#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-১১
সেঁজুতির কাছ থেকে সব ঘটনা শুনতে শুনতে সকালের চোখ কপালে উঠলো-“এতোকিছু হইয়া গেছে?”
“হহুমমম বুবু। আমাগো ঘর দখল কইরা নিছে তোমার স্যার।”
সেঁজুতি মুখ গোমড়া করলো। সকাল অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“আব্বা চুপচাপ সব মাইনা নিলো? দাদাজান তাইলে সত্য সত্যই ওনাগো ওইসব সম্পদ লিখা দিছে?”
“আমরাও অবাক হইছি বুবু। আইজকা তোমার কথা শুইনা বুঝলাম এমনে এমনেই মানে নাই। ওই বেডার চাকরির পাওয়ার আছে হেই ডরে মাইনা নিছে।”
সেঁজুতি ফিসফিস করলো সকালের কানে। কেয়া নীলা আর টিয়া সকালের গা ঘেঁষে বসে আছে। নীলা বললো-“আব্বারে কইতে শুনছি, দাদা জানের ওই পক্ষে একটা মাইয়াও আছিল। একমাত্র মাইয়া হওয়ার কারণে দাদাজান নাকি তারে মেলা ভালোবাসতো।”
“হহহ বুবু, সেই মাইয়া নাকি মেলা সুন্দরী আছিল। শহরের বাড়িটা নাকি দাদাজান তার মাইয়ার নামেই দিছে।”
কেয়া ফিসফিস করলো। সকাল ভাবুক হয়ে গালে হাত দিলো-“তার মানে আমাগো ফুপু আছে একজন?”
নীলা টিপ্পনী কাটলো-“হহহ, সৎ।”
সকাল উৎসাহী কন্ঠে প্রতিবাদ করলো-“তাতে কি হইছে? তাও তো একজন ফুপু আছে? আমার তো তারে খুব দেখতে মন চাইতেছে।”
কেয়া ফিসফিস করলো-“যা কওয়ার কইছো বুবু। দাদীর কানে গেলে খবর আছে।”
সেঁজুতি কিছুক্ষণ ভেবে বিজ্ঞের মতো বললো-“ওইদিন যে নতুন মাইয়াডারে দেখলাম ওই বাড়িতে ওইডা তাইলে তার ফুফাতো বোন? আমাগো ফুপুর মাইয়া?”
“আমি দেখছি। দুইজন বয়স্ক মহিলা পুরুষের সাথে একটা পোলা আর একটা মাইয়া আইছিল। খুব সুন্দর পোশাক আছিল তাগো পরনে।”
টিয়া সগর্বে ঘোষণা করলো যেন। কেয়া সন্দিহান নজরে দেখে বললো-“তুই কখন দেখলি? চাচী তো তোরে বাইর অইতেই দেয় না?”
টিয়া মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিলো-“মা নিজেই ডাইকা দেখাইছে। কইছে ভালো মতো পড়ালেখা কইরা ওগো মতো ইস্মাট হবি।”
কেয়া আর নীলা কুটিল দৃষ্টি হানলো টিয়ার উপর। সকাল বললো-“তোরা যাই কস না কেন, ওই স্যাররে আমার মোটেও খারাপ মনেহয় নাই। কি সুন্দর কইরা আমার কেসের সুরাহা কইরা দিলো। চাইলে শত্রুতা কইরা আমার ক্ষতি করতে পারতো কিন্তু তা করে নাই। উল্টা আমারে সাহায্য করছে।”
সেঁজুতি বিরবির করলো-“ওই দাদীও খুব ভালো বুবু।”
কেয়ারা হামলে পড়লো সেঁজুতি উপর-“তুমি কেমনে জানলা? তার সাথে কই দেখা হইলো তোমার?”
সেঁজুতি মনে মনে ঢোক গিললো। আমতা আমতা করে বললো-“কেন? ওইদিন মিলাদে দেখস নাই? আমাগো দাদী বুড়ি হেরে কতডি খারাপ কথা কইছে কিন্তু হেয় পাল্টা কিছু কয় নাই। তাতেই বোঝা যায় মানুষটা খারাপ না।”
“তোমার এইসব কথা দাদী শুনলে কিন্তু খবর কইরা ছাড়বো।”
সেঁজুতি চোখ বড় বড় করে তাকালো-“দাদীরে কে কইবো এইসব? তোরা?”
দুইবোন দ্রুত গতিতে মাথা নেড়ে সমস্বরে বললো-“আমরা কমু কেন? এমনেই তোমারে কইলাম আর কি।”
সকাল সবাইকে সাবধান করলো-“শোন, আমাগোর মধ্যের আলাপ বড়গো কবি না কইলাম। কেউ এমুন করছে জানলে আমরা তারে বয়কট করুম।”
কেয়া আর নীলা একে অপরকে দেখে ঢোক গিললো।
★★★
সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে জাহাঙ্গীরের কাছে সব শুনে মাজেদ চুপ করে গেলো। পরিস্থিতি তার বিপক্ষে। সকালের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে গেলে বিশাল খরচ হবে। এক গ্রাম লোককে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো এই মুহূর্তে কষ্টকর। একে তো নতুন করে বাড়ির কাজ করতে হচ্ছে তার উপর রুজাইফের আবদার। মরার উপর খাড়ার ঘা হলো নাদেরের হুমকি। সে আপোসে টাকার মিটমাট চায় না। কি চায় তা খোলাসা করেনি। তবে যদি নাদের তার মেয়ে সেঁজুতিকে চায় তাহলে কি করবে? মাজেদ চিন্তায় পাগলপ্রায়।
ভাইদের সাথে আলাপ করবেন সে উপায়ও নেই। রুজাইফদের আগমনের পর থেকেই সবাই যেন পাল্টে গেছে। সবাই নিজের নিজের ভবিষ্যত চিন্তায় ব্যাকুল। অথচ হাজারো সুযোগ পাওয়া সত্বেও কোনদিন নিজে আলাদা টাকা জমায়নি সে। বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে সবার জন্য আগে ভাবতো সে। মাজেদের বড় অস্থির লাগে। এখন মনেহচ্ছে সকালের ব্যাপারটাতে বাড়াবাড়ি করেছিল তারা। তখন বাড়াবাড়ি না করলেও হতো। সোহাগ ছেলেটা এতোটাও খারাপ না। পরিবারের অবস্থা একটু কমা হলেও সৎ ভাবে ইনকাম করে খায়। কেন যে তখন ভাইয়ের বুদ্ধিতে মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দিতে গেছিলো? এখন এর ক্ষতিপূরন দিতে হবে তারই। সকালের উপর নতুন করে রাগটা মাথাচাড়া দিচ্ছে। বেয়াদব মেয়ে একে তো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে তার মানসম্মান নষ্ট করেছিল এখন আবার নতুন করে বলে তার বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হবে। এই মেয়ে মরে গেলেই বরং ভালো হতো।
“ভাইজান, কি ভাবতেছেন এতো?”
সাজেদের ডাকে ধ্যানভঙ্গ হলো মাজেদের মাথা নেড়ে বললো-“অনেক খরচ খরচা সামনে আর হাতে নাই টেকা তাই ভাবতেছি কি করুম কেমনে সামাল দিমু।”
জাহাঙ্গীর কাশলো-“ভাইজান, তাইলে কেমনে কি করবেন?”
“ধান বিক্রি হইছে? উত্তরের জমির গম? আলুর কি অবস্থা?”
জাহাঙ্গীর মায়ের মুখের দিকে তাকালো। শামসুন্নাহার তজবি জপছে। ছেলের কথায় থেমে বললো-“এইসবের টাকা দিয়া কি এতো খরচ মিটবো? স্কুলের আয় কি কইমা গেছে?”
“বাড়ির কাজে হাত দিছি মা। তুমি তো জানোই বাড়ি করতে কেমন খরচা। সাজেদ, ইটের বিক্রি বাট্টা কেমুন?”
সাজেদ মিনমিনিয়ে জবাব দিলো-“খুব বেশি না ভাইজান। জিনিস পত্রের দাম বাড়ছে তাই বাড়ি করা কইমা গেছে। ইটের বিক্রি বাট্টাও কমছে।”
মাজেদ বললো-“সকালের বিয়ার খরচটা আলগা পাইলে ভালো হইতো আমার জন্য। তোরা আমারে সাহায্য কর।”
শামসুননাহার টোন কাটলো-“পলাইয়া যাওয়া মাইয়ার আবার এতো ধুমধামে বিয়ে দেওয়া লাগবো কেন?”
মায়ের কথায় রেগে গেলো মাজেদ-“সাধে দিতাছি না মা। আপনেরাই এই ঝামেলা লাগাইছেন। হুদাই তহন উস্কানি দিয়া এই আকাম করাইছেন। দুই দুই বার মাইয়ার বিয়া দিয়া নিজে পাপও কামাইছি মাইয়াডারেও ঝামেলায় ফালাইছি। এখন তো তার দায় চুকানো লাগবেই। নাইলে জেল জরিমানা হইবো। তাতে আপনেগো কি সব তো এহন আমার মাতার উপর দিয়া যাইবো।”
বলেই মাজেদ উঠে গেলো। তার মেজাজ অত্যধিক খারাপ হয়েছে। সবার স্বরুপ বেরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। যাদের আপন ভেবে দিনরাত এক করে খেটেছে আজ তারা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। আরও কত দূরে যাবে সেটাও দেখতে চায় সে।
★★★
সাতসকালে চেচামেচির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো রুজাইফের। নিচে নেমে দেখলো মাজেদ অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের দরজার সামনে। সে কর্কশ গলার বললো-“সাতসকালে এখানে কি চাই?”
মাজেদ জড়সড় হলো-“নাদের লোকজন নিয়া আইসা ঝামেলা করতেছে।”
রুজাইফ বিরক্ত হয়ে বললে-“কেন? তার সাথে মিমাংসা করেন নাই? সে যা চায় দিয়ে দিলেই তো হয়।”
মাজেদ হায়হায় করলো-“সে টাকা দিয়ে মিমাংসা করতে রাজি না।”
“তাহলে?”
“আমার ছোট মাইয়াকে বিয়া করতে চায়।”
“তো দিয়ে দেন। এক বিবাহিত মেয়েকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিছিলেন। এখন ছোটটাকে দিতে দোষ কি?”
মাজেদকে অসহায় দেখালো। সে মাথা নেড়ে বললো-“আমার এই মাইয়াডা খুব জেদি। বিয়ার কথা শুইনাই সে কইছে জোর করলে গলায় দড়ি দিবে, আইজকাই দিবে। এখন আপনেগো এইখানে আইসা পলায়া রইছে।”
রুজাইফ বেশ মজা পাচ্ছে মাজেদের নাজেহাল অবস্থা দেখে। সে জানতো এমন কিছু হবে। নাদেরের মতো ঘাড়ত্যাড়া ছেলে এতো সহজে নিজের হার মেনে নেবে না। মাজেদ হাতজোড় করে মরমে মরে গেলো-“আপনে বিচার করছেন এখন আপনেই সমাধান দেন। এই বিপদ থিকা রক্ষা করেন আমারে?”
নাহিয়ান নিমা হাশেম সবাই কৌতূহলে তাকিয়ে দেখছে।
মাজেদের কন্ঠ শুনে ফজিলাতুন্নেছা আর নাদিরা বেরিয়ে এলো। তাদের পেছনে সেঁজুতি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রুজাইফ বিস্মিত হয়ে তিনজনকে দেখলো। ফজিলাতুন্নেছা বললো-“রুজাইফ, এই মেয়েটা সেদিন আমাকে সাহায্য করছিল। কি সাহায্য করছিল তা তোকে পরে বলবো। এখন তুই এই মেয়েটার বিয়ে ক্যান্সেল করার ব্যবস্থা কর। বিয়ে তো ছেলেখেলা না যে জোর করে ধরে বেঁধে দেবে।”
রুজাইফ সেঁজুতিকে দেখে তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো-“এদের কাছে বিয়েটা ছেলেখেলাই দিদা। দেখছোনা এক মেয়ের দুইবার বিয়ে দেয়।”
“তা হোক কিন্তু এই মেয়েটার বেলায় এমন কিছু হতে দেব না আমি। তুই ব্যবস্থা কর।”
নাদিরাও মিনতি করলো-“হ্যা দা ভাই, সেঁজুতিপুর জন্য কিছু করো প্লিজ।”
রুজাইফের মুখ হা হয়ে গেলো-“সেঁজুতিপু! তুই ওকে কবে থেকে চিনলি?”
নাদিরা লাজুক হাসলো-“আরে এখনই চিনলাম তাতে কি? আপু কি কিউট দেখেছ?”
রুজাইফ মুখ বাঁকাল-“কিউট না ছাই। চিনিস না ওকে। বদের হাড্ডি একটা।”
সেঁজুতি রুজাইফের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। রুজাইফও কটমট করে তাকিয়ে আছে। ওকে তাকাতে দেখে সেঁজুতি মুখ ভেংচায়। ফজিলাতুন্নেছা নম্র গলায় বললো-“এখন এসব কথা থাক। মেয়েটার জীবন মরন সমস্যা। তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার কর।”
“তাতে আমি কি পাবো? এদের জন্য ভালো চিন্তা করা মানে নিজের ক্ষতি করা।”
রুজাইফের কথার প্রতিউত্তরে সেঁজুতি চেচিয়ে উঠলো-“আর কি চান? আমাদের বাড়িঘর তো দখল করছেনই আর কি নেওয়া বাকি আছে? আমার দরকার নাই আপনের সাহায্য। দরকার হইলে এখনই গলায় দড়ি দিয়া মরবো তাও আপনার সাহায্য নেব না।”
সেঁজুতি হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। মাজেদ অসহায় চোখে একবার মেয়েকে আরেকবার রুজাইফকে দেখলো। তারপর মেয়ের পিছু পিছু গেলো-“সেজু মা, পাগলামি করিস না। শোন আমার কথা।”
“শুনুম না। তুমি বুবুর লগে যা করছো আমার লগেও তাই করতে চাইতেছ। তোমারে এমুন সুযোগ আমি দিমু না। দরকার হইলে মইরা যামু তাও না।”
“মারে শোন একবার।”
সেঁজুতি দৌড়ে দোতলায় উঠে গেলো। মাজেদ মাথায় হাত দিয়ে উঠনে বসে পড়লো। রুজাইফরা সকলেই দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো বাপ মেয়ের এমন দৃশ্য। ফজিলাতুন্নেছা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রুজাইফকে ডাকে-“রুজাইফ, ওদের সমস্যা মিটিয়ে দে। না হয় বাচ্চা মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।”
রুজাইফ বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো-“এই পরিবারে জন্মেছে ওদের জীবন এমনিতেই নষ্ট দিদা।”
“তাও যা। তোর সাধ্যে যতটুকু কুলোয় কর। ওরা যতই খারাপ হোক চোখের সামনে অনিষ্ট হতে দেখা যায় না।”
নাদিরা মন খারাপ করে বললো-“যাও না দা ভাই। আমিও তো সেঁজুতিপু মতো৷ আমার সাথে এমন হলে তুমি মানতে?”
রুজাইফের চোয়াল শক্ত হলো। নাদিরাকে কষে ধমক দিলো-“বাজে কথা বলবি না নাদিরা। আমরা অমন মানুষ নই। আর তোর সাথে কেউ এমন কিছু করার কথা ভাবলেও তারা আস্ত থাকবে না।”
“সেঁজুতিপুও ভালো। তুমি প্লিজ ওর কোন ক্ষতি হতে দিও না।”
নুমা রুজাইফের পিঠে হাত রাখলো-“সবাই বলছে যখন যেয়ে দেখ কি হচ্ছে।”
অগত্যা রুজাইফ হার মেনে নিলো-“উফফ, জ্বালালে তোমরা।”
উঠন জুড়ে বেশ ভীর। নাদের একপাশে বসে আছে, তার সাথে আছে কয়েকজন মুরুব্বি। এদিকে তমিজউদদীনের একপক্ষের সবাই। সকাল কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এককোনে পরিবার থেকে দূরে। রুজাইফকে দেখে নাদের উঠে দাঁড়িয়ে গেলো-“স্যার, আপনে! এইখানে?”
রুজাইফ তার কথা পাত্তা না দিয়ে দুই হাত বুকে আড়াআড়ি বেঁধে জানতে চাইলো-“কি চলছে এখানে?”
নাদের তার পাশে থাকা সকলকে দেখে কিছুটা সাহস নিয়ে বললো-“তাদের কারণে আমার মানসম্মান নষ্ট হইছে। এখন টাকা দিয়া মান ফেরত আনতে পারুম না। তাই আমি প্রস্তাব রাখছি আমারে অন্য মেয়ের লগে বিয়া দিতে হইবে।”
রুজাইফ নাদেরের দিকে তাকালো-“আবার জোরজবরদস্তি করে বিয়ে? ওই মেয়েও যদি পালায় তাহলে আপনার মান থাকবে?”
নাদের মাথা নেড়ে গোঁয়ারের মতন বললো-“পালাইবে না স্যার।”
রুজাইফ হাসলো-“এতো বিশ্বাস নিয়ে কিভাবে বলেন? তাকে কি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবেন?”
নাদের লাজুক হাসলো-“দরকার পড়লে রাখবো।”
রুজাইফের হাসি পেলেও ধৈর্য্য ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-“আপনার পড়ালেখা কতদূর? কি কাজ করেন?”
“ম্যাট্টিক পাশ দিছি স্যার। মাছের ঘের আছে আমাদের। সাজেদ চাচা সব জানে।”
“বাহ, ভালো কাজ করেন। আপনার ইনকাম তাহলে বেশ ভালো।”
নাদের দাঁত বের করে হাসলো। রুজাইফ বললো-“আপনে যেহেতু ম্যাট্রিক পাশ করেছেন তাহলে আরেকটু কম শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করা ভালো। কলেজে পড়ে এমন কাউকে বিয়ে করলে বড় জ্বালা হবে আপনার। মেয়েরা আজকাল খুব ধুরন্ধর বুঝলেন। শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলে সে আপনার মাথায় কাঠাল ভেঙে খাবে।”
“মানে? কি বলতেছেন কি বুঝতেছি না স্যার।”
রুজাইফ এগিয়ে এলো-“আপনের আগের বিয়ের ঘটক কে?”
“সাজেদ চাচা। লাকি চাচি আমার দূরের সম্পর্কের আত্মীয় লাগে।”
“আরে বাহ, তাহলে তো হয়েই গেলো। আপনার এই বাড়ির মেয়েই লাগবে তো? মিস্টার সাজেদের মেয়ে হলে সমস্যা আছে?”
নাদেরের চোয়াল ঝুলে গেলো। কোথা থেকে কি হয়ে যাচ্ছে? কি ভেবেছিল কি হচ্ছে? নাদের সাজেদের দিকে তাকালো। লাকির সাথে চোরা চোখে কথা হলো। নাদের মিনমিন করলো-“ওরা তো ছোট।”
সাজেদ এগিয়ে এলো-“কি সব কইতেছেন? আমার মাইয়ারা ছোট। তাছাড়া ওর ঝামেলা মাজেদ ভাইয়ের সাথে তাইলে আমার মাইয়াগো টানেন কেন?”
“কারণ এই সমস্যার সৃষ্টিতে আপনার ভুমিকা ছিলো। আপনার মেয়েরা কোন ক্লাসে পড়ে?”
সাজেদ থতমত খেলো-“একজন নাইনে একজন টেনে।”
রুজাইফ হাসলো-“এতোও ছোট না তাহলে। বড়টার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করলাম।”
নাদেরের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলতেই নীলা চেচিয়ে উঠলো-“আব্বাহ! কি কয় এগলা?”
রুজাইফ দেখলো মেয়েটাকে। ও তাকাতেই মেয়েটা কারো পেছনে লুকিয়ে গেলো। লাকি আঁতকে উঠে ছুটে এলো-“কি কন এইসব? ওর এখনো আঠারো হয় নাই। আপনে আইনের লোক হইয়া আইন ভাঙতে কন?”
রুজাইফ বিরক্ত হলো। লাকির কথা পাত্তা না দিয়ে বললো-“আগামী শুক্রবার সকালের অনুষ্ঠানের মাঝেই কাজি ডেকে আপনার কন্যার সাথে নাদের সাহেবের বিয়ে দেবেন। মেয়ের আঠারো বছর হলে আনুষ্ঠানিক ভাবে ম্যারেজ রেজিষ্ট্রি করে মেয়ে তুলে দেবেন। ঠিক আছে নাদের সাহেব? এই সিদ্ধান্তে আপনার আপত্তি নেই তো?”
নাদের খুশি হবে না বেজার বুঝে পেলো না। সে ভয়ে ভয়ে সাজেদের দিকে তাকালো। সাজেদ বললো-“আমি মানি না আপনার সিদ্ধান্ত।”
নাদেরের সাথে থাকা মুরুব্বিদের কয়েকজন বললো-“কিন্তু সিদ্ধান্ত খুব যুক্তিযুক্ত। আমরা এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত। এর চাইতে ভালো সমাধান আর হয় না। দুই পরিবারের মান বজায় থাকলো। সাজেদ তুমি আপত্তি কইরো না। নাদের পোলাতো খারাপ না। তোমার মাইয়া সুখে থাকবে।”
উত্তর না পেয়ে সাজেদ রেগেমেগে ঘরে চলে গেলো। রুজাইফ অবশ্য তার রাগ পাত্তা দিলো না। নাদেরকে বললো-“এবার বিয়ের প্রস্তুতি নিন। আর কোন ঝামেলা চাই না আমি। যদি এরপরও কোন ঝামেলা করেন তাহলে সোজা থানায়।”
নাদের অনিচ্ছায় ঠোঁট টেনে হাসার ভান করলো-“ঝামেলা হইবো না স্যার।”
“না হলেই ভালো।”
রুজাইফ শীষ দিতে দিতে চলে এলো। তার মনটা বেশ প্রফুল্ল। একই তীরে দুইভাই বিদ্ধ হয়ে যাবে তা ও নিজেই জানতো না। এখন পুরো ঘটনা ভেবে নিয়ে সে প্রীত হলো। এ যে মেঘ না চাইতেই জল অবস্থা!
চলবে—
©Farhana_Yesmin
#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-১২
সে রাতে সকালের উপর দিয়ে আরেকদফা সুনামি বয়ে গেলো। সবাই ঝাপিয়ে পড়লো তর উপর। বিশেষ করে সাজেদ লাকি আর তার দুই মেয়ে অকথ্য ভাষায় সকালকে গলাগাল দিলো। শামসুন্নাহার তে আরেক ধাপ এগিয়ে এসে মেরেই বসলো সকালকে। থরথর করে কাঁপছে সকাল। সেঁজুতি বোনকে আগলে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দুই বোন অসহায় দৃষ্টিতে বাপকে দেখছে। সকাল ভাবলো তার বাপ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে। মাজেদ ঠায় বসে আছে দেখে জীবনে প্রথমবারের মতো শ্যামলী শাশুড়ীর মুখোমুখি দাঁড়ালো-“আম্মা, আমার মাইয়ার গায়ে আর হাত তুলবেন না কইলাম। অনেক মারছেন অনেক অন্যয় করছেন কিছু কই নাই। আইজকা আর না কয়া পারলাম না।”
শামসুন্নাহার রেগে গেলো-“হা*রামজাদি, মাইয়া ফিরা আইছে দেইখা সাহস বাড়ছে তোর? আমার সামনে গলা উচায়া কথা কস?”
বলে তেড়ে গেলো শ্যামলীর দিকে। তবে শ্যামলী ভয় পেলো না এবার। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো-“মারবেন আমারে? মারেন তাও আমার মাইয়ারে কিছু কইতে দিমু না। এইবার চোখ খুলছে আমার। দেখলাম জানলাম, পরের মাইয়র বেলায় যা সই লাগে নিজের মাইয়ার বেলায় তা সয় না।”
লাকি এগিয়ে এলো-“কি কইতে চান বড়ভাবি?”
“কি কইতে চাই তা তুমি ভালোই জানো লাকি। আমার বিয়াইত্তা মাইয়ারে নাদেরের লগে বিয়ার বুদ্ধিডা তুমি দিছিলা। নাদের মেলা ভালো পোলা, টেহাপয়সা আছে এইসব গল্প শুনাইছো। তয় আইজ নিজের মাইয়ার লগে বিয়ার কথা শুইনা তোমার এত জ্বলতেছে কেন? সে তো ভালো পোলা তোমার মাইয়ার জামাই অইলে সমস্যা কি?”
লাকি দাঁতে দাঁত চেপে শ্যামলীর কথা হজম করলো। সাজেদ এগিয়ে এলো-“তাই বইলা আমার মাইয়ার এমন আকাইলা দিন আসে নাই যে ডিভোর্সী বেডার লগে তার বিয়া দিতে হইবে। তোমার মাইয়ার জন্য আমার মাইয়ারে গাঙে ভাসামু কেন?”
শ্যামলী মাজেদকে ডাকলো-“বারে বাহ। ও সকালের বাপ, দেখেন কাগো কথা শুইনা মাইয়ার জীবনে প্যাচ লাগাইছিলেন। হেরা আমার মাইয়ার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে এখন তাগো মাইয়ার বেলায় সব ভুইলা গেছে।”
মাজেদ ক্লান্ত হয়ে উঠে এলো-“সাজেদ, আর ঝামেলা করিস না। জজ সাহেব যে সিদ্ধান্ত দিছে তা না মাইনা কোন উপায় নাই। তাও আবার জজ যদি ঘরের শত্রু হয় তাইলে তো আরও মানাই লাগবে। তাছাড়া নাদের তো খারাপ পোলা না। সকালের সাথে সংসার হয় নাই নীলার সাথে হইলে খারাপ কি?”
নীলা চেচিয়ে উঠলো-“আমি মানি না আব্বা, এই বিয়া আমি করুম না।”
শামসুননাহার ধমক দিলো-“তুই এইগুলার মধ্যে কথা কস কেন? আমরা বড়রা কথা কইতেছি না?”
মাজেদ নীলার কাছে হাত জোর করলো-“মারে, তুই যদি বিয়া না করোস তাইলে নাদের ঝামেলা করবো। মাইনা নে মা।”
লাকি এগিয়ে এলো-“আমার একখান শর্ত আছে ভাইজান। সব ঝামেলার মুলে আপনের বড় মাইয়া। সে নাগরের লগে পলায়া যারা ঝামেলা পাকাইছে। ওর সাজা পাইতেই হইবো। নীলার বিয়া নাদেরের লগে দিমু আমি তার আগে আপনে কতা দিবেন এই বিয়ার অনুষ্ঠানের পর সকাল যেন কোনদিন এই বাড়িতে না আসে।”
শ্যামলী আর্তনাদ করে উঠলো-“এইডা কি কইলা লাকি? মাইয়া তার বাপের বাড়ি আসবে না?”
লাকি নির্বিকার থেকে বললো-“আমার যা কওয়ার কইছি এহন সিদ্ধান্ত আপনেগো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে মাইনা নিলাম তোমার শর্ত। সকাল আর আইবোনা এই বাড়ি।”
মাজেদ কথাগুলো বলতেই লাকির মুখে চোরা হাসি ফুটে উঠলো। সেঁজুতি বললো-“আব্বা, এইটা ঠিক না।”
“আমারে ঠিক ভুল শিখাবি না সেঁজু। আমি খুব বুঝি কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। আর তোরে আইজ একটা কথা পরিস্কার বইলা দেই। তুই যদি এমুন কোন ভুল করোস তাইলে আমার মরন ছাড়া কোন গতি থাকবে না।”
“আব্বা!”
আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেলো সেঁজুতি।
মাজেদ হুঙ্কার দিলো-“কিসের আব্বা? কথা মনে গাইথানে। ভুল হইলে কোন মাফ নাই।”
পুরো ঘরে নিরবতা নেমে এলো। সাজেদ কিছুক্ষণ পর জানতে চাইলো-“তাইলে উপল আর মেরাজরে খবর দেই। ওরা আসুক বইনে গো বিয়া উপলক্ষে। কামকাইজও তো মেলা।”
“হুমমম, খবর দে। অনুষ্ঠান ধুমধামে করুম আমার মাইয়ার বিদায় অনুষ্ঠান বইলা কথা।”
সকাল ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। শ্যামলী ডুকরে কেঁদে উঠলো। এসব কিছুতে একমাত্র সেঁজুতিকে অটল বসে থাকতে দেখা যায়।
★★★
উপল এই পরিবারের লোকদের থেকে একদমই ভিন্নরকম হয়েছে। পারিবারিক কুটকাচালি, অহেতুক ঝামেলা করা কারো পেছনে লেগে থাকা এসব সে একদমই পছন্দ করে না। ছোটবেলা থেকে সে নির্বিবাদী মানুষ। তার ধ্যান জ্ঞান ছিলো পড়ালেখার জগতে ডুবে থাকা। তার পুরস্কার স্বরুপ সে এখন ডাক্তারিতে পড়ছে। কেবলমাত্র তৃতীয় বর্ষ তার।
বড় ছেলের প্রথম সন্তান বলে একটু আদরের ছিলো সে। তার উপর পড়ালেখা আর স্বভাবে ভালো বলে সে ছিলো তমিজউদদীনের চোখের মনি। প্রায়ই গল্পছলে দাদার কাছ থেকে যেটা শুনতে হয়েছে সেটা হলো, সে নাকি একদমই অন্যরকম, তার এক চাচার মতো দেখতে। কোন চাচা জানতে চাইলে কখনো বলতো না দাদা। চুপ করে যেত। আবার এও বলতো, আমি এসব বলেছি তা কাউকে বলিস না। তখন অল্প বয়সে দাদার কথাগুলো রহস্যময় লাগতো তার কাছে। মাঝে মাঝে মনে হতো সে দেখতে ওই চাচার মতো বলেই হয়তো দাদা তাকে চোখে হারাতো।
সেদিন দাদার মিলাদে আসা লোকটাকে দেখে কেন যেন উপলের তার সেই না দেখা চাচার কথা মনে হয়েছে। মনে অদ্ভুত টান অনুভব হয়েছে লোকটার প্রতি। কিছুটা কানকথা আর কিছুটা অনুমানে উপল অনেক কিছু বুঝলেও সেসব নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করেনি সে। পরদিনই মেডিকেলে ফিরে এসেছিল। আজ বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে বেশ অবাকই হলো। তার যে বোনকে ত্যাজ্য করা হয়েছিল তারই নাকি বিয়ের অনুষ্ঠান হবে বাড়িতে। অবাক করার মতোই ঘটনা বটে। কে করছে এসব? তার বাবা চাচা যে স্বইচ্ছায় এসব করছে না তা বেশ বুঝতে পারছে। তাহলে কি ওই লোকটা এসব করাচ্ছে? যদি করিয়ে থাকে তাহলে ভালো কাজই করেছে। মানুষে মানুষে এতো হিংসা বিদ্বেষ তার একদম পছন্দ না যেটা তার দাদী শামসুননাহারের একমাত্র পছন্দের কাজ।
★★★
ব্যস্ততায় রুজাইফ শ্বাস ফেলার সময় পায়নি। অফিসের কাজ শেষ করে ঘরের জন্য নানা সরঞ্জাম পছন্দ করে কেনা থেকে শুরু করে বাড়ি ফিরে মিস্ত্রিদের কাজের তদারকি। এরমধ্যে নাদিরা আর নাহিয়ানের স্কুল আর কলেজে ভর্তির জন্য ছোটাছুটি।
সব মিলিয়ে দমবন্ধ অবস্থা। দেখতে দেখতে পুরো সপ্তাহ চোখের পলকে পার হয়ে গেলো। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আলোর ঝলকানি আর উঠোনের মাঝের জায়গায় প্যান্ডেল খাটানো দেখে মনে পড়লো কাল ওই বাড়ির মেয়েদের বিয়ে। তাকে বিশেষ ভাবে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। রুজাইফ বাড়ি ঢুকতে যেয়ে নিচে দাঁড়ালো খানিকটা সময়। সবার মধ্যে বেশ তোরজোর। হলুদ শাড়ী পরা মেয়েদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে।
মিউজিক বক্স আনা হয়েছে সেখানে জোরেশোরে গান বাজানো হচ্ছে। কয়েকজন ছেলে মেয়ে বসে গল্প করছে। বিরক্ত মুখে সেসব দেখে নিজেদের ঘরে ঢুকে গেলো রুজাইফ। গোসল সেরে নিচে নামতেই নুমা তাকে চা দিলো। হাশেমকে দেখতে না পেয়ে জানতে চাইলো-“ফুপা কোথায়?”
“নাদিরার ঘরে আছে।”
“ওহহহ। ডাকো ওদেরকে একসাথে চা খাই।”
নুমার মুখ জুড়ে আমাবস্যা-“নাদিরা গোস্যা করছে। ওই বাড়ির মাইয়া আইসা ডাকছে। আইজকা ওগো হলুদ দিব। নাদিরা যাইতে চায় ওইখানে।”
রুজাইফ বিরক্ত হলো। বারবার বলার পরও নাদিরার এমন বাচ্চামির কারণ কি? সে জবাব না দিয়ে চা খাওয়ায় মন দিলো। ফজিলাতুন্নেছা এসে বসলো রুজাইফের কাছে-“নাদিরারে যেতে দে রুজাইফ। বাচ্চা মানুষ সবার আনন্দ দেখে ওরও মন চাইতেছে আনন্দ করতে।”
“ওরা আমাদের ডাকে নাই দিদা। আমি দাওয়াত পেয়েছি বিচারক হিসেবে৷ তাছাড়া সত্যি বলতে ডাকলেও আমি যেতে দিতাম না। ওদের পশমে পশমে শয়তানি। কোথাথেকে কি করবে বুঝবে না।”
ফজিলাতুন্নেছা ধরা গলায় বললো-“সেঁজুতি আইসা ডাইকা গেছে ওরে। তোর ভয়ে যায় নাই।”
“যাওয়ার দরকার নাই।” রুজাইফ উঠে গেলো সামনে থেকে। এখানে থাকলেই দিদা ব্লাকমেল করবে যেটা রুজাইফের একদম পছন্দ না।
ঘরে গিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করলো কিছুক্ষণ। গানের আওয়াজটা বড্ড বেশি কানে লাগছে। উঠে পায়চারি করলো অকারণে। তারপর বেরিয়ে কোনার কামরায় এলো। দরজাটা কিঞ্চিৎ ফাঁকা হয়ে আছে। রুজাইফ ডাকলো-“নাদিরা, আছিস?”
আওয়াজ না পেয়ে দরজা ঠেলে দিলো। বিছানা ফাঁকা এমনকি ঘরখানাও। রুজাইফ বারান্দায় উঁকি দিতেই দেখলো হাশেম মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নাদিরা মন খারাপ করে নিচে তাকিয়ে। প্যান্ডেলের মাঝের ফাঁকা দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। একটা স্টেজ সাজানো হয়েছে ওখানে। ফুল দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘সকাল আর নীলার গায়ে হলুদ’। রুজাইফ নাদিরাকে দেখলো। মেয়েটা মলিন মুখে তাকিয়ে আছে। রুজাইফ ওর মন ঘুরাতে ডাকলো-“নাদিরা, আজ ভাইয়া আসার পর নিচে যাসনি।”
নাদিরা চমকে পিছু ফেরে। রুজাইফকে দেখে তার চেহারায় খানিকটা ভয়ের ছাপ পড়লো। হাশেম হাসলো-“ওরা নাচগানা করবে। ওরও মন চাইতেছে করতে।”
নাদিরা বিরক্ত হলো-“আহ বাবা, চুপ করো।”
হাশেম চুপ করলো। রুজাইফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-“ওখানে যেতে চাস?”
“নাহ তুমি মানা করেছ এরপর আর যাই কি করে?”
“আমি বললে যাবি?”
নাদিরা চট করে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। রুজাইফকে দেখে ওর চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো-“সত্যি যেতে দেবে দা ভাই?”
রুজাইফ মাথ দুলাতেই নাদিরা ওর গলা ধরে ঝুলে গেলো-“ইউ আর দা বেস্ট ব্রাদার দা ভাই। জানো, আমি না গেলে সেঁজুতিপু খুব মন খারাপ করতো। বারবার করে বলে গেছে। এসো, এই যে দেখো আমাকে শাড়ী দিয়ে গেছে। কি সুন্দর না?”
রুজাইফ দেখলো ক্যাটক্যাটে হলদে রঙের শাড়ীটা বুকে জড়িয়ে আছে নাদিরা। রুজাইফ হাসলো-“তৈরি হয়ে আমাকে দেখিয়ে যাস। আর হ্যা, বাবাকে সাথে নিবি। ওদের দেওয়া কোন খাবার খাবি না। ওকে?”
“ওকে।”
★★★
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর নিজের রুমে ঢুকতে যেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো রুজাইফ। গান ভেসে আসছে-
তোমরা দেখগো আসিয়া
কমলা নিত্য করে থমকিয়া থমকিয়া।
রুজাইফ পায়ে পায়ে নাদিয়ার কামরায় দিকে এগুলো। ঘরের বাতি নিভিয়ে অন্ধকার করে বারান্দায় চলে এলো। কিছুটা আড়াল নিয়ে দাঁড়ালো সে। কেউ দেখে ফেললে হাস্যকর ব্যাপার হবে। সাবধানে উঁকি দিতেই দেখলো স্টেজে তখন নাচ হচ্ছে। রুজাইফ হা করে তাকিয়ে আছে। ডেয়ার গার্ল পুরো স্টেজ ঘুরে ঘুরে নাচছে। লাল পাড়ের সাদা শাড়ীর সাথে মিলিয়ে সাদা আর লালের মিশেলে ফুলের গহনা গায়ে। মনেহচ্ছে যেন কোন পরি নেমে এসেছে আকাশ থেকে। দেখতে দেখতে রুজাইফের নেশা লেগে গেলো। হুট করে নাচ শেষ হয়ে গেলো। আরেকদল স্টেজে এলো। কিন্তু রুজাইফের নজর আঁটকে রইলো সেঁজুতিতে। তার চোখ দুটো নিজের অজান্তেই সেঁজুতিতে ঘুরছে। ও যেখানে যেখানে যাচ্ছে রুজাইফের নজরও সেখানে যাচ্ছে। সেঁজুতি নাদিরার কাছে এসে বসলো। ওর কানে কানে কিছু বললো। নাদিরা তুমুল বেগে মাথা নাড়লো। কিছুক্ষণ পরই নাদিরাকে টেনে নিয়ে স্টেজে উঠে গেলো। গান শুরু হয়েছে-“লীলাবালি লীলাবালি বড়ই যৈবতী সইগো…”
নাদিরা লাজুক লতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেঁজুতি তার চারিদিকে ঘুরে ঘুরে নাচছে। দেখতে দেখতে কঠোর মনের রুজাইফের ঠোঁটের কোনে আবছা হাসি ফুটে উঠলো। তার এমন মুগ্ধতার আবেশে নিমজ্জিত হাসি এর আগে দেখা যায়নি কখনো।
চলবে—
© Farhana_Yesmin