যে প্রেম হঠাৎ আসে পর্ব-০৩

0
111

#যে_প্রেম_হঠাৎ_আসে❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম.
– পর্ব:০৩

(গল্পে নায়িকা আর নায়িকার বোনের নাম অনুশ্রী আর তনুশ্রী পাল্টে অনুজা আর তনুজা রাখা হয়েছে।)
.
থমথমে পরিবেশ। ক্রিং ক্রিং শব্দ করে রাস্তার ওপাশ থেকে রিকশা ভ্যান যাচ্ছে। অনুজা ইহান তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। অনুজা কিছু সময় পর মুখ খোলে। নীরব কণ্ঠে বলে,
“আপনি যদি ভেবে থাকেন টিপিকাল প্রেমিকাদের মতো আমি আমার ওড়না দিয়ে আপনার মুখ-টুখ মুছে দিব। তবে আপনি ভুল ভাবছেন। দ্রুত বাড়ি যান। ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে থাকুন।”

ইহান কিছু বলে না। চুপ করে রয়। অনুজাকে কি বড্ড নিষ্ঠুর ঠেকছে তার। মোটেও ঠেকছে না। অনুজা সুন্দর। ভীষণ সুন্দর। ভয়ংকর সুন্দর। ইহান মৃদু হাসল। শান্ত স্বরে শুধাল, “আপনি আবারও ভুল করলেন অনুজা।”

অনুজার বিস্মিত চেহারা। আঁখিপল্লবে হতাশার ছোঁয়া। সে আশ্চর্য কণ্ঠে জানায়,
“আবার কি করলাম?”

ইহান তার কপালে লেপ্টে থাকা পানিটুকু হাত দিয়ে মুছল। বলল, “ওই যে ভুল করে হলেও নিজেকে আমার প্রেমিকা বললেন।”

অনুজার বিস্ময়ের শেষ রইল না। এই ছেলে সবসময় কেন যে তার সব কথার উল্টো অর্থ বের করে ভেবে পায় না অনুজা। অনুজা হতাশার নিশ্বাস ছাড়ে। বিরক্ত কণ্ঠে শুধায়,“সবসময় ভুলভাল না ভাবলে কি আপনার চলে না?”

ইহান একগাল হেঁসে উত্তর দেয়,
“আপাতত চলে না। তবে যেদিন আপনি পুরোপুরি আমার হবেন সেদিন চলে যাবে।”
“আমি আপনার কোনোদিনও হবোনা ইহান।”
“দেখা যাবে। তবে আপনি জেনে রাখুন এই ইহান এত সহজে আপনার পিছু ছাড়বে না।”

অনুজা চুপ হয়ে গেল। ইহানের শরীর চুইয়ে পানি পড়ছে। অনুজার খারাপ লাগল। তার জন্যই ছেলেটা নর্দমার পানিতে ভিজল। অনুজা সৌজন্যতার খাতিরে নিজের ছাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা নিয়ে যান ইহান। মুখ ঢেকে নিয়েন।নয়তো এলাকায় ঢুকলে আপনায় দেখে সবাই হাসাহাসি করবে।”

ইহান নিলো না। শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইল। অনুজা আরেকবার বলে, “কি হলো নিবেন না?”

ইহান মুখ খোলে। একটু ঝুঁকে শীতল কণ্ঠে আওড়ায়, “ছাতা নেয়া যাবে না শুভ্রলতা, ছাতা নিলে যে আপনার বদনাম হয়ে যাবে।”

অনুজা থতমত খায়। দু’কদম পিছিয়ে যায় নিমিষেই। থমথমে কণ্ঠে শুধায়,
“মানে?”

ইহানের তড়িৎ উত্তর,
“সব কিছুর মানে যে খুঁজতে নেই শুভ্রলতা।”

অনুজা আবারও চুপ হয়ে গেল। উত্তরে বলার মতো কোনো শব্দই পেল না। হঠাৎ অনুজার টনক নড়ল।মনে পড়ল তার টিউশন আছে। অনুজা তাড়া দিল। জোড়ালো কণ্ঠে বলল, “বাড়ি যান ইহান। আমার দেরি হচ্ছে।”

ইহান মেনে নেয়। দ্বিধাহীন জানায়,
“ঠিক আছে যান। ভেবে ছিলাম অনেকটা পথ যাব কিন্তু নর্দমার বৃষ্টি তাও হতে দিল না। যাক ব্যাপার না সাবধানে যাবেন অনু।”

অনুজা কথা বলে না। ইহান চলে গেল। ভেজালো শরীর নিয়েই উল্টো পথে হাঁটা ধরল। অনুজাও কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে ছেঁড়া জুতো পরিধিত হাঁটা ধরল। কাছেই জুতো সেলাইয়ের দোকান পড়বে। অনুজা ঠিক নিজেকে গুছিয়ে ছুটতে পারবে।’


সময়ের চাকা একটু একটু করে ছুটে। ইহান হেঁটে হেঁটে ঝন্টুর দোকানের সামনেটায় এলো। আশেপাশের লোক তাকে দেখছে। ইহানের এসবে যায় আসে না। সে চুপচাপ হাঁটে। হঠাৎই ইহানের নজর পড়ল দূর থেকে তাঁর বাবা ফখরুল রহমান আসছেন। তাকে দেখেই ইহান দ্রুত ঝন্টুর দোকানে ঢুকে পড়ল। হানা দিয়ে বলল,
“মামা, দ্রুত দু’মগ ফ্রেশ পানি দেও তো।”

আচমকা ইহানের আগমনে আর তার অবস্থা দেখে অবাক হলেন ঝন্টু মিয়া। দ্রুত পানির মগটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “একি অবস্থা করছ মিয়া?”

ইহান জবাব দেয় না। দ্রুত মগটা হাতে নিয়ে নিজের গায়ে পানি ঢালে। ঝন্টু মিয়া হতভম্ব হয়ে চেয়ে। ইহান আরো এক মগ পানি নিলো। রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে আবারও পানি ঢাললো গায়ে। ঠিক সেই মুহুর্তেই সেখানে উপস্থিত হলেন ফখরুল রহমান। ছেলের কান্ডে বিস্মিত হলেন তিনি। বিস্ময় চোখে তাকিয়ে বললেন,
“তুমি এখানে কি করছ ইহান?”

ইহান অবাকের ন্যায় পিছন ফিরে বিস্মিত কণ্ঠে জানায়, “আরে চেয়ারম্যান সাহেব যে! আপনি এখানে?”

ফখরুল রহমানের মেজাজ বিগড়াল। তিনি রাগী কণ্ঠে বললেন,
“তোমায় বলেছি না রাস্তাঘাটে আমায় চেয়ারম্যান বলে ডাকবে না।”
“আপনি তো বাবা ডাকার পারমিশন দিলেন না তাই চেয়ারম্যান ডাকা। যতই হোক বাড়ির চেয়ারম্যান আপনি।”

ফখরুল রহমান কিছু সময় চুপ থাকলেন। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি বাড়ি না গিয়ে এখানে কি করছ ইহান? আর এভাবে ভিজলে কিভাবে?”

ইহান হাতে থাকা লাল মগটা দেখিয়ে বলল,
“গোসল করছিলাম।”
“বাসায় কি পানির ঠেকা পড়েছে? যে তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গোসল করছ। বোকা পেয়েছ আমাকে।”
“পাওয়ার কি আছে? আপনি তো বোকাই।”

বিড়বিড় করে বলল ইহান। ফখরুল রহমান কিছু আধো আধো শব্দ শুনে বললেন,
“কি বললে তুমি?”
“কিছু বলি নাই সাহেব। আপনি যান। নাকি আরো কিছু বলবেন আমায়।”

ফখরুল রহমানের রাগ উঠল। ছেলের এমন খামখেয়ালি হাবভাব তাঁর মোটেও পছন্দ নয়। ফখরুল রহমান চেয়েছিলেন কিছু বলতে। কটু কথা শোনাতে। কিন্তু পরমুহূর্তেই কিছু না বলে চলে গেলেন। ইহান তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। বাবার যাওয়ার পানে শক্ত চোখে তাকিয়ে।”

ফখরুল রহমান যখন রাস্তার মোড় থেকে বেরুলেন তখন ইহান চায়ের দোকানে বসে। ঝন্টুর দিকে পানির মগটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “নেও মামা।”

ঝন্টু মিয়া নিলেন। তার দোকান ফাঁকা। এতক্ষণের কার্যকলাপের সবটাই চুপচাপ হজম করলেন তিনি। ইহানের সাথে ইহানের বাবার দ্বন্ধ চলে। এটা আর কেউ না জানলেও ঝন্টু মিয়া জানেন। তিনি নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গলায় ঝুলিয়ে রাখা গামছাটা ইহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,“কি হইছে মিয়া?”

ইহান গামছা হাতে নেয়। মাথাটা কোনোরকম মুছে বলে,“ প্রেম বিরহে ভুগছি গো মামা। তুমি তো জানো সবটা।”

ঝন্টু মিয়া চমৎকার হাসলেন। তার বত্রিশ পাটি দাঁত দেখা গেল তাতে। তিনি আচমকা গেয়ে উঠলেন,
“আরে পিরীতি কাডালের আডা লাগলে পড়ে ছাড়ে না, গোলেমালে গোলেমালে পিরীত কইর না। ও মিয়া গোলেমালে গোলেমালে পিরীত কইর না।”

ঝন্টুর কাজে ইহান হেঁসে ফেলে। নিদারুণ সুন্দর দেখায় সেই হাসি। ঝন্টু মিয়া লক্ষ্য করেন। আপনাআপনি তিনিও হাসেন।”


টুংটাং গিটারের শব্দ শোনা যায়। কেউ বাজাচ্ছে। বোধহয় ইহান। অনুজা নিজ রুমের পড়ার টেবিলে বসা। গিটারের তালে তার মনোযোগ নষ্ট হয়। অনুজা বিরক্ত হয় না। ইহান এমনিতে একটু ঘাড়ত্যাড়া হলেও, গিটারটা দারুণ বাজায়। শুনতে বেশ লাগে। অনুজা ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত নয়টা পয়তাল্লিশ। অনুজা বইয়ের পাতা বন্ধ করে। আর ভাল লাগছে না। বাহির থেকে অনুজার ছোট বোন তনুজার ডাক শোনা যায়। সে বলে,
“আপা খাবি না?”

অনুজা তক্ষৎণাৎ উত্তর দেয়, “আসছি।”

খাওয়া শেষ করে রুমে আসতে আসতে অনুজার সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। খাওয়ার পরে পরিবারের সাথে একটু খোশগল্প আর মায়ের কাজে সাহায্য করতে পছন্দ করে অনুজা। অনুজা রুমে ঢোকে। পুরো ঘরে লাল লাইট জ্বলছে। বিছানায় উবুড় হয়ে তনুজা শুয়ে। অনুজা একটু হাসে। নিজের রুমের দরজা আঁটকে এগিয়ে যায় বেলকনির দিকে। মাঝরাতের আকাশ দেখতে অনুজা দারুণ পছন্দ করে। কিন্তু ইহানের জন্য এটাও ঠিক মতো হচ্ছে না। অনুজা চুপিচুপি বেলকনির কপাট খুলে ওপাশে তাকায়। দেখে পুরো রুম অন্ধকার। হয়তো ইহান ঘুমিয়ে পড়েছে। অনুজা খুশি হলো। বেলকনির কপাটটা মৃদু খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। তখনই আঁধারের ভীড়ে ইহানের কণ্ঠ শোনা যায়। সে মলিন কণ্ঠে বলে,
“আমাতে এত ভয় অনু, যে বেলকনিতে আসতেও তোমায় উঁকিঝুঁকি মারতে হয়।”

অনুজার বুকটা বিস্ময়ের ন্যায় ছ্যাঁত করে ওঠে। পা থেমে যায় ওখানেই। সর্বাঙ্গে মৃদু কম্পন ধরে। ইহান তাকে তুমি করে বলল। গত এক বছরে আজই প্রথম ইহান অনুজাকে তুমি করে বলেছে। অনুজা কথা বলতে পারে না। ইহান সিগারেট ধরায়। অনুজা চেয়ে। ব্যাপারটা নতুন না। ইহান সিগারেট খায়। বিশেষ করে রাতে। রোজই লাইট জ্বালিয়ে খায়। কিন্তু আজ বন্ধ করে খাচ্ছে। নিশ্চয়ই অনুজাকে ফাঁদে ফেলা’র জন্য। অনুজা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে উল্টো পথে হাঁটা ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ইহানের করুণ শোনা যায়। সে বলে,“দয়া করে যাবেন না অনু।”

অনুজার পা আবার থেমে গেল। ইহানের কণ্ঠটা ঠিক কেমন যেন ঠেকল! ছেলেটা কি অসুস্থ? আচ্ছা তখন নর্দমায় ভিজে আবার জ্বর-টর বাঁধিয়ে বসল না তো?”

অনুজা ঘুরে তাকায়। ইহানের চোখ দুটো ছাড়া সেভাবে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ইহানের চোখ লাল। সত্যি সত্যি জ্বর বাঁধালো নাকি। অনুজার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু করা গেল না। উল্টো বলল, “আমি আপনার কথা শুনব কেন ইহান?”

ইহান কথা বলে না। মোবাইলের আলোটা জ্বালিয়ে চারপাশ খানিকটা আলোকিত করে। অনুজা দাড়িয়ে রয়। হঠাৎ তার যেতে ইচ্ছে করছে না। পা দু’টো আঁটকে গেছে বোধহয়। ইহান সিগারেট ধরালেও খায় না। হাতেই রয়। ইহান কিছু বলছে না। অনুজাও চুপ হয়ে যায়। চারপাশ নিস্তব্ধ লাগে। দূরের আকাশে মেঘেরা ভাসে। হঠাৎ নীরবতার দড়ি ছিন্ন করে ইহান বলে,
“আমি কি খুব খারাপ মানুষ অনু? যে আমার কথা শোনা যাবে না।”
“এটা ভালো খারাপের প্রশ্ন নয় ইহান। আপনি আমার কেউ হন না, যে আমি আপনার কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ব।”
“অথচ আপনি দাঁড়িয়ে আছেন।”
“আমি যাচ্ছি। আর কখনো আদেশ দিয়ে কথা বলবেন না। মনে রাখবেন, আপনার আদেশ শুনতে আমি বাধ্য নই।”

ইহানের করুণ মুখ। অসহায়ত্ব ফুটে। অনুজার কথাগুলো বিষের ন্যায় বুকে বিঁধে। ইহানের এত খারাপ লাগে। অভিযোগ জাগে, মেয়েটা কেন তাকে বোঝে না?”

অনুজা এক পা হাঁটে। তখনই ইহানের মলিন কণ্ঠ শোনা যায়। সে মৃদু স্বরে আওড়ায়,
“আমার শহর ভীষণ অসুস্থ রাত্রীপ্রিয়া, আপনি কেন সুখের ঔষধ হয়ে আমার শহরে আসেন না?”

#চলবে…

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ।]

#TanjiL_Mim♥️.