যে বর্ষণে প্রেমের ছোঁয়া পর্ব-৩৩+৩৪+৩৫

0
23

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৩

চলন্ত বাসে শুরু হয়েছে অশান্তি। এক নারীর সাথে অ/শ্লীলতা করার পর শৌভিকের হাতে ধরা পড়ার কারণে সকলেই ধমকাচ্ছে তাকে। তবে সেই অপ/রাধ কৃত ছেলেটির মুখে কোনো প্রকার অনুশোচনার লেশ দেখতে পেল না শৌভিক। ছেলেটির ঘাড়ের দিকের কলার চেপে ধরে কাছে এনে বলে,
“কী রে! তোর মুখে সামান্য অনুশোচনাও দেখি না কেন আমি? কীসের এত দম্ভ দেখাচ্ছিস?”

ছেলেটি এবার ক্ষিপ্রতায় ফোঁস ফোঁস করে উঠল। উল্টো ধ;মকে বলল,
“ছাড় আমাকে। তুই জানিস তুই কাকে এমনে ধরছিস। তোরে কী হাল করতে পারি জানিস? একটা কল যাবে তোরে হসপিটালে পাঠানো হবে।”

শৌভিকের আরো ক্রুদ্ধ হলো। ছেলেটির গাল চেপে বলল,
“কোন রাজার পোলা তুই? শুনি তো আগে।”

ছেলেটি ছটফটিয়ে নিজেকে ছাড়াল। শৌভিকের মতো চওড়া গঠনের মানুষের সামনে নিজের সামান্য শক্তি দিয়ে পেরে ওঠা দায়। আঙ্গুল উঁচিয়ে শৌভিকের উদ্দেশ্যে বলল,
“কামালের ছেলে আমি। মন্ত্রী সরোয়ার সাহেরকে চিনিস তুই? তার সহযোগী কামালের ছেলে। এবার কী বলবি বল!”

মন্ত্রীর নাম শোনামাত্র সকলে তটস্থ হলো যেন। এতক্ষণ যে জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল তাদের মুখের মাঝে ফ্যাকাসে ভাবের উদয় হলো। ছেলেটি ভাবল সকলের ন্যায় শৌভিকও নিভল বোধহয়। কারণ শান্ত দেখা গেল তাকে। তৎক্ষনাৎ শৌভিক নিজের পাঞ্জাবির হাতা ঠিক করতে করতে তার সাথে থাকা দুজন সঙ্গীকে বলল,
“রাতুল, নীরব! শুনলি তো? ভাইটা কিন্তু মন্ত্রী সাহেবের খাস লোক। আমাদের উচিত ভাইটির ভালো মতো আপ্যায়ন করা।”

শৌভিকের এ কথার মাঝে থাকা ইঙ্গিত বুঝে নিলো রাতুল এবং নীরব। এক গাল হেসে সম্মতি দিলো,
“অবশ্যই শৌভিক ভাই।”

বাস থেকে রাতুল আর নীরব ঘাড় ধরে নামালো ছেলেটিকে। দুজন দুদিকে ঘাড়ে হাত রেখে একপ্রকার জোর করে ধরে নিয়ে গেল সেলুনে। সেলুনে থাকা লোকটি শৌভিককে দেখামাত্র বলল,
“ভাই আপনে এখানে?”

শৌভিক ছেলেটিকে এনে ঘাড় ধরে বসিয়ে বলল,
“তেমন কিছু না। আপনার চুল কাটার মেশিনটা দেন তো ভাই।”

সেলুনের লোকটি কথা না বাড়িয়ে মেশিন এগিয়ে দেয়। উগ্র ছেলেটি চিল্লিয়ে বলল,
“দেখ, ভালো চাইলে ছাড় আমাকে। আমি ছাড় পেলে না তোকে পুঁ/তে ফেলব।”

শৌভিক সেসবে কর্ণপাত করল না। বরং রাতুল আর নীরবকে বলল,
“এই তোরা ভাইরে ধর ভালো করে। নড়তে যেন না পারে। নাহলে আপ্যায়ন ভালো মতো হবে না।”

নীরব আর রাতুল হেসে কুটিকুটি হয়ে ধরল ছেলেটিকে। শৌভিক মেশিন চালিয়ে দিলো ছেলেটির মাথায় আর চোখের ভ্রু-তে। ইচ্ছেমতো হাত চালিয়ে মাথার চুলের অবস্থা যা-তা করে ফেলল শৌভিক। আর বাম চোখের ভ্রু ছেটে ফেলে দিলো একবার। শেষমেশ তার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে নীরব আর রাতুল। রাতুল বিনয়ী হবার ভান ধরে বলে,
“জোকার ভাই কেমন ফিল করছেন?”

ছেলেটি রাগে এবং অপমানে শরীর রি রি করে উঠলেও তখন বলার মতো কোনো পরিস্থিতিতে রইল না। শৌভিক তাকে টেনে তুলে বলল,
“তোর বাপের বাপ মানে মন্ত্রী মশাইকে আমি ভয় পাইনা। এরপর নিজের এসব আলগা ক্ষমতা আর মেয়েদের সাথে অসম্মানজনক কাজ করার আগে তোর চুল আর চোখের ভ্রুর এই দশা মনে পড়বে। যা ভাগ।”

শৌভিকের চেহারার দিকে একবার তাকাল ছেলেটি। মনে ভরা ক্রোধ নিয়ে একপ্রকার ছুটে বের হলো সেলুন থেকে।

গাড়িতে অনবরত নিজের মাথার চুল উন্মাদের মতো টানছে স্বচ্ছ। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে এটা ভেবে যে সে মোহকে কোথায় খুঁজবে? আদেও যদি কেউ কিড/ন্যাপ করে থাকে তাহলে তাকে এখনো গ্রামের কোথাও কি রেখেছে? এরই মাঝে পাশে থাকা সৌমিত্র মুখ খুলল,
“ভাই! পুলিশে একবার জানাই? হয়ত পুলিশ মোহের বাবা-মায়ের কথা শুনবে না। আমাদের কথা তো শুনতেই পারে।”

স্বচ্ছ তেতে ওঠে তৎক্ষনাৎ। জোর গলায় বলে ওঠে,
“মাথা খারাপ তোর? পুলিশ আমাদের বাপের কথা শুনবে। আমাদের নয়। অন্যকিছু ভাবতে হবে।”

সৌমিত্র চুপ রইল। তানিয়ার সাথে বলা কথোপকথন আবারও মনে করতে করতে তার মস্তিষ্কে এলো কিছু ঘটনা। ক্ষীণ সন্দেহ তখন নিজের বাবার বিরুদ্ধে। ঢক গিলে নিলো সে। ভাইকে বলা উচিত হবে কি হবে না সেটা ভেবে কূলকিনারা পেল না। অবশেষে ধীর গলায় বলে ওঠে,
“ভাই আমি না একটা জিনিস খেয়াল করেছি। জানি না ব্যাপারটা কতটুকু লজিক্যাল!”

“তুই লজিক দিয়ে কবে থেকে কথা বলিস? আজকে সিরিয়াস টাইমে তোর লজিকের কথা মাথায় আসলো?”

সৌমিত্র আমতা আমতা করে বলল,
“দ্যা ম্যাটার ইজ ভেরি সেনসিটিভ, ব্রাদার৷”

“কী সেটা তাড়াতাড়ি বল!”

“কালকেই আমি আমাদের বাড়িতে ইয়াকীনকে দেখেছিলাম। ওর সাথে দেখা হয় আমার।”

সৌমিত্রের কথায় টনক নড়ে স্বচ্ছের। বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করল,
“ইয়াকীন মানে ওই গু/ণ্ডা?”

“হ্যাঁ ভাই। বাবার কাছে এসেছিল সম্ভবত। কিন্তু কেন এসেছিল জানি না। আমি জানি বাবার উপর সন্দেহ করা ঠিক হচ্ছে না তবুও মনে হলো তাই…”

স্বচ্ছ ক্রুদ্ধ হয়ে জবাব দিল,
” সন্দেহ করা ঠিক হচ্ছে না আবার কী? মানুষটা সাংঘাতিক। এই কয়দিনে যেন নতুন চিনছি তাকে। তার এই রূপ সম্পর্কে আমি অবগত ছিলামই না। আবারও বোঝাপড়া হবে! শুধু একবার উনি বাড়ি ফিরুক।”

সৌমিত্র এবার আর কিছু বলে না। সে নিজেও হতবাক হবে কাজটা যদি সত্যিই তাদের বাবা করে থাকে। স্বচ্ছ জিজ্ঞেস করল,
“ইয়াকীনের ডেরা কোথায় জানিস তুই?”

“আমি একবার শুনেছিলাম। কিন্তু এখনো ওখানে থাকে কিনা জানি না।”

“গাড়ি থেকে নাম।”

সৌমিত্র তব্দা খেয়ে তাকায় ভাইয়ের দিকে। অসহায় পানে বলে,
“তুমি সবসময় আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে কী মজা পাও ভাই?”

“নাম বলছি!”

সৌমিত্র এবার বাধ্য মতো নেমে গেল। জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই স্বচ্ছ বলল,
“ফোনে ইয়াকীনের আগের ডেরার এড্রেস পাঠা। আর বাকিদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা এখন ও ওখানেই থাকে কিনা। আমার হাতে সময় কম। আমি চাইনা কোনোভাবে আমার বা বাবার জন্য মোহের সামান্যতমও ক/ষ্ট হোক।”

স্বচ্ছ তাড়াহুড়ো করে গাড়ি নিয়ে চলল। সৌমিত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“হয়, হয়। প্রেম রোগে ধরলে এমনি হয়।”

ধীরে ধীরে দুচোখ খুলে ঝাপসা দেখল ইয়াকীন। টিমটিমে আলোতে শুধু অস্পষ্ট দেখল এক নারী অবয়ব। নড়েচড়ে ওঠে ইয়াকীন। মস্তিষ্ক তাকে মনে করায় জ্ঞান হারানোর আগের কাণ্ড। রাগে ফেটে পড়ে সে। উঠে বসতে গিয়ে খেয়াল করে তারই হাত-পা বাঁধা। মোহ তাকিয়ে তাকিয়ে ইয়াকীনের কর্মকাণ্ড দেখছে। হাতে তার ফোন। ফোনটা ইয়াকীনের। ইয়াকীন চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“খুলে দে বাঁধন।”

মোহ স্পষ্টভাবে বলে,
“খুলব। একটা শর্ত আছে আমার।”

“তোর শর্তের গুষ্টির ***। তুই না খুললে তোর অবস্থা কী হবে জানিস? খুলে দে।”

“নিজের অবস্থার কথা চিন্তা করছি না মোটেই। ভয় দেখাতে আমিও পারি। আমার হাতে এখনো দড়ির কিছু অংশ আছে। এটা দিয়ে চেপে ধরলে এবার জ্ঞান আর হারাবি না। চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বি। এখন পছন্দ তোর। আমার কথা মতো কাজ করবি নাকি আমি আমার আগের কাজটা পুনরায় করব।”

দড়ির ফাঁ/সের কথা মনে পড়তেই ইয়াকীনের যেন ম/রণ যন্ত্র/ণা অনুভব করে। কত কাছেই ছিল মৃ/ত্যু। সে ভয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বলে,
“না, না৷ আমি ম/রতে চাইনা।”

মোহ হাসে। হাসিতে তাচ্ছিল্য মিশে রয়েছে।
“যে নিজেই মৃ/ত্যুর ভয় কাটাতে পারে না সে আবার অন্যকে মা/রতে আসে।”

“আমাকে ছেড়ে দে।”

ইয়াকীনের কণ্ঠে এবার অনুরোধ। মোহ বলে,
“শর্ত মানবি?”

“কী শর্ত? সব মানব।”

“আমি ভিডিও করব সেখানে সমস্ত কীর্তির কথা স্বীকার করবি। তোকে কে কাজটা করতে বলেছে সব বলতে হবে। আমি মন্ত্রী সাহেবের পতন চাই।”

ইয়াকীন সঙ্গে সঙ্গে হাঁসফাঁস করে উঠে বলল,
“না৷ এটা আমি পারব না। আমি নিজের ভুল স্বীকার করতে পারব কিন্তু মন্ত্রী সাহেবের নাম নিতে পারব না।”

“তাহলে এখানেই ম;রতে হবে।”

মোহ শুধু আতঙ্কিত করতেই এগোয় ইয়াকীনের নিকটে। ছটফটিয়ে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে ইয়াকীন। মোহ দড়িটা ইয়াকীনের গ/লায় দিতেই ইয়াকীন বলে,
“আমি সব করব। আমারে মা/রিস না। বাসায় দুইডা পোলা আছে আমার। মা নাই তাদের। ছেড়ে চলে গেছে। আমি ম/রলে ওদের কে দেখবে? দুই বেলা খাবার তুলে দেওয়ারও লোক নাই।”

মোহ থমকায়। কথাগুলো হৃদয়ে সামান্য পীড়া দেয়। মায়া লাগে। তবে এই মায়া ক্রোধের ঊর্ধ্বে যায় না। পৃথিবীর সকল মানুষ নিজ স্বার্থে কাজ করে। লোকটি যদি কাজটি করে বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিতে তবে মোহও কাজটি করছে সরোয়ার সাহেবের আসল রূপ বের করতে।
“গু/ণ্ডামি, কিড;ন্যাপিং ছাড়াও অনেক কাজ করা যায়। যা অন্যায় ব্যতীত। তুই সেটা করিস নি। আজকাল মানুষ ময়লা সংগ্রহ করেও সংসার চালায়। তাই আমাকে এসব কথা বলে ভোলানো সম্ভব নয়।”

বহু তর্ক বির্তকের পর অবশেষে নিজের কাজ করতে সক্ষম হলো মোহ। শুধুমাত্র একারণেই সে এখনো পালিয়ে যায় নি। সে যদি পালিয়ে যায় তবে সত্যিটা কাউকে মুখ ফুটে বললেও বিশ্বাস করত না। সে শা/স্তি চায় নিজের সাথে করা অ/ন্যায়ের। কঠোর শা/স্তি।

মোহ কাঁচুমাচু করে বের হলো ছোট্ট কুঠুরি মতো ঘর থেকে। বাহিরে বিশাল বারান্দা। বারান্দায় পড়ে থাকা নেশার বোতল দেখে বোঝায় যাচ্ছে এখানে প্রতিদিন আড্ডা বসে নেশাখোরদের। মোহ বাহিরে গিয়ে বুঝল এই জায়গাটি ভালো নয়। চারিপাশে সব পুরুষ জু/য়া খেলতে বসেছে। এ সময় এক অল্পবয়সী নারীকে দেখে হতবাক হয়ে ঘুরে ঘুরে মোহকে দেখছে তারা। ওড়না দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টায় রইল মোহ। হাঁটার গতি বাড়াল। পায়ে নেই জুতো। নিচে থাকা ছোটো ছোটো ইটের টুকরো পায়ে বিঁধছে। গলি পেরিয়ে পাকা রাস্তায় এলো মোহ। এখানে দুয়েকটা গাড়ি চলছে। স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে। জায়গাটি দেখে তার গ্রাম মনে হলো না আর। তবে কি সে ফের ঢাকা শহরে চলে এসেছে? ইথান কী করছে তাকে ছাড়া? দুর্বল শরীরে এসব ভাবনা চিন্তায় মাথা ঘুরল মোহের। পাশে এক দোকানের সাইনবোর্ড দেখে বুঝল জায়গাটি আসলেই শহরের মধ্যে। মোহ এবার ইয়াকীনের ফোনটা দেখে ভাবল, বাবার নম্বরে কল দেওয়া যাক। ফাঁকা অটো পায় কিনা সেটা ভেবে ভয়ে ভয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফোনের নম্বর ডায়াল করতে থাকল সে। অন্ধকার নেমে এসেছে আকাশে। সামনে দেখা গেল এক বড়ো গাড়ির আলোর ঝলকানি। বেশ জোরেই আসছে। নিজের শক্তি হারাচ্ছে মোহ। আগপাছ না ভেবে যেই না হাত বাড়িয়ে গাড়িকে দাঁড় করাতে চাইল গাড়িটি থেমেও গেল। গাড়ি থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসা মানুষটিকে দেখে বিস্মিত হলেও যেন কোথাও স্বস্তির বাতাস এসে লাগল মনে। স্বচ্ছ ছুটে এলো। মোহের অবস্থা পরিলক্ষিত করল। পায়ে জুতো নেই, হাতে এখনো দড়ি দিয়ে বাঁধার দাগ স্পষ্ট। সুন্দর হয়ে সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকা চুল এলোমেলো। গোল গোল সুন্দর আঁখি দুটো যেন কিছু ঘণ্টার ব্যবধানে গর্তে ঢুকে গিয়েছে। কপালের পাশে জমাট বাঁধা র;ক্ত। মোহ তাল হারায়। চোখ বুঁজে আসে। সে নিজেও জানে না এতক্ষণ কী করে সাহস ধরে রেখে কাজগুলো করেছে। এখন আর শক্তিতে কুলায় না। স্বচ্ছ চোট করে ধরে মোহের বাহু।
“ঠিক আছো তুমি? কী হয়েছে তোমার? কে করেছে অবস্থা?”

স্বচ্ছের শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠ। কী যে উচাটন তার মনে সেটা তার কথাতেই স্পষ্ট। মোহ প্রায় নিভে যাওয়া কণ্ঠস্বরে বলল,
“আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন প্লিজ? আমি বাড়ি যেতে চাই।”

“হ্যাঁ। চলো। আমায় ধরে হাঁটো। এখন আবার অস্বস্তি বোধ করো না।”

স্বচ্ছের কোথায় এক পলক তাকাল মোহ দুর্বল দৃষ্টিতে। স্বচ্ছ আস্তে করে মোহের হাত ধরল। মোহ পায়ের ধাপ ফেলে খুবই ধীর গলায় বিড়বিড়িয়ে বলল,
“হয় না অস্বস্তি এখন আর।”

স্বচ্ছের কান অবধি কথা পৌঁছায় না। সে নানান চিন্তায় দিশাহারা। মোহকে সাবধানে গাড়িতে তুলে বসাতেই মোহ বলে,
“পানি আছে? তেষ্টা পেয়েছে।”

“আচ্ছা দাঁড়াও। আমি দেখছি। বসো একটু।”

মোহ বন্ধ করে বসে রইল। স্বচ্ছ দোকানে গিয়ে পানি কিনে আনলো। পানি খেয়ে এবং মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে যেন ফিরে এলো চেহারায় সামান্য সজীবতা। শক্তি ফিরে পেল যেন মোহ। স্বচ্ছ এবার বলল,
“তোমার হাতটা দাও।”

মোহের নেত্রপল্লব বড়ো হলো। শুধাল,
“কেন?”

স্বচ্ছ জবাব ব্যতীত মোহের হাত ধরল। মোহের হাতে দাগ হয়ে যাওয়া অংশে ঠাণ্ডা পানি দিলো সে যত্নের সহিত। হাতটা ধরেছেও হালকাভাবে। যদি আবার আ;ঘাত পায়? ব্যস্ত কণ্ঠে স্বচ্ছ এবার বলে,
“একটু হলেও যন্ত্র/ণা থেকে রেহাই পাবে।”

এবার গাড়ির দরজা খোলে স্বচ্ছ। হাঁটু মুড়িয়ে বসে সে গাড়ির কাছে। মোহকে বলল,
“পা একটু বাড়িয়ে দাও।”

মোহ সাফ মানা করে।
“না, না। পায়ে দিতে হবে না। উঠুন। খারাপ দেখাচ্ছে বিষয়টা।”

“আমার বিষয় খারাপ দেখাক, ভালো দেখাক, বিশ্রী দেখাক তোমায় চিন্তা করতে হবে না। পা ধরে মা/রব এক টান। শুধু পা নয় পুরো বডি চলে আসবে।”

মোহ জেদ ধরে বলল,
“আমি বাড়ি যাব। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এতটুকু সাহায্য কী করতে পারবেন? নাকি অন্য রাস্তা দেখব?”

স্বচ্ছের ঘোলাটে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবার মোহের জেদ অতিক্রম করে। মোহকে জানান দেয়, এবার তার কথা না শুনলে সত্যিই পা ধরে দেবে টান। মোহ পা বাড়িয়ে দেয়। আস্তে করে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিলো স্বচ্ছ। বিড়বিড়িয়ে নিজ মনে বলল,
“সূর্যের সমান তেজ নিয়ে জন্ম নিয়েছে যেন!”

সবশেষে গাড়িতে উঠে বসে স্বচ্ছ। বুকের ধকধকানি কমানো যাচ্ছে না কিছুতেই। মন করছে বা/জে এক আবদার। এত সময় উদ্ভ্রান্ত হয়ে খুঁজে যাওয়া নারীটি তার সামনে থাকায় জড়িয়ে ধরে নিজেকে শান্ত করতে মন চাইছে। আচমকা স্বচ্ছ নিজের দুহাত দিয়ে নিজের দাড়ি যুক্ত গালে আলতো করে একের পর এক থা/প্পড় মা/রতে লাগলে অবাক পানে তাকায় মোহ। এই লোকটা আবার পাগল হলো নাকি? আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বলল,
“এ কী! মাথা ঠিক আছে আপনার? নাকি যতটুকু ভালো তারগুলো ছিল সেটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে?”

স্বচ্ছ হাফ ছেড়ে বলল,
“তুমি ওসব বুঝবে না। তোমাকে খুঁজে পাওয়ার পর মনে অদ্ভুত চিন্তাধারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

“কী চিন্তাধারা?”

স্বচ্ছ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঢক গিলে নির্লিপ্তে বলে ফেলল,
“অশ্লীল অসভ্য চিন্তাধারা।”

মোহের চক্ষুদ্বয় তখন কপালে। পুরো মুখশ্রীতে বিস্ময়ের ঝলকানি। থমতম খেয়ে শুধায়,
“মানে?”

“না, কিছু না। চুপ করো তো। আমার চিন্তার কথা বলতে গেলে আমি এক্সি/ডেন্ট করে বসব।”

স্বচ্ছের ধমকানিতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে নীরব হয় মোহ। মিনিট দুয়েক পরেই স্বচ্ছ হুট করে শুধায়,
“আচ্ছা! কাউকে নিয়ে অসভ্য চিন্তা কখন ঘুরপাক খায়?”

মোহ বিরক্তি নিয়ে তাকায় স্বচ্ছের পানে। এই লোকের কথার আগামাথা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাই মোহ সোজা উত্তর করে,
“যখন ভেতরের কুস্বভাব মেয়েদের দেখলে নাড়া দেয় তখন।”

“ছি, ছি। বহুবচনে যাইনি আমি। একবচনে আঁটকে আছি। আমার অসভ্যতা একবচনকে ঘিরেই।”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৪

মোহের হাসি পেল। কিন্তু হাসতে চাইল না। লুকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। মৃদু হেসে ফেলল রাস্তার পানে তাকিয়ে। কেননা, তার দৃঢ় বিশ্বাস সেই একবচন মানুষটি সে নিজেই। পরক্ষণেই মুখ মলিন হয়ে গেল মোহের। দ্রুত নিজের হাতে থাকা ইয়াকীনের ফোনটি নিয়ে ডায়াল করে নিজের বাবার নম্বর। স্বচ্ছ মোহের হাতের ফোন দেখে বলল,
“ফোন তোমার কাছে ছিল? জানাতে পারতে তো তাহলে সবাইকে তুমি কী অবস্থায় ছিলে।”

“আমাকে কি দেখতে বোকা মনে হয় আমার?”

পাল্টা প্রশ্নে স্বচ্ছ সোজা উত্তর করল,
“না, একদম না। মাঝে মাঝে দেশী মরিচ, মাঝে মাঝে মঞ্জুলিকা মনে হয়।”

মোহের রাগ হলেও সেসব নিয়ে তর্ক না করে বলল,
“যে আমায় কিড/ন্যাপ করেছিল তার ফোন নিয়ে এসেছি।”

স্বচ্ছ দ্রুত গাড়ির ব্রেক কষে। মোহের দিকে সন্দিহান হয়ে তাকায়। দ্রুত নিজের ফোনটা বের করে নেয়। একটা ছবি বের করে বলে,
“এই সেই লোক যে তোমায় কিড/ন্যাপ করেছিল?”

মোহ একপলক তাকিয়েই ফট করে বলে ফেলে,
“হ্যাঁ সেই লোকটাই তো। যে আমায় ব/ন্দি করে রেখেছিল।”

স্বচ্ছ ফোনের বাটন জোরে চাপ দিয়ে অফ করল। একটু একটু করে স্বচ্ছের মন থেকে যেন অনেক হাত নিচে নেমে গেল সরোয়ার সাহেবের প্রতি সম্মান। বিষিয়ে উঠল অন্তর। নিজের বাবার প্রতি তিক্ততা হয়ে উঠল প্রগাঢ়। ক্রোধের আগুনে ধ্বংস করতে ইচ্ছে জাগল আশপাশ। কিন্তু সে চুপ রইল। মোহ আকুতি করে বলল,
“একটু দ্রুত চলুন প্লিজ। বাড়ির সবাই অনেক চিন্তা করছে। আর ইথান নিশ্চয় কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়েছে। আমি ছাড়া ও একটা কাজও করেনা।”

স্বচ্ছ বড়ো বড়ো শ্বাস নিলো কয়েকটা। সম্মতি জানিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শুধাল,
“ইথানকে অনেক ভালোবাসো তাই না?”

মোহ মলিন হাসে। বলে,
“ওকে ভালোবাসি বলেই ওর জন্য আমার পুরো গ্রামের সাথে মনমালিন্য তৈরি হয়েছে। সকলে আমায় লাঞ্ছিত করেছে। আমি দমে যাইনি শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি আর আমার পরিবার বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেড়ে এসেছি। শুধু ইথানের মুখে দিকে চেয়ে। এখনো যখন তখন লোকজনের তিক্ত কথা শুনতে হয়। তবুও ওর প্রতি কখনো বিরক্ত হইনি। একটা সন্তানের প্রতি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা তার মায়েরই বোধহয় থাকে। সেটা যেই মা-ই হোক।”

শেষ কথাটি বেশ ধোঁয়াশা লাগল স্বচ্ছের। কৌতূহলী চোখে একবার চেয়ে জানতে চাইল,
“মানে?”

“মানে আবার কী? আমি বিশ্বাস করি মা তো মা-ই হয়। সেটাই বলতে চাইছি।”

স্বচ্ছ আরো কথা বাড়ানোর আগে মোহ কল করল তার বাবা আজহার সাহেবকে।

ইথানের কান্নাকাটি থামানোর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন আজহার সাহেব। কোলে করে তুলে পিঠে হাত বুলিয়ে থামানোর চেষ্টা করলেও ইথান ক্ষণে ক্ষণে ফুঁপিয়ে উঠে বলছে,
“মায়ের কাছে যাব। মাম্মা কোথায়? আসছে না কেন?”

আজহার সাহেব বারংবার একই শান্তনা দিয়ে যাচ্ছেন,
“এসে যাবে সোনা। রাস্তায় আছে তোমার মাম্মা।”

তবুও ইথান থামার নয়। এমতাবস্থায় আজহার সাহেবের ফোনে কল এলে তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখেন অচেনা নম্বর থেকে কল এসেছে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় আগপাছ না ভেবে কল রিসিভ করেন উনি। মোহ অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“বাবা!”

আজহার সাহেবের চক্ষুদ্বয় আকারে বড়ো হয়। কলিজায় যেন পানি আসে এত সময় পর মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনে। বিচলিত হয়ে জানতে চান,
“মোহ মা! কোথায় আছো? কী অবস্থায় আছো? ভালো আছো তো? কোথায় গিয়েছ তুমি মা?”

“বাবা আমি এখন ঠিক আছি। তুমি চিন্তা করো না। আমি বাসায় আসছি। গিয়ে সব বলব তোমাদেরকে। মা কেমন আছে? চিন্তায় কি কান্নাকাটি করছে?”

“সেটা করা তো স্বাভাবিক। আমারই তো চোখ ভিজে আসছিল তোমায় চিন্তায়৷ তোমার মা অস্থির হয়ে উঠেছে।”

মোহ আশ্বস্ত করে বলল,
“মাকে চিন্তা করতে মানা করো। আমি ফিরছি বাড়ি।”

“বাড়িতে তো আমরা কেউ নেই। গ্রামে এসেছিলাম তোমার খোঁজে।”

তৎক্ষনাৎ ইথানের কাঁদার আওয়াজ শুনতে পায় মোহ।
“বাবা! ইথান কাঁদছে? ওকে একটু ফোনটা দাও।”

আজহার সাহেব ইথানের দিকে চেয়ে বললেন,
“ইথান! এইযে তোমার মায়ের ফোন এসেছে। কথা বলো নাও।”

ইথান কানে ফোন ধরে আরো কান্না বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“মাম্মা! তুমি কোথায়?”

মোহ চটপটে কণ্ঠে বলল,
“আমি রাস্তায় ইথান। কিন্তু আমি তো এই বাসায় যাচ্ছি। এখন গ্রামের বাসায় যেতে পারব না তো। আজকের রাতটা তুমি দাদুভাইয়ের কাছে থাকো। কাল সকাল সকাল এখানে চলে এসো দাদুভাইয়ের সাথে। আজকে একটু লক্ষী ছেলের মতো থাকো। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

ইথান বিষণ্ণ হয়ে বলল,
“তুমি আমায় ছেড়ে বাসায় চলে গেছো?”

“আমার কাজ পড়ে গিয়েছিল যে। এই কাজে বাচ্চাদের আনা যায় না। আজকের রাতটা থাকো ওখানে। ঠিক আছে?”

“আচ্ছা।”

ইথানের থেকে ফোনটা নিয়ে আজহার সাহেব বলেন,
“বাড়ির এক্সট্রা চাবি বাড়িওয়ালার কাছে জমা দিয়ে এসেছি। সাবধানে থেকো। বুঝতে পেরেছ?”

মোহ সায় জানিয়ে আরো কিছু কথা বলে কেটে দিলো ফোন। স্বচ্ছ প্রশ্ন করল,
“ইথান কাঁদছে?”

“হুঁ। আমার কাছে আসার জন্য বায়না করছে শুধু।”

“তুমি কি গ্রামে যেতে চাও? তুমি বললে গ্রামে পৌঁছে দিই তোমায়?”

“না তার কোনো দরকার নেই। অনেক রাস্তা এখান থেকে গ্রামে। আপনাকে এত কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। আমাকে বাড়ি অবধি দিয়ে আসুন। আপনার শরীরও ভালো নয় এখনো।”

স্বচ্ছ প্রতিত্তোরে আর কিছু বলল না। মোহের চোখ লেগে আসছে। ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। চারিপাশ ঝাপসা লাগছে তার। হঠাৎ বলল,
“আমি একটু ঘুমোতে চাই। আমার বাড়ি অবধি পৌঁছে গেলে একটু ডেকে দেবেন?”

“ঘুমাবে এখন তুমি?”

মোহ কপাল কুঁচকে বলে,
“হুঁ। কোনো সমস্যা?”

“আমার তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি ঘুমালে তোমার সমস্যা হবে না তো?”

স্বচ্ছের ভনিতা দেখে আঁড়চোখে তাকায় মোহ। বলে,
“কী সমস্যা?”

“তুমি ঘুমিয়ে পড়লে যদি তোমায় বাড়িতে না গিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে চলে যাই? আমাকে বিশ্বাস করে আমার গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়া কি ঠিক হবে?”

“তা আমায় কোথায় নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে?”

স্বচ্ছ চোখজোড়া সরু করে। সামনের দিকে মনোযোগ দিয়ে বলে,
“যে কোথাও! ধরো, যদি নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রেখে দিই?”

মোহ অন্যদিকে ফিরে চোখ বুঁজে নেয়। নির্লিপ্তে বলে,
“তাহলে আপনাকেও ওই কিড/ন্যাপারের মতোই উল্টো ব;ন্দী করে চলে আসব। সিম্পল!”

স্বচ্ছ চকিতে তাকায়। অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়,
“কী করেছ তার সাথে তুমি? বলো!”

মোহ আর উত্তরে কিছু বলে না। বলতে চায় না। স্বচ্ছ ফের জিজ্ঞাসা করে,
“এই বলো! কী করেছ ইয়াকীনের সাথে।”

মোহের নীরবতায় থামে স্বচ্ছ। হয়ত ঘুমাচ্ছে সে। আর বিরক্ত করে না সে। মনোযোগ দেয় নিজ
কাজে।

মোহের বাড়ি যাওয়ার গলির সামনে গাড়ি থামায় স্বচ্ছ। মোহ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দিনভর ক্লান্তির ফলে আশপাশটা খেয়াল নেই মেয়েটির। স্বচ্ছ তাকে জাগায় না। নিজের ফোনটা বের করে কল করে সৌমিত্রকে।

বাহিরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত সৌমিত্র। আড্ডার মাঝে ক্যারাম খেলা চলছে। নিজের ফোনটা বেজে ওঠায় একটু দূরে সরে গিয়ে কল রিসিভ করে সে। স্বচ্ছ ভালোমন্দ জিজ্ঞেস না করে সরাসরি বলে দেয়,
“কোথায় আছিস তুই?”

সৌমিত্র আমতা আমতা করে। পরক্ষণেই ফট করে বলে,
‘তোমার মোহের চিন্তায় ভীষণ চিন্তিত ছিলাম ভাই। তাই ভাবলাম বন্ধুদের সাথে কথাবার্তা বলে নিজের চিন্তা দূর করি।”

স্বচ্ছ ধমকে বলে ওঠে,
“নিজের চাপার জোর কমাবি নাকি কানের নিচে খাবি আজকে? কত চিন্তা তোর আমার জানা আছে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিস তাই তো? তাহলে ওদের সাথে মিলে আমার একটা কাজ করে দে।”

“কী কাজ?”

“ইয়াকীনের ডেরায় গিয়ে দেখ। ও আছে কিনা খোঁজ কর। ওকে পেলে ওরে নিয়ে সোজা ক্লাবে নিয়ে আসবি। ওকে রেখে দিবি। তারপর আমি আসছি।”

সৌমিত্র বাধ্য ছেলের ন্যায় বলে,
“আচ্ছা ঠিক আছে। মিস. মোহকে পেয়েছ তুমি?”

“হুঁ। আমার সাথেই আছে।”

খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,
“হাউ রোমান্টিক! রাতের বেলা, ঠাণ্ডা হাওয়া, একই গাড়িতে তুমি আর তোমার পছন্দের নারী…”

স্বচ্ছ দ্রুত কল কাটে। রাগে বিড়বিড়িয়ে মোহের মুখের পানে তাকায়। অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না তাকে। তবে তার অবয়ব তার চোখ, নাক, মুখ সবটাই তুলে ধরেছে যেন। এই ঘুমন্ত নারীকে জাগিয়ে বিরক্ত করা কি উচিত হবে?

মোহ জাগল প্রায় আধঘন্টা পর। আস্তে করে দুর্বল চোখ দুটো খুলতেই বুঝতে পারল মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। মাথায় একহাত রাখল। পাশে তাকিয়ে দেখল স্বচ্ছ নিজের ফোন ধরে কী যেন করছে। মোহ আশেপাশে তাকাল। এটা তার চেনা রাস্তা। তারই বাড়ির সামনের গলিটা। গলা খাঁকারি দিয়ে মোহ প্রশ্ন করল,
“বাড়ির সামনে এসে পড়লে ডাকতে বলেছিলাম তো। তা না করে কী করছেন আপনি?”

স্বচ্ছ হালকা কেশে নিজের কণ্ঠস্বরে খামখেয়ালি ভাব আনার চেষ্টা করে বলল,
“ওহ! আমি একটু গেম খেলছিলাম।”

মোহ ফোনের দিকে চাইল। ব্যঙ্গ করে বলল,
“আজকাল বুঝি ফোন উল্টো করে গেম খেলে? এটা কি ফোনের নতুন সিস্টেম? আমি বোধহয় বেশি ব্যাকডেটেড হয়ে গেছি। তাই বিষয়টা সম্পর্কে জানিনা।”

স্বচ্ছ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে মোহের তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ হজম করে নিলো। তার চালাকি কখনোই মোহ নামক মেয়েটির সামনে ফলে না। বোকা বনে যায় মাত্র এবং মাত্র মোহের সামনেই। মোহ কি বুঝে ফেলল, এতক্ষণ ধরে সে মোহকে বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল? এইসব ভেবে ঘামতে শুরু করল স্বচ্ছ। কান গরম হয়ে এলো ভাবনার মাঝে। মোহ মুচকি হেসে গাড়ির দরজা খুলে নেমে গেল। গাড়ির জানালায় উঁকি দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ আপনাকে। আমার উপকার করার পাল্লা বেশি ভারী হয়ে গেল। যদি কখনো সুযোগ আসে আমি শোধ করার চেষ্টা করব।”

স্বচ্ছের চেহারা মলিন হলো। বলল,
“আমায় সবসময় এত ছোটো করো কেন তুমি মোহ? কী মজা পাও?”

“ছোটো করব কেন? কৃতজ্ঞতা জানাব না আপনাকে?”

“এটা তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা মনে হলো? তাহলে এই কৃতজ্ঞতা আমার শত্রুরও কপালেও না থাকুক।”

মোহ নির্বিকার ভাবে বলল,
“শক্রর কপালে জুটতে হবে না। আপনার কপালে জুটলেই চলবে। তাহলে আমি এখন আসি।”

মোহ গলির সম্মুখে দাঁড়ায়। স্বচ্ছ তড়িঘড়ি করে জানালা দিয়ে নিজের মাথা বের করে দিয়ে মোহকে ডাকে।
“মোহ!”

মোহ পিছু ফিরে তাকায়। ইশারায় জানতে চায়, কী হয়েছে? স্বচ্ছ অনুতপ্ত হয়ে বলে,
“সরি। আই এম সরি।”

মোহ ভ্রু কুঁচকায়। হঠাৎ ক্ষমা চাওয়ার কারণ বুঝতে পারে না। গাড়ির সন্নিকটে আসে ফের।
“সরি কেন?”

“আমি সব জানি। আমার বাবার কৃতকর্ম। সব জানতে পেরেছি। তার জন্য তোমার জীবনে এত সমস্যা। সেও আমার জন্যই এই সমস্যা তৈরি করছে। আমায় ক্ষমা করো। যদি তাও না করতে চাও তাহলে শা/স্তি দাও। আমার বুক ভার হয়ে আছে আমার নিজে বাবার অ;পরাধের কারণে। সেই ভার আমি কমাতে চাই।”

“সেই ভার কমবে তখনি যখন আপনার বাবাকে আপনি সামলাতে পারবেন। আপনার বাবার নিজের ক্ষমতার ভুল ব্যবহারকে শুধরে যদি দিতে পারেন তবেই সেই ভার কমবে। সরি বলে বা পানিশমেন্ট চেয়ে লাভ হবে না। কারণ তিনি আবারও সমস্যা তৈরির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবেন। আপনার বাবার অহংকার আপনাকেই চূর্ণ করতে হবে। নয়ত হয়তবা খুব বাজেভাবে তিনি নিজেই একদিন চূর্ণ হবেন।”

মোহের শেষ কথাগুলো বেশ ধারালো। তবে প্রতিত্তোরে কিছু বলার সুযোগ দিলো না সে। চলে গেল গলির ভেতরে।

স্বচ্ছ বাড়ি ফিরতেই দরজা খুলে দিলেন মিসেস জেবা। প্রথমেই স্বচ্ছকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন তিনি।
“এতক্ষণ কই ছিলে? দুই ভাই সারাদিন কোথায় না কোথায় ঘুরতে থাকে ঠিক নেই। একবার মাকে বলারও প্রয়োজনবোধ করে না। ছোটোটা একটু আগেই বাড়ি ফিরল। আর তুমি মাত্র ফিরলে।”

স্বচ্ছ মিসেস জেবাকে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে বলল,
“জানি আমি। ওকে আমিই কাজে পাঠিয়েছিলাম।”

“সারাদিন এত কী কাজ থাকে তোমাদের? আমায় বলতে পারো?”

“একটু পরেই জানতে পারবে। তা মন্ত্রী সাহেব বাড়িতে ফিরেছে?”

স্বচ্ছের কথায় মিসেস জেবা হেসে ছেলের হাতে চা/পড় দিলেন। ভাবলেন ছেলে হয়ত মজার ছলে বাবাকে এমন ডাকছে।
“কী বলো নিজের বাবাকে?”

“বাবা বলে ডাকতে অসহ্য লাগছে এখন মা।”

স্বচ্ছ আরো এগিয়ে এলো বসার বড়ো ঘরে। শুনতে পেল সেই কণ্ঠ। সরোয়ার সাহেব চা খাচ্ছিলেন বসে বসে। ছেলেকে দেখেই বললেন,
“আজকাল বাহিরেই ঘোরাফেরা করা হয় বেশি। বাহিরই হয়ে গিয়েছে বাড়ি আর বাড়িই হয়ে গিয়েছে বাহির তাই না?”

স্বচ্ছ সরোয়ার সাহেবের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। তাচ্ছিল্যের সহিত বলল,
“তোমার জন্যই কত যে ধকল সইতে হয় তার ঠিক আছে?”

সরোয়ার সাহেব চায়ের কাপটা রাখলেন টেবিলে। ইতিমধ্যে কপালে পড়েছে ভাঁজ। সন্দিহার হয়ে বলে উঠলেন,
“আমার জন্য ধকল সইতে হচ্ছে? কীসের ধখল?”

“কেন তুমি জানো না? তোমার তো ভালো করে জানার কথা।”

“কী জানার কথা বলছ?”

স্বচ্ছ এবার গর্জে উঠল যেন। মনের ভেতর জমা থাকা সমস্ত রাগ দা/বানলে রূপান্তর হলো।
“মনে আছে? ওইদিন হসপিটালে আমাকে প্রমিস করেছিলে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার তুমি করবে না কখনো। সেই প্রমিস তুমি নিমিষেই ভাঙলে। এই মন্ত্রী সাহেবকে আমি কখনোই চিনি না বাবা। একটা কাপুরুষের মতো অন্যকে দিয়ে একটা সাধারণ মেয়েকে তোমায় কিড/ন্যাপ করাতে হচ্ছে। কেন?”

সরোয়ার সাহেব ‘কাপুরুষ শব্দটি শুনেই উঠে দাঁড়ালেন। উপস্থিত হলো মিসেস জেবা আর নিচের ঘর থেকে ছুটে এলো ফারাহ। সরোয়ার সাহেব ধমকে বলে উঠলেন,
এই ছেলে, কাপুরুষ কাকে বলো তুমি? তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে কী বলছ তোমার হুঁশ আছে?”

“আছে হুঁশ। সব জ্ঞান আছে। এতদিন হয়ত সেই জ্ঞান ছিল না। সেই কারণে বুঝতেও পারিনি আমি যাকে নিজের আদর্শ মানি সেই মানুষটাই ভুল।”

বাবা-ছেলের দ্বন্দ্ব দেখে ফারাহ নিজের ভাইকে ডেকে উঠল।
“ভাইয়া!”

ক্রোধান্বিত স্বচ্ছ ফারাহর দিকে আঙ্গুল তুলে বলল,
“আমার আর বাবার কথার মাঝে কেউ আসবে না। কেউ না।”

সরোয়ার সাহেব হেয় করে বললেন,
“কার জন্য এত বড়ো গলা বের করছ তুমি? একটা মেয়ের জন্য নিজের বাবাকে যা নয় তাই বলে যাচ্ছো? ভুলে যাচ্ছো তাই না? আমি তোমার বাবা?”

“ভুলিনি তো। তবে আফসোস হচ্ছে এই ভেবে কেন ভুলে গেলাম না। তুমি যা করো নি ঠিক করো নি। তুমি মোহের সাথে অ/ন্যায় করে চলেছ বাবা৷”

সরোয়ার সাহেব একগুঁয়ের ন্যায় বললেন,
“অ/ন্যায় নয়। যা করেছি সেটা ওর প্রাপ্য।”

“এটা করো না তুমি বাবা প্লিজ। অন্ধ হয়ে যাচ্ছো তুমি ক্ষমতার নেশায়। এটা করো না। নিজের ভুল স্বীকার করে নাও।”

স্বচ্ছ আবেগাপ্লুত হলো এবার। যতই হোক নিজের আদর্শ যেই মানুষকে মেনে এসেছে তার প্রতি কঠিন হওয়া যেন দুর্বিষহ ব্যাপার। তবে সরোয়ার সাহেব একইভাবে বললেন,
“আমি কোনো ভুল করিনি। যা করেছি ঠিক করেছি। স্বীকার করব না নিজের ভুল। কী করবে তুমি? পুলিশের কাছে যাবে?”

স্বচ্ছ নির্লিপ্তে বলল,
“আমি তো সেটাই চাই। আইন যখন বানানো হয়েছে সেটা সকলের জন্য সমান হোক। মোহের বাবাকে তুমি জেলে পাঠিয়েছিলে না? বিনা অপ/রাধে। আজ তোমার নিজের অপ/রাধ তোমায় কত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে জানো?”

মিসেস জেবা এগিয়ে এলেন স্বচ্ছের দিকে। সৌমিত্র ঘুম থেকে উঠে টলতে টলতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। মিসেস জেবা ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,
“চুপ করো স্বচ্ছ। বাবার সঙ্গে এভাবে কথা বলো না।”

সরোয়ার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“জেবা! দেখো তোমার ছেলেকে। আমার দিকে আঙ্গুল তুলছে ও। অথচ ওর জন্যই আমি সব করেছি।”

স্বচ্ছ শব্দ করে হাতজোড় করে চোখ খিঁচে বলল,
“অনেক করেছ। প্লিজ আর কিছু করো না।”

সরোয়ার সাহেব এগিয়ে এলেন। স্বচ্ছের গাল দুটো আলতো চেপে ধরে বললেন,
“কীসের এত টান তোমার ওই মেয়েটার প্রতি? ওর জন্য নিজের বাবার বিরুদ্ধে যেয়ে কি ঠিক করছ? কেন বারবার ওর পিছু ছুটছ? কেন? ও শুধুমাত্র একটা মেয়ে! ভুলে যাও তাকে। ও তোমার প্রায়োরিটি ডিজার্ভ করেনা।”

স্বচ্ছ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। আস্তে করে নিজের গাল থেকে সরোয়ার সাহেবের হাত সরিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
ওকে আমি ভালোবাসি বাবা!”

চলবে…

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৫

সকলের চক্ষু যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম। স্বচ্ছের মুখে এমন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউই। উপস্থিত সকলে তখন হতবিহ্বল নয়নে চেয়ে আছে স্বচ্ছের দিকেই। সৌমিত্র নিজের বৃদ্ধ আঙ্গুলের নখ দাঁত দিয়ে কাটতে কাটতে বিড়বিড়িয়ে বলে ফেলল,
“নাও! ভাই আরো একটা বো/ম ফা/টিয়ে দিলো। ভাঔ আর বাবা দুজনেই তো চলাফেরা করা জীবন্ত বো/ম। কে কখন ফেটে যায় তার ঠিক নেই। এখন বাকি রইল বাবা ফেটে যাওয়ার। আল্লাহ্, জানে সামনে কী হতে যাচ্ছে।”

সৌমিত্রের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই রাগে ফেটে পড়লেন সরোয়ার সাহেব।
“তুমি কী বলছ সেটা আদেও বুঝতে পারছ স্বচ্ছ? মাথায় জ্ঞান রেখে কথা বলছ তুমি? ওই মেয়ের একটা বাচ্চা আছে। এ ব্যাপারে জানো তুমি?”

স্বচ্ছ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে ওঠে,
“জানব না কেন? সব জানি। বাচ্চার নাম ইথান। দেখতেও বেশ সুন্দর। সহজসরল একটা বাচ্চা।”

ছেলের কথায় যেন ভাষা হারালেন সরোয়ার সাহেব। স্বচ্ছ এমনভাবে ইথানের সম্পর্কে বলে যাচ্ছে যেন ইথানের সম্পর্কে সে রচনা জানতে চেয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন তিনি। নিরাশ কণ্ঠে বললেন,
“আমাকে এই দিনও দেখতে হলো। আমার ছেলে কিনা এখন এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসছে যার চরিত্রের কোনো ঠিকঠিকানাই নেই। আবার বড়ো মুখ করে বলছে সে মেয়েটাকে ভালোবাসে।”

মোহের চরিত্রের কথা ওঠামাত্র যেন কাঁপুনি ধরে গেল স্বচ্ছের শরীরে। ঘাড়ের রগগুলো একবার ফুলে উঠছে একবার বসে যাচ্ছে। নিজের ঘাড়ে কাঁপা হাত রেখে মাথা কাত করে ঘাড়ে জোরে জোরে চাপ দিতে থাকল সে। ক্রোধে নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে তার।
“ওর চরিত্র নিয়ে কোনো কথা বলবে না বাবা প্লিজ। আমি নিজের ভারসাম্য হারাচ্ছি।”

সরোয়ার সাহেব দুম করে উঠে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছের মুখোমুখি এসে স্বচ্ছের বুকে ধাক্কা দিয়ে শুধালেন,
“বললে কী করবে তুমি? মা/রবে? হাত ওঠাবে নিজের বাপের উপর?”

সৌমিত্র ছুটে এলো। স্বচ্ছের হাত ধরে পিছু হটিয়ে দিয়ে নিজে সরোয়ার সাহেবের সামনে দাঁড়াল। সে জানে তার বড়ো ভাই আর বাবার রাগ একত্র হলে কত কিছু ঘটে যেতে পারে। সে দুজনকেই থামানোর চেষ্টা করে বলল,
“অনেক ঝগড়া হয়েছে। থামো তোমরা। বাবা কী করছ? তুমিও কি ভাইয়ের সাথে নিজের রাগে বোধবুদ্ধি হারালে?”

সরোয়ার সাহেব সৌমিত্রের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বললেন,
“তোমার ভাইয়ের মাথা পাগল হয়ে গেছে মেয়েটার জন্য। তোমার ভাইকে সামলাও। বোঝাও। ও কী করছে, কী বলছে ও নিজেও জানে না।”

“বাবা, ভাই নিজের জায়গা থেকে ঠিকই আছে। তুমি কেন এমন করছ বলো তো? সেদিন ইয়াকীনকে ডেকেছিলে। মোহকে কিড/ন্যাপ করিয়েছ। কেন করছ এসব? তুমি একজন সম্মানীয় মানুষ। তোমার কি এসব মানাচ্ছে? আর ভাই যদি মোহকে ভালোও বেসে থাকে তাহলে ক্ষতি কোথায় বলো? তার পছন্দ যদি মোহ হয় তাহলে তো আমাদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সংসার, বিয়ে সব ভাইয়া করবে। তার যদি আপত্তি না থাকে…”

সৌমিত্রকে মাঝখান থেকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন সরোয়ার সাহেব।
“তোমার বয়স এখনো হয়নি কী করলে কী সমস্যা হতে পারে এসব বোঝার। মোহের মতো মেয়েকে মেনে নিয়ে আমি নিজের রেপুটেশন খোয়াতে পারব না। গুনে গুনে বহু বছর লেগেছে আমার এই জায়গা পেতে। তোমাদের কী মনে হয়? এটা আমি নষ্ট করব?”

“তোমার কী মনে হয় বাবা? তুমি যা করেছ সেটা প্রকাশ পেলে তোমার সেই রেপুটেশন তুমি ধরে রাখতে পারবে?”

মিসেস জেবা ও ফারাহ দ্রুত এগিয়ে এলো স্বচ্ছের দিকে। স্বচ্ছের কাঁধে হাত রেখে মিসেস জেবা অসহায় গলায় বললেন,
“চুপ করো। তোমার বাবা হয় উনি। কথা বাড়িয়ো না। ঘরে যাও।”

সরোয়ার সাহেব ফের প্রশ্ন করেন,
“সেসব প্রকাশ কে করবে? তুমি?”

“যদি তুমি প্রকাশ করতে না পারো, যদি অনুতপ্ত হতে না পারো তবে আমাকেই তোমার ছেলে হওয়ার দরুণ কাজটা করতে হবে।”

সরোয়ার সাহেব এবার ধমকে উঠলেন,
“স্বচ্ছ!”

সৌমিত্র আবারও স্বচ্ছকে উদ্দেশ্য করে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“ভাই! মাথা গরম করো না। চলো, আমার সাথে ঘরে চলো। মাথা ঠাণ্ডা করো। রাগ নিয়ে কোনো সমাধান হবে না৷ বাবার মাথাটাও ঠাণ্ডা হতে দাও। তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। পরে ভালো মনে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে। এখন ঘরে চলো ভাই প্লিজ!”

মিসেস জেবারও স্বামীর বাহুতে হাত রেখে বললেন,
“ঠাণ্ডা হও তুমি। স্বচ্ছকে তো জানো ও কতটা মাথা গরম করা ছেলে। তুমি ওর সাথে তর্ক করতে গেলে কথা বাড়বে। ওকে আমি বোঝাব।”

সরোয়ার সাহেব আগের মতোই গম্ভীর সুরে বললেন,
“ওকে বলে দাও, জেবা। আমার বাড়িতে থেকে আমার বিরুদ্ধে কথা বলা বা কাজ করা আমি সহ্য করব না।”

স্বচ্ছের মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল আবার। তার সামনে থাকা মানুষটার এমন তৎপর আচরণ মেনে নিতে পারছে না সে। অ/ন্যায়ের পরেও যখন অনুনয়ের কোনো ছাপ দেখছে না যখন শরীর রি রি করছে তার। ফট করে বলে বসে,
“ঠিক আছে। তাহলে থাকব না তোমার বাড়িতে আমি।”

মিসেস জেবা বি/স্ফোরিত নয়নে তাকালেন। দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেকে বললেন,
“চুপ করো। মুখে লাগাম দাও।”

সরোয়ার সাহেব তাচ্ছিল্য করে বলেন,
“আচ্ছা? তো কোথায় যাবে?”

“যেখানে ইচ্ছে চলে যাব। কিন্তু তুমি দোষ স্বীকার না করা অবধি এখানে আমি থাকব না।”

“তাই? তো কে আটকিয়েছে তোমায়? চলে যাও।”

ফারাহ চমকায়। সৌমিত্র চোখ কপালে উঠে যায়। ফারাহ হতভম্ব হয়ে বলে,
“বাবা ভাইয়া কোথায় যাবে?”

“সেটা ও বুঝে নেবে। এই বিলাসিতা জীবন তার পোষাচ্ছে না হয়ত।”

স্বচ্ছও এবার রাগের জের ধরে বলল,
“তাহলে একটা কথা শুনে রাখো বাবা। এইযে আমি যাচ্ছি। আর ফিরব না। না জানি এই বাড়িটাও কত মানুষের সাথে বেইমানি করে তৈরি করেছ। আমি এই বাড়িতে থাকব না। চলে যাচ্ছি।”

সরোয়ার সাহেব শাসিয়ে বলেন,
“হ্যাঁ, যাও যাও। আমিও দেখব তোমার কত মুরোদ। যেই ছেলে বাপের টাকা ছাড়া এক ধাপও চলতে পারে না সেই ছেলে কতদূর যেতে পারবে আমার জানা আছে। মনে রেখো, তুমি বাহিরে পা দেওয়া মাত্র তোমার ব্যাংক ব্যালেন্স, তোমার এটিএম কার্ড সমস্ত কিছু অচল হয়ে যাবে।”

স্বচ্ছ বাহিরের পানে পা বাড়িয়েছিল। থেমে গেল বাবার কথায়। পিছু ফিরে এলো। সোফার সামনে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখ সরোয়ার সাহেবের চোখে রেখে নিজের পকেট থেকে ম্যানিব্যাগ বের করে সেখানকার ভাঁজে ভাঁজে থাকা তিনটা কার্ড আর গাড়ির চাবি শব্দ করে রেখে দিলো টেবিলে। তার এমন কাজে হতবাক হলেন সরোয়ার সাহেবও। তিনি অবশ্য আশা করেন নি স্বচ্ছ এমন করতে পারে। তবুও শক্ত রইলেন তিনি। স্বচ্ছ ফের যেতে নিলে সৌমিত্র হাত চেপে ধরে তার।
“ভাই! কোথায় যাবে তুমি এই রাতে? কোথায় থাকবে? নিজের সমস্ত কার্ড, টাকা রেখে যাচ্ছো। এভাবে কোথায় যাবে? পাগল হয়ে গিয়েছ?”

ফারাহ স্বচ্ছের কাছে এসে নিজ ভাইকে আগলে দাঁড়িয়ে বলে,
“এত রাগ করতে নেই ভাইয়া। এভাবে কোথায় যাবে? টাকা নেই, গাড়ি নেই। সব ফেলে কী করে যাবে? মাথা ঠাণ্ডা করো।”

স্বচ্ছ নিজেকে নির্বিঘ্নে ছাড়িয়ে নিলো। বলল,
“দরকার পড়লে রাস্তায় কোনো গাড়ির নিচে ম/রে পড়ে থাকব তবুও এই লোকের বাড়িতে আসব না।”

স্বচ্ছ সদর দরজার কাছে চলে যায়। সৌমিত্র আটকাতে চেষ্টা করে। তার ফলস্বরূপ চ/ড়, থা/প্পড়, ধা/ক্কা পায় সে বড়ো ভাই থেকে। ফারাহ বারংবার ডাকতে থাকে। মিসেস জেবা কাঁদো কাঁদো গলায় চিৎকার দিয়ে ওঠেন,
“স্বচ্ছ তুমি যাবে না। মায়ের কথা শোনো।”

স্বচ্ছ পিছু ফিরে তাকায়। সরোয়ার সাহেব শক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ওকে আজ কেউ বাঁধা দেবে না। ও নিজে একসময় ফিরে আসবে আমার বাড়ির দোরগোড়ায়।”

স্বচ্ছ বিড়বিড়িয়ে বলে,
“জীবনেও নয়।”

মায়ের মিনতি, ভাইয়ের বারণ, বোনের অনুরোধ ঠেলে দিয়ে বাহিরে চলে আসে স্বচ্ছ। সরোয়ার সাহেব ভার কণ্ঠে বলেন,
“একদিনেই বুঝে যাবে, জীবন কতটা কঠিন। এই বাবা ছাড়া সে কতটা অসহায় সে উপলব্ধি করবে খুব দ্রুত। একটু বুঝুক, কত ধানে কত চাল!”

মিসেস জেবা কেঁদে ফেললেন এবার। নারাজ হয়ে বললেন,
“তাই বলে ছেলেটাকে এভাবে চলে যেতে বলবে? ও কোথায় যাবে এই রাতে? তুমি কি ভুলে যাচ্ছো ও তোমারও ছেলে? ওর যদি কিছু একটা হয়ে যায় তখন কী হবে?”

সরোয়ার সাহেব কঠোর গলায় বলে ফেললেন,
“আমি ওকে বলেছি বাড়ি ছেড়ে দিতে? ও নিজে চেয়েছে। তাও ওই সামান্য মেয়েটার জন্য! আমি ভুলিনি ও আমার ছেলে। ভুলিনি জন্যই এতদিন ওর কোনো কাজে বাঁধা দিইনি। ও বলেছে, বাবা আমি এখনি রাজনীতিতে জড়াব না। আমি তাতে সম্মতি দিয়েছি। ও বলেছে, বাবা আমি জীবনটাকে এখন নিজের মতো আনন্দ করব। সেকারণে আমি ওকে কোনোরকম কাজের চাপ দিইনি। তার বদলে ও আমাকে কী দিলো? এই অপমান? আর তুমি কী ভাবলে জেবা? আমি ওর অপমান সহ্য করব?”

“তুমি এটা ভুলে যাচ্ছো ও মতোই জেদি। তুমি যদি জেদ ধরে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারো তাহলে ও নিজেও জেদ ধরে বাড়িতে না আসার প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে পারে। ও কষ্টে শেষ হয়ে যাবে। তাও বাড়িতে আসতে চাইবে না। তুমি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। আমার ছেলে আমার কাছে থাকুক প্লিজ!”

জেবার কথায় সৌমিত্র বলে,
“আমি যাচ্ছি ভাইকে আনতে।”

সরোয়ার সাহেব আবারও আক্রোশে ফেটে পড়ে বললেন,
“না। ওকে কেউ নিয়ে আসবে না। ও নিজে এখানে ফিরে আসবে। বলেছি না? শুধু একটু যেতে দাও। ও যেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সেখানেই উপস্থিত হবে। যার টাকা ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না সে আর কতক্ষণ বাহিরে টিকতে পারবে! ও নিজেও উপলব্ধি করুক। বাপ ছাড়া ও কতটা অসহায়। ও যদি ফিরে আসে আমিও ওকে আগের মতোই মেনে নেব।”

সৌমিত্র তবুও যেন বিষয়টা মানতে পারল না। বলল,
“কিন্তু বাবা…”

সরোয়ার সাহেব ইশারায় থামালেন তাকে। বললেন,
“আর একটা কথাও না। আমার মুখের ওপর কথা বলা আমি পছন্দ করি না। আশা করি তুমি সেটা জানো? নাকি তোমারও ভাইয়ের মতো বাড়ির ছাড়ার ইচ্ছে হয়েছে?”

সৌমিত্র মাথা নত করল। নীরব হলো। সরোয়ার সাহেব এবার ক্লান্তির সুরে হাফ ছেড়ে বললেন,
“সামনে ভোটের অনেক কাজ আছে আমার। তাই অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কেউ বিরক্ত করতে আসবে না। আমার বিশ্রাম দরকার। যে যার ঘরে চলে যাও। আর জেবা! কান্নাকাটি করবে না একদম। ওই ছেলে যে নিজের বাবার বিরুদ্ধে যায় সেই ছেলেকে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করার কোনো মানেই হয়না।”

এই বলেই চলে গেলেন নিজ ঘরে সরোয়ার সাহেব। মায়ের মন মিসেস জেবার। কোনো বাঁধা কি মানে? চোখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে যাচ্ছে অশ্রু। সৌমিত্র কাছে এলো মায়ের। মাকে আগলে ধরে শান্তনা দিয়ে বলল,
“এভাবে কেঁদো না মা। প্রেসার লো হয়ে যাবে তোমার। আমি আছি তো। সবসময় ভাইয়ের খোঁজ রাখব। তুমি চিন্তা করো না। ভাই ফিরে আসবে।”

মিসেস জেবা কেঁদে কেঁদে ছোটো ছেলের কাছে আবদার করলেন,
“দ্রুত স্বচ্ছকে তুমি নিয়ে এসো।”

“হ্যাঁ নিয়ে আসব। বলছি তো। ঘরে যাও।”

মিসেস জেবাকে শান্ত করে ঘরে পাঠাল সৌমিত্র। তবে তার মাথা থেকেই চিন্তা দূর হলো না যেন।

চলবে…