যেখানে পথচলা শুরু পর্ব-২১+২২

0
267

#যেখানে_পথচলা_শুরু |২১|
সাদিয়া মেহরুজ

ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণে বসে তীরু। ইলির সাথে সাক্ষাৎ করতে তার এখানটায় আসা। পনের মিনিট পার হয়েছে। ইলির দেখা নেই। অথচ মেয়েটা ফোনে এমনভাবে তাড়া দিচ্ছিল যেন সে ক্যাফেতে এসে বসে আছে এক ঘন্টা যাবৎ। বিরক্ত হয় তীরু! ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আশপাশে তাকায়। আচানক তার দেখা মিলে সাদিফের। ভারী বিষন্ন, মনমরা দেখাচ্ছে ছেলেটাকে! দুঃখেরা যেনো আন্দোলিত তার মুখোশ্রী জুড়ে। চোখের নিয়ে গাঢ় কালো দাগ। সুঠাম দেহ শুকিয়ে কাঠ! মুখোবয়বে লেপ্টে রয়েছে যেন হাজারো বে দ না। আস্তে ধীরে কফিতে চুমুক দিতে অন্যমনস্ক হয়ে বসে রয়েছে। তীরুর কেমন যেন লাগল! ভীষণ ইচ্ছে করলো গিয়ে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতে, ‘ এতো দুঃখ কাঁধে নিয়ে ঘুরছেন কেন? বলুন তো। ‘

স্থির চিত্তে থাকা হলো না। উঠে সাদিফের নিকট গেল তীরু। চেয়ার টেনে ইচ্ছে করে খানিকটা শব্দ করে বসল। ধ্যান ভাঙে সাদিফের। তীরুকে দেখে ভীষণ ইতস্তত বোধ করে শুধায়,

-” আরেহ আপনি, কেমন আছেন? ”

সাদিফের অস্বস্তি লক্ষ্য করলো তীরু। কপালে ভাজ পড়ল তার। বলে উঠলো,

-” ভালোই আছি। কিন্তু আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি একদমই ভালো নেই। কি ব্যাপার? ”

সাদিফ হাসার চেষ্টা করলো। ” কই, আমি তো ভালই আছি। ”

-” মিথ্যা বলবেন না সাদিফ। আপনার চেহারা দেখে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে আপনি ঠিক নেই। এমনকি এখন আপনাকে ছোট একটা বাচ্চা দেখলেও সেও বলে দিতে পারবে আপনি আপসেট! কি হয়েছে? খুলে বলুন আমায়। আমি তো আপনাকে হেল্প করতেও পারি নাকি? ”

সাদিফ এ পর্যায়ে পূর্বের মতো বিষন্নতা আঁকড়ে ধরলো নিজের চেহারায়। তীরুর কথায় ভরসা খুঁজে পেল। বুকটা ভার ভার লাগছে! অন্তঃকরণে জমে থাকা কথা কাওকে বলা দরকার। একটু শান্তির দরকার। কন্ঠের খাদ নামিয়ে নিষ্প্রাণ কন্ঠে সাদিফ বলল,

-” একা হয়ে পড়েছি। রাদিফ আপনার সাথে যা করলো তারপর আমি, আমার লাইফ সবকিছু হয়ে গেছে অবিন্যস্ত। রাদিফ কেমন তা জানতাম আমি কিন্তু ও যে এতোটা জ ঘ ন্য কাজ করে বসবে তা আমি কখনো ভাবতেও পারিনি তীরু। আমি অত্যান্ত দুঃখিত রাদিফের তরফ থেকে। লজ্জিত আমি। ও আমার ভাই হতো তীরু। যেমনই হোক কখনো সে আমায় কষ্ট দিত না। বড় ভাইয়ের মতো আমায় আগলে রেখেছে রাদিফ। নতুন একটা জীবন দিয়ে আমাকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে। প্রত্যেক দিন রাতে ও যখন বাড়ি ফিরতো আমরা আড্ডা দিতাম। গিটার বাজিয়ে গান গাইতাম। আমার মন খারাপের সময় গুলোতে ও আমার মন ভালো করতে মরিয়া হয়ে যেত। বহুদিন অব্দি আমি ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। রাদিফের জন্য আমি ভালোবাসা পেয়েছি। পেয়েছি মায়ের মতো খালামনি। একটা ঘর পেয়েছি। কিন্তু যখন রাদিফ এই ঘটনাটা ঘটাল তারপর ওকে জে লে নিয়ে গেল পুলিশ। মেয়েদের সাথে এরূপ অপরাধ করার জন্য বেশ কয়েকবছর ও জে লে থাকবে। এবং এটা ওর প্রাপ্য আই নো বাট কোথাও আমার ওর জন্য কষ্ট হয় তীরু! রাদিফ জে লে যাওয়ার পর খালামনিও আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন। কারণ তিনি ভাবেন সবকিছু আমার জন্য হয়েছে। আমি দায়ী! আমার জন্যই আপনার আর রাদিফের পরিচয় হয়েছে। বর্তমানে আমি কোনোরকম দিনাতিপাত করি। সৃষ্টিকর্তার নিকট নিজের মৃ ত্যু প্রার্থনা করি। একা থাকা ভারী কষ্টের তীরু। একাকীত্ব কারো জীবনে না আসুক। একচুয়েলি পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে না যাদের জীবনে সুখ কোনোদিন আসে না? আমি হচ্ছি সেই মানুষদের কাতারে পড়ি। ”

সময় নিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলল সাদিফ। চোখ দু’টো জল দ্বারা পরিপূর্ণ। নিজেকে সামলে কিয়ৎ হেঁসে শুধাল,

-” ভালো থাকুন তীরু। খুব সুখে থাকুন। দোয়া রইল আপনার জন্য। আসি তবে। ”

বিল পে করে সাদিফ চটজলদি পা বাড়াল। তীরু তখন নির্জীব। সাদিফের চলে যাওয়া দেখছে। এই ছেলেটা তার কেওই না। তবুও কেমন খারাপ লাগা কাজ করছে। ছেলেটা কি কখনোই সুখী হবে না পৃথিবী? ও আওড়াল,

-” পৃথিবী, তুমি ছেলেটার দুয়ারে একটুখানি সুখের পরশ লাগাও। একটুখানি শান্তি দাও ওকে। ভালো মানুষ গুলো কেন সবসময় দুঃখী হয়ে রবে? ”

_

প্রিয়কে টুকটাক সাহায্য করছিল তীরু। মলিন হয়ে রয়েছে মুখোশ্রী। মন খারাপের কারণটা অবশ্য সাদিফ! ওর কথা মাথায় আসলেই বুক ভারী হচ্ছে। খারাপ লাগছে প্রচন্ড! সাদিফের অতীত সম্পর্কে ও অবগত। ছেলেটা কতই না কষ্ট পেল ফেলে আসা দিনে। এখন একটু কি সুখ পাবে না?
বাসায় ফেরার পর ঘন ঘন কিচেনে যাতায়াত করছে অরোন। তীরুকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। মেয়েটা আজ সে বাড়ি ফেরার পরও একবার রুমে গেল না। শেষে অধৈর্য হয়ে নিজেও বেড়িয়ে এসেছে অরোন। নিষ্প্রভ তীরুকে দেখে চমকেছে ও! মেয়েটার হলো টা কি?

কাজের মাঝে হটাৎ পেছন তাকাল প্রিয়। অরোনকে দর্শন করা মাত্রই শুধাল,

-” কিছু লাগবে ভাইয়া? ”

-” উহ্, মাথা ধরেছিল একটু। কফি হবে? ”

-” এক্ষুণি দিচ্ছি। তুমি ততক্ষণে রুমে গিয়ে বসো ভাইয়া। ”

মাথা নাড়াল অরোন। শেষবারের মতোন তীরুর পানে তাকাল। মেয়েটা পিছন তাকিয়ে তাকে একটু দেখল অব্দি না। কেমন গায়ে লাগল বিষয়টা। পা ফেলে জায়গাটা ছেড়ে রুমে চলে গেল ও।

কফি বানানো শেষ হতেই প্রিয় তীরুর কাঁধে হাত রাখল। আলগোছে কান থেকে ইয়ারপড খুলে তীরু জিজ্ঞেস করলো,

-” কিছু বলবে প্রিয়? ”

-” অরোন ভাইয়া এসেছিল ভাবী। কফি চাইলো। তুমি একটু দিয়ে আসবে প্লিজ? ”

-” শিয়র! আমার কাছে দাও। ”

অরোনের আজ খোঁজ খবর নেয়া হয়নি। নিজের খামখেয়ালিপনাতে বিরক্ত হলো তীরু! ভাবনায় ডুবে থাকা দুনিয়া ভুললে চলে? অরোনটা কি ভাবছে কে জানে।

-” আপনার কফি। ”

অরোন শার্টের টপ দু’টো বোতাম খুলে সবে মাত্র গা এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়। চোখ দু’টো ক্লান্তিতায় মুদে এসেছে। তীরুর কণ্ঠ শ্রবণ মাত্রই চট করে উঠে বসল। ভ্রু কুঁচকে তীরুকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল,

-” তোমার হয়েছে টা কি বলো তো? ”

অরোনের হাতে কফির মগ দিয়ে তীরু তার পাশে বসল। প্রশ্ন ছুড়ল,

-” এই কথা বলছেন কেন! আমি আবার কি করলাম? ”

-” মুখে এমন অমাবস্যার প্রলেপ কেন? কি হয়েছে?”

-” তেমন কিছু না। ”

তীরুর শুকনো উত্তরটা শুনে অরোন মগে ঠোঁট ছোঁয়াল। তীরুটা ভীষণ জেদি, চাপা! অনেকটা তার মতোই। নিজের অনুভূতি কাওকে জানতে দিতে চায় না। নিজেকে কেমন খোলসে আবৃত করে রাখে। আগে নাহয় সে অন্যরকম ছিল কিন্তু এখন তো খানিক বদলেছে নাকি? তীরুটা এখনও তার সাথে সহজ হতে পারল না! বিশ্বাস করতে পারল না!

-” ওকে বলতে হবে না। সবাইকে তো আর সবকিছু বলা যায় না। আই আন্ডারস্ট্যান্ড! ”

কণ্ঠে কেমন অভিমানের ছোঁয়া। তীরু ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। অরোন কেমন মেয়েদের মতো অভিমান করে বসে মাঝে মাঝে। হাসি পায় তার। নিজেকে স্বাভাবিক করে সাদিফের ব্যাপারটা খুলে বলে সে। অরোন মন দিয়ে শোনে পুরোটা। শেষে শুধায়,

-” আমাকে একটু পরিচয় করিয়ে দিও তো ওনার সাথে। ”

তীরু অবাক হলো! ” কেন? আপনার সাদিফকে দিয়ে কি কাজ। ”

-” তুমি যা যা বললে এতে মনে হলো উনি বর্তমানে খুব ডিপ্রেস’ড। আর মানুষ সবথেকে বেশি ভুল করে ডিপ্রেশনে থাকলে। এ মূর্হতে ওনার সু ই সা ই ড করার চিন্তা ভাবনা আসতে পারে আই থিঙ্ক। এমন সময় ওনার একটু মেন্টালি সাপোর্ট প্রয়োজন যেটা আমি দিতে চাচ্ছি। মানুষ তো মানুষের জন্যই। তাই নয় কি? আমি ওনাকে হেল্প করতে চাই। ”

বিমোহিত হলো তীরু! অরোন, ছেলেটা সম্পূর্ণরূপে আলাদা। সে শুধু একদিকের নয় সবদিক নিয়েই ভাবে। পার্ফেক্ট দায়িত্ববান ছেলের সংজ্ঞা তীরুর জানা নেই কিন্তু এই উপাধিটা যদি অরোনকে দেয়া হয় তবে বোধহয় খুব বেশি ভুল হবে না।

তীরু নম্র কন্ঠে বলল,

-” আজ আপনার মা বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন জানেন? আপনাকে নিয়ে অনেক গর্ব বোধ হতো তার। ”

অরোন এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাতের কফি মগটা বাড়িয়ে দিল তীরুর পানে। এখনো অর্ধেকাংশ কফি বাকি। তীরু তা দেখে বলে উঠলো,

-” আরেহ্ সবটুকু শেষ করুন। অযথা ফেলবো কেন? ”

-” এতটুকু তোমার। ”

-” আমার? ”

-” হ্যা। আমার সবকিছুতেই তোমার অধিকার আছে। অর্ধেকাংশ আমার আর বাকিটা তোমার। কিন্তু এই আমিটা কিন্তু সম্পূর্ণরূপে তোমার। ”

তীরু লাজুক হাসল। অরোন মুগ্ধ নয়নে শুষে নিল তার লাজুকলতার লজ্জা পাওয়ার লহমা।

চলবে~

#যেখানে_পথচলা_শুরু |২২|
সাদিয়া মেহরুজ

তীরু ল্যাপটপে ব্যাস্ত। হাতের আঙুল ব্যাস্ত ভঙ্গিতে চলছে কি-বোর্ড এর ওপর। ফোনে নোটিফিকেশন এলো। ই-মেইল এসেছে। ব্যাস্ত তীরু ফোনটা হাতে নেয়া মাত্রই তার মুখোশ্রীতে ছেপে গেল হৃষ্টচিত্ততা।
অফিস থেকে নয় দিনের ছুটি দেয়া হয়েছে। সকাল হতে সে ব্যাকুল মনে সে এই ই-মেইল এর অপেক্ষায় ছিল। হাত ফোন রাখল তীরু। অবশেষে তার বহুদিন যাবৎ গড়ে তোলা স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে। হাতে তার তিন মাসের বেতন জমা। ভিসা থেকে শুরু করে পাসপোর্ট সহ বাকিসব কিছু গুছিয়ে রাখা আছে। তীরুর সেই যে ছোট্টবেলার স্বপ্ন, আকাঙ্খা, চোখ ভরা সুখের লেলিহান। তা একটু একটু করে আজ পূরণ হওয়ার পথে। সৃষ্টিকর্তা যদি কাওকে সৃষ্টি করার পূর্বে জানতে চাইতো, সে কি হয়ে পৃথিবীতে প্রবেশ করতে চায়? তাহলে তীরু বিনাবাক্যে পাখি হতে চাইতো। পাখির মতো মুক্ত আকাশে উড়ে তার দুনিয়া দেখার শখ, স্বপ্ন! পৃথিবীতে যদি এই সংসার করা নামক ধরা বাধা নিয়মটা না থাকতো তাহলে ও পাখি হতো, যে পাখি ঘর বোঝেনা, যার কাঁধে নেই কোনো দুশ্চিন্তা, যার মনে নেই কোনো দুঃখ।

-” তীরু আসবো? ” মিহি কণ্ঠস্বর।

দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করলো তীরু। দৃষ্টিপাত ছুড়লো সম্মুখে। হাতে ধোঁয়া ওঠা দু’টো কফি মগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরোন। তাকিয়ে রয়েছে উত্তরের আশায়। তীরু ল্যাপটপ তড়িঘড়ি করে বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলে উঠলো,

-” আরেহ্ আসুন না। আপনারই তো বাসা। নিজের বাসা, নিজের রুমে আসতে অনুমতি চাওয়ার কি আছে? ”

পা দিয়ে দরজা ঠেলে অরোন ভেতরে প্রবেশ করল। মুখোবয়বে কিয়ৎ অসন্তুষ্ট ভাব। তীরু অবাক! এই তো ভালো ছিল হটাৎ প্রতিক্রিয়া কেন বদলালো? সে কি কোনো ভুল কিছু বলল নাকি!

-” নাও। ”

কফির মগটা হাতে তুলে নিতে নিতে তীরু শঙ্কা নিয়ে শুধাল,

-” আমার কোনো কথায় কি কষ্ট পেয়েছেন? ”

অরোন ভারী কন্ঠে জবাব দিল,

-” বাড়িটা একার আমার না। তোমারও। নেক্সট টাইম এভাবে কখনো বলবে না। মনে থাকবে? ”

অন্তরালে কিয়ৎ হাসল তীরু। অরোনটা না! ভয় পাইয়ে দেয় তাকে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে অভিমান করে বসে, আশ্চর্যজনক ব্যাপার! তীরু ধাতস্থ হয়ে বলল,

-” মনে থাকবে স্যার। ”

ডিভানে গিয়ে বসল অরোন। ইশারায় তীরুকে পাশে বসতে বলল। ভারী দুশ্চিন্তা নিয়ে তীরু তার পাশে বসলো। দেশের বাহিরে যাওয়ার ব্যাপারটা অরোন কে এখনো বলা হয়নি। সাহস জুটেনি! অথচ গরুর মতো একগাদা টাকা অপচয় করে ভিসা, পাসপোর্ট করে বসে আছে! এখন যদি অরোন অনুমতি না দেয়? তাহলে তো টাকাই যাবে জলে। অরোন যেতে নিষেধ করলে তীরু যাবে না। এই শক্ত ধারণাটা ও মাথায় গেঁড়ে নিয়েছিল। ছেলেটার প্রতি দূর্বল সে। এখন অরোন যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও সে টু শব্দটি করবে না। জলাঞ্জলি দেবে নিজের স্বপ্নের! তবুও অরোনের কথার হেরফের করবে না। তার পক্ষে সম্ভব নয়! এতো কষ্টে ঠিক করা সংসারটা নষ্ট হোক সে চায় না। একটুও না।

তীরুকে ভাবুকতায় ডুবে থাকতে দেখে অরোন বলে উঠলো,

-” আজ তুমি বাসায় যে? অফিস নেই? ”

-” উঁহু। নয় দিনের ছুটি দিয়েছে। তিন মাস এতো চাপ গেল! হলিডেতেও তো কাজ করতে হয়েছে। তাই ছুটি দিয়েছে। এখানে তিন মাস পর পর নয়, দশ দিন করে ছুটি দেয়। আরেকটু সিনিয়র আর পাকাপোক্ত হলে ছুটির দিন বাড়িয়ে দেয়। জুনিয়র আর নতুনদের জন্য ছুটি কম। ”

-” ওহ আচ্ছা। লম্বা ছুটি পেলে। কোথাও যাওয়া উচিত তোমার রিফ্রেশমেন্টের জন্য। ঘরে বসে থেকে লাভ কি? ”

মোক্ষম সময়! তীরু অন্তরালে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো এ ব্যাপারে বলার। অমনি ফোনের রিংটোনের শব্দে ধস নামল কক্ষের নীরবতার। তপ্তশ্বাস ফেলল তীরু! তিতকুটে বিরক্তিটা গলায় গেঁড়ে বসেছে। ফোন হাতে নেয়ার পর দেখল মায়ের ভিডিও কল।

-” অরোন বাবা ভালো আছো? ”

তানহা অরোনের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত! পাংশুটে বর্ণের চেহারা নিয়ে অরোনের পাশটায় বসল তীরু। দিলো তো মা সব পন্ড করে! তার ওপর কল দিয়ে তীরুকে দূর দূর করে তাড়িয়ে অরোনের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত। তীরুকে দেখেও যেন দেখল না। রাগ হয় তীরুর! এতদিন পর কল দিয়ে এমন ব্যাবহার? বুকের ভেতরে তৈরি হয় অভিমানের কুন্ডলী। ওদের কথা চলে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হটাৎ তানহা বাম দিকে দৃষ্টি ফেলেন।তীরুকে চুপটি করে বসে থাকতে দেখে শুধান,

-” কিরে তীরু, মায়ের খোঁজ খবর নিলি না? এতদিন পর ফোন দিলাম। আমি কেমন আছি না জিজ্ঞেস করে এমনে থম মে রে বসে আছিস কেন? ”

তীরু অদ্ভুত দৃষ্টিপাত ফেলে। মেয়ের মনোঃবস্থা বুঝতে বেগ পেতে হয় না তানহার। আসন্ন অবস্থা বিবেচনায় রেখে তৎক্ষনাৎ বললেন,

-” আম্মা ভালো আছো? চোখমুখের এই হাল কেন আম্মা? ঘুমাও না? ”

তানহার দশা ভেজা বেড়ালের মতো। অভিমান বুকে চেপে তীরুর হটাৎ হাসি পেল খুব! হাসল না তবুও। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে গম্ভীর গলায় বলল,

-” ভালো আছি। ”

তীরু যে এখন সহজ হয়ে কথা বলবে না তা ভালই টের পেলেন তানহা। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। তার মেয়েটা হয়েছে ভারী অভিমানী। একদম তার মতো। তুচ্ছ বিষয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে! হাত পায়ে বড় হওয়ার পর অবশ্য স্বভাবের ক্ষীণ উন্নতি এসেছে। কিন্তু তার বেলায় যেই সেই! পরিবেশ স্বাভাবিক করতে এবার তিনি বললেন,

-” তা বাবারা, বিয়ের তো কম দিন হলো না। আমি কি নাতি – নাতনির মুখ দেখে কবরে যেতে পারবো না? ”

কাজ হলো বৈকি। তীরুর গম্ভীরতা কাটল। মুখোশ্রী জুড়ে শোভা পেল লাজুক আভা। অরোনের বিষম উঠেছে। ও আঁড়চোখে তাকাল তীরুর পানে। কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে শুধাল,

-” নাতি – নাতনির মুখ দেখবেন কি করে মা? আপনার মেয়ে তো আসল কাজই করতে দিলো না। কাছে গেলেই তো প্রজাপতির মতো ছুটে পালায়। ”

তীরু স্তম্ভিত! আঁখি জোড়া বড়সড় করে তাকালো অরোনের পানে। অরোন উঠে দাঁড়িয়ে কৃত্রিম হেঁসে বলল,

-” আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি। একটু কাজ পড়ে গেছে। জরুরি! ”

তানহার থেকে বিদায় নিয়ে অরোন দরজার কাছে গেল। পেছন ফিরে ইশারায় বলে উঠলো,

-” আমার কিন্তু আপত্তি নেই তীরু মা কে নাতি নাতনির মুখ দেখাতে। তুমি রাজি থাকলে মিশন শুরু করতে পারি। ”

গাল দু’টো গরম হয়ে রয়েছে! হাত দু’টোর বেসামাল কাঁপুনি টের পাচ্ছে তীরু। লজ্জায় নত মস্তকে বসে রইল। তানহার বলা আর কোনো কথা তার কান দিয়ে ঢুকলো না।

_

অরোনের দেখা মিলল দুপুরে। তীরু ছোট্ট বিড়াল ছানার মতো অরোনের পিছু পিছু ঘুরছে। সেদিকে ধ্যান নেই অরোনের। বেচারা ভারী ব্যাস্ত! ফোনে কথা বলছে। কাওকে কর্কশ কন্ঠে ঝাড়ি দিচ্ছিলো! হতাশ হয় তীরু। হাসঁফাসঁ করছে সে। অধৈর্য হয়ে পিছু ঘোরা বন্ধ করলো। গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে অরোনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল,

-” নি ষ্ঠু র মানুষ! পিছে যে সুন্দরী বউ ননস্টপ ঘুরে যাচ্ছে সেদিকে ধ্যান নেই তার। ”

কল কে টে দিয়েছে অরোন। তীরুর কথায় ঠোঁট চেপে হাসল। বলল,

-” নিজের প্রশংসা নিজে করছো। লজ্জা করে না? ”

-” মানুষ তো করে না। তাই নিজেই করি। এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে, আশ্চর্য! ”

প্রসঙ্গ পাল্টাল অরোন। ” তুমি কি কিছু বলতে চাচ্ছিলে? ”

লম্বা দম নেয় তীরু। বলে,

-” অফিস বন্ধ। তাই চাচ্ছিলাম একটা ট্যুর দিব। যদি আপনি অনুমতি দেন তবেই। ”

-” এ ব্যাপারে তো সকালে আমিই বললাম। যাও! এতে অনুমতি চাওয়ার কি আছে? ”

-” একচুয়েলি আমি প্যারিস মানেহ ফ্রান্সের বাহিরে যেতে ইচ্ছুক। ভিসা, পাসপোর্ট যাবতীয় সবকিছু ম্যানেজ করা শেষ। ” মিনমিনে কণ্ঠ!

তীরু আগ্রহ নিয়ে তাকালো। অরোন মৌন। তার মুখোশ্রী ভার ভার হয়ে! নিজেকে ভৎসনা করলো তীরু, ইশ! কেন যে অরোনকে না জানিয়ে এসব বাড়াবাড়ি করতে গেল। ছেলেটা কি ভাবছে এখন? অরোনের প্রতিত্তুরের আশায় তৃষ্ণার্থ কাকের মতো তাকিয়ে রইল তীরু। বক্ষঃস্থল তার শুকিয়ে কাঠ!

চলবে~