যে থাকে আঁখি পল্লবে পর্ব-০৪

0
8

#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৪

সারারাত জেগে বসেছিল মাজেদুর। শ্যামলীও ম্লানমুখে স্বামীকে সঙ্গ দিয়েছে। শ্যামলী মানুষটার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে বেশ। মাজেদুর সঙ্গীনির দিকে তাকালো-“আব্বা মারা যাইতে না যাইতেই এমুন অবস্থা দাঁড়াইব জানতাম না বউ। দুইভাইরে সবসময় জানের চাইতে বেশি মহব্বত করছি। আইজ সম্পদের জন্য কিছু সময়ের মধ্যেই ওরা আমারে দূরের মানুষ বানায়া দিলো।”
শ্যামলী স্বান্তনা দিলো-“আহা, খামাখাই মন খারাপ কইরেন না। খুকু তার জায়গায় ঠিকই আছে। সে শখ কইরা ঘর বানাইছে সেই ঘর আমরা দখল করতে চাইছি। দোষ আমাগোই মনার বাপ। আপনে মন খারাপ কইরেন না।”
মাজেদুরকে দ্বিধান্তিত দেখলো-“তুমি কি কও? জাহাঙ্গীরের ঘরের উপর ঘর বানামু না? তাইলে থাকমু কই?”
এবার শ্যামলীকেও দ্বিধান্বিত দেখায়। কি বলবে খুঁজে পেলো না। মাজেদুর মাথা নাড়ে-“ডাইনে জায়গা আছে বাড়ি করার কিন্তু আব্বা তো মনেহয় ওইপাশ পুরাটাই ছোট পক্ষকে দিছে। এইদিকে জাহাঙ্গীর আর সাজেদ বাড়ি করার পর তো আর জায়গা নাই। রাস্তার ওই পাড়ের জায়গায় বাড়ি করতে পারি কিন্তু আম্মা বাঁইচা থাকতে এই বাড়ির বাইরে যাইতে চাই না আমি। আম্মা তাতে কষ্ট পাইবো।”
“সদর দরজার পাশে যেটুক জায়গা আছে সেটুকুতে করা যায় না?”
শ্যামলী ফিসফিস করলো। মাজেদুর চিন্তিত হলো-“কোন পাশে? সাজেদের বাড়ির পাশে?”
শ্যামলী মাথা দুলালো। মাজেদুর দাঁড়িতে হাত বুলালো-“ওইখানে তো অল্প জাগা। ছোট ছোট দুইটা রুম হইবো কিনা সন্দেহ। আমাগোর সবসময় বড় জায়গায় থাইকা অভ্যাস। পারবা থাকতে অতটুক জাগায়?
“হোক না। যতখানি হয় ততখানিতেই আমরা থাকুন না হয়। আপনি একবারে দুই তালা বানানোর প্রস্তুতি নেন। নিচে দুইডা রুম আর উপরে দুইটা রুম হইলেই হইলো আমাগো। নিচে আমরা থাকপো উপরে ছেলেমেয়েরা। চাইলে দুইতলার পর একটা রুম কইরা দিবেন উপল থাকবে।”
“আচ্ছা, ভাইবা দেখি। কাইল আম্মা আর সাজেদের লগে আলাপ করুমনে। ওরা কি কয় শুনি।”
মাজেদুর শুয়ে পড়ে পাশ ফিরে। বাকী রাত তার আর ঘুম আসবে না। শ্যামলী অন্ধকারে স্বামীর মুখপানে তাকিয়ে রইলো। যদিও মানুষটার মনে কি চলতেছে কিছু বোঝার উপায় নাই তবুও তাকিয়ে আছে। সে জানতো এমন একদিন আসবে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি আসবে ভাবেনি। অন্যায় করলে সাজা তো পাইতেই হয়। কিন্তু অন্যায় তো তার স্বামী একা করে নাই তাইলে সাজা তার একার ভাগে কেন আইলো? তার সাদা মনে একটাই প্রশ্ন শশুর আব্বা তাদের ভাগের জিনিসগুলাই কেন ওদের দিয়া গেলো?

★★★

রুজাইফের ঘুম ভেঙেছে সকাল সাতটার দিকে। পাখির কিচিরমিচির শুনে ঘুম চটে গেছে তার। তারউপর জানালার কাঁচ ভেদ করে সকালের রোদ সরাসরি তার মুখের উপর পড়েছে। ঘুমিয়ে থাকার কোন উপায়ই নেই। রুজাইফ ভীষণ বিরক্ত হলো। কাল শরীর এতো ক্লান্ত ছিলো, ভেবেছিল আজ বেলা পর্যন্ত ঘুমাবে কিন্তু হলো না। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়লো সে। উঠে হেঁটে কোনার ঘরটায় উঁকি দিলো। এই সাতসকালে বারান্দা থেকে রোদ এসে ঘরটা আলকিত করে ফেলেছে। এখন দেখে আরও বেশি মুগ্ধ হলো। যে সাজিয়েছে মনের সবটা শুভ্রতা ঢেলে দিয়েছে। রুমও এভাবে সাজানো যায় তা আগে জানতো না রুজাইফ। চাকরি পাওয়ার পর লোকজনের সাথে সখ্যতা বেড়েছে। ধীরে ধীরে বড়লোকি ব্যাপার স্যাপার গুলোও জানা হচ্ছে তার। তবে এই কামরার সৌন্দর্য অন্যরকম। দেখলে কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগে। দাঁড়িয়ে থেকে ভাবনাগুলো এলোমেলো হলো। হাতের দিকে তাকালো।কালচে দাগ হয়ে গেছে। ভাবলো আজই রুমটা পরিস্কার করার ব্যবস্থা করবে। রাতে মাঝের রুমের একটাতে ঘুমিয়েছিল সে। গায়ের অসহ্য চুলকানিতে আর এই রুমে আসার সাহস হয়নি। রুম পরিস্কারের ব্যবস্থা করবে ভেবে দ্রুত নিচে নামলো রুজাইফ।

নিচে নামতেই দেখলো দিদা বসে আছে চেয়ারে তার পাশে একজন অপরিচিত মহিলা। রুজাইফকে দেখে ডাকলো-“তোরা দাদুর বোন হয়। তোর রোমেলা দিদা। আমার আসার খবর শুনে এসেছে।”
রুজাইফ হাসলো-“গ্রামে খবর এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছে জানতাম না।”
রোমেলা একগাল হাসলো-“কাইল এই বাড়িতে যে কাহিনি হইছে তা এহন পুরা গ্রাম জানে। তুমি তো হিরো হইয়া গেছো দাদাভাই।”
রুজাইফ অবাক হলো-“হিরো হওয়ার মতো কি করলাম আমি?”
রোমেলা তার পান খাওয়া দাঁত বের খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে-“কি করছো পরে টের পাইবা বাজান। এহন আমার পাশে আইসা বও। তোমাগো লাইগা খাওন রাইন্দা আনছি। গরম গরম খিচুড়ি আর ডিম রানছি। খাইয়া দেহ কি মজা।”
রুজাইফ মাথা চুলকায়-“কিন্তু এখন যে আমার কাজ আছে। বসতে পারবো না।”
ফজিলাতুন্নেছা রোমালার দিকে তাকালো। রোমালা ভীষণ উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে দেখছে রুজাইফকে।
ফজিলাতুন্নেছা বললো-“তুই কি আজ অফিসে জয়েন করবি?”
“হ্যা, জয়েন করে চলে আসবো। ঘরবাড়িগুলো ঠিকঠাক করবো। ফার্নিচার দেখতে যাব ভাবছিলাম। নাদিয়া নাহিয়ানের জন্য স্কুলের খোঁজ নেব। কাল থেকে আবার ফুলটাইম অফিস করতে হবে।”
মনোযোগ দিয়ে রুজাইফের কথা শুনলো রোমেলা। উৎসাহী হয়ে বললো-“কি ঠিক করা লাগবে? আমি কাজের মহিলা দিতে পারুম। আর আমার পোলা আছে কাডের কাম করে। কি কিনবা তুমি ভাই?”
ফজিলাতুন্নেছা বললো-“রান্নার লোক পাওয়া যাবে রোমেলা? বাসাবাড়ি পরিস্কার করার লোক? সারাদিনরাত থাকবে আমার সাথে। বোঝোই তো, আমার বয়স হইছে কাজ করতে পারি না।”
“তুমি একটুও টেনশন নিও না ভাবি। আমি এখনই আবার বাড়ি যাইতেছি। কামের মানুষ নিয়া ফেরত আসমু। আর আমি যদি তোমার লগে থাকি কোন সমস্যা আছে? রাগ হইবা?”
ফজিলাতুন্নেছা রুজাইফ কে দেখলো সাথে সাথে। রুজাইফের মুখে কোন অনুভবের প্রকাশ নেই। ফজিলাতুন্নেছা মাথা নাড়ে-“তোমার ছেলেমেয়ে রাগ হবে না? আমার কোন সমস্যা নাই তুমি থাকলে।”
রোমেলা রুজাইফকে ইশারা করলো-“বাই তো কিছু কয় না।”
রুজাইফ হেসে দিলো-“আমি কি বলবো? দিদার কথার উপর কথা বলি না আমি। দিদা আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি। খেয়ে বেরুব।”
বলেই সে আবার দোতলায় উঠে এলো।

★★★

কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে সেঁজুতি। সাথে আছে নীলা আর কেয়া। ওরা যাবে স্কুলে। দু’জন যথাক্রমে সপ্তম ও নবম শ্রেণিতে পড়ে। আর সেঁজুতি এ বছর স্কুল পাস করে কলেজে উঠেছে। বাড়ি থেকে বেরুতেই গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো ওরা। কেয়া ওর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো-“সেঁজুবুবু, দেখো গাড়ি।”
সেঁজুতি আর নীলা কৌতুহলে এগিয়ে এলো। সেঁজুতি জিজ্ঞেস করলো-“কার গাড়ি? আমাদের বাড়িতে তো আগে কেউ গাড়ি নিয়ে আসে নাই।”
নীলা গলা নামিয়ে বললো-“ওই যে বেডা আইছে হের গাড়ি। কাইল রাইতে দেখছিলাম একবার গাড়ি থাইকা জিনিস নামাইতে।”
সেঁজুতি দুই কদম এগিয়ে এসে গাড়িটাকে দেখলো ভালোমতো। সাদা রঙের মাইক্রো। সেঁজুতি গাড়ির চারপাশ ঘুরতে ঘুরতে নীলাকে ডাকলো-“তুই ঠিক কইতেছিস তো? গাড়ি ওই বেডার?”
নীলা ভরকে গেলো। মাথা দুলিয়ে সায় জানালো-“আমি তো তাই দেখলাম। কেন বুবু? কি হইছে?”
সেঁজুতি দুষ্ট হাসি দিলো-“কিছু অয় নাই তয় এহন অইবো।”
কেয়া বুঝতে পারছে না বুবু কি হওয়ার কথা বলছে। সে জানতে চাইলো-“কি অওয়ার কতা কও বুবু?”
সেঁজুতি কেয়ার দিকে তাকালো-“”তোর কাছে আলতা আছে? রং আছে না?”
কেয়া ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো-“হহহ আছে তো।”
“দৌড়াইয়া যায়া নিয়ায়।”
নীলা সেঁজুতির কাছে এসে দাঁড়ালো। কম্পিত কন্ঠে জানতে চাইলো-“তুমি কি করতে চাইতেছ বুবু? চাচা জানলে রাগ অইবো। আর ওই বেডা জানলে কি করবে বুবু?”
সেঁজুতি গোঁয়ারের মতো মাথা নাড়ে-“কিছুই অইবো না। আব্বারে কেউ কিছু কবি না কইলাম।”

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছাকাছি আসতেই হতভম্ব হয়ে গেলো রুজাইফ। তিনটে মেয়ে মিলে রং গুলিয়ে পুরো গাড়িতে রং মারছে। পানিতে গুলিয়েও হচ্ছে না। হাত দিয়ে গ্লাসে রং মাখিয়ে দিচ্ছে। সরকারি গাড়ির এই হাল দেখে তেতে উঠলো রুজাইফ। তাকে কত টাকা গচ্চা দিতে হবে ভেবেই মেজাজ চড়ে গেলো। চেচিয়ে উঠলো-“এই কি হচ্ছে এখানে?”
মেয়ে তিনটে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামলো। একটারও চেহারা দেখার উপায় নেই। ওড়না দিয়ে মুখ বাঁধা। শুধু চোখ দেখা যাচ্ছে। জবাব না পেয়ে রুজাইফ এগুলো। আবার জানতে চাইলো-“কি হচ্ছে হ্যা? কি করছো তোমরা?”
লম্বা মতন মেয়েটা এগিয়ে এলো-“কি করতাছি দেখেন না? গাড়ির বারোটা বাজাইতেছি।”
মেয়েটার বেয়াদবি দেখে হতবাক রুজাইফ। বাকি দু’জন তখন সোৎসাহে বালু তুলছে সামনের বনেটে। রুজাইফ চিৎকার করলো-“সরকারি গাড়ি এটা। নষ্ট হলে কঠিন সাজা হবে বলে দিচ্ছি। ছাড়বো না একটা কেউ। সরো গাড়ির কাছ থেকে।”
“সরুম না। কি করবেন? কুংফু কারাতে কইরা মারবেন আমাদের? আমরাও কিন্তু কম জানি না। দেখবেন?”
রুজাইফ কিছু বোঝার বা বলার সুযোগ পেলো না। তার আগেই এক বালতি রঙিন পানি তার সাদা শার্টে আছড়ে পড়লো। তিনজনের দুনিয়া এক মুহূর্তের জন্য থামলো। তারপরই রুজাইফকে দেখে বাঁধভাঙা হাসিতে
ফেটে পড়লো।
মাত্রই গোসল সেরে পরিপাটি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে রুজাইফ। এখন নিজের দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হলো। তার সাদা শার্টে হরেক রঙের মেলা বসেছে যেন। মাথা থেকে তখনো ফোঁটায় ফোঁটায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। দাঁতে দাঁত চেপে জানতে চাইলো-“কি হলো এটা?”
“আপনারে গোসল দেওয়াইলাম। আমাদের এলাকার নিয়ম হইলো নতুন কেউ আসলে তারে রঙের পানিতে গোসল দিয়া আমন্ত্রণ জানানো হয়।”
রাগে শরীর জ্বলছে তার। তমিজউদদীনের গোটা বংশ শয়তানি বুদ্ধিতে ভরপুর। এই নচ্ছর বদমাশ মেয়েগুলোগুলোকে শায়েস্তা করতে হবে ভেবে বললো-“রিয়েলি? আর কোন নিয়ম নেই? এই যেমন নতুন মানুষটা এলাকার মানুষদের জন্যও পাল্টা কিছু করবে। তোমাদের এখানে না থাকলেও আমাদের এলাকায় আছে। কি জানো?”
সেঁজুতি তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছে রুজাইফের দিকে।
লোকটা কি চাল চালছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক।। রুজাইফ বাঁকা হাসলো-“নতুন মানুষকে নিজেদের চাঁদ মুখ দেখাইতে হয়।”
বলেই সেঁজুতির ওড়না ধরে টান দিলো। আচমকা টান লাগায় নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে গোল গোল ঘুরতে শুরু করলো সেঁজুতি। ওর গা থেকে একটু একটু ওড়না সরছিল। ভয়ে ওর শরীর থেকে আত্মা বের হওয়ার উপক্রম। ওড়না পুরোটা খুলে পড়ার আগেই সেজুতি ওড়নার শেষ প্রান্ত আঁকড়ে ধরলো কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। রুজাইফ ওর অবস্থ দেখে বাঁকা হেসে নিজের হাতে থাকা অংশটা ধরে জোরে টান দিতেই সেঁজুতি উল্টো ঘুরে রুজাইফের বুকে আছড়ে পড়লো। ওর খোঁপা করা ঘন লম্বা চুলগুলো আছড়ে পড়লো রুজাইফের গায়ে মুখে।

চলবে—
©Farhana_Yesmin