যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব-২৩+২৪

0
844

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
উত্তেজনায় ঘরের মাঝে বারবার পায়চারি করছেন আমেনা বেগম। সাথে বারবার আহনাফকে কল করছেন। রিং হওয়া সত্ত্বেও আহনাফ ফোন রিসিভ করছে না। সে তার বাড়ির আর কারও সাথে যোগাযোগ না রাখলেও মাঝেমধ্যেই মায়ের সাথে কথা বলত। খোঁজ-খবরও নিত। তাহলে আজ আবার হঠাৎ কী হলো? অস্থিরচিত্তে মাথায় হাত রেখে সোফায় বসে আছেন জহির চৌধুরী। দুশ্চিন্তায় অন্তর্আত্মা কাঁপছে তার। এতক্ষণে অর্ষার সুইজারল্যান্ড পৌঁছে যাওয়ার কথা। অথচ আহনাফের সাথে তারা এখনো কোনো যোগাযোগ করতে পারছে না।

অর্ষাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিয়ে আসার পর থেকেই আমেনা বেগম এবং তিনি আহনাফের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। অনেকগুলো ম্যাসেজও পাঠিয়েছেন তারা। ডেলিভারি হলেও আহনাফ সীন করেনি। চিন্তায় তাদের গলা শুকিয়ে আসছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে অসাড় হয়ে আসছে।

জহির চৌধুরী দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। রাত ৪:০৫ বাজে। তাহলে সুইজারল্যান্ডে এখন রাত ১২:০৫ বাজে। এত রাতে মেয়েটা কোথায় আছে এখন! আহনাফের বাড়ির ঠিকানাও তো অর্ষাকে দেওয়া হয়নি।

তার বুকের ব্যথাটা বাড়ছে। তিনি সোফায় হেলান দিয়ে বসে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,’ফোন ধরেনি?’

আমেনা বেগম মুখটা কাঁদোকাঁদো করে বললেন,’না! ম্যাসেজও সীন করছে না।’

‘আমরা মনে হয় আবার ভুল করে ফেললাম আমেনা! মেয়েটাকে এভাবে একা পাঠানো উচিত হয়নি আমাদের। অনেক বড়ো ভুল করে ফেললাম।’

আমেনা বেগম কী বলবে বুঝতে পারছেন না। হঠাৎ করে যে আহনাফ ফোন ধরবে না, ম্যাসেজ সীন করবে না এটা তো তারা কেউই ভাবতে পারেনি। এর আগে আমেনা বেগম যতবার ফোন করেছে, ম্যাসেজ করেছে আহনাফ রেসপন্স করেছে। আজ তাহলে হঠাৎ কী হলো ওর? কোনো দূর্ঘটনা! নাহ্! এসব ভাবতেই দুশ্চিন্তার পারদ আরো বেড়ে যাচ্ছে।

অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার বিষয়টি আহনাফকে আগেই জানানো হয়নি। তাহলে আহনাফ যে কোনোমতেই রাজি হতো না এটা তারা সকলেই জানে। এজন্য তারা প্ল্যান করেছিল অর্ষারকে ফ্লাইটে তুলে দিয়ে আহনাফকে খবরটি জানাবে। তখন অর্ষাকে বাড়িতে না নিয়ে ওর কোনো উপায় থাকত না। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে ঘটনা হিতে বিপরীত হয়ে গেল।

ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠেছিল আহিল। বাইরে লাইটের আলো জ্বলতে দেখে বের হয়। লিভিংরুমে বাবা-মা’কে দেখে একটু অবাকই হয়।

ঘুম ঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’তোমরা এখনো না ঘুমিয়ে এখানে কী করছ?’

আহিলকে দেখে জহির চৌধুরী এবং আমেনা বেগম দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার বিষয়টি আহিলের থেকে লুকিয়েছে সবাই। কেননা এভাবে অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার বিষয়টি সে কোনোমতেই সমর্থন করত না। রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর আহিল যখন অর্ষার কথা জানতে চেয়েছিল, তখন তারা মিথ্যে বলেছিল অর্ষা ওর বাবার বাড়ি।

‘কোনো সমস্যা?’ বাবা-মাকে নিশ্চুপ ও নির্বাক থাকতে দেখে নিজেই আবার প্রশ্ন করল আহিল।

জহির চৌধুরী আমতা আমতা করে বললেন,’না। সব ঠিক আছে।’

আহিল তীক্ষ্ণ চোখে বাবা-মায়ের দিকে তাকায়। শাণিতকণ্ঠে বলে,’তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সব ঠিক আছে। কিছু লুকাচ্ছ তোমরা আমার থেকে?’

আমেনা বেগম হাসার চেষ্টা করে বললেন,’না, বাবা। কী লুকাব?’

‘কী লুকাচ্ছ সেটাই তো আমি জানতে চাচ্ছি।’

‘কিছুই না। তুমি অযথাই জেরা করছ।’ বললেন জহির চৌধুরী।

‘জেরা করছি না আব্বু। আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি।’

‘বললাম তো কিছু হয়নি।’

আহিলের সর্বপ্রথম এখন যেই নামটা প্রথম মাথায় এলো তা হলো ‘অর্ষা’। অর্ষার বিষয় ঘটিত কিছু বাবা-মা লুকাচ্ছে না তো?

সে কাঠ কাঠ গলায় শুধাল,’রাতে অর্ষা কখন বাড়ি ফিরেছিল?’

ভয়ে আমেনা বেগম ঘেমে গেছেন। একই তো অর্ষার চিন্তায় কলিজায় একটুখানিও পানি নেই। এখন আবার ছেলের জেরার সম্মুখে পড়তে হয়েছে। তারা দুজনেই উপলব্ধি করতে পারে আহিলের থেকে কিছু লুকিয়ে আর লাভ নেই। তারা ভেবেছিল অর্ষা আহনাফের কাছে পৌঁছানোর পর তারা আহিলকে সবটা জানাবে। এখন ঘটনা যখন ভিন্ন কিছু, তখন অপেক্ষা করার আর জো নেই।

লম্বা দম নিয়ে আমেনা বেগম সবকিছু আহিলকে বলতে শুরু করে। সব শুনে বিস্ফোরিত হয় আহিল।

বাবা-মায়ের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,’তোমরা আমায় না জানিয়ে কাজটা কেন করলে? ভাইয়ার সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে এক ভুল তো করেছই; এখন আবার আরেক ভুল। এটা তো ভুল নয় রিস্ক। কীভাবে ও’কে তোমরা একা পাঠালে বলো তো?’

রাগে চেঁচিয়ে কথাগুলো বলে ফুলদানিটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। তাদের কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই বলে,’আমার বন্ধুরা আমার জান। সব বন্ধুগুলোর চেয়ে অর্ষা যে ব্যতিক্রম জানো না? ও বোকা স্বভাবের মা! তোমরা কাজটা একদম ঠিক করোনি। ওর যদি কিছু হয় সত্যি বলছি, খুব খারাপ হবে এবার।’

সে আর কিছু না বলে, না শুনে নিজের ঘরে গিয়ে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। অপেক্ষা করে সকাল হওয়ার। গ্যাঞ্জাম পার্টির বাকিরা কি জানত অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার কথা?
__________
হেলেন তার বান্ধবী রিশিতাকে রিসিভ করে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখল এয়ারপোর্টের বাইরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্ষা। চোখে-মুখে চিন্তার ছাঁপ।

গাড়িতে ওঠার পূর্বে দুজনের একবার চোখাচোখিও হয়ে গেল। হেলেনকে দেখেই অর্ষা জড়সড় হয়ে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দাঁড়াল। হেলেন ওর কাণ্ডে বাঁকা হাসে।

রিশিতা জিজ্ঞেস করে,’হাসছিস কেন?’

হেলেন হেসে দু’দিকে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ বিশেষ কোনো কারণ নেই। গাড়িটি চোখের আড়াল হতেই অর্ষা হাফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু তার দুশ্চিন্তা তো কমেনি। আহনাফ এখনো কেন আসছে না? আচ্ছা সে আসবে তো? যদি না আসে? তাহলে কোথায় যাবে, এখানকার কিছুই তো সে চেনে না।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেও পা ব্যথা করছিল। তাই লাগেজ মাটিতে রেখে, লাগেজের ওপর বসে। রাস্তার ধারে থাকা দূরের আলপাইন গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহ্-কে ডাকছে।

২ঘণ্টা সে এভাবেই বাইরে বসে থাকে। এছাড়া সে করবে-ই বা কি? এতক্ষণেও আহনাফ আসেনি। এবার তার কান্না পাচ্ছে। সবাই বলেছিল আহনাফ নাকি ও’কে নিতে আসবে। কিন্তু আসেনি। ও অবশ্য এমন কিছুই ভেবেছিল। কারণ আহনাফ যে ও’কে পছন্দ করে না সেটা তো ও ভালো করেই জানে। তবুও সে অপেক্ষা করতে থাকে। তার কাছে কোনো সিমও নেই যে,যোগাযোগ করবে। কোথাও পরিচিত নেই কেউ। কার কাছে সাহায্য চাইবে? এই ভিনদেশে এখন সে কোথায়ই বা যাবে? কোথায় খুঁজবে আহনাফকে?

‘এক্সকিউজ মি?’

কারো কণ্ঠ শুনে চকিতে মাথা তুলে তাকায় অর্ষা। শর্ট স্কার্ট পরা একটি মেয়ে ঝুঁকে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঝুঁকে দাঁড়ানোর ফলে সিল্কি চুলগুলোও ঝুঁকে রয়েছে। মেয়েটি কি বাঙালি? মুখের আদল তো অনেকটা ওরকম-ই। তবে দেখতে বেশ ফরসা।

সে সুললিত কণ্ঠে ইংরেজিতে বলল,’তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি এখানে বসে আছো। কী হয়েছে?’

দুশ্চিন্তায় বোধবুদ্ধি হারানোর উপক্রম অর্ষার। সে কথাই বলতে পারছে না। এবার মেয়েটিও হাঁটু মুড়ে সামনে বসে। অর্ষার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখটা দেখে জিজ্ঞেস করে,’তুমি কি বাঙালি?’

অর্ষা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। এবার মেয়েটি স্পষ্ট বাংলা ভাষায় বলে,’আমিও বাঙালি। তবে ইন্ডিয়ান। তুমি?’

‘বাংলাদেশি।’

‘ওহ আই সী! তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছ?’

‘জি।’

‘কোথায় যাবে?’

‘জুরিখ শহরে।’

‘তুমি কি নতুন সুইজারল্যান্ডে? তোমায় কেউ নিতে আসেনি।’

এতক্ষণ যাবৎ আটকে রাখা কান্নাগুলো যেন এবার ঝর্ণার গতিতে আসতে চাইছে। সে দৃষ্টি নামিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়ে। ফোঁপাচ্ছে সে।

মেয়েটি অস্থির হয়ে বলে,’একি! কাঁদছ কেন তুমি? আমায় বলো কী হয়েছে?’

এবার অর্ষা সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলে। মেয়েটি আবারও জানতে চায় কী হয়েছে। অর্ষা ক্রন্দনরতস্বরে সব বলে।

মেয়েটি অর্ষাকে আশ্বস্ত করে বলে,’কেঁদো না। আমার বাড়িও জুরিখ শহরে। তোমার হাজবেন্ড তো এখনো আসলো না। তুমি আপাতত আজ আমার বাসায় চলো। কাল সকালে না হয় দুজনে মিলে তোমার হাজবেন্ডকে খুঁজব। ছবি আছে তো?’

‘আছে।’

‘গুড। এবার বলো যাবে আমার সাথে?’

অর্ষা বুঝতে পারছিল না মেয়েটিকে বিশ্বাস করবে নাকি করবে না। পরক্ষণে ভাবল,এই ভিনদেশে বাঙালি যদি কেউ সাহায্যও করে সেটাই তো অনেক। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার চেয়ে এই রিস্কটুকু নেওয়াই যায়। তাই সে রাজি হয়ে গেল সাথে যাওয়ার জন্য।
.
.
কিছু ভাঙার শব্দে ঘুমের ঘোর কাটে আহনাফের। কিন্তু নেশা এখনো কাটেনি। আজ এক বন্ধুর পার্টি উপলক্ষে সারাদিন বারে ছিল। নেশার পরিমাণটা আজ বেশি হয়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। হেলেন বাড়িতে দিয়ে না গেলে তো সে বোধ হয় আজ বাসায়ও আসতে পারত না। কী ভেঙেছে দেখার জন্য বহুকষ্টে সে উঠে দাঁড়ায়। হেলতে-দুলতে এগিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালায়।

ফ্লোরে কাচের গ্লাস ভেঙে পড়ে আছে। পাশের টি-টেবিলে লেজ গুটিয়ে বসে আছে ক্যাথিওন। কাজটা কে করেছে বুঝতে বেগ পেতে হয় না ওর। সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। এরপর কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ থেকে লেবু এবং ঠাণ্ডা পানি বের করে শরবত বানায়। তিন গ্লাস শরবত পেটে চালান দেওয়ার পর নেশার ঘোর কাটে তার। মাথায় পানি দিয়ে চুলগুলো ভিজিয়ে নেয়।

বেডরুমে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ক্যাথিওনকে বলে,’অসময়ে ঘুম ভাঙালি, আবার গ্লাসও ভাঙলি। বড্ড জ্বালাচ্ছিস তো তুই।’

ক্যাথিওন উত্তরে বলে,’ম্যাউ, ম্যাউ।’

ও যে কী বলে ও-ই ভালো জানে। ওর ম্যাউ ম্যাউ ভাষা বোধগম্য হয় না আহনাফের। সে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নেয়। হোয়াটসএপে মায়ের অনেকগুলো ফোন আর ম্যাসেজ দেখতে পায়। অর্ষা সুইজারল্যান্ড! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সে। তাদের ম্যাসেজ অনুযায়ী প্রায় তিন ঘণ্টা আগেই অর্ষার ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। ততক্ষণে মায়ের নাম্বার থেকে আবারও কল আসে।

সে ফোন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে আমেনা বেগম অস্থির হয়ে বলা শুরু করেন,’কোথায় ছিলি তুই? ফোন কেন রিসিভ করছিলি না? ম্যাসেজও দেখছিস না।’

আহনাফের ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,’কাজটা তোমরা একদম ভালো করোনি মা। আমি যাচ্ছি এয়ারপোর্ট।’

সে ফোন কেটে দিয়ে গায়ে একটা শার্ট জড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে এয়ারপোর্ট যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এয়ারপোর্ট পৌঁছিয়ে পুরো এয়ারপোর্ট তন্ন তন্ন করে খোঁজে। বাইরেও খোঁজে। কোত্থাও নেই অর্ষা। সে এখন কোথায় খুঁজবে মেয়েটিকে? এই অচেনা শহরে যদি কোনো ক্ষতি হয়? সে কী করবে না করবে বুঝতে না পেরে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবার চেষ্টা করে কোন স্টেপ তার নেওয়া উচিত। সে গাড়ি নিয়ে জুরিখ শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে অর্ষা খোঁজার বৃথা চেষ্টা করে। এভাবে একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে অসম্ভব মনে হয়নি আহনাফের। এমনও হতে পারে আহনাফকে না পেয়ে অর্ষা হয়তো নিজেই রাস্তায় হেঁটে খোঁজার চেষ্টা করছে। এরকম আরো অনেক কিছু ভেবেই সে অর্ষাকে খোঁজার চেষ্টা করে। একসময় সে হাঁপিয়ে পড়ে। বুঝতে পারে এভাবে অর্ষাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। পুলিশের সাহায্য লাগবে।

পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার আগে মনে পড়ল অর্ষার ছবিও তো তার কাছে নেই। সে গাড়ি এক সাইডে পার্ক করে আমেনা বেগমকে ম্যাসেজ করে অর্ষার কিছু ছবি পাঠিয়ে দিতে বলে।
.
.
অর্ষা মেয়েটির সাথে তার বাড়িতে এসেছে। সে চোখ ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখছে। দু’রুমের একটা ফ্ল্যাট তবে বেশ নামি-দামি বেশভূষা বাড়িটির। আর সবকিছু পরিপাটি করে গোছানো।

অর্ষাকে রুম দেখিয়ে মেয়েটি বলল,’আগে ফ্রেশ হয়ে এসো।’

অর্ষা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ম্যাজম্যাজ করছিল। ফ্রেশ হওয়াটা অতীব জরুরী ছিল বটে। সে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মেয়েটি টেবিলে হরেক রকমের খাবার সাজিয়েছে।

অর্ষাকে দেখে হেসে বলল,’বসো।’

অর্ষা বসল। আশেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,’বাড়িতে আর কেউ থাকে না?’

‘না, আমি একাই।’

‘ওহ। আচ্ছা আপনার নাম কী?’

‘সুজিকা। আমি কিন্তু খ্রিস্টান। আর আমাকে আপনি করে বলতে হবে না। তুমি করেই বলো।’

উত্তরে অর্ষা একটু হাসল। মেয়েটি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল,’বাই দ্য ওয়ে, তোমার নাম কী?’

‘অর্ষা। আমি মুসলিম।’

অর্ষার সরলতায় সুজিকা মুচকি হাসে। খাবার সামনে পেয়ে চুপচাপ গলাধঃকরণ করছিল অর্ষা। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ ক্ষুধার্ত সে। তাই সুজিকা খাওয়ার সময় আর কোনো কথা বলল না। দুজনে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে ঘুমাতে যায়। শুয়ে শুয়ে দুজনে দেশের গল্প করছিল।

অর্ষা এক পর্যায়ে বলে,’আপনি অনেক ভালো আপু। ভাগ্যিস আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। নয়তো, আল্লাহ্ ভালো জানে এখন আমার কী হতো!’

সুজিকা হেসে বলে,’ডোন্ট ওয়্যারি বেবি। গড যা করে, ভালোর জন্যই করে। আচ্ছা তোমার হাজবেন্ড কেন তোমায় নিতে এলো না?’

অর্ষা প্রত্যুত্তরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’তার সাথে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। সে আমাকে পছন্দ করে না।’

এরপর বিস্তারিত সবই বলল। সব শুনে সুজিকা জিজ্ঞেস করে,’তোমাদের মাঝে ফিজিক্যাল কোনো সম্পর্ক হয়নি?’

অর্ষা একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। জড়তা নিয়ে বলে,’না।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। অনেক জার্নি করে এসেছ। এখন তুমি ঘুমাও। কাল সকালে গল্প করা যাবে।’

কথা সত্য। অর্ষার সত্যিই ভীষণ ঘুম পেয়েছে। সে ‘গুড নাইট’ বলে অল্প কিছু সময়ের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে। আচানক ঘুমের মাঝে সে অনুভব করে কেউ তার শরীরে হাত বুলাচ্ছে। দুঃস্বপ্ন ভেবে কাটাতে চাইলেও হচ্ছে না। স্পর্শগুলো বাস্তব মনে হচ্ছিল। চকিতে চোখ মেলে তাকায় অর্ষা। সবুজ ডিম লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় সুজিকা অর্ধন’গ্ন হয়ে অর্ষার ওপর ঝুঁকে রয়েছে এবং শরীরে হাত বুলাচ্ছে।

অর্ষা ধাক্কা দিয়ে সরাতে সরাতে জিজ্ঞেস করে,’এসব আপনি কী করছেন আপু? সরেন প্লিজ! আপু, আপনি এমন করছেন কেন?’

সুজিকা ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে,’স্টপ ইউর মাউথ বেবি।’

এরপর সে অর্ষার ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে চুমু খায়। ভয়ে, আতঙ্কে চেহারার বর্ণ পাল্টে গেছে অর্ষার। সে ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে সুজির থেকে নিজেকে ছাড়ানোর। সে তো এটাই বুঝতে পারছে না, একটা মেয়ে হয়ে সে কেন এমন করছে? পরমুহূর্তে তার মাথায় এলো, সুজি কি তবে লেসবি’য়ান! অর্ষার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মাথা কাজ করছে না। মনে মনে সে আয়তুল কুরসী পড়তে লাগল। সেই মুহূর্তে সে খেয়াল করল বেড সাইড টেবিলে কাচের গ্লাসটি। গ্লাসটা হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে জোরে আঘাত করে সুজির মাথায়। হঠাৎ আক্রমণে সুজিকা দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে অর্ষা দৌঁড়ে ঘরের বাইরে বের হয়। পেছন পেছন সুজিকাও আসতে থাকে। অর্ষা দৌঁড়ে মেইন দরজার কাছে চলে আসে। ভাগ্যিস তালা দেওয়া ছিল না। সে দরজা খুলে দৌঁড়াতে থাকে রাস্তায়। পেছন পেছন সুজিকাও আসছে।

সে বারবার বলছে,’অর্ষা দাঁড়াও বলছি। আমি বলছি দাঁড়াও।’

অর্ষা প্রাণপণে দৌঁড়াতে থাকে। সে সময়ে সুজিকা এবং অর্ষাকে এভাবে দৌঁড়াতে দেখতে পায় আগত গাড়িতে থাকা পুলিশ। এভাবে দুজনকে দৌঁড়াতে দেখে তাদের সন্দেহ হয়। তাই তারা-ও ওদের ফলো করা শুরু করে।

গাড়ি নিয়ে দাঁড় করায় অর্ষার সামনে। অর্ষা থমকে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে পুলিশ বের হয়ে দুজনকেই ধরে ফেলে।

একজন অর্ষাকে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’

অর্ষা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কান্নার জন্য ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না। তাই পুলিশ দুজনকে থানায় নিয়ে আসে। থানায় গিয়ে অর্ষা কিছুটা শান্ত হয়। এমন কিছু কখনো তার সাথে হতে পারে বা হবে সে কল্পনাতেও ভাবেনি। মনে পড়লেই বুক ফেটে কান্না আসছিল।

‘শান্ত হোন। কী হয়েছে আমাদের বলুন।’ বলল সামনে বসে থাকা পুলিশ।

অর্ষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিস্তারিত সব বলে। সমস্ত ঘটনা জানার পর সুজিকাকে লকাপে আর অর্ষাকে সামনেই বসিয়ে রাখে। সে তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। দুজন পুলিশকে সুজিকার বাসায় পাঠানো হয়েছে অর্ষার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসার জন্য।

অর্ষাকে শান্ত করতে সামনে বসে থাকা পুলিশটি পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’পানি পান করুন।’

কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাসটি হাতে নিয়ে এক চুমুকে সম্পূর্ণ পানি শেষ করে অর্ষা। কান্নার পরিমাণ কিছুটা কমে এসেছে এখন। সে শান্ত হয়ে চেয়ারে বসে আছে। হাত-পা কাঁপছে এখনো। মনে হচ্ছে কোনো ঘোরের মাঝে আটকা পড়ে আছে। ঘটনাটি কিছুতেই ভুলতে পারছে না।

‘অর্ষা!’

কিছুক্ষণ বাদে পরিচিত কণ্ঠে নিজের নামটি শুনে চমকে পেছনে তাকায় অর্ষা। আহনাফ দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এক পলক নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে উল্কার বেগে দৌঁড়ে গিয়ে আহনাফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে সে। শার্ট খাঁমচে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করে। আহনাফ কিছু বলছে না। শুধু আলতোভাবে অর্ষার মাথায় হাত রাখে।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
আহনাফ থানায় এসে অর্ষার নিখোঁজ হওয়ার ডায়েরি করে গিয়েছিল। সেই সাথে সকল ইনফরমেশন, ছবি এবং সমস্ত ঘটনাও বিস্তারিত বলেছে। পুলিশ তাদের সর্বোচ্চ সহায়তা করবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু তবুও মনের ভেতর ভয়ের দানা ধীরে ধীরে বীজ এবং অল্প সময়ে তা বিশাল মহিরুহের আকার ধারণ করেছিল। অস্বস্তি, দুশ্চিন্তায় গাট হয়েছিল আহনাফের সমস্ত তনু-মন। সে অর্ষাকে সহ্য করতে পারে না, এ কথা ঠিক। তাই বলে সে তো কখনোই অর্ষার ক্ষতি চায়নি আর চায়ও না। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছিল তখন বাবা-মায়ের ওপর।

অন্যদিকে বাবা-মা যখন শুনল অর্ষাকে এয়ারপোর্ট গিয়ে পায়নি তখন তাদেরও দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। আমেনা বেগম তো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। জহির চৌধুরী একটু পরপর আহনাফকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছিলেন, অর্ষাকে পাওয়া গেছে কিনা। রাগে-ক্ষোভে বাবা-মাকে দু/চারটা কথা শুনিয়ে দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছিল আহনাফ।

দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন ও অসাড় হওয়া শরীর নিয়ে যখন সে বাড়িতে পৌঁছাল, তার ঠিক মিনিট দশেক পর-ই থানা থেকে ফোন আসে। পুলিশ যখন জানাল, অর্ষাকে তারা পেয়েছে তখন মনে হলো অনেক বছর বাদে সে কোনো খুশির খবর পেয়েছে। কোনো কিছু না ভেবে তখনই আবার বেরিয়ে পড়েছিল থানায় আসার জন্য।

বিধ্বস্ত অর্ষাকে মাথা নত করে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও তার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠেছিল। কোনো ক্ষতি হয়নি তো? তার ভাবনার প্রহর ফুরাবার পূর্বেই মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল অর্ষার নামটি। আর এরপর প্রবল বৃষ্টিপাতের মতোন অর্ষার ছুটে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়াটা ছিল বিশাল মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতো। যদিও তখন ভয়টা ক্রমশই বাড়ছিল।

এই মুহূর্তে আহনাফ এবং অর্ষা দুজনেই পুলিশ স্টেশনে রয়েছে। আহনাফের গা ঘেঁষে পাশাপাশি বসে আছে অর্ষা। আহনাফের এক হাত জড়িয়ে ধরে হাতের বাহুতে গাল ঢেকিয়ে রয়েছে। অর্ষার শরীরের কাঁপুনি স্পষ্ট টের পাচ্ছিল আহনাফ। সে পুলিশের কাছে বিস্তারিত সব শুনেছে। এই ঘটনার পর অর্ষার মতো মেয়ের ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অন্য কেউ হলে তো ভয়েই জমে যেত! সেখানে অর্ষা নেহাৎ-ই সহজ-সরল, শান্ত ও ভীতুগোছের মেয়ে। আল্লাহ্ যে ও’কে রক্ষা করেছে এতেই আহনাফ মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানায়।

আহনাফ ক্ষীণস্বরে বলে,’অর্ষা? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’

অর্ষা ফোঁপাচ্ছিল। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,’নাহ্!’

অথচ তার গায়ে তখন প্রচণ্ড জ্বর। কীরকম পাখির ছোট্ট ছানার মতো আহনাফের গা ঘেঁষে রয়েছে। অন্য সময় হলে অর্ষা লজ্জাতেই সামনে আসতো না, আর সেখানে তো! আহনাফ দীর্ঘশ্বাস নেয়। যে দুটো পুলিশকে অর্ষার জিনিস-পত্র আনার জন্য পাঠানো হয়েছিল তারা কিছুক্ষণ বাদেই সব নিয়ে ফিরে আসে।

আহনাফ সবকিছু চেক করে পুলিশকে ধন্যবাদ জানায়। অর্ষা তখনো আহনাফকে ছাড়েনি। যেন ছাড়লেই সে আবার হারিয়ে যাবে। তাছাড়া অচেনা এই ভিনদেশে এখন অর্ষার একমাত্র ভরসার কেন্দ্রবিন্দু তো আহনাফ-ই। সেটা এ দুজন মানুষ স্বীকার করুক বা না করুক; বাস্তবতা তো এটাই।

পুরোটা রাস্তায়ও অর্ষা আহনাফের হাত ছাড়েনি। বাড়ি ফিরে অর্ষাকে সোফায় বসাল সে। অর্ষার জন্য পানি আনতে গিয়ে দেখল দেয়ালের আড়াল থেকে ক্যাথিওন উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তার অর্ষার দিকে আটকে রয়েছে। মনে মনে হয়তো ভাবছে,’এই নতুন মানুষটার আমদানি হলো কোত্থেকে আবার?’

আহনাফ পানি এনে দিলে অর্ষা বিনাবাক্যে পানিটুকু পান করে। নিস্তেজস্বরে বলে,’ভালো লাগছে না। ঘুমাব।’

অর্ষাকে ধরে উঠিয়ে আহনাফ বলল,’চলো।’

দুটো বেডরুম আহনাফের ফ্ল্যাটে। সে যেই রুমে থাকে তার পাশের রুমে অর্ষাকে নিয়ে যাবে ভাবল। পরক্ষণে ভাবল রুমটা গোছানো হয়নি। আজ বরং অর্ষা তার রুমেই থাকুক। পরে না হয় ঐ রুমে শিফট্ করবে। সে অর্ষাকে নিজের ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলো।

মাথায় হাত দিয়ে ব্যথায় কোঁকাচ্ছে অর্ষা। সে জড়ানো কণ্ঠে অনুরোধ করে বলে,’প্লিজ! আপনি কোথাও যাবেন না। এখানেই থাকুন।’

‘যাচ্ছি না কোথাও। তুমি একটু শুয়ে থাকো।’

আহনাফ ফাস্টএইড বক্স থেকে থার্মোমিটার নিয়ে জ্বর মেপে দেখল ১০৩ ডিগ্রি জ্বর। অস্ফুটস্বরে বলল,’সর্বনাশ! অনেক জ্বর।’

এরপর সে জ্বরের ট্যাবলেট নিয়ে অনেকটা জোরপূর্বক অর্ষাকে খাইয়ে দিলো। পাশে বসে কিছুক্ষণ জলপট্টি দিয়ে জ্বর নামাল। সকাল হলে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।

অর্ষা ঘুমানোর পর ফোন হাতে নিলো। বাবা-মা অনেকগুলো কল আর ম্যাসেজ করেছে। আহনাফের এই মুহূর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে ঘুমন্ত অর্ষার ছবি তুলে মাকে হোয়াটসএপে পাঠিয়ে সাথে লিখল,’চিন্তা কোরো না। অর্ষা এখন আমার কাছেই আছে। ঘুমাচ্ছে। কাল সকালে ফোন করব।’

এরপর ফোন চার্জে দিয়ে মাঝখানে কোলবালিশ রেখে সেও অর্ষার পাশে শুয়ে পড়ল। লাইট নেভায়নি আজ। যখন তখন অর্ষার ঘুম ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে আজ। অন্ধকার দেখে ফের যদি ভয় পায়? এই আশঙ্কায় লাইট জ্বালিয়েই রাখল। যদিও লাইটের আলোয় তার ঘুম আসে না, কিন্তু কিছু করারও তো নেই। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে দেখল ক্যাথিওনও এই রুমে এসেছে। চেয়ারের ওপর গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে।

আহনাফ মৃদু হাসে ক্যাথিওনের দিকে তাকিয়ে। মনে মনে বলে,’ভাগ্যিস তুই গ্লাসটা ভেঙেছিলি!’
_______
সকাল ৭:২৪

সারা রাত দুশ্চিন্তায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি আহিল। আমেনা বেগম অবশ্য এসে ভয়ে ভয়ে অর্ষার পৌঁছানোর খবর জানিয়ে গেছেন। তবে আহিল তার কথায় কোনো রেসপন্স করেনি। সকাল হতেই একে একে সব বন্ধুর নাম্বারে ফোন করে ইমার্জেন্সী দেখা করার কথা বলে। ওর হঠাৎ দেখা করার কথায় সবার পিলে চমকে ওঠে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে সব জেনে গেছে আহিল আর তাই সবাইকে দেখা করতে বলছে।

সকাল নয়টায় সবার রেস্টুরেন্টে থাকার কথা। আহিল রেডি হয়ে সাড়ে আটটার দিকে বের হয়। ডাইনিংরুম থেকে রেণু জিজ্ঞেস করে,’ভাইজান নাস্তা করবেন না?’

‘না।’ বলে আহিল চলেই যাচ্ছিল, আবার কী ভেবে যেন ফিরে আসে।

ডাইনিংরুমে কেউই নেই। সে রেণুকে জিজ্ঞেস করে,’বাবা-মা কোথায়?’

‘ঘুমাইতাছে। রাতে ঘুম হয় নাই তো তাই।’

‘রেণু আপা, তুমি কি জানতে অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার কথা?’

রেণুর বুকটা কেঁপে ওঠে এবার। আহিল শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেও, ওর চোখে-মুখে থাকা রাগের আভাস স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে।

‘কী হলো? জানতে?’ রেণুকে নিরব দেখে ফের প্রশ্নটি করে আহিল।

রেণু ভয়ে ভয়ে বলে,’অর্ষা আপা যাওয়ার আগের দিন জানছিলাম।’

আহিল কিছু বলল না। শুধু তেড়ছাভাবে হেসে সেখান থেকে প্রস্থান করল।

গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলেই রেস্টুরেন্টে ছিল। নিজেরা নিজেরা আলোচনা করছিল আর ভাবছিল কী করে আহিলকে হ্যান্ডেল করবে। আহিলকে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতে দেখে সকলেই নড়েচড়ে বসে। আহিলও বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

সবার দিকে তাকিয়ে দেখে সকলে ওর দিকেই ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আহিল ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,’কী?’

ওরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আশিক অনেকটা সাহস সঞ্চয় করেই জিজ্ঞেস করল,’হঠাৎ জরুরী তলব?’

আহিল কিছুটা সময় চুপ করে রইল। এরপর লম্বা দম নিয়ে বলল,’যাক তোরা যখন আসল প্রসঙ্গে চলে এলি, তখন আমিও আর ভনিতা না করি।’

একটু থেমে ফের বলল,’অর্ষা যে সুইজারল্যান্ড গেছে তোরা জানিস?’

সকলে একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে সমস্বরে বলল,’জানি।’

‘কবে থেকে জানতি?’

সবাই এবার নিরুত্তর। আহিল বলল,’চুপ করে থাকবি না। কবে থেকে জানতি তোরা? যাওয়ার পর জেনেছিস নাকি আগে থেকেই জানতি?’

এবারও সবাই চুপ করেই থাকে। আহিল বেশ শান্তভাবে বলে,’উত্তর দিবি না তোরা?’

লামিয়া ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে,’বেশ কিছুদিন ধরেই জানতাম।’

‘সবাই?’

‘হুম।’

আহিলের চোখে-মুখে এবার স্পষ্ট ক্রোধ ফুটে ওঠে। সেই সাথে পুরো মুখখানা অভিমানে ছেঁয়ে যায়। বিতৃষ্ণায় মুখ তেতো হয়ে ওঠে।

সে কিছুক্ষণ নিরব থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে। অভিমানী কণ্ঠে বলে,’তোরা সবাই সব জানতি শুধু আমি বাদে। এমনকি অর্ষাও আমায় কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করল না। ওয়েল! দরকার নেই। তোদের কাউকেই আমার আর দরকার নেই। ভালো থাক তোরা।’

জুঁই বলে,’দোস্ত তুই রাগ করিস না। আমাদের কথাটা শোন।’

‘না, না আমি রাগ করছি না। রাগ করবই বা কাদের ওপর? অর্ষার ওপর? তোদের ওপর? আমার পরিবারের ওপর? লাভ নেই তো। তোরা আমায় আপন ভাবিস না সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে।’

‘দেখ দোস্ত, তুই আহনাফ ভাইয়ার ওপর রেগে আছিস। এভাবে বিয়েটাও মানতে পারিসনি। অন্যদিকে আহনাফ ভাইয়া এবং অর্ষা দুজনের কেউই কাউকে বোঝার সুযোগটুকু পাচ্ছিল না। এভাবে যদি ওরা দূরে দূরে থাকত তাহলে সম্পর্ক গড়ার আগেই সম্পর্কটা ভেঙে যেত। তাই অর্ষার সুইজারল্যান্ডে যাওয়াটা প্রয়োজন ছিল। তোকে আগেই জানানো হয়নি কারণ, তাহলে তুই রাজি হতি না। আর তুই না বললে অর্ষাও কখনো যেত না। তাই পুরো বিষয়টা তোর থেকে গোপন রাখা হয়েছিল। ভুল না বুঝে ঠান্ডা মাথায় ভেবে একটু বোঝার চেষ্টা কর।’ বলল আশিক।

‘বললাম তো ভুল বুঝিনি। তোরা যেটা ঠিক মনে করেছিস, সেটাই করেছিস। অর্ষা তোদের ফ্রেন্ড; তাই ওর ভালোমন্দও শুধু তোরাই ভাবিস। অর্ষা আমার বাবা-মায়ের বড়ো ছেলের স্ত্রী; তাই ওর ভালোটা শুধু তারাই বোঝে। কিন্তু আমি! আমি কে বল? আমি কেউ নই। ওদেরও না, তোদেরও না। যাই হোক, উঠছি আমি। ভালো থাকিস তোরা।’

‘প্লিজ! রাগ করিস না। এবারের মতো আমাদের ক্ষমা কর। স্যরি দোস্ত।’

আহিল শুনল না কিছু। একরাশ চাপা অভিমান সঙ্গে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল।
.
.
জুরিখ শহরের এক পরিচিত ডাক্তার রয়েছে আহনাফের। সকাল হতেই আহনাফ তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। রাতে অবশ্য অর্ষার জ্বর অনেকটাই কমে এসেছিল। সে অর্ষাকে দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলো।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর অর্ষার ঘুম ভাঙে। সে যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই শুধু সাদা রঙের ছড়াছড়ি। বেড কভার, বালিশের কভার, জানালার পর্দা সবকিছু সাদা রঙের। সে মাথাটা দু’হাতে ধরে উঠে বসে। হঠাৎ মাথা আবার চক্কর দিয়ে ওঠায় বিছানায় শুয়ে পড়ে। ডান হাতটা বিছানার ওপর রাখতেই নরম, উষ্ণ, তুলতুলে কিছু অনুভব করে সে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সবকিছু চারদিকে ঘুরছে। ঝাপসা লাগছে। সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে।

কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে। ততক্ষণে ঐ উষ্ণ জিনিসটা আরো বেশি করে অনুভব করছে সে। কী সেটা বোঝার জন্য পাশে তাকাতেই দেখতে পায় সাদা ধবধবে একটা বিড়াল তার হাতের ওপর শুয়ে রয়েছে। খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে সে। এরপর যারপরনাই আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে জোরে চিৎকার দেয়। হাতটা তড়িৎবেগে সরিয়ে দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়।

অর্ষার চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে যায় আহনাফ। এদিকে ক্যাথিওনের-ও ঘুম ভেঙে গেছে। সেও অর্ষার পিছু দৌঁড় দেয়। এটা দেখে তো অর্ষা আরো জোরে চিৎকার করতে শুরু করে। ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে বের হয়েছিল আহনাফ। গার্ডেন থেকে দ্রুতপায়ে সে বাড়ির দিকে আসে। মেইন দরজা চাপানো ছিল। অর্ষাও বের হতে যায় আর আহনাফও ভেতরে ঢুকতে যায়; যার ফলে দারুণ এক ধাক্কা খায় দুজনে। টাল সামলাতে না পেরে অর্ষার পরে যাওয়ার উপক্রম। সেই সময়ে আহনাফ তার শক্তপোক্ত হাতে অর্ষাকে ধরে ফেলে। সাপোর্ট পেয়ে অর্ষাও এবার শক্ত করে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে।

আহনাফ জানতে চায়,’কী হয়েছে? তুমি চিৎকার করছ কেন?’

তখন দেখতে পায় সামনে ক্যাথিওন দাঁড়িয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আহনাফ বলে,’বাই এনি চান্স, তুমি ক্যাথিকে দেখে চিৎকার করোনি তো?’

অর্ষা এবার মুখ তুলে তাকায়। চোখদুটো পিটপিট করে বলে,’ক্যাথি?’

আহনাফ ক্যাথিওনের দিকে ইশারা করে বলল,’আমার বিড়াল! বিডিতে বলেছিলাম ওর কথা।’

অর্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে ক্যাথির দিকে তাকাল। ক্যাথিকে এমন গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন? বিড়ালও রাগটাগ করে নাকি? সে আহনাফকে কিছু বলার জন্য আহনাফের মুখের দিকে তাকায়। পরক্ষণে খেয়াল করে, আহনাফের মুখটা এত কাছে কেন? এবং আরো ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে, সে তো আষ্টেপৃষ্ঠে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সে এটাও খেয়াল করে, সে অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে ধরলে কী হবে; আহনাফ একদম হাত দুটো সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্থাৎ সে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরেনি। মনে মনে প্রবোধ গুনল অর্ষা। নিজেকে ধিক্কার জানাল। কী লজ্জা! কী লজ্জা!

‘তোমার ভয় আর লজ্জা পাওয়া শেষ হলে আমায় ছাড়ো।’ বলল আহনাফ।

অর্ষা দ্রুত ছেড়ে দেয় আহনাফকে। ক্যাথিওনকে কোলে নিয়ে সামনে আসতেই অর্ষা আবার চেঁচিয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলে,’ও’কে নিয়ে সামনে আসবেন না।’

‘আশ্চর্য! ও কি তোমাকে খেয়ে ফেলবে নাকি?’

‘আমার ভয় লাগে।’

আহনাফ ক্যাথিওনকে নামিয়ে দিয়ে অর্ষাকে বলল,’ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো।’

অর্ষা যেই রুমে ছিল, সেই রুমে গিয়েই ফ্রেশ হয়ে আসে। আহনাফ হালকা-পাতলা কিছু নাস্তা এনে টেবিলে রেখেছে।

অর্ষাকে দেখতে পেয়ে আহনাফ বলল,’খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।’

‘এত তাড়াহুড়া কেন?’

‘বাইরে যাব। ওষুধ আনতে।’

‘আমি তো এখন ঠিক আছি।’

আহনাফ কিছু না বলে খেতে লাগল। অগত্যা অর্ষাকেও চুপচাপ খাওয়া শুরু করতে হয়।

খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আহনাফ বলল,’তুমি রেস্ট নাও। আমি বাহির থেকে আসছি।’

অর্ষা ব্যস্ত হয়ে বলল,’না। আমি এই বিড়ালের সাথে বাড়িতে থাকব না।’

‘ওর নাম ক্যাথিওন।’

‘ঐতো!’

‘তো কী করবে? সাথে যাবে?’

‘আপনার সমস্যা না হলে যাব।’ মাথা নত করে, নিচুস্বরে বলল অর্ষা।

আহনাফ শ্লেষেরসুরে বলল,’যে নিজের সমস্যার কথা ভাবে না, সে নাকি এখন আমার সমস্যার কথা ভাবতে শুরু করেছে।’

অর্ষা আহত দৃষ্টিতে তাকায়। আহনাফ বলল,’রেডি হয়ে নাও।’
.
অর্ষাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য বের হয় দুজন। রাতে এতসব ঘটনা ঘটে গেছিল যে, সুইজারল্যান্ডে আসার সব আনন্দই মাটি হয়ে গেছিল। সকালবেলা সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য দেখে সে অভিভূত হচ্ছে। দু’পাশে থাকা বিশাল বিশাল আলপাইন গাছের মাঝখানে সরু রাস্তা। চারপাশে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। পথে যেতে যেতে পাশে একটা লেকও দেখতে পেল। স্বচ্ছ লেকের পানি। যেন এতটুকুও ময়লা নেই কোথাও। পুরো শহর একদম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।

আহনাফ আজ অফিসেও গেল না।বাইরে থেকে ফিরে এসেও বাসায় রইল। ফোনে কাদের সঙ্গে যেন কথাও বলল। ওষুধের ডোজ বেশি হওয়ায় দুপুরে খেয়ে অর্ষা ঘুমিয়েছিল। ঘুম যখন ভাঙে তখন বাইরে অন্ধকার। বাংলাদোশের কথা খুব মনে পড়ছে তার। বন্ধুদেরকেও ভীষণ মিস করছে সে। সবাই কেমন আছে? ওরা-ও কি অর্ষাকে মিস করছে? বুকচিরে বেরিয়ে আসে ভারী দীর্ঘশ্বাস।

অর্ষা ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয়। আহনাফকে ড্রয়িংরুমে না পেয়ে ডাকল সে,’শুনছেন? কোথায় আপনি?’

পাশের রুমের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সে পিছু ফিরে তাকায়। ফোন হাতে আহনাফ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’ঘুম ভাঙল?’

অর্ষা ওপর-নিচ মাথা দোলাল। আহনাফ বলল,’বসো তুমি। আমি আসছি।’

অর্ষা গিয়ে সোফায় বসল। আহনাফ ফিরে এসে বলল,’তোমার ফোন কোথায়?’

‘ঘরে।’

‘নিয়ে আসো।’

অর্ষা গিয়ে ফোনটা নিয়ে এলো। আহনাফ নিজে ফোনে সীম ঢুকিয়ে দিয়ে, ওয়াইফাই কানেক্ট করে দিলো।

অর্ষা খুশি হয়ে বলল,’আমি আপনাকে এখনই সীমের কথা বলতাম। থ্যাঙ্কিউ।’

আহনাফ এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ধমক দিয়ে বলল,’এরকম স্টু’পিড মার্কা একটা কাজ কীভাবে করলে তুমি? অবশ্য তুমি তো স্টু’পিড-ই। তোমার দ্বারাই এমন কর্ম সম্ভব।’

অর্ষা বিস্ময়ে থ বনে যায়। সে আবার কী করল এখন? শান্ত মানুষটা হঠাৎ এমন ফায়ার হয়ে গেল কেন? সে কাচুমুচু হয়ে জিজ্ঞেস করে,’বকছেন কেন? কী করেছি আমি?’

‘কী করেছ তা আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে? একা কেন এসেছ সুইজারল্যান্ড?’

অর্ষা নিরুত্তর।

আহনাফ বলল,’চুপ করে থাকবে না। বলো কেন এসেছ একা? ভয় করেনি? যদি সত্যিই কোনো অঘটন ঘটে যেত?’

কণ্ঠ খাদে ফেলে অর্ষা বলে,’আপনি আমায় নিতে এয়ারপোর্ট যাবেন ভেবেছিলাম, তাই ভয় করেনি তখন।’

আহনাফ থমকে যায়। কী বলবে সে এই কথার পিঠে? ও’কে চুপ থাকতে দেখে অর্ষা মাথা তুলে তাকায়।

ভয়ে ভয়ে বলে,’একটা অনুরোধ করি?’

‘কী?’

‘আঙ্কেল-আন্টির সাথে রাগারাগি করবেন না প্লিজ! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। রাগারাগি করলে তো আর সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে না।’

আহনাফ নিশ্চুপ। অর্ষা ঢোক গিলে বলল,’রাগ করবেন না তো তাদের সাথে? বলেন?’

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আহনাফ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ননসেন্স মেয়ে! তুমি সুস্থ হও শুধু। তোমাকে আমি বাংলাদেশ রেখে আসব।’

‘কেন?’

‘কেন আবার কী? তুমি এখানে কেন থাকবে?’

‘আপনি কেন থাকেন?’

‘আমার ভালো লাগে তাই থাকি।’

‘আমারও এই দেশটা ভালো লেগেছে। অনেক সুন্দর।’

‘তো?’

অর্ষা ঢোক গিলে বলল,’তো আমিও থাকতে চাই।’

‘মামা বাড়ির আবদার?’

অর্ষা বিড়বিড় করে বলল,’না, স্বামী বাড়ির আবদার!’

‘কী বলো?’

‘কিছু বলিনি। আপনি সবসময় এমন রেগে যান কেন?’

‘তোমার মুখে তো দেখি ভালোই কথার খই ফুটেছে।’

‘স্যরি।’

‘হয়েছে। এখন আর স্যরি বলতে হবে না। বাবা-মা তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে ফোন দিও।’

‘আচ্ছা।’

‘রাতে কী খাবে?’

‘আপনার ইচ্ছে।’

আহনাফ একটু চুপ থাকল। এরপর বলল,’এখন কী খাবে? চা নাকি কফি?’

‘ইচ্ছে।’

‘ইচ্ছে, ইচ্ছে, ইচ্ছে! সব যদি আমারই ইচ্ছে তাহলে এখানে আসার আগে আমার ইচ্ছে জানতে চাওনি কেন?’ বিরক্ত হয়ে বলল আহনাফ।

অর্ষা ভয়ে ঢোক গিলে। সোফা থেকে উঠে এক পা, দু’পা করে পেছাতে থাকে। উদ্দেশ্য দৌঁড়ে রুমে চলে যাবে। তার আগেই সে পিছে না দেখে ক্যাথির পায়ে পাড়া দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দাঁতমুখ খিঁচে ক্যাথি ‘ম্যাউ, ম্যাউ’ করে ওঠে। অর্ষাকে আর পায় কে। সে ভয়ে দৌঁড়ে গিয়ে আহনাফের পেছনে লুকায়।

আহনাফের পরনের টি-শার্ট খামচে ধরে বলে,’ও সবসময় আমার সামনেই কেন পড়ে?’

‘একটু কিছু হলেই তুমি কেন আমায় জড়িয়ে ধরে?’

অর্ষা বলল কী? আর তার কথার পিঠে আহনাফ এটা বলল কী? তাই সে লক্ষ্য করে দেখল, আহনাফের কথা সত্য। সে সত্যিই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করে বলল,’কই না তো!’
এরপর সেখান থেকে সরতে গিয়ে সোফার সাথে পা লেগে সোফাতেই পড়ে যায়। ভয়ে মৃদু চিৎকার দিয়ে ওঠে।

‘এখানে এসে কি মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে নাকি তোমার? এমন বিহেভিয়ার করছ কেন?’

অর্ষা হাসার চেষ্টা করে বলল,’না মানে শরীরটা মনে হয় আবার খারাপ লাগছে!’

একটু নড়তে গিয়ে আবার হলো বিপরীত ঘটনা। এবার তো সোফা থেকে সোজা নিচেই পড়ে গেল। ওর একেক বার একেক রকম কাণ্ডে আহনাফ অবাক না হয়ে আর পারল না।

সে অর্ষার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’ওঠো।’

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]