ্যা বলেছে রাউশিকে।ভাবতেই গা জ্বলে ওঠে রাউশির।পেছনে তাকিয়ে দেখে মেহরান কেমন করে যেন দাঁড়িয়ে আছে আর দৃষ্টিও কেমন ঘোলা।মেহরান কাছে এগিয়ে আসতেই বিদঘুটে গন্ধ এসে নাকে লাগে রাউশির।বুঝতে আর বাকি থাকে না মেহরান ড্রিংকস করেছে।রাউশি খুব শান্তভাবে বলে,
“ভাইয়া আপনি এখানে কি করছেন?আপনি তো_”
মেহরান আরেকটু এগিয়ে এসে মাতাল হওয়া আওয়াজে বলে,
“কেন আমায় দেখে কি ভালো লাগছে না?”
ঘোরলাগা কণ্ঠ।শুনতেও কেমন একটা আলাদা অনুভুতি এসে যায় মনের গহীনে। চোখ বুজে জোরে একটা শ্বাস নেয় রাউশি। জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে এত তাড়াতাড়ি এমন কিছু চায় নি।এমনকি পরবর্তীতে প্রেমে না পড়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে।তবে মেহরানের জন্য সেটা কতটা সহজলভ্য হবে এটাই ভাবছে রাউশি।মেহরান এবার ধমকে বলে,
“কি বলছি শুনতে পাস নি?”
ধমকে বললেও সেটা আজ ধমকিত শোনায় না যেন।অনুকম্পিত হৃদয় নিয়ে ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে রাউশি জবাব দেয়,
“এমনটা কিছুই না ভা_”
মেহরান নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে ধরে বলে,
“হুশশ।”
কাছে এগিয়ে আসতেই রাউশি পিছাতে থাকে।মেহরান থেমে যায়।মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।রাউশির বিচলিত মুখ দেখে মেহরান ক্ষীণ হাসে। বারবার পলক ফেলে রাউশিকে দেখতে থাকে।দীর্ঘ নেত্রপল্লবে আলাদা মাধুর্য আজ। গোলাপী ঠোঁটজোড়ার দিকে তাকিয়ে নেশা লেগে যাচ্ছে মেহরানের।তবে নিজেকে এমন অবস্থাতেও সংযত করে নেয় সে।ঠিক করেছে বিয়ের আগ পর্যন্ত এমন কিছুই নয়। নেশাক্ত গলায় ফিসফিসিয়ে বলে,
“আমার এই কান তোর মুখ থেকে অন্যকিছু শুনতে চায় রাউশি।অনুভব করতে পারছিস?”
রাউশি কেঁপে ওঠে।মেহরানের গলার স্বরটা আজ খুবই আলাদা শোনালো তার কাছে।অনুভুতিটা অন্যরকম নেশালো বললে ভুল হবে না।
চলবে……
#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ১৩
তুষারের বাবার নিজস্ব ব্যবসা আছে।সেই ব্যবসা আপাতত তুষারই সামলাচ্ছে।ড্রাইভার ছুটি নিয়েছে কিছুদিনের জন্য।তাই নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে অফিসে যাচ্ছে তুষার।রাস্তায় জ্যাম এটা ঢাকা শহরের নিত্যদিনের একটা জটঝামেলা।তুষার চোখের কালো চশমার আড়ালে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলো।তখনই পাশে থেকে হাসির আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকায়। তাকাতেই চোখ চকচক করে ওঠে তার। সেদিনের সেই মেয়েটা।ঠোঁটে আপনা-আপনিই হাসি ফুটে ওঠে তুষারের। মন চাইছে এখনই গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটার কাছে যেতে তবে তুষার সেটা করবে না।আজ মেয়েটার পিছু নেবে ভেবে ঠিক করে নেয় সে।বয়স কি কম হলো নাকি? এখনই তো বিয়ের বয়স।মেয়েটার খোঁজ নিয়ে একেবারে বিয়ের প্রস্তাব দেবে পরিবার থেকে এটাই ভেবে ঠিক করে নেয় সে।জ্যাম ছুটে যেতেই রিকশাটা সামনে আগাতে শুরু করে।তুষারও খুবই ধীরে গাড়ি চালাতে শুরু করে।পিছু নিতে নিতে রিকশাটা একটি ভার্সিটির সামনে গিয়ে থামে।তুষার তো বুঝতে পারে মেয়েটা এই ভার্সিটিতেই পড়ে।সেই মেয়েটা আর তার পাশে অন্য আরেকটি মেয়ে দুজনে নেমে যায়।তুষারও নেমে যায়।চোখের কালো চশমাটা একটু ভালোভাবে ঠিক করে নেয়। কালো কোর্টটা ভালোভাবে ঠিক করে সামনে আগায়।মেয়েটি আর তার বান্ধবী ভার্সিটির গেইটের ভেতর প্রবেশ করে।তুষার খেয়াল করে এই ভার্সিটিতেই তো নুজাইশ জব করে।ভাবতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে নাচতে মন চাই তুষারের।মেয়েটির পিছু পিছু যেতে যেতে নুজাইশকে একটা কল করে।নুজাইশ কল রিসিভ করতেই তুষার খুশিতে বলে,
“আমি তোর ভার্সিটি এসেছি।তুই কোন ডিপার্টমেন্ট যেনো?”
এদিকে নুজাইশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“তুই এখানে কি করছিস?আর কোথায় তুই? ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিংয়ের সামনে চলে আয়।আমি নিচে আসছি।”
নুজাইশের সেসব কথা কানে নেয় না তুষার। সে তো খুবই গম্ভীর ভঙ্গিতে মেয়েটির পেছন পেছন যাচ্ছে।তবে ভাবটা এমন রেখেছে যেন কেউ বুঝতে পারে না তার আসল ধান্দা কি?আরেকটু এগিয়ে যেতেই নুজাইশকে আসতে দেখে তুষার।মেয়েগুলো নুজাইশকে দেখে দাঁড়িয়ে যায় সাথে নুজাইশের সাথে কিছু কথা বলছে তারা।তুষার কৌতূহলী হয়। এই মেয়েটা আবার নুজাইশের ডিপার্টমেন্টের নয়তো?বড় বড় পা ফেলে নুজাইশের কাছে যেতেই নুজাইশের চোখ পড়ে তুষারের দিকে।
রুনা আর শ্রুতি নুজাইশ স্যারের সাথে কথা বলছিলো।স্যার তাদের পেছনের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখে লম্বাটে ফর্মাল ড্রেসে এক যুবক দাঁড়িয়ে।দৃষ্টি কোনদিকে সেটা বোঝা যাচ্ছে না কালো চশমার জন্য।চশমার আড়ালে তুষার যে তার দিকেই তাকিয়ে সেটা রুনা একটুও বুঝতে পারে না।রুনা নুজাইশকে সালাম জানিয়ে চলে যায়। রুনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে তুষার।নুজাইশ কাছে এসে পিঠে চাপড় মেরে বলে,
“তুই এখানে কি করছিস আগে সেটা বল।”
তর্জনী তাক করে নীল টপস পড়া মেয়েটির দিকে, তারপর নুজাইশকে জিজ্ঞাসা করে,
“মেয়েটির নাম কি?”
নুজাইশ ভ্রু কুচকে তুষারের আঙ্গুল তাক করা সেদিকে তাকিয়ে দেখে নীল টপস পড়া রূনাকে।যে কিনা এখন ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ ঢুকছে।স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
“রুনা, ২য় বর্ষের স্টুডেন্ট।কেন? কি হয়েছে?”
তুষার ঠোঁট বাকিয়ে হাসে।নুজাইশ তুষারের মতগতি বুঝতে পারছে না।জিজ্ঞাসা করে,
“কিরে কিছু বলছিস না যে?”
“মেয়েটাকে আমার মনে ধরেছে।এখন তার সম্পূর্ণ ডিটেইলস তুই দিবি।”
নুজাইশ মুখ বাকায়।তবে মনে মনে চমকায় তুষারের হঠাৎ এমন কথায়।এই ছেলের হঠাৎ কি হলো?যে ভার্সিটি এসে মেয়েদের দেখিয়ে বলছে মনে ধরেছে।এমন কথা বলার পাত্র অন্তত তুষার নয়।চঞ্চল,দুষ্টু স্বভাবের হলেও নারীজনিত রোগ তার মাঝে নেই বলা চলে।তবে আজ এমন কি হলো যে ভার্সিটি বয়ে এসে এমন কথা।নুজাইশ আবারও বলে,
“বুঝতে পারছি না ভালোভাবে বল।”
“বুঝতে পারছিস না?মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়েছে।বউ হওয়ার জন্য তো পার্ফেক্ট হবে? তাই না?”
নুজাইশ কিছুটা হলেও বুঝে।তবে চোখ যায় সামনে থেকে হেঁটে আসা মৌরিনের দিকে। মৌরিন কাছে আসতেই নুজাইশকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছাত্রী হিসেবে বিনম্রভাবে সালাম জানায়।
“আসসালামু ওয়ালাইকুম স্যার।কেমন আছেন?”
তুষার রাউশির দিকে তাকায়।রাউশিকে দেখে যেন তার মনে হলো মেয়েটাকে কোথাও দেখেছে।নুজাইশ হেসে বলে,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম মৌরিন। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো স্যার।আসি তাহলে স্যার।ক্লাসে দেখা হবে।”
বলে চলে যায় রাউশি। নুজাইশ সেদিকে তাকিয়ে থাকে এবার।তুষার ভ্রু কুঁচকে বলে,
“এই মেয়েটাকে কোথাও যেন দেখেছি মনে হচ্ছে।”
“মেয়েটার নাম মৌরিন খান।”
তুষার এবার কিছু মনে পড়ার মতো করে বলে,
“ওহ হ্যা হ্যা মনে পড়েছে।এই নুজাইশ এই মেয়েই তো রাউশি।মেহরানের কাজিন। আরেহ মেহরান যাকে পছন্দ করে।গতকাল মনে নেই তোর? আরেহ এই সেই মেয়ে। সাঈদ গতকাল আমায় ছবি দেখিয়েছিলো তুই তো চলে গিয়েছিলি।মৌরিন খান রাউশি ওর নাম।আগে মনে পড়লে তো মেয়েটার সাথে গল্প করতে পারতাম।ইশ।”
আফসোস করতে থাকে তুষার।এদিকে নুজাইশ এখনও স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।তার কানে এখনও বাজছে তুষারের বলা কথাগুলো।নুজাইশের মন খুব করে বলছে এমনটা যাতে না হয়।আবার অপরমন বিদ্রুপ করে বলছে ‘এমনটাই’। নুজাইশের পুরুষমন নড়বড়ে হয়ে ওঠে। সত্যটা যাচাই করতে তখনই মেহরানকে কল করে।একবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়।
“তোর কাজিনের নামটা যেন কি ছিলো মেহরান?যে আমার ডিপার্টমেন্টে ২য় বর্ষের স্টুডেন্ট?”
মেহরান বুঝতে পারে না এই ছেলে এইসময় এটা কেমন প্রশ্ন করছে?এতদিন হলো এখনও নাম জানে না নাকি?যখনই মনে পড়ে সেদিন নুজাইশকে রাউশির নাম বলা হয় নি।রাউশির কথা মনে পড়তেই একটা ভালোলাগা কাজ করে যেন মেহরানের।আজ চারদিন হয়ে গেলো ঢাকার বাইরে এসেছে মেহরান।খুবই গুরত্বপূর্ণ একটি কাজে।সেদিন রাতে রাউশি কোনো উত্তর দেয় নি।তবে ব্যবহার কিছুটা হলেও নমনীয় হয়েছে।এটা ভালো লক্ষ্মণ হিসেবে ধরে নিয়েছে মেহরান।এরপরের দিনই মেহরান চট্টগ্রাম চলে এসেছে।এখানের ব্যবসার কাজটা শেষ হলেও চলে যাবে দ্রুত।অনেকদিন হলো রাউশির মুখ দেখছে না।কল দিলেও নানা বাহানায় একটু কথা বলেই কেটে দেয়।মেয়েটা এখনও তার প্রতি দূর্বল হয় নি।তবে এটা কোনো ব্যাপার না।নারীমন একটু কষ্টসাধ্য হলেও খুব তাড়াতাড়িই তারই মাঝে আবদ্ধ হবে বলেই মেহরানের ধারণা।সেদিন রাতে মেহরান রাউশিকে জিজ্ঞাসা করেছিলো,
“আমায় ইগনোর কেন করছিস? এর ব্যাখ্যা দে।”
রাউশি শুধু নজর লুকাচ্ছিলো।নিচের ঠোঁট বার বার কামড়ে ধরছিলো আর জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছিলো।মেহরানের পুরুষমন পুলকিত হয় তবে সংযমী মনোভাব যথেষ্ট শক্তিশালী তার।রাউশি উত্তর দিতে না পারায় মেহরান জিজ্ঞাসা করে,
“যদি মনে করিস ফালতু কোনো এক্সকিউজ দেখাবি তবে দুই গালে দুটো চড় পড়বে।ধৈর্য অনেক আমার।অপেক্ষায় থাকবো।”
চলে যাওয়ার সময় রাউশির দিকে যখন তাকিয়েছিলো মেয়েটা তখনও কেমন লজ্জিত ভঙ্গিতে দাড়িয়েছিলো।তবে মেহরানের সর্বশেষ কথায় রাউশির বক্ষস্থল কেঁপে উঠেছিলো,
“রাজি হোস বা না হোস তবুও তুই আমারই।মনে রাখিস।”
কথাগুলো মনে পড়ে মেহরান কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকায়।মেয়েটাকে এবার বাড়িতে গেলে জেরা করবে।নুজাইশের প্রশ্নের কথা মনে পড়তেই শীতল অথচ কণ্ঠে কঠিন ভালোলাগা ঢেলে উত্তর দেয়,
“মৌরিন খান রাউশি।”
ফোন ধরে রাখা হাতটা নড়ে ওঠে।বুকের ডান পাশে ক্রমশ ব্যথা অনুভত হয়।চোখজোড়া শান্ত হয় ভীষণ।মুখ থমথমে হয়ে যায়।তুষার শুধু নুজাইশকে দেখেই যাচ্ছে। নুজাইশ কল কেটে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।তার হাত পা কাঁপছে হঠাৎ করে। হৃদয়টা কষ্টে,পীড়ায় চৌচির হয়ে যাচ্ছে। ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আজ মোটেও ক্লাস করানো সম্ভব নয় তার।বুক কাঁপছে স্ববেগে। ঠোঁটজোড়াও ভীষণ কাঁপছে মনে হলো।তু্ষার নুজাইশের হাত ঝাকিয়ে বলে,
“এই তো কি হয়েছে?আমায় কিছু বলছিস না কেন?”
কণ্ঠনালী ভীষণ কাঁপছে।কান্না আসছে না হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরোতে চাইছে বুক ফেঁটে।বুকটা কেটে যদি দেখা যেতো তাহলে হয়তো আশেপাশে থাকা সবাই দেখতে পেতো ধীরে ধীরে মৌরিনের প্রতি বেড়ে ওঠা একটি সুন্দর অনুভুতি,ভালোলাগা,আবেগ মুহুর্তের মাঝেই কিভাবে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে।নুজাইশ বড় বড় পায়ের ধাপ ফেলে হাঁটা ধরে।তুষার একবার পেছনে তাকিয়ে নুজাইশের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করে।সে এটা বুঝতে পারছে নিশ্চয় কোনো ঘাপলা আছে।
.
রূপা বেগম শাড়ির আচল মুখে গুজে কাঁদছেন।সামনে বাড়ির কর্তারা বসে আছেন।উর্মিলা বেগম আর রোকসানা বেগম রূপা বেগমকে ধরে আছেন।একটু আগে একটা কল এসেছিলো।কলটা করেছে মূলত আমেনা বেগম।আমেনা বেগম জানিয়েছে আজ সকাল ১০টার দিকে রায়হান সিকদার মৃত্যুবরণ করেছেন। শারিরীক অবস্থার অবনতির কারণেই এত তাড়াতড়ি পৃথিবীর মোহমায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন।রাউশি যখন তাদের বাড়িতে ছিলো। অর্থাৎ ঘটনা ঘটার আগে থেকেই রায়হান সিকদার অসুস্থ ছিলেন কিছুটা।তবে রাউশি যাওয়ার পর অসুস্থতা অতিরিক্ত বেড়ে গেছে।যার ফলে সেদিন রাতে স্ট্রোক করলো।আর আজ সকালের দিকে সকলের মাঝে থেকে চলে গেলেন।রূপা বেগম তার ভাইকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারলেন না। রূপা বেগমের তার ভাই রায়হান ছাড়া আর কেউ ছিলো না।এখন সেই মানুষটাও আর নেই ভাবতেই কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আসছে।মাহবুব খান রূপা বেগমের দিকে একপলক তাকিয়ে বলেন,
“রাউশির জন্য চিন্তা হচ্ছে।মেয়েটা জানতে পারলে ভেঙ্গে পড়বে।”
মাহমুদ খানও কষ্ট পাচ্ছেন।রায়হান সিকদার যথেষ্ট ভালো ছিলেন।মাথা নিচু করে বলেন,
“আমরা কি রাজশাহী যাব ভাইজান?”
“লাশ কবে দাফন করা হবে?”
“শুনলাম তো আগামীকাল।”
মাহবুব খান কিছু একটা ভাবেন।আয়াশ থাকবে সেখানে মন একদিকে সায় না দিলেও রূপার জন্য খারাপ লাগছে।রূপাকে নিজের বোনের মতোই ভাবেন মাহবুব খান।কিছু একটা ভেবে বলেন,
“তুই আর মাহতাব দুজনে যা রাজশাহী।রূপার যাওয়ার দরকার নেই।”
রূপা বেগমের দিকে তাকিয়ে মাহবুব খান বলেন,
“আমায় ভুল বুঝো না রূপা।তোমায় আমি নিজের বোনের মতোই দেখি।তোমার এই দূর্দিনে তোমার সহায় হতে পারলাম না। রায়হানদের সাথে আমাদের খুবই ভয়ানক একটি ঘটনা ঘটেছে সেটাতো তোমার জানা আছেই।আমারও মন বলছে তোমার যাওয়া উচিত।তবে সবদিক থেকে বিবেচনা করলে এটা নিতান্ত অসম্ভবও হয়ে দাঁড়ায়।আমি মাহমুদ মাহতাব আর মেহরানকে পাঠিয়ে দেবো।রাউশি জানতে পারলে মেয়েটা ভেঙ্গে পড়বে।তুমি তাকে সামলিও।আমায় ক্ষমা করো।”
রূপা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“এভাবে বলবেন না ভাইজান।আমি বুঝতে পারছি।”
মাহবুব খান রূপা বেগমের কথাটা শুনেই মেহরানকে কল করেন।কল রিসিভ হয় না তবে কিছুক্ষণ পর কল ব্যাক আসে।মাহবুব খান রিসিভ করেন।
“কি হয়েছে বাবা?”
“রাউশির মামা রায়হান আর আমাদের মাঝে নেই।”
মেহরান নিশ্চুপ হয়।সর্বপ্রথম মনে পড়ে রাউশির কথা।তাই বাবাকে জিজ্ঞাসা করে,
“বাবা রাউশি?মেজো মা?”
“রাউশির জন্য চিন্তা হচ্ছে।আমি চাইছি তুমি, মাহমুদ আর মাহতাব মিলে রাজশাহী যাও আজই।তুমি সেখান থেকে রওনা দাও।আর মাহমুদ মাহতাব এদিক থেকে রওনা হবে।”
ফোস করে ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহরান।মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত।কখন যে মৃত্যুর দেশে পাড়ি দিতে হয় এটা কেউই বলতে পারে না।মেহরানের খুবই চিন্তা হচ্ছে রাউশির জন্য।মেয়েটার না জানি কেমন অবস্থা হবে।
চলবে……