যেখানে পথচলা শুরু পর্ব-২৭+২৮

0
285

#যেখানে_পথচলা_শুরু |২৭|
সাদিয়া মেহরুজ

সেলফোন বাজছে। তানহা কিচেন থেকে স্পষ্টত শুনতে পাচ্ছেন। প্রকোট গরমে নাস্তানাবুদ তানহা হাতের কাজ ফেলে যাওয়ার সুযোগটা অব্দি পাচ্ছে না। রান্না চড়িয়েছে চুলোয়। এ মূর্হতে রান্না ফেলে গেলে খাবার পুড়ে ছাই হবে! অনবরত কল আসতে থাকায় শেষে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে চুলো থেকে পাতিল মেঝেতে রেখে ছুটলেন ফোনের নিকট। তীরু কল দিয়েছে। যতটা বিরক্তি নিয়ে তিনি ছুটে এসেছিলেন তার থেকে দ্বিগুণ প্রশান্তি নিয়ে কল রিসিভ করে কানে ধরলেন। আহ্লাদী গলায় বলে উঠলেন,

-” কেমন আছে আমার আম্মা? ”

ফোনের অপর পাশ হতে তীরু তানহার করা প্রশ্নের উত্তর দিল না। চটপট আওড়াল,

-” পেছন তাকাও তো মা ”

তানহা হতভম্ব! কানে ফোনটা চেপে রেখেই পেছন তাকালেন। লহমায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিনি! হাত হতে ফোনটা স্ব-শব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। চক্ষুজোড়া যেন মেনে নিতে পারছেনা সামনে দেখা দৃশ্য। অক্ষি কোটরে লহমায় হানা দিলো জলেরা। অধর যুগল তিরতির করে কাঁপছে। বক্ষঃস্থলে কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে তার! মস্তিষ্ক অচল। এতদিন পর একমাত্র সন্তানকে দেখে তিনি যেন মূর্তি বনে গেছেন। ইচ্ছে করছে পুতুলটাকে বুকে ঝাপটে ধরতে। কিন্তু নড়তে যে পারছে না। কি জ্বালা!

তীরু তার বত্রিশটি দাঁত বের করে সুন্দর এক হাসি দিলো। মায়ের হাল দেখে আনন্দ হচ্ছে! ঠিক এই রূপটা দেখার জন্যই তো কিছু না জানিয়ে এসেছে সে। হ্যান্ডব্যাগটা সোফায় ছুড়ে ও ছুটল। তানহাকে ঝাপটে ধরতেই চিরচেনা সেই ‘ মা, মা ‘ গন্ধটা কানে এসে ঠেকলো। শরীর কেঁপে উঠল! তানহার বুকে মুখ গুঁজে তীরু আহ্লাদী কন্ঠে শুধাল,

-” এতদিন পর এলাম আমি। আমায় দেখে এমন চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছো কেন মা? জড়িয়ে ধরবে না আমায়? ”

ভীষণ কষ্টে নিজের স্তব্ধতা কাটাল তানহা। মেয়েকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মনকে শক্ত রাখার প্রয়াস তার বৃথা গেল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। করুণ কন্ঠে আওড়ালেন,

-” আম্মা আমার আম্মা! তুই যে আমার বুকে আছিস এটা আমার বিশ্বাস হয়না। এতদিন পর আমার বাচ্চা আমার বুকে ফিরে আসছে। ”

তীরুর মুখটা সামনে তুলে তানহা চুমু খেলেন। দূরে দাঁড়িয়ে তখন অরোন। সদর দরজার কাছটায়। চুপটি করে দাঁড়িয়ে মা – মেয়েকে দেখছে। অন্তরালে প্রশান্তির রাজ। কি যে দারুণ লাগছে দৃশ্যটা! অধর প্রসারিত হয়ে ফুটে উঠল মিষ্টি হাসি। আঁখিজোড়ায় জলে টইটম্বুর। আড়ালে চোখ দু’টো মুছে নিলো ও। মায়ের কথা মনে পড়ছে তার। বুক জ্বলছে দাউদাউ করে! তীরুর মতো তারও মায়ের কোলে ঘাপটি মে রে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সকল ইচ্ছে যে পূরণ হবার নয়। প্রকৃতির এ এক কঠিন নিয়ম!

তানহার হটাৎ দরজায় নজর গেল। অরোন দাঁড়িয়ে রয়েছে। ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। তীরুকে সরিয়ে খানিক শাসন করলেন,

-” এটা কেমন কথা তীরু? জামাই দরজায় দাঁড়ায় আছে! তুই ওরে ঘরে বসাবি না আগে? অরোন বাবা ঘরে আসো। ওখানে দাঁড়ায় কেন? ”

এগিয়ে এলো অরোন বিনা শব্দে। তানহার নিকট পৌছে নম্র কন্ঠে বলল,

-” আসসালামু আলাইকুম আম্মা। কেমন আছেন? ”

-” ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। আমি তো ভালো আছি বাবা। তীরু আসছে, তুমি আসছো এখন খুব ভালো আছি। কিন্তু তোমার এই অবস্থা কেন বাবা? শুকায় গেছো অনেক। খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করো না? ”

অরোনের প্রতিত্তুর করার পূর্বে তীরু ঠোঁট বাঁকিয়ে জবাব দিলো,

-” খাওয়াদাওয়া করার টাইম আছে নাকি ওনার? সারাক্ষণ ছোটাছুটির ওপর থাকে। খেতে বসলে মনে হয় এক যুগ চলে যাবে তার। ”

তানহা চিন্তিত গলায় শুধালেন,

-” এটা তো ঠিক না বাবা। ঠিক মতো না খেলে তো অসুস্থ হয়ে যাবা। ”

মৌন রইল অরোন। নতজানু অবস্থায় কিয়ৎ হাসল। তীরুর পর দ্বিতীয় কোনো নারী, যার শাসনে মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেল।

তানহাকে আপাদমস্তক দেখে তীরু গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,

-” অরোনকে বলছো তোমার নিজের অবস্থা কি? ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া তো আমি থাকতেউ করতে না। মেয়ে হয়ে মাকে বলে বলে খাওয়ানো লাগতো। তৈরি হও! এবার আমরা একা যাচ্ছি না। তুমিও যাচ্ছো সঙ্গে। পার্মানেন্টলি! আমি সব প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। ”

_

পুকুরপাড়ে পা ডুবিয়ে বসে আছে তীরু। আঁখি দুটো নিবদ্ধ আকাশপানে। নীলাকাশে পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘের বিচরণ। নাম না জানা এক দল পাখি অতি সুখে উড়ছে অম্বরে। রোদ পড়েছে। রোদের তেমন তেজ নেই। সবুজাভ প্রকৃতিতে সোনালি আভাদের অবাধ ছোটাছুটি। মাঝেমধ্যে মিষ্টি দখিনা বাতাসে দুলে উঠছে গোটা ফসলের ক্ষেত। শা শা শব্দ! কানে কেমন মধুর শোনায়। বৃষ্টি হয়েছিল দুপুরে। সিক্ত মাটির নিদারুণ গন্ধে মো মো করছে চারিপাশ। বৃষ্টি হওয়ার পর আশপাশটা সজীবতা ফিরে পেয়েছে। ধুলোবালি ধুয়ে মাটিতে মিশেছে। দৈত্যস্বার গাছের পাতা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে জল। বাতাবরণে যেন এক মোহনীয়, শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের বিচরণ! কেঁপে উঠে তীরু। মনে পড়ে শৈশব। জড়তা ঠেলে পা দু’টোর স্থিরতা ভাঙে সে। পানিতে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়! সেই ঢেউ তোলা পানিতে নিজের অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব দেখে আনমনে হয়ে রয় ও৷

ভারী পা ফেলার শব্দ! তীরু হুঁশে এলো। পেছনে তাকানোর পূর্বে তার পাশে এসে বসলো অরোন। কিয়ৎ রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

-” এলাম এগারটায়। সেই থেকে স্থির নেই তুমি। খেয়ে ছুটলে টো টো করে ঘুরে বেড়াতে। একটু রেস্ট নেয়া যায় না? অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন কি হবে? ”

তীরু বুক ফুলিয়ে জবাব দিলো,

-” এতটুকুতে তীরু অসুস্থ হয়না। তীরু শক্ত মেয়ে! ”

অন্তঃকরণে হাসলেও বাহিরে শক্তপোক্ত ভাবটা ধরে রাখলো অরোন। তীরু তার বাহু আঁকড়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। এতক্ষণ যাবৎ কেমন খা খা করছিল তার হৃদয়! কিসের এক শূন্যতা, বিষন্নতা ঝাপটে ধরেছিল অন্তরালকে। অরোনের কাঁধে মাথা রাখার পর সবটা কেমন চট করে হাওয়ায় উবে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো লহমায় গায়েভ হয়ে গেল! ছেলেটা জাদু জানে কি? মন ভালো করার জাদু।

গলা পরিস্কার করলো অরোন। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের গম্ভীরতা, রগচটে ভাবটা অদৃশ্য করে শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-” কি কালার গরু কিনবো? ”

হতবিহ্বল তীরু! ছেলেটা এ কেমন প্রশ্ন করছে? কন্ঠে বিষ্ময়তা ঝাড়ল ও,

-” এটা কেমন প্রশ্ন? ”

-” সহজ প্রশ্ন। গরু কিনতে যাচ্ছিলাম। তোমার একটা পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার আছে না? বলো কি রঙের গরু আনবো? ”

আকস্মিক ঘটনায় থ বনে রইল তীরু। এহেন প্রশ্নে সে হাসবে নাকি কাঁদবে বোধগম্য হচ্ছে না। দ্বিধার প্রহর কাটিয়ে বলে উঠলো,

-” গরুর রঙে কিইবা আসে যায় অরোন? একটা আনলেই তো হয়। পছন্দ বললে গরুর ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা সম্ভব না। আমার নীল রঙ পছন্দ। এই রঙের গরু কি পৃথিবীতে আছে নাকি! ”

অরোন ভাবুক গলায় শুধাল, ” নেই তবে তুমি চাইলে গরু কিনে তারপর নীল রঙ কিনে রঙ করে দিতে পারি। এর মধ্যে গরু গুঁতো না দিলেই হলো। ”

তীরু শব্দ করে হাসল! অরোন বিমুগ্ধ নয়নে দেখল ওকে। মেয়েটার মনের হাল যে ভালো ছিলনা তা সে এখানেই এসেই বুঝতে পেরেছে। তাই উল্টোপাল্টা প্রলাপ বকে একটুখানি স্বাভাবিক করার প্রয়াস।

তীরু হাস্যরত অবস্থায় বলল,

-” যাহ পাগল! ভুলেও এ কাজ করতে যেয়েন না কিন্তু। ”

_

-” দাঁড়ান অরোন। ”

তীরু ছুটে এলো। হাতে পায়েশের বাটি। অরোন ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

-” ছোটাছুটি করছো কেন? ”

-” ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে মিষ্টি কিছু খেয়ে যেতে হয়, জানেন না? খালি মুখে বের হচ্ছেন কেন আশ্চর্য! দেখি হা করুন। ”

-” দেরী হয়ে যাচ্ছিল। “এক চামচ পায়েশ মুখে নিয়ে তা চিবুতে চিবুতেই প্রতিত্তুর করে অরোন। মুখের খাবার শেষ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

-” পায়েশ কি তুমি রান্না করেছ? ”

-” হ্যা অবশ্যই। কেমন হয়েছে? ফিডব্যাক দিন। ”

তীরুর হাত থেকে বাটি নিয়ে আরো দুই চামচ খেলো অরোন। জুতো পড়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,

-” এসে বলবো। ”

গাল ফুলিয়ে দরজা লাগায় তীরু। একটা শব্দ বলে গেলে এমন কি হতো?

নামাজ শেষে অরোন যখন ফিরে এলো তখন সে তীরুকে টেনেটুনে ঘরে এনে হাতে মেহেদী দিতে বসলো। সেই যে তীরু বকবক করছে বাহিরে যেতে ছেলেটা শুনলে তো! সে একমনে তীরুর হাতে আকি বুকি করতে ব্যাস্ত। ক্লান্ত হয়ে চুপ রয় তীরু। অরোন তার কাজ শেষে হাত থেকে মেহেদী টিউবটা ফেলে উঠে দাঁড়ায়। বলে,

-” ইদের দিন খালি হাত নিয়ে ঘুরলে ভালো দেখায় না। বাহিরের কাজ এমনিতেও বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি আমি অন্যদের। এবার নিজে যাচ্ছি। শান্তি? ”

তাড়া দিলো তীরু। ” দ্রুত বের হোন। ”

হাত দু’টোতে নজর বুলিয়ে তীরু হাসল। ছেলেটা খারাপ মেহেদী দেয়নি। সুন্দর হয়েছে বেশ! এতোটা চমৎকার তীরুরও হয়না।

বাহিরে কাজে ব্যাস্ত অরোন। তখন কোথা থেকে ছুটে আসে তার বোন। তাকে দেখে অবাক হয় সে। কেমন বিধস্ত লাগছে মেয়েটাকে। অরোন চটজলদি বোনকে আগলে নিয়ে শুধায়,

-” আপু তুই এখানে? কখন এলি? ”

উন্মাদের মতো লাগছিল বোনটাকে। কেমন যেনো এলোমেলো সবটা! বোনের ভীতসন্ত্রস্ত মুখোশ্রী দেখে অরোনের হৃৎস্পন্দন বাড়ে। চিন্তা হয়। প্রশ্ন ছুঁড়বে অমনি তার বুকের কাছে গুটিয়ে থাকা মেয়েটা হুট করে যন্ত্রের মতো বিড়বিড়িয়ে উঠল,

-” বাবা, বা..বাবা দোষী অরোন। বাবা মায়ের মতো আমাকেও মে রে ফেলবে। ঐ লোক গুলো আসছে, আমাকে নিয়ে যাবে। আবার মা র বে। আমি যাবো না। তুই আমাকে তোর কাছে নিয়ে যা। ”

চলবে~

#যেখানে_পথচলা_শুরু |২৮|
#লেখনীতে_সাদিয়া_মেহরুজ

তিমিরাবৃত রজনী। কলুষিত আঁধার বাতাবরণ জুড়ে আষ্টেপৃষ্টে লেপ্টে রয়েছে। ঘোরতর অমাবস্যা আজ। বাতাসের তোড়ে বাঁশঝাড়ে শো শো শব্দ হচ্ছে। গা ছমছমে পরিবেশ। রক্ত হীম করা নীরবতা! দুরুদুরু করে বুক কাপেঁ তীরুর। পা দু’টো থেমে যেতে চায়। ভীষণ কষ্টে, বুকে সাহস জুগিয়ে পুনরায় পা ফেলে হাঁটা ধরে। থামলে যে চলবেনা। অরোনকে খুঁজতে হবে। ছেলেটা বাড়িতে নেই। বিকালের পর হুট করে কোথায় যে উধাও হলো! ধরনী জুড়ে আঁধারের কালিমা সেঁটে যাওয়ার পরও ছেলেটার দেখা নেই। চিন্তা হয় তীরুর। হৃদয়ে কু ডাকে। ছটফটে মন নিয়ে চট করে মা’কে বলে ছুট লাগায়। তানহা একা যেতে নিষেধ করেছিল তাকে। নিষেধাজ্ঞা কানে নেয়নি ও। এখন মনে হচ্ছে মস্ত বড় ভুল হয়েছে! অস্থিরতার সময় কেন যে মাথাটা কাজ করা বন্ধ করে দেয়, ইশ!

‘ ও আল্লা গো..’ কারো আর্তনাদ ছিটকে এলো! ভীত হলো তীরু। পদচারণ থামাল। আশপাশে ঘন ঘন নজর বুলাল। গোঙানির আওয়াজটা এখনও কানে এসে লাগছে। কে কাঁদছে? শুনে তো মনে হলো সে কোনো পুরুষ। গলায় পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা বুকে চেপে ধরে তীরু এগোয়। কৃত্রিম আলোর পসরা বসেছে রাস্তায়। ফোনের টুংটাং নোটিফিকেশন তাকে জানান দিচ্ছে এই কৃত্রিম আলোর পসরা আর থাকবেনা বেশিক্ষণ। অতএব, দ্রুত নিজের কাজের সমাপ্তি টানতে হবে। যত পা ফেলে এগোচ্ছে তত গোঙানির আওয়াজটা দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হচ্ছে! বেশি দূর যেতে হলো না তীরুর। দুকদম এগোতেই দৃশতর হলো আকাঙ্খিত মুখোশ্রী। তবে স্বাভাবিক রূপে নয়। তীরুর পায়ের গতি কমলো। স্তব্ধ নয়নে দেখল সম্মুখের দৃশ্য, অরোনের হিংস্র মুখখানি। অস্ফুটে ও আওড়াল,

-” অরোন! ”

পূর্বদিকে কৃত্রিম রশ্মির পসরা বসেছে। ফ্লাশলাইটের ধবধবে সাদা আলোয় স্পষ্টত অরোনের হিংস্র, ক্ষুদ্ধ মুখোশ্রী। হাতে মোটা বাঁশ। সেটা দিয়েই কাওকে ক্রমাগত আ ঘা ত করে যাচ্ছে। ওদিকটা জনশূন্য। তেমন বাড়িঘর নেই। তাইতো লোকটার করুণ আ র্ত না দ কারো কানে পৌঁছাচ্ছে না।অরোন হুঙ্কার ছেড়ে অশ্রাব্য ভাষায় কিছু বলছে। পাশে অন্তিক দাঁড়িয়ে। মুখে বিরাজ করছে তার আতঙ্ক, ভয়! থরথর করে কাঁপছে ঠোঁট দু’টো। তীরুর মতো অন্তিকটাও কি অরোনের এই রূপটা হজম করতে পারছেনা? হয়ত! হয়ত তাই হবে। চিরদিনের লৌহ শান্ত মানুষটার হটাৎ কোনো হিংস্র রূপ দেখলে যে কারোরই থমকানোর কথা। ধানক্ষেতটার আড়ালে আর স্তব্ধ রূপ নিয়ে থাকতে পারেনা তীরু। মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে ওঠে। লম্বা পা ফেলে ছোটা শুরু করে গিয়ে ঝাপটে ধরে অরোনকে। টের পায় অরোনের দেহের কাঁপুনি। সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে তখনো। তবে তীরু হুট করে জড়িয়ে ধরাতে কিছুটা শান্ত রূপে ফিরে এসেছে। তবে কন্ঠে ক্রোধ ঢেলে শুধায়,

-” এখানে কি করছো তুমি? রাতের বেলা বাহিরে কেন বের হয়েছ? ”

কেঁপে উঠল তীরু! অরোন ধমকাচ্ছে! তাও তাকে? ভয় হচ্ছে তীরুর। অন্তরালে হিমাগারে রূপান্তরিত হয়েছে। আস্তে ধীরে অরোনের বুক থেকে মাথা তুলে চোখে চোখ রাখল। ভীষণ কোমল গলায় বলল,

-” কি হয়েছে তোমার? কেন মা র ছি লে লোকটাকে বলো তো? তোমাকে চিনতে পারছিনা আমি। এ যেন এক অন্য অরোন। হিংস্র লাগছে বড্ড! বলোনা কি হয়েছে? ”

আঁধারে হটাৎ ধূমকেতুর মতো তীরুকে ছুটে আসতে দেখে আশ্বস্ত হয় অন্তিক। মনের আতঙ্কটুকু কিছুটা কমে। এগিয়ে যায় সম্মুখে। অরোনের সন্নিকটে গিয়ে বলে,

-” ভাই শান্ত হোন! এভাবে এই কু ত্তা দে র মে রে নিজের হাত অপবিত্র করবেন কেন? ওদের শাস্তি আল্লাহ দেবে, আদালত দেবে। আপনি দয়া করে থেমে যান ভাই। ”

-” কি করেছে ওরা? ” মাঝখানে ফোড়ন কাটে তীরু।

-” অরোন ভাইয়ের বোনকে ধ র্ষ ণ করতে চেয়েছে। তাছাড়া ওরা ভাইয়ের মা’কেও মে রে ছে। ”

বিমূঢ় তীরু! অরোনকে ছেড়ে সরে দাঁড়াল। অন্তিক টেনেটুনে নিয়ে গেল অরোনকে কিয়ৎ দূরে। ওখানে উপস্থিত বাকিরা ভূমিতে পড়ে থাকা আহত দেহ গুলোকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলছে। আহত দেহের সংখ্যা ছয়। সেদিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে একবার পরখ করে তীরু অরোনের নিকট এগোল। অন্তিক তাকে দেখা মাত্র তাড়া দিয়ে বলল,

-” ভাবি, আপনি ভাইয়ের কাছে বসেন। আমি ওদের থানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করছি। ”

-” ওদের সবাইকে কি অরোন মে রে ছে? ” তীরুর কন্ঠ কেমন অবিচল শোনাল।

অন্তিক জবাব দেয়, ‘ জী ভাবি। সবাইকেই কম বেশি মে রে ছে। আপনি আসার সময় যাকে মা র তে দেখলেন? ওনাকে বেশি মে রে ছে। বাকিদের টাইট মা র দিয়েছে ভাইয়ের ছেলেপুলেরা। ”

মূল ঘটনা জানতে ব্যাকুল হৃদয়স্থল! উত্তেজনায় হৃৎস্পন্দনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। অরোনকে দ্বিতীয় বার আর জিজ্ঞেস করতে হয়নি। তীরু তার পাশে গিয়ে বসতেই যন্ত্রের মতো কাটকাট গলায় শুধাল,

-” বিকেলে তনু আপু এসেছিল। আপুকে বিধ্বস্ত লাগছিল ভীষণ। আপু বারবার বলছিল, ওরা পিছে আসছে। আতঙ্কে আর কিছু বলার সুযোগ পায়নি। অজ্ঞান হয়ে গেছে। আপুকে হাসপাতালে পাঠিয়ে আমি ওদের নিয়ে বের হই। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল আমার এতো বছরের প্রতীক্ষা আজ শেষ হতে যাচ্ছে। মায়ের খু নী, তনু আপার বেহাল দশা! সব যেন একই সূত্রে গাঁথা। সন্দেহ ঠিক ছিলো। এরা আমার মা’কে মে রে ছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার কি জানো? বাবাও এতে সত্যিই জড়িত ছিলো। রাস্তায় বের হতেই আমি এদের দেখতে পাই। ওদের ধরে নিয়ে আসি এখানে। প্রথমে বলতে চাচ্ছিল না কিছু। পরে মা র ধ র করার পর সব স্বীকার করে। ”

অরোন থামল। হাসফাস করে উঠলো কেমন। তীরু ওর প্রশস্ত পিঠে হাত রাখল। লম্বা শ্বাস টেনে পুনরায় নির্জীব কন্ঠে বলল,

-” বাবা ই য়া বার ব্যাবসা করতো যখন আমাদের সংসারে অভাব অনটন চলছিল। এ কথা মা ছাড়া কেও জানতো না। এমনকি মাও এতে জড়িত ছিল। ই য়া বা পাচারে মা নিজেও সহায়তা করতো। অর্থ কষ্ট, সন্তানদের নিজের চোখের সামনে অনাহারে ভুগতে দেখা, নিজে অনাহারে, অসুস্থতায় ভোগার পরও চিকিৎসা করতে না পারা, চোখের সামনে নিজের বৃদ্ধ বাবাকে অসুস্থতায় ভুগতে দেখে তার জন্য কিছু করতে না পারা, এসব মাথায় এনে মা নিজেও জড়িয়ে যায় এই অন্ধকার জগতের সাথে। মা দ ক ব্যাবসা শুরু করার প্রথমদিকে খুবই অল্প পরিমাণে টাকা পেত। তা দিয়ে তেমন কিছুই হতো না। তবে দিন বাড়ার সাথে সাথে টাকার অঙ্কটাও বাড়তে থাকে। মা চাচ্ছিল নানার চিকিৎসা করিয়ে সে সরে আসবে এসব থেকে। আমাদের এই অবৈধ পথে অর্জন করা টাকা দিয়ে তিনি মানুষ করতে কখনোই চাইতেন না। তাই ছোট থাকতেই আমাদের কাজে পাঠিয়ে দেন। শুধুমাত্র নানার চিকিৎসায় মোটা অঙ্কের টাকা দরকার বলে বাবার কথায় রাজি হয়ে যায় মা। নানা দিনকে দিন সুস্থ হওয়ার বদলে অসুস্থ হতে থাকেন এবং একসময় মা রা যান। এর পর হতেই মা সরে আসতে চাচ্ছিলেন। মা বারবার মনে করতো তার জন্যই নানা মা রা গিয়েছে কারণ তিনি অবৈধ টাকা দিয়ে তার চিকিৎসা করিয়েছেন। মা বাবাকে বারবার বোঝাতে থাকেন এসব থেকে সরে আসার জন্য। কিন্তু ততদিনে বাবা টাকার নেশায় বুদঁ হয়ে গেছেন। শেষে মা না পেরে বাবাকে ব্লাকমেইল করতে থাকেন, তিনি পুলিশকে জানিয়ে দেবেন সবকিছু। আর এটাই মা’র জীবনে কাল ডেকে আনে। বাবা অন্যান্য ই য়া বা পাচারকারীদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেন এবং তারা সিদ্ধান্ত নেয় মা’কে মে রে ফেলা হবে। বাবা নেশা করতো। তাই তাকে যা বলা হতো তাই করতো। যথাসময়ে মা কে মে রে ফেলা হয়। ই য়া বা পাচারের কাজ তাই কিছুদিনের জন্য বন্ধ রেখে তারা পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো শুরু করে। তখন পুলিশ, র‌্যাবের তৎপরতা বেশ বেড়ে গিয়েছিল তাই। সবকিছু এতো সুক্ষ্মভাবে করা হয় যে কোনো কিছুরই সমাধান করতে পারেনা পুলিশ, না র‌্যাব না এনএসআই এর কর্মকর্তা! এরা তারাই ছিল যারা মা’কে মে রে ফেলার কুবুদ্ধি সবার মাথায় ঢোকায়। ওদের নজর এখন তনু আপার পড়েছিল। ”

কাছে পাশে কোথাও ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। কান এঁটো করা শব্দ। মাথা ধরে যায়। অন্যান্য সময় হলে তীরু বিরক্তিতে চেঁচাত! কিন্তু এখন, সবকিছু যেনো অনুভূতিশূন্য, নিষ্প্রাণ।বুকটা নীল বেদনায় হাহাকার করছে! অরোনের জন্য মন কেমন করছে। ছেলেটা এসব শুনে স্থির আছে কিভাবে?
তীরু জিজ্ঞেস করলো,

-” আপনার বাবা কোথায়? ”

অরোন নত মস্তকে বসে। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে ভরাট কন্ঠে জবাব দিল,

-” সু ই সা ই ড করেছে। ”

এবার তীরুর যেন চমকানোর পালা! সে কন্ঠে বিষ্নয় ঢেলে শুধাল,

-” কেন? ”

-” সব জানাজানি হয়ে গেছে। এখন লোকেরা তার মুখে থু থু দেবে। পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। সিনক্রিয়েট হবে তাই। উনার আত্মসম্মানবোধ প্রবল। কারো কাছে নিচু হতে হবে বা নিজের সম্মানে কলঙ্ক লেগে মানুষ ছিঃ! ছিঃ! করবে তার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। এটা আমার ধারণা। অন্য কারণও হতে পারে। আমি নিশ্চিত নই। ”

এই এতটুকু সময়ের ব্যাবধানে কতকিছু ঘটে গেলো! অথচ তীরু সব জানতে পারলো শেষে। জানবেই বা কেমন করে ও। সকাল থেকে অরোন বের হওয়ার পর হতেই শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছিল। কোনো কাজ করতে পারলো না। মা ঠেলেঠুলে শুতে পাঠিয়ে দিলো। সেই যে লম্বা এক ঘুম দিয়েছে, উঠেছে প্রায় সন্ধ্যা হবো হবো ভাব তখন। অরোনের সন্নিকটে গা ঘেঁষে বসল ও। নতজানু করে রাখা মাথাটা টেনে নিজের বুকে চেপে ধরলো। ঘন চুলে হাত বুলিয়ে নম্র গলায় শুধাল,

-” কাঁদবেন তো কাঁদুন। এভাবে চেপে রেখে ফুঁপিয়ে লাভ আছে? কাঁদলে মন হালকা হয়। ”

তপ্ত বাতাস বইলো হটাৎ।বাতাসের তোড়ে অরোনের নির্জীবতা, নির্লিপ্ততা কাটল। শব্দহীন পরিবেশে হুট করে ধস নামল নীরবতায়। হু হু করে কেঁদে উঠলো অরোন। রাতের আঁধারে একজন পুরুষের কান্না ক্রমেই করুণ থেকে করুণে রূপ নিলো।

চলবে~