#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: সাতাইশ|
” তোমার বাবার নাম, আসাদুজ্জামান। তোমার দাদীর আগের ঘরের সন্তান ছিলো সে। তোমার দাদীর পূর্বের বিয়ের ব্যাপারে মোল্লা বাড়ির কেউ জানতো না। ফিরোজের বয়স যখন তেরো বছর আর কায়েসের এগারো হয় তখন আসাদকে নাজিম ভাই এই বাড়িতে নিয়ে আসেন। আসাদের কথা তোমার দাদীর থেকেই জানতে পান। সেদিনের ঘটনা নাজিম ভাই আমাকে চিঠিতে লিখেছিল। আসাদকে মোল্লা বাড়িতে আনায় সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিল তোমার দাদী। তিনি মোল্লা বাড়ির কাউকে তার অতীত সম্পর্কে জানাতে চায়নি। আসাদকে নিয়ে আসার পর মোল্লা বাড়ির কারো উপর তেমনভাবে প্রভাব না পড়লেও ফিরোজ ও কায়েসের উপর প্রভাব ফেলে। তোমার দাদীর থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে তাদের চলাফেরা আচার ব্যবহারেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। নাজিম ভাইয়ের অগোচরে মেয়েদের নেশায় জড়িয়ে যায় দুইজনই। নাজিম ভাইয়ের কানে আসতে আসতে তারা পাপ কাজের অতলে ডুবে যায়। তোমার দাদী দুই ছেলের শোকে দুনিয়া ছাড়েন। এদিকে তোমার বাবা আসাদকে কাজ কর্ম বুঝিয়ে দিতে শুরু করে। বিয়েও করায় আমার পছন্দ করা পাত্রীর সাথে। রুনা আমার দূর সম্পর্কের আত্নীয়ের ভাগ্নী। মা বাবা কেউ ছিল না। আসাদ ও রুনার সংসার ভালোই চলছিল এরমধ্যে সংবাদ পাই রুনা মা হবে। রুনার গর্ভমাস তখন পাঁচ মাস চলে, একদিন বাজার থেকে সংবাদ আসে আসাদ মা’রা গেছে। তখন এতো তদন্ত কে করতে যায়! আসাদের জানাজা হয়ে যায়। তিনমাস পর নাজিম ভাই স্বার্থপরের মতো কায়েসের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়।”
নাজমা বেগম এতটুকু বলে থামেন। চোখ থেকে চশমা খুলে আঁচলে মুছে নেন। রুনা মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে। অতীতের ব্যাপারে সে কখনোই অন্তিককে জানাতে চায়নি কিন্তু পরিস্থিতির চাপে আজ অন্তিককে জানাতে হচ্ছে।
” মা পূন্যালয়ে কীভাবে পৌঁছেছে?”
নাজমা বেগম উত্তর দেন, ” পূন্যালয়ের জমি আসাদের ছিল। রুনা সেই রাতে বিধ্বস্ত অবস্থায় আমার দুয়ারে এসে দাঁড়ায়। আমি পরদিনই নাজিম ভাইকে চিঠি লেখি। বারোদিন পর নাজিমভাই এই জমির উপর পূন্যালয় তৈরী করা শুরু করেন। রুনাকে স্থান দেন সেখানেই।”
মর্মযন্ত্রণায় আক্রান্ত মোল্লা বাড়ির প্রতিটি সদস্য। এতো বছরের লুকায়িত রহস্য উন্মোচনে কেউ কারো চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। বাড়ির বড়োদের পাপের বোঝা বাচ্চাদের উপর ঝুঁকছে। অন্তিক সকলের দিকে নজর ঘুরিয়ে বলতে শুরু করে, ” আমাদের পিতা-মাতা যেমনই হোক, যাই করুক না কেন; আমরা ভাইবোন একসাথে থাকবো। আমি আজ সকলের সামনে কথা দিচ্ছি, এই বাড়িতে ফুল ছাড়া আর কিছুই ফুটতে দিব না। শত্রুর সামনে পরিবারের জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়াবো।”
পিয়াসের নতজানু দৃষ্টি তুলে অন্তিকের দিকে তাকায়। এতক্ষণ অপরাধবোধ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।অন্তিকের কথায় জড়িয়ে ধরে পিয়াস। আস্থার সুরে বলে, ” আমিও পরিবারকে আগলে রাখব ভাই!”
মিষ্টি এতক্ষণে মুখ খুলে। তার মনে ভীষণ কৌতূহল। এখন তার অনেক কথাই অজানা। অন্তিকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,
” কিন্তু তুমি কীভাবে জানতে পারলে, বাবা মনি মাকে অপহরণ করেছে? মানে, বাবার এরূপ দেখে তো বুঝার উপায় নেই যে বাবার মনে দুষ্ট চিন্তা ভাবনা ছিল। আর বাবারই বা কী হয়েছে? কোথায় তিনি?”
” ঐ লোকটাকে বাবা ডাকবে না, মিষ্টি?”
মিষ্টি নির্বাক, অন্তিক তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলছে! সে তো না জেনে প্রশ্ন করেছে তার জন্য এই ব্যবহার! মিষ্টি কথা বলার প্রস্তুতি নিতেই অন্তিক পুনরায় ধমকে দেয়। চিৎকারের সুরে বলে, ” ঐ লোক বাবা হওয়ার যোগ্য নয়, মিষ্টি। প্রশ্ন করছো আমি কীভাবে জানতে পেরেছি তাই না! বলছি, রেস্টুরেন্টের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। মাকে অজ্ঞান অবস্থায় ঐ লোকই গাড়িতে উঠায়, ড্রাইভার জানো কে ছিল? ফিরোজ চাচা। এরপর ফিরোজ চাচার ফোন ট্রেস করে জায়গার সন্ধান পাই। চাচী ঐ লোকটাকে খু’ন করেছে। ফিরোজ চাচার দলের লোকেরাই এই সংবাদ আমাদের জানায়। আর কিছু জানতে চাওয়ার বাকী আছে? ”
মিষ্টি মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তার আর কিছু জানার নেই। অন্তিক নিজের ভুল বুঝতে পারে, মিষ্টিকে তার এভাবে বলা ঠিক হয়নি। রুনা বিষয়টি বুঝতে পেরে অন্তিকের কাঁধে হাত রেখে বলে, ” ভুলে যাবি না, তোকে এই অন্তিক রূপে ফিরে আনতে মিষ্টির অবদান বেশি। মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়া কী ঠিক হয়েছে, তাও এই অবস্থায়!”
অন্তিক নিশ্চুপ, বাকশক্তি হারিয়েছে যেন। রুনা গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলতে শুরু করে, ” আমি খালার সাথে পূন্যালয়ে ফিরে যাচ্ছি। এই শহর আমার না। এই শহর দেখলেই আমার অতীতের স্মৃতি স্বরণ হবে। তারচেয়ে বরং আপন নীড়েই ফিরে যাই!”
মায়ের হাত ধরে অন্তিক শান্ত হয়ে বসে। আশ্বাসের বুলিতে বলে, ” সে আমার প্রাণ, মা! তাকে কষ্ট দিলে দ্বিগুণ কষ্ট আমার বুকের বাম পাশটায় হয়!”
” তবে কষ্ট দিলি কেন?”
” রাগ সামলাতে পারিনি, আর এমন হবে না। ”
” মিষ্টির কাছে যা, এই অবস্থায় মেয়েটাকে একা রাখিস না।”
অন্তিক মাকে আশ্বস্ত করে ঘর থেকে বের হয়ে আসে।
—————————
বিছানায় বসে আয়েশের সাথে আচার খাচ্ছে মিষ্টি। অন্তিক ঘরে প্রবেশ করে মিষ্টির স্বাভাবিকতা দেখে থতমত খেয়ে যায়। এই মেয়েটাকে তার পূর্ব থেকেই জানা আছে। নিশ্চয়ই খেয়ে দেয়ে তার সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দিবে! কিন্তু এমন কিছুই হলো না, মিষ্টি আচারের পর্ব শেষ করে অন্তিকের গলা জড়িয়ে ধরে। অন্তিকের ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁট আলতো ছুঁয়ে বলে, ” আদর পেতে ইচ্ছে করছে!”
বউরের নেশাকারী কথায় অন্তিকও বিমোহিত হয়ে যায়। মিষ্টির কোমর চেপে বলে,” এই অবস্থায় এত আদর পাওয়া কী ঠিক হবে?”
” কিন্তু আমার যে চাই-ই আদর!”
অন্তিক ঘামছে। বিশেষ মুহূর্তে এসে গলার স্বর আঁটকে আসছে। নেশায় বুদ হয়ে যাওয়া মাতালদের মতো বলে,”এখনই!”
” হুম!”
মিষ্টির ঠোঁটের সাথে অন্তিকের ঠোঁট ছুঁই ছুঁই এমন সময় মিষ্টি অন্তিকের ঠোঁটে হাত চেপে ধরে। অন্তিক ছটফটে পাখির ন্যায় বলা ওঠে, ” থামালে কেন? আদর না চাইছিলে?”
মিষ্টি এবার স্বাভাবিক সুরে উত্তর দেয়, ” আমি তো আচারের কথা বলছিলাম। আদর বরই আচার, শুনেছি ভীষণ টেস্ট। আমার আর বাবুর খুব খেতে ইচ্ছে করছে!”
ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি– অন্তিকের অবস্থাও তাই। আচারের কথা এভাবেও বলতে হয়! অন্তিক অসহায় দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকায়। মিষ্টির মিটিমিটি হাসি দেখে বুঝাই যাচ্ছে অন্তিকের জীবন আজ থেকে তেজপাতা হওয়া শুরু! একটু ধমকের জন্য তার বউ তাকে রাস্তায় এক টুকরো ত্যানা পরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতে দ্বিতীয়বার ভাববে না!
দুই বছর পর,
ফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙে মিষ্টির। দেয়াল ঘড়িতে জানান দিচ্ছে এখন মধ্যরাত। এই সময়ে তার সতীন ছাড়া আর কেউ কল করবে না৷ সে আর জানে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কল রিসিভ করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত ফোন বাজতেই থাকবে। অগত্যা ঘুমঘুম কণ্ঠস্বরে ফোন রিসিভ করেই বলতে শুরু করে,” কলি বাঁশের ফলি, কী সমস্যা রে তোর? এতো রাতে কেন এতো জ্বালাতন করিস আমাদের? তোর বর মোহাম্মদ এনামুল সাহেব কী আদর যত্নে কমতি রাখছে যে, আমার জামাইয়ের কথা স্বরণ করছিস?”
” ভাবী, আমি এনামুল। কলির বর বলছি।”
মিষ্টি চোখ কচলে ফোনের নাম্বার পুনরায় দেখে নেয়, হ্যাঁ এটা তো কলির নাম্বার। নিশ্চয়ই এই মেয়ে আবারও ক্রিমিনালের মত কাজ করেছে! এনামুল ভাই সেটার বিচার দিতেই হয়তো কল করেছেন। মিষ্টি ফোস করে নিশ্বাস ত্যাগ করে বলতে শুরু করে, ” কলি কোন অন্যায় করেছে ভাই? এমন হলে ওরে ক্ষমা করে দেন। আসলে মেয়েটা আদরে আদরে বড়ো হয়ে একদম বাঁদর হয়ে গেছে। ছেলেমানুষি বলে ভুলে যান সব!”
এনামুল সাহেব সম্মানের সহিত মিষ্টিকে নিষেধ করে বলেন, ” আরে না ভাবী, কলি কিছু করেনি কিন্তু কলির কিছু হয়েছে!”
মিষ্টি উদ্রিত স্বরে বলে, ” কী হয়েছে?আপনি কী মে’রে’ছে’ন? কেন মা’র’লে’ন? মানছি আমাদের মেয়ের একটু সমস্যা আছে তাই বলে মা’র’বে’ন? আপনার সাহস তো কম নয়! বিয়ের সময় তে ঠিকই লাফিয়ে লাফিয়ে বিয়ে করতে চলে এসেছেন।এক বছরেরই স্বাধ মিটে গেছে? পাঠিয়ে দেন আমাদের মেয়েকে। রাজকন্যার মতো রাখব বলে দিলাম!”
” আরে ভাবী, আপনি তো রিতীমত আমাকে অপরাধী বানিয়ে ফেলেছেন। আমি কলিকে মা’র’তে যাব কোন দুঃখে! আমি বলতে চাইছিলাম, কলি অসুস্থ; মানে সে প্রেগন্যান্ট।”
মিষ্টি হাফ ছেড়ে বাঁচে। মিনমিন স্বরে বলে, ” তাই বলুন! আমি তো কি ভেবেছিলাম!”
” অন্তিক ভাই, তাহলে ভুল বলে না। আপনি সত্যিই এক পিস ভাবী!”
মিষ্টি নড়েচড়ে শোয়! নিজের সম্পর্কে সুনাম শুনতে তার বেশ ভালো লাগে। সুর টেনে সে বলে, ” আর কী কী বলেছে আমার নামে, শুনি!”
এনামুল সাহেব এবার বলেন, ” আর বলতে পারব না, ভাবী। আপনি না হয়, ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে শুনে নেন। আমার বউ লাঞ্চ করতে ডাকছে, রাখছি।”
ফোন কাটতেই মিষ্টি বিড়বিড় করে বলে, ” শা*****র বিদেশীদের এজন্যই আমি দেখতে পারি না। এরা সময়ের মূল্য দেয় না।”
পিয়াস স্ত্রী সহ সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমিয়েছে গত বছরই। কলিরও বিয়ে হয়ে যায় এক বিদেশির সাথে। তাদের বিয়ের এক বছর হয়েছে। রুনা পূন্যালয়ে ভালো আছে। লায়লা বেগম কারাগারে, কারো সাথে দেখা করেন না। মিষ্টির একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। মিষ্টি তার নাম দিয়েছে, নয়না। অন্তিকেরও নামটা পছন্দ হয়েছে।
সময়ের হসাব জানা নেই মিষ্টির। মিষ্টি এবার স্বামীর দিকে ফিরে তাকায়। মানুষটা আরামে ঘুমাচ্ছে, অন্তিকের এতো সুখ কী আর মিষ্টির সহ্য হবে! সে অন্তিকের শরীর ঘেঁষে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ” শুনেছি, রাত বিরাতে বউকে চুমু খেলে ভিটামিন-এ পাওয়া যায়! কথাটা কী সত্যি অন্তু?”
অন্তু এক ঝটকায় মিষ্টিকে তার উপরে ফেলে ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। সময় নিয়ে ঠোঁটের স্বাদ নিয়ে বলে, ” হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি। এই ভিটামিন-এ আমার আজীবন চাই-ই চাই, চন্দ্রিমা!”
মিষ্টি লজ্জায় মুখ লুকায় অন্তিকের বুকে। অন্তিক স্ত্রী মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলতে শুরু করে, ” যদি দেখার ইচ্ছে হয়! তবে ফিরে যাও সূচনায়, সেখানে স্বাদ পাবে দুষ্ট মিষ্টি ভালোবাসার!”
সমাপ্ত