যেখানে দিগন্ত হারায় পর্ব-১২+১৩

0
163

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১২
জাওয়াদ জামী জামী

” আম্মা, তুমি এটা কি করলে? তুমি কি চাওনা তোমার ছেলে বেঁচে থাকুক? ” মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’কে নিয়ে বিদায় নিতেই, আরমান ওর আম্মাকে বলল।

” এইসব কি কও, বাপ! আল্লাহ্ আমার মাথায় যত চুল আছে, তত আয়ু তোমারে দিক। তুমি আমার আন্ধার ঘরের বাতি। এমন কথা আর মুখে আইনোনা। ” আয়েশা খানমের গলা ভারি হয়ে আসল। আরমান সেটা বুঝতে পেরে মা’কে ডান হাতে জড়িয়ে ধরল।

” তুমি যে উনাদের কথা দিলে, তাদের মেয়েকে দেখতে যাবে, তাদের মেয়ের সম্পর্কে আগে জানবে না? না জেনেই কেন কথা দিলে, আম্মা? ” আরমান মৃদুস্বরে বলল।

” তারা মানুষ ভালো। তাদের কোনকিছুই আমার কাছে অতিরিক্ত মনে হয়নি। তাই আমি কথা দিছি। তোমার কি সেই মেয়েরে পছন্দ নয়? ”

” বিষয়টা পছন্দ-অপছন্দের নয়, আম্মা। বিষয়টা হলো তাদের মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটা তার বাবা-মা’র মত নয়। চরম অবাধ্য সে। ”

” হয়তো বাপ-মায়ে’র শাসন পায়নি। শাসনের অভাবেই এমনডা হইছে। দুনিয়ায় কি সব মানুষই সমান, বাপ? দশ বছর আগে তুমি যেমন আছিলা, এখনই কি তেমনই আছো? নাইতো? তেমনি সেই মেয়ে এখন আমার যেমন আছে কয় বছর পর যে এমনই থাকবো এইডা কিন্তু না। মানুষ বদলায়। মানুষের মন স্থির থাকেনা কোনকালেই। বয়সের সাথে সাথেই মানুষ পাল্টায় যায়। ”

” কিন্তু আম্মা, আমি শিওর ঐ মেয়ে পাল্টানোর নয়। হাজার বছরের সাধনায়ও ওকে তুমি বদলাতে পারবেনা। ও অন্য ধাতুতে গড়া। বাবা-মা’র আচরণ দেখে যদি তুমি সেই মেয়েকে জাজ করতে যাও, তবে তুমি ভুল। ” আরমান ওর মা’কে বোঝানোর চেষ্টা করছে।

” আমি কথা দিছি, বাপ। তারে আমার দেখবার যাওনই লাগব। তবে যদি তোমার পছন্দের কেউ থাকে, আমারে কও। আমি তাদের না কইরা দিমু। ”

” নাহ্ তেমন কেউই নেই। আমি শুধু বলতে চাইছি, তুমি যাকে পুত্রবধূ করতে চাইছ, সে ম্যারেজ ম্যাটেরিয়াল নয়। ”

” ভাইয়া, তুমি আম্মা’র কথার মাঝে বাঁধা দিচ্ছ কেন! আম্মা সাধ করেছে তার ছেলের জন্য বউ দেখতে যাবে, তোমার উচিত আম্মাকে সাপোর্ট দেয়া। লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে এদিকসেদিক ঘুরঘুর করা। কন্যা দেখতে কি কি ফলমিষ্টি নিবা গোপনে সেগুলোর লিস্ট করা। কিন্তু সেটা না করে তুমি আম্মার ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিতে চাইছ! ” শশী এবার মা-ছেলের মধ্যে কথা বলেই ফেলল।

আরমান শশীর দিকে রাগী চোখে তাকাতেই এগিয়ে আসল সুধা।

” শশীতো ঠিকই বলেছে, ভাইয়া। তোমার বিয়ের কথা শুনে আমাদের দুই বোনের যে কত আনন্দ হচ্ছে সেটাকে তুমি ভেস্তে দিতে চাইছ কেন? তোমার কোন কথাই আমরা শুনবনা। কাল সন্ধ্যায় আমরা পাত্রী দেখতে যাবই। ”

” তোরা এখন বুঝবিনা, কোন জিনিস দেখার জন্য উদগ্রীব হচ্ছিস। বাবা-মা’কে দেখে মেয়ের বিচার করছিস। একবার তার সামনে যা, তার মুখ ঝামটা সহ্য কর, তারপর বুঝবি কাকে দেখার জন্য পা’গ’ল হয়েছিলি। ”

” বাপ, এইডা কোন ধরনের কথা কইলা? তোমার ভাষাতো এমন ছিলনা। আমরা মেয়ে দেখতে যাইতাছি, তারে সাথে কইরা আনবার যাইতাছিনা। আগে মেয়ে দেখি, পছন্দ হয় কিনা সেইডাও দেখি। তারপর পাকা কথা দিমু। আর তুমি যে কইলা, মেয়ের বাবা-মা’রে দেইখা, মেয়েরে পছন্দ করতাছি। বিষয়ডা খানিকটা সত্য। বাবা-মায়ে’র স্বভাব সব ছেলেমেয়েরাই পায়। তবে সেইডা কারও তারাতারি প্রকাশ পায়, কারও প্রকাশ পাইতে দেরি হয়। হয়তো এই মেয়ের বেলায়ও সেইডা প্রকাশ এখনও পায়নাই। ”

আরমান বুঝতে পারছে ওর আম্মার মাথায় মাশিয়ার বিষয়টা গেঁথে গেছে। তাকে আর এখান থেকে সরিয়ে আনা যাবেনা। সে মেয়েটাকে দেখেই তবে ছাড়বে।

” শুনলে, ভাইয়া? এবার আম্মার কথা শুনে কনে দেখতে যাওয়ার প্রস্তুতি নাও। আমরা কাল সন্ধ্যায় যাচ্ছি সেখানে। ” শশীর আর আনন্দ ধরছেনা।

” পা’গ’ল নাকি! আমি যাব ঐ মেয়েকে দেখতে? তোদের শখ হয়েছে তোরা গিয়ে দেখে আয়। আমি এরমধ্যে নেই। ”

” তুমি এমনভাবে বলছ, যেন সে একটা পা’গ’ল? আর আমরা সেখানে গেলে আমাদের কা’ম’ড়ে দেবে? শুধু শুধু ভয় দেখাও কেন! ” শশী মুখ গোমড়া করে বলল।

” ভয় দেখাচ্ছিনা, সত্যিই বলছি। মেয়েটাকে বিশ্বাস নেই। তোদের কথাবার্তা শুনে কা’ম’ড়ে দিতেও পারে। কা’ম’ড়া’নো’র সম্ভাবনা তখনই বেড়ে যাবে, ও যখন শুনবে তোরা আমার বোন। সাবধানে থাকবি কিন্তু সেখানে গিয়ে। ”

” বাপ, তুমি আবারও মেয়েডারে অসম্মান করতাছ? তোমারে ছোট থাইকা শিখাইছি, মেয়েদের কখনোই অসম্মান করবানা। তাদের সম্মান দিবা, ভালোবাসা দিবা। দেখবা তারাও তোমারে মাথায় তুইলা রাখব। মনে রাইখো, তুমি যা দিবা সেডাই ফেরত পাইবা। ”

” বুঝেছি, আম্মা। তবে তোমরা তাকে দেখতে যাচ্ছ যাও। কোন কথা দিয়ে বসোনা কিন্তু। তাকে দেখবে, সবার সাথে কথা বলবে এরপর বাসায় চলে আসবে। আমি সকাল গাড়ি ঠিক করে রাখব। ”

” আচ্ছা। এবার আইসা খাইয়া নাও। ”

” মাশিয়াত বিনতে মোর্তাজা, আপনার মন কোথায় আছে? এর আগেও বলেছি ক্লাস করতে ইচ্ছে না করলে বাহিরে গিয়ে দাঁড়াবেন। আপনার জন্য অন্যদের মনযোগ নষ্ট হোক সেটা আমি চাইনা। ” ক্লাস নেয়ার ফাঁকেই আরমান লক্ষ্য করেছে মাশিয়া ওর কথা না শুনে কিছু একটা করছে।

” আমি এর পরের ক্লাসের একটা নোট দেখছিলাম। ” মাশিয়া চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

” যখনকার কাজ তখন করবেন। তবে চেষ্টা করবেন ক্লাসের নোটগুলো বাসা থেকে সল্ভ করে আনার। যদি না পারেন তবে সেটা সেই স্যারকে বলবেন অথবা আমাকে ক্লাস শেষে আমাকে বলবেন। বোঝাতে পেরেছি? ”

” হুম। ” মাশিয়া আর কিছু না বলে নোটগুলো রেখে দেয়। আর মনে মনে আরমানকে গালি দিতে থাকে।

” মাস্টার, একবার তোমাকে বাগে পাই, তখন বুঝবে মাশিয়া কি জিনিস। খালি আমার ওপর মাতব্বরি ফলতে চাওয়া? এমন ফাঁদে তোমাকে ফেলব, তুমি কেঁদেও কূল পাবেনা। ”

” মনে মনে গালি দিতে চাইলে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ান আর যত খুশি গালি দিন। তখন অবশ্য মনে মনে না দিয়ে জোড়েই গালি দিতে পারবেন। ” আরমান মাশিয়ার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে ও গালি দিচ্ছে।

আরমানের কথায় মাশিয়া চমকে যায়। সেই সাথে অবাকও হয়। ওর মাথায় ঢুকছেনা মনে মনে গালি দিল ও, কিন্তু সেটা মাস্টার বুঝল কিভাবে!

” মাশিয়া, ওঠ। আর কত ঘুমাবে? উঠে রেডি হয়ে নাও। আজকে বাসায় মেহমান আসবে। ” মাশিয়া আজ তারাতারি ভার্সিটি থেকে এসেছে। এসে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে। বিকেল পাঁচটা বাজতেই ওর ভাবী দোলনের ডাকে ঘুম ভাঙল।

” ডাকছ কেন, ভাবিপু? আরেকটু ঘুমাতে দাও। তোমার বিয়ে হয়েছে আটদিন। এখন তোমার হানিমুনে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা না করে আমার ঘুমের চৌদ্দটা বাজাচ্ছ কেন? ”

” আমার হানিমুনে যেতে আরও কয়দিন লেগে যাবে। এখন আমার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের চিন্তা কর। উঠে ফ্রেশ হও। এরপর সুন্দর পোশাক পরে রেডি হয়ে নাও। ”

” আমি কিছুই করতে পারবনা। ” মাশিয়া ওর ভাবির কথা না শুনে আবারও শুয়ে পরল। দোলন ওকে ডেকেও তুলতে পারলনা। বাধ্য হয়ে সে কল্পনা মোর্তাজার কাছে যায়।

” মাশিয়া, অনেক ঘুমিয়েছ। এবার ওঠ। তোমার পাপা লিভিং রুমে তোমার অপেক্ষা করছে। ” কল্পনা মোর্তাজা মাশিয়াকে টেনে তুললেন।

” মম, তুমিও ডাকাডাকি শুরু করলে? আরেকটু ঘুমাতে দাও। কিছুক্ষণ পর পাপার সাথে কথা বলে নিব। ”

” সারারাত ঘুমানোর জন্য কি যথেষ্ট নয়? তুমি যদি এখন না ওঠ, তবে শরীরে পানি ঢেলে দেব। মেহমানরা কখন যেন এসে যাবে। কিন্তু তুমি এখনও পরে পরে ঘুমাচ্ছ! ”

” মেহমান আসার সাথে আমার ঘুমানোর সম্পর্ক কি! মেহমান আসলে তোমরা আছ তাদের আপ্যায়নের জন্য। এরমধ্যে আমাকে টানছ কেন? ”

” মেহমান আসছেই তোমার জন্য। ”

” বোঝ ঠ্যালা। আমি আবার কি করেছি! আমাকে দিয়ে তাদের কি কাজ? ”

” তারা তোমাকে দেখতে আসছে। ” কল্পনা মোর্তাজার কথা কারেন্টের মত কাজ করল। মাশিয়া এক ঝটকায় উঠে বসল।

” কিহহহহ। আমাকে দেখতে আসছে মানে কি? আমি কি গ’রু নাকি ছা’গ’ল, যে আমাকে দেখতে আসবে? ” মাশিয়ার চিৎকারে বদ্ধ রুম প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

” আস্তে কথা বল। তুমি কোন গ’রু, ছা’গ’ল নও। তুমি অসভ্য একটা মেয়ে। অবশ্য সেটা আমি পাত্রপক্ষকে জানাইনি। আর তারা ছেলেকে বিয়ে করাবে। সেজন্য মেয়ে কেমন সেটা দেখার অধিকার তাদের আছে। ”

” আমি কোথাও যাবনা। তুমি বাহিরে যাও। আমি দরজা বন্ধ করে ভেতরেই থাকব। ”

” আর একটা কথা বললে তোমাকে টেনে থা’প্প’ড় মা’র’ব। বেয়াদবির একটা সীমা থাকে। যেটা ক্রস করা তোমার জন্য বোকামি হবে। তুমি প্রথমে ফ্রেশ হবে এরপর মার্জিত পোশাক পরবে এবং মেহমান আসলে তাদের সামনে যাবে এবং তাদের সাথে ভালোভাবে কথা বলবে। তাদের প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দেবে। মনে রেখ তোমার কারনে যদি তোমার বাবার কোন অসম্মান হয়, তবে আজই তোমার এই বাড়িতে শেষ দিন। তোমাকে গ্রামে তোমার দাদুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। সেখানেই একা থাকবে তুমি। ” কল্পনা মোর্তাজা আর সেখানে থাকলেননা। দৃঢ় পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কল্পনা মোর্তাজা যাওয়ার পর মাশিয়া কিছুক্ষণ থম মে’রে বসে থাকল। ও বেশ বুঝতে পারছে বাবা-মা ওর বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ওর কোন নিষেধই তারা শুনবেনা। এমনকি ও কিছু করতে গেলেই তারা সেটার জন্য শাস্তি দিতেও দুইবার ভাববেনা। ও যেন এই মুহুর্তে অকূলপাথারে পরেছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। কিছুক্ষণ পর দোলনের ডাকে ওর হুশ ফিরল। বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।

” তোমার নাম কি, মা? ” মধ্যবয়সী নারীর ডাকে সম্বিৎ ফিরে মাশিয়ার। ও লিভিং রুমের সোফায় বসে সামনে বসা মানুষগুলোর গোষ্ঠী উদ্ধার করছিল।

” মাশিয়াত বিনতে মোর্তাজা। ”

” মাশা-আল্লাহ সুন্দর নাম। শুনলাম তুমি নাকি না খাইয়াই ঘুমায় গেছিলা? এমুন কইরোনা গো, মা। এতে শরীলডা খারাপ হইয়া যায়। ”

এবার সেই মধ্যবয়সী নারীর কথা শুনে মাশিয়া আকাশ থেকে পরল। ওর বুঝে আসছেনা পাপা-মম কি দেখে এমনভাবে কথা বলা একজন মহিলার ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিতে চাচ্ছে। ও মনে মনে ভাবছে, যার মা এভাবে কথা বলে, তার ছেলে না কিভাবে কথা বলবে। মাশিয়ার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এমন সময় মাশিয়া বুঝল, ওর পাশে এসে একজন বসল। ও লিভিং রুমে ঢোকার সময়ই দেখেছিল একজন সুন্দরী মধ্যবয়সী মহিলার সাথে দুইজন মেয়ে এসেছে। সেই মেয়েগুলোর একজনই ওর পাশে বসেছে। মাশিয়া স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। একটু এদিকওদিক হলেই মম ওকে থাপড়ানোর হুমকি দিয়েছে। মাশিয়া পাশে বসা মেয়েটার দিকে তাকায়। মেয়েটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি।

” তোমাকে একটু দেখছি। কিছু মনে করোনা। ভাইয়ার বউয়ের সব ঠিকঠাক আছে কিনা সেটাতো আমাকেই দেখতে হবে। তাইনা বলো? ” ”

মাশিয়া কিছু না বলে ওপর-নিচে মাথা নাড়ায়। মেয়েটার কথায় ও বিরক্ত হয়েছে।

” আহ্ শশী। কিসব বলছিস? ” আরেকজনের মৃদু ধমক শুনে মাশিয়া বুঝল মেয়েটির নাম শশী।

” আমিতো ঠিকই বলেছি, আপু। ভাইয়ার কথা মিলিয়ে নিতে হবেনা? ভাইয়াইতো বলেছিল, এই মেয়ে সুযোগ পেলেই আমাদের কা’ম’ড়ে দিতে পারে। আমাকে তো সেটা পরখ করতে হবে নাকি? হাজার হলেও কা’ম’ড় দেয় এমন কোন মেয়ের সাথে আমার ভাইয়ার বিয়ে দিতে পারিনা। ” শশীর কথা শুনে আয়েশা খানম আর সুধা লজ্জায় মাথা নিচু করে।

কল্পনা মোর্তাজা তার স্বামীর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। আর মাশিয়াতো পারলে সব তছনছ করে দেয়। লিভিং রুমে বর্তমানে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।

” তবে ভাইয়া যাই বলুক না কেন, তুমি কিন্তু বেশ সুন্দরী। ভাইয়ার সাথে তোমাকে মানাবে। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তবে কা’ম’ড় দেয়ার অভ্যাস থাকলে সেটা ছেড়ে দাও। বিয়ের পর তোমার কা’ম’ড়া’নো’র অভ্যাস থাকলে দুইমাসের মধ্যে দেখবে তোমার একটা দাঁতও থাকবেনা। ভাইয়া আবার দাঁত তোলায় এক্সপার্ট। আর দাঁত না থাকলে আমার আম্মার হাতের রান্না করা মাংস খেতে পারবেনা। আম্মার হাতের হাঁসের মাংস ভুনা হেব্বি টেস্টি হয়। ঐটা না খেলে তোমার লাইফে বড় জিনিস মিস করে যাবে। ”

শশীর কথা শুনে মিরাজ মোর্তাজা হো হো করে হেসে উঠলেন। আয়েশা খানম চোখ বড় করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ওকে চুপ থাকতে বললেন। কল্পনা মোর্তাজাও হাসছেন।

মাশিয়া এবার রেগে কল্পনা মোর্তাজার দিকে তাকায়। কল্পনা মোর্তাজা ইশারায় ওকে বসে থাকতে বললেন। বাধ্য হয়ে মাশিয়াকে সেখানেই বসে থাকতে হল।

” শশী, একটু চুপ করবি বইন? তুই আগেই আপুকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছিস। আমার ভাইয়া কি ভয়ংকর কেউ? আমার ভাইয়ার মত ভাইয়া সারা দেশ খুঁজলে দশটা পাওয়া যাবেনা। ” সুধা পরিবেশ হালকা করতে বলল।

” তুমি ওর কথায় কিছু মনে কইরোনা, মা। এই মেয়ে একটু বেশি কথা কয়। আমার আরমান খাঁটি একখান মানুষ। সে কখনোই অন্যায় করেনা আর অন্যায়কে মাইনাও নেয়না। ”

আরমান নামটা কানে আসতেই ঝট করে কল্পনা মোর্তাজার দিকে তাকায় মাশিয়া। সেটা লক্ষ্য করেই সুধা বলল,

” তোমার শিক্ষক আরমানের কথাই বলছে, আম্মা। ”

” মম, তোমরা ঐ মাস্টারের মা-বোনদের বাসায় আসতে বলেছিলে? তোমরা জানোনা ঐ মাস্টার যখনই সুযোগ পায়, তখনই আমাকে অপমান করে। ইনফ্যাক্ট আজও সে আমাকে অপমান করেছে। তোমরা ভাবলে কি করে, ঐ মাস্টারকে আমি বিয়ে করব? আমি জীবনেও ঐ হিটলার মাস্টারকে বিয়ে করবনা। ” আয়েশা খানম তার মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে যেতেই খেঁকিয়ে উঠল মাশিয়া। ও এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করেছে। তারা চলে যেতেই সে আগ্নেয়গিরির ন্যায় ফেটে পরল।

” তোমার হ্যাঁ কিংবা না তে কিছুই আসে যায়না। আগে দেখ তারা তোমাকে পছন্দ করে কিনা। তারা পছন্দ করলে শুকরিয়া আদায় করবে, বুঝলে? এখনকার দিনে আরমানের মত ছেলে পাওয়া দুষ্কর। তারা যদি তোমাকে পছন্দ করে, তবে আমরা সাতদিনও দেরি করবনা। বিয়েটা তোমাকে করতেই হবে। ”

” আমি কিছুতেই ঐ মাস্টারকে বিয়ে করবনা। নেভার এভার। ”

” তাহলে আমাকে তোমার চিরদিনের জন্য হারাতে হবে। ” কল্পনা মোর্তাজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন।

হতভম্ব মাশিয়া ছলছল নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। ওর আজ নিজেকে বড্ড একা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই ধুলার ধরনীতে ও নিঃস্ব, জরাজীর্ণ এক নারী মাত্র। যার মূল্য কেউই দিতে চায়না। টুপ করে দু ফোঁটা নোনা জল ঝরে পরল ওর চোখের কোন বেয়ে।

আরমান আপাতত স্বস্তিতে আছে। আয়েশা খানম তাদেরকে তেমন কিছু বলে আসেননি। তবে আরমান আয়েশা খানমের হাবভাবে বুঝতে পেরেছে মাশিয়াকে তার পছন্দ হয়েছে। তিনি যেকোনো মুহূর্তে আরমানের কাছে বিয়ের কথাটা তুলবেন। তবে আরমান সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ও এই প্রথমবার আম্মার কথার বিপক্ষে যাবে। মাশিয়াকে ও কখনোই বিয়ে করবেনা।

চলবে…

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_১৩
জাওয়াদ জামী জামী

পরদিন মাশিয়া আর ভার্সিটিতে যায়না। ও ভার্সিটির টাইমেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

আরমান তার নির্ধারিত ক্লাস নিয়ে চলে যায় সুপারশপে। বাসা থেকে বেরোনোর সময় শশী ওর হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। সেসব কিনতেই ও সুপারশপে যায়।

মাশিয়া সারাটা সকাল রিশাদের সাথে কফিশপে বসে কাটিয়েছে। ও রিশাদের কাছে মনের যত রাগ উগড়ে দিয়েছে। এই সুযোগে রিশাদও ওকে আরমানের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে। দুপুর গড়াতেই মাশিয়ার হুশ ফিরল। অন্যদিন এতক্ষণে ও বাসায় থাকে । কিন্তু আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। আর সময়ক্ষেপন না করে বিল মিটিয়ে ও রিশাদকে নিয়ে কফিশপ থেকে বেরিয়ে আসল।

আরমান ব্যাগ হাতে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। রোদে ওর মাথা ঘোরাচ্ছে। ঘামে শরীর ভিজে গেছে। কপাল বেয়ে ঘামের সরু রেখা নেমে এসেছে ভ্রুর নিচে। পকেট থেকে রুমাল বের করে আরেকবার পুরো মুখ মুছে নেয়। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আশেপাশে একটা রিক্সাও চোখে পরছেনা।

” আরে এতো দেখছি দুই টাকার মাস্টার! বাব্বাহ্ মাস্টার দেখছি সুপারশপের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! আবার ব্যাগও জিনিসপত্রে ভর্তি! তা বলছি কি, সুপারশপের বিল মেটানোর টাকা কাছে ছিল? নাকি বাকিতে এনেছেন?”

রোদে, গরমে এমনিতেই মেজাজ খিঁচরে ছিল তারউপর কারও এমন অপমানজনক কথা শুনে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখল মাশিয়া ঠোঁটের কোনে৷ ব্যাঙ্গের হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে রিশাদ।

” আমি করেছি না করেছি, সেটা নিয়ে আপনার এত মাথা ব্যথা কেন? নিজের চরকায় তেল দিন। শুনেছি পরপর দুইবার সেকেন্ড সেমিস্টারে ফেইল করেছেন? এখন যেভাবে চলছেন, এমন করলে আগামী দুই সেমিস্টারও একই ক্লাসরুমে কাটাতে হবে। কান খুলে শুনে রাখুন, শিক্ষক আমি, কোন ভিখারি নই। তাই সুপারশপে আমিও কেনাকাটা করতে পারি। ” রাগে আরমানের চোখমুখ র’ক্তবর্ণ ধারন করেছে।

” বেইবি, লেকচারারের দেখি রাগও আছে! লটারি লেগে গেছে তার। আর এজন্যই তেজী ঘোড়ার মতো ছটফট করছে। ” ওদের কথার মাঝে রিশাদ ফোঁড়ন কাটে।

” ঠিকই বলেছ। আমার পাপার প্রপার্টি, বাংক-ব্যালেন্স এসবের মালিক আমিও। আর সে বুঝেশুনেই আমার পাপা-মমকে পটিয়েছে। পাপা-মম তো এই মাস্টার বলতে পা’গ’ল। আমার কোন কথাই শুনছেনা। আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছ? ” মাশিয়া আরমানকে উপেক্ষা করে রিশাদের সাথে কথা বলছে।

আরমান রাগে ফুঁসছে। পাব্লিক প্লেস না হলে এই মুহুর্তে ও মাশিয়াকে থাপ্পড় দিতে একবারও ভাবতনা।

” সব বুঝেছি, বেইবি। তুমি তোমার পাপার অর্ধেক প্রপার্টির মালিক। কিন্তু তোমাকে হাত করা সহজ নয় দেখে তোমার বাবাকে হাত করেছে। যে করেই হোক তোর সব প্রপার্টি তার চাই, সেটাইতো? সা’পও ম’র’ল, লাঠিও ভাঙ্গলনা পদ্ধতিতে কাজ করছে লেকচারার। সবই হচ্ছে তোমার বাবার প্রপার্টির জন্য। এই লেকচারার ভিষণ চালু। নিজেকে সবার সামনে সাধু প্রমান করে ভেতরে ভেতরে দাবার চাল দিতে দক্ষ সে। ঠিক বলেছিতো লেকচারার? ” রিশাদ শেষ কথাটা বলে আরমানের কাঁধে হাত রাখল।

নিজের কাঁধে রিশাদের হাতের ছোঁয়া পেতেই আরমান তার হাতে থাকা ব্যাগ নিচে রেখেই, রিশাদের নাক বরাবর ঘুষি মা’র’ল। আচমকা ঘুষি খেয়ে রাস্তায় ছিটকে পরল রিশাদ। ওর নাকমুখ, মাথা ব্যথায় দপদপ করছে। কিছুক্ষণের জন্য চোখে অন্ধকার দেখল। মাশিয়া আরমানের এমন কাজে ভয় পেয়ে গেছে। ও চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে।

” ইউ ব্লাডি ফুল। আমার কাঁধে হাত রাখার সাহস পাও কিভাবে? ভবিষ্যতে আমার সামনে আবার আসলে মে’রে মাটিতে পুঁতে দেব। এরপর কাউকে লোভী বলার আগে কয়েকবার ভাববে। আই স্পিট অন মিরাজ মোর্তাজা’স ওয়েলথ। সবাইকে নিজের মত মনে কর তাইনা? এই মেয়ের পেছনে তুমি এমন ঘুরঘুর কর বিনা স্বার্থেই? হুম? তোমার এই মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করার জন্য এর বাবার প্রাপার্টি ছাড়া আর কোন কারন খুঁজে পাইনা আমি। বাবার সম্পদের অহংকার ছাড়া কিচ্ছু নেই এই মেয়ের মধ্যে। সি ইজ আ টোটাল ননসেন্স গার্ল। ” আরমান লক্ষ্য করল ওদের কথপোকথন শুনে আশেপাশের কয়েকজন মানুষ ওদের দেখছে। তাই সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।

এদিকে মাশিয়া আরমানের মুখে নিজের সম্পর্কে এমন অপমানজনক কথা শুনে তেড়ে আসল আরমানের দিকে।

” আমি ননসেন্স! আমি ননসেন্স হলে আপনি কি? আপনি যে একটা ভিখারি। যে আমার পাপার সম্পত্তির লোভে নিজের মা’কে আমার বাসায় পাঠিয়েছেন। আপনার মা যেই শুনেছে আমি অনেক সম্পদের মালিক, তখনই মেয়েদের নিয়ে নাচতে নাচতে আমাদের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছে। আপনার মত লোভী, ভিখারিকে আমি বিয়ে করতে চাইনা। ”

” সাট আপ ইউ স্টুপিড গার্ল। কথা বলতে গিয়ে নিজের সীমা অতিক্রম করোনা। তাহলে ফল মোটেও ভালো হবেনা। ” আরমান কথার মাঝেই হাতের ইশারায় একটা রিক্সা ডাকে।

” কি করবেন আপনি? বিয়ে করবেননা আমাকে? তাহলে অনেক কিছু হাতছাড়া হয়ে যাবে আপনার! তারপর কি ভার্সিটির জবটা করবেন? অবশ্য জব না করে কোথায় যাবেন! জবটাই তো আপনার একমাত্র সম্বল। ওটা হারালে রাস্তায় বসে যেতে হবে। শেষ অব্দি কার ফল খারাপ হবে? আমার না আপনার? ”

এই মুহুর্তে আরমানের কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা। এদিকে রিক্সাও এসে গেছে। ও ব্যাগ হাতে তুলে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসল। আর মাশিয়া নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আরমানকে যাচ্ছেতাই বলছে। আরমান শুধু এক নজর মাশিয়ার দিকে তাকায়।

পুরো রাস্তা আজকের ঘটনার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একবার ভাবল আরমান। শেষে রাগে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। রাগের বশেই কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল সে। যেখান থেকে ওকে ফেরানোর সাধ্য কারও নেই। বাসায় পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে শশীকে ফোন দিয়ে নিচে আসতে বলল।

অসময়ে নিজের অফিসে ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত আরমানকে দেখে বেশ অবাকই হয়েছেন মিরাজ মোর্তাজা। তবে আরমানের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝলেন কিছু একটা ঠিক নেই।

” আরে ইয়াং ম্যান! তুমিতো আমাকে সারপ্রাইজ দিলে। এস বস। ”

আরমান মিরাজ মোর্তাজাকে সালাম দিয়ে চেয়ার টেনে বসল।

” আপনার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিল। ”

” কথাবার্তা পরে হবে। আগে তুমি গলা ভিজিয়ে নাও। ভার্সিটি থেকে এসেছ বোধহয়? তোমাকে টায়ার্ড দেখাচ্ছে। ” মিরাজ মোর্তাজা ইন্টারকমে তার পিওনকে জুস পাঠাতে বললেন।

” স্যার, আমার কথা আগে শুনুন। তারপর যদি মনে করেন আমাকে আপ্যায়ন করা যায়, তবেই জুস আনতে বলবেন। ”

আরমানের কথা শুনে মিরাজ মোর্তাজার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। শঙ্কা এসে বাসা বাঁধে বুকের কোটরে।

” গুরুতর কিছু মনে হচ্ছে? আচ্ছা আগে বল কি হয়েছে? ”

” আমাকে আপনি নিজের মেয়ের জন্য হঠাৎ কেন সিলেক্ট করেছেন? ” কোন জড়তা ছাড়াই বলল আরমান।

” তোমার নিষ্ঠা, সততা, ব্যাক্তিত্ব, তোমার রেজাল্ট, জব এসব দেখে। ” মিরাজ মোর্তাজা একবাক্যে সত্যিটাই বললেন।

” যদি এই মুহুর্তে আমি জব ছেড়ে দেই তবেও কি আপনার মেয়ের জন্য আমাকে বেছে নেবেন? ”

” কি ব্যাপার বলতো? মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে এবং সেটা ভালো কিছুই নয়। ” মিরাজ মোর্তাজার গলায় শঙ্কা প্রকাশ পায়।

” আপনার মেয়ে মনে করে আমি আপনার প্রপার্টির লোভে তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। তার ভাষায় আপনাকে আমি পটিয়েছি। সেকারণেই আমার আম্মা আর বোনদের আপনার বাসায় পাঠিয়েছিলাম। ”

” হোয়াট! মাশিয়া এসব বলেছে? ”

” জ্বি। আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই, যেটা আপনি দেননি। আমার জব না থাকলেও কি মাশিয়ার জন্য আপনি আমাকে ভাববেন? ”

মিরাজ মোর্তাজা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকলেন আরমানের দিকে। তিনি কিছু বলার ভাষা হারিয়েছেন তাকে চুপ থাকতে দেখে আরমান মৃদু হেসে আবারও মুখ খুলল।

” মানছি আপনি একজন আদর্শ পিতার দ্বায়িত্ব পালন করতে চেয়েছেন। কিন্তু ভুল আপনি করেছেন। যার বিয়ের কথা ভাবছেন, সে বিয়েতে রাজি কিনা সেটা আগে জেনে নেয়া দরকার ছিল। নিজের মেয়ের সম্পর্কে সবকিছুই জানেন আপনি। আপনার মেয়ে কোন ধাতুতে গড়া সেটাও আপনার অজানা নয়। ”

” আমরা ওর পছন্দের ওপর ভরসা কোন কালেই করিনা। অবশ্য ওর কোন পছন্দের মানুষও নেই। আমরা ভেবেছিলাম তুমিই একমাত্র ওকে ঠিক পথে আনতে পারবে। একমাত্র তোমার কাছেই ও জব্দ হয়। ”

” নিজের মেয়েকে জব্দ করতে গিয়ে তাকে আমার সাথে বেঁধে দিতে চাইছেন! একবারও ভাবলেননা, এতে আপনার মেয়ের প্রতিক্রিয়া কি হবে? কিংবা এর প্রভাব আমার ও আমার পরিবারের ওপর কিভাবে পরবে? ” আরমানের কন্ঠে নিখাঁদ বিস্ময়।

” তুমি কি করতে চাইছ? ” মিরাজ মোর্তাজা নিচু গলায় বললেন। তিনি বুঝতে পারছেন তার আশার আলো ধীরে ধীরে নিভতে চলেছে।

” কিছু করতে চাইনা। বলতে চাই। আমি জব ছাড়লে কি আপনি আপনার মেয়ের জন্য আমাকে ভাববেন? আপনার উত্তর যদি ‘ হ্যাঁ ‘ হয়, তবে আমি কালকেই জব ছাড়ব। এবং ওকে আমার সাথে গ্রামে যেতে হবে। সেখানেই তাকে থাকতে হবে যতদিন না সে শোধরায়। ওকে আমার পরিবার, পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে হবে। আমার মত করে থাকতে হবে। আমি চাষাবাদ করব, সেখানে তাকে সহযোগিতা করতে হবে। মোটকথা, একজন আদর্শ গ্রাম্য বধূ হয়ে উঠতে হবে তাকে। এবং যতদিন সে না শোধরাবে, ততদিন সে আপনার বাসায় বছরে দুইবার আসবে এবং সেখানে দুই রাতের বেশি থাকতে পারবেনা। এবং আপনার উত্তর যদি ‘ না ‘ হয় তবেও আমি জব ছাড়ব। অন্য এক প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। সেখানে জয়েন করব। আপনার জবাবের অপেক্ষা এবং আশা উভয়ই করছি আমি। তবে সেটা এখনই না জানালেও চলবে। আসছি। ” আরমান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

” আরে উঠছ কেন? তুমি টায়ার্ড। খাবার চলে আসবে এখনই। যেওনা। ” মিরাজ মোর্তাজার গলায় অনুনয়।

” আজ নয়। আপনার উত্তরের ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। ” আরমান বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।

বাসায় এসে আরমান সোজা ওয়াশরুমে ঢুকল।গোসল সেড়ে বেরিয়ে এসে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পরল। আজকের ঘটনা ভুলতে চায় সে। সেজন্য একটা শান্তির ঘুম দরকার। ওর স্থির বিশ্বাস মিরাজ মোর্তাজা ওর প্রস্তাবে কিছুতেই রাজি হবেননা। আর যাইহোক কোন বেকার ছেলের সাথে কোন বাবা-মা’ই তাদের মেয়েকে তুলে দেবেননা।

” মাশিয়া কোথায়? বাসায় আছে? ” মিরাজ মোর্তাজা স্ত্রী’কে কোন সম্ভাষণ ছাড়াই জিজ্ঞেস করলেন।

” খাচ্ছে। একটু আগেই বাসায় এসেছে। ” কল্পনা মোর্তাজা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন কিছু একটা ঘটেছে।

মাশিয়া ডাইনিং টেবিলে সাজানো কয়েকরকম তরকারি থেকে শুধু চিংড়ি ভুনা নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল। মিরাজ মোর্তাজা যে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেদিকে ওর খেয়ালই নেই। হঠাৎই সামনে থেকে খাবারের প্লেট সরে যেতেই ও বিরক্ত হয়ে ঘার ঘুরিয়ে তাকায়।

” পাপা, তুমি? কিছু বলবে? ” আর কিছুই বলতে পারলনা মাশিয়া। গালে সপাটে একটা থাপ্পড় খেয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে পাপা ওকে থাপ্পড় মেরেছে।

” আরমানকে কি বলেছ? এত সাহস পেয়েছ কোথায় থেকে? ”

এবার মাশিয়া বুঝল কেন ওকে থাপ্পড় হজম করতে হল৷

” যা বলেছি ঠিক বলেছি। ” ফুঁপিয়ে কাঁদছে মাশিয়া।

” তার মানে তুমি বলতে চাইছ, আমাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল? ”

” ভুল এবং বিরক্তিকর সিদ্ধান্ত ছিল। ” মাশিয়ার কান্না কিছুতেই থামছেনা।

” তোমার কাছে যেটা ভুল এবং বিরক্তিকর সেটাই আমাদের কাছে সঠিক। আর সেটা মানতে তুমি বাধ্য। তোমার ভালো চাই আমরা। যেভাবে তুমি চলাফেরা কর, সেটা আর যাইহোক ভালো কিছু হতে পারেনা। তোমাকে আমরা একজন আদর্শ পাত্রের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলাম। ”

” চাইনা আমার এমন আদর্শ স্বামী। সে একটা অসভ্য, বর্বর মানুষ। মেয়েদের সে সম্মান দিতে জানেনা। আর আমাদের ফ্যামিলির সাথে তার ফ্যামিলি কোনদিক দিয়ে যায় বলতে পার? আমার আত্মীয় বন্ধুরা যেখানে হাই সোসাইটি বিলং করে, সেখানে আমি একজন শিক্ষকের স্ত্রী হয়ে জীবন পার করব? ”

” অন্যের উদাহরণ দেয়ার আগে নিজের যোগ্যতা একবার যাচাই কর। তোমার আত্মীয়, বন্ধুরা যেখানে হাইলি এডুকেটেড সেখানে তুমি কি? অবশ্য তোমাকে এভাবে বলে আমি আরমানকে ছোট করতে পারবনা। তোমার ভাগ্য ভালো যে, আরমানের মা তোমাকে পছন্দ করেছে। তিনি এখন ছেলের মতামতের অপেক্ষা করছেন। আরমান ছাড়া অন্য কেউ যদি তোমার জীবনে আসে, তবে তাদের অর্থ থাকবে ঠিকই, তারা কেউই আরমানের মত ব্যাক্তিত্বের হবেনা, ওর মত আদর্শবান হবেনা। ”

” তুমি যতই ঐ মাস্টারের সাফাই গাওনা কেন, তাকে আমি কিছুতেই বিয়ে করবনা। ”

” তাহলে তুমি বোধহয় আমাকে ছাড়াই বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার প্ল্যান করেছ? সেটা যদি করেই থাক, তবে শুনে রাখ, আমার মৃ’ত্যু’র পর তুমি আমার চেহারা দেখতে পাবেনা। এমনকি আমার মৃ’তদেহের আশেপাশে তোমার ছায়াটুকুও থাকবেনা। আজকের পর থেকে আমার মুখ তুমি দেখবেনা। ” কল্পনা মোর্তাজা এতক্ষনে মুখ খুললেন।

” মম! তুমি এভাবে বলোনা। তোমাদের ছাড়া আমি থাকতে পারবনা। আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি, মম। ”

” তুমি যদি আমাদের সত্যিই ভালোবেসে থাক, তবে বিয়ের প্রস্তুতি নাও। সেই সাথে প্রস্তুতি নাও আরমানের সাথে তার গ্রামে যাওয়ার। এবং এখন থেকে তোমাকে সেখানেই থাকতে হবে, যতদিন না তুমি নিজেকে বদলাতে পার। ” মিরাজ মোর্তাজার কথায় তার দিকে তাকালেন কল্পনা মোর্তাজা। তার চোখের তারায় খেলা করছে প্রশ্ন।

মাশিয়া বাবার কথা শুনে নিজে কি বলবে ভেবে পায়না। তবে কি আর কোন পথ খোলা নেই! এদিকে মমও ওকে কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। যেটা মান্য করার কথা ও ভাবতেও পারছেনা। ও কিছুতেই সইতে পারবেনা মা’য়ের মৃ’ত্যু। আবার আজ প্রথমবার বাবা ওর গায়ে হাত তুলেছে। যেটা মাশিয়ার কাছে অসম্ভব ব্যাপার। সবকিছু মিলিয়ে মাশিয়া বুঝতে পারছে ওকে হার মানতেই হবে। এতকিছুর পরও ওর মনের গভীরে বাবা-মা’র প্রতি এক গাঢ় অভিমান জমাট বাঁধল।

” তুমি নিচে ঐ কথা বললে কেন? ” মিরাজ মোর্তাজা রুমে আসলে, তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করলেন।

” কোন কথা? ”

” আরমানের গ্রামে যাওয়ার কথা। ”

স্ত্রী’র কথায় মাথা তুলে তার দিকে তাকালেন মিরাজ মোর্তাজা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন। এরপর একে একে সব বলতে থাকলেন।

পরদিন একটু দেরিতে ভার্সিটিতে যায় আরমান। ও রাতেই রিজাইন লেটার তৈরী করেই রেখেছে। ভার্সিটিতে যেয়ে শুধু জায়গামত পৌঁছে দিয়েই ও বাসায় ফিরবে। এরপর আম্মাকে সব জানাতে হবে।

ডিপার্টমেন্ট ঢুকতেই আরমানকে পিওন জানায়, চেয়ারম্যান স্যার তার জন্য নিজের কেবিনে অপেক্ষা করছেন। আরমান কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে উত্তর হাতড়ে বেড়ায়। কিন্তু কোন উত্তর পায়না সে।

” এসো ইয়াং ম্যান। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। ” মিরাজ মোর্তাজা হাসিমুখে বললেন।

” আমাকে কেন ডেকেছেন, স্যার? ”

” ইয়াং ম্যান, আমরা মানুষরা প্রত্যেকেই স্বার্থপর। নিজেদের স্বার্থ ব্যাতীত আমরা অন্য কিছুই ভাবতে পারিনা। এই যে আমাকে দেখ। আমি মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে ভুলে গেছি তোমারও কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে, কিছু বলার থাকতে পারে। কিন্তু আমি সেটাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কথাই ভেবে চলেছি। আবার তুমি, নিজের এবং পরিবারের ভালোটা চিন্তা করতে গিয়ে আমার মেয়েকে চাইছনা, তাই কঠিন শর্তের বেড়াজালে বেঁধেছ আমাকে। কিন্তু ঐ যে বললাম, আমরা মানুষ বড়ই স্বার্থপর। তাই মেয়ের ভালোর জন্য তোমার শর্ত আমাকে মেনে নিতেই হচ্ছে। দাও তোমার রেজিগনেশন লেটার। ”

মিরাজ মোর্তাজার কথায় আরমানের মাথায় যেন ঝাঁকে ঝাঁকে বাজ পড়ল। ও কল্পনাও করতে পারেনি ওর এমন কঠিন শর্তে এই ভদ্রলোক সহজেই রাজি হয়ে যাবেন! হঠাৎই ওর পা দুটো বেইমানী করতে শুরু করল। তারা আর দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছেনা।

চলবে….