যে থাকে আঁখি পল্লবে পর্ব-২৬

0
13

#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-২৬

খাওয়া শেষে ঠিক হলো সবাই মিলে সকালের বাসায় যাবে। নাদিরা আর সেঁজুতি তুমুল উৎসাহ নিয়ে সাজতে বসেছে। দু’জনের পরনে একইরকম ড্রেস। রুজাইফ ঈদ উপলক্ষে এই ড্রেস কিনে দিয়েছে দু’জনকে। নাদিরার দাবি ছিলো এটা। ঈদে দুজনকে একইরকম ড্রেস কিনে দিতে হবে। রুজাইফ কিনে এনেছিল। নাদিরা অবশ্য সাজতে পারে না। সেঁজুতি এ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানী। সে নাদিরাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। সাজ শেষ হওয়ার পর নাদিরাকে বললো-“দেখ কেমন লাগছে?”
নাদিরা আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হয়। আসলেই ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে। তাদের জামার রঙ হচ্ছে হাওয়াই মিঠাই কালার। সেঁজুতি ওকে পুরো পিংক বার্বি বানিয়ে দিয়েছে। নতুন রুপে ভীষণ মুগ্ধ হলো নাদিরা। সেঁজুতি চোখ নাচায়-“কেমন লাগছে বল?”
নাদিরা সরল হাসি দিয়ে বললো-“অনেক সুন্দর আপু। তুমি আমাকে সাজতে শিখিয়ে দিয় তো। আমি একদম সাজতে পারি না।”
সেঁজুতি মায়া মায়া মুখ করে বললো-“তুই না সেজেই সুন্দর নাদিরা। তোর বয়সে সাজতে নেই বেশি। এমনিতেই ন্যাচারাল সৌন্দর্য বেশি ভালো লাগে।”
নাদিরা হাসলো-“দা ভাইও তাই বলে জানো? তোমরা দু’জন দেখি সেম কথা বলো।”
সেঁজুতি মুখ বাঁকাল-“আমার বয়েই গেছে তোর দা ভাইয়ের মতো কথা বলতে। খারুস পান্ডা একটা।”
নাদিরা খিলখিল হাসিতে লুটিয়ে পড়লো-“তুমি দা ভাইকে একদম পছন্দ করো না তাই না?”
সেঁজুতি বিরবির করলো-“মাঝে মাঝে করি। এই যেমন এতো সুন্দর জামা দিয়েছে। বেটার পছন্দ ভালো।”
সেঁজুতি মনোযোগ দিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়৷ হুট করে ঘুরে বসে জানতে চাইলো-“এই নাদিরা, তোর দা ভাইকে বিয়ে দিচ্ছিস না কেন? বুড়ো হয়ে গেল তো?”
বলেই জিভ কাটলো, আয়হায় এসব কি বলছে সে? খারুস পান্ডা শুনলে নির্ঘাত ওকে কেটে টুকরো টুকরো করবে। নাদিরা অবশ্য এতো কিছু ভাবলো না। সে মাথা দুলাল-“আর বলো না। মা নানু বলতে বলতে হয়রান। দা ভাই এর এক কথা, সে বিয়ে করবে না।”
সেঁজুতি মিনমিন করলো-“বিয়ে করবে না! ওর শশুরও বিয়ে করবে। বললেই হলো?”
নাদিরা বললো-“কিছু বলছো আপু?”
সেঁজুতি মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়-“নাহ। এবার চল তাড়াতাড়ি। ছেলেগুলো অপেক্ষা করতে করতে বুড়িয়ে যাবে নয়তো।”
“হ্যা চলো।”

ওরা নিচে নামতেই দু’জনার দৃষ্টি আঁটকে গেলো। রুজাইফ আর উপল লুকিয়ে লুকিয়ে দু’জনকে দেখতে লাগলো। রুজাইফ তো বলা যায় নজর হেফাজতে রাখতে পারছে না। বারবার সেঁজুতির দিকে তাকাচ্ছে। গোলাপি রঙে মনে মনে যেমনটা ভেবেছিল তার চাইতে বেশি ভালো লাগছে সেঁজুতি কে। দু’জন সমানে এটাসেটা বলে যাচ্ছে। রুজাইফ ওদের বকবক দেখে দিলো। এতো কথা বলতে পারে মেয়েগুলো।

উপল নাহিয়ানের সাথে কথা বললেও ওর নজর নাদিরার দিকে। বারকতক তাকিয়েছে নির্লজ্জের মতো। মেয়েটা যেন আজ ওকে দেখছেই না। অথচ উপল চাইছিলে একবার তাদের নজর মিলুক। রেজা তাড়া দিতেই সকলে হইহই করে উঠলো। দিদা আর ফুমার থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বেরুলো। রুজাইফ আজ নিজে গাড়ি ড্রাইভ করবে যেহেতু ড্রাইভার ছুটিতে। সকলে উঠে বসার পর রুজাইফ ড্রাইভিং সিটে বসলো। রিয়ারভিউ মিররটা ঘুরিয়ে এমনভাবে সেট করলো যেন তাকালেই সেঁজুতিকে দেখা যায়। তাহলে সারা রাস্তা দেখতে দেখতে যাব। আর মিরর ঠিক করতে গিয়ে সেঁজুতির সাথে চোখাচোখি হলো তার। ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি দেখে সেঁজুতি ভরকে গেলো। মুখ কাচুমাচু করে সাট পাট হয়ে বসলো মেয়েটা। মনে মনে রুজাইফকে হাজারটা গালি দিলো। এই লোক তাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না কিছুতেই।

এদিকে ওদের সবাইকে রুজাইফের গাড়িতে উঠতে দেখে শকুনের নজরে তাকিয়ে রইলো দু’জন। ওদের দৃষ্টি জুড়ে ভয়ংকর ঝরের আভাস।

★★★

সকাল আর সোহানদের ছোট্ট কাঁচা পাকা ঘরটা ওদের পদচারণার মুখরিত। এতো খুশি লাগছে সকালের বলার না। বিয়ের পর এই প্রথমবার এতো আনন্দ হচ্ছে তার। ওদের জন্য নাস্তা বানাতে বানাতে সকাল বারবার চোখ মুছছে। সে নিজেকে চিমটিও কেটেছে দু’বার। বিশ্বাসই হচ্ছে না ওরা তার বাড়িতে এসেছে। শেষ পর্যন্ত সোহান বকা দিলো-“আরে, তুমি কি ওগো চোখের পানি দিয়া চা খাওয়াইবা? এতো কাঁনতেছ কেন?”
“আমার বিশ্বাস হইতেছে না ওরা সবাই আইছে।”
“বিশ্বাস না হওয়ায় কি আছে? রুজাইফ ভাইজান খুব দায়িত্ববান মানুষ। সবদিকে নজর থাকে তার। দেখছো না আমাগো সবার জন্য কাপড় কিনা দিয়া গেলো।”
রুজাইফ এসে দাঁড়ায়-“কি করছো দু’জন? আমরা কিন্তু খাবো না। খেয়েই বেরিয়েছি। শুধু চা দিতে পারো।”
সোহান তাড়াহুড়ো করে জবাব দিলো-“চা’ই দিতেছি স্যার।”
“স্যার! আমি তোমার স্যার হলাম কবে? ভাইজান বলো সোহান। ঈদের দিন এসব স্যার ডেকে মাথা নষ্ট করো না। আর শোন, তোমরা তৈরি হয়ে নাও। আমাদের সাথে যাবে ও বাড়িতে। আজ রাতে থেকে কাল চলে এসো। তার আগে তোমরা আমার কিনে দেওয়া কাপড় পরো। সুন্দর ছবি তুলে দেই।”
সোহান ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো-“জ্বি ভাইজান, কাপড় না হয় পরবো কিন্তু ওই বাড়ি যাব না। মা আর বোনকে একা রেখে যাব না।”
“ওদের রেখে যাওয়ার কথা কখন বললাম? সবাই যাব আমরা। আর তোমরা যাবে আমার বাসায় অতো ভেব না। দিদা বলেছে তোমাদের নিয়ে যেতে।”
সোহান কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু রুজাইফ থামিয়ে দিয়ে বললো-“কোন কথা শুনতে চাই না। যা বলছি তাই করো।”
ওরা আর কথা বাড়ায় না। সবাইকে চা আর মুচমুচে পাকোড়া খেতে দিয়ে সকাল গেলো তৈরি হতে। সবাই মিলে নদীর ধারে বেড়াতে গেলো। অনেক ছবি তোলা হলো সবাই মিলে। ছবিগুলো রুজাইফ তুলছে তার মোবাইলে। কিছু কিছু ছবিতে সেঁজুতিকে ফোকাস করা হলো সেঁজুতির অজান্তে। রুজাইফ একা একা বসে ছবিগুলো দেখছে আর হাসছে। হুট করে ওর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিলো কেউ। তাকিয়ে দেখে সেঁজুতি। রুজাইফ রেগে গেলো-“এটা কি ধরনের অসভ্যতা সেঁজুতি? অন্য কারো মোবাইল কেড়ে নেওয়া ব্যাড ম্যানার্স। দাও ফোন ফেরত দাও।”
সেঁজুতি যেন শুনেও শুনলো না। সে তখন মন দিয়ে ছবি ক্রল করছে। যত ছবি দেখছে ততই অবাক হয়ে রুজাইফকে দেখছে। হুট করে একটা ছবি রুজাইফের মুখের সামনে ধরলো-“এগলা কি? এটা কোন ম্যানার?”
রুজাইফ অসস্তি বোধ করলো। সেঁজুতি ওড়না ঠিক করছিল এমন একটা ক্যানডিড পিক তুলেছিল সে। অন্যমনস্ক সেঁজুতিকে দারুণ লাগছে সে ছবিতে। ধরা পড়ে মোবাইল কেড়ে নিতে চাইলেও পারলোনা। সেঁজুতি দ্রুত সীমার বাইরে পালালো। মুখ ভেংচে বললো-“এইগুলা করেন আপনি? লুচ্চা বেডা।”
রুজাইফ ওর পিছনে দৌড়াল-“মোবাইল ফিরিয়ে দাও নয়তো খারাপ হবে।”
সেঁজুতি বাঁচার জন্য ছুটছে দিকবিদিক। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো-“দেব না। আর কি কি ছবি তুলছেন দেখবো আগে।”
রুজাইফ পিছু নিয়ে আছে। সেঁজুতি ছুটতে ছুটতে বাড়ি থেকে খানিকটা নির্জনে চলে এসেছে। পিছু ফিরে রুজাইফকে না দেখে মোবাইলে ছবি দেখতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি। মোবাইল লক হয়ে গেছে। বিরক্তিতে মুখ দিয়ে গালি বেরিয়ে এলো তার। এটা কি হলো? এতো কষ্ট করে মোবাইল চুরি করে লাভ কি হলো? মন খারাপ করে ফিরে যাচ্ছিল তখন রুজাইফ ওকে আঁটকে ফেললো। হাত দু’টো সহ পেট আঁকড়ে ধরলো একহাতে-“এবার কোথায় পালাবে সুন্দরী? হা হা হা।”
বলেই ভিলেন টাইপ হাসি দিয়ে মোবাইল কেঁড়ে নিলো রুজাইফ। সে নিরাপদে পকেটে ঢুকিয়ে সেঁজুতিকে সামনাসামনি দাঁড় করালো-“বাঁদরামি কিছু কম করা যায় না?”
সেঁজুতি ফুঁসে উঠলো-“আপনে আমার ওইসব ছবি তুলছেন কেন? মানুষ দেখলে কি কবে?”
রুজাইফের ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো-“মানুষ কিভাবে দেখবে? ওসব আমি নিজের জন্য তুলেছি। আমি একা একা দেখবো।”
সেঁজুতি বিরক্ত হলো-“একা দেখবেন মানে? মেয়েদের এমন ছবি দেখতে হয়? কেউ দেখলে আমারে কি ভাববে।”
“বলছি তো কেউ দেখবে না। দেখলে না মোবাইলে লক আছে।”
“আপনে আমার এমন ছবি তুলবেন কেন?”
রুজাইফ সেঁজুতির মুখ পানে তাকিয়ে বুঝতে চাইলো ও কি বলতে চাইছে আসলে। মাথা নেড়ে বললো-“আমি তুলবো না তো কে তুলবে? পাড়ার মজনু?”
সেঁজুতির গাল গোলাপি হলো-“কেউই তুলবে না। না আপনি না অন্য কেউ।”
রুজাইফ গোয়ারের মতো মাথা নাড়ে-“তোমার ছবি একমাত্র আমি তুলবো অন্য কেউ না, বুঝেছ? এ বিষয়ে খামোখা আর্গু করো না। যাও বাসায় যাও। না হলে ওরা আবার কি না কি ভেবে বসে।”
সেঁজুতি প্রশ্ন করতে চাইলো-“কি ভাববে?”
কিন্তু করলোনা। বেশি বোকামি করা ভালো দেখায় না।
সে হাঁটা ধরলো। রুজাইফ পিছু ডাকলো ওকে-“শোন, আজ তোমাকে সুন্দর লাগছে ভীষণ।”
সেঁজুতি মুখ বাঁকাল।

বাড়ির দিকে ফিরতে গিয়ে নাদিরা খানিকটা পিছিয়ে গেছিল। মাটির পথে খানিকটা উঁচু হিল পড়ে হাঁটা কষ্টকর। সে তাই ধীরে ধীরে হাঁটছিল। উপল খেয়াল করলো ব্যাপারটা। সে নিজে খানিকটা ধীর হয়ে নাদিরার সাথে সাথে হাঁটতে লাগলো। দুই একবার নাদিরাকে হোটচ খেতে দেখে বললো-“পিচ্চি, তুমি বরং হিল জুতো জোড়া খুলে ফেলো। না হলে পা মচকে যেতে পারে।”
নাদিরা মন খারাপ করে বললো-“খালি পায়ে হাঁটবো? মাটি লেগে যাবে না?”
উপল ওর সরলতায় আরেকবার মুগ্ধ হয়-“তা তো লাগবেই। তবে মাটিতে খালি পায়ে হাঁটার একটা মজা আছে বুঝলে। না হাঁটলে টের পাবে না।”
নাদিরা কৌতুহলী চোখে জানতে চাইলো-“কি মজা?”
“আগে জুতো খুলে হাতে নাও। হালকা ঘাসের পথে হাঁটো তারপর টের পাবে।”
নাদিরাকে দ্বিধান্বিত দেখায়। উপল সাথে সাথে নিজের পায়ের স্যান্ডেল জোড়া খুলে হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে লাগলো। ওর দেখাদেখি নাদিরাও স্যান্ডেল খুলে ফেললো। নরম ঘাসে হালকা ভেজা ভেজা মাটিতে পা রাখতেই পায়ের তলায় শিরশিরে শীতল অনুভূতি হলো। কয়েক কদম চলতেই দারুণ লাগলো নাদিরার। সে এবার বেশ সাবলীলভাবে হেলেদুলে হাটতে থাকে। উপল তা দেখে হাসলো-“কি বলেছিলাম না মজা পাবে।”
নাদিরাও মিষ্টি করে হাসলো। সে বুঝতে পারছে তার যাতে একা হাঁটতে অসস্তি না হয় তাই উপল নিজে খালি পায়ে হাঁটছে, কেবল তাকে সঙ্গ দিতে। নাদিরা খুশি হয়ে গেলো। উপলের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মৃদুস্বরে বললো-“আপনি কি জানেন, আপনি খুব ভালো মনের একজন মানুষ? ঠিক আমার বাবার মতো সচ্ছ হৃদয় আপনার।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin