মেহেরজান পর্ব-২১+২২

0
2

#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ২১

বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই ভীষণ ভালো লাগলো রাউশির।কি সুন্দর বাড়ির ভেতরটা। নাকে ভেসে এলো একটি সুঘ্রাণ।এখন আপাতত অন্দরমহলে কেউ নেই।রাউশিকে গাড়িতে আটকে রেখেছিলো মেহরান। তাইতো দেরিতে প্রবেশ করায় কাউকে পেলো না রাউশি।হেঁটে সামনে এগিয়ে যেতেই একটি মেয়ের দেখা পেলো।একটি ব্যাগ নিয়ে মেয়েটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে।রাউশির সামনে আসতেই মেয়েটি সুন্দর হেসে বিনয়ীভাবে বলল,
“আপনি রাউশি আপু তাই না?”

রাউশি মাথা নাড়ালো।মেয়েটি আবারও হেসে বলল,
“আমি বিপাশা।আসুন আমার সাথে আসুন।আপনার রুমটা দেখিয়ে দিচ্ছি।”

রাউশিও পেছন পেছন চললো মেয়েটার।সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময়ই বিপাশা মেয়েটা আবারও বলল,
“আপনার ব্যাপারে মায়ের কাছে অনেকবার শুনেছি আপনি নাকি অনেক সুন্দর।আজ সামনাসামনি দেখে বুঝলাম আসলেই মুখে বলার চেয়েও বেশি সুন্দর।”

“আমার যে, সুন্দর তো হওয়ারই কথা।”

পুরুষালী আওয়াজ শুনতেই বিপাশা পেছনে ফিরে তাকালো।রাউশি বুঝলো এটা মেহরান।চোখ ছোট ছোট করে পেছনে দেখলো মেহরান পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে।বিপাশা মুচকি হাসলো।আর বলল,
“হ্যা তাইতো।আমাদের মেহরান ভাইয়ের যে।”

রাউশি লজ্জা পেলো।মাথা নামিয়ে নিলো। তবে মেহরানকে গালি দিতে ভুললো না। মেহরান রাউশিকে পাশ কাটিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দ করা রুমটিতে চলে যায়।বিপাশা পুনরায় হাঁটা শুরু করে আর পেছন পেছন রাউশিও।রাউশি এবার জিজ্ঞাসা করে,
“তোমায় ঠিক চিনতে পারলাম না।”

“আমি এ বাড়ির সবার ছোট মেয়ে।মেহরান ভাইয়ের মামাতো বোন।অর্থাৎ উর্মিলা খালার ছোট ভাই উর্ভর হাওলাদারের বড় মেয়ে।”

রাউশি এবার চিনতে পারলো।হাওলাদার বাড়ির কর্তা হলেন অনিমেশ হাওলাদার। উনার চার ছেলে মেয়ে।তিন ছেলে এক মেয়ে।বড় ছেলে অরুন হাওলাদার,এরপর আমিন হাওলাদার এরপরেই হলেন উর্মিলা হাওলাদার আর সবার ছোট উর্ভর হাওলাদার।রাউশিদের মতোই উনাদেরও যৌথ পরিবার।অরুন হাওলাদারের তিন ছেলে,আমিন হাওলাদারের এক ছেলে এক মেয়ে আর সবার ছোট উর্ভর হাওলাদারের দুই মেয়ে এক ছেলে। বাড়ির কর্তা অনিমেশ হাওলাদারের মৃত্যুর পর এখন সবার বড় হিসেবে বাড়ির কর্ত্রী খাদেজা বেগমকেই মান্য করা হয়।এইযে ঢাকা থেকে একমাত্র মেয়ের পরিবারের সবাই ঘুরতে আসবে শুনে ভীষণ খুশি হন তিনি।সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন তাদের জন্য।অরুন হাওলাদারের স্ত্রী নাজিয়া বেগম আর আমিন হাওলাদারের স্ত্রী সাইফা বেগম কত করে বলছেন যে বিশ্রাম নিতে তবুও খোদেজা বেগম সেই সকাল থেকে বসার ঘরে অপেক্ষা করছেন ছেলের বউদের কথাও শুনছেন না। বাড়ির ছোট বউ হালিমা বেগম গিয়েছেন নিজের বাপের বাড়ি।উনাকেও বাড়িতে আসার জন্য হুকুম করেছেন খোদেজা বেগম।বিকেলের ভেতর এসে পড়বেন বলে জানিয়েছেন হালিমা।বিপাশা উর্ভর হাওলাদার আর হালিমা হাওলাদারের মেয়ে এটা রাউশি বুঝতে পারলো।উনাদের ফ্যামিলির কাহিনী উর্মিলা বেগমই শুনিয়েছিলেন একদিন। হাটতে হাটতে রাউশির চোখ গেলো সামনে বিশাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেইন্টিং করা অবস্থায় এক যুবকের দিকে।উৎসুক হলো দৃষ্টি।পরক্ষণেই মেহরানের কথা মনে পড়লো।এদিকে বিপাশা সামনে শিহাবকে দেখে ডেকে উঠলো,
“শিহাব ভাই! দেখো একটা জলজ্যান্ত পুতুল এসেছে।”

শিহাব পেইন্টিং করছিলো বিপাশার কণ্ঠ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রাউশিদের দিকে।বিপাশা আর পাশে অচেনা মেয়েকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো।রাউশি বিপাকে পড়লেও বিপাশা টেনে নিয়ে গেলো রাউশিকে শিহাবের সামনে।রাউশির অনিচ্ছাকৃতভাবেই যেতে হলো সামনে। শিহাব শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে এইতো কয়েক মাস আগে।এখন আপাতত বেকার আছে তবে চাকরির খোঁজে আছে। বাড়িতে থাকলে পেইন্টিং করেই দিন পার করিয়ে দেয়।এবাড়ির একটা ছেলেও এখনও বিয়ে করে নি।শিহাব বাড়ির মেজো কর্তা আমিন হাওলাদারের বড় ছেলে।আর বাড়ির সমস্ত ছেলেদের মাঝে সেজো ছেলে। খান পরিবারেও মেহরান যেমন সবার বড় ঠিক মায়ের পরিবারের দিকেও মেহরানই সবার বড় ছেলে।খুবই ভদ্র একজন ছেলে শিহাব।সাথে ভীষণ বুঝদার আর সরল প্রকৃতির।বিপাশা আর রাউশি সেখানে যেতেই শিহাব জিজ্ঞাসা করলো,
“কে ও?”

বিপাশা বলল,
“মেহরান ভাইয়ের মেজো চাচার মেয়ে মৌরিন খান রাউশি।”

শিহাব এবার সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল,
“হাই রাউশি।আমি শিহাব।”

রাউশি সৌজন্য হাসলো শুধু আর বলল,
“হ্যালো।”

পেছন থেকে আবার একটি মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেলো।

“এই বিপাশা কে ও?”

বিপাশা সহ রাউশিও পেছনে ফিরে তাকালো।মডার্ন ড্রেস পড়া একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তীক্ষ্ণ তার চাহনী রাউশির ওপরই নিক্ষিপ্ত।শিহাব আবারও নিজের কাজে মন দিলো।বিপাশা হেসে বলল,
“শায়মা আপু এ হলো রাউশি।তোমারই সমবয়সী।মেহরান ভাইয়ার মেজো চাচার মেয়ে।ওইযে বড় মা সবসময়ই যার প্রসংশা করে।এই তো রাউশি।”

শায়মা শিহাবের ছোট বোন।শায়মা এগিয়ে আসলো।উপর নিচ রাউশিকে একবার দেখলো।রাউশি বিব্রতবোধ করলো।শায়মা ঘাড় হেলিয়ে বলে,
“প্রসংশনীয় এমন কিছুই তো চোখে পড়লো না।”

রাউশি চোখ তুলে তাকালো।মেয়েটার কথায় স্পষ্ট অন্যকিছু আছে।বিপাশাসহ শিহাব তারা কিছুটা ইতস্ততবোধ করলো রাউশির সামনে শায়মার এমন আচরণে।শিহাব গম্ভীর আওয়াজে বলল,
“শায়মা রুমে যা।”

শায়মা আবারও তীক্ষ্ণ চাহনীতে দেখলো রাউশিকে।আর বলল,
“পরেরবার যাতে আমার সাথে তোমার দেখা না হয় রাউশি।”

রাউশি বিরক্ত হলো।এই মেয়ে শুরুতেই এমন ফালতু কথাবার্তা বলছে কেন?সমস্যা কি এর?রাউশিও পালটা জবাবে বলল,
“আমারও ইচ্ছে নেই।ধন্যবাদ।”

কথাটা শুনে পেছনে থাকা শিহাব আড়ালে মুচকি হাসলো।তার বোন যে কি পরিমাণ হিংসুটে সেটা বাড়ির সবাই জানে।বিপাশার হাসি পেলেও হাসতে পারলো না।পাছে শায়মা আবার মেরে না বসে।শায়মা গলা উঁচিয়ে বলে,
“এটা আমার বা_”

বাকি কথাটা বলার আগেই সেখানে উপস্থিতি ঘটে মেহরানের,
“আসতে না আসতে অতিথির সাথে এমন ব্যবহার? আমার জানা মতে মেজো মামা একজন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। কিন্তু উনার মেয়ের স্বভাব যে এমন সেটা প্রত্যাশার বাইরে ছিলো।”

শিহাব মেহরানের কণ্ঠ শুনে এগিয়ে এলো আর মেহরানের সাথে হ্যান্ডশেক করে কোলাকুলি করলো।শায়মা মেহরানের দিকে একবার ভালোভাবে তাকালো।চোখ কোনোভাবে সড়িয়ে ঝামটা মেরে সেই স্থান ত্যাগ করলো।মেহরান রাউশির দিকে এমনভাবে তাকালো যেন কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে এখন।এদিকে রাউশি ভড়কে গিয়ে বিপাশাকে বলল,
“চলো আমার রুমটা দেখিয়ে দাও।টায়ার্ড লাগছে।”

বিপাশা আর রাউশি চলে গেলো।শিহাব কিছুক্ষণ মেহরানের সাথে কথা বললো। বিপাশা রাউশিকে তার রুমটা দেখিয়ে দিয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলো তখনই তার হাতে টান দিয়ে কেউ অন্যপাশে নিয়ে যায় বিপাশাকে।বিপাশা দেখলো এটা উজান। বিপাশা মুখ ফুলিয়ে বলল,
“ভয় পাইলে দিয়েছিকে ভাইয়া।”
“একটু আধটু ভয় পেতে হয় মাঝেমধ্যে।”

বলে বিপাশার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“বড় হয়ে গেছিস দেখছি।মোটাও হয়ে গেছিস।গালগুলো ফুলে গেছে তোর।”

বিপাশা রেগে গেলো।মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলেই আবারও হাত টেনে ধরলো উজান।বলল,
“এই দাঁড়া দাঁড়া।এতো রেগে যাস কেন? তুই তো আগে রাগী ছিলি না? এমন রাগী হলি কবে থেকে?”

বিপাশা দাত কিড়মিড় করে বলল,
“বড় হয়েছি,মোটা হয়েছি তাই রাগীও হয়েছি।”

উজান গালে হাত দিয়ে বলল,
“হ্যা এটা ঠিক বলেছিস।তবে চিন্তা করিস না।এবার তোকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে জিমে ভর্তি করিয়ে দেবো।কি বলিস?”

আরও বেশি ক্ষেপে গেলো বিপাশা।চোখ রাঙিয়ে হাত ছাড়িয়ে চলে গেলো অন্যদিকে।উজান ভাবলো রাগের কি আছে?তখনই সেখানে তানজিম এসে উজানের পিঠ চাপড়ে বলল,
“শালা আসতে না আসতেই টাংকি মারা শুরু?তুই আর জীবনেও ভালো হইতি না।”
“আমি তো রাস্তায় টেম্পু চালায় সবার সামনে।কিন্তু তুই তো অলি গলি দিয়া টেম্পু চালাস শালা।আমি কি বুঝি না মনে করো? ”

মেহরান সেদিক দিয়েই রাউশির রুমের দিকে যাচ্ছিলো এই দুইজনের কথা শুনে থেমে গিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বলল,
“বাবা আর ছোট চাচা কি জানে? তোরা টেম্পু চালাচ্ছিস?এমনিতেও তো বেকারই আছিস, কবে কবে টেম্পু কিনলি?”

মেহরানকে দেখে তানজিম উজান সোজা হয়ে দাড়ালো।দুজনে একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি ঢোক গিললো।উজান আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে তুমি তো গহীন জলের মাছ।তাই আমরাও টেম্পু চালিয়ে আনাচে কানাচে বিভিন্ন এক্সপার্টদের কাছে গিয়ে শিখছিলাম কিভাবে গহীন জলের মাছ হওয়া যায়?”

মেহরান ধমকে বলল,
“চুপ কর।এখান থেকে যা।”

তানজিম বলল,
“হ্যা এইতো যাচ্ছি।”

বলেই দুজনে চলে গেলো বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে।মেহরান সোজা রাউশির রুমের সামনে যেতেই আবার দেখতে পেলো নুজাইশকে।ফোনে কথা বলে বলে নিচের দিকে যাচ্ছে।মেহরান ভাবলো আগে রাউশিকে একটু হুমকি ধমকি দিয়ে তারপর নুজাইশের কাছে যাবে।যেই ভাবা সেই কাজ। রাউশির রুমের সামনে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লো।রাউশি ভাবলো বিপাশা এসেছে হয়তো তাই দরজা খুলতেই মেহরানকে দেখে আবারও দরজা লাগাতে যাবে তার আগেই মেহরান দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো।ভেতরে ঢুকে দরজা লক করে দিয়ে রাউশির দিকে এগিয়ে গেলো।রাউশি পেছাতে পেছাতে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকলো।মেহরানের সাথে রাউশির দূরত্ব খুব বেশি নয়।মেহরান কিছুক্ষণ চুপ করে রাউশিকে দেখলো।রাউশিও তারই দিকে তাকিয়ে।চোখ নামালো না মেয়েটা।সেও তাকিয়ে দেখলো আজ মেহরানকে।মেহরান বলল,
“নিষেধ করেছিলাম।”
“আমার কোনো দোষ নেই।বিপাশাই তো।”

রাউশির ঠোঁটে নিজের তর্জনী রাখলো মেহরান।এবার রাউশি কিছুটা হলেও কেঁপে উঠলো।অবাধ্য অনুভুতিগুলো আবারও ধড়ফড় করে উঠলো।ঠোঁটজোড়া কাঁপছে রাউশির।মেহরান আরেকটু এগিয়ে গিয়ে রাউশির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“চল আজই বিয়ে করে ফেলি।তাহলে আর কোনো চিন্তা থাকবে না।”

চলবে……

#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ২২

অনেকদিন যাবৎ রাউশিকে ভার্সিটি না দেখে আয়াশ এবার ভীষণ কৌতূহলী হলো। রাউশির এক ফ্রেন্ডের থেকে অবশ্য জেনে নিলো রাউশি সিলেট গিয়েছে। আয়াশ মনে মনে খুশি হলেও কষ্ট পেলো।আজকাল রাউশির কথা যখন তখন মনে পড়ে। খারাপ লাগলেও আবার রাউশির নতুন জীবনের জন্য নিজেও খুশি হয়ে যায়।সে তো নিজের জীবন নিজেই শেষ করেছে।রাউশিকে পেয়েও রাখে নি নিজের বন্ধনে।ভাবলেই হতাশাগুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেড়িয়ে আসে।আয়াশ সবসময়ই দোয়া করে রাউশি নিজের জীবন নিয়ে ভালো থাকুক।ভবিষ্যত অনেক বেশি সুন্দর হোক রাউশির।এই মনষ্কামনা করলে মনটা হালকা হালকা লাগে আয়াশের। অনিমার কথা মনে পড়লো আবার। মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়েছে আয়াশ। এর কারণ অনিমা আমেনা বেগমকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলো সেদিন।

আয়াশ ভার্সিটিতে গিয়েছিলো সেদিন। বাড়িতে অনিমা আর আমেনা বেগম।আমেনা বেগম অসুস্থ থাকায় বিছানায় শয্যাশায়ী। এদিকে অনিমা একটা কাজ করতেও নারাজ।আমেনা বেগমকে ডাকলে আমেনা বেগম অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে বারণ করলেই অনিমা রেগে যায়। ভীষণ আজেবাজে কথা বলতে থাকে। তা সহ্য করতে না পেরে আমেনা বেগম প্রতিবাদ করলে অনিমা রেগে গিয়ে মারার জন্য উদ্যত হয়।সঠিক সময়ে আবার দরজা খোলা পেয়ে বাসায় ঢুকে পড়ে আরিশা। আর চেচামেচির শব্দ শুনে মায়ের রুমে গেলে ভাবীর এমন রূপ দেখে নিজেও চমকে যায়।বিকেলে আয়াশ আসতেই সমস্ত কথা জানায় আরিশা।আয়াশ ভীষণ রেগে গিয়ে অনিমাকে চড় মেরে বসে।আর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।অনিমাও অবশ্য থাকে নি।সে নিজেও চলে গেছে ড্যাংড্যাং করে কারণ অনিমার অন্য এক ছেলের সাথে অ্যাফায়ার চলছিলো কিছুদিন যাবৎ।আয়াশ কিছুটা বুঝলেও প্রতিবাদ করে নি। কারণ সে নিজেও তো এমন করেছে।ডিভোর্স হয়ে গেছে তাদের।এইতো আজ সকালেই কাজটা কমপ্লিট হলো।আয়াশ মনে করলো সে এখন ঝামেলামুক্ত।

জীবনটা আরেকবার দেখবে সে।তবে জীবনে আর কাউকে ঠায় দিতে পারবে না সে।দুজন এসেছে তার জীবনে।একজন হিরা তো অন্যজন কাঁচের এক টুকরো।হিরা পেয়েও নিজের কাছে রাখতে পারে নি আয়াশ।এই আক্ষেপটাই হয়তো তার আজীবন থেকে যাবে।তবে এর চেয়ে আর কোনো আক্ষেপ বা আফসোস নেই।নিজের পরিবারের সদস্যদের ভালোভাবে খেয়াল রাখার দৃঢ় পরিকল্পনায় মত্ত হয়েছে।বাবার কথা মনে পড়লে চোখ দিয়ে অশ্রুও বেরিয়ে আসে।তার বাবাকে খুব করে বলতে ইচ্ছে করে,
“বাবা আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি।তুমি সেদিন আমার জন্য সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলো।কিন্তু সেটা আমি বুঝতে খুব দেরি করে ফেলেছি।জানি তুমি আমার ওপর রেগে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছো। তবে বাবা পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।এখন দেখো আমি অনেক ভালো আছি।শুধু দুইটা আক্ষেপ জীবনে।এক তোমার কথার মূল্যায়ন না করা আর রাউশিকে পেয়েও হাতছাড়া করা।এ ছাড়া আর কিছু নেই।ওপারে ভালো থেকো।”

আয়াশের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো পুনরায়।ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“ভালো থেকো বাবা।আমি মা আর বোনকেও ভালো রাখবো।ওদিকে তোমার প্রিয় রাউশিও ভালো আছে।আমিও ভালো থাকবো তোমাদের ভালো থাকা দেখলে।”

.

ঠিক সময় রৌদ্রজ্বল দিন। শীতের আগমনী বাতাস বহমান। তাছাড়া গ্রামের এতো সুন্দর পরিবেশে মনটা আপনা-আপনিই ভালো হয়ে যায়।রাউশিরও মনটা ভীষণ ভালো। মা-কে বলে একটু আগে এক মগ কফি আনিয়েছে। তার রুমে লাগোয়া একটি বারান্দা আছে। বারান্দায় একটি বেতের চেয়ার রয়েছে। সেখানেই খোশমেজাজে বসে রাউশি। হাতে কফির মগ, বাইরে থেকে পাখির কলতান, স্নিগ্ধ শুদ্ধ হাওয়া, ঝলমলে দিন যেন এক কল্পনার উপমা।রাউশি কফির মগে চুমুক দিয়ে চোখ বুজে। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঠোঁটে হাসি ফোটায়।তখনই চোখ যায় নিচে। উজানকে দেখলো জোরে জোরে হাঁটছে। তারই সামনে আবার বিপাশা।এবার চক্ষু কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো যেন। ঠোঁট আপনা-আপনি ফাঁকা হয়ে যায়।

এদিকে উজান বিপাশাকে ডাকছিলো কিন্তু বিপাশা পাত্তা না দিয়ে চলে যাওয়ায় উজানও বিপাশার পিছু নিয়েছে।আর ডেকে চলেছে,
“এই বিপাশা দাঁড়াও।”

তবে বিপাশা তো শোনার মেয়ে না।তার অভিমান হয়েছে এই উজান ভাইয়ের ওপর। আজ কতবছর পর এলো আর এসেই তার প্রতি এমন মন্তব্য? ভাবতেই বিপাশার গা জ্বলে উঠলো তখনই।পেছনে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
“আমার পিছু করা বন্ধ করুন।”

উজান ভুলে শোনায় জিজ্ঞাসা করলো,
“কিসের হিসু?”

এটা শুনে প্রচন্ড ক্ষেপে গেলো বিপাশা,
“ছি।”

বলে দ্রুতপায়ে এগোতে শুরু করলো।উজান বুঝলো না ছি বলার কারণ? বিপাশা এসব কি বলছে আজকাল?মেয়েটা কি কয়েক বছরেই পাগল হয়ে গেলো নাকি? এতো তাড়াতাড়ি যদি মাথার এমন সমস্যা হয় তাহলে বাকি জীবন কাটাবে কিভাবে? পরক্ষণেই ভাবলো, ভালোবাসার মানুষ পাগল হোক বা পশু।ভালোবাসা থাকলে আজন্ম কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব।ভেবেই মন নেচে উঠলো উজানের।আবারও পিছু ডাকতে ডাকতে এগিয়ে গেলো।বাড়ির মানুষরা সবাই ভেতরে আছে খোশগল্পে মেতে।এটাই সুযোগ মেয়েটাকে একটু একলা নিয়ে গিয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার। নয়তো আর সময় পাবে না মনখুলে বলার,
“ভালোবাসি বিপাশা।এখন থেকে নয় তোমায় সেই ছোটবেলায় দেখেছি যখন, তখন থেকে।”

কিন্তু এই মেয়ে যে পাগলামী আর তিড়িংবিড়িং করছে উজানের মনে হচ্ছে না এই জন্মে বলা হবে!

রাউশি দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো উজান বিপাশাকে।কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারলো এই মেয়েকেই উজান ভাই পছন্দ করে।এই একটা জিনিসের কথাই বলেছিলো তাহলে।বিপাশা মেয়েটা ভীষণ ভালো। ব্যবহারও অমায়িক। জা বানানোই যায়। এটা ভেবেই মনে মনে হাসলেও তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো সে কি ভাবছে? নিজের ভাবনাতে নিজেই চোখ বড় বড় করে ফেললো। মাথা দুদিকে বার বার নাড়িয়ে না না করতে থাকলো। আবার মেহরানের মুখটা চোখে সামনে ভাসতেই উপরনিচ ঝাকিয়ে হ্যা প্রকাশ করলো।পরে নিজের মনোভাবে নিজেই বিরক্ত হলো কিঞ্চিৎ।

বিপাশা তার বাবার কাছে চলে গেলো।উর্ভর হাওলাদার বাগান পরিচর্যা করছিলেন।এই কাজ বন্ধের সময় উনি নিজেই করে থাকেন। এতে বাড়িতে মালি রাখার প্রয়োজন মনে করেন না।বিপাশা তার বাবার কাছে যেতেই উর্ভ হাওলাদার মেয়েকে দেখে হাসিখুশি হলেন। নিজের মেয়েদের সাথে তিনি বরাবরই বন্ধুসুলভ।মেয়েকে দৌঁড়ে আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কি হয়েছে মা?এভাবে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছিস কেন?”

বিপাশা একবার পিছু তাকালো।উজানকে দেখতে পেলো না হয়তোবা উর্ভর হাওলাদারকে দেখে সড়ে গেছে।বিপাশা বাবার কাছে গিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
“কিছু না বাবা।চলো দুজনে মিলে কাজ করি।”

খুশি হলেন উর্ভর সাহেব।তিনি বড় মেয়ের থেকে নিজের ছোট মেয়েকে একটু বেশিই ভালোবাসেন।কারণ বিপাশা একদমই নম্র-ভদ্র।অন্যদের মতো এতো আহ্লাদীও নয় আর না অহংকারী।মেয়ের দিকে একপলক তাকালেন তিনি।সবে ভার্সিটিতে উঠেছে বিপাশা।উর্ভর সাহেব ঠিক করলেন ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেবেন।

“বাবা খান পরিবারের সবাই কত ভালো। বড়রাও কত্ত ভালো।কি সুন্দর কথা বলে। আর ছেলেমেয়েরাও একেকজন খুবই ভালো।”

মেয়ের কথায় হুশে ফিরলেন উর্ভর সাহেব। হেসে বললেন,
“তোর ফুফু আসলেই সৌভাগ্যবতী এমন এক পরিবার পেয়েছে।নয়তো এতো বনেদি পরিবার হওয়া স্বত্তেও আমাদের এই গ্রাম্য পরিবারের মানুষের সাথে কত ভালো ব্যবহার করছেন।”

চোখ ছোট ছোট করলো বিপাশা।বলল,
“আমরাও কম কিসে?”

মেয়ের কথায় হাসলেন উর্ভর সাহেব।বিপাশা আবারও বলল,
“উনাদের পরিবারের সবাই কত সুন্দর সুন্দর।বিশেষ করে রাউশি আপু তো অনেক বেশিই সুন্দর।”

উর্ভর সাহেব গাছে পানি দিতে দিতেই বললেন,
“মেয়েটাকে আমিও ছবিতে ছাড়া কখনও দেখিনি।আজ দেখলাম। যেমন নম্র ভদ্র তার ব্যবহার ঠিক তেমনই রূপে গুণে সবকিছুতেই পরিপূর্ণ যেন।”

মাথা নাড়ালো বিপাশা।বলল,
“আমার মনে হয় কি জানো বাবা? মেহরান ভাই__”

বাকি কথাটা বলার আগেই সেখানে মেহরান উপস্থিত হলো।আর বিপাশার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কথা ঘুরিয়ে উর্ভর সাহেবকে বলল,
“মামা আপনি দেখি আরও বেশি ইয়াং হয়েছেন?”

কারও কথা শুনে দুজনেই মেহরানের দিকে তাকালো।উর্ভর সাহেব মেহরানকে দেখে চমৎকার হেসে বললেন,
“আরেহ ইয়াং ম্যান যে। আমাদের জীবন তো শেষের দিকে।ইয়াং কোথায়? মাথার চুল দেখো সব পেকে গেছে।”

মেহরান আরও এগিয়ে আসলো।শুরু হলো তাদের মাঝে কথাবার্তা।

উজান বিপাশাকে মামার কাছে যেতে দেখে থেমে যায় সে।হতাশ মনে হাতটা একবার উঁচিয়ে আবারও নামিয়ে নেয়।বিষণ্ণ মনে পেছনে ফিরে তাকাতেই দোতলার একটি রুমের বারান্দায় গিয়ে চোখ গেলো।রাউশি হাত নাড়ছে তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। উজান হতাশ চোখে তাকালো। রাউশি ওপর থেকেই বলল,
“দেখে ফেলেছি।”

এপাশে মানুষজন নেই তাই কারোর শোনার প্রশ্ন খুব একটা আসে না।উজান মাথা নামিয়ে কপালে হাত দিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
“সবই কপাল রে রাউশি,কপাল।”

রাউশি একটু গলা উঁচিয়ে বলল,
“আহা চিন্তা করো না, এখন তোমারই দিন চলছে। চালিয়ে যেতে থাকো।সফলতা এই তো ধারে কাছেই।তাই শুভকামনা তোমায় ভাই।”

উজান রাউশির কথাটা শুনে খুশি হলো। রাউশিকে হাত দিয়ে ফ্লায়িং কিস দিলো,
“তাই যেন হয়।”

বলে চলে গেলো অন্যপাশে।রাউশি কফির মগে আরেক চুমুক দিয়ে কফিটা গিলে একবার হাসলো।ভাবলো আহা ভালোবাসা কি সুন্দর।

“অন্যের জন্য শুভকামনা জানাচ্ছেন! নিজের জন্য কবে জানাবেন?”

পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে আওয়াজটা ঠিক কোনদিক থেকে এলো সেটা বুঝে বাম পাশে ফিরে তাকালো রাউশি।তার রুমের বারান্দার সাথে অপরপাশের বারান্দাটা খুব কাছাকাছি। চোখ সেদিকে পড়তেই অচেনা এক পুরুষকে দেখে হতচকালো রাউশি। কালো পাঞ্জাবি পরনে, রিমলেস চশমা, ঝাকড়া চুলের এই পুরুষকে দেখে রাউশি প্রথম দেখায়, চিনতে পারলো না।একে দেখেনি আজ সকাল থেকে।দেখতে কিছুটা এই বাড়ির বড় কর্তা অরুন হাওলাদারের মতো।রাউশি শুনেছে অরুন হাওলাদারের তিন ছেলে।বড় ছেলের নাম আরুশ, যে কিনা মেহরানের থেকে কয়েক দিনের ছোট মাত্র।ভাইদের আগে উর্মিলার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ছেলেমেয়েদের দিকে ভাইদের আগে এগিয়ে গেছেন উর্মিলা বেগন।আরুশ সিলেট শহরে থাকে একা।সেখানেই তার ব্যবসা আছে নিজস্ব। মেজো ছেলের নাম আবির। আবির নাকি উজানের থেকে এক বছরের বড়। সে প্রফেসর হিসেবে একটি সরকারি কলেজে চাকরিরত। আর ছোট ছেলে আসিফ। ছেলেটা রাউশির থেকে বছর দুয়েকের ছোট।রাউশি ভাবলো আরুশ যেহেতু সিলেট শহরে থাকে আর আসিফ যেহেতু তার নিজের থেকেও ছোট তাহলে এই ছেলেটা তাদের দুজনের মাঝে কেউ না। আর বাকি থাকে আবির।তারমানে এই ছেলে আবির? সকাল থেকে তো দেখেনি রাউশি।বাড়ির সবার সাথেই পরিচিত হয়েছে রাউশি।শুধু ছেলেদের বাদে।কারণটা অবশ্য মেহরান।তবে যতই উপেক্ষা করুক বার বার এই বাড়ির ছেলেদের সাথেই তার অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ হয়ে যাচ্ছে।

আবির রাউশিকে ভাবনায় বুদ থাকতে দেখে কথা পালটিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“কেমন আছেন রাউশি খান?”

রাউশি সৎবিৎ ফিরে পেলো।বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনার অবস্থা কেমন?”

আবির রাউশির বোকা হাসি দেখে নিজেরও হাসি পেলো।তবে নিজেকে সামলে বলল,
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ। ”

রাউশি ‘ওহ আচ্ছা’ বলে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে ভাইয়া।আপনার সাথে পরে কথা হবে।আমি একটু ব্যস্ত আছি।”

আবিরও কিছু বললো না।আবারও মাটিতে বসে পড়লো ছবিটি হাতে নিয়ে।অনেক্ষণ যাবৎ ফ্লোরে বসে ছিলো একটি ছবি হাতে। ছবিটি আজ দুপুরে তোলা।প্রফেসর হওয়ার পাশাপাশি ফটোগ্রাফি করতে ভীষণ ভালোবাসে আবির।হাতে থাকা ছবিটি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ পাশের বারান্দা হতে মেয়েলি আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে যায়।নিচে তাকিয়ে দেখে ফুফাতো ভাই উজান চলে যাচ্ছে।এদিকে পাশের বারান্দার মেয়েটিকেও সে চেনে।নাম রাউশি খান। খান বাড়ির পরিবারের মানুষদের এ বাড়িতে অনেকবারই কতশত আলোচনা হয়েছে।সেসব আলোচনায় আবির সামিল ছিলো বলেই এই চেনা।তাই সেই কথাটি বলেছে রাউশিকে।মজার ছলেই বলেছে কথাটি।না জানি রাউশি আবার কি ভাবলো নাকি?

চলবে……