যে থাকে আঁখি পল্লবে পর্ব-৩৫+৩৬

0
18

#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৩৫

এলাকায় তমিজউদদীন এর একটা সন্মান ছিলো। পরপর দুইবার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, এলাকার মানুষের জন্য কাজের কাজও বেশ করেছেন। অপছন্দের কাজ করলেও তাই লোকে তাকে অপছন্দ করতে পারেনি। মুখের উপর পাল্টা জবাব দিতে পারেনি। কিন্তু এখন তো এ বাড়ির গল্প সবার মুখে মুখে চর্চা হচ্ছে। মানুষ বাড়ি বয়ে এসে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। সেসব শুনে শামসুন্নাহার মুর্ছা যায়। সারাজীবন বেশ দাপটে জীবন কাটিয়ে এই শেষ বয়সে এসে এসব ঠিক হজম হয় না তার। তার সাজানো গোছানো সংসার এইভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো এটা মেনে নিতে ভীষণ বুক পুড়ে। সব কিছুর জন্য সে রুজাইফ আর ফজিলাতুন্নেসাকে দায়ী করে দিনরাত শাপশাপান্ত করে। তাতেও শান্তি হয় না তার। প্রায় সময়ই জাহাঙ্গীরের তিন সন্তানের কান্নাকাটি দেখে তার বুক ব্যাথা করে। খুকুর চোদ্দ গুষ্টিকে গালি দিয়েও তৃপ্তি মেলে না তার। নিরীহ বাচ্চাদেরকে মেরে নিজেকে শান্ত করেন।

তার অন্তরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। প্রতিবার ফজিলাতুন্নেছা তার সাজানো জীবনে আপদের মতো উদয় হয় তারপর সব লন্ডভন্ড করে দেয়। কেন করে এমন? কিসের শত্রুতা তার সাথে? সেবার এতোকিছু করার পরও মহিলার শিক্ষা হয়নি যে আবার এই বাড়িতে ফিরে এসেছে? আর ফিরে এসে এইভাবে শোধ তুলবে? খাটের ওপর বসে বসে হিসেব মিলিয়ে চলেছে শামসুননাহার। তার চোখ দুটো হিংসার আগুনে জ্বকছে ধিকিধিকি। ‘ওই মহিলা কি ভাবছে আমি চুপচাপ বইসা বইসা তামসা দেখুম? সব মাইনা নিমু? আমার সংসার উজার কইরা ওয় নিজের সংসার গুছাইব? আমি শামসুননাহার বাঁইচা থাকতে এমুন হইতে দিমু না। মইরা যামু তাও ওর জীবনে শান্তি দিমু না’-বিরবির করে বললো শামসুন্নাহার। প্রায় দুই যুগ আগে এইরকম ঘটনার পরিকল্পনা করেছিল সে। নিখুঁতভাবে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নও করেছিল কিন্তু এবার কেন যেন সব ভেস্তে গেলো। পরিকল্পনা মতো এগুতেই পারেনি। নাহ আর না। এবার কিছু করতেই হবে। ওই মহিলারে তার জায়গা দেখানোই লাগবে। আমার জীবন এলোমেলো করুনেই শাস্তি তার পাওয়াই লাগবে।

★★★

গভীর রাতে একটা ফোনকল আর দরজায় ঠকঠক শুনে রুজাইফ নিচে নেমে এলো। দরজা খুলতেই লাকি আর মিরাজকে দেখা গেলো। ওরা ঘরে ঢুকে মুখ কাচুমাচু করলো। রুজাইফ বরাবরের মতো শান্ত ধীর স্থির। মিরাজ বললো-“আব্বা আসছে। ডাকুম তারে?”
রুজাইফ চোখের ইশারায় ডাকতে বললে মিরাজ বাইরে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো সাজেদকে নিয়ে। ক’দিনে সাজেদের চেহারা ভঙ্গুর দশা, হাতে লাঠি। সেটায় ভর দিয়ে অনেক কষ্টে হেঁটে এলো সে। হাঁপাচ্ছে রীতিমতো। রুজাইফ বসার কথা বলতেই বসে পড়লো-“এট্টু পানি হইবো?”
রুজাইফ পানি এনে দিলো। সাজেদ পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হলো। খরখরে গলায় বললো-“বাবারে, আর পলায় থাকতে পারতেছি না। এইবার এট্টু দয়া করো।”
রুজাইফ জবাব দিলো না। চুপচাপ বসলো ওদের সামনে। সাজেদ আবার মুখ খুললো-“আমি জানি তুমি তোমার বাপের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতাছ। কিন্তু বাবা আমার পোলার কি দোষ? ওর জীবনটা নষ্ট কইরো না। আমি আত্মসমর্পণ করুম তুমি ওরে ছাইড়া দাও।”
রুজাইফের চোয়াল শক্ত হলো। নিচু অথচ শীতল কন্ঠে বললো-“আমারও কোন দোষ ছিলো না। আমার ফুমারও দোষ ছিলো না। অথচ আমরা সাজা ভোগ করেছি। সবচেয়ে বড় কথা আমার বাবা নির্দোষ ছিলো। আপনারা নিজেদের স্বার্থে আমার বাবাকে ফাঁসিয়েছিলেন।”
হুট করে লাকি আর মিরাজ রুজাইফের পায়ে পড়লো। মিরাজ বললো-“ভাইজান, মাফ কইরা দেন। আর কোনদিন কোন খারাপ কাম করুম না। শেষ বারের মতো সুযোগ দেন আমারে।”
লাকি বললো-“বাপজান, তার অবস্থাডা দেখো। শরীর খারাপ হইয়া গেছে। তারে মুক্তি দেও বাপ। তুমি যা কইবা তাই করুম আমরা। একবার শুধু মামলা তুইলা নাও।”
রুজাইফ স্থির বসে রইলো। পা ছাড়িয়ে নেওয়ার কোন চেষ্টা করলো না। মৃদুস্বরে বললো-“আমি সম্পত্তির বন্টন দলিল বানাব। আপনার বাবা আমাদের যা যা লিখে দিয়েছেন সেসব নিয়ে আপনাদের কোন আপত্তি নেই এই মর্মে দলিলে সাইন করে দেবেন। শুধু আপনি না আপনার মাসহ অন্যান্য সবাই এই দলিলে সাক্ষর দেবেন। আমি আমার সব সম্পদ বুঝে নিয়ে আপনাদের নামের মামলা তুলে নেব। ঠিক আছে?”
লাকি আর মিরাজ কিছু বলার আগেই সাজেদ বললো-“আমি রাজি। তুমি কাগজ বানাও মার থিকা সাইন আমি নিয়া দিব। বাকী আর কেও ঝামেলা করবে না।”
রুজাইফ বললো-“কাগজ হলে আমি ওনার হাতে দিয়ে দেব।”

★★★

দিন দুয়েক বাদে গভীর রাতে সাজেদ এলো মায়ের কাছে। শামসুন্নাহার সাজেদকে দেখেই কেঁদে দিলো-“তুই আইসোছ? দেখছোসনি জাহাঙ্গীর কি করছে? আমার সোনার সংসারে কার নজর লাগলো রে সাজেদ।”
সাজেদ মায়ের কান্না পাত্তা দিলো না। সে কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললো-“এই কাগজে সাইন দাও আম্মা।”
শামসুন্নাহার জানতে চাইলো-“কিসের কাগজ?”
“আব্বা ওগরে যেইসব জমিজমা দিছে ওইগুলা ওগোরে দিয়া দেই। আর ঝামেলা ভালো লাগে না মা। পলাইতে পলাইতে পাও ভাঙছি। আর পলাইয়া থাকতে পারতাছি না। এইবার সব মিটমাট কইরা ফালাই।”
শামসুন্নাহার বেঁকে বসলো-“আমি সাইন দিতাম না। ওই মাতারী সারাজীবন জিতা যাইব এমনে? একবার আমার সংসার দখল করছিল আর এইবার সম্পদ৷”
সাজেদ বললো-“তোমার কাছে কি জরুরি আম্মা? আমি জেলে থাকলে তোমার চলবে তাও জমি দখল কইরা রাখবা? আমরা না থাকলে কি করবা জমি নিয়া?”
“দরকার হইলে তাই রাখুম তাও ওগোরে কিছু দিমু না।”
সাজেদ অবাক হলো-“তারমানে এই যে আমি পলায়া থাকি আপনের কষ্ট লাগে না? আপনে চান আমি জেলে যাই? একপোলা তো গেছেই এইবার আমি গেলে শান্তি? একা একা ভুতের বাড়ি আগলায় রাখবেন?”
“এতোকথা বুঝি না আমি। ওই মাতারিরে জিততে দিমু না এইটাই শেষ কথা।”
সাজেদ রেগে গেলো। এগিয়ে গিয়ে একটা ছুড়ি নিয়ে এলো। শামসুন্নাহারের সামনে ছুড়ি উচিয়ে বললো-“আম্মা, সারাজীবন আপনে যা করতে কইছেন করছি। পূন্য আর পাপ হিসাব করি নাই। তাইতো আপনে রুজাইফের বাপের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন আমরা সাথ দিছিলাম। হেগোরে মাইরা শখ মিটাইছেন। হেই পাপের ফল এখন দেউন লাগতাছে তাও আপনের নখরা কমে না। আর কতো আম্মা? সারাজীবন আপনের কথা শুনুনের পরও আইজ যখন আমি আপনেরে কিছু করতে কইলাম তখন আপনে কন পারবেন না। কেন পারবেন না? কি করবেন এই সম্পদ দিয়া? এক পোলা জেলে গেছে, আপনে না মানলে আমারও যাওয়া লাগবে। বাকি রইলো ভাই। আপনি এখন তখন যাই যাই এর মধ্যে জমি নিয়া পইড়া আছেন। আপনে আসলে স্বার্থপর।”
শামসুন্নাহার ব্যাথীত নয়নে চেয়ে থেকে বললো-“তুই এমনে কইতে পারলি? তোগো লাইগা কি করি নাই আমি।”
সাজেদ ধমকে উঠলো-“আমাগো লাইগা না আপনে নিজের লাইগা সব করছেন। এখন ভালোয় ভালোয় সাইন দেন আম্মা নাইলে আমি নিজেই নিজেরে শেষ করুম। আপনের এক পোলা জেলে গেছে আমি দুনিয়া ছাড়ুম। আপনে সব নিয়া একা একা সুখ করেন। আমাগো তো দরকার নাই আপনের।”
শামসুন্নাহার ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে থাকে ছেলের মুখপানে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না সাজেদ এমন কিছু বলতে পারে। শামসুন্নাহার হাড় মানে, ধীরে হাত বাড়িয়ে কলম তুলে নিয়ে সাইন করে দিলো কাগজে। সাজেদ হাত থেকে ছুড়ি ফেলে দিলো-“সারাজীবন মেলা আকাম করছেন আম্মা এইবার এট্টু ভালো হন।”
বলেই চলে গেলো। সে পেছনে ফিরে দেখলো না ছুড়িটা শামসুন্নাহার হাতে তুলে নিয়েছে।

শামসুন্নাহার ছুড়ি হাতে বসে থাকে কিছুক্ষণ। বুকটা ভীষণ ব্যাথা। সাজেদ এভাবে বলতে পারলো? তার স্বামী একসময় তাকে ভুলে বিয়ে করে এনেছিল ওই ফজিলাতুন্নেছাকে। তার কি দোষ ছিলো? বিয়ের তিনবছর পার হওয়ার পরও বাচ্চা দিতে পারছিল না। তাই শয়তান লোকটা আরেক বউ আনলো। তার কি প্রশংসা। শুনে সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরতো শামসুন্নাহারের। স্বামীকে শেয়ার করার মতো কঠিন কাজ আর আছে? তার উপর সবাই যদি ছোট বউয়ের প্রশংসা করে তখন তো আরও জ্বালা। তার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার জন্যই যেন বিয়ে করে নিয়ে আসার ছয় মাসের মাথায় ফজিলাতুন্নেছা পোয়াতি হলো। হায়রে! কি মাতামাতি তাকে নিয়ে। শশুর শাশুড়ী জামাই সবাই তাকে পারলে মাথায় নিয়ে নাচে৷ কতরাত কেঁদে কেঁদে পার করেছে শামসুন্নাহার। একটা বাচ্চার অ্ভাব তাকে কতটা অসহায় করে দিয়েছিল। একটা বছর অসহনীয় যন্ত্রণায় কেটেছে তার। তারপর ফজিলাতুন্নেছার ছেলে হলো আর সেও পোয়াতি হলো। কিন্তু প্রথমবার পোয়াতি হলে যে সুখ পাওয়ার কথা তার পুরোটা পেলো না সে। ফজিলাতুন্নেছাকে সবাই মাথায় করে রাখতো আর তাকে যতসামান্য যত্ন। সেই শোক ভুলতেই তো ফজিলাতুন্নেছাকে তাবিজ করলো। আল্লাহ তাকে তিনটে ছেলের মা করেছে তবুও যেন ফজিলাতুন্নেছার দাপট কমে না। তার ছেলেটার সবার মন জয় করে নিয়েছে। পড়ালেখা আচার ব্যবহার সব দিকে তার সমান দখল। তার বাপের খুব গর্ব তারে নিয়ে। শখ করে ছেলেকে অল্প বয়সে বিয়ে করিয়ে দিলো। স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ছেলেকে দায়িত্ব দিলো। সব ওই ছেলে আর তার তিনটে চাকরের মতো আগে পিছে ঘরতো। দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে গেছে শামসুন্নাহার। তারপর একদিন সুযোগ পেয়ে দিয়েছে কোপ। এক কোপ বাজিমাত। সেই বাজিমাত আবার কেন করতে পারবে না? কেন জিতবে ওই মাতারি? শামসুন্নাহার বিরবির করলো-“তোরে আমি জিততে দিমু না কিছুতেই। নিজে মইরা হইলেও তোরে অশান্তি দিমু। গতবার তোর পোলা বউরে মাইরা ফালানোর পরও তোর হাউস যায় নাই। তুই আবার ফিরা আইছোস এই বাড়িতে। আমার পোলাগো সম্পত্তি লুইটা খাবি তা আমি হইতে দিমু না কিছুতেই।”
বলেই ছুড়িটা হাতে তুলে নিলো। চোখ বুঁজে ছুড়িটা এগিয়ে আনতে লাগলো বুক বরাবর। ঠোঁট দু’টো শক্ত করে চেপে ধরেছে। তার একটাই লক্ষ্য সে যে কোন ভাবে ফজিলাতুন্নেছাকে শায়েস্তা করবে। তাতে যদি সে মারা যায় যাক। ছুড়ি সমেত হাতটা দ্রুত এগিয়ে আনছে শামসুন্নাহার। হাত কাঁপছে তার। বুকটা ভারী হয়ে আছে। আজই তার জীবনের শেষ দিন। এই সোনার সংসার ছাড়খাড় হওয়া দেখার চাইতে মরন ভালো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

#যে_থাকে_আঁখি_পল্লবে
#পর্ব-৩৬

“আপনে এতো স্বার্থপর মানুষ আম্মা? এই ঝামেলা থিকা মুক্ত হইতে নিজের জান নিবেন? আর আমাগো সারাজীবনের লাইগা দোষী বানায়া যাইবেন? আমরা দুনিয়ায় বুকে কষ্ট করুম আর আপনে সব থুইয়া পালাইবেন? না আম্মা, এতো সহজে মরতে পারবেন না আপনে। আমাগো সাথে সাথে কষ্ট করতে হইবো আপনেরও।”
লাকি ফোঁস ফোঁস করে কথা বলে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসেছিল সে। নয়তো আজ শামসুন্নাহারের লাশ দেখতে হতো। শামসুন্নাহারের হাত পা কাঁপছে। মাথা নিচু করে বসে আছে। লাকির রাগ বাড়লো তাতে-“আপনের পোলা কতদিন হইলো পলায়া আছে। কত কষ্ট হইতেছে তার তাও আপনে কন নাই সব কিছু মিমাংসা কইরা ফালাই। যেইখানে আব্বা সবকিছু ভাগ কইরা দিছে সেইখানে আপনের কেন এতো আপত্তি?”
শামসুন্নাহার মুখ তুললো-“তোমাগো লাইগাই কইতেছিলাম। আমার কি দরকার? তিনকাল কাইটা গেছে এখন আর এইসব দিয়া কি করুম?”
“কথা তো সেইটাই আম্মা। তিনকাল কাইটা গেছে তাও এতো হিংসা মনে পুইষা কি হইছে? আমরাই শেষ হইয়া গেলাম। আপনেরে কবে কইছি খুকুর কথা। আপনে কানে তুলেন নাই। ভাবছেন আমি হিংসা করতেছি। মানুষের কাছে হাসির পাত্র হইলেন, লোকের কথায় বাইরে যাওন যায় না কি করবেন এখন আম্মা? সবচেয়ে বড় কথা এই যে তিনডা পোলাপান বাপ মা ছাড়া হইলো এই দায় কার?”
শামসুন্নাহার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। তার চোখ মুখ ঘামছে রীতিমতো। লাকি বললো-“আমার এক মাইয়ার বিয়া বাকি আছে এখনো। সেঁজুতি বাকি আছে। ভাগ্যিস বড়ডার বিয়া দিছিল ওই পোলা। নাইলে দুই মাইয়া নিয়া কি করতাম। এই ঘটনার পর এই বাড়ির মাইয়াগো বিয়া হইবো আর? কন আপনে? কারো জন্য চিন্তা নাই কারো কথদ ভাবার নাই আপনে কেবল আপনের চিন্তা করতেছেন। কেন আম্মা কেন?”
শামসুন্নাহার অসহায় আত্মসমর্পণ করলো-“বউ আমাকে মাফ দাও। এতো কিছু ভাবি নাই আমি। কয়দিন ধইরা যদ হইলো তাতে আমার বাঁইচা থাকার স্বাদ গেছেগা। আমারে মরতে দাও নাইলে মাইরা ফালাও। এই জীবন রাইখ কি হইবো?”
“জীবন রাখা না রাখার আপনে কেডা আম্মা? কর্মফল ভোগ না কইরা কেউ মরে না আম্মা। চিন্তা কইরেন না যখন মরার তখন মরবেন।”
লাকি চলে গেলো। শামসুন্নাহার আস্তে করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সত্যি কি সে স্বার্থপর? কারো কথা ভাবেনি? নিজের সন্তানের জন্য ভাবেনি? কেবল নিজের কথা ভেবেছে? জীবন তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে? তার অপরাধটা কি? অস্থির মন নিয়ে এপাশ ওপাশ করে সারারাত।

ভোর হওয়ার পরও শাশুড়ীকে উঠতে না দেখে ডাকতে আসে শ্যামলি। এসে দেখে শামসুন্নাহার মেঝেতে পড়ে আছে জ্ঞানহীন, তার মুখ দিয়ে গ্যাজলা বের হয়েছে। ভয় পেয়ে চেচিয়ে উঠলো সে। ছুটে এলো মাজেদ সেঁজুতি মিরাজসহ সকলে। দ্রুত হাসপাতালে নিলো তাকে। জানা গেলো ভোরের দিকে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তার। অবস্থা ক্রিটিক্যাল।

তিন চার দিন পর শামসুন্নাহার ফিরে এলো। তার বাপ পাশ অবশ হয়ে গেছে। মুখ বেঁকে গেছে একপাশে। কথা বলতে পারে না ঠিকঠাক। কেবল গো গো আওয়াজ করে। একসময়কার দাপুটে শামসুন্নাহার এখন সবচেয়ে অসহায় মানুষ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। দিন হয়তো এভাবেই বদলে যায়।

★★★

কথা মোতাবেক রুজাইফ ওদের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিলো। সাজেদ মাজেদ দুইভাই রুজাইফের জমিগুলো তাকে বুঝিয়ে দিলো। সবকিছু নিজের আয়ত্তে নিয়ে রুজাইফ কেন যেন খানিকটা স্বস্তি পেলো। সেই সন্ধ্যায় রুজাইফ দিদার কাছে এলো। কাগজগুলো দিদার হাতে তুলে দিয়ে তার কাছে বসলো। ফজিলাতুন্নেছা সব দেখে রুজাইফের দিকে তাকাল। রুজাইফ বললো-“এবার কি তোমার মন শান্ত হয়েছে দিদা?”
ফজিলাতুন্নেছা মৃদু হাসলো-“তুই একবার তোর বাপের কবরের সামনে দাঁড়াইয়া দোয়া করলে আমার মন শান্ত হইবো দাদু। তোর বাপ বহুদিন ধইরা তোর দোয়ার অপেক্ষায় আছে। বাবা মায়ের মৃত্যুর পরজীবনে তারা কেবল সন্তানের দোয়ার জন্য অপেক্ষা করে। তুই এইবার তোর বাপের অপেক্ষার অবসান কর দাদুভাই।”
রুজাইফ গম্ভীর মুখে বসে থাকে। চেহারায় কষ্টের ছায়াঘনায়। আবেগে গলা কেঁপে ওঠে তার-“আমার নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা ছিলো দাদু। এই বাড়িতে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে বাবার কবরের সামনে দাঁড়াব না। আজ সেই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হয়েছে। আজ বাবার কাছে যাব দিদা।”
ফজিলাতুন্নেছার চোখ ছলছল হলো-“আমার আব্বাজান আজকে শান্তি পাইবো রুজাইফ। বহুদিন ধইরা কষ্টে ছিলো আইজ ওর কষ্ট শেষ হইবো। আব্বা আইজ আরামে ঘুমাইব তোর দোয়া পাইয়া।”
বলেই হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ে ফজিলাতুন্নেছা। রুজাইফ এগিয়ে এসে দিদাকে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ দুটো ভেজা ভেজা, ঠোঁট চেপে কান্না গিলে নেওয়ার চেষ্টা করছে আপ্রান।

এই প্রথম রুজাইফ সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরেছে। অজু করে সে ধীর পায়ে হেঁটে বাড়ির পেছনে পারিবারিক কবরস্থানে এসে দাঁড়ায়। গেট খুলে বাবার কবরের সামনে আসে। দীর্ঘ দিনের অযত্নে কবরের বুকে লম্বা ঘাস জন্মেছে। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। বিশটা বছর তার বাবা কতটা অবহেলায় থেকেছে এখানে। রুজাইফ পরম যত্নে বাবার কবরের মাটিতে হাত বুলায়। চোখের জল ফেলে দু’হাত তুলে দোয়া করে বাবার জন্য। আগে থেকে বানিয়ে রাখা নামফলক নিজের হাতে বাবার কবরের সামনে রোপণ করে। কাজ শেষ করে বাড়ির উঠোনে আসতেই সেঁজুতিকে দেখলো। ওর দিকে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে-“কই গেছিলেন?”
“কবরস্থানে। আমার আব্বার কবর জিয়ারত করতে। টিউবওয়েলটা চাপো তো হাত মুখ ধুয়ে নেই।”
সেঁজুতি বিনা বাক্যে টিউবওয়েল চাপে। রুজাইফ হাতমুখ ধুতে ধুতে জানতে চাইলো-“তোমার দাদী কেমন আছে?”
সেঁজুতি ঠোঁট ওল্টায়-“যেমন থাকার তেমনই আছে। কষ্ট তো আমার মার হইতেছে সারাদিন ওই বুড়ির পিছনে খাটতে খাটতে।”
রুজাইফ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সেঁজুতি আমতা আমতা করে। রুজাইফ বললো-“একটা লোক রাখলেই তো হয়।”
সেঁজুতি জবাব দিলো না। রুজাইফ জানতে চাইলো-“পড়ালেখার খবর কি? ঠিকঠাক পড়ছো? সামনে তোমার এক্সাম না।”
“হুমমম।”
“যাও পড়তে বসো।”
“এখন!”
“তো কখন? ফাঁকিবাজি না করে পড়তে বসো। ক’দিন ধরে দেখছি খালি এলোমেলো ঘুরছো। কলেজেও যেতে দেখি না।”
সেঁজুতি মন খারাপ করে বললো-“কলেজে গেলে সবাই খালি আজেবাজে কথা কয় এইজন্য যাইতে মন চায় না।”
“কেউ কিছু বললেই কানে নেবে কেন? দরকার হলে কানে তুলো গুঁজে থাকবে। কারো কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।”
“জবাব না দিয়া থাকন যায়? যে সব কথা কয়?”
রুজাইফ নির্বিকার থেকে বললো-“সত্য কথাই তো বলে তাহলে সহ্য করতে পারো না কেন? শান্তিতে থাকতে হলে মুখ একটু কম চালাবে।”
রুজাইফ আর দাঁড়ায় না। সেঁজুতি সেদিকে তাকিয়ে থেকে মুখ বাঁকাল-“কথা না কইলে মানুষ বাঁচে?”

★★★

“দিদা, শুক্রবার বাবা মায়ের জন্য দোয়ার আয়োজন করতে চাই। এই এলাকার মানুষ আমার আব্বা মাকে ভুলে গেছে অনেকে হয়তো চেনেই না। তাদের জন্য মিলাদের আয়োজন করবো আর এতিম বাচ্চাদের জন্য দুপুরের খাবার।”
রুজাইফের প্রস্তাবে ফজিলাতুন্নেছা হাসলো। সেই হাসিতে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়-“খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিছো দাদাভাই। আমি মনে মনে ভাবতেছিলাম এমন কিছু।”
রুজাইফ মাথা দুলায়-“সবাইকে বলছি তাহলে। আমার অফিসের কয়েকজনকে বলবো ভাবছি।”
“অবশ্যই সবাইকে বলবি। সবার সাথে চিনাপরিচয় এর দরকার আছে।”
ফজিলাতুন্নেছা সায় দিলো-“ওই বাড়ির ওদের বলবি তো?”
রুজাইফকে দ্বিধান্বিত দেখায়-“বলবো না?”
ফজিলাতুন্নেছা হেসে দিলো-“বলবি না কেন? সবাইকে বলবি। আচ্ছা শোন, ওদের আমি বলবো। আমি নিজে গিয়ে দাওয়াত দিবনে।”
“আচ্ছা। তোমার যেমন ইচ্ছে।”
রুজাইফ চলে যাচ্ছিল, ফজিলাতুন্নেছা ডাকলো-“শোন রুজাইফ, এদিকে আয়। কাছে বস তো।”
রুজাইফ অবাক হয়ে ফজিলাতুন্নেছার কাছে বসলো-“কি হয়েছে দিদা?”
ফজিলাতুন্নেছা রুজাইফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো-“যা করতে চাইছিস সবই তো হইলো এইবার তাহলে তুই একটা বিয়ে কর। বয়স তো কম হয় নাই।”
রুজাইফ অসস্তি বোধ করে। চঞ্চল দৃষ্টি আশেপাশে ফেলে। ফজিলাতুন্নেছা তা দেখে মুচকি হাসে-“তোর পছন্দের কেউ আছে? থাকলে বল। না এক কাজ কর শুক্রবার দাওয়াত দে। আসুক এই বাড়িতে কথা বলি।”
রুজাইফ চমকে মুখ তুলে চাইলো-“কি সব বলছো দিদা? এমন কিছু না। আপাতত বিয়ের ভাবনা বাদা দাও। অনেক কিছু গোছানো বাকি আছে।”
“বাদ দিব না। তোর কোন পছন্দ না থাকলে আমি মেয়ে দেখা শুরু করবো। এইবার তোর আপত্তি কানে নিব না। শরীর ঠিক থাকে না কখন কি হয়। তুই বিয়ে করলে শান্তিতে মরতে পারবো।”
“দিদা!”
রুজাইফ আহত স্বরে ডাকলো-“আমি জীবনে বিয়েই করবো না যাও।”
বলেই উঠে চলে গেলো। ফজিলাতুন্নেছার হাজার ডাক কানে তুললো না।

চলবে—
©Farhana_Yesmin