যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব-২৭+২৮

0
900

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________
‘তুমি আমার ওয়েট জানতে চাচ্ছ কেন? আমায় অপমান করছ তুমি?’ তিরিক্ষি মেজাজে পালটা প্রশ্ন করল আহনাফ। এরপর সে উঠে দাঁড়াল।

অর্ষাও সোজা হয়ে বসে বলল,’ওয়েট জানতে চাওয়া মানে কি অপমান করা?’

‘এই সিচুয়েশনে জানতে চাওয়া অবশ্যই অপমান করা। এন্ড লিসেন, ইট ওয়াজ অ্যান এক্সিডেন্ট। মোরওভার, নাথিং এলস্।’

অর্ষা নাকমুখ কুঁচকে বলে,’তো আমি কখন বললাম অন্য কিছু? একেই বলে চোরের মন পু্লিশ পুলিশ।’

‘কী বললে তুমি?’

‘কিছু না।’

‘কিছু তো অবশ্যই। কী বলতে চাচ্ছ ক্লিয়ার করে বলো।’

‘ছোটো বেলায় যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়তাম। তখন অঙ্ক ক্লাসে এক ছেলে বই দেখে অংঙ্কের সমাধান করেছিল। যাকে বলে চুরি করা। স্যারকে খাতা দিয়ে বলেছিল, ‘স্যার আমি কিন্তু দেখে লিখি নাই।’ তখন স্যার বলল,’ঠাকুর ঘরে কে রে? ঠাকুর থেকে উত্তর এলো, কলা তো আমি খাইনি।’ আপনি যদি বুদ্ধিমান হয়ে থাকেন, তাহলে আমার কথার সারমর্ম বুঝতে পারবেন। এখন সরুন, ঘুমাব।’

অর্ষা গিয়ে শুয়ে পড়ে। আহনাফ রাগে গজরাতে গজরাতে বলে,’তোমার ধারণা মোটেও ঠিক নয়।’

‘আচ্ছা।’ অর্ষা আর কথা বাড়াল না।

এদিকে রাগ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না আহনাফের। অর্ষা কী ভাবল? সে কি ইচ্ছে করে পড়েছে নাকি? ওর কি চোখ নাই? দেখেনি ক্যাথির জন্যই তো… এবার আহনাফের ধ্যান ও রাগ সব গিয়ে পড়ল ক্যাথিওনের ওপর।

সে দাঁত কিড়মিড় করে ক্যাথির দিকে তাকিয়ে বলল,’বেয়া’দব তোর জন্য এখন আমাকে উলটা-পালটা কথা শুনতে হচ্ছে।’

ক্যাথিওন অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে। ওর এই দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে, শক্ত হাতে বগলদাবা করে লিলিয়ার রুমে দিয়ে এলো আহনাফ। ঘরে ফিরে এসে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে নিজের উপস্থিতি এবং রাগের কথা অর্ষাকে জানান দিলো। অর্ষার অবশ্য এতে কোনো হেলদোল নেই। সে অলরেডি ঘুমিয়েও পড়েছে। লাইট নিভিয়ে আহনাফও গিয়ে নিঃশব্দে পাশে শুয়ে পড়ল। মাঝখানে বর্ডার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আহনাফের আদরের কোলবালিশকে। কোলবালিশ যে জড়িয়ে ধরবে তারও কোনো উপায় নেই। পরে যদি কোনোভাবে অর্ষার গায়ে স্পর্শ লাগে, তাহলে নির্ঘাত মেয়েটা তাকে ক্যারেক্টারলেস ভেবে বসবে।
____
সকালে অর্ষার আগে আহনাফের ঘুম ভাঙে। এলার্ম বন্ধ করে ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। গোসল করে ফিরে এসে দেখে অর্ষা তখনো ঘুমাচ্ছে। হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আলমারির কাবার্ড থেকে জামা-কাপড় বের করে তৈরি হয়ে নেয়। বডিস্প্রে করার সময় আয়নায় চোখ যায় অর্ষার দিকে। তখনই গতকাল অর্ষার বলা ‘আপনার ওয়েট কত’ কথাটি মনে পড়ে যায়।

তখন সে ঘুরেফিরে নিজেকে দেখে স্বগতোক্তি করে,’আমি কি মোটা হয়ে গেছি এই ক’দিনে? কই না তো! ফিট-ই তো মনে হচ্ছে। নাকি একটু মোটা সত্যিই হয়েছি? হলেও হতে পারি। অনেকদিন তো হলো শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়া হয় না।’

সে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে,’ধুর! কী যা তা ভাবছি। ধ্যাত!’

সে নাস্তা করতে চলে যায়। লিলিয়ার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,’স্মিথ কোথায়?’

‘ও তো ঘরে।’ লিলিয়ার উত্তর।

‘আসতে বলো। নাস্তা করে ও’কে স্কুলে ড্রপ করে দেবো।’

‘আচ্ছা।’ বলে লিলিয়া স্মিথকে ডাকতে চলে যায়।

স্মিথ যখন এলো তখন ওর সাথে সাথে নতুন বিড়ালটাও এসেছে। ক্যাথি অনুপস্থিত এখানে।

আহনাফ স্মিথকে চেয়ার দেখিয়ে বলল,’বসো এখানে।’

স্মিথ বসার পর ওর পা ঘেঁষে বসেছে নতুন বিড়ালটি। আহনাফ হেসে বলল,’আরে বাহ্! এক রাতেই দেখি ও তোমার ভক্ত হয়ে গেছে।’

উত্তরে স্মিথ শুধু হালকা হাসল। এই ছেলে চুপচাপ স্বভাবের। কথা কম বলে। রুটিতে কামড় বসিয়ে আহনাফ বলল,’ওর নাম রেখেছ?’

স্মিথকে এবার উৎসাহিত দেখাল। সে অতি উৎসাহে বলল,’না, ব্রো। তুমি রাখো।’

তখন চট করেই আহনাফের মাথায় ‘অ্যানিওন’ নামটা এলো। সে বলল,’ওকে। ক্যাথিওনের নামের সাথে মিলিয়ে অ্যানিওন রাখলে কেমন হয়?’

‘ভালো হয়।’

‘বেশ। তাহলে আজ থেকে ওর নাম অ্যানিওন।’

‘আচ্ছা।’

‘ক্যাথি কোথায়?’

‘তোমার রুমে।’

আহনাফ বাম হাতে নিজের কপাল চাপড়ে বলল,’হায় আল্লাহ্! ও আবার অর্ষার কাছে গেছে।’

স্মিথ মুচকি হেসে বলল,’আমার মনে হয়, ক্যাথিওন আপুকে অনেক পছন্দ করে।’

আহনাফও মুচকি হেসে বলল,’হতে পারে।’

ওদের খাওয়া শেষ হওয়ার পূর্বেই অর্ষা বিরক্তমুখে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এখনো যে ঘুম ছাড়েনি সেটা ওর দু’চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এগিয়ে এসে সে স্মিথের পাশের চেয়ারে বসল। চোখে ঘুম থাকায় অ্যানিওনকে খেয়াল করেনি। কিন্তু তৎক্ষণাৎ অর্ষা আসার পর অ্যানিওন দৌঁড়ে লিলিয়ার রুমে চলে গেল। যাওয়ার সময় অর্ষা ও’কে দেখতে পায়। ঘুম ছুটে যায় তার।

অবাক হয়ে জানতে চাইল,’এটা কী হলো? আমি আসার পর এই বিড়ালটা দৌঁড়ে চলে গেল কেন?’

আহনাফ কাঁধ উঁচিয়ে বলল,’কী জানি!’

অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,’হায়রে কপাল! একজন পিছুই ছাড়ে না আর অন্যজন দেখলেই পালায়।’

‘তোমার তো ঘুম শেষ হয়নি মনে হচ্ছে। উঠলে কেন?’

‘আবার কেন? আপনার সাধের বিড়ালের জন্য।’

‘ক্যাথি? কী করেছে আবার?’

‘কী আর করবে! ঘরে গিয়ে তার ম্যাউ ম্যাউ শুরু। চিৎকারের জন্য ঘুমানোর উপায় আছে নাকি।’

মাথায় হাত দিয়ে বসে কথা বলছিল অর্ষা। এবার সে সোজা হয়ে বসে আহনাফের উদ্দেশ্যে বলে,’আচ্ছা আপনার বিড়ালটা সবসময় আমার পিছে পিছে ঘুরে কেন?’

আহনাফ বিরক্ত হয়ে বলে,’তুমি আসার আগে থেকে ক্যাথিওন এই বাড়িতে থাকে। তোমার থেকে ওর অগ্রাধিকার অনেক বেশি। ও কোথায় যাবে, কোথায় ঘুমাবে কার পিছে ঘুরবে এটা একান্তই ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার।’

‘আশ্চর্য! বিড়ালেরও আবার ব্যক্তিগত বিষয় হয়?’

‘হ্যাঁ, হয়। আর খামোখা কখনো ওর ভয়ে চেঁচাবে না এভাবে। ক্যাথিওন বাঘ কিংবা ভাল্লুক নয় যে তোমাকে গিলে খাবে।’

‘বাঘ, ভাল্লুকও যদি পালতেন এরচেয়ে ঢের ভালো ছিল। এক থাবাতেই পেটের ভেতর চলে যেতাম। কষ্ট, ভয় যা পাওয়ার একেবারেই পেতাম। কিন্তু আপনার ক্যাথিওন তো প্রতিটা ক্ষণে ক্ষণে আমায় ভয় দেখাচ্ছে।’

আহনাফ বিড়বিড় করে বলে,’ভীতুর ডিম।’

এরপর সে স্মিথের উদ্দেশ্যে বলল,’তোমার হয়েছে?’

স্মিথ মাথা নাড়িয়ে বলল,’হ্যাঁ।’

‘যাও ব্যাগ নিয়ে আসো। আমি আসছি।’

স্মিথ চলে যাওয়ার পর আহনাফ অর্ষাকে বলল,’ঘরে আসো একটু।’

অর্ষা হেলতে-দুলতে ঘরে যায়।
জিজ্ঞেস করে,’ঘরে ডাকলেন কেন?’

‘এই নাও কিছু সুইস ফ্রাঙ্ক রাখো। বাইরে গেলে কাজে লাগবে।’

বোকার মতো প্রশ্ন করে অর্ষা,’সুইস ফ্রাঙ্ক কী?’

‘সুইজারল্যান্ডের মুদ্রাকে সুইস ফ্রাঙ্ক বলে। আমরা যেমন বাংলাদেশে টাকা বলি।’

‘ওহ। আমার লাগবে না।’

‘কেন?’

‘এমনি। তাছাড়া আমি তো বাইরে যাই না। এখানকার কিছু চিনিও না। কোথায় যাব একা?’

আহনাফ একটুখানি সময় চুপ থেকে কী যেন ভাবল। এরপর বলল,’আচ্ছা তাও রাখো। আমি সময় পেয়ে তোমায় ঘুরতে নিয়ে যাব।’

অর্ষা অবিশ্বাস্যকণ্ঠে বলল,’আপনি?’

‘আর কেউ আছে তোমার?’

অর্ষা থতমত খেয়ে বলল,’মানে?’

‘আসছি আমি।’

আহনাফ চলে যাওয়ার পরও অর্ষা বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ক্যাথিওনকে আবারও সে নিজের রুমে আসতে দেখতে পায়। বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয় সে।

নিজের নাস্তাগুলো একটা প্লেটে নিতে নিতে লিলিয়াকে বলল,’আন্টি আমি খাবার নিয়ে ঘরে যাচ্ছি। আপনি ক্যাথিওনকে বাইরে আনেন তো।’

অর্ষার যে বিড়াল ভীতি রয়েছে সেটা আহনাফ তাকে জানিয়েছিল। তাই সে মুচকি হেসে বলল,’আচ্ছা।’

খাবার নিয়ে রুমে যায় অর্ষা। গেইট লক করে লম্বা শ্বাস নেয়। ভেঙে যাওয়া ঘুমটা আর আসবে না। তাই ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। খেতে খেতে কী করবে ভেবে না পেয়ে বন্ধুদের গ্রুপে কল করে। সবার আগে কলে জয়েন হয় আহিল।

আহিল-ই প্রথম কথা বলে,’কী অবস্থা? কেমন আছিস?’

অর্ষা ক্ষীণস্বরে বলল,’ভালো। তুই কেমন আছিস?’

‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। কী করছিস?’

‘নাস্তা করি। তুই?’

‘আমিও।’

‘আঙ্কেল-আন্টি, রেণু আপা কেমন আছে?’

‘সবাই ভালো আছে।’

‘ঐ, ঐ আমারে একটু সাইড দে।’ কলে জয়েন হয়ে বলল লামিয়া।

ততক্ষণে আশিক, দিদার আর রেশমিও জয়েন হয়েছে। শুধু জুই নেই।

আশিক তখন বলল,’লামিয়া আর আশিক তোরা কালকে অফলাইনে ছিলি ক্যান? কাহিনি কী মামা?’

আহিল হেসে বলে,’কাহিনি কিছুই না মামা। লামিয়া বিয়াইত্তা মহিলা ওর সাথে কি আমার কাহিনি হবে?’

লামিয়াও দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’এই আশিক বান্দরডারে কেউ থামা। হুদ্দাই খালি ফাউ কথা কইব।’

‘ওর কাম-ই তো এইডা।’ বলল রেশমি।

অর্ষা বলল,’দিদার চুপ করে আছিস কেন?’

‘আমি ভাই সকাল সকাল এনার্জি নষ্ট করতে চাইতেছি না। তোরা ঝগড়া কর। আমি একটু শান্তিতে খাই।’ খেতে খেতেই বলল দিদার।

‘ভাইরে তুই খাওয়া ছাড়া আর কিছু বুঝিস না?’

‘না আফা। দুনিয়াতে খাওনের আর হাগনের মতো শান্তি আর কিস্সুতে নাই বুঝছিস মনু?’

সকলে দাঁতমুখ খিঁচে বলল,’খাচ্চোর। খাওয়ার সময়েও কী সব বলে!’

‘মামা হাছা কথা কইতে আবার সময়-অসময় কী?’

আহিল বলল,’না ভাই, কোনো সময়-অসময় লাগব না। তুই মুখ অফ রাইখা চুপচাপ খা। আর আমাদের শান্তিমতো খাইতে দে।’

‘অহ। তোরাও খাইতেছিস?’

আহিল বলল,’অনেকেই নাস্তা করতেছি।’

‘আচ্ছা খা। আমিও গিলি।’

আশিক আড়মোড়া ভেঙে বলল,’কীরে আজকে কুইকুই নাই?’

‘কার কথা বলিস? জুঁই?’ প্রশ্ন করল রেশমি।

‘আর কে তাহলে? ঐ একখানই তো কুইকুই আছে আমাদের।’

‘ঘুমায় মনে হয়। নয়তো রানতাছে দেখগা।’

লামিয়া বলল,’ঐ অর্ষা ভার্সিটিতে কোথায় পড়বি? বিডিতে আসবি না?’

আশিক বলল,’ঠিক কথা। ভালো প্রশ্ন করছিস। আমরা কিন্তু সবাই এক ভার্সিটিতে ভর্তি হমু।’

অর্ষা বলল,’আগে তো রেজাল্ট দেক।’

‘রেজাল্ট তো দেবেই। কিন্তু তোর কী ইচ্ছা শুনি?’

‘আমার আবার কী ইচ্ছা হবে? জানিনা এখনো কিছু।’

রেশমি মনমরা হয়ে বলল,’আমাদের মনে হয় ভার্সিটিতে একসাথে পড়া হবে না রে।’

দিদারের খাওয়া শেষ। সে কলে ফিরে আসে আবার। বন্ধুদের জানায়,’রেজাল্টের পর রাজশাহীতে চলে যাব রে।’

‘ওখানে কেন?’ জানতে চায় আহিল।

‘ফুল ফ্যামিলিসহ যাব। বাকি পড়াশোনা ওখানেই।’

‘পড়াশোনা না ছাই। তুই তো যাবি রাজশাহীর আম আর লিচু খাওয়ার লোভে।’ বলল লামিয়া

সবাই হেসে ফেলে। দিদারও হেসে বলে,’আমি তো খাব-ই। তোদের জন্যও পাঠাব। কিন্তু একটা সত্যি কথা কি জানিস, তোদের মতো বন্ধু আমি আর কখনোই পাব না। তোদের ছাড়া যে কী করে থাকব কে জানে!’

সবার-ই মনটা খারাপ হয়ে যায় এবার। আসলে বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো এমনই। একটা সময়ে প্রত্যেককে নিজের ক্যারিয়ার কিংবা ব্যস্ততার কাছে হার মানতে হয়। চাইলেই যখন তখন দেখা করা যায় না। রাস্তার মোড়ে টং দোকানে চায়ের আড্ডা দেওয়া যায় না। চাইলেই একসাথে ভেজা যায় না ঝুমবৃষ্টিতে। জীবনের এই গতিধারাকে মানতে কষ্ট হয় তবুও আমাদের মেনে নিতে। মনে নিতে নয়। সকলের বুক ভারী হয়ে আসে। বুকচিরে বেরিয়ে আসে প্রলম্বিত শ্বাস। মনের ভেতর চলছে কালবৈশাখীর ঝড়। এমন বিচ্ছেদ মেনে নেওয়া দুষ্কর, কষ্টদায়ক।

আহিল সকলের উদ্দেশ্যে বলে,’সবাই এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? এক ভার্সিটিতে না পড়লে কি আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে? শুরুতে আমাদের বন্ধুত্ব যেমন ছিল। জীবনের শেষ পর্যন্ত তেমন-ই থাকবে ইন-শা-আল্লাহ্। উদাহরণ হিসেবে অর্ষাকে দেখ। অর্ষা আমাদের থেকে কত্ত দূরে! সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি দেশে। চাইলেই ও আমাদের কাছে আসতে পারবে না যখন-তখন। আমরাও ইচ্ছা হলে যখন-তখন যেতে পারব না। এতে কি অর্ষার প্রতি থেকে আমাদের বন্ধুত্বের টান কমে গেছে? নাকি অর্ষার আমাদের প্রতি থেকে টান কমে গেছে? আমাদের কিন্তু নিয়ম করে একবার হলেও প্রতিদিন ফোনে কথা হচ্ছে। ভিডিয়ো কলে একে-অপরকে দেখতে পাচ্ছি। এটাই বা কম কী বল? এই প্রাপ্তিটুকুও তো অনেক। বাস্তবতা তো উপেক্ষা আমরা করতে পারব না। এটলিস্ট বছরে একবার হলেও তো আমাদের দেখা হবে? সেই দিনটাকে আমরা স্মৃতিমধুর করে রাখব। সেই একটা দিনকেই আমরা এমনভাবে উপভোগ করব যাতে বাকি ৩৬৪ দিন একটা দিনের স্মৃতিকে মনে পুঁজি করে কাটাতে পারি সবাই।’

জুঁই কলে জয়েন হয়ে আহিলের কথা শুনে চুপ করে ছিল। সকলে ইমোশোনাল হয়ে পড়ে। জুঁই তো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে শুরু করে,’আমাদের গ্যাঞ্জাম পার্টি যেন সবসময় এমনই থাকে দোস্ত।’

‘গ্যাঞ্জাম পার্টি শুধু একটা দল-ই নয়, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। আমরা একসাথে ছিলাম, আছি আর থাকব।’ বলল অর্ষা।

লামিয়া তখন আবদার করে বলল,’মনটা ভীষণ খারাপ রে বোকারানী। বন্ধু নিয়ে গানটা শুনিয়ে দে তো।’

সকলে লামিয়ার সাথে সহমত পোষণ করে। অর্ষা বলে,’গাইতে পারি। যদিও তোরা আমার সাথে তাল মেলাস।’

আশিক বলে,’অবশ্যই। তাল মেলাতে মেলাতে মাতাল হয়ে যাব। তুই শুরু কর।’

অর্ষা গান শুরু করে। বাকিরাও সাথে তাল মেলায়। মুহূর্তেই মন খারাপ উড়ে গিয়ে ঝলমলে রোদের মতো আনন্দেও মনটা ঝলমল করে ওঠে সকলের। কিছু বন্ধুত্ব এমনই থাকুক। আজীবন।
__________
দুপুরের দিকে লিলিয়ার ফোনে কল আসে। তারপর থেকেই তাকে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছিল। ফোনে কথা বলা শেষ হলে অর্ষা জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে?’

লিলিয়া অস্থিরচিত্তে বলে,’আমার ছোটো বোন প্রেগন্যান্ট। খুব অসুস্থ হয়ে গেছে হঠাৎ করে। হাসপাতালে ভর্তি এখন।’

‘আপনি চিন্তা করবেন না। ইন-শা-আল্লাহ্ তার কিছু হবে না। আর সময় থাকতে আপনিও বেরিয়ে পড়ুন।’

তিনি ইতস্তত করে বললেন,’আমি চলে গেলে তুমি থাকবে কী করে?’

‘আমার কথা ভাবতে হবে না। আমি থাকতে পারব। আর সে তো রাতে চলেই আসবে। আপনার বোন কোথায় থাকে?’

‘বার্ন সিটিতে।’

‘ওহ। তাহলে আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ুন। যাওয়ার পথে না হয় স্মিথকে সাথে করে নিয়ে যাবেন।’

‘তুমি কি শিওর থাকতে পারবে?’

‘হ্যাঁ, পারব।’

লিলিয়া তৈরি হতে চলে যায়। এই সময়ে ছোটো বোনের পাশে না থাকতে পারলে সেও স্বস্তি পেত না। ঘরে গিয়ে আহনাফকেও সে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। আহনাফও বারণ করেনি।

যাওয়ার পূর্বে তিনি অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’সাবধানে থাকবে তুমি। আর বিড়াল দুটোকে আমার ঘরে রেখেছি। ভয় পেও না।’

অর্ষা স্মিত হেসে বলল,’সাবধানে যাবেন।’

লিলিয়া চলে যাওয়ার পর অর্ষা গেইট লাগিয়ে রুমে ফিরে এলো। কী করবে ভেবে না পেয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখল। টিভি দেখতেও তার ভালো লাগছিল না। তাই বুকশেলফ থেকে একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করে। বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুম চলে এসেছে আর সে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরও পায়নি।
.
.
আকাশের অবস্থা ভালো নয়। চারদিকে ঘুটঘুটে কালো মেঘের প্রভাব। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। অর্ষা বাড়িতে একা। সূতরাং তাকে আহনাফকে আগেই বাসায় ফিরতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাতের কাজগুলো শেষ করে নিল। অফিস থেকে বের হওয়ার আগে হেলেন কল করেছিল বারে যাওয়ার জন্য। আহনাফ নাকচ করে দিয়েছে। এজন্য অবশ্য হেলেন অর্ষাকে জড়িয়ে মজা নিতেও সময় বিলম্ব করেনি।

আহনাফ যখন অফিস থেকে বের হয় তখন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। এরপর বৃষ্টি জোরে পড়তে শুরু করে। যেখানে সে তাড়াতাড়ি আসার জন্য চেষ্টা করছিল সেখানেই তাকে সমস্যায় পড়তে হয়। মাঝরাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। গাড়ি সারাতে হয় তাকে বৃষ্টিতে ভিজেপুড়ে। বাড়ি ফিরতে আধ ঘণ্টা লেট হয়ে যায়।

বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে বাড়িতে পৌঁছায় সে। কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় অর্ষা। আহনাফকে দেখে রীতিমতো চমকে ওঠে।

দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলে,’একি! ভিজে এসেছেন কেন?’

আহনাফ ভেতরে ঢুকে বলল,’শখে।’

অর্ষা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আহনাফ সত্যিই শখ করে ভিজেছে নাকি বুঝতে পারছে না। সে আহনাফের পিছু পিছু রুমে ঢোকে। আহনাফ সোজা ওয়াশরুমে চলে গেছিল। দরজায় দাঁড়িয়ে অর্ষাকে বলল,’আলমারি থেকে একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার দিয়ে যাও।’

মেরুন রঙের হাফ স্লিভের একটা টি-শার্ট আর অ্যাশ কালারের ট্রাউজার নিয়ে অর্ষা ওয়াশরুমের কাছে গেল। আহনাফ জামা-কাপড় নিয়ে ফোন আর ওয়ালেট অর্ষার হাতে দিলো।

অর্ষা সেগুলো বেড সাইড টেবিলের ওপর রেখে চা বানাতে যায়। আহনাফের গোসল শেষ হতে হতে চা বানানোও হয়ে যায়।

অর্ষা চা নিয়ে আসায় আহনাফ মৃদু হেসে বলে,’থ্যাঙ্কিউ। এটার খুব প্রয়োজন ছিল এখন।’

অর্ষা খেয়াল করল, আহনাফের দু’চোখ অস্বাভাবিক রকমের লাল হয়ে আছে। সে আঁৎকে উঠে বলল,’আপনার চোখ দুটো ভীষণ লাল হয়ে গেছে।’

‘বৃষ্টিতে ভিজলে এমন হয়।’ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল আহনাফ।

‘আপনি বৃষ্টিতে ভেজেন না তাহলে?’

‘ইচ্ছাকৃত কখনো ভিজি না। আজ মাঝরাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়েছিল তাই এই অবস্থা।’

‘মনে হচ্ছে জ্বর আসবে।’

চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটি টেবিলের ওপর রাখল আহনাফ। মাথা দুলিয়ে বলল,’আসতে পারে। আমি এখন একটা নাপা খেয়ে শুয়ে পড়ব। রাতে আর না-ও উঠতে পারি। তুমি খেয়ে নিও।’

অর্ষা কিছু বলল না। শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আহনাফ সত্যি সত্যি ট্যাবলেট খেয়ে ব্লাঙ্কেট গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। অর্ষা করার মতো কিছু না পেয়ে আবার বই নিয়ে বসে পড়ে।

ঘড়ির কাটায় ন’টা বাজে। বই পড়তেও এখন বোর হয়ে গেছে অর্ষা। উঁকি দিয়ে একবার আহনাফের দিকে তাকাল। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হাত বাড়িয়ে একবার দেখবে কিনা গায়ের তাপমাত্রা কেমন? বুঝতে পারছে না, কাজটা ঠিক হবে কিনা। পরক্ষণে মনে হলো এখানে বেঠিকের-ই বা কী আছে? সে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূরে ছুঁড়ে ফেলে। ডান হাতটি রাখে আহনাফের গায়ে। আশ্চর্য! জ্বরে শরীর তো পুড়ে যাচ্ছে। লিলিয়াও বাসায় নেই। কী করবে সে এখন?

দিকদিশা ভুলে গিয়ে সে চুপচাপ বসে রইল কিছুক্ষণ। এরপর ভাবল আমেনা বেগমকে একবার ফোন করবে। পরবর্তীতে মনে হলো, মায়ের মন! উনি চিন্তায় পড়ে যাবে। তাই সে আহিলকে ফোন দিয়ে আহনাফের জ্বর হওয়ার কথা জানাল।

আহিল সব শুনে বলল,’তুই চিন্তা করিস না। ভাইয়া বৃষ্টিতে ভিজলে এমন জ্বর আসে। যতগুলো ওষুধ আছে সবগুলোর ছবি তুলে আমাকে পাঠাবি এখনই। কোনটা জ্বরের ওষুধ আমি বলে দিচ্ছি।’

‘আচ্ছা।’

‘আর শোন, ভাইয়ার জ্বর কিন্তু সহজে ছাড়ে না। মাথায় পানি দিস।’

‘আচ্ছা।’

‘ওষুধ খাওয়ানোর আগে কিছু খাইয়ে দিস মনে করে। খালি পেটে ওষুধ খাওয়াইস না আবার।’

‘আচ্ছা।’

আহিল এবার চুপ মেরে যায়। কয়েক সেকেন্ড মৌন থেকে বলে,’সব কথায় আচ্ছা আচ্ছা বলছিস কেন? নার্ভাস তুই?’

‘আহিল! আমার না ভীষণ ভয় করছে।’

‘ধুর পাগলী! ভয় নেই। কারেন্ট আছে তো?’

‘আছে।’

‘মোমবাতি, ম্যাচ এসব কাছেই রাখিস। ভয় পাবি না। কিছু হবে না।’

‘আচ্ছা।’

‘এখন তোকে যা বললাম তাই কর।’

অর্ষা ছবি তুলে আহিলকে পাঠিয়ে রান্নাঘরে গেল খাবার গরম করতে। তখন মনে পড়ল, বিড়াল দুটোকেও তো খাবার দেওয়া হয়নি। সেই যে দুপুরে লিলিয়া শুধু খাইয়ে গিয়েছিল। ওদের-ও নিশ্চয়ই অনেক ক্ষুধা লেগেছে! সে অনেকটা সাহস সঞ্চয় করল। সে যদি এখন মনে না সাহস আনতে পারে, তাহলে বিড়াল দুটোকেও না খেয়ে থাকতে হবে।

খাবার গরম করা শেষ হলে বিড়ালের আলাদা খাবার আছে সেগুলো দুটো বাটিতে বেড়ে নিল। এরপর ভয়ে ভয়ে রুমের দরজা খুলল। বিড়াল দুটো মেঝেতে শুয়ে ছিল। অর্ষাকে দেখে মাথা উঁচু করে একবার তাকাল শুধু। একটা শব্দও করল না। খাবার রেখে জলদি ফিরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয় অর্ষা। মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন।

ঘরে ফিরে আহনাফের বাহু ধরে হালকা ঝাঁকিয়ে বলল,’এইযে শুনছেন?’

আহনাফ নিরুত্তর।

অর্ষা বলল,’শুনুন না? উঠুন। কিছু খেয়ে নিন।’

আহনাফ জড়ানো কণ্ঠে বলল,’চুপ।’

‘আচ্ছা আমি চুপ করব। আপনি খেয়ে নিন।’

আহনাফ আবারও জড়ানো কণ্ঠে বলল,’আমার ভালো লাগছে না। মাথা ব্যথা করছে।’

‘খাবার খেয়ে ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’

‘খাব না কিছু। তুমি কে? চলে যাও।’

অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,’অ্যা! আমি কে মানে?’

পরে আবার নিজেই মাথা নাড়িয়ে বলে,’জ্বরে প্রলাপ বকছে নিশ্চয়ই।’

সে অনেক কষ্টে আহনাফকে ধরে আধশোয়া অবস্থায় বসায়। লাজ-লজ্জাকে এক সাইডে রেখে মনকে স্থির করল, সামনের মানুষটি শুধু তার স্বামী-ই নয় বরং সে এখন অসুস্থও। তার সেবা করা অর্ষার দায়িত্ব ও কর্তব্য উভয়ই। তাই সে নিজের হাতেই আহনাফকে খাইয়ে দিলো। বেশি খাওয়াতে পারেনি অবশ্য। বহু কষ্টে দু’লোকমা ভাত শুধু খাওয়াতে পেরেছে। এরপর আহিলের বলে দেওয়া ওষুধ খাইয়ে আবার শুইয়ে দিয়েছে।

মাথার নিচে বড়ো একটা পলিথিন রেখে বালতি ভরে পানি নিয়ে আসে। পাশে বসে মিনিট বিশেক মাথায় পানি দিয়ে দেয়। এক হাত দিয়ে মগে পানি নিয়ে ঢালছিল আর অন্য হাতে আহনাফের মাথায় চুলের মাঝে বিলি কাটছিল যাতে পানি চুলের ভেতর অব্দি পৌঁছায়। হঠাৎ আহনাফ অর্ষার হাত ধরে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে,’উঁহু! আর না।’

অর্ষা শুনল তার কথা। পলিসহ বালতি ওয়াশরুমে রেখে আহনাফকে সোজা করে শুইয়ে দিলো। ঘরের লাইট নিভিয়ে সেও আহনাফের পাশে শুয়ে পড়ে। বরাবরের মতো আজও দুজনের মাঝে কোলবালিশ রয়েছে। একটু পর পর আহনাফের কপালে হাত রেখে দেখছে, জ্বর আবার বেড়েছে কিনা। আজ আর অর্ষার ঘুম ঠিকমতো হবে না বোঝা যাচ্ছে। আকস্মিক কোলবালিশ সরিয়ে অর্ষার গায়ে হাত রাখে আহনাফ। তার উত্তপ্ত হাত অর্ষার শীতল হাতের ওপর পড়তেই অর্ষা চমকে ওঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায় ঘুমন্ত আহনাফের দিকে। এরপর আস্তে-ধীরে হাতটি ধরে সরাতে যাবে, উলটো আহনাফ তখন অর্ষার হাত ধরে একটানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে যায় অর্ষা। আহনাফের শরীরের উত্তপ্ত উত্তাপ শুষে নিচ্ছে অর্ষার শীতল গাত্র। বাইরের রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ এখন আর সে শুনতে পাচ্ছে না। এখন শুধু শুনতে পাচ্ছে আহনাফের বুকের ভেতর হওয়া ঢিপঢিপ শব্দ।

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
কিছু অনুভূতি হয় মেঘের মতো। যখন মেঘগুলো সাদা মেঘের ন্যায় নীল আকাশের বুকে বিচরণ করে, তখন সেই দৃশ্য যতটা দৃষ্টিনন্দিত লাগে, ঠিক ততটাই শীতল মনোমুগ্ধকর লাগে যখন মেঘগুলো কালো হয়ে আকাশে বিচরণ করে। মুহূর্তের মধ্যেই ফের বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। শীতল করে তোলে উত্তপ্ত পৃথিবী। অর্ষার অবস্থান এখন সেরকম মেঘ ও বৃষ্টির মতো। অপরদিকে গনগনে উত্তপ্ত ধরণী হচ্ছে আহনাফ। যে এখন অর্ষার সংস্পর্শে এসে নিজেকেও শীতল করে নিচ্ছে।

জ্বরে ঘোরের মাত্রা বাড়ে। সেই সঙ্গে শুরু হয় আহনাফের প্রলাপ। জড়ানো কণ্ঠে সে মৃদুস্বরে ডাকে,’শোনো!’

অর্ষা শোনে তবে প্রত্যুত্তর করে না। বলা বাহুল্য, সে প্রত্যুত্তর করতে পারছে না। মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোনো শক্তি শক্ত হাতে তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। সে একটা টু’শব্দও পর্যন্ত করতে পারছে না। আর না পারছে একটুকুও নড়াচড়া করতে! জমে বরফ হয়ে আছে। আহনাফের এতটা কাছে ইতিপূর্বে কখনো আসা হয়নি। কখনো আসবে এমন মনোভাব কিংবা চিন্তাও কখনো তার মনে, মস্তিষ্কে, মাথায় উদয় হয়নি। তাহলে আজ হঠাৎ কী হলো? কেন হলো? কেন অভাবনীয় ঘটনা এভাবে ঘটে গেল? মানুষটা কাছে টেনেছে। সেটা কি সেচ্ছায়? নয়তো! জ্বরের ঘোরে। সে জানেই না সে এখন কী করছে, কী বলছে। তাহলে কেন এই অনুভূতি? এই অনুভূতি ভয়ংকর। প্রবল ভয়ংকর। শুধু আহনাফের বুকের ঢিপঢিপ শব্দ-ই নয়; বরঞ্চ স্পষ্টভাবে নিজের বুকের হৃদস্পন্দনও সে শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই বুঝি মিনি হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যাবে।

আহনাফ বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে, ‘শুনছ না কেন?’

অর্ষা থমকায়। চমকে ওঠে। এই কণ্ঠে শুধু আকুতি নয়; রয়েছে আবদারও। কী সেই আবদার? কেন এমন হচ্ছে। কেন এমন লাগছে? সবকিছু উলট-পালট লাগছে অর্ষার। সে এই মানুষটির কণ্ঠস্বরেও পর্যন্ত হারিয়ে যাচ্ছে।

‘মারব তোমায়। কথা বলো না কেন?’ একই কণ্ঠে বলে ওঠে আহনাফ।

আবার একটুখানি চুপ। ঘোরলাগা কণ্ঠে ফের বলে ওঠে,’শুনছ?’

অর্ষার মুখ থেকে বহুকষ্টে বের হয়,’হু।’

‘তুমি অনেক নরম। তুলতুলে। ছোট্ট পাখির ছানার মতো।’

যতটুকু স্তব্ধ কিংবা বরফ হতে অর্ষার বাকি ছিল এবার আর ততটুকুও অবশিষ্ট রইল না। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। জ্বরের ঘোরে বলে কি এই লোক?

আহনাফ এবার আরো ভয়ংকর একটা কান্ড করে বসে। সে অর্ষার গালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দেয়। শরীর হালকা হয়ে আসে অর্ষার। সে নিজেও কোনো ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছে। যখন সম্বিৎ ফিরে পায়, তখন তড়াক করে উঠে বসে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় আহনাফের বাহুবন্ধন থেকে।

আহনাফ বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠে বলে,’প্লিজ যেও না! আমায় একা করে যেও না। আমি আর কথা বলব না। সত্যি, প্রমিজ।’

অর্ষা নিরবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। মেঝে থেকে কোলবালিশটা তুলে বিছানায় রাখে। ড্রেসিংটেবিলের সামনে থেকে চেয়ার টেনে এনে বিছানার কাছে এনে আহনাফের পাশে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘যাচ্ছি না কোথাও। আপনি ঘুমান।’

‘সত্যিই?’

‘সত্যি।’

‘তুমি অনেক ভালো।’

‘আচ্ছা।’

অর্ষা নিরবে বসে আহনাফের ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আহনাফ ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন শুধু তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘুম নেই শুধু অর্ষার চোখে। সে ভুলতে পারছে না মুহূর্তটাকে। বারবার মানসপটে, দৃশ্যপটে শুধু একই দৃশ্য ভেসে উঠছে। অর্ষা মনেপ্রাণে চেষ্টা করছে দৃশ্যটিকে ভুলে যেতে। আহনাফ ইচ্ছাকৃত এসব কিছু করেনি। জ্বরের প্রভাবে করেছে। জ্বর সারলে হয়তো মনেও থাকবে না। তাই তারও এসব মনে রাখা উচিত নয়। একদম-ই নয়।
.
.
ফজরের আজানের পর নামাজ পড়ে একেবারে ঘুমিয়েছে অর্ষা। সকাল ছয়টা বাজতেই আবার উঠে পড়েছে। আহনাফের কপালে হাত দিয়ে দেখে ঠান্ডা। গালে, গলায়ও হাত রেখে দেখল শরীরে জ্বর নেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। অসুস্থতা মানুষটাকে কাবু করতে পারেনি তেমন! এই-ই ঢের তার কাছে।

সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে তাই পরিবেশ আজ ঠান্ডা। বাইরের সবুজ প্রকৃতিতে মিশে আছে মুক্তোদানার মতো বৃষ্টির ছোটো ছোটো ফোটা। সে কিচেনে গিয়ে সকালের নাস্তা বানিয়ে ঘরে ফিরে আসে। আহনাফকে ডাকতে গিয়ে কিছুক্ষণ এক পলকে তাকিয়ে থাকে। গভীর সেই দৃষ্টি। আহনাফ যদি এখন জেগে থাকত, তাহলে নিঃসন্দেহে এই দৃষ্টি তার অন্তর্ভেদ করত। বিশেষ কিছু কোথায় আছে? আহনাফের মায়া মায়া মুখটিতে নাকি অর্ষার টানা দুটো চোখদুটিতে?

পরক্ষণে দ্রুত দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নেয়। নিজের প্রতিবিম্বকে ভর্ৎসনা করে বলল,

‘একি কী হলো তোর? হঠাৎ করে কি মাথায় ভূত চেপেছে? কাল রাতের কথা সম্পূর্ণ ভুলে যা। দিনদিন কি বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস নাকি?’

‘কী হয়েছে?’ আহনাফ ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে অর্ষার দিকে। ঘুম ভেঙে অর্ষাকে হাত নাড়িয়ে কথা বলতে দেখে প্রশ্নটা আর না করে পারল না।

অর্ষা লজ্জা পেয়ে যায়। অপ্রস্তুত হয়ে বলে,’কই, কিছু না তো!’

‘কার সাথে কথা বলছ?’

‘কারও সাথে না। আপনি উঠুন। অফিসে যাবেন না?’

আহনাফ আলসেমি ভেঙে উঠে বসে। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বলে,’ভালো লাগছে না আজ।’

‘এখনো মাথা ব্যথা করছে?’

‘হুম।’

‘তাহলে আজ আর যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে রেস্ট করুন।’

আহনাফ নিরুত্তর। অর্ষা বলল,’আগে গোসল করে আসুন। আমি কফি আর নাস্তা দিচ্ছি। খেয়ে ওষুধ খাবেন।’

এরপর সে নিজেই জামা-কাপড় বের করে আহনাফকে দিলো। আহনাফ বাধ্য ছেলের মতো গোসল করতে চলে যায়। সমস্যা হয়ে গেছে অর্ষার। সে আহনাফের দিক থেকে চোখ-ই ফেরাতে পারছে না। এরকম বেহায়া স্বভাব তো তার কোনোকালে ছিল না! লোকটাকে হঠাৎ করে এত সুন্দর লাগছে কেন? নাকি সে আগে থেকেই সুন্দর? হতেও পারে। হয়তো অর্ষাই আগে খেয়াল করেনি। আর নয়তো জ্বর আসার পর কিউট হয়ে গেছে। যাহ্! জ্বর এলেও বুঝি কেউ কিউট হয়? নিজের বোকা বোকা চিন্তা-ভাবনায় নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারছে না সে।

আহনাফ গোসল সেরে এসে দেখে অর্ষা নাস্তা নিয়ে বসে আছে। সে পাশের একটা চেয়ারে বসে বলল,’তুমি খেয়েছ?’

অর্ষা ছোটো করে বলল,’না। পরে খাব।’

‘পরে কেন?’

‘এখনো ক্ষুধা লাগেনি।’

আহনাফ কফির মগে চুমুক দিয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,’বাহ্! কফি তো ভালোই বানাও।’

‘থ্যাঙ্কিউ।’

‘ইউ আর ওয়েলকাম। পরে একা একা না খেয়ে আমার সাথেই খাও।’

অর্ষার দৃষ্টি নত। সে তাকাচ্ছে না আহনাফের দিকে। হঠাৎ করে তার মাঝে বিশাল পরিবর্তন বুঝি এসে পড়েছে।

‘তুমি ঠিক আছো?’ অর্ষার পরিবর্তন দৃষ্টি এড়াল না আহনাফের।

অর্ষা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করল। গুমোট স্বরে বলল,’জি।’

‘তাহলে মন খারাপ?’

‘কোনোটাই না। আপনি খেয়ে বিড়াল দুটোকে খেতে দিয়েন।’

‘তুমি কোথাও যাবে নাকি?’

অর্ষা রুমে চলে যেত। পাছে আহনাফ আবার কোনো সন্দেহ করে, অথবা অর্ষার পরিবর্তন পুরোপুরি পরখ করে নেয়, এই শঙ্কায় বলল,

‘না তো!’

‘তুমি কিছু লুকাচ্ছ আমার থেকে। বলো কী হয়েছে?’

‘কিছু হলে তো বলব।’

আহনাফ একটুখানি সময় চুপ করে থেকে বলল,’তোমার সাথে জ্বীন প্রজাতির কিছু নেই তো?’

অর্ষা অবাক হয়ে তাকাল। সরাসরি আহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,’মানে কী? এ প্রশ্ন কেন করছেন?’

‘হঠাৎ দেখি তুমি শান্তশিষ্ট, হঠাৎ দেখি ভীষণ চঞ্চল। এখন আবার দেখছি গম্ভীর হয়ে আছো। তাই জানতে চাইলাম।’

‘আপনি মানুষটা ভীষণ অদ্ভুত। আর সেই সাথে আপনার চিন্তা-ভাবনাও।’

অর্ষা রেগে গেছে বুঝতে পেরে মনে মনে হাসছে আহনাফ। ইনোসেন্ট লুক নিয়ে বলল,’তাই নাকি? আচ্ছা অদ্ভুত কাকে বলে?’

অর্ষা বিরক্ত হয়ে তাকায়। সেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে, আহনাফ তাকে ইচ্ছে করে রাগাচ্ছে। আর সে জেনেও বোকার মতো রেগে যাচ্ছে। অদ্ভুত সে নাকি আহনাফ এখন সেটাই ভাববার বিষয়।

অর্ষাকে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে আহনাফ বলল,’বলছ না যে?’

‘আপনি না অসুস্থ? খেয়ে রেস্ট করুন যান।’

‘এখন ততটা অসুস্থ লাগছে না। কফি খেয়ে মাথাও এখন হালকা লাগছে।’

‘তাহলে অফিসে যাবেন?’

‘না। অলরেডি ফোন করে ছুটি নিয়েছি। কী ব্যাপার বলো তো, আমাকে দূরে সরাতে চাইছ মনে হচ্ছে।’

অর্ষা থতমত খেয়ে যায় আহনাফের প্রশ্নে। আমতা আমতা করে বলে,’ক..কই! আমি তো এমনি বললাম।’

অস্বস্তিটুকু আহনাফের দৃষ্টির আড়াল করতে সেও নাস্তার প্লেট এগিয়ে নেয়। সাথে চেষ্টা করে নিজেকেও স্বাভাবিক করার।

খেতে খেতে সে বলল,’রাতে বিড়াল দুটোকে আমি খেতে দিয়েছি।’

আহনাফ অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,’তাই? খুব ভালো করেছ। সাহসীও হয়েছ।’

‘ছাই! পরিস্থিতির শিকার ছিলাম।’

‘তুমি শুধু শুধু ভয় পাও। ওরা কিছু করবে না। আমি তোমাকে ওদের কোলে নিতে শিখিয়ে দেবো।’

অর্ষা লাফ দিয়ে উঠে বলল,’কোনো দরকার নেই।’

‘ওকে, ওকে রিল্যাক্স। তুমি বসো শান্ত হয়ে। খাওয়া শেষ করো।’

অর্ষা শান্ত হয়ে বসে। খেতে খেতে আড়দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

‘আপনি কি রসায়ন সাবজেক্ট অনেক পছন্দ করতেন?’

‘এ কথা জানতে চাচ্ছ কেন?’

‘না মানে, ক্যাথিওন ও অ্যানিওন নামটা কেমন জানি ক্যাটায়ন আর অ্যানায়নের মতো মনে হয়।’

খাওয়া বাদ দিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে আহনাফ। বিস্ময় নিয়ে বলে,’এসব অদ্ভুত চিন্তা-ভাবনা তোমার মাথায় আসে কী করে?’

‘আমার মাথা থেকে আসেনি।’

‘তাহলে?’

‘অন্যদের মাথা থেকে এসেছে।’

‘এই অন্যরা কারা?’

‘আপনি চিনবেন না।’

‘না চিনলে বলো কেন? আজব!’

‘কাদের মাথা থেকে এসেছে সেটা আপনার না জানলেও চলবে। আপনি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।’

‘রসায়ন, ফিজিক্স, হায়ার ম্যাথ, ইংরেজি এগুলো সাবজেক্ট আমার ফেভারিট ছিল। বাট গড সেক, তোমার মতো আজগুবি চিন্তা করে আমি ওদের নাম রাখিনি। এদেশে ক্যাথি, অ্যানি এসব নাম বিদেশি শব্দের মতো। যদিও অ্যানি নামে বাঙালি অনেক মেয়ে রয়েছে। ক্যাথিওনের নামের সাথে মিলিয়েই অ্যানিয়ন নাম রেখেছি। বোঝা গেছে?’

‘হ্যাঁ।’

খাওয়া শেষ হলে আহনাফ গিয়ে ক্যাথিওন আর অ্যানিওনকে খাবার দেয়। ওদের খাওয়া শেষ হলে বাইরে যাওয়ার আগে অর্ষার উদ্দেশ্যে বলে,

‘আমি ওদের নিয়ে গার্ডেনে যাচ্ছি। চাইলে তুমিও আসতে পারো।’

‘আপনি যান। আমি আসছি একটু পর।’

আহনাফ চলে যাওয়ার পর অর্ষা এঁটো থালা-বাসনগুলো কিচেনে রেখে আগে টেবিল গুছিয়ে ফেলে। এরপর থালা-বাসন ধুয়ে রান্নাঘর ঝাড়ু দেয়। ঘরে গিয়ে বিছানা গোছায়, ঘর ঝাড়ু দেয়। সবকিছু পরিপাটি করে গুছিয়ে বের হওয়ার সময় থেমে যায়। কী মনে করে যেন আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে আগাগোড়া পরখ করে নিতে নিতেই মনে মনে আবার নিজেকে ভর্ৎসনা জানায়।

খুশি মনে বাড়ি থেকে বের হলে কী হবে, বাইরে গিয়ে তার মনটাই খারাপ হয়ে যায়। এক বিদেশি মেয়ের সাথে আহনাফ হেসে হেসে কথা বলছে। দুজনে পাশাপাশি বসে আছে বেঞ্চে। কখনো হাসতে হাসতে কথার ছলে মেয়েটি আহনাফের বাহুতে মারছেও।

কী অদ্ভুত! অর্ষা স্বগতোক্তি করে,’সে যা খুশি করুক। তাতে আমার কী! আমি কেন শুধু শুধু হিংসা করতে যাচ্ছি?’

মনকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা। যেই প্রেম-সাগরে সে পড়েছে, সেখান থেকে ওঠার যে পথ নেই তা এখনো তার বোধগম্য হয়নি। গার্ডেনের মাঝখানে সবুজ গাছের ওপর বিড়াল দুটোকে নিয়ে বসে আছে হেলেন আর সেই বাচ্চাটা। কী জানি নাম! ওহ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। হানি।

মেয়েটি অর্ষাকে দেখে দৌঁড়ে আসে। হাত ধরে টেনে বলে,’আসো। আমার সাথে আসো।’

হেলেন যেখানে বসে আছে, হানি তাকে সেখানে নিয়ে যায়। ওদের পাশে বসতে বলে। অর্ষা পড়েছে মহা মুশকিলে। এই অপরিচিত মানুষ দুটো যদি জানে, অর্ষা বিড়ালকে বাঘের চেয়েও বেশি ভয় পায় তখন কী ভাববে? নিশ্চয়ই মজা নেবে?

তার ভাবনার মাঝেই হানি আরেকবার হাত ধরে টান দিলো। সে হানির পাশে বসল ঠিক-ই, তবে বিড়ালের থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে। তার দৃষ্টি তো তখনো ছিল আহনাফের দিকেই। হঠাৎ হেলেনের দিকে দৃষ্টি আসায় চোখাচোখি হয়ে যায়। হেলেন এক পলকে তার দিকে তাকিয়ে ছিল।

চোখাচোখি হওয়ায় অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামলে নেয় হেলেন। সে হেসে বলে,’হাই, আমি হেলেন।’

অর্ষা ভদ্রতাসূচক মৃদু হেসে বলল,’আমি অর্ষা। আপনাকে আমি চিনি।’

হেলেন হাসল। তাকে হাসলে কতটা সুন্দর লাগে সেটা ইতিপূর্বে বহুবার বলা হয়েছে। আজ কাছাকাছি হওয়ায় তার সুন্দর হাসিটা অর্ষার দৃষ্টিতেও আটকাল।

হেলেন হেসে হেসে বলল,’সেদিনের ধাক্কার জন্য মাফ করেছিলে তো?’

‘জি।’

হেলেন নিজের ধবধবে প্রশস্ত বুকে ডান হাত রেখে বলল,’থ্যাঙ্কস কুইন।’

অর্ষা ভ্রুঁকুটি করে বলল,’কুইন? আমার নাম অর্ষা।’

‘আই নো, ইউ আর অশা।’

‘অশা’ শুনে মুখটা হা হয়ে যায় অর্ষার। সেই সঙ্গে আহতও হয়। ভাগ্যিস মশা-টশা কিছু বলেনি!

‘হেই!’ অর্ষাকে অন্যমনস্ক দেখে তুড়ি বাজাল হেলেন।

সম্বিৎ ফিরে পেল অর্ষা। মৃদু হাসিররেখা ঠোঁটে ফুটিয়ে বলল,’ইয়েস?’

সেই সময়ে আহনাফ মেয়েটিকে নিয়ে এখানে আসে। অর্ষাসহ সকলে উঠে দাঁড়ায়। আহনাফ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,

‘ওরা আমার ভার্সিটি লাইফের ফ্রেন্ড। হেলেনকে তো আগেই দেখেছ। আর ও হচ্ছে গ্লোরিয়া।’

অর্ষা হেসে বলল,’নাইস টু মিট ইউ।’

আর গ্লোরিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,’আর ও অর্ষা। আমার স্ত্রী।’

গ্লোরিয়াও হেসে বলল,’অলসো নাইস টু মিট ইউ।’

অর্ষার সেদিকে কোনো ভাবান্তর নেই। সে তো আহনাফের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বারবার কানে বাজছে আহনাফের বলা ‘আমার স্ত্রী’ কথাটি। এর আগেও তো সে অর্ষাকে তার বউ বলে পরিচয় দিয়েছে। তখন তো এমন অনুভূতি হয়নি। গতকাল রাত থেকে কী হয়ে গেল তার! ধ্যাৎ। নিজের ওপর সে যেমন বিরক্ত হচ্ছে, আবার নিজের জন্য তার মায়াও লাগছে।
________
নিহাল আজ অফিসে যায়নি। কয়েকদিন ছুটি নিয়েছে। লামিয়া কাপড় ভাঁজ করছিল।

শুয়ে থাকা নিহালের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,’শুনছেন?’

নিহাল ফোনে গেইম খেলতে খেলতে উত্তর দিলো,’হু।’

‘বলছিলাম যে, বিয়ের তো কতদিন পার হয়ে গেল। আমাদের কিন্তু এখনো কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি।’

‘বলেছি তো, তোমার রেজাল্ট দেওয়ার পর নিয়ে যাব।’

‘সেটা মনে আছে। আমি বলতে চাচ্ছি, কোথায় নিয়ে যাবেন?’

‘তুমিই বলো কোথায় যাবে।’

‘যেখানে যেতে চাইব নিয়ে যাবেন?’

নিহাল মুচকি হেসে বলল,’অবশ্যই।’

হাতের কাপড়গুলো রেখে লামিয়া নিহালের পাশে বসল। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,’সুইজারল্যান্ড যাব।’

হাত থেকে মোবাইল ছিটকে পড়ে নিহালের। শোয়া থেকে উঠে বসে। অবাক হয়ে বলে,’বাংলাদেশ রেখে সুদূর সুইজারল্যান্ড?’

লামিয়া মুখটা অন্ধকার করে বলল,’তাতে কী হয়েছে? আপনার বাপের কি টাকার অভাব পড়েছে নাকি আপনার?’

‘কারও-ই না। চাইলে যাওয়া যায়। কিন্তু অনেক ঝামেলা আছে। পাসপোর্ট, ভিসা ইত্যাদি। এসবের সময় কোথায়?’

লামিয়া চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,’সময় যখন নাই-ই তাহলে বিয়ে করতে বলেছিল কে? বউকে সঙ সাজিয়ে রাখার জন্য?’

‘আরে তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?’

‘রাগ করব না তো কী করব? একটা মাত্র আবদার করেছি। সেটাও রাখতে পারবেন না? উলটো বাহানা বানাচ্ছেন।’

নিহাল লামিয়ার হাত ধরে টেনে কাছে আনল। জড়িয়ে ধরে বলল,’বাচ্চাকাচ্চা বিয়ে করা মানেই ঝামেলা। একটু কিছু হলেই শুধু গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।’

‘তো যান, বুড়ি কাউকে বিয়ে করেন।’

নিহাল হেসে ফেলে বলে,’না। আমি তো আমার বাচ্চা বউটাকেই ভালোবাসি। আমার আর কাউকে লাগবে না। আমি তোমার আবদার রাখব।’

‘সত্যিই? সুইজারল্যান্ড ঘুরতে নিয়ে যাবেন?’

‘হ্যাঁ, ইন-শা-আল্লাহ্।’

‘সরুন। আমি অর্ষাকে ফোন করে জানাই।’ বলে নিজেই নিহালের হাতের ফাঁকা দিয়ে বেরিয়ে যায়।

নিহাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে বলে,’বাপ্রে বাপ! বরের চেয়েও বান্ধবীর প্রতি দরদ বেশি।’
.
.
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল বিধায় বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছিল আহিল। দূর থেকে দেখতে পায় ছাতা মাথায় একটা মেয়ে বসে রয়েছে। তাও আবার রাস্তার মাঝামাঝি। তাই বাধ্য হয়েই স্পিড কমিয়ে দিতে হয়।

বাইক নিয়ে কাছে যাওয়ার পর মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। পরনে স্কুল ড্রেস। ছিপছিপে গড়নের, গোলগাল চেহারা। মুখের আদলে বাচ্চা বাচ্চা ভাব। অবশ্য স্কুল পড়ুয়া মেয়ে তো বাচ্চাই হবে। ইনোসেন্ট লুক নিয়ে আহিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

আহিল ভ্রুঁকুটি করে জিজ্ঞেস করে,’মাঝরাস্তায় বসে আছেন কেন?’

মেয়েটি তার ডান হাত উঁচু করে জুতাগুলো দেখাল। এরপর বাচ্চা বাচ্চা কণ্ঠে বলল,’জুতা ছিঁড়ে গেছে।’

‘তো এজন্য রাস্তায় বসে থাকতে হবে?’

‘একটু বাসায় পৌঁছে দেবেন? প্লিজ!’

আহিল দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায় কী করবে। পরক্ষণে সিদ্ধান্ত নেয়, মেয়েটিকে সে সাহায্য করবে।

মেয়েটিকে উদ্দেশ্য বলল,’উঠুন।’

মেয়েটা খুশি হলো। ছাতা বন্ধ করে পিছে গিয়ে বসল। আহিলের কাঁধে হাত রেখে বলল,’চলুন।’

‘ভালোমতো বসেছেন?’

‘জি। আমাকে আপনি করে বলতে হবে না। আমি তো আপনার ছোটো। তুমি করে বলবেন।’

আহিল মেয়েটির কথায় পাত্তা না দিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। কিছুদূর যাওয়ার পর মেয়েটি নিজে থেকেই বলল,

‘আমার নাম সকাল। গার্লস স্কুলে পড়ি। আপনার নাম কী?’

আহিল নিরুত্তর। সকাল কাশি দিয়ে বলল,’শুনছেন?’

‘চুপ করে বসে থাকুন।’

আহিল শান্তভাবে কথাটা বললেও কথার সুরে কেমন যেন ধমকের একটা আভাস ছিল। তাই সকাল আর বলার মতো সাহস পেল না।

সকালের বলে দেওয়া স্থানে গিয়ে বাইক থামায় আহিল। সকাল বাইক থেকে নেমে বলে,’একটা কথা বলি?’

আহিল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সকাল আশেপাশে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,’আপনার অনেক ভাব। কিন্তু আপনি দেখতে দারুণ! একদম পুরাই আগুন।’

কথা শেষ করে আর দাঁড়াল না সে। এক দৌঁড়ে চলে গেল পাশের গলিতে। আহিল হতবিহ্বল হয়ে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। সেখানে আরো কতগুলো স্কুল ড্রেস পরা মেয়েদের দেখতে পায়। সকালও ওদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সবগুলো মেয়ে সমস্বরে হাসছে। সকাল যাওয়ার পথে হাসতে হাসতে একবার পিছু ফিরে তাকায়।

আহিল স্বগতোক্তি করে বলে,’আজ-কালকার মেয়েগুলো ছোটো হলে কী হবে! বিচ্ছু একেকটা।’
__________
গ্লোরিয়া মেয়েটা ভালো ছিল। বেশ হাসি-খুশি স্বভাবের। মিশুকও। সব ভালো লাগলেও, আহনাফের সাথে এত ফ্রি ভাবটা অর্ষার মোটেও ভালো লাগেনি। সে সকাল থেকেই থম মেরে ছিল। হেলেন, গ্লোরিয়া আর হানি যতক্ষণ ওদের সাথে ছিল জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখেছিল অর্ষা। বিকেলে সকলে চলে যাওয়ার পর হনহনিয়ে রুমে প্রবেশ করে। বিছানায় গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে।

আহনাফও ঘরে এসে বলল,’চলো ফুপির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। তুমি এখানে এসেছ শুনে অনেকবার যেতে বলেছিল।’

‘কোথাও যাব না।’

‘কেন?’

‘এমনি।’

‘তুমি এখানে এসে কোথাও-ই যাও নি। যাও গিয়ে রেডি হও। ঘুরে আসি। ভালো লাগবে তোমার।’

‘আমার এমনিতেই ভালো লাগছে। আজ আর কোথাও যাব না।’

আহনাফ কাঁধ নাচিয়ে বলল,’ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছা।’

এরপর সে ড্রয়িংরুমে চলে যায় টিভি দেখতে। অর্ষা শোয়া থেকে উঠে বসে। দাঁতমুখ খিঁচে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলে,’ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছে। ঢং!’

সন্ধ্যায় আহনাফকে নাস্তা বানিয়ে দিলেও কোনো কথা বলেনি সে। চুপচাপ থেকেছে। রাতে খাওয়ার পর অর্ষা গম্ভীর হয়ে বলে,

‘আপনার ম্যাউ দুইটাকে নিয়ে আপনি এই রুমে থাকেন। আমি আজ ঐ রুমে ঘুমাব।’

আহনাফ বিনাবাক্যে রাজি হয়ে বলেছে,’আচ্ছা।’

অর্ষা তীক্ষ চোখে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না। রাতে সত্যি সত্যিই আলাদা রুমে ঘুমাল। এটাই ভালো হবে। এসব অনুভূতি ভালো নয়। এক ঘুমে রাত পার করে ফেলে। সকালে ঘুম ভাঙার পর বালিশের কাছে ফোন খুঁজে পেল না। পরে মনে হলো, ফোন তো ঐ রুমেই রয়ে গেছে। কেউ ফোন দেয়নি তো? দিলেও বা কী! ফোন তো সাইলেন্ট করা।

সে হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে ঘড়ি দেখে। নয়টা বাজে। আজ বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছে। আহনাফ কি অফিসে চলে গেছে? ওদের বেডরুমে গিয়ে দেখল দরজা খোলা। বারান্দার দরজাও খোলা। ওখান থেকে কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

সে গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় যায়। ক্যাথিওন আর অ্যানিওনকে কোলে বসিয়ে ওদের সাথেই আহনাফ কথা বলছিল। হাফ স্লিভের কালো টি-শার্টের সাথে সাদা প্যান্ট আহনাফের পরনে।

অর্ষা চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বলে,’একি! আপনি নেং’টু প্যান্ট পরে বাড়িতে ঘুরছেন কেন?’

অর্ষার কথা শুনে চকিতে ফিরে তাকায় আহনাফ। যেন সে আকাশ থেকে পড়েছে। চোখে-মুখে বিস্ময়। একবার নিজের দিকে ভালোমতো তাকিয়ে বলল,

‘নেং’টু প্যান্ট মানে? এটাকে শর্টস বলে।’

‘নাম যাই হেক। নেং’টু প্যান্ট তো নেং’টু প্যান্ট-ই। হাঁটু দেখা যায়।’

আহনাফ হতবিহ্বল হয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে। নির্বোধ মনে হচ্ছে এখন তার নিজেকে। কী বোঝাবে সে এই মেয়েটিকে?

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।