#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ৩৭
পড়ন্ত বিকেলে টিউশনি করিয়ে বাড়িতে ফিরছিলো রাউশি। কেটে গেছে আরও একটা মাস। পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুর। তবে এতো কিছুর মাঝে শুধু মেহরানই আর এলো না। রাউশি একটি দোকানের সামনে গিয়ে ঠান্ডা পানির বোতল কিনলো। টিউশনি করিয়ে আজকাল নিজের একাকিত্ব ঘোছাচ্ছে রাউশি। এতে অবশ্য নিজেরও আয় হয়ে যাচ্ছে। যে টাকাগুলো আয় হয় সে টাকাগুলো দিয়ে প্রতি মাসে একবার পথশিশুদের জন্য ব্যয় করে থাকে রাউশি। মোট পাঁচটা টিউশনি করাচ্ছে রাউশি। বাড়িতে কেউ না করে নি অবশ্য। এটা খুবই ভালো লক্ষ্মণ ছিলো।
রাউশি পানির বোতলটা সাইড ব্যাগে ঢুকিয়ে হাঁটা আরম্ভ করে। তখনই পেছন থেকে কেউ ডেকে ওঠে,
“রাউশি!”
পরিচিত কণ্ঠস্বর। রাউশি পেছনে ঘুরে তাকানোর আগেই ইউসুফ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। মুখে হাসি টেনে বলে,
“বাড়িতে ফিরছিলি?”
রাউশি ক্লান্ত আওয়াজে বলল,
“হ্যা।”
“চল একসাথে যাই।”
“তোর বাড়ি তো এদিকে না। কোথায় যাবি তুই?”
ইউসুফ ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। ঠোঁটে তার লাজুক হাসি। রাউশি বুঝতে পারলো এই ছেলে তার সিনিয়র ক্রাশকে দেখার জন্যই যাবে। রাউশি কিছু বলল না। হাঁটা শুরু করলো। ইউসুফও পেছন পেছন যেতে লাগলো।
“এই রাউশি তোর কি আজও মন খারাপ?”
“আমার মন কবেই বা ভালো ছিলো?”
“আচ্ছা ঠিক আছে মন খারাপ করিস না।”
রাউশি চুপ রইলো। ইউসুফ ডেকে উঠল,
“এই রাউশি!”
“বল।”
“তোর কি মনে হয় সিনথিয়া আমায় পছন্দ করে?”
“আমি কিভাবে জানবো?”
“না তোর কি আন্দাজ নেই একটুও?”
“না।”
“আচ্ছা।”
রাউশি আবারও চুপচাপ হাটতে লাগলো। ইউসুফ বকবক করে যাচ্ছে। আরেকটু সামনে যেতেই দুজনে আয়াশকে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে দেখলো। রাউশি আয়াশের সাথে কথা বলে না। তবে খারাপ ব্যবহারও করে না। আয়াশও রাউশিদের দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। ইউসুফ স্যারকে দেখে সালাম জানালো।
“আসসালামু ওয়ালাইকুম স্যার।”
আয়াশের সালামের উত্তর করলো। রাউশিও চলন থামিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আয়াশ রাউশিকে একপলক তাকিয়ে ইউসুফকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কোথাও কি গিয়েছিলেন আপনারা?কোথা থেকে ফিরছিলেন আপনারা?”
“স্যার আমি তো বাসা থেকেই আসছি। তবে রাউশি কোথা থেকে আসছে জানি না।”
আয়াশ রাউশিকে কিছু বললো না। আবার কথা না বলেও থাকতে পারছে না। তাই একবার জিজ্ঞাসা করলো,
“রাউশি আপনার পায়ে ব্যাথা কি বেড়েছে নাকি কমেছে?”
রাউশি মাথা তুলে আয়াশের দিকে তাকালো। ভালোভাবেই উত্তর দিলো,
“জ্বি কিছুটা কমেছে স্যার।”
আয়াশ শুকনো ঢোক গিললো। এই মেয়েটা একদিন তার স্ত্রী ছিলো ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তিনটে বছর স্ত্রী হিসেবে ছিলো এই মেয়ে। অথচ আয়াশ তখন অন্য নারীতে আসক্ত ছিলো। ভাবতেই নিজের ওপর নিজেরই বিষাদে ছেয়ে গেলো।
রাউশি এবার অস্বস্তি নিয়ে ছোট্ট করে বলল,
“স্যার আমরা আসি।”
বলেই ইউসুফের হাত ধরে টেনে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আয়াশ তাকিয়ে রইলো শুধু। কিছুটা দূরে যেতেই সিনথিয়াদের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছালো রাউশিরা। ইউসুফ খুশি খুশি মুখ নিয়ে বলল,
“তুই যেতে পারবি রাউশি?”
“হ্যা।”
“আচ্ছা যা তাহলে।আমি একটু_”
রাউশি ইউসুফের বাকি কথাটা না শুনেই হাঁটা ধরলো। ইউসুফ দাত কেলিয়ে হাসলো। এই ছেলে সবার সামনে চুপচাপ থাকলেও রাউশির সাথে সবসময়ই হাসিখুশিভাবে কথা বলে।
রাউশি মিনিট দশেকের মাঝেই বাড়িতে ফিরলো। বসার ঘর পেরিয়ে যেতে দেখলো অচেনা কিছু মানুষজন। দুজন মধ্যবয়স্ক লোক, একজন মধ্যবয়সী মহিলা আর এক যুবক বসে আছে। রাউশির মনে পড়লো সকালে তার মা বলেছিলো আজ বিকেলে তানিয়াকে দেখতে আসবে। রাউশি একপলক সেদিকে তাকিয়ে চলে গেলো ওপরে।
রাউশি ফিরতেই সবাই রাউশির দিকে তাকিয়ে ছিলো। এদিকে তানিয়াকে দেখতে আসা পাত্রের বাবা মিজান রহমান রাউশিকে দেখে চিনতে পারলেন না। মিজান রহমানের স্ত্রী মুনতাহা বেগম উর্মিলা বেগমকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“মেয়েটা কি ভাবি?”
উর্মিলা বেগমের রাউশিকে দেখলেই কষ্ট হয়। মুখটা মলিন হয়ে গেলো উনার।ম্লান মুখে উত্তর করলেন,
“আমার বড় ছেলে মেহরানের স্ত্রী।”
মুনতাহা বেগম চুপসে গেলেন। উনি তো আবার নিজের বড় ছেলের জন্য ভাবছিলেন এই কয়েকমুহুর্ত সময় নিয়ে। এদিকে মিজান রহমান মাহমুদ খানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আপনার মেয়ে না?”
মাহমুদ খান রাউশির যাওয়া দেখছিলেন। মিজান রহমানের কথা শুনে ফিরে তাকিয়ে বললেন,
“হ্যা।”
মিজান রহমান হাসলেন। আবারও কথা শুরু হলো। এদিকে কিছুক্ষণ পর তানিয়াকে নিয়ে আসা হলো সেখানে। বাড়ির সবার মুখই কেমন মলিন। আজ মেহরান থাকলে ওই সমস্ত কিছু করতো। তবে ছেলেটা নেই। তবে সবার মাঝে মাহবুব খান একটু বেশিই খুশি আছেন আজ।
পাত্রের নাম ফুয়াদ। ফুয়াদ তানিয়াকে দেখে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তানিয়া মাথা তুলে তাকালো না। তানজিম ফুয়াদের পাশে বসে ছিলো। ফুয়াদ তার বন্ধু। ফুয়াদকে এভাবে নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফুয়াদের একটু কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“লজ্জার মাথা কি বাড়ি থেকেই খেয়ে এসেছিস নাকি?”
তানজিমের কথায় ফুয়াদ চোখ নামালো। তানজিমকেও আজ কেমন খুশি দেখা গেলো। সেসময় তানজিমের ফোনে নুজাইশের কল এলো। তানজিম সবাইকে এক্সকিউজ মি জানিয়ে সেখান থেকে উঠে অন্যপাশে চলে গেলো।
রাতের দিকে ফুয়াদরা একেবারে আংটি বদল করে খাওয়া দাওয়া সেড়ে চলে গেলেন। রাউশি এসবে নিজেকে রাখলো না। সে তো ছাদে বসে আকাশে ওঠা চাঁদ দেখতে ব্যস্ত। আজ অন্যদিনের মতো হাওয়া নেই। বরং অনেক গরম। তবুও রাউশি সেখানে বসে রইল। কিছুক্ষণ আগে তানজিম এসে তার সাথে মজা করে গেছে। কিন্তু রাউশি কি আর সেসবে গুরুত্ব দেয়? রাউশি নিজের মতো করেই বসে রইলো। ঘণ্টা দুয়েক এক ধ্যানেই সেখানে বসে রইলো রাউশি। তার এখন না ঠিক আছে খাওয়া আর না ঘুম। সবই এলোমেলো। তখনই ছাদে এলেন মাহবুব খান। রাউশি বড় চাচাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। মাহবুব খান রাউশিকে উঠতে দেখে বললেন,
“বোস মা বোস। উঠে দাঁড়াতে হবে না। তোর পায়ে এমনিতেই এখনও ব্যথা।”
“সমস্যা নেই বড় বাবা।”
মাহবুব খান রাউশির পাশে বসলেন। রাউশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“রাউশি মা রে খেতে যাস নি কেন? আমাদের সাথে একসাথে বসে খেতে ইচ্ছে করে না মা?”
রাউশি মাথা নামালো। ছোট্ট আওয়াজে বলল,
“এমনটা নয় বড় বাবা। আসলে আমার _”
বাকিটা বলতে পারলো না। মাহবুব খানই বললেন,
“আজ প্রায় আট মাস ধরে তুই আমাদের সাথে বসে খাওয়া দাওয়া করিস না। বাড়ির সবাই তোর আগের রাউশিকে খুব বেশি মিস করছে জানিস? তোর কষ্ট আমরা বুঝি মা। তবে আমি তোকে কি বলেছিলাম একদিন? মেহরান যত যাই বলুক ওর ওপর বিশ্বাস আছে তো?”
রাউশি শুকনো ঢোক গিললো। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর করলো,
“বিশ্বাস আছে বলেই আটটা মাস যাবৎ বেঁচে রয়েছি বড় বাবা।”
মাহবুব খান প্রশান্তির হাসি হাসলেন। রাউশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তোর হাসির দিন অতি সন্নিকটে রে মা।”
রাউশি মলিন হাসলো। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন হলো। রাউশিই সেই নিরবতা ভেঙ্গে বলল,
“মেহরান ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাই না বড় বাবা?”
চমকে গেলেন মাহবুব খান। রাউশির দিকে বিস্ফোরিত চোখে চাইলেন। রাউশি ম্লান হেসে আবারও মেঘে ঢেকে রাখা চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এত বড় কথা আমার থেকে লুকাতে পারলে তুমি আর বাবা?”
মাহবুব খান কি বলবেন, বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। মেয়েটা কিভাবে জানলো সেটাই উনি বুঝতে পারছেন না। রাউশিই আবার বলল,
“গতকাল বাবা, তুমি আর তানজিম ভাইকে কথা বলতে শুনে ফেলেছিলাম।”
মাহবুব খান কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। উঠে দাঁড়ালেন। চলে যেতে নিয়েও একবার রাউশির দিকে তাকালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তোর ভালোর জন্যই বলি নি মা আমরা। পারলে ক্ষমা করে দিস।”
রাউশি মাহবুব খানের হাত ধরে বলল,
“এসব কি বলছো বড় বাবা। আমি বুঝতে পারছি তোমাদের মনোভাব।”
মাহবুব খান আবারও রাউশির মাথায় হাত বুলিয়ে হঠাৎ বললেন,
“শুভ জন্মদিন মা।পুরোনো দিন ফেলে এই বছর তোমার এতটাই ভালো কাটুক যে আমরাও যেন খুব ভালো থাকি।”
রাউশি চমকে গেলো। তার জন্মদিনের কথা মাথায় আসলো। সে তো নিজের জন্মদিনের কথা ভুলেই গিয়েছিলো। মাহবুব খান হেসে চলে গেলেন। রাউশি আবারও একা একা বসে রইলো ছাদে। ফোনে টুংটাং মেসেজ চোখ গেলো ফোনের স্ক্রিনে। মেসেজ অপশনে ক্লিক করতেই দেখলো নাহিনের মেসেজ।
“হ্যাপি বার্থডে বিয়াত্তা বেডি।”
রাউশির চোখ গেলো স্ক্রিনের ওপরে। রাত ১২টা বাজে। এরপর পরপর তার বাবা, উজান ভাই, তানজিম ভাই, মাইশা, তানিয়াসহ বৃষ্টিও উইশ করলো তাকে হোয়াটসঅ্যাপে। হঠাৎ মেসেজ এলো নুজাইশের নাম্বার থেকে।
“শুভ জন্মদিন মৌরিন।”
রাউশি এতকিছুর মাঝেও খুব একটা খুশি হতে পারলো না। গতকাল সে শুনে ফেলেছিলো মেহরানের ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছিলো। অপারেশনের পর মেহরান কোমায় চলে গিয়েছে। এটুকু শুনেই রাউশি সারারাত কান্না করেছে। মেহরান এখন কেমন আছে? এই কথাটা তানজিমের থেকে জিজ্ঞাসা করেছিলো সকালে। তানজিম ভুত দেখার মতো চমকে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে বলেছে আগের তুলনায় ভালো। এটুকুতেই রাউশির কষ্ট কিঞ্চিৎ পরিমাণ লাঘব হলেও হাজার পরিমাণে যখমে হয়েছিলো এত বড় সত্য কথা ভেবে। মেহরানের যদি কিছু হয়ে যেতো? এটা আর ভাবতেই পারলো না রাউশি। তার মাথা কাজ করছে না। রাউশির ছুটে আমেরিকা চলে যেতে মন চাইছিলো সেমুহুর্তে। তবে যখন শুনেছে মেহরানই তাকে বলতে নিষেধ করেছে। তখন ভয়ানক এক অভিমান এসে ভর করে মনে মস্তিষ্কে।
মেহরানের কথা ভাবতেই রাউশির আবারও কান্না পেলো। আজ এমন দিনে মেহরান তার পাশে থাকবে না ভেবে। তখনই অতি পরিচিত, বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসলো পেছন হতে। তৃষ্ণার্ত কানজোড়াও যেন কিছুক্ষণের জন্য অবশ হয়ে এলো রাউশির।
“শুভ জন্মদিন মেহরানের মেহেরজান। হাজার, হাজারও দোয়া এই যে; রাউশির এই বছরটা তার মেহরানের সাথে এতটাই মধুর ভাবে কাটুক যে আশেপাশের প্রতিটি কোণায় কোণায় তা খোদাই করে লেখা থাকবে আজীবন ধরে।”
থামলো সেই কণ্ঠস্বর। পুনরায় কণ্ঠে শীতলততা মিশিয়ে শোধালো,
“আবারও দেখা হলো আমাদের।”
চলবে….
#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ৩৮
প্রিয় মানুষটির মুখ হতে নিঃসৃত বাক্যগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করলো রাউশি। খুবই শান্ত ভঙ্গিতে পেছনে ঘুরে তাকালো। চোখে পড়লো তার থেকে ছয় সাত হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটার দিকে। মাথায় ব্যান্ডেজ করা, বলিষ্ঠতা কমে শুকনো মুখ, ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা। তবে সেই হাসিটা কেমন মলিন লাগলো রাউশির কাছে। রাউশির মনে হচ্ছে হাজার বছর পর দেখা পেল সে মেহরানের। স্থির দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ একধ্যানেই তাকিয়ে রইলো।
মেহরান রাউশির কাছে এগিয়ে এলো। রাউশি কাঁদলো না। বরং স্থিরচোখেই পলক ফেলে তাকিয়ে রইলো মেহরানের দিকে। মেহরান তার আরও কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“কথা বলবি না?”
রাউশি সৎবিৎ ফিরে পেলো। একবার নিচে তাকিয়ে আবারও মেহরানের দিকে তাকালো। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বলল,
“কেমন আছেন?”
মেহরান হাসলো। রাউশির মাথা ডান হাত রেখে বলল,
“সামনে কাঙ্ক্ষিত নারী দাঁড়িয়ে আর মেহরান ভালো থাকবে না? তা কি করে হয় রাউশি?”
রাউশি এবার মুচকি হাসলো। রাউশিকে অন্যদিনের তুলনায় অনেক চুপচাপ লাগছে। মেহরান রাউশির গালে হাত রেখে বলল,
“অভিমান করেছিস?”
“না।”
“তাহলে কথা বলছিস না যে?”
রাউশি এবার মেহরানের হাত ধরলো। মাথা নিচু করে বারকয়েক দীর্ঘশ্বাস নিলো। এরপর মেহরানের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে পা দুটি উঁচিয়ে মেহরানের কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিলো। মেহরান আবেশে চোখ বুজলো। ফিসফিস করে বলেই ফেলল,
“ব্যাস এতটুকুই?”
রাউশি হেসে উঠলো। টুপ করে মেহরানের শুষ্ক ঠোঁটজোড়ায়ও একটা চুমু দিলো। মেহরান রাউশির এহেন কাজে হেসে ফেললো। রাউশির দিকে ঝুকে বলল,
“তানজিম যখন বললো তুই আমার ব্যাপারে সব জেনে গিয়েছিস, তখন ভেবেছিলাম না জানি কতদিন লাগবে তোর অভিমান ভাঙতে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি আমার রাউশিটা এতো বুঝে আমাকে। এজন্যই তো_”
বাকিটুকু বলার আগে রাউশির কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিলো মেহরান। রাউশির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“অনেক বেশি ভালোবাসি।”
কথাটা শেষ করেই মেহরান এক হাতে রাউশির কোমড় জড়িয়ে ধরলো । অন্য হাতে কানের পাশে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিলো। উষ্ণ হাতের তালু রাউশির গালে রেখে নাকে নাক ঘষলো। একইভাবে ফিসফিসিয়ে আওড়ালো,
“আমায় ক্ষমা করে দিস। সত্যিটা বলতে পারি নি। বেঁচে না থা_”
রাউশি আর বলতে দিলো না মেহরানকে। ঠোঁটে হাত রেখে বলল,
“আমার সাথে পুরো একটা জীবন কাটিয়ে দিন। মৃত্যু যদিই হয় তবে দুজনের একসাথেই হোক।”
মেহরানও কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“তাই হোক তবে।”
মেহরান এবার নিজের উষ্ণ শুষ্ক ঠোঁটজোড়া রাউশির ওষ্ঠপুটে ডুবিয়ে দিলো। নিস্তব্ধ রজনীর মাঝে হালকা নাতিশীতোষ্ণ বাতাস জানান দিলো কিছু প্রশান্তির।
.
এই গভীর রাতেই ছোটখাটো একটা সভা বসেছে খান বাড়িতে। বাড়ির বড় ছোট সবাই উপস্থিত। সভার মধ্যবিন্দু হলো মেহরান। উর্মিলা বেগম রোকসানা বেগম আর রূপা বেগমের মাঝে বসে কেঁদে চলেছেন ছেলের অসুস্থতার কথা শুনে। অনেকেই স্বান্তনা দিচ্ছে তবে তিনি থামছেন না। নাহিন,মাইশা, তানিয়া, তাজবিরের ঘুম পাচ্ছে। ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
এদিকে মাহবুব খান সবাইকেই বলছেন ঘটনা। ঘটনা যত গভীরে যাচ্ছে বাড়ির কর্ত্রীদের কান্নার বেগ বাড়ছে। এতক্ষণ শুধুমাত্র উর্মিলা বেগমই কান্না করছিলেন এবার রূপা বেগম আর রোকসানা বেগমও যোগ দিলেন। এদিকে মাহতাব খান তো অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছেন। চোখ বড় বড় করে শুধু তাকিয়েই আছেন। রাউশি মেহরানের পাশে বসেছে। মেহরানের সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো উজানকে মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে।
উজান বাড়িতে একবার দুবার এসে দেখা করে যেতো শুধু। এইতো আজ তানিয়াকে দেখে গেলো পাত্রপক্ষ। ছেলেটা আজও আসে নি। একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে উজান। ঢাকার মিরপুরে একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে নিজের টাকায়। মাহবুব খান ছেলেকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তবে উজান মানা করে দিয়েছে। মেহরান এসেই উজানকে মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে।
উজানও জানালো যে সে আসছে। এদিকে মাহমুদ খান বললেন,
“মেহরান অনেক বড় রোগ থেকে বেঁচে ফিরেছে। ওকে কিছুদিন রেস্টে থাকতে হবে। তাই ওদের ঘুমাতে যেতে দেওয়া হোক।”
একদিকে শ্বশুর তো অন্যদিকে মেজো চাচা। মাহমুদ খানের কথা শুনে মেহরান খুব খুশি হলো। উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের কাছে গেলো আগে। উর্মিলা বেগম ছেলেকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় বললেন,
“বাপ রে আমাদের বুঝি কষ্ট হয় না? এভাবে আমাদের না জানিয়ে গেলি কেন? আর একটাবারও কথা বলিস নি।”
তানজিম পেছন থেকে বলল,
“মেহরান ভাই তো এই কয়মাসই কোমায় ছিলেন। কথা কিভাবে বলতেন।”
উর্মিলা বেগমের কান্না আরও জড়ালো হলো। মেহরান মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
“তোমাদের যদি জানানো হতো তবে তোমরা ট্রমায় থাকতে মা।দেখো, আমি সুস্থ আছি। তোমার দোয়ায় আল্লাহর দোয়ায় আমি সুস্থ আছি। তুমি শুধুশুধু কান্না করো না মা।তোমার কান্না আমার ভালো লাগে না।”
উর্মিলা বেগম কেঁদে কেঁদেই বললেন,
“তুই আর কি বুঝবি রে বাপ?”
এরপর মাহবুব খানের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললেন,
“ও নাহয় বাচ্চা মানুষ। কিন্তু তুমি বুড়ো হয়ে কিছুদিন পর নাতি দেখবে। তোমারও কোনো আক্কেল নেই।”
মাহবুব খান বউয়ের কথায় একবার চারপাশে তাকালেন। বাচ্চারা কেমন মুখ টিপে হাসছে। হালকা কাঁশলেন মাহবুব খান। তিনিই বা আর কি বলতেন? যদি কথাটা ভাইরাল হতো তাহলে পুরো বাড়ির প্রতিটা মানুষই মেহরানের মতো কোমায় থাকতো এতদিন। মাহবুব খান চুপ রইলেন।
মেহরান আবারও মায়ের চোখ মুছে দিলো। আর বলল,
“কেঁদো না মা। আমি একদম ঠিক আছি। আমি খুবই ক্লান্ত মা। এখন কিছুটা রেস্টের দরকার!”
ছেলের কপালে চুমু খেয়ে উর্মিলা বেগম বললেন,
“ঠিক আছে যা ঘুমা গিয়ে। বাবা কিছু খাবি না?”
উনার এই কথাটা শুনে বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো সব একে একে নিজেদের রুমে চলে গেলো। এটা দেখে বাড়ির বড়রা শুধু তাকিয়ে রইলেন। রাউশি মেহরানের জন্য অপেক্ষা করছে। মেহরান বলল,
“আমার ক্ষিদে নেই মা। আপাতত একটা ঘুমের দরকার।”
উর্মিলা বেগম রাউশিকে ইশারা করলেন মেহরানকে নিয়ে যেতে। রাউশিও মেহরানকে চলুন বলে হাত ধরলো। তারাও চলে গেলো। দুজনকে এক সাথে দেখে বাড়ির বড়রা মাশা-আল্লাহ আওড়ালেন।
রুমে এসে মেহরান দরজা বন্ধ করে দিলো। রাউশি মেহরানের জন্য কাভার্ড থেকে জামাকাপড় বের করে দিলো। মেহরান সেসব নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। শাওয়ার নেওয়াটা অতিব জরুরী এখন।
রাউশি বিছানা ঝারলো। মেহরানের জন্য অপেক্ষা করলো। মেহরান বের হলো। রাউশি এগিয়ে গেলো মেহরানের দিকে।
“আপনি এখনও অসুস্থ। ঠিকভাবে সুস্থ হোন নিম কিছুদিন বাড়িতে থেকেই রেস্ট করবেন।”
মেহরান টাওয়ালটা মাথায় রেখেই বলল,
“যথা আজ্ঞা আমার রানী।”
রাউশি মেহরানকে খাটের ওপর বসিয়ে টাওয়ালটা দিয়ে মেহরানের চুল মুছে দিলো। মেহরান হুট করেই রাউশির কোমড় জড়িয়ে ধরলো। রাউশিকে বিছানায় ফেলে নিজেও রাউশির পাশে শুয়ে রাউশিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এখন একটা প্রশান্তির ঘুম দরকার। পাশে অবশ্যই তোকে চাই।”
রাউশি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না। মেহরানকে হারানোর ভয় তাকে জেকে বসেছে। মেহরানকে অন্তত তার জন্য সুস্থ থাকতে হবে। মেহরানকে আর কখনোই কষ্ট দেবে না সে। মেহরানের কপালে চুমু দিয়ে নিজেও চুপ করে রইলো। মেহরান বলল,
“ঘুমা।”
বাইরে থেকে বারান্দার পর্দা ভেদ করে বাতাস এসে দুজনের গা ছুয়ে দিলো। অনেকদিন মাস পর আজ হয়তোবা দুজনের শান্তির এক ঘুম হবে!
চলবে…..