ম্লান সন্ধ্যায় পর্ব-১১+১২

0
392

#ম্লান_সন্ধ্যায় (১১)

পাখিদের প্রভাত সঙ্গীতে কোয়েলিয়ার ঘুম ভাঙল।সারাহ তখন ও ঘুমুচ্ছে।যাদবের কথা রাখতে বোধহয় রাতে একপশলা বৃষ্টি নেমেছিল। বাড়ির সামনেটা একরকম পাকাই বলা চলে,তাই কাদামাটির ভয় নেই। পেছন দিকে অনেকটা জায়গা নিয়ে আম জাম কাঁঠাল,চালতাসহ বিভিন্ন গাছের সমাবেশ।তবে সবকিছু বেশ পরিচ্ছন্ন। কোয়েলিয়া প্রথমেই ছাদে গেল।সূর্য তখনও ঘুম থেকে জাগনি।দূরের গারো এবং মেঘালয় পাহাড়ের চূড়ায় তুলার ন্যায় মেঘপুঞ্জরা বাসা বেঁধেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা খাদ্য অনুসন্ধানে রওনা দেবার সময় একপলক মেঘালয়কে দেখে নিচ্ছে।এ সত্যিই অভূতপূর্ব দৃশ্য।

কোয়েলিয়া ব্রাশ করতে করতে বাইরে বের হলো। রাস্তার দুধারে বিশাল জমি। মাঝেমাঝে বাড়িঘর চোখে পড়ে। দেখে মনে হয় সবুজ সমুদ্রের মাঝে খন্ড খন্ড দ্বীপ। জমিতে হলুদ সর্ষে ফুল,যদিও গাছগুলো এখনও বড় হয়নি,তাই মাঠজুড়ে হলুদ চাঁদোয়ার পরিবর্তে সবুজের মাঝে ছিটছিট হলুদের নকশা তৈরি করেছে। অনেকদিন পর ওর মনে হলো,ও ওর চিরচেনা গ্রামের বাড়িতেই আছে।
পুকুরঘাটে সরফরাজের সাথে দেখা হলো।ওপরে বসে ফোনকলে কথা বলছিল। কোয়েলিয়া ওকে পাশ কাটিয়ে পুকুরে পানিতে মুখ ধুয়ে ওঠার সময় সরফরাজ বললো,
‘সুপ্রভাত।’
কোয়েলিয়া প্রতিত্তরে বললো,
‘এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছেন।’
‘গত রাতে অনেক আগেই ঘুমিয়েছিলাম,তাই বোধহয় ঘুম ভেঙ্গে গেল। জায়গাটা খুব সুন্দর। এখানে থেকে যেতে পারলে ভালো হলো।’
‘কয়েকদিন থাকুন। শেষে এমনিতেই পালাতে চাইবেন।’
‘তা একেবারে ভুল বলেননি।’

কোয়েলিয়া খেয়াল করলো,অনিক ওদের দিকে আসছে।ও সরফরাজকে রেখে সামনে এগোতেই অনিকের মুখোমুখি হলো। কোয়েলিয়া মুচকি হেসে বলল,
‘ঘুম ভেঙ্গে গেল?’
‘তৈরি হয়ে থাকবেন,ন’টার দিকে আমরা বেরোবো।’
কোয়েলিয়া মাথা নাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে অনিক বললো,
‘শুনুন।’
কোয়েলিয়া প্রশ্নাতুর চোখে ওর দিকে তাকায়।অনিক কিছু একটা ভেবে বললো,
‘কিছু না যান।’
কোয়েলিয়া অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভেতরে চলে গেল।অনিকের কাছে সরফরাজের সাথে কোয়েলিয়ার কথা বলাটা ভালো ঠেকেনি। কিন্তু এটা ও কিভাবে বলততো!সরফরাজ ও খারাপ ছেলে না, ফুফাতো ভাই বন্ধু হিসেবে খুব ভালো করে চেনে।তবে কেন ওদের এই কথোপকথন ওর কাছে কাঁটার ন্যায় ঠেকলো?

*
রাকিব হোসেন লোকটা দূরে থেকেও অতিথিদের আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখেনি। সকাল সকাল যাদব রান্নাঘরে খাবার তৈরিতে লেগে পড়েছিল। কোয়েলিয়া নিজেও ওকে সাহায্য করেছে।মধ্যবয়স্ক লোকটার আচরণ পিতৃসুলভ।কথা বলতে বলতে ওর পরিবার সমন্ধে শুনে নিলো।একটি ছেলে তিনটে মেয়ে।বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ওরা পাচগাওতে থাকে।
সকালের খাবার হিসেবে পাহাড়ী বনমোরগের ঝালঝাল ভুনা,শিম বরবটি আর গাজরের মিক্সড ভাজি সাথে রুটি। আহামরি কোন খাবার নয়,কিন্তু এটাই ওরা তৃপ্তি করে খেল। ভ্রমণের বাতাস এদের মনে বিপুল পরিবর্তনের জোয়ার বইয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে অনিকের মনে।

সারাহ উচ্ছাস প্রকাশ করে বললো,
‘যাদব কাকা,রান্নায় আপনি মেয়েদের ও হার মানাবেন। আপনার কম্পিটিশনে যাওয়া উচিত।’
যাদব মাথা নিচু করে বিনয় প্রকাশ করে বললো,
‘আপনাদের ভালো লেগেছে এটাই বেশি। বাড়িতে গিন্নি আমাকে রান্নাঘরে ঢোকার সুযোগ ই দেয়না।’
‘সবকিছু কতো চমৎকার।ইচ্ছে করছে এখানে থেকে যাই।’
সরফরাজ বললো,
‘তাহলে তোকে এখানে রেখেই যেতে হবে।কাকা একটা ছেলে দেখো, বোনটাকে এখানে বিয়ে দেবার সুবাদে মাঝেমাঝে আসতে পারবো।’
‘নিজের বিয়ের কথা ভাবো।বুড়ো হয়ে যাচ্ছ, কয়েকদিন পর তো মেয়েই খুঁজে পাবে না।’
‘আমাকে দেখে বুড়ো মনে হচ্ছে।’
‘একদম ফিডার খাওয়া বেবি লাগছে‌।’
‘তুইকি আমার কাছে মার খেতে চাস।’
‘আমি এখন কফি খাবো।ওই মারটা বরং তোমার বৌয়ের জন্য তুলে রাখো।’

এদের তর্ক যে চলতেই থাকবে,তা বুঝতে কারোর বাকি নেই। কোয়েলিয়া ওদের থামাতে অন্য প্রসঙ্গ তুললো।
অনিক চুপচাপ খাচ্ছিল। গুরুত্বপূর্ণ কথা ছাড়া ও তেমন কিছু বলেনা।যাদব কোয়েলিয়াকে আরেকটা রুটি নিতে অনুরোধ করলে, কোয়েলিয়া জানায় ও যথেষ্ট খেয়েছে‌।

*
বেলা নটার দিকে ওরা পাচগাও এর উদ্দেশ্যে বের হলো।যেটা কলমাকান্দার রংছাতি ইউনিয়নের অংশ এবং ভারতের সাথে পাহাড় দ্বারা বিভক্ত। ওদেরকে ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব নিলো যাদবের বড় ছেলে গৌরাঙ্গ।লম্বা চওড়া,সদা হাস্যোজ্জ্বল এক যুবক। নিজের পরিচয় দিয়ে জানালো ও শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র। ওরা গাড়ি নিয়েই বের হলো। গতরাতে সামান্য বৃষ্টি পড়েছে,যার জন্য অসুবিধা হবে না।তবে গৌরাঙ্গ জানালো চন্দ্রডিঙা পাহাড়ে যেতে হলে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।

গৌরাঙ্গ মোটরসাইকেল অনুসরণ করে ওদের গাড়ি এগিয়ে চললো।যদিও অনিক আর সরফরাজ অনেক আগে একবার এসেছিল, পথঘাট মোটামুটি জানা আছে।তবে এখন বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে। দুপাশে বিস্তির্ণ মাঠের বুকের ওপর দিয়ে পিচঢালা রাস্তার দু’পাশে সারি সারি গাছ। আশেপাশের লোকজন মাথা তুলে একপলক দেখে নেয়,এ রাস্তায় সাধারণত সিএনজি বাইক ছাড়া অন্য কিছু চলে না,তাই ক্ষণিকের জন্য কৌতুহল দেখায়। রাস্তার অবস্থা আগের তুলনায় ভালো।

ওরা পাচগাও বাজারের মোড়ে এসে সবুজ চাদরে মোড়া সুউচ্চ পাহাড়কে কাছাকাছি দেখতে পেল। ছোটবেলায় মোম প্যাস্টেলে দিয়ে আকা ছবির পাহাড়গুলো ভূমিতে খুঁটির ন্যায় স্থবির দাঁড়িয়ে উত্তরের শীতের মোকাবিলা করছে।সারহর ইচ্ছে করছিল গাড়ি থেকে নেমে ছুটে ওই পাহাড়ের কাছে চলে যায়। কিন্তু সোজাসুজি পথ মনে হলেও বেশ দূরে এবং সামনে জলাবদ্ধ ভূমি‌।
সবুজ গারো পাহাড়ের একটু ওপরে সারধরা মেঘালয় পর্বতমালা।খন্ড খন্ড মেঘেরা পাহাড়ের সাথে মিতালী করেছে।মনে হচ্ছে ওই চূড়ায় উঠলে পুঞ্জ মেঘের ভেলায় চড়ে বহুদূর পাড়ি দিতে পারবে।তাইতো বুঝি দূরের ওই গিরিমালা মেঘালয় নামে খ্যাত।অনিক দূর থেকে গারো পাহাড়ের কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।

সারাহ কোয়েলিয়াকে পাহাড়ের দিকে হাত তুলে দেখিয়ে বললো,
‘দেখো ভাবী,কি চমৎকার দৃশ্য,তাই না! ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যাই। কিন্তু দেখো, ওখানে পুকুরে পানি জমে আছে।’
‘ওটা ঠিক পুকুর নয়। রাস্তার জন্য হয়তো মাটি নিয়েছিল,তাই ওমন গর্ত। তবে সত্যিই খুব সুন্দর।মনে হচ্ছে পাহাড় আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।’
‘তবে আমরা পাহাড়ে উঠতে পারবো না।কারণ ওখানে বাংলাদেশের সীমান্ত।’
সরফরাজের কথা শুনে সারাহ একটু হতাশ হয়ে বললো,
‘তাহলে আর কি।শুধু দূর থেকেই দেখবো?’
অনিক ওকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
‘মমিনের টিলাতে উঠিস। আবার দূর্গাপুরের গারো পাহাড়েও আমরা যাবো।’
‘টিলা আর কত উচু হবে!’
‘যখন উঠবেন তখন একথা মুখে আসবে না।’
‘আর কতদূর?’
‘সামনে গাড়ি রেখে হেঁটে যেতে হবে।পারবি তো?’
অনিকের কথার মাঝখানে সরফরাজ বললো,
‘ও আর হাঁটা।শেষে দেখা গেল, ওকে দোকানে চকোলেট দিয়ে বসিয়ে রেখে আমাদের ওখানে যেতে হলো।’
‘দেখ ছোটভাইয়া, ঘুরতে এসেছি তাই তোকে কিছু বললাম না। ভালো হয়ে যা।’
‘তোমার ভয়ে আমি ইঁদুরের গর্তে লুকাবো।’
‘তোকে কিন্তু আমি।’
‘এই তোরা থামবি। নয়তো দু’টোকেই মাঝপথে ফেলে চলে যাব ।
অনিকের ধমকে সারাহ ভেংচি কেটে কোয়েলিয়ার সাথে আলাপ জুড়ে দেয়।

*
দোকানের পাশে গাড়ি, মোটরসাইকেল রেখে যেতে হয়। কেননা সামনের পথটা পায়ে হেটে চলার উপযোগী। উঁচুনিচু সরু মেঠোপথটা এগিয়ে গিয়েছে পাহাড়ের কাছে। মাঝখানে মানুষ চলাচলের কারণে ধূলি-ধূসরিত,দুপাশে সবুজ।শীতের রিক্ততা প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে, কিন্তু গতরাতের বৃষ্টিতে সবকিছু সবুজময়। কোয়েলিয়া এই প্রথমবার পাহাড় দেখলো।ও মুগ্ধ চোখে দূর পাহাড় দেখতে দেখতে হাঁটছিল।ওর পেছনে অনিক আসছিল।পথ যথেষ্ট বন্ধুর ছিল, দৃষ্টি উপরে থাকায় ও হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে অনিক ওর হাত ধরে ফেলে। দু’জনের চোখে চোখ পড়লো।অনিক মোহাবিষ্টের ন্যায় ওভাবেই তাকিয়ে ছিল। হয়তো আরও সময় থাকতো,সারাহর ইচ্ছাকৃত কাশির শব্দে ও কোয়েলিয়ার হাত ছেড়ে সামনের দিকে এগোয়। গৌরাঙ্গ আর সরফরাজের দিকে চোখ পড়তে দেখলো ওরা মিটিমিটি হাসছে।
‘পড়ে যাচ্ছিল,তাই হেল্প করেছি।’
গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে ও হনহন করে সামনের দিকে হেঁটে যায়। গৌরাঙ্গ হেসে বলল,
‘দাদা ভীষণ লজ্জা পেয়েছে।’
সরফরাজ হাসলো। অনিককে দেখলে কে বলবে,এটা ওর দ্বিতীয় বিয়ে! মনে হচ্ছে নতুন প্রেমে পড়া কোন কিশোর।

*
হেমন্তের শেষভাগে আসলেও ঝিরিপথে তখনও পানি ছিল।কূলকূল করে পানির ধারা ছোট বড় নুড়ি-পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে।একপাশে পাহাড়, মাঝখানে এই ঝিরি অন্যপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। ঝিরিপথ দিয়ে এগিয়ে ওরা ঝর্ণার দিকে চললো। পাহাড়ের যত কাছাকাছি আসছিল, ওদের মুগ্ধতা পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো। অবশেষে ওরা একদম পাহাড়ের বুকে পৌঁছাল। নানারকম পাহাড়ী লতা, বাঁশ, বিভিন্ন রকম গাছের সবুজ চাদরে মোড়ানো পাহাড়। কোয়েলিয়া আর সারাহ একদম কাছাকাছি গেল। দূর থেকে লতাগুল্ম আর গাছের সমাবেশকে ছোট মনে হলেও, কাছে পৌঁছাতেই মনে হলো, গহীন কোন অরণ্যে উপস্থিত হয়েছে।অনিক ফটাফট ওদের ছবি তুলেই চলেছে। সরফরাজ গৌরাঙ্গের সাথে পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে।

অনিকের সব মনোযোগ কোয়েলিয়ার দিকে।এই প্রথম ও সালোয়ার কামিজে মেয়েটাকে দেখলো।এই মেয়েকে না দেখলে হয়তো জানতো না,কৃষ্ণকন্যাদের কোঁকড়া চুলেও দারুন মানায়। মেয়েটা একদম সবুজের সাথে মিশে গেছে।অনিক ওখানে থাকা একখন্ড পাথরের ওপর বসলো। কোয়েলিয়ার নজর সেদিকে যেতেই ও অনিকের দিকে এগিয়ে এলো।
‘আপনার কি খারাপ লাগছে?’
‘খারাপ লাগবে কেন?’
‘লাগলে বলুন, আমি বিয়ার নিয়ে এসেছি।’
অনিক অবাক হয়ে বললো,
‘আপনি তো দেখছি আমাকে বদ্ধ মাতাল ঠাউরেছেন।এই তাহলে আপনার ব্যাগ আনার রহস্য।’

বলা বাহুল্য বের হবার সময় ওর কাঁধে বড় আকারের সাইড ব্যাগ দেখে সারাহ কৌতুহল হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,ওতে করে কি নিয়ে যাচ্ছে। তখন কোয়েলিয়া বলেছিল দরকারি কিছু,বলতে পারবে না।
কোয়েলিয়া বললো,
‘আপনার মাথায় এমনিতেই রাগ চড়ে বসে থাকে‌।শেষে দেখা গেল,এত সুন্দর একটা জায়গার সৌন্দর্য আপনার রাগের জন্য মনভরে দেখতে পারবো না!’
‘আমি কি সবসময় রাগ করি!’
‘বেশিরভাগ সময়। যাহোক অসংখ্য ধন্যবাদ।’
‘কেন?’
‘জীবনে প্রথম পাহাড় দেখাটা আপনার জন্য হলো।’
প্রতিত্তরে অনিক মুচকি হাসলো।এই প্রথম ও অনিককে কোয়েলিয়া বিমোহিত হয়ে মুখখানার দিকে তাকিয়ে রইল।হাসলে কি সুন্দর লাগে লোকটাকে।

*
গৌরাঙ্গকে অনুসরণ করে ঝিরির জলে পা ডুবিয়ে ওরা ঝর্ণার কাছাকাছি আসতেই পাথরের ওপর পানির আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পেল। নির্জন জায়গায় পাখির ডাক আর পানির শব্দ শুনে ওরা বিষাদের গ্লানি ভুলে গেল। কোয়েলিয়ার এতদিনের জমানো ব্যাথা নিমেষেই দূর হয়ে গিয়ে মনজুড়ে আনন্দেরা আনাগোনা শুরু করলো। এইতো জীবন, জীবনের আনন্দ। অসংখ্য পাথর আর নুড়ি বিছানো ঝিরিপথ ধরে ওরা গেল ঝর্ণার কাছে।আজ কোন পর্যটককে দেখা গেল না।এতে অবশ্য অনিক মনে মনে খুশি। কোয়েলিয়া কাছে এ অভিজ্ঞতা নতুন।

পাহাড়ের গা বেয়ে জলের ধারা শ্যাওলা পড়া পাথরের ওপর আছড়ে পড়ার সময় জল ছিটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।ঠিক তার আরেকপাশে বড় বড় পাথরের ওপর দিয়ে ওপর থেকে পানি গড়িয়ে আসছিল। চারপাশজুড়ে পানির শব্দ যেন সঙ্গীতের সুর তুলছে।সরফরাজ ঝর্ণার পাশের পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে ভেতরের দিকে গেল।সারাহ এর আগে মাধবকুন্ড গিয়েছিল এবং এই ছোট্ট ঝর্ণা মাধবকুন্ডের কাছে তেমন কিছুই নয়, তবুও ও আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে জিন্সের কিয়দংশ ওপরে তুলে জলের কাছাকাছি দাঁড়াল। পাথরের ওপর আছড়ে পড়া পানির ধারা ওর মুখে এসে পড়লো। হাত দিয়ে পানি ছুঁয়ে বললো,
‘এত সুন্দর জায়গা বাংলাদেশে আছে জানতাম না। সবকিছু কতো সুন্দর। এলাকার নামটাও কি চমৎকার! কলমাকান্দা!’
গৌরাঙ্গ বললো,
‘কলমাকান্দা নামের পেছনেও একটা লোককথা আছে।’
‘তাই নাকি!’
‘হ্যাঁ।বয়স্করা বলে,পাহাড়ি ঢলের পলিতে যে জমি গড়ে ওঠে , স্থানীয় ভাষায় কান্দা তা আঁকড়ে ধরে রেখেছিল কলমি লতা। এজন্য এর নাম হয় কলমাকান্দা।’
‘বাহ্, দারুন তো।’

*
অনিক এতক্ষণ ছবি তুলেছিল। সামনের বড় বড় পাথর দেখে মনে ইচ্ছে জাগলো, কোয়েলিয়াকে নিয়ে ওপরে উঠবে। আশেপাশে তাকিয়ে কোয়েলিয়াকে দেখলো না,সারাহ পাথরের ওপর বসে গৌরাঙ্গের সাথে কথা বলছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন কোয়েলিয়াকে দেখতে পেল না, তখন ওর বুকটা ধুক করে উঠলো। গৌরাঙ্গের কাছে গিয়ে বললো,
‘ও কোথায় গেছে?’
‘কার কথা বলছেন দাদা।’
‘কোয়েলিয়া,আমার স্ত্রী। ওদিকে গিয়েছে নাকি!’
ওপরের পাথরের দিকে তাকিয়ে,অনিক সরফরাজকে ডাকলো।ওর উদ্বিগ্ন কন্ঠ পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে গমগমে শোনাল।
গৌরাঙ্গ বললো,
‘ওদিকে তো যেতে দেখেনি। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।তবে চিন্তিত হবার কিছু নেই। এখানে হারানোর ভয় নেই। চলুন সামনে এগিয়ে দেখি।’

অনিকের মনে তবুও আশঙ্কার জন্ম হয়।এখানের কিছুই ও চেনে না,তার ওপর ওর কাছে ফোন নেই।বন জঙ্গলে সাপের উপদ্রব খুব,যদি কিছু হয়ে থাকে?অনিক আর ভাবতে পারেনা।ও উদ্বিগ্ন চিত্তে এদিক ওদিক তাকায়। সরফরাজ ততক্ষনে নেমে এসেছে। ওরা সামনে যাচ্ছিল, পথিমধ্যে ওদের চোখে পড়ে, সালোয়ার কামিজ পরিহিত লম্বা ছিপছিপে গড়নের একটা মেয়ে ছবি তুলছে। পায়ের শব্দ পেয়ে মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো‌।অনিক দ্বিধা না করেই বললো,
‘একটা মেয়েকে দেখেছেন, কোঁকড়া চুল সালোয়ার কামিজ পরা।’
মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘ওই সামনে বটগাছের নিচে বসে আছে।’

অনিক কালক্ষেপণ করলো না।দ্রুত পায়ে মেয়েটার দেখানো পথে অগ্রসর হলো।
কিছুদূর যাওয়ার পর দূর থেকে শ্যাওলা ধরা পাথরের ওপর কোয়েলিয়াকে বসে থাকতে দেখলো। একরকম দৌড়ে ও কোয়েলিয়ার হাত ধরে বসা থেকে উঠিয়ে বলে,
‘আপনার কোন কমনসেন্স নেই।না বলে চলে এসেছিলেন কেন?কত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম জানেন!’
অনিককে উত্তেজিত দেখায়। কোয়েলিয়া ওর হাতটা ধরে পাথরের ওপর বসালো। তারপর বললো,
‘শান্ত হন প্লিজ। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলাম।এখানটা নিরিবিলি তাই একটু বসলাম।’
‘তাই বলে কথা নেই বার্তা নেই একা একা চলে আসবেন।’
‘সরি।’
‘হ্যা সরি বললেই সব উদ্ধার হয়ে যাবে।’
ততক্ষনে অনিক স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এরকম আচরণের জন্য কিছুটা লজ্জিত হলো। ও বললো,
‘হারিয়ে গেলে বাবাকে কি বলতাম?বাবা কিছু না বললে আপনাকে খোঁজার ইচ্ছে ছিল না। ভাববেন না যে আপনার চিন্তায় আমি পাগল হতাম।’
‘আমি মোটেও ভাবছি না।’

ওদের কথার মাঝখানে ওরা তিনজন উপস্থিত হলো। সরফরাজ বললো,
‘আপনার জন্য তো আরেকটু হলে আমার ভাই হার্ট অ্যাটাক করছিল।’
অনিক ধমক দিয়ে বলে,
‘কি যা তা বলছিস।’

সারাহ এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
‘বটগাছটা কিন্তু বিশাল।ডালপালা মেলে ছাতার মতো দেখাচ্ছে।এইযে গৌরাঙ্গ দা চন্দ্রডিঙা পাহাড়ে তো ঘুরতে নিলেন না।’
‘চন্দ্রডিঙা পাহাড়ের কাছেই তো আছি।ওইযে দেখুন।’
গৌরাঙ্গের সাথে সাথে ওরা পাহাড়ের দিকে তাকায়। অনেকটা অর্ধচন্দ্রের ন্যায়। অনিক বললো,
‘এই পাহাড়ের মিথটা আমি জানি।’
গৌরাঙ্গ উৎসুক হয়ে বললো,
‘সত্যি দাদা, বলুনতো।’
‘ বহুকাল আগে এখানে কালিদহ সাগর ছিল। চাঁদ সওদাগর পদ্মা দেবীর পূজা না করায় এখানে তার নৌকা ডুবে যায়।পরে এখানের পাহাড়ের ওপর চন্দ্রের আকৃতি দেখে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধারণা ওটা নৌকাডুবির ঘটনাকে স্মরণ করে গড়ে উঠেছে।’
‘আপনারা আগে এসেছিলেন নাকি!’
‘হ্যাঁ। আমরা দুই ভাই অনেক বছর আগে এসেছিলাম।’
ততক্ষনে বেলা এগারোটা বেজে গেছে। সূর্যের তেজ তেমন নেই।হালকা বাতাসে বটের পাতার সাথে সূর্যকিরণ খেলা করছে। ওরা বটের ছায়ায় কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলো।

শ্যাওলা পড়া পাথরের গায়ে মস ফার্ণ জন্মে নান্দনিকতা এনেছে। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে গুল্ম আর পাহাড়ীলতা। ওরা ঝর্নার পাশের পাথুরে পথ ধরে ওপরে চলছে।পাথর পিছলে হওয়ায় খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। কোয়েলিয়ার পাথর অতিক্রম করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল।ও ক্লান্ত হয়ে পাথরের ওপর বসে পড়লো।ওপর থেকে আসা স্বচ্ছ জল ওর পা ছুঁয়ে গেল। ঠিক তখনই একটা বলিষ্ঠ হাত ওর ছিপছিপে হাতখানা ধরলো।বললো,
‘সামনে অল্প একটু যেতে পারবো,ওদিকে ইন্ডিয়ার বর্ডার।উঠুন।’
কোয়েলিয়া মনটা পুলকিত হলো। শহরের যান্ত্রিকতা জড়ানো মন এই পাহাড়ে এসে সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সামনে কি হবে জানা নেই।তবে বর্তমানে এই মুহূর্ত উপভোগ করার লোভ সামলাতে পারলো না।কোয়েলিয়া অনিকের হাতটা আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চললো। এমন একটা হাত ধরে পথ চলতে সব মেয়েই চায়। চারপাশে জলতরঙ্গের সুর আর এই পাষাণে গড়া শৈলমালা,একটি সুন্দর মূহুর্তের সাক্ষী হলো।

চলবে…
®️ সুমি খানম

#ম্লান_সন্ধ্যায় (১২)

চন্দ্রডিঙা পাহাড় দেখার পর, হাঁটতে হাঁটতে ওরা বেদগড়ায় পৌঁছাল। শীতের সূর্যের তাপ প্রখর নয়।তবে পাহাড়ের উষ্ণতায় সারাহ ক্লান্ত হলেও,বেশ উৎসাহের সাথে এগিয়ে চলছে। কোয়েলিয়ার মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই।অনিক ক্যামেরা দিয়ে আশেপাশের ছবি তুলতে ব্যস্ত।সরফরাজ,গৌরাঙ্গ আর সাথে আসা দুটো হাজংবাচ্চার সাথে বেশ গল্প জমিয়ে দিয়েছে।বেদগড়া জায়গাটা ওদের খুব পছন্দ হলো‌।মূলত প্রকৃতির কোন সৌন্দর্যই মনে বিতৃষ্ণা যোগায় না।

সবুজে ঘেরা সুউচ্চ কৈলাস মালা, তার ওপর দিয়ে ভারতীয় সীমান্তের পিচঢালা রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠে গেছে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝিরিকে কাঁটাতারের বেড়া আটকাতে পারেনি।দুপাশের পানির সংযোগ বড় বড় পাইপের সাহায্যে।এর ভেতর দিয়ে অনায়াসে একজন মানুষ কুঁজো হয়ে চলে যেতে পারবে। ওদেরকে সরাসরি দেখাতে বাচ্চাদের একজন ভেতর দিয়ে ঢুকে ওপারে চলে গেল। কোয়েলিয়া বললো,
‘ওপাশে গেল‌।যদি বিএসএফ ঝামেলা করে!’
‘এখানকার মানুষ অনায়াসে ওপারে যেতে পারে, কোন ঝামেলা হয় না। এখানকার দোকানদাররা ভারতীয় পণ্য এনে বিক্রি করে।তারা অবশ্য এই পাইপের ভেতর দিয়ে যায় না।বর্ষায় পাহাড়ী ঢল নামলে ঝিরিতে পানি বেড়ে যায়।’
গৌরাঙ্গের কথায় কোয়েলিয়া সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘পৃথিবীতে কতকিছু দেখার আছে। কিন্তু জীবনসংগ্রামের জন্য অনেক কিছুই আমাদের দুচোখ দেখে না।’

নুড়িবিছানো আর লালচে বালির ঝিরিতে ওরা নেমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো।স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় জলে পা ডোবানো অন্যরকম অনুভূতি।আজলা ভরে জল তুলে সরফরাজ মুখ ধুলো।অনিক বাচ্চাদের নিয়ে প্রচুর ছবি তুললো।কোনাটায় ওরা পাঁচজন,কোনোটাই ও আর বাচ্চাদুটো। কোয়েলিয়ার নজর কাড়লো একধরনের বেগুনি ফুল। পাতাগুলো চ্যাপ্টা,তার মাঝখানে মাঝারি ফুলগুলো চন্দ্রডিঙা পাহাড়েও অনেক দেখেছে।ও একটা ফুল কানের কাছে গুজতে দেরি করলেও, অনিকের ছবি তুলতে দেরী হলো না। কোয়েলিয়ার কাছাকাছি সরফরাজ দাঁড়িয়ে ছিল।ও মুচকি হেসে বললো,
‘পাহাড়ী ফুলের জীবন আজ স্বার্থক হলো।’
‘কেন?’
‘এই নির্জন পাহাড়ের পাদদেশে এক নন্দিনী তাকে চিকুরে ধারণ করলো,এতো ওর সার্থকতা।’
‘তাই নাকি!তবে আপনার কথা শুনলে যেকেউ ভুল কিছু বুঝবে।’
‘যাকে বলছি সে ভুল না বুঝলেই হবে।’

অনিক দূর থেকে সবটাই অবলোকন করছিল। দুজনকে কথা বলতে দেখে ওর রাগ হলো। মাথায় একটা কথাই এলো, সরফরাজ কেন কোয়েলিয়ার দিকে তাকিয়ে কথা বলবে।ওই কৃষ্ণকায়া বেগুনি ফুল গোঁজা কোঁকড়া চুলের কন্যার সাথে কথা বলার অধিকার শুধুমাত্র ওর।আজকাল ওর কি হয়েছে কে জানে? নিজের মনকে এতো শাসন করা, মেয়েটার থেকে নিজেকে দূরে রাখা এসব কোথায় উধাও হলো।ও যে ধীরে ধীরে ওই তনয়ার প্রেমে মজে যাচ্ছে।তবে কি আরো একবার নারীর ছলনার শিকার হবে?নাহ্ ওরা গল্প করে করুক গে।ওর কি?

কিন্তু এতক্ষন নিজের মনকে বুঝিয়েও বশ করতে পারলো না।ও ওদের দিকে এগিয়ে গেল। কোয়েলিয়াকে বললো,
‘চলুন, আমরা ওই বড় টিলাটায় উঠে আশপাশটা দেখবো।’
কোয়েলিয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করে ওর হাত ধরে এগিয়ে চললো। সরফরাজ অনিকের ঈর্ষা উপলব্ধি করে স্মিত হাসলো।একটা ফুলের পাপড়িতে হাত ছুইয়ে বললো,
‘মানুষ বড়ই রহস্যময় সৃষ্টি‌। যে বিপদের আশঙ্কায় দূরে থাকতে চায়,সেই বিপদের কাছেই ছুটে আসার আগ্রহ বেশি থাকে‌। আগুনে মৃত্যু জেনেও পতঙ্গ যেমন ছুটে যায়।’

টিলায় উঠতে চেয়েও চূড়ায় যেতে পারলো না।অল্প একটু উঠেই ওরা চারপাশটা ভালো করেই দেখতে পেল। ছোট ছোট গুল্মে আর পাহাড়ী ফুলগাছে জড়ানো টিলা। মাঝেমাঝে বড় আকারের কালো পাথরের ফাঁক দিয়ে ফার্নের বিভিন্ন প্রজাতি মাথা তুলেছে।এই পাথরের ওপর পড়লে আহত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।ওরা অল্প একটু উঠলো। কেননা মধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে এই ভরদুপুরে এখানে চড়া মানে অসুস্থতাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো।তাই সরফরাজ ওদের নিষেধ করলো। তবুও অনিক বেশ খানিকটা ওপরে উঠে সবুজের সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দি করে নিলো।রাগী লোকদের এই এক সুবিধা।এরা যে কাজে গো ধরে তাতে ক্লান্ত হয়না।

যাদব বাড়ি ফেরার পথে ওদের জন্য কালভার্টের সামনের দোকানে অপেক্ষা করছিল।ও খুব করে ধরে বসলো,পাচগাওয়ে যখন এসেছে তখন দুপুরের খাবারটা ওর ওখানেই খেতে হবে।যাদবগিন্নী ওদের জন্য অপেক্ষা করছে।অনিক আপত্তি করে বললো,
‘আমরা ঘুরতে এসে আপনাদের অসুবিধায় ফেলতে চাই না। এমনিতেই গৌরাঙ্গের সময় নষ্ট করলাম।’
স্বল্পভাষী লাজুক গৌরাঙ্গ এবার প্রতিবাদ করলো।বললো,
‘আপনাদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে নতুন করে জন্মভূমিকে দেখছি।এত কাছে তবুও সবসময় আসা হয়না।দিনদিন আমাদের ভেতর যান্ত্রিকতা চলে এসেছে।আপনাদের সাথে সুন্দর একটা দিন কাটালাম। তাছাড়া রাকিব কাকার অতিথিরা আমাদেরও অতিথি। কোন আপত্তি চলবে না।
সরফরাজের অনিকের কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘আপত্তি করিস না,চল।’
অনিক রাজী হলে যাদব মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যায়।আর গৌরাঙ্গ ওদের গাড়িতে ওঠে।অল্প একটু পথ অতিক্রম করলেই ওদের বসতভিটা।

সারাহ বরাবরই কৌতুহলী।ও যেতে যেতে গৌরাঙ্গকে বললো,
‘আপনাদের এখানে জুম চাষ হয় না?’
‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা বরাবরই সমতলে চাষবাস করতেন বলে গারোরা আমাদের নাম দিয়েছিল হাজং,মানে মাটির পোকা। এখানে সবাই সমতলের ধানচাষী।তবে দূর্গাপুরের গারোরা জুমে শাকসবজি ফলায়।’
‘আপনারা কি সবাই বাংলাতে কথা বলেন?’
‘নিজেদের ভেতরে হাজং ভাষায় বলি। তবে বাংলা শেখাটাও আমাদের জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পড়ালেখার খাতিরে মোটামুটি তিনটে ভাষা জানতে হয়।’
‘তিনটে মানে?’
‘বাংলা,ইংরেজি,হাজং।’
‘তাহলে তো এখানকার মানুষ পড়াশোনায় অনেকটাই এগিয়ে গেছে?’
‘আগের তুলনায় অনেক।অবশ্য অনেকেই দারিদ্রতার কারণে পড়াশোনা করার থেকে চাষবাসকেই ভালো মনে করে।তবে পূর্বের তুলনায় এখানকার উন্নতি হয়েছে। অনেকেই পাবলিকে চান্স পাচ্ছে,প্রযুক্তির উন্নয়নকে সমানভাবে কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু ভালো চিকিৎসার জন্য আমাদের ময়মনসিংহে যেতে হয়।’
সরফরাজ গাড়ি ড্রাইভ করছিল।ও বললো,
‘সবথেকে বড় কথা, তোমরা প্রাণভরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে পারো,যেটা আমাদের সম্ভব হয় না। চট্টগ্রাম সিলেটে দূষণ ঘটলেও এখানে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কম।’
‘এই দিকটা অবশ্য আমাদের জন্য ভালো। তবে বর্ষায় অনেকেরই সমস্যায় পড়তে হয়। বিশেষ করে সোমেশ্বরী,কংস,গনেশ্বরীর জলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।’
‘আগের থেকে কিন্তু অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমরা যখন প্রথমবার দূর্গাপুর আসি, তখন রাস্তায় বের হলে ধূলিস্নান করতে হতো। এখন তো গাড়ি নিয়েও চলাচল করতে পারছি।’

পাকা সড়ক থেকে মাটির পথ ধরে টিলাসদৃশ একটা জায়গায় উঠে যাদবের বাড়িসহ আশেপাশে চারপাচটা পরিবারের বসতি।দুখানা টিনের ঘর, দেওঘর আর রান্নার জায়গা । সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার। বাড়ির পেছনে সুপারি গাছের সমাবেশ।এ অঞ্চলে ছনের ঘর এখন আর দেখা যায় না। এখানকার মানুষদের জীবনধারায় বহু পরিবর্তন এসেছে। ওদেরকে ঘরের ভেতরে বসতে দেওয়া হলো।যাদব গিন্নীর মুখটা গোলগাল, তামাটে বর্ণ চেহারায় সবসময় হাসি। এজন্যই বোধহয় নথিপত্রে লেখা আছে,হাজং সম্প্রদায় সবসময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে।পরনে হাজংদের ঐতিহ্যবাহী তাঁতে বোনা পাথিন।জামার ওপর প্যাচানো শাড়ি বুকের ওপরে বন্ধনী দিয়ে আটকানো। পাহাড়ে চলাচল,চাষবাসের উপযোগী পোশাক।তবে বাচ্চাদের পরণে ফ্রক দেখে বোঝা গেল,পোশাকের ঐতিহ্য শুধুমাত্র বয়সীরাই ধরে রেখেছে।ঘরে বিদ্যুৎচালিত পাখার উপস্থিতি প্রমাণ করে,পূর্বের সেই অজপাড়াগা বলতে এখানে কিছু নেই।
গৌরাঙ্গ হাত মুখ ধোয়ার জায়গায় নিয়ে গেল। দুপুরের খাবারের পূর্বে কয়েকরকম পিঠা আর ফলমূল কেটে ওদের খেতে দেওয়া হলো।খেতে খেতে ওরা সবার সাথে পরিচিত হলো।যাদবের বাড়িতে ওর মা,ছোট ভাই ও তার পরিবার একসাথে থাকে।যৌথ পরিবার বলা চলে। দুপুরের খাবার আর যাদবের পরিবারের আতিথেয়তা গ্রহণ করে ওদের বেশ ভালোই লাগলো।

*
যাদবের বাড়ি থেকে যখন ওরা বেরোলো, তখন ঘড়ির কাটা তিনটে ছুঁইছুঁই। ওরা এবার যাবে পাতলাবনের দিকে। সবশেষে মমিনের টিলা থেকে সূর্যাস্ত দেখবে।আজ বড় চমৎকার দিন। সূর্যের সাথে সাথে ওরাও আজ হাসিখুশি,বিষাদেরা রয়েছে বহুদূরে।তারা অপেক্ষা করছে এই মানব-মানবীরা কবে শহরে ফিরবে।লালচে ধূলো উড়িয়ে ওরা চললো পাতলাবনের দিকে।নাম পাতলাবন হলেও এখানে পাহাড়ের ওপর সবুজের সমারোহ কিন্তু পাতলা নয়। ভাগাভাগিতে বাংলাদেশের ভাগে জুটেছে গুটিকয়েক টিলা আর সিংহভাগ টিলা ও পাহাড়ের সমাবেশের মালিক ভারত।দুদেশকে আলাদা রাখতে মেঘালয় থেকে নেমে এসেছে মহাদেও নদী। শুষ্ক মৌসুম কাছাকাছি আসায় নদীতে হাঁটুসমান জল।বিস্তির্ণ চরে লালচে বালি,যা ইমারত তৈরির অত্যাবশকীয় উপাদান আর ছোট বড় পাথর।তার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জল।পাহাড় থেকে নেমে আসার কারণে বর্ষায় পাহাড়ী ঢলের সাথে বালি পাথর নেমে আসে,যার জন্য নদীর মাঝে মাঝে চর জেগে উঠেছে।মহাদেও এর বর্তমান রূপ ছোটবেলায় পড়া রবীন্দ্রনাথের সেই ছোট নদী,বৈশাখে যার হাঁটুজল থাকে।

গৌরাঙ্গ বললো,
‘আপনারা ফেব্রুয়ারিতে এলে পা ডুবিয়েই ওপারে চলে যেতে পারতেন।তবে চারপাশ এতো সবুজ থাকতো না।’
কোয়েলিয়া বললো,
‘একদম রবিঠাকুরের ছোট নদী। কিন্তু আজ এখানে কাওকে দেখছি না যে।’
‘প্রায়ই এখানে অনেকেই ঘুরতে আসে।আজ তো অফডে নয় ,তাই হয়তো কেউ নেই। তাছাড়া প্রশাসন ও একে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কোন পদক্ষেপ নেয়নি।একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, এখানে অনেকেই সাধ্যের মধ্যে ঘুরতে পারবে। খাবারের চড়া দাম কিংবা গাইডের খরচ বা ছবি তুলতে বাড়তি খরচের প্রয়োজন হয় না। একা একাই আসা যায়, কিন্তু স্থানীয় কেউ সাথে এলে ভালো হয় আর কি।’
‘ওপাশের টিলাতেও গারোদের বাস?’
‘হ্যাঁ। ওখানে গেলে মাচাং ঘর দেখতে পাবেন।’
‘দারুন তো।’

সরফরাজ আর অনিক থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের সুবিধা ভোগ করে হাটুসমান জল ঝাঁপিয়ে চরের ওপর গিয়ে দাঁড়াল।সারাহ হতাশ হয়ে ওদের ছবি তোলার দায়িত্ব নিলো। এদের দেখে কে বলবে দলে নব্যবিবাহত একজোড়া কপোত কপোতী আছে‌। মনে হবে চার বন্ধু ট্যুরে এসেছে। কোয়েলিয়া ধূ ধূ চরে হেঁটে কিছুদূর গেল। এরকম পরিবেশে লালচে বালির ওপর পা রেখে নিরুদ্দেশ হবার বাসনা জাগে।শীতের বিকেল তাড়াতাড়ি নেমে আসে।সাড়ে তিনটা বাজে কিন্তু রৌদ্রের তেজ মরে গেছে।এক জায়গায় ও অল্প পানি পেল। সারাহ কে ডেকে ওরা ওখানে গিয়ে দাঁড়াল।সারাহ নানা পোজে সেলফি নিলো। পেছনে ভারতের গারো পাহাড়। চমৎকার ব্যাকগ্রাউন্ড। ওরা একজন গারো নারীকে মাছ ধরতে দেখল।সারাহ বেশ আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।মহিলাটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা জানে।সে জানালো ওই টিলার ওপর ওদের বাস।সারাহ একটা সেলফিও তুললো। কোয়েলিয়ার এই মেয়েটাকে খুব ভালো লাগে।এই বয়সী বেশিরভাগ মেয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো আচরণ করে। অথচো সারাহ কে দেখলে একজন প্রাণোচ্ছ্বল কিশোরী মনে হয়। সবসময় জিন্স টপস পরা,চুলে ক্লিপ লাগানো মেয়েটাকে যে কেউ খুব সহজে ভালোবাসবে।অন্যদিকে অনিক নাজমার মতো। গম্ভীর, কথা কম বলে এবং সর্বদা নিজেকে রহস্যময় করে তুলতে সচেষ্ট।

ওরা নদীর আরেকটু ভেতরে যেতেই বর্ডারগার্ডের হুইসেল ওদের সতর্ক করে দিলো, ওদিকে আর নয়।অনিক ওদের চলে আসতে বললো।আশেপাশের টিলায় ওঠার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ওদের এখনও দুটো জায়গা ঘুরে দেখার বাকি রয়েছে।ওয়াচ টাওয়ারের পাশে গাড়ি পার্ক করা ছিল।অনিক ওয়াচ টাওয়ারে উঠে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। অবশ্য বর্ডারগার্ড দেখলে ঝামেলা করতো কিনা,কে জানে।

*
পাচগাওয়ের রাস্তা থেকে বের হয়ে ওদের গাড়ি চললো লেংগুরার দিকে। গৌরাঙ্গ বললো,গাড়ি চলাচলের পথ হিসেবে বাজারের রাস্তা ধরেই যাওয়া ভালো।গাড়ি চালানোর আনন্দ এসব রাস্তায় উপভোগ করা যায়। বাজার পেরিয়ে যেতেই কোয়েলিয়া বললো,
‘দেখো,মন্দিরটা সুন্দর না।’
‘ইশ্, পেছনে পড়ে গেল। ভাইয়া,গাড়ি ব্যাকে নেও তো।’
অনিক বিরক্ত হয়ে গাড়ি পিছিয়ে মন্দিরের সদর দরজায় রাখলো। গৌরাঙ্গ বাইক নিয়ে ব্যাকে এসে বললো,
‘কিছু হয়েছে,দাদা?’
‘সাথে ললনাদের আনলে যা হয়। এখন মন্দির দেখবে।’
‘আসার পথে দেখতে পারবেন, সমস্যা নেই।’

অনিককে ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। আপাতত ক্যামেরার দায়িত্বে রয়েছে সরফরাজ।মন্দির পেরিয়ে কিছুটা দূরে ফুলবাড়ি বাজার পড়লো।ওখান থেকে স্ন্যাকস আর কোক নিয়ে ওরা চললো সাত শহীদের মাজারে।
মাজারে যাওয়ার রাস্তাটা অন্য রাস্তাগুলো থেকে একটু বিশেষ। রাস্তার কিনারা ঘেঁষে বয়ে চলেছে গনেশ্বরী।বর্ষায় বান ডেকে আনা গনেশ্বরীতে এখন অল্প পানি আর লালচে বালি। স্রষ্টার সৃষ্টির তুলনা নেই। কীর্তিনাশা গনেশ্বরী,মহাদেও এখন যৌবন হারিয়ে শান্ত। আবার বৃষ্টির ছোঁয়া পেলে নিজের দানবীয় রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটবে।এযেন জাদুর কাঠি ছোঁয়ানোর মতো।

*
সারি সারি মেহগনির বাগানের শেষভাগে ফুলবাড়ী গ্রামে দেশের সাতজন সূর্য সন্তান ঘুমিয়ে আছে।ওপাশে ভারতের সীমানা।নিচ দিয়ে গনেশ্বরীর প্রবাহ।দূরে গারো পাহাড় আর মেঘালয়।এই বাগানেই বাংলাদেশের শেষ। এরমধ্যে বিজিবির হুইসেলের আওয়াজ এলো।পর্যটকদের এখানে এলে একটু সতর্ক থাকতে হয়।
তবে এখানকার সাধারণ মানুষের কোন বাঁধা নেই। কোনোরূপ বাধাবিপত্তি ছাড়া আত্মীয়ের মতো ওপারের মানুষ এপারে আসে, এপারের মানুষ ওপারে যায়।দেশ ভাগ হলেও ওদের ভাষা সংস্কৃতির কোন পরিবর্তন হয়নি। সমাধির পাশেই লালরঙের বোর্ডে সতর্কবার্তা লেখা রয়েছে‌। সারাহ সেটা অতিক্রম করে বললো,
‘এইযে আমি এখন ভারতে চলে গেলাম।’
‘হ্যাঁ, মেহগনি বাগান থেকে একপা বাইরে রাখো। বিএসএফরা বুলেট ছুড়ে ওয়েলকাম জানাবে।’
সরফরাজের কথার উত্তরে সারাহ ভেংচি কেটে নদীতে নামলো।সারাহ সবেমাত্র গনেশ্বরীর লালচে বালিতে পা রেখেছে ওমনি হুইসেলের শব্দ চারপাশে মেতে উঠলো। গৌরাঙ্গ বললো,
‘জলদি উঠে আসেন।ওরা ঝামেলা করতে পারে।’

সমাধিতে ছয়টি কবর দৃশ্যমান,যদিও এখানে সাতজনকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল।সাদা রঙা টাইলস দিয়ে চারপাশ বাঁধানো।ওরা নীরবে কিছুক্ষণ সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। এখানে দেখার তেমন কিছুই নেই, কিন্তু যারা এখানে ঘুমিয়ে আছে,এরা তো সাধারণ কেউ না। ওদের চোখের সামনে চিরনিদ্রায় শায়িত সাতজন অপরাজেয় মানব।

১৯৭১ সালের ২৬শে জুলাই এই সন্তানেরা প্রস্তুত ছিল ঘাতকদের নির্মূল করতে। হয়তো হানাদারেরা বুঝতে পেরেছিল,তাইতো ওরা এমন সময় কলমাকান্দায় পা রাখলো,যখন বীরেরা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। তবুও ওরা যেভাবে পারলো, আধুনিক সমরাস্ত্রের বিরূদ্ধে লড়লো। কিন্তু একাত্তরে দেশমাতৃকার প্রয়োজন ছিল রক্তের। রক্ত দ্বারা শোষক জর্জরিত নিজের দেহ পরিষ্কারের তাগিদ দেখা দিয়েছিল। তাইতো একসমুদ্র রক্ত নিতে লক্ষাধিক সন্তান ঘাতকের হাতে শহীদ হয়েছে।এই সাতজন তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।তাও এরা সমাধি পেয়েছে। অনেকেই তো হয়েছে শেয়াল কুকুরের খাবার।অনেকে বা গনকবরে ঠাই পেয়েছে,কেউবা সলিল সমাধি পেয়েছে। এদের কারো কারো পরিবার হয়তো বছরের পর বছর প্রতিক্ষা করতো। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলেই দৌড়ে এসে যখন কাঙ্ক্ষিত মানুষটার পরিবর্তে অন্য কাউকে দেখতো,তখন একবুক বেদনা নিয়ে মিছে হাসি হাসতো।এই দেশ এতো সামান্য ভূখণ্ড নয়। রক্ত দ্বারা পরিশ্রুত একখন্ড ভূমি।

*
মমিনের টিলা আপাতদৃষ্টিতে ছোট মনে হলেও, মধ্যাকর্ষণের বিপরীতে ওপরে উঠতে গিয়ে ওরা হাঁপিয়ে গিয়েছিল।যদিও কোয়েলিয়া এবং গৌরাঙ্গ বাদে বাকিরা বান্দরবান গিয়েছে। কিন্তু বাঁশ ছাড়া এভাবে উঠতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে।উচু উঁচু মেহগনি,রেইনট্রি শাল, বাঁশ আর লতাগুল্মের দিয়ে টিলাটি ঢাকা। ফাঁকে ফাঁকে কালো পাথর, আপাতদৃষ্টিতে কয়লা মনে হয়।ঢালু সরু পথ এঁকেবেঁকে ওপরে উঠেছে।সমস্ত নির্জনতা ভেদ করে মাঝেমাঝে পাহাড়ী পাখির ডাক ওদের মনে দূর্ভেদ্য গহীন অরণ্য পাড়ি দেবার মতো রোমাঞ্চকর অনুভূতি জোগাচ্ছে।মাঝেমাঝে বিশ্রাম নেবার জন্য গাছের গুঁড়ি, ছাতার নিচে শান বাঁধানো বসার জায়গা। মমিনের টিলার বিশেষত্ব হলো,মনে হবে এই বুঝি চূড়ায় উঠে পড়েছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছালে দেখা যায় আরেকটা ঢালুপথ এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে গিয়েছে।

কোয়েলিয়া ধপ করে পাথরে বসে বড় বড় শ্বাস নিলো।সারাহ ওর সাথে ছিলো, কোয়েলিয়াকে বসতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
‘তোমার কি খুব খারাপ লাগছে?’
কোয়েলিয়া মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘আমার ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করো।’

পানি পান করে ও কিছুটা স্বস্তিবোধ করলো।অনিক অনেকটা যাওয়ার পর পেছনে ওদেরকে না দেখে উল্টোদিকে হেঁটে কোয়েলিয়াকে দেখলো। কাছাকাছি এসে বললো,
‘আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?’
‘না, হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম। কখনো উঠিনি তো।’
‘ঠিক আছে আর যেতে হবে না।সারাহ, তুই এগিয়ে যা, আমি এখানে আছি।’
‘তার কোন দরকার নেই। আমি এখন যেতে পারবো।’
‘সিওর তো?ওপরে গিয়ে অসুস্থ হলেও কোলে করে নামাতে পারবো না কিন্তু।’
‘আপনার কোলে চড়ার জন্য আমি কাঁদছি।’

অবশেষে ওরা টিলার চূড়ায় উঠলো। একেবারে ওপরে বৃহৎ একখন্ড পাথর। ওখানে দাঁড়িয়ে নীচের দৃশ্যটা চোখ জুড়ানোর মতো।গনেশ্বরীর U আকৃতির বাকের মাঝে সবুজ বসতি। গাছের ছায়ায় জলের রং সবুজ। এখানে ড্রোন ওড়ানো নিষেধ, তবে ছবি তোলাই যায়।দূরে মেঘালয়ের ওপরে সূর্যের কমলা আভা ছড়িয়ে পড়েছে। ওরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল ‌।

সূর্য ডোবার আগেই ওরা নেমে এলো। উঠতে কষ্ট হলেও, নামতে বেশ ভালোই লাগলো। কলমাকান্দা শেষ সৌন্দর্যটি দেখা শেষে সারাহ মনে করিয়ে দিলো এখনও মন্দিরটা দেখা বাকি।
অগত্যা ওরা গেল হাজংদের শ্রী হরি ও কামাখ্যা মন্দির।মন্দিরটি টিলার ওপরে,যেখানে ওঠার জন্য অনেকগুলো সিড়ি উঠে গেছে।সারাহ বললো,
‘আরেব্বাস, শাহরুখ দীপিকাকে কোলে নিয়ে এরকম একটা মন্দিরের সিড়ি বেয়ে নেমেছিল।’
একপাশে ছোট আকৃতির কামাখ্যা আর বড়টি শ্রী হরি মন্দির। টিলার নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে লেংগুরার সৌন্দর্য গনেশ্বরী।

অনিক সরফরাজ মন্দিরের গেটের কাছে চলে গিয়েছিল।সারাহ কোয়েলিয়াকে বললো,
‘ভাবী তুমি এখানে একটু বসো।আমি আসছি।’
নিচে এসে অনিককে বললো,
‘ভাবী পায়ে ব্যাথা পেয়েছে। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। তুমি একটু নিয়ে আসো না।’
‘তোর আনতে কি হয়েছিল?’
‘তুমি থাকতে শুধু শুধু আমি কেন এনার্জি নষ্ট করবো। এখন যাও তো।’
অনিক দ্রুতপায়ে সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করলো। গিয়ে দেখলো, কোয়েলিয়া সিঁড়ির ধাপে বসে আছে।অনিক ওর হাত ধরে বললো,
‘আস্তে আস্তে আসুন।’
ম্লান সন্ধ্যায় দুজনের এতো সুন্দর মূহুর্তে টাকে সারাহ ক্যামেরাবন্দি করতে ভুললো না। অনিক যখন ওর দিকে তাকালো,সারাহ চোখ টিপে বলল,
‘তোমাদের দুজনকে কিন্তু দারুণ দেখাচ্ছে।তাই না গৌরাঙ্গদা?’

চলবে…
®️ সুমি খানম