যেখানে দিগন্ত হারায় পর্ব-২৫+২৬

0
172

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২৫
জাওয়াদ জামী জামী

ওরা যখন বাড়িতে আসল তখন সন্ধ্যা প্রায় ছুঁইছুঁই। বিকেল তার আলোটুকু নিভিয়ে নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। যেন ফিঁকে রংটুকু নিয়ে বিকেল দিগন্তে হারাতে চলেছে। সেই দিগন্তের ওপারে সন্ধ্যা নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে অপেক্ষায় রত।

আয়েশা খানম ছেলে আর ছেলের বউকে দেখে খুশিতে আটখানা হয়ে গেলেন। যেন কয়েক যুগ পর ওদেরকে দেখছেন। আরমান ভেবে পায়না কেন ওর আম্মাকেই এত মমতাময়ী হতে হলো! যে মানুষটার সন্তান ছাড়া কখনোই কোনও কিছু প্রাধান্য পায়নি। আব্বার মৃ’ত্যু’র পর একটা আস্ত বটগাছের ন্যায় তিনি সন্তানদের আগলে রেখেছেন। কখনো ওদের শরীরে ফুলের টোকাটিও পরতে দেননি। এসএসসি পাশ করার পরই তিনি বউ হয়ে এসেছিলেন এই সংসারে। আবার অল্প বয়সেই বিধবাও হয়েছিলেন। তার আব্বা-ভাইয়েরা অনেকবার তাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। আবারও বিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু আম্মা সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য জলাঞ্জলী দিয়ে স্বামীর ভিটে কা’ম’ড়ে পরে থেকেছেন। স্বামীর রেখে যাওয়া অস্তিত্বদের মানুষ মত মানুষ করেছেন। এই সেই আম্মা যিনি কখনোই আব্বার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেননি। সব সময়ই স্বামী ও তার পরিবারের সবাইকে সম্মান করেছেন। বিনিময়ে আজ তিনি শ্বশুর বাড়ির মধ্যমনি।

” বাপ, এম্নে চাইয়া রইছ কেন? বাড়িতে যাইবানা? ” আরমান আম্মার দিকে তাকিয়ে নানান চিন্তায় বিভোর ছিল। আয়েশা খানমের ডাকে তার চিন্তা ভঙ্গ হয়। ”

” আম্মাআআআ, কেমন আছেন? আপনাকে অনেক মিস করেছি। আরিব্বাস আপনিতো দেখছি আগের থেকে সুন্দরী হয়ে গেছেন! আপনার রূপের গোপন রহস্য কি, আম্মা? ” মাশিয়ার এহেন কথায় আয়েশা খানম থতমত খেয়ে গেলেন। এই মেয়ে বলে কি!

মাশিয়ার কথা শুনে শশী এগিয়ে আসল।

” ভাবি, আমিও আম্মাকে এই কথাটাই তিনদিন আগে বলেছিলাম। কিন্তু আম্মা ধমক দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু দেখ একই কথাটা তুমি আম্মাকে বললে, আর আম্মা চুপচাপ শুনে গেল। আজ বুঝলাম, আম্মা আমার থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসে। ”

” তুই থাম কইলাম। খালি ফাও কথা কয়! যা আমার মা’য়েরে নিয়া ভিতরে যা। বাপ, তুমি সুধার সাথে কইরা জিনিসপত্র নিয়া আসো। আমারেও কিছু দেও। ”

” তুমি ভেতরে যাও, আম্মা। আমিই সবকিছু নিয়ে আসছি। ”

মাটির ঘরে অনেকদিন পর এসে মাশিয়ার মন খুশিতে ভরে উঠল। বাহিরে প্রচন্ড গরম। অথচ এই ঘরটিতে শীতল মলয় এসে থেকে থেকেই দোলা দিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণের জানালা হাট করে খুলে দিল। প্রায় সাথে সাথেই হুহু করে দখিনা মলয় আছড়ে পড়লো, উড়িয়ে দিল মাশিয়ার দীঘল কালো কেশরাশি। মাশিয়া কিছুক্ষণ জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। উথাল-পাতাল মলয়ে শরীরে শিহরণ খেলে যাচ্ছে। শিহরিত হচ্ছে শরীরের প্রতিটি র’ক্তকণিকা। শেষ বিকেল আর সন্ধ্যার এই সন্ধিক্ষণে অম্বরে নীলচে-কালো রংয়ের অপূর্ব সমাহার ঘটেছে। যেন কোন এক রমনী তার নিলচে-কালো আঁচল বিছিয়েছে সূদুর অম্বরে। মাশিয়া অভিভূত নয়নে তাকিয়ে থাকে অম্বর পানে।

” এভাবে দেবদাসীর মত বাহিরে তাকিয়ে কি দেখছ? এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে ফ্রেশ হয়ে এস। ” আরমানের কথা শুনে মাশিয়া ন্যাপসাক খুলে কাপড় বের করে কলপাড়ের দিকে যায়।

” আম্মা, এতদিন আপনার হাতের খাবার ভিষণই মিস করেছি। স্বীকার করতেই হবে আপনার মত রান্না খুব কম মানুষই করতে পারে। ” রাতে বারান্দার চৌকিতে বসে খাচ্ছে সবাই। খেতে খেতে মাশিয়া শ্বাশুড়ির রান্নার প্রসংশা করছে।

” কি কও, মা! এতদিন তোমার মা তোমারে রাইন্দা খাওয়াইছে, আর তুমি কইতাছ আমার হাতের রান্দনের অভাববোধ করছ! কতদিন পর মা’য়ের হাতের রান্দন খাইছ হেইডা ভালো লাগেনাই? তোমার পছন্দের খাবার মা’য়ে কেম্নে রান্ধে আমারে কইয়া দিও, আমি তোমারে রাইন্দা খাওয়ামুনে। ”

” আমার মমের হাতের রান্নাও অনেক মজার হয়। বিশেষ করে, রুই মাছের কালিয়া, কোপ্তা কারি, ইলিশের দোপেয়াজা। এতদিন মমের হাতের রান্না খেয়েছি ঠিক আছে, তারমধ্যেও আপনার রান্না মিস করেছি, ট্রাস্ট মি। আপনাদের দু’জনের রান্নার ধরন আলাদা। নিজ নিজ ক্ষেত্রে আপনারা সত্যিই পারদর্শী। ” মাশিয়া তৃপ্তি করে লাউ-চিংড়ি দিয়ে ভাত খাচ্ছে।

” আম্মা, আমি ঢাকার ঐ বাসাটা ছেড়ে দিয়ে আসিনি। সুধাকে মেডিকেল কোচিং-এ ভর্তি করিয়েছি। আগামী কয়েকমাস সুধা ঐখানেই থাকবে। ” আরমানের কথা শুনে বারান্দায় অবস্থিত প্রত্যেকেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে। সবার একসাথে তাকানোয় আরমান অপ্রস্তুত হয়ে গেছে।

” কি কও, বাপ! সুধায় ঢাকা গিয়া একলাই থাকবো? ও একলা থাকপার পারবো! তাছাড়া সমত্ত একটা মাইয়া একলা একটা বাড়িতে থাকব, যদি কুন বিপদ হয়? ও ঢাকার পথঘাট কিছুই চিনেনা। তুমি বাড়িডা ছাইড়া দেও, বাপ। ” আয়েশা খানম ছেলের কথা শুনে ভিষণই চমকে গেছেন।

” আম্মা, তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমিতো আছি নাকি? আমি ওকে ঢাকা নিয়ে যাব। প্রয়োজনে আমিও সুধার সাথে থাকব। ওকে সব চিনিয়ে দেব। তাছাড়া ঐ বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় আমার এক বন্ধুও থাকে ওর পরিবার নিয়ে। এছাড়াও বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি বেশ ভালো। সেখানে সুধার কোনও সমস্যা হবেনা। তুমি রাজি হয়ে যাও, আম্মা। তোমার স্বপ্ন ছিল আমি ডক্টর হই। কিন্তু আমি তোমার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। সুধাকে তোমার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ অন্তত দাও। ” আরমানের গলায় অনুনয়। যা স্পর্শ করল আয়েশা খানমের অন্তর।

” বাপ, তুমি ডাক্তার হইতে পারোনাই জন্য মন খারাপ করবানা কইলাম। আর নিজেরে দোষীও করবানা। তুমি অসুস্থ আছিলা তাই মেডিকেলে পরীক্ষা দিবার পার নাই। এই দোষতো তোমার না। তুমি মেডিকেলে পড়বার পারোনাই তো কি হইছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো খারাপ না। সেইখানে পড়তেও কপাল লাগে। ঠিক আছে, সুধা ঢাকা যাইব। কিন্তু ঐ বাসায় নাকি একটাই ঘর? সেখানে থাকবা ক্যাম্নে? ” আয়েশা খানমের কথায় আরমান হাঁফ ছাড়ল। ওর মুখে হাসি। ও হাসিমুখেই বলল,

” আম্মা, সেখানে একটা শোবার ঘর, একটা রান্নাঘর আর একটা ছোটমত ড্রয়িংরুম আছে। সেখানেই একটা ডিভান বসিয়ে নিলেই আমি থাকতে পারব। সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। তুমি শুধু দিনরাত আমাদের জন্য দোয়া করবে। তোমার কাজ একটাই, বুঝলে? ”

” তুমি ডিভানে থাকবে আর আমি বিছানায় আরামে থাকব! এটা কখনোই হবেনা, ভাইয়া। আমি সেটা হতেই দেবনা। আমি ডিভানে থাকব, তুমি বেডরুমে থাকবে। ” সুধা মা-ছেলের কথার মধ্যে কথা বলল।

” তোকে মাতব্বরি করতে বলিনি। তোর কাজ পড়াশোনা করা, তুই সেটাই করবি। বাকি কাজগুলো আমিই করতে পারব। তাই চুপচাপ খেয়ে ঘরে গিয়ে পড়তে বস। ” আরমানের ধমকে ভড়কে যায় সুধা। ওর আর কিছু বলার সাহস হয়না।

মাশিয়া এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে মা ছেলের কথা শুনছিল। সেই সাথে দেখছিল ভাইবোনের খুনসুটি। মা-ছেলের, ভাইবোনদের মধ্যে এত ভাব দেখে ওর খুব ভালো লাগছে। আরমান যে ওর বোনদের খুব ভালোবাসে সেটা মাশিয়া আগেই বুঝেছে। আজ আবার নতুনভাবে বোনের জন্য ভাইয়ের ভালোবাসা দেখল। যে ভাই তার না হওয়া স্বপ্ন বোনকে দিয়ে পূরণ করতে চাচ্ছে।

শশীও কলেজে ভর্তি হয়েছে। ও এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছিল। শিক্ষা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিল। পরবর্তীতে আরমান ওকে ওদের জেলার সবচেয়ে ভালো কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। শশীর রেজাল্ট দেখে আরমানই সবথেকে বেশি খুশি হয়েছিল। বোনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছিল।

মাশিয়া বুঝতে পেরেছে এরা তিন ভাইবোন অসম্ভব ট্যালেন্ট। ওদের পাশে মাশিয়ার নিজেকে কেমন ফিঁকে লাগে। শশী দুষ্টু হলে কি হবে, পড়াশোনার ব্যাপারে ও সব সময়ই সিরিয়াস। সুধাও তাই। বরং শশীর থেকেও বেশি মনযোগী সুধা। মাশিয়ার বিশ্বাস সুধাও শশীর মতই ভালো রেজাল্ট করবে। ওদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মাশিয়ার হিমশিম খেতে হয়। আর যাইহোক মাশিয়া ওদের মত ট্যালেন্ট নয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে ওর ও জিদ চেপে যায়। ইচ্ছে করে ভালো রেজাল্ট করার। সেই মত বই নিয়ে বসেও থাকে। পণ করে ভালো রেজাল্ট করে সবাইকে দেখিয়ে দিবে। কিন্তু মাঝপথেই আবার সব পণ বাতাসে মিলিয়ে যায়। কিন্তু আরমান কখনোই হাল ছাড়েনা। ও মাশিয়ার পড়াশোনার দিকে কড়া নজর রাখে। এখনও সুধা, শশীর সাথে মাশিয়াকেও পড়তে হয়। দ্বিতীয় সেমিস্টার শেষ হয়েছে বলেও ছাড়া পায়না। তৃতীয় সেমিস্টারের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে এখন থেকেই।

বাড়িতে প্রায় সারা বছরই কোননা কোন ফসল থাকেই। তবে আরমান আপাতত সেদিকে নজর দিচ্ছেনা। সেসব তদারকির জন্য দুইজনকে রেখেছ। আরমান বর্তমানে সুধাকে নিয়ে ব্যস্ত আছে। ও চায় সুধা মেডিকেলে পড়ুক। তার জন্য যত কষ্ট করতে হয় আরমান সব করবে। তবুও ওর আম্মার স্বপ্ন পূরণ করবেই। ওরা আর পাঁচ-সাতদিন পরই ঢাকা যাবে। আয়েশা খানম ব্যস্ত মেয়ের সাথে কি কি দেবেন সেসব নিয়ে। আরমান সুধাকে সবকিছু আগে থেকেই গুছিয়ে রাখতে বলেছে। সুধা ভাইয়ের কথামতই কাজ করছে। মাশিয়া শুধু বসে বসে এদের কাণ্ডকারখানা দেখছে।

চলবে…

#যেখানে_দিগন্ত_হারায়
#পার্ট_২৬
জাওয়াদ জামী জামী

আয়েশা খানম কলপাড়ে কাপড় ধুচ্ছেন। সকাল সকাল তিনি অনেকগুলো কাপড় ধোয়ার জন্য ভিজিয়ে রেখেছেন। কাজের মেয়ে আসলে সেগুলো ধুয়ে দেবে। কিন্তু কাজের মেয়ে আজ হঠাৎই অসুস্থ হয়ে গেছে। তাই সে আসতে পারেনি। এদিকে সুধা, শশীও বাড়িতে নেই। তাই আয়েশা খানমকে বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীরেই কাপড় ধুতে হচ্ছে। মাশিয়া নিজের ঘরে আছে। শ্বাশুড়ি যে অসুস্থ শরীরে কাজ করছে সেটা মাশিয়া দেখেও দেখলনা। আবার আয়েশা খানমও মাশিয়াকে কাজ করার জন্য ডাকেননি।

আরমান বাড়িতে এসেই ওর আম্মাকে কাপড় ধুতে দেখল। আয়েশা খানম হাঁপাচ্ছেন। তার বুকও অল্প অল্প ব্যথা করছে। আরমান দৌড়ে যায় আয়েশা খানমের কাছে।

” আম্মা! তুমি কাপড় ধুচ্ছ কেন? শিল্পী আপা কই? তোমাকে হাজারবার নিষেধ করেছি এসব কাজ করবেনা। ” আরমান জোড় করে আয়েশা খানমকে কলপাড় থেকে সরিয়ে আনল।

” বাপ, শিল্পীর শরিলডা ভালো না। তাই আস আসেনাই। সুধা, শশীও কলেজে গেছে। তাই আমিই ধুইতাছি। ” আয়েশা খানম হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন।

” মাশিয়া কোথায়? ” আরমানের গলায় রা’গের আভাস স্পষ্ট।

আয়েশা খানম চমকে ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি বুঝতে পারলেন আরমানের রাগের কারন।

” কি কও, বাপ! বউমা কাপড় ধুইব কেন? হেয় কি বাপের বাড়িতে কুনদিন এইসব কাম করছে! তুমি ঘরে যাও। আমি কাপড় ধুইয়া আসতাছি। ”

” বাবার বাড়িতে এসব কাজ করেনি জন্য যে শ্বশুর বাড়িতেও করতে পারবেনা, এমন কথা কোথায লেখা আছে! ও তো প্রতিদিন কাপড় ধুচ্ছেনা বা বাড়ির কাজও করছেনা। একদিন করলে সমস্যা কোথায়? ”

” তুমি আর একটা কথাও কইবানা। আমি যতদিন বাঁইচা আছি, বউমার এসব কিছুই করতে হইবনা। আমি পোলার বিয়া দিয়া বউ আনছি, দাসী আনিনাই। ” আয়েশা খানম ছেলের কমানোর উপায় খুঁজছেন।

” সংসারের কাজ করলেই কি বাড়ির বউয়েরা দাসী হয়ে যায়? তাহলেও তুমিও এই বাড়ির দাসী? আমার চাচি, চাচাতো ভাইয়ের বউয়েরাও দাসী? আম্মা, তুমি লেখাপড়া জানা মানুষ হয়ে কেমন অশিক্ষিতের মত কথা বলছ, এটা কি বুঝতে পারছ? নিজের সংসারের কাজ করলে কেউ দাসী হয়না, আম্মা। মাশিয়াকে-ও নিজের দ্বায়িত্ব পালন করতে শিখতে হবে। ওকে বুঝতে হবে, ও বাড়ির একজন সদস্য। কিছু দ্বায়িত্ব কর্তব্য ওর ও আছে। নিজের কাজ নিজে করার মানসিকতাও ওকে গড়ে তুলতে হবে। তবেই সংসারে ব্যালান্স আসে। ”

” আমি সব জানি, বাপ। তবুও আমি চাইনা, বউমা এখনই এইসব কাম করুক। তার কাম করনের লাইগা সারাজীবন পইরা রইছে। এখন আমারে কলপাড়ে যাবার দেও। ”

” তুমি গোসল করে এস। কাপড় আমি ধুচ্ছি। ”

” তুমি পা’গ’ল হইছ, বাপ? এইসব কাম তোমার জন্য না। ”

” আমি আর একটা কথাও শুনতে চাইনা। যে কাজ করতে গিয়ে আমার আম্মার কষ্ট হয়, সেই কাজ যদি তার সন্তান করতে না পারে, তবে সেই সন্তানের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তুমি গিয়ে গোসল করে নাও। ”

আরমানের জিদের কাছে হার মেনে আয়েশা খানম গোসল করতে যান। আর আরমান কাপড়গুলো ধুয়ে, শুকাতে দেয়।

” আম্মা একা একা কাপড় ধুচ্ছিল, তুমি তাকে একটু সাহায্য করতে পারতে। তুমি জানো আম্মা অসুস্থ। ডক্টর তাকে ভারী কাজ করতে নিষেধ করে দিয়েছে। ” আরমান ঘরে এসে মাশিয়াকে শুয়ে থাকতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই কথাগুলো বলল। কিন্তু সেটা শোনার সাথে সাথে মাশিয়া রিয়্যাক্ট করে বসল।

” আমি কাপড় ধোব! তা-ও আবার এতগুলো কাপড়! ঢাকায় থাকতে আমাকে কখনোই নিজের কাপড় ধুতে হয়নি। ওয়াশরুমে কাপড় রেখে আসতাম, পরে সেগুলো আলমারিতে গোছানো অবস্থায় পেয়েছি। ”

” তোমার ঢাকার জীবন আর এখনকার জীবনের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। তুমি এখন এই বাড়ির বউ। আর বাড়ির বউদের একটুআধটু কাজ করতেই হয়। এতে সম্মান যায়না। আর তাছাড়া তোমাকে আমি আজকের কথা বলেছি। সব সময়ই যে তোমাকে কাপড় ধুতে হবে সেটা বলিনি। আম্মা কাপড় ধুতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে। তাকে কিছুক্ষণ সাহায্য করলে তোমার কি খুব বেশি কষ্ট হতো? ”

” অবশ্যই কষ্ট হতো। আমিতো বলেইছি, এসবে আমার অভ্যাস নেই। তারপরও কেন একই কথা বলছেন? বিয়ে করার আগে একবার চিন্তা করে দেখেছেন , যাকে বিয়ে করছেন সে এসব কাজে অভ্যস্ত কিনা? তার থেকে বরং আরেকটা কাজের মেয়ে রাখতেন। যে আপনার বাড়ির কাজ বিনাবাক্যে করে দিত। যতসব চিপ মাইন্ডের লোকজন! বিয়ে করে বউ নয় কাজের মানুষ আনতে চায়! বাবার রাজ প্রাসাদ ছেড়ে এই মাটির বাড়িতে এসে থাকছি দেখেই একেকজন নিজেকে গড ভাবতে শুরু করেছে। মনে করেছে সে যেটা বলবে আমাকে সেটাই করতে হবে! ডিজগাস্টিং। ”

মাশিয়া কথা শেষ করতে পারে পারলনা আরমানের থাপ্পড় খেয়ে ওকে থেমে যেতে হয়।

” একটা সাধারণ কথাকে তুমি কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ! তোমাকে কি আমার আম্মা কখনো কাজের মেয়ের মত ট্রিট করেছে? কাজের মেয়েকে কেউ কখনো মুখে তুলে খাইয়ে দেয়? তুমি বেয়াদব আমি জানতাম কিন্তু এতটা বেয়াদব সেটা বুঝতে পারিনি। বিয়ের আগে কাজ করোনি বলে কি বিয়ের পরও কাজ করতে হবেনা? এটা কোন অভিধানে লিখা আছে? তোমার মধ্যে যদি সহবৎ থাকত, তবে আজ তুমি এই ধরনের কথা বলতে পারতেনা। আজ মনে হচ্ছে তোমার বিয়ে করে আমি জীবনের সবথেকে বড় ভুল করেছি। আমিও পা’গ’ল, সেদিন কেন যে শপিংমলের সামনে তোমার কথা শুনে রিয়্যাক্ট করেছিলাম। সেদিন যদি তোমার কথাগুলো ইগনোর করতাম, তাহলে আজ আমাকে এভাবে ভুগতে হতোনা। আমার ক্যারিয়ার শেষ হতোনা।” আরমান রাগের চোটে চেয়ারে লা’থি মা’র’ল।

মাশিয়া আগে কখনোই আরমানকে এমন রাগতে দেখেনি। রাগে আরমানের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আরমানকে আরও কিছু বলে রাগিয়ে দিতে চায়না মাশিয়া। তাই চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

আয়েশা খানম বারান্দা থেকে সবকিছু শুনলেন। ছেলের এমন রাগ তিনি মেনে নিতে পারছেননা। আজ তাও আফসোস হচ্ছে, কেন সেদিন তিনি আরমানের বিরুদ্ধে গিয়ে ওর বিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। অঝোরে কাঁদতে থাকেন আয়েশা খানম। আজ মনে হচ্ছে, নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনি তার ছেলের জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন।

আরমান রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও ও যখন বাড়িতে ফিরলনা তখন আয়েশা খানমের মনে চিন্তার পাহাড় বাড়তে থাকল। সারাদিন ধরে তার ছেলে না খাওয়া। ছেলের চিন্তায় তিনিও খাননি।

সুধা, শশী কলেজ থেকে এসে দেখল ওদের আম্মার মন খারাপ। ওরা অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পায়না। আবার মাশিয়াও ঘর থেকে একটিবারের জন্যও বের হয়নি। ওরা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা কি হয়েছে।

রাত নয়টার দিকে আরমান বাড়িতে আসল। ও এসে সরাসরি আম্মার ঘরে ঢুকল। সেখানেই রাতের খাবার খেয়ে ওর লাইব্রেরীতে গিয়ে শুয়ে পরল। সেখানে ছোট একটা চৌকি পেতে রাখা আছে।

” মা গো, মুখহাত ধুইয়া আসো। আমরা মা-মেয়েতে মিল্যা দুইডা খাইয়া লই। ” আয়েশা খানম মাশিয়াকে ডাকতে এসেছেন। মাশিয়াও জিদ করে না খেয়ে আছে।

” আমার ক্ষুধা নেই, আম্মা। ”

” সেই সকালে দুইডা রুটি খাইছ, সারাদিন এক ফোঁটা পানিও পেটে পড়েনাই। আর তুমি কইতাছো ক্ষুধা লাগেনাই? আমার কথা শোন, রাগ কইরনা। সংসার করবার গেলে কত ঝগড়াঝাটি হয়, সেইগুলাকে সাথে সাথেই মাটি চাপা দিতে হয় গো, মা। রাগ কখনো পুইষা রাখতে হয়না। তুমি রাগ যত পুইষা রাখবা, ততই তোমার ক্ষতি হইব। রাগ, জেদ, হিংসা, ঘৃণা কখনোই কারও মঙ্গল আনেনা। আমার আরমান বুঝদার একটা পোলা। ছোটবেলা থাইকাই ওয় শান্ত, ঠান্ডা। হেয় সহজেই রাগেনা। কিন্তু আবার যখন রাইগা যায় তখন সহজেই ঠান্ডা হয়না। কিন্তু আমার পোলার মনডা খুব নরম। তুমি ওর মনের মত হইয়া দেখ, ও তোমারে মাথায় তুইলা রাখব। দুনিয়ার সব সুখ তুমি না চাইলেও তোমার পায়ের কাছে আইনা লুটায়া দিব। মাগো, আমি চাই আমার পোলা সুখে থাকুক। তোমরা সুখে সংসার কর। আমার পোলাডা আমার নাই ঘরের ধন। সেই কবে ওর আব্বায় আমাগোরে ছাইড়া গেছে। তখন থাইকাই ঐ পোলার মুখের দিকে তাকায় আমি বাঁইচা রইছি। ওর কোন কষ্ট আমি সইবার পারিনা। ওরে তুমি কষ্ট পাইতে দিওনা গো মা। ” আয়েশা খানম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

মাশিয়া আয়েশা খানমের কথা শুনে ঠোঁট কা’ম’ড়ে মাথা নিচু করল। ও এক মায়ের কান্নায় কিভাবে শান্তনার প্রলেপ লাগাবে সেটা ভেবে পায়না।

চলবে…