যতনে রাখিবো পর্ব-৩৩+৩৪

0
228

#যতনে_রাখিবো

৩৩
তাথৈয়ের সাথে থাকার জন্য হাফসা এসেছে। অভয় বাইরে কোথাও শুটিং করতে গেলে তাথৈ আপুদের বাসায় চলে যেত। কিন্তু এবার বান্ধবীকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। হাফসা আসার পর থেকে হাত-পা ছড়িয়ে বসে তাথৈকে এটা সেটা অর্ডার দিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে তাথৈ বিরক্ত হয়ে বলল,

-তোকে আমায় পাহারা দিতে এনেছি নাকি তোর সেবাযত্ন করতে!

দুইটা ডাবল বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই শেষ করে এখন কোকে চুমুক দিতে দিতে হাফসা বলল,

-সেবাযত্ন কই করছিস? হাত-পা তো টিপে দিচ্ছিস না।

তাথৈ রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,

-গলা টিপে দেই?

হাফসা কোকটাও শেষ করে শব্দ করে ঢেঁকুর তুলে বলল,

-না থাক। একদিনে এত ভালোবাসা হজম হবে না।

দুইটা প্রাণী ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। দু’জন পুরোটা দুপুর হরর মুভি দেখে কাটাল। কারণ দিন ছাড়া রাতের বেলা ভূতের মুভি দেখার সাহস কারো নেই। বিকেলে কী মনে করে দু’জনই শাড়ি পরলো। সুন্দর করে সেজেগুজে ছবি তুলতে ছাদে চলে এলো। ক্যামেরাম্যান হিসেবে তাথৈ বরাবরই ফার্স্ট ক্লাস। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বান্ধবী গুলোও কোথাও ঘুরতে গেলে তাকে একপ্রকার চ্যাং-দোলা করে সাথে নিয়ে যেত। হাফসার পোজের কোন শেষ নেই। একটার পর একটা পোজ দিয়েই যাচ্ছে।

-তোর ছবি দিয়ে গ্যালারি ভরে গেল। আর কত তুলবি? এবার আমারটা তোল।

-না না দোস্ত, এই পোজে একটা তোল না প্লিজ। বেশি না আমার আর কয়টা পিক তুলে দে। তারপরই তোকেও তুলে দেব।

তাথৈ হাফসার যে ছবিগুলো তুলে তা সবই সুন্দর হয়েছে। কিন্তু হাফসা তাথৈয়ের যে ছবিগুলো তুলে দিয়েছে তাতে একটায় চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যটায় মুখ বাঁকা। মানে পঞ্চাশটা থেকে পাঁচটা ছবিও ফোনে রাখার মতো না। ছবি তুলতে তুলতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সন্ধ্যার পরে বাইরে বেরোনোর প্ল্যান করেও বাতিল করে দিয়েছে।

-রাতে কী খাবি বল। তোকে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াবো।

হাফসা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-শহরে এত দামী দামী রেস্টুরেন্ট থাকতে আমি তোর হাতের বিস্বাদ রান্না কেন খাবো? কাচ্চি অর্ডার কর। সাথে চায়নিজ থাকলেও খারাপ হবে না।

তাথৈ মনে মনে ভাবে, এমন হারামি বান্ধবী একটাই যথেষ্ট। কোন জিনিসে উৎসাহ তো দিবেই না। তার উপর আবার নিন্দা করতে ভুলবে না।

ঘুমাতে যাবার জন্য বিছানায় শুয়ে হাফসা প্রশ্ন করল,

-তোর জামাই কি সারাদিনে তোকে একবারও কল করেনি?

তাথৈ ফোন দেখেনি। তবে কল করলে রিং হতো নিশ্চয়। তাই বলল,

-না মনে হয়।

-এটা কেমন কথা দোস্ত!

-উনি মনে হয় শুটিংয়ে ব্যস্ত।

তার বান্ধবী বোকা হলেও সে বোকা না। কী এমন ব্যস্ততা যে একটা ফোনকল করারও সময় পায় না।

-ব্যক্তিগত একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। তোদের মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে তো?

-আরে কী মুশকিল! ঠিকঠাক থাকবে না কেন? এই লোক এমনই। তুই প্রথম দেখছিস তো তাই অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু আমার কাছে এখন স্বাভাবিকই লাগে।

-তারপরও বান্ধবী পুরুষ মানুষ বউ পাগল না হলে চলে না। দোষ তোরই। তুই এখনও ওই বেটাকে লাইনে নিয়ে আসতে পারিসনি। জামাই হবে এমন, বউয়ের কথায় উঠবে বসবে।

-তোর কথায় উঠবস করার জন্য তুই একটা রোবট কিনে আনিস। কারণ কোন মানুষই কারো কথায় পুরোপুরি চলাফেরা করে না। সবারই একটা নিজস্ব স্পেস থাকা দরকার।

-স্পেস দিতে দিতে জামাই অন্য বেডির কাছে চলে যাবে তখন বলতে আসিস শুধু।

-তুই ঘুমা তো। আমাকে স্বামী সংসারের জ্ঞান দিচ্ছে অথচ নিজেই এখনও অবিবাহিত।

হাফসাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেও ওর বলা কথাগুলো তাথৈকে ভাবাচ্ছে। সত্যিই কি অভয় এতটাই ব্যস্ত। অভয় কল করেছে কি-না চেক করার জন্য ফোন হাতে নিলে হাফসা বলল,

-এখন আবার ফোন হাতে নিচ্ছিস কেন? আলো থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না।

-নাকে মুখে চাদর টেনে দিয়ে ঘুমা।

ফোন হাতে নিয়ে তাথৈয়ের নিজের গালেই চড় দিতে ইচ্ছে করল। অভয় ঠিকই অনেক বার কল করেছে। কিন্তু তার ফোন সাইলেন্ট হয়ে ছিল বলে শুনেনি। তাথৈ তো ফোন সাইলেন্ট করেনি। তাহলে নিশ্চয় ভুলবশত হাতে চাপ লেগে কখন হয়ে গেছে। হাফসা মাথা ঢেকে শুয়ে ছিল। তাথৈ ওকে ঠেলতে ঠেলতে বলল,

-দেখ ফকিন্নি। খুব তো ভাষণ দিচ্ছিলি।

হাফসা সজোরে চাদর সরিয়ে খেঁকিয়ে উঠে বলল,

-ঘুমাতে দিবি না? কী দেখাবি শুনি?

-তোর মাথা দেখাবো। তুই না বলেছিলি আমার বেডা অন্য বেডির কাছে চলে যাবে। দেখ কতবার কল দিয়েছে।

হাফসা মুখ ভেঙাল। তাথৈ আর সময় নষ্ট না করে সাথে সাথে অভয়কে কল ব্যাক করলেও এবার অভয়কে পাওয়া গেল না। নিজের উপর রাগ করে তাথৈ বলল,

-তোকে সকাল বিকেল দুই বেলা থাবড়ানো দরকার। তাহলেই যদি তুই মানুষ হোস।

হাফসা চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করল,

-কাকে থাবড়াবি?

-নিজেকেই।

-আহারে বেচারি! জামাইয়ের ভালোবাসায় আর কয়দিন পর পাগলই না হয়ে যাস।

——

রাত তখন কয়টা হবে? কে জানে। ঘড়ি দেখলে জানা যেত। দুই বান্ধবীই একে অপরের উপর হাত-পা তুলে দিয়ে গভীর ঘুমে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাবার চেয়ে বিরক্তিকর অনুভূতি হয়তো পৃথিবীতে আর নেই। ফোনের রিংটোনে হাফসার ঘুম ভেঙে গেলে সে তাথৈকেও শান্তিতে ঘুমাতে দিলো না।

-এই হারামি ওঠ। জামাই ওয়ালা বেডি। তোর বেডার কল করার মাঝরাতে সময় হয়েছে? সারাদিন কী চুরি করেছে?

তাথৈও ভেবেছিল অভয়ই হয়তো কল করেছে। কিন্তু ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনের নম্বরটা চিনতে পারল না। তারপরও রিসিভ করে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,

-হ্যালো কে?

-তোমার ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনে হার্টবিট মিস করে ফেললাম।

তাথৈ কপাল কোঁচকাল। এটা অভয় হতেই পারে না। ওই লোক এসব সস্তা ডায়লগ ছাড়বে না। হাফসা বিরক্তি নিয়ে বলল,

-কে রে?

-জানি না।

ঘুম নষ্ট করে রং নাম্বারে কথা বলার মতো ধৈর্য তাথৈয়ের নেই। তাই সে কল কেটে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু ওই নাছোড়বান্দা কিছুতেই থেমে থাকল না। শেষে তাথৈ রেগে গিয়ে ছেলেটাকে আজ জন্মের শিক্ষা দিবে ভেবে নিলো।

-কেরে তুই কুত্তা? কেন ডিস্টার্ব করছিস? তোকে কতবার বলেছি আমি বিবাহিতা মহিলা। নায়কের মতো সুন্দর একটা জামাই আছে আমার। নায়কের মতো কেন, আমার জামাই তো নায়কই। আমার নায়ক জামাই রেখে তোর সাথে কথা বলতে যাব কোন দুঃখে? কল রাখ।

ছেলেটা যেন বিদ্রূপ করে হাসল। খসখসে গলায় বলল,

-ও তাই বুঝি? তোমার জামাই নায়ক? সালমান খান নাকি শাহরুখ খান?

-ওই বেডা ওই, আমার জামাই সালমান খান শাহরুখ খান হতে যাবে কেন? আমার জামাই অভয় খান।

-অভয় খান তোমার জামাই? মজা পেলাম। হা হা।

-শালা! দাঁত ভেঙে দিব তোর। হাসছিস কেন হারামজাদা?

-অভয় খান তো লুচ্চা নায়ক। কত মেয়েদের সাথে ওর ডলাডলি।

-আমার জামাইয়ের নখের যোগ্য হতে পারবি তুই? আমার জামাই লুচ্চা। শত মেয়ের সাথে ডলাডলি করে এতে আমার সমস্যা না থাকলে তোর এত সমস্যা কি? তুই কি ওই টাইপের ছেলে নাকি? ফোন রাখ শালা। নইলে তোর ওইটা কেটে সত্যি সত্যিই কিন্তু ওই টাইপ ছেলে বানিয়ে দেব।

তাথৈ আরও অনেককিছু বলে ফেলত। কিন্তু তার আগেই কটকট শব্দ করে কল কেটে গেছে। রাতদুপুরে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। তার জামাই নিয়ে দুনিয়ার মানুষের এত মাথা ব্যথা কেন? তাথৈ পুরোটা রাত আর ঘুমোতে পারল না। রাগে মাথা দপদপ করেছে। ফোন হাতে নিয়ে বার কয়েক অভয়ের নাম্বারে কল করতে গিয়েও কেটে দিয়েছে। না থাক। মানুষটা হয়তো ঘুমোচ্ছে। সকালে শুটিং আছে। উনার আবার টাইম বাঁধা জীবন। দিনের বেলাও একটু ঘুমানোর সময় পায় না। তাই রাতে বিরক্ত করল না। কিন্তু আর থাকতে না পেরে ভোরের দিকে কল করে বসল। ওপাশ থেকে অভয়ের ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনতে পেয়ে মনটা শান্ত হলো।

-হ্যালো তাথৈ।

-হুম।

-কিছু বলবে?

তাথৈ ভেবে পেল না কী বলার আছে তার। হুদাই কল দিয়ে বসে আছে। এখন কী কথা বলবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। তাথৈ কিছু বলছে না দেখে অভয় নিজেই বলল,

-রাতে ভালো ঘুম হয়নি, না?

-হুম।

-কেন?

-এমনি।

-কোন বিষয় নিয়ে ডিস্টার্বড আছো?

-কই না তো।

-একা থাকতে ভয় পাচ্ছ?

-না। হাফসা আছে আমার সাথে।

-শুটিং প্রায় শেষের দিকে। শীঘ্রি ফিরে আসব।

-হুম।

-আমাকে মিস করেছ?

-হুম।
হুম বলে ফেলে তাথৈ প্রশ্নটা খেয়াল করল। সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠল,

-না।

অভয় শব্দহীন হাসল।

-হুম না! তার মানে একটু একটু মিস করেছ।

-রাখি এখন। আপনি ঘুমান।

-ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে এখন ঘুমাতে বলছো?

-বুঝতে পারিনি আপনি এখনও ঘুমোচ্ছেন।

-বুঝতে যখন পারোই নি। তাহলে আরেকটু কথা বলো।

-হু?
তাথৈ হু বলে প্রশ্ন করলেও অভয় ভেবে নিল সে কথা বলতে হ্যাঁ বলেছে। তাথৈয়ের স্বভাব তোতাপাখির মতো কথা বলে যাওয়া। চুপ থাকার মেয়ে না সে। তবুও আজকাল কথা হারিয়ে ফেলছে। বিশেষ করে এই একটা মানুষের সামনে কথাই খুঁজে পায় না।

-তুমি কখনো কক্সবাজার এসেছ?

-কখনও ঢাকার বাইরে গিয়েছি কিনা ওটা আগে জিজ্ঞেস করুন।

-কক্সবাজার যাওনি?

-না।

-তোমার সমুদ্র ভালো লাগে?

-পাহাড় বেশি ভালো লাগে।

-মুভির জন্য আমাকে অনেক দেশে গিয়ে শুটিং করতে হয়। পাহাড়, সমুদ্র। কিন্তু আমার সবচেয়ে বেশি কোথায় ভালো লাগে জানো? আমার নিজের বাড়িতে। পারলে আমি সারাবছর রুমেই বসে থাকি।

-আপনি নায়ক। আমি তো আর নায়িকা না। এত এত জায়গায় যেতে পারছেন বলে ভালো লাগে না। আমার মতো নিজের দেশেই কোথাও যেতে না পারতেন। তখন বুঝতেন আপনার এই জীবন কত সুখের।

-তুমি নায়িকা না। কিন্তু নায়কের বউ তো। তুমি তোমার সবগুলো পছন্দের জায়গা আমার সাথে ঘুরে দেখবে। আমি এবার ফিরে এসেই তোমার ড্রিম কান্ট্রি বা প্লেসে নিয়ে যাব। এখন থেকে তোমার সব স্বপ্ন আমার সাথে পূরণ হবে।

চলবে
Jerin Akter ণিপা

#যতনে_রাখিবো

৩৪
আজকের দিনটাই এখানে লাস্ট শুটিং ছিল। বাকি ঢাকায় ফিরে গিয়ে শ্যুট করা হবে। শট শেষ করে হোটেলে ফিরে আসার সময় পেছন থেকে লোপার ডাক শোনা গেল। অভয় লোপাকে এভয়েড না করলেও ওর সাথে ভালো সম্পর্কও রাখতে চাচ্ছে না। কাজের সূত্রে যেটুকু কথা বলা লাগে সেটুকুই বলে।

-অভয়, দাঁড়াও। হোটেলে ফিরছো?

-হুম।

-রাতে কোন প্ল্যান আছে? না মানে আজ লাস্ট শ্যুট ছিল। আসার পর থেকে ঘোরাঘুরির তেমন সময় পাইনি। রাতে বিচে আসবে?

-আমি ভীষণ টায়ার্ড লোপা। রুমে গিয়ে রেস্ট নেবো।

একথা বলে অভয় চলে যাওয়া ধরলে লোপা মুখ বাঁকাল। সে-ও পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বলল,

-ঠিক আছে। তাহলে কাল সকালে দু’জন একসাথে ফ্লাইট ধরবো।

অভয় হু না কিছুই বলল না। লোপা কিছুটা অভিমানী গলায় বলল,

-এখনও তুমি পুরোনো কথা মনে রেখে বসে আছো? আমি তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। তোমাকে স্যরিও বলেছি। আর কতবার স্যরি বললে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে বলো তো।

-স্যরি বলতে হবে না। আমি কিছু মনে রাখিনি।

-তুমি সত্যিই আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ তো?

-হ্যাঁ।

-কীভাবে বুঝবো আমি? প্রমাণ দাও।

অভয় শান্ত চোখে লোপার দিকে তাকালে লোপা হেসে বলল,

-আরে ভয় পেয়ো না। তোমাকে তেমন কিছুই করতে বলবো না। শুধু ঢাকা ফিরে কাল আমার জন্মদিনের পার্টিতে আসতে হবে। তুমি একা না। তাথৈকেও নিয়ে এসো। তোমরা দু’জন এলে আমি বুঝে নেবো সত্যিই তুমি পুরোনো কোন কথা মনে রাখোনি। আসবে তো?

-দেখি।

-কোন দেখাদেখি নেই। তোমাকে আর তাথৈকে আসতেই হবে। তোমরা না আসা পর্যন্ত কিন্তু আমি কেক কাটবো না।

——
তাথৈ ভাত পানি ছেড়ে দিয়ে শুধু আচারই খেয়ে যাচ্ছে। অভয় তার জন্য কার্টুন ভর্তি আচার এনেছে। সে জীবনে কক্সবাজার যায়নি। বান্ধবীরা কেউ গেলে একটা কথাই বলে দিত, আমার জন্য আচার নিয়ে আসিস। অভয়কে বলতে হয়নি। মানুষটা তার না বলা সব কথা কীভাবে কীভাবে যেন জেনে যায়।
অভয়ের ফোন রিং হচ্ছে। লোকটা রুমে নেই। একবার দু’বার রিং হয়ে কেটে গেলেও তাথৈ ধ্যান দিত না। কিন্তু বারবার রিং হতে থাকলে তাথৈ বিরক্ত হলো। কে এমন অধৈর্য মানুষ!
স্বামীর মোবাইল সে ধরতেই পারে। এতে অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু স্বামীর ফোনে তার এক্সের কল আসা নিশ্চয় অনেক বড় অন্যায়। চোখমুখ কুঁচকে তাথৈ ভাবছে,

-এক্স কালনাগিনীটা কেন কল করছে? কক্সবাজার গিয়ে নতুন করে ভাব জমেছে নাকি?

অভয়ের আসার শব্দ পেয়ে তাথৈ জলদি জলদি ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কিছুটা সময় ওয়াশরুমে পায়চারি করে সময় কাটিয়ে বেরিয়ে এলো। রুমে এসে দেখল অভয় কার সাথে কথা বলছে। মনে মনে জ্বলে গেল তাথৈ। কান খাড়া করে অভয়ের কথা শোনার চেষ্টা করছে।

-আ’ম স্যরি লোপা, আমরা তোমার পার্টিতে আসতে পারবো না। আসলে আজ তাথৈয়ের বাসায় একটা ফাংশন আছে।

ভ্রু কুঁচকে তাথৈ ভাবছে তাদের বাড়িতে আজকে আবার কিসের ফাংশন! মিথ্যা বলছে কেন লোকটা?

-তুমি কেক না কাটলেও আমার আসলে কিছু করার নেই। ফ্যামিলি প্রোগ্রাম রেখে পার্টিতে যাওয়া পসিবল না।

যাক কালনাগিনী তাহলে তার জামাইকে বশ করতে পারেনি। পার্টিতে না যাওয়ার জন্য কত সুন্দর করে বানিয়ে মিথ্যা বলছে।
লোপা তবুও মানতে নারাজ। সে এখন তাথৈয়ের সাথে কথা বলার জেদ করছে। অভয় বাহানা দিলেও কাজ হলো না। তাথৈয়ের দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে অভয় ইশারায় বলছে,

-না করে দাও। বলো তোমাদের বাসায় যেতে হবে।

লোপার সাথে কথা বলে তাথৈয়ের মনটা একটু নরম হয়ে এলো। আহা বেচারি কত করে রিকোয়েস্ট করছে। তাথৈ রাজি হয়ে গেল। বলল,

-ঠিক আছে আমরা আসবো। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। কেক কাটা শেষ হলেই চলে আসবো।

অভয় ভেবেছিল তাথৈ মানা করবে। কিন্তু এই মেয়ে তো আরও রাজি হয়ে বসে আছে। কল কেটে দিলে অভয় বলল,

-কেন যাবে বললে?

তাথৈ বিছানায় বসে অর্ধেক খাওয়া আচার হাতে নিয়ে দায়সারা ভাবে বলল,

-আপনার এক্স এত করে বলছিল, মুখের উপর না করতে পারিনি।

-লোপা আমার এক্স না।

-ভালো বন্ধু?

-সেটাও না।

-তাহলে কী? না থাক বলতে হবে না। উনার সাথে আপনার কী সম্পর্ক তা জেনে আমার কাজ কী?

কথাগুলো বলার সময় তাথৈ জোর কামড়ে হাসি চাপছে। অভয় স্থির দৃষ্টিতে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মধ্যে এখনও কি কোনকিছু ক্লিয়ার হওয়া বাকি? বাড়িতে পৌঁছেই অভয় একটা সারপ্রাইজ পেয়েছে। তাথৈ বেডরুম, হলরুমে তাদের বিয়ের ছবি সহ আরও অন্যান্য ছবি টানিয়ে রেখেছে। একেকটা ছবির সাইজ বিশাল। তাথৈয়ের এই সারপ্রাইজ অভয়ের পছন্দ হয়েছে। এখন এই বাসাটাকে তাদের দু’জনের ছোট্ট একটা সংসার মনে হবে।

—–
পার্টিতে যাওয়ার জন্য ওরা সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে পড়েছে। দু’জন পাশাপাশি বসে আছে। অভয়ের দৃষ্টি এক বারের জন্যও তাথৈয়ের উপর থেকে সরছে না। তাথৈও সেটা লক্ষ্য করেছে। তারপরও কিছু বলেনি।
দু’জন মানুষ একেবারে চুপচাপ। তারপরও যেন একজন আরেক জনের বলতে না পারা কথাটা বুঝে নিচ্ছে। দু’জনের মনের অবস্থাই সেইম। কেউ কাউকে বলতে পারছে না এটাই যা প্রবলেম। তাথৈ অন্য দিকে ফিরে ভাবছে,

-স্কুল কলেজে সবসময় ফার্স্ট এসেছিস। এবার কেন তাহলে সেকেন্ড হওয়ার জন্য বসে আছিস? উনি বলার আগেই তোকে বলতে হবে।

তার হাতের উপর অভয়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে তাথৈয়ের ভাবনা হোঁচট খেলো। হঠাৎ আজানা কারণে একঝাঁক লজ্জা এসে তার মধ্যে বাসা বেঁধেছে। কিছুতেই মানুষটার দিকে তাকাতে পারছে না। অভয় এটা ভেবে সময় নষ্ট করছিল তাথৈ কী ভাববে? তাথৈকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে চায় না বলেই এতক্ষণ সময় লাগিয়েছে। তবে এখন তার সাহস অনেকটাই বেড়ে গেছে। কারণ তাথৈ তাকে ফিরিয়ে দেয়নি। অভয় তাথৈয়ের হাত পুরোটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে এলো। পরিবেশ সহজ করতে গলা খাঁকারি দিয়ে ড্রাইভারকে গান ছাড়তে বলল। লোকটার কাণ্ডকারখানা দেখে তাথৈয়ের হাসি পাচ্ছে। পুরুষ মানুষ এত ভীতু হবে কেন? হাতটা ধরতেই এত সময় লাগিয়েছে। সে যে কথাটা শুনতে চাচ্ছে তা বলতে এই জীবন লাগিয়ে না দিলেই হলো।

—–

গাড়ি থেকে নামার সময় তাথৈয়ের পা বেকায়দায় পড়ে প্রচন্ড ব্যথা পেলো। অভয়ের হাত ধরা ছিল বিধায় নিচে পড়ে যায়নি। ব্যথায় বেচারির মুখ নীল হয়ে গেছে। অভয় তাৎক্ষণাৎ তাথৈয়ের পায়ের কাছে বসে পড়ল। আজও তাথৈ হিল পরেছে দেখে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলো। অভয় তাথৈয়ের পায়ে হাত দিলে সাথে সাথে তাথৈ চেঁচিয়ে উঠল।

-আরে আরে কী করছেন? পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?

-কতটুকু ব্যথা পেয়েছ দেখতে হবে না?

অভয় তাথৈকে গাড়ির সিটে বসিয়ে দিয়ে পা বাইরের দিকে ঝুলিয়ে রাখল। এক হাঁটু গেড়ে নিচে বসে তাথৈয়ের পা থেকে জুতা খুলে দিল। তাথৈ বিস্ময় নিয়ে মানুষটাকে দেখছে। অভয় পা টিপে টিপে পরীক্ষা করছে কোথায় ব্যথা পেয়েছে।

-বেশি ব্যথা করছে?

অভয়কে দেখতে দেখতে তাথৈ সব ব্যথা ভুলে গেল। এই লোক সামনে থাকলে তার পা কেটে ফেললেও বুঝতে পারবে না।

-ডক্টর দেখানো প্রয়োজন। চলো।

-কোথায়? পার্টিতে যাবেন না?

তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে অভয় বলল,

-তুমি এখনও পার্টিতে যেতে চাও!

-না গেলে আপনার এক্স কেক কাটবে না।

এমন একটা সময়েও তাথৈ মজা করছে দেখে অভয়ের রাগ হলো। এই মেয়ে নিজেকে নিয়ে এত উদাসীন কেন?

-আমার পা তো ভেঙে যায়নি। ঠিকঠাক হাঁটতে পারবো। আপনি এত টেনশন করবেন না তো।

-তোমার জন্য আমার টেনশন না করাই উচিত। তবুও কেন যে টেনশন না করে থাকতে পারি না।

অভয় কি রাগ থেকে এসব বলছে? তাথৈ মুখ টিপে হাসল। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে অভয় বাধা দিল।

-কী হলো?

অভয় তাথৈয়ের আরেক পায়েরও জুতা খুলে দিয়ে বলল,

-আজকের পর তুমি কোনদিন হিল পরবে না।

-হিল না পরলে আপনার হাইটের সাথে ম্যাচ করবো কীভাবে?

-তুমি যেমন আছো তেমনই আমার জন্য পারফেক্ট। তোমাকে আমার হাইটের সাথে ম্যাচ করার জন্য হিল পরে পা ভাঙতে হবে না।

তাথৈ মনে মনে খুশিতে আকাশে উড়লেও মুখে বলল,

-আমি কি তাহলে খালি পায়ে ভেতরে যাবো? মানুষ বলবে না সুপারস্টার তার বউকে জুতা কিনে দিতে পারে না! ছি কী কৃপণ।

তাথৈয়ের কথার মাঝখানেই ওকে হতভম্ব করে দিয়ে অভয় তাথৈকে কোলে তুলে নিলো। তাথৈ চোখ বড়ো বড়ো করে অভয়কে দেখছে। অভয় ভেতরের দিকে হাঁটা ধরে বলল,

-এভাবে গেলে নিশ্চয় মানুষ তোমার স্বামীকে কৃপণ বলবে না।

তাথৈ অভয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,

-এভাবে গেলে কে কী বলবে জানি না। কিন্তু ব্রেকিং নিউজ যে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

চলবে
Jerin Akter Nipa