#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪০ [দ্বিতীয় খণ্ড]
আজ আরিদ্রের কেইস কোর্টে ওঠার কথা। এতদিন দেরির কারণ আরিদ্র আহত ছিল। তাই বিরতিতে ছিল বিচারকার্য। মোহ ভিক্টিম হওয়ায় সে সহ কয়েকজন সাক্ষীকে ডাকা হয়েছে বিচারের জন্য। কোর্টের সামনে স্বচ্ছদের সামনে পড়ে যান আরিদ্রের মা মিসেস জামিলা। স্বচ্ছের মায়ের কাছে এসে প্রাঙ্গণেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
“জেবা, আমার ছেলেকে দয়া করো তোমরা। ক্ষমা করো। ওর যাবজ্জীবন হয়ে যাবে। আমার কাছে ওকে আর পাব না। ওর পুরো জীবন শেষ হয়ে যাবে।”
“জীবনের বদলে তো জীবনই নেওয়া উচিত। তাই নয় কী? তবুও আপনার ছেলের প্রাণে বেঁচে থাকার সম্ভবনা আছে। কিন্তু আপনার ছেলে একজনকে শেষই করে দিয়েছে।”
মিসেস জামিলার প্রত্যুত্তর বেশ শক্তভাবে করল মোহ। তার চোখ দুটি অনুভূতিহীন দেখাচ্ছে আজ। সেই চোখে খুশি নেই, মায়া নেই। আছে শুধু যে কাউকে ধ্বংস করার কামনা। মিসেস জামিলা মোহের হাত ধরে অনুরোধ করে বললেন,
“আমি জানি, ও অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু ওকে ছাড়া আমি কী নিয়ে থাকব বলো মোহ?”
মোহ কোনো শব্দ উচ্চারণ করবার আগে স্বচ্ছ গর্জে ওঠে।
“এক মিনিট মামি। ভুলের সংজ্ঞা আপনার জানা উচিত। আপনার ওই কুলাঙ্গার অপরাধ করেছে। ভুল মানুষ না জেনে করে। ও সজ্ঞানে, সব বুঝেশুনে প্ল্যানিং করে এসব করেছে।”
“স্বচ্ছ, ও তো তোমার ভাই। তুমি ওকে মেরো, পিটিয়ে যা ইচ্ছে করো। কিন্তু তোমার বউটাকে একটু বোঝাও।”
ঘৃণায় চোখমুখ জড়িয়ে এলো স্বচ্ছের। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“না, না মামি। আমার ভাই এই কথাটা উচ্চারণ করবেন না। এ কথা শুনলে আমার নিজেকে শেষ করতে ইচ্ছে করে, ঘৃণা লাগে নিজের উপর। যদি পারতাম ওই জানোয়ারকে খু/ন করে নিজের কলিজা শান্তি করতাম।”
কারোরই মন গলতে না দেখে বেকায়দায় মিসেস জেবার হাত চেপে ধরলেন মিসেস জামিলা। মাথা নিচু করে বললেন,
“আমি দিশাহারা হয়ে গিয়েছি জেবা। তুমি তোমার ছেলে আর ছেলের বউকে বোঝাও। দয়া করো।”
মিসেস জেবা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে জামিলাকে নিরাশ করে বললেন,
“তোমার ছেলে যা করেছে তা আমার ছেলের মধ্যে কেউ করলে তার গলা নিজ হাতে টিপে শেষ করে দিতাম। তোমার এমন অদ্ভুত আকুতিতে বোঝাই যাচ্ছে তুমি এভাবেই নিজের ছেলেকে কুশিক্ষা দিয়ে শেষ করেছ। আমি তোমাকে এ বিষয়ে কোনো উপকার করতে পারব না।”
মিসেস জামিলা কিছু বলার মতো মুখ থাকল না। মোহ যান্ত্রিক স্বরে বলল,
“আপনার জন্ম দেওয়া জন্তুটাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার বিপরীতে যদি আমাকে জীবন দিতে হয় তাও আমি দেব। তবুও আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।”
সেখানেই তাদের কথোপকথন শেষ হয়। কোর্টের ভেতরে শুরু হয় বিচার। ঈশানী ও মোহের কেইস নিয়ে কথা বলছে স্বচ্ছের বন্ধুর বাবা। যিনি একজন বেশ ভালো আইনজীবী। পিছিয়ে নেই আরিদ্রের পক্ষের আইনজীবীও। তিনি শহরের নামি-দামি আইনজীবীর মধ্যে একজন। আরিদ্র কাঠগড়ায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছাড়া পাবার আশায় চোখ চকচক করছে। তার মুখশ্রী দেখেই চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে এলো মোহের। মস্তিষ্ক বিগড়ে গেল। বারবার কানে প্রতিধ্বনিত হলো ঈশানীর মৃত্যুর আগে গোঙানির আওয়াজ। মোহ কান দুহাত দিয়ে বন্ধ করল। শ্বাসকষ্ট শুরু হলো তার। মোহের এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে ঘাবড়ে গেল স্বচ্ছ। মোহের কানে থাকা হাত দুটি ধরল সে। মোহ বন্ধ চোখ খুলল। পানিতে ভরে গেছে তার আঁখিদুটি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইল সে কান্না রোধ করতে। স্বচ্ছ ফিসফিস করে মোহকে শান্তনা দিলো,
“রিল্যাক্স, মোহ। কিছু হয়নি। আমি আছি তোমার কাছে। শান্ত হও।”
ধীরে ধীরে স্বস্তি পেল মোহ। স্বচ্ছের হাত শক্ত করে ধরে খুঁজে পেল তার বিশ্বাস। প্রথম প্রথম আরিদ্রের পক্ষের আইনজীবী মিথ্যে গল্প সাজিয়ে বলে বিষয়গুলো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও দমে গেল ইথানের বিষয়ে। ইথান সত্যিই ঈশানী আর আরিদ্রের সন্তান সেটার প্রমাণ পেশ করা হলো। একটু একটু করে বেরিয়ে এলো আরিদ্র আর ঈশানীর অতীত। মোহের জবানবন্দিতে পরিষ্কার হলো অতীতে তাদের সম্পর্ক। মোহ এসে স্বচ্ছের পাশে বসে প্রচণ্ড আতংক নিয়ে শুধাল,
“ইথান যে আমাদের ছেলে নয় সেটা তো সবাই জেনে গেল। ওকে কি আমাদের থেকে আলাদা করে দেবে?”
স্বচ্ছ মৃদু হেসে তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলে ওঠে,
“কখনোই না। আইনত ভাবে আমরা ইথানকে দত্তক নিয়েছিলাম। তাই এটা কখনোই সম্ভব নয়। তোমার মনে আছে আমাদের বিয়ের দিন হলুদের সময় আমি আগে এডপশনের কাগজপত্র দিয়ে তোমায় সাইন করিয়েছিলাম আর নিজেও সাইন করেছিলাম। ওই কাজটা এত দ্রুত করার কারণ ছিল এটাই। আমি জানতাম কোর্টে কেইস উঠলে ইথান যদি আইনত আমাদের সন্তান না হয় তবে ওকে হয় অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেবে নয়ত আরিদ্রের বাড়িতে ইথানকে থাকতে হবে। তাই কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলেছিলাম। আর ইথানকে আমরা কেমন রেখেছি সেটা তো কালকে মহিলা পুলিশ অফিসার সিভিল ড্রেসে গিয়ে খোঁজ নিলো। ইথানের সঙ্গে তিনি নিজে কথা বলেছেন যেন ইথানকেও কোর্টে না আনতে হয়। তাই আর এই নিয়ে চিন্তা নেই।”
মোহ নিজের জীবন ফিরে পেল যেন। হাফ ছেড়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ আমার পাশে এভাবে থাকার জন্য।”
“এটা আমার সৌভাগ্য।”
কাঠগড়ায় পুলিশের বয়ানও নেওয়া হয়। জানতে চাওয়া হয় সেদিন ঈশানীর মৃত লা/শ আর মোহকে তারা কী করে খুঁজে পেয়েছিল। শৌভিকও আসে। নিজের জানা পুরোটা প্রকাশ করে। হাজির করা হয় সেই দুটো ছেলেকে যারা সেই রাতে আরিদ্রের সাথে ছিল। এতকিছুর পর আরিদ্রকে আর কোনো মিথ্যে দিয়ে নির্দোষ করতে পারে না তার পক্ষের আইনজীবী। আরিদ্রের মুখে নেমে আসে কালো ছায়া। বিচারক নিজের রায় প্রকাশ করেন। আরিদ্রের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কোর্টের ভেতরেই মিসেস জামিলা চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। হাতকড়া পরানো অবস্থায় পুলিশ কনস্টেবল আরিদ্রকে কাঠগড়া থেকে নামায়। মিসেস জামিলা পাগলামি করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। আর ছাড়েন না। মহিলা কনস্টেবল জোর করে উনাকে ছাড়িয়ে নেন। এমতাবস্থায় মোহ অবিশ্বাস্য কাজ করে বসে। বসা থেকে ছুটে গিয়ে আরিদ্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কষিয়ে তার দুটো গালে থা/প্পড় দিয়ে ফেলে। স্বচ্ছ আর শৌভিক হন্তদন্ত হয়ে ছুটল মোহের দিকে। স্বচ্ছ মোহের কাঁধ চেপে ধরে সেখান থেকে সরাতে চেষ্টা করে। মোহ সরাসরি থুথু নিক্ষেপ করে আরিদ্রের মুখ বরাবর। চোখমুখ খিঁচে ফেলে আরিদ্র। শৌভিক আর স্বচ্ছ মোহের হাত ধরে দূরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তবুও মোহ শাসিয়ে বলে,
“জীবনের কোনো প্রান্তে গিয়ে যদি সুযোগ পাই তবে তোকে নিজ হাতে ঠিক সেভাবে মা/রব যেভাবে ঈশানীকে মে/রেছিলি।”
মোহকে টেনেহিঁচড়ে বাহিরে আনা হয়। শৌভিক মোহের হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
“মোহ, হুঁশে আয়। এমন করিস না।”
চুপ করে গেল মোহ। তার গালে এসে এক ফোঁটা অশ্রু। স্বচ্ছ নিজের পকেট হাতড়ে রুমাল পেল না। পাশে দাঁড়ানো শৌভিককে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রুমাল আছে তোমার কাছে?”
শৌভিক গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের চশমা ঠিক করে পকেট থেকে রুমাল বের করে বলল,
“নিজের বউয়ের চোখের পানি মুছে দিতে বোনের স্বামীর রুমাল চেয়ে নিতে হচ্ছে। কী যুগ জামানা এলো!”
স্বচ্ছ দাঁত কিড়মিড় করে রুমাল ছোঁ মেরে নিয়ে মোহের গালে চেপে ধরে বলল,
“তুমি যতটুকু পেরেছ সেটা করেছ। বাকিটা উপরে যিনি আছেন উনি করবেন। উনার প্রতি বিশ্বাস রাখো। শান্ত হও।”
“আমি ওই দৃশ্য ভুলতে পারছি না। ঈশানীর সঙ্গে যেন আমারও দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে।”
মোহের প্রত্যুত্তরে শৌভিক তার মুখের দিকে চেয়ে বলে উঠল,
“এমন পাগলামি করে আর কোনো লাভ হবে না। আর না ঈশানী ফিরে আসবে। তোকে স্বাভাবিক হতে হবে। ইথানের মা তো তুই।”
সময়ের সঙ্গে নিজেকে ধাতস্থ করল মোহ। বাড়ি ফিরতে রওনা দিলো তারা। শৌভিক গেল নিজের কাজে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। আজকে ফারাহকে রান্নাঘরে দেখে মীর সাহেবের চোখজোড়া যেন কপালে উঠে গেল। মেয়েটা কফি ছাড়া সব রান্নাতেই ঢেঁড়স। তাতে মীর সাহেবের কোনোকালে কোনো আপত্তি ছিল না। বাড়িতে রান্নার লোক আছে। তিনি চান বাড়ির বউ নিজের যা মন চায় করুক। ঘোরাফেরা করুক, নিজের কাজ করুক। নিজের অনলাইন মিটিংয়ে অংশ নেওয়ার আগেও ফারাহকে স্বচ্ছের সাথে কথা বলতে দেখেছিলেন মীর সাহেব। সম্ভবত মোহের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছিল ভাইয়ের কাছ থেকে। মিটিং শেষ করে ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি পান করতে এসে হকচকিয়ে গেলেন ফারাহকে রান্নাঘরে দেখে। মেয়েটা চাল ধুয়ে নিচ্ছে। মীর সাহেব তড়িঘড়ি করে ভেতরে ঢুকে বললেন,
“এ কী করছ? বাড়ির রান্নার লোক কই?”
ফারাহ খানিকটা চমকে গিয়ে ইতস্ততবোধ করে বলল,
“বাবা, আমি ছুটি দিয়েছি। আজকে আমি রান্না করতে চাইছিলাম।”
মীর সাহেব প্রথমে বড়ো বড়ো চোখে তাকালেন। তারপর জোরে শব্দ করে হেসে উঠে বললেন,
“আমার বউমার দেখি গিন্নি হওয়ার শখ জেগেছে। তাই তো বলি আজকে তুমি এত আগে অফিস থেকে এলো কেন!”
“আপনার মিটিং শেষ? কফি করে দেব?”
“না। এখন দরকার নেই। তোমার তো অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে এসে এত ঝামেলার দরকার নেই। তাছাড়া এসব করতে গিয়ে হাত কেটে গেলে বা কোথাও পুড়ে গেলে কী হবে বলো তো?”
ফারাহ মুখ ফুলিয়ে বলল,
“ধুর। বাকি মেয়েরা বিয়ে হয়ে গেলে শ্বশুরবাড়িতে রান্নাবান্না করে পাকা গিন্নি হয়ে ওঠে। আর আমার শ্বশুর আমাকে রান্না করতেই বারণ করে। আপনি একদম শ্বশুর ম্যাটেরিয়াল না।”
মীর সাহেব সামান্য হেসে বলে উঠলেন,
“আচ্ছা, তোমার যা মন চায় করো। কী রান্না করা হবে শুনি?”
ফারাহ নিজের ফোনে রান্নার ভিডিও দেখতে দেখতে বলে,
“ওই তেহারি আর আর বিফ কাবাব।”
“আচ্ছা, এবার বুঝলাম। আমার উজবুক ছেলের পছন্দের রান্না করা হচ্ছে।”
ফারাহ লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“উনার আজকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফেরার কথা। কয়েকদিন ধরে তো ব্যস্ত থাকছেন। আজকে একটু ফ্রী আছেন তাই ভাবলাম কিছু করি।”
“তা আমার কি আমার বউমার হাতের রান্না চেখে দেখার সৌভাগ্য হবে?”
ফারাহ ফিক করে হেসে বলে,
“কী যে বলেন আমি আপনাকেই সবার আগে টেস্ট করাব। তাছাড়া আপনার তো তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে।”
মীর সাহেব হালকা কেশে মশকরা করে প্রশ্ন করলেন,
“তা খাবার মুখে দেওয়া যাবে তো?”
ফারাহ তৎক্ষনাৎ মুখ ফুলিয়ে বলে ওঠে,
“বাবা, আমি রান্নাই করব না।”
“আরে বাবা, আমি মজা করলাম। আমার বউমার উপর আমার ফুল কনফিডেন্স আছে।”
ফারাহর মুখে মিষ্টি হাসি আসে। মীর সাহেব খানিকটা উৎসুক হয়ে জানতে চান,
“মোহের কী অবস্থা জানো? শৌভিকের মুখে শুনেছিলাম ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। এখন কেমন আছে মেয়েটা?”
“সেটা জানতেই কল করেছিলাম ভাইয়াকে। ভাইয়া বলল ভাবি এখনো অন্যমনস্ক হয়ে থাকছে। ভালো মতো খাওয়াদাওয়া করছে না।”
আরো টুকটাক কথা বলে চলে গেলেন মীর সাহেব। ফারাহ বেশ প্রস্তুতি নিয়ে লেগে পড়ল নিজের কাজে। প্রথমে ভালো কাটাকুটি করলেও পেঁয়াজ কাটতে বেঁধে গেল বিপত্তি। চোখ মেলতেই কষ্ট হয়ে গেল। চোখ, নাক থেকে পানি বেরিয়ে একাকার হয়ে গেল। হার মানে না সে। কয়েকবার মুখ ধুয়ে পেঁয়াজ কাটা শেষ করল। মাঝখানে চোখ জ্বালার চোটে তার বৃদ্ধ আঙ্গুলও কেটে গেল। বিরক্তিতে কান্না পেয়ে গেছিল ফারাহর। রান্নার কাজটাকে তার নিজের ডিজাইনের কাজের থেকেও জটিল মনে হলো। ঘড়ির সময় দেখে কাজের গতি বাড়ায় সে। গরম তেলে ভুল করে পানি ফেলে তেলগুলো ফুটে উঠলে তা ফারাহর হাতের কব্জিতে পড়ে পুড়ে লাল হয়ে গেল। চিল্লিয়ে উঠল ফারাহ। মীর সাহেব ভয়ে ছুটে এলেন রান্নাঘরে। ফারাহর হাতের এমন অবস্থা দেখে তৎক্ষনাৎ কড়া কণ্ঠে বললেন,
“এজন্য বারণ করেছিলাম। আর রান্না করতে হবে না। অনেক করেছ তুমি। এখনি বের হবে রান্নাঘর থেকে।”
ফারাহ নাছোড়বান্দা। এতদূর এসে সে হাল ছাড়বে না। কোনোমতে মীর সাহেবকে বুঝিয়ে রান্না শেষ করেই যেন বিজয় হাসিল করে ফেলল সে। চোখেমুখে প্রফুল্লতায় ভরে গেছে তার। মীর সাহেব বেশ কৌতূহল নিয়ে খাবার টেবিলে বসলেন। প্রথমবার বউমার হাতের রান্না খাবেন বলে কথা! ফারাহ আনন্দের সহিত খাবার পরিবেশন করলে প্রথমে কাবাব খালি মুখে খেতে শুরু করলেন মীর সাহেব। এরপর একবার তেহারি মুখে নিলেন। রান্না কেমন হয়েছে ভেবে ফারাহর দুশ্চিন্তায় মাথা ফেটে যাবার উপক্রম। উতলা হয়ে সে প্রশ্ন করল,
“বাবা, বাবা কেমন হয়েছে কিছু বলুন।”
মীর সাহেব আরো একবার তেহারি মুখে নিয়ে বললেন,
“চমৎকার হয়েছে প্রথমবার হিসেবে। জাস্ট স্পিচলেস। আমার ছেলের বউ যে ট্যালেন্টেড সেটা তো আমি জানতামই।”
ফারাহ কিছুটা সন্দেহী দৃষ্টিতে চাইল। বলল,
“সত্যি বলছেন নাকি ঢপ দিচ্ছেন?”
“তিন সত্যি বলছি। তবে তেহারি একটু ঝরঝরে হলে ভালো হয় আর আমার কাছে কাবাবে একটু ঝাল বেশি লেগেছে। বেশি না একটু! তবে শৌভিক ঝালই খেতে পছন্দ করে। অনেক চমৎকার রান্না করেছ, মা।”
খুশি ধরেনা যেন ফারাহর। এখন শুধু অপেক্ষা শৌভিকের বাড়ি ফেরার। হয়ত লোকটা আর বিশ থেকে ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে।
নিজের ঘরে খাবার নিয়ে প্রবেশ করল স্বচ্ছ। মোহ বলেছিল তার খিদে নেই তাই রাতে খাবে না। কিন্তু স্বচ্ছের মন মানেনি। তাই সামান্য খাবার এনেছে। বিছানার দিকে স্বচ্ছের চোখ যেতেই সে দেখল মোহ আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটা যে ভালো নেই সেটা তার আচরণেই উপলব্ধি করে স্বচ্ছ। নয়ত মোহ এত দ্রুত ইথানকে না ঘুম পাড়িয়ে নিজে ঘুমায় না। ইথানও চুপি চুপি ঘরে ঢুকল। মোহকে ঘুমাতে দেখে স্বচ্ছের পানে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল সে। স্বচ্ছ নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ইথানকে চুপ থাকতে বলল। ইথান বাধ্য ছেলের মতো চুপটি করে মায়ের কাছে গিয়ে বসে। স্বচ্ছও খাবার রেখে মোহের অন্যপাশে বসে মোহের মুখের সামনের দুয়েকটা ছোটো চুল সরিয়ে দেয় আলতো করে। ইথানের কাছে ব্যাপারটা বেশ মজা লাগে। সেও মোহের মুখের একটি চুল সরিয়ে দেয়। স্বচ্ছ তার কাণ্ডে মুচকি হেসে তার মাথার চুল বুলিয়ে দেয়। অতঃপর অনেকক্ষণ মোহের চুপসানো, নিস্তেজ মুখশ্রীর পানে অপলক তাকিয়ে থাকে। চটপটে ইথান স্বচ্ছের পাশে গিয়ে বসে তার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“মাম্মার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন বাবা?”
স্বচ্ছ ইথানকে জড়িয়ে ধরে নিচু সুরে বলল,
“তোমার বাবা ভাবছে তোমার মাম্মা এত কিউট কেন!”
ইথান আগ্রহ নিয়ে বলে,
“ঠিক বলেছ। আমিও মাম্মার মতোই কিউট হয়েছি।”
স্বচ্ছ চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,
“কেন? আমার মতো হওনি? আমি দেখতে খারাপ?”
ছোট্ট ইথানের মস্তিষ্ক বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। একবার বাবার দিকে আরেকবার মায়ের দিকে তাকিয়ে ঘরের আয়নার দিকে দৌড়ে গেল। চেহারা মেলাতে চাইল। তবুও উত্তর খুঁজে পেল না। সেই সময় হঠাৎ করে আকস্মিকভাবে চিৎকার করে একবারে ঘুম থেকে উঠে বসল মোহ। নিজের মাথার চুল ধরে অস্ফুটস্বরে বলল,
“ঈশানী! ওকে ছেড়ে দাও। ওকে যেতে দাও।”
স্বচ্ছ দিগবিদিক শূন্য হয়ে পড়ল আচানক এমন ঘটনায়। ইথানও চমকে উঠেছে। তাই সে ইথানকে বলল,
“ইথান বাবু, যাও দেখি তোমার দাদুমনি কী করছে দেখে এসো।”
ইথান একবার মোহের ভয়ার্ত চোখমুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কিন্তু মাম্মার কী হলো?”
“সব বলব। মাম্মা দুঃস্বপ্ন দেখেছে। আমি শান্ত করছি। তুমি দাদুমনিকে দেখে এসো।”
ইথান মাথা চুলকে চলে গেল। মোহ তখনও মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে মাথায় হাত রেখে কিছু বিড়বিড় করছে। হয়ত এখনো তার ঘুমের রেশ কাটেনি। স্বচ্ছ মোহের কাঁধে হাত দিয়ে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
“মোহ! কী হয়েছে?”
মোহ ভয়ে চমকে ওঠে। চোখ মেলে স্বচ্ছকে দেখতেই কাঁপা স্বরে বলে,
“ঈশানীকে আমার চোখের সামনে মেরে দিলো। আমি একদম ওর সামনে ছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো সে। ভেবেছিলাম আমি সাহায্য করব। কিন্তু আমি কিছু করতে পারিনি।”
মোহের শরীর দরদর করে ঘামতে থাকে। কপালের ঘাম মুছে দিয়ে স্বচ্ছ মোহের গালে হাত রেখে বলল,
“অনেককিছু করেছ তুমি মোহ। কিন্তু ভাগ্য বলে একটা ব্যাপার থাকে। তুমি সেই ভাগ্যের উপর হাত ঘোরাতে পারবে না। দেখো আরিদ্র তো শাস্তি পেয়েছে।”
“কিন্তু আমার চোখের সামনে ও শেষ হয়ে গেল। ও মরে গেল।”
সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরে যায় মোহের। দুর্বিষহ স্মৃতি তার মস্তিষ্ককে আঁকড়ে ধরেছে। সেদিনের সেই ঘটনায় সে আঁটকে গেছে পুনরায় যেখান থেকে সে বেরিয়ে এসেছিল। স্বচ্ছ কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে মোহকে কাছে নিয়ে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে নিজের সঙ্গে ধরে রাখল। মোহ স্বচ্ছের বুকে মাথা দিয়েও কিছু একটা বলতেই থাকল। স্বচ্ছ তার মুখে হাত রেখে সামান্য ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ! একদম চুপ করো। কিছু হয়নি। তোমার কাছে সব আছে। আমি আছি। আমাদের ইথান আছে। পরিবার আছে।”
মোহ কয়েকটা বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে নিস্তব্ধ রইল। মোহের সাথে এমন ঘটনা ঘটেছে যার কারণে তার মানসিক বিপর্যয় ঘটতে সময় লাগবে না। আগের মতোই কোনোকিছু করে তাকে স্বাভাবিক করার চিন্তাভাবনা করল স্বচ্ছ। কিন্তু কী করবে ভেবে পেল না। নিজের চোখের সামনে এত নৃশংস খু/ন দেখেছে সে। তাও নিজের প্রিয় বান্ধবীর। নিজেও মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরেছে। সেদিন নদীতে মৃত্যু নিশ্চিত ছিল তার। সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিল সেদিন। এতসব বিপর্যস্ত স্মৃতি নিয়ে বাঁচা কঠিন। স্বচ্ছ ধীরে ধীরে মোহের মাথা নিজের কোলে রাখল। বুঝতে পারল এই অবস্থায় তাকে খাওয়াতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। মোহের কপালে হাত রাখতেই স্বচ্ছ হালকা জ্বর উপলব্ধি করল। আর কিছু না ভেবে মোহের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল সে অনবরত। মোহ স্বচ্ছের অন্যহাত ধরে ঘুমিয়ে পড়ল আবারও।
ইথান মিসেস জেবার ঘরে উঁকি দিলো বাহিরে থেকে। সে এক গুমোট কান্নার শব্দ পেল ভেতরে। তার কৌতূহলী মনের কৌতূহল দমাতে একটুখানি ঘরে প্রবেশ করে দেখল মিসেস জেবা কাঁদছেন নিঃশব্দে। মুখ ভার হয় ছোটো ইথানের। চুপিসারে এগিয়ে গিয়ে মিসেস জেবাকে চমকে দিয়ে বলে ওঠে,
“কাঁদছ কেন দাদুমনি? কে কী বলেছে তোমায়?”
মিসেস জেবার তড়িৎ নিজের অনুভূতি লুকাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নিজের কাছে রাখা ছবিটা লুকাতে যান। ছবিতে সরোয়ার সাহেব আর উনার নিজের ছবি ছিল। ছবি লুকানোর আগেই ইথান আরেকটা প্রশ্ন করে বসল,
“ছবিতে কে তোমার সাথে এটা?”
মিসেস জেবা কণ্ঠে জোর করে গাম্ভীর্য এনে বললেন,
“তুমি এসময় আমার ঘরে কী করছ?”
“তুমি আগে বলো কাঁদছিলে কেন?”
“আমি কাঁদছিলাম না। তুমি ভুল দেখেছ। না বলে কারোর ঘরে আসা উচিত না।”
ইথান নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রেখেই বলল,
“আমি দেখেছি তুমি কাঁদছিলে। মিথ্যে বললে পাপ হয় জানো? বাবা আমাকে পাঠিয়েছে এখানে। তুমি কী করছ দেখতে। আমাকে বলো কেউ কিছু বলেছে? বললে তাকে বকা দেওয়ার ব্যবস্থা করব।”
মিসেস জেবা কান্নারত কণ্ঠে বলে ফেলেন,
“আমি ভীষণ একা হয়ে পড়েছি।”
ইথান কিছু না বুঝে নিজের মতো করে বলল,
“আমি তো আছি তোমার কাছে। তুমি কি ছবিতে থাকা এই লোকটাকে মিস করছ?”
মিসেস জেবা কোনো উত্তরই দেন না। একমনে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ইথান একটার পর একটা প্রশ্ন করতেই থাকল।
“তুমি একা রাতে ঘুমাও? ভয় করেনা? আমি তো রাতে একা ঘুমাতেই পারিনা।”
মিসেস জেবা দুর্বল স্বরে বলে,
“আমি তো একাই হয়ে গেছি। একজন আমাকে একা করে গেছে। যার সঙ্গে ঘুমাতাম সে চলে গেছে আমায় ছেড়ে।”
ইথান বেশ খানিকটা সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবল আপন মনে। তারপর প্রসারিত হাসি দিয়ে বলে উঠল,
“আমি তোমার সাথে এখন থেকে ঘুমাব। আর ভয় লাগবে না। আমি নানুমনির সাথেও ঘুমিয়েছি। এখন থেকে দাদুমনির সাথে ঘুমাব।”
মিসেস জেবা কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন। কণ্ঠস্বর শক্ত করে বললেন,
“না তার কোনো দরকার নেই। আমি ভয় পাচ্ছি না। তুমি যাও তোমার ঘরে। ঘুমিয়ে পড়ো।”
“উঁহু, আমি তোমাকে একা ভয় পেতে দেব না। আমি এখনি বাবাকে বলে আসছি ঘুমাতে।”
মিসেস জেবা বারংবার মানা করলেও কথা শুনতে রাজি হয়না ইথান। কিছুক্ষণের মধ্যে স্বচ্ছকে জানিয়ে ফের মিসেস জেবার ঘরে হাজির হয়ে সটান হয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে। মিসেস জেবা আর চেয়েও মানা করতে পারে না। মোহের সঙ্গে স্বচ্ছের বিয়ে হওয়ার সময় এই একটা বিষয় নিয়ে কিছুটা আপত্তি ছিল মিসেস জেবার। সেটা হচ্ছে ইথানের এই বাড়িতে আসা। এই আপত্তি তিনি কাউকে জানাননি ছেলের কথা ভেবে। সবসময় ভেবেছেন সমাজকে ইথানের বিষয়ে কী উত্তর দেবেন। সবসময় ইথানকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় থেকেছেন। কিন্তু ইথান জেদ করেই উনার কাছে ঘেঁসেছে। যেন সে জোর করেই মিসেস জেবার মনে জায়গা করে নিয়ে ছাড়বে।
কিছুক্ষণ বসে থেকে নিজেও শুয়ে পড়লেন। তারপর উনার সত্যিই মনে হলো তিনি একা নন। রাতের একাকিত্ববোধ ক্রমশ লোপ পেতে থাকল। মনের গহীনে স্বস্তি উঁকি দিলো। অন্য দিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লেন মিসেস জেবা।
সূর্যদ্বয়ের প্রথম আলো মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল ফারাহর। রাতের কথা স্মরণে আসতেই চট করে উঠে বসে পড়ল সে। পাশে তাকিয়েই ঘুমন্ত শৌভিককে খুঁজে পেল। শৌভিক কখন বাড়িতে এলো সেটা মনে করার চেষ্টা করতে থাকল ফারাহ। গতকাল ফারাহ রান্নাবান্না করে এসে নিজের ঘরে শুয়ে ক্লান্তি নিয়ে ফোন ঘেঁটে কিছু ডিজাইন করার চেষ্টা করছিল। পরক্ষণেই সে ঘুমে বিভোর হয়ে যায়। এরপর আর ঘুম ভাঙেনি। তারও কিছু খাওয়া হয়নি। শৌভিক কি তার হাতের রান্না খেয়েছিল? ভাবতে ভাবতে ঘর ছেড়ে সে বাহিরে খাবার টেবিলের কাছে এলো। খাবার টেবিলে সব খাবার সাজানো ছিল। ফারাহ সেসব মনে করে বাড়ির গৃহকর্মীকে ডেকে উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
“কালকে শৌভিক কখন বাড়িতে এসেছেন জানো? টেবিলে রাখা খাবারগুলো খেয়েছেন উনি?”
“না। কাল তো শৌভিক ভাই বেশ রাত করে এলেন বাড়িতে। আপনি ঘুমাইছিলেন তাই ডাকেন নি আপনাকে। খাবার খাইতে বলছিলাম কিন্তু উনার পেট নাকি ভরা ছিল। কোন যেন বিয়ের দাওয়াতে গেছিলেন কইলেন। তাই আর বাড়ির খাবার খান নি। এজন্য আমি ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখছিলাম খাবার।”
ফারাহ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। আশেপাশের সবকিছু বিষাক্ত লাগতে শুরু করে। নিশ্বাস ভারী হতে শুরু করে। গৃহকর্মীকে আদেশ করে বলে,
“কেন ওসব ময়লা ফ্রিজে রেখেছ এখনো? যাও ওসব ডাস্টবিনে ফেলে দাও।”
গৃহকর্মীর চোখমুখ চুপসে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
“খাবারগুলা তো ভালোই আছে এখনো। খাওয়া যাবে তো।”
ফারাহ এবার কঠিন ধমক দিয়ে বলল,
“আমি বললাম তো খাবারগুলো ফেলে দিতে। এখনি ফেলে দাও।”
গৃহকর্মী ভয়ে দ্রুত ফারাহর তৈরি খাবার ফেলেই দিলো। খাবারে মিশে ছিল ফারাহর পাগলামি অনুভূতি। ব্যথিত হলো ফারাহ। মুখ ফিরিয়ে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখের কোণে পানি জমলো। ফারাহর মনের গহীনে যে আঘাত শৌভিক তার অজান্তে করে ফেলল তা শৌভিকের জানা হলো না।
বিছানার চাদর দুমড়েমুচড়ে নিয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে গভীর ঘুম ঘুমাচ্ছে সৌমিত্র। মাথার নিচে বালিশ নেই। গায়ের চাদর নিচে পড়ে আছে। সুখের এই ঘুমের সময় জ্বালাতন করে বসল কারোর ফোন কল। দুই বার নড়েচড়েও যখন রিংটোন বন্ধ হলো না তখন অসহ্য হয়ে আশেপাশে হাতড়াতে থাকল সে। কিন্তু শূন্য ফলাফল পেয়ে পিটপিট করে বিছানার আশেপাশে তাকাল সে। কোথাও তার ফোনের চিহ্ন নেই। তিরিক্ষি মেজাজে উঠে বসতেই আবিষ্কার করল তার নিচে ফোন। ফোনের স্ক্রিনে লেখা মিস গোলাপি পড়তেই হাওয়ায় ভাসতে থাকল সৌমিত্র। দেরি না করে ফোন কানে ধরতেই ওপাশ থেকে বিরক্তভরা আওয়াজ এলো,
“একটা মানুষের ঘুম ভাঙতে এত সময় লাগে?”
“বিশ্বাস করুন, আপনি ফোন করেছেন জানলে জীবনে এত লেট করে ঘুম ভাঙতো না। আপনি ফোন করার এক ঘণ্টা আগে ফোনটা হাতে নিয়ে বসে থাকতাম।”
“আপনাকে ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকতে হবে না। আপাতত বই হাতে নিয়ে বসে থাকলেই হবে।”
সৌমিত্র চোখ কচলাতে কচলাতে হতাশ কণ্ঠে বলল,
“আপনাকে আমার প্রেমিকা কম বিনা বেতনে আমার স্ট্রিক্ট প্রাইভেট টিচার বেশি মনে হয়। কী কপাল আমার! প্রেমিকা আর প্রাইভেট টিচার দুটো একসাথে পেয়েছি।”
তানিয়া ফিক করে হেসে দিলো। সৌমিত্র ফের বলল,
“আপনি কিন্তু ঘোর অবিচার করছেন মিস গোলাপি। একে তো আপনি হাসছেন কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি না। শুধু হাসির শব্দ শোনাচ্ছেন। তার উপর সারাদিন কলের অপেক্ষা করে আমি আপনার কল পাইনা। অথচ সকাল সকাল আপনি কল করে আমাকে ঘুম থেকে ওঠানোর পায়তারা করেন।”
“ঘুম থেকে ওঠালাম কারণ আর এক সপ্তাহ পর আপনার ফাইনাল। একে তো আপনি এতগুলো সময় অপচয় করে শেষ সময়ে এক্সামের প্রিপারেশন নিয়েছেন। এখন যদি জোর দিয়ে না পড়াশোনা করেন ভালো রেজাল্ট করা মুশকিল হয়ে যাবে। আর কয়দিন পর আমার বাবা আর ভাই আসছে দেশে জানেন তো! তারা নিশ্চয় আমাকে বিয়ের কথা বলবে। তখন কী বলব আমি বলুন তো?”
সৌমিত্র একটু ভেবে বলল,
“বলবেন আপনি সৌমিত্র নামক যুবকের জন্য আজীবনের মতো বুক হয়ে গেছেন।”
“আমার বাবা আর ভাইকে রাজি করানোর দায়িত্ব আপনার। রিমাইন্ডার, তারা কোনো বেকার লাফাঙ্গা যুবকের সাথে আমার বিয়ে হতে দেবে না।”
সৌমিত্র বড়ো শ্বাস নিয়ে নির্লিপ্তভাবে বলল,
“আমিও আমার বর্ষণের প্রেমকে এত সহজে হারাতে দেব না। তার জন্য আমাকে যেই সীমানা অতিক্রম করতে হয় আমি করব। ওকে টাটা, আমার মনে জোশ এসে গেছে। আমি পড়তে বসব।”
চলবে…
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪১ [দ্বিতীয় খণ্ড]
ঘুম ভাঙতে ভাঙতে প্রায় আটটা বেজে গেল শৌভিকের। তাও ফোনের কলের আওয়াজে ঘুমের ইতি ঘটে তার। উঠে বসে নীলয়ের নম্বর দেখে ফোনটা না ধরে কেটে রেখে দিয়ে পাশে তাকিয়ে ফারাহকে খোঁজে সে। তাকে না দেখে কিছুটা আশ্চর্য হয়। ফারাহ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতেই পারেনা। ওর রাত জেগে নিজের কাজ করার অভ্যেস। কাল আসা থেকে দেখছিল সে ঘুমাচ্ছে। আর তাকে বিরক্ত করার কথা ভাবেনি শৌভিক। তার কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে নিজেও ঘুমিয়েছিল। বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে চশমা পরে বাহিরে গেল সে। বসার ঘরে বসে টিভি দেখতে দেখতে তার বাবা সকালের নাস্তা করছিল। তা দেখেই শৌভিক অধৈর্য হয়ে বলল,
“তুমি দিনদিন ছোটো হয়ে যাচ্ছো বাবা। টিভি দেখতে দেখতে কেউ খায়? চলো খাবার টেবিলে।”
মীর সাহেব ধমক দিয়ে বললেন,
“খবরদার আমার বাপ সাজবি না। বাপ সাজার শখ হলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে তার বাপ হয়ে দেখা। আজকে থেকে বাহিরে কাজের জন্য যেতে হবে। অনেক ঝামেলা সামলাতে হবে। সময়ই হবেনা টিভি দেখার। গোপাল ভাঁড়ের ইন্টারেস্টিং এপিসোড চলছে। দেখতে দে। সর সামনে থেকে।”
শৌভিকের জবানই একবারে বন্ধ করে দিলেন তার বাবা। ফারাহর সন্ধান করে তার দুটো লোচন। আনমনে প্রশ্ন করে ফেলে,
“তোমার বউমা সকাল সকাল হাওয়ার মতো কোথায় উড়ে গেল?”
মীর সাহেব টিভি দেখতে দেখতেই ব্যস্ত স্বরে বললেন,
“ও তো অফিসে চলে গেল তাড়াহুড়ো করে দেখলাম।”
“অফিস? এই সময়?”
হতভম্ব হয় শৌভিক। ফারাহ অফিসে যায় হেলেদুলে প্রায় সাড়ে নয়টার দিকে। আজকে এত তাড়াতাড়ি কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে গেল? বিষয়টা ভাবায় শৌভিককে। মীর সাহেব ফট করে পিটপিট করে চেয়ে হাসিমুখে শুধালেন,
“কীরে? প্রথমবার বউয়ের হাতের রান্না খেয়ে কেমন অনুভব করলি? মেয়েটা রান্নাবান্না না জানলেও কিন্তু প্রথমবার হিসেবে একশতে একশ দিয়েছে রান্নায়। আসলে মেয়েরা যাই করুক রান্নাবান্না ওদের হিডেন পাওয়ারের মতো।”
আরো একদফা চমকায় শৌভিক। যেন আকাশ থেকে পড়ে। থেমে থেমে বলে,
“ফারাহর হাতের রান্না? ও নিজে রান্না করেছিল?”
এবার মীর সাহেবও চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
“কেন? তুই রাতের খাবার খাসনি?”
“না। কাল তো আমাদের পার্টির ওই সবুজ নামের ছেলেটা আছে না? ওর বিয়ের বউভাত ছিল। নীলয় আর বাকি সবাই মিলে জেদ করল খেতে যাবে। তাই আমিও গেছিলাম। ওখান থেকে খেয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ফারাহকে তো মেসেজ করেছিলাম যাতে ও খাওয়াদাওয়া করে নেয়। আমাকে বাহিরে খেতে হবে। কল করতে পারিনি হইচই এর মাঝে। ও নিজ হাতে রান্না করেছিল?”
মীর সাহেবের জ্বলে উঠলেন। রাগে কটমট করে উঠে দাঁড়ালেন খাওয়া ছেড়ে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“বেয়াদব, হতচ্ছাড়া, অকর্মণ্য! মেয়েটা কাল হাত পুড়িয়ে, হাত কেটে এত কষ্টে রান্না করল তোর পছন্দের খাবার। আর তুই কিনা বাইরে থেকে খেয়ে এলি! তোর সাহস কেমনে হয়?”
রেগেমেগে নিজের হাতের কাঁটা চামচ ছেলের দিকে ছুঁড়ে দিলেন মীর সাহেব। সৌভাগ্যবশত শৌভিক তা ধরে ফেলল। মীর সাহেব দমে না গিয়ে ডালের বাটিতে থাকা বড়ো হাতা তুলে ছেলের দিকে তেড়ে গেলেন।
“তোর আজকে খবর আছে। উজবুক কোথাকার!”
শৌভিক লাফিয়ে সোফার অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মীর সাহেব সেদিকেই ছুটে যান। ঘাবড়ে গিয়ে মীর সাহেবের হাত ধরে নেয় শৌভিক। হাঁপিয়ে উঠে বলে,
“বাবা, আমি যদি এটা জানতাম আমি সত্যিই খেয়ে আসতাম না। ও আমাকে এটা জানায় নি একবারও। হয়ত আমার মেসেজও ভুলে দেখেনি।”
মীর সাহেব ফের তেতে উঠলে বললেন,
“ওহ, এখন সব দোষ আমার বউমার ঘাড়ে দিবি তুই?”
“না, না। দোষ আমার আমি মানছি। ভুল হয়ে গেছে আমার। আচ্ছা, খাবারগুলো কোথায় ফ্রিজে?”
শৌভিক কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে আসে। ফ্রিজ খুলে তন্নতন্ন করে খাবার খোঁজে। রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত গৃহকর্মী মেয়েটাকে প্রশ্ন করে,
“কাল রাতের খাবার কোথায়? ফারাহ কোনগুলো বানিয়েছিল?”
মেয়েটা মিনমিন করে বলল,
“ভাবি তো ওইগুলা ফেলে দিতে কইছে। ফেলে না দিলে অনেক রাগ করতেছিল। তাই ফেলে দিছি।”
থমকে দাঁড়াল শৌভিক। এই মুহূর্তে নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করল ওর। প্রথমবার তার স্ত্রী তার জন্য শখ করে কষ্ট করে রান্না করল কিন্তু সেটা নিজের মুখে দিতে পারল না ভেবেই মর্মাহত হলো সে। তাহলে ফারাহ ঠিক কতটা ব্যথিত হয়েছে? কতটা কষ্ট পেয়েছে নিজে নিজে? হয়ত সেই অনুরাগ থেকেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিসে চলে গেছে। এখন তার হৃদয়ের যাতনা কী করে ভোলাবে শৌভিক?
সকাল দশটা পেরিয়ে গেল। ফারাহ তার অনামিকা আঙ্গুলের আংটির দিকে এক ধ্যানে চেয়ে রয়েছে। আংটিটা শৌভিক নিজ হাতে পরিয়েছিল। দুরুদুরু বুকে চাপা উত্তেজনা, কত আবেগ, শতশত অনুভূতি নিয়ে আগপাছ না ভেবে দুম করে বিয়েটা করে বসল সেই একটা মানুষকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করে। তারপর? অনুভূতিগুলো লুকিয়েই থেকে গেল। প্রকাশের সুযোগটাও পেল না। চেপে থাকতে থাকতে কোথাও বিলুপ্ত হচ্ছে তারা নয়ত কষ্টে পরিণত হচ্ছে। ল্যাপটপের স্ক্রিন অনেকক্ষণ ধরে অন থাকলেও সেই কাজে তার কোনো মনোযোগ নেই। আংটি আঙ্গুলে ঘোরাতে ঘোরাতে মেয়েলি কণ্ঠে সোজা হয়ে বসল ফারাহ। তার পিএ ধীর স্বরে মাথা নুইয়ে বলল,
“কালকে যার আসার কথা ছিল সেই ক্লায়েন্ট এসেছেন। বিদেশি ক্লায়েন্ট মিস্টার স্মিথ। কনফারেন্স রুমে ওয়েট করছেন। আপনার সঙ্গে ডিজাইন বিষয়ে কথা বলতে চান।”
ফারাহ কিছুটা চটেই গেল। কারোর কথা আর বিন্দুমাত্র সহ্য হচ্ছেনা তার। ফোনটা হাতে নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে বলে উঠল,
“ঠিক আছে, যাও। চেহারা গুম করে ফেলো নিজের। ফাস্ট!”
হাওয়ার গতিতে চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেল ফারাহর পিএ। ফারাহ দাঁড়িয়ে একবার ফোনটা চেক করল। শৌভিকের কোনো কল বা মেসেজ না পেয়ে তার মুখশ্রীতে একরাশ নিরাশা ফুটে উঠল। মনে ভাবনা এলো, বিয়ের পর বোধহয় সব পুরুষের বদল হয়। হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ তারা কাঙ্ক্ষিত মানুষের দলিল পেয়ে যায়। তখন মানুষটিকে অবহেলা করলেও বা কী? কিছুই যায় আসে না।
দুপুরে গোসল সেরে এসে বিছানায় বসল মোহ। তার ভারাক্রান্ত মনটা এখনো সেরে উঠতে পারেনি। মস্তিষ্ক তাকে কোনো ঘটনা ভুলতে দেয়নি। সে রান্নাঘরে গেছিল অবশ্য। কিন্তু মিসেস জেবা নিজেই রান্নার সব করতে চাইলেন। এখনি সংসার থেকে অবসর নিতে চাইলেন না তিনি। বাড়িতে বসে বসে তার বেশ একা লাগে। তাই নিজেই ব্যস্ত থাকতে চাইলেন। আর ইথান এখনো স্কুলে। স্বচ্ছ তাকে আনতে গেছে। মোহ একা একা বসে আছে। চুপচাপ বসে থাকা তাকে আরো অন্ধকারে ভরা সেই স্মৃতিতে ঠেলে দিচ্ছে। আচানক ধুপধাপ পায়ের শব্দে নিজেকে সামলায় মোহ। ইথান দৌড়ে ঘরে ঢুকে এসে মোহকে জড়িয়ে ধরে। মোহ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। না চাইতেও মৃদু হেসে বলে,
“ওয়েলকাম, ব্যাক।”
ইথান তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ রেখে নিচে যেতে চায়। মোহ তাকে আঁটকে শুধায়,
“কোথায় যাওয়া হচ্ছে স্কুল ড্রেস না চেঞ্জ করেই?”
ইথান বায়না ধরে বলে,
“সৌমিত্র চাচ্চুর সাথে লুকোচুরি খেলব। যাই মাম্মা প্লিজ!”
মোহ জানে সে বারণ করলেও ইথান শুনবে না। তাই কিছুই বলল না। ইথান উচ্ছ্বসিত হয়ে বাইরে চলে গেল। তার ভালোই হয়েছে এ বাড়িতে বাড়তি মানুষজন পেয়ে। যখন যার কাছে ইচ্ছে তার কাছে গিয়ে থাকছে, খেলছে। এসব ভাবতে গিয়ে মোহ অনুভূত করল তার চুল কেউ মুছে দিচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে স্বচ্ছকে দেখতেই স্বচ্ছ সামান্য ধমকে বলল,
“চুলের আগা দিয়ে পানি পড়ে বিছানা ভিজে যাচ্ছে। এত অসাবধান কেন হচ্ছো তুমি মোহ?”
মোহ ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“খেয়াল ছিল না।”
মোহের এত অন্যমনস্ক মনোভাব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বচ্ছ। মোহের সামনাসামনি বসে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করে,
“কী সমস্যা হচ্ছে তোমার? আমাকে খুলে বলো। আমার পাগল পাগল লাগছে এবার।”
মোহ মাথা নিচু করে থেকে বলে,
“কিছু ভালো লাগছে না। ঈশানীর মৃত্যুর আগের ফ্যাকাসে নির্জীব মুখ, বাঁচতে চাওয়ার আকুতি মনে পড়ছে। ওকে মে/রে যেন নিজে বেঁচে আছি আমি।”
“ওকে মে/রে নয় ওকে বাঁচিয়ে বেঁচে আছো তুমি। তুমি যা ভাবছ তোমার ভুল ধারণা। ঈশানীর অংশ ইথান৷ তাকে তুমি বাঁচিয়েছ, আগলে রেখেছ। তাকে আগলে রাখা মানে ঈশানীকে আগলে রাখা। রাইট? ঈশানীও শেষ মুহূর্ত অবধি সেটাই চেয়েছিল যে তুমি ইথানের মা হয়ে থাকো। নিজে বাঁচার মতো বাঁচো।”
মোহ ফুঁপিয়ে উঠে কোনো কথা না বলে নিজের মাথা স্বচ্ছের বুকে লাগিয়ে দিলো। স্বচ্ছ মোহের মাথায় হাত রাখল। একটু একটু করে মাথায় হাত নাড়াতে থাকল সে। অন্তরে অন্তরে দিশাহারা হয়ে খুঁজতে থাকল প্রিয়তমাকে আগের ন্যায় করে তোলার কোনো উপায়।
অফিসে এখন লাঞ্চ ব্রেক চলে। সকালে খুব একটা বেশি না খাওয়ায় মাথা কাজ করছিল না ফারাহর। ভাবল সামনের ভালো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়ার কথা। যেই মানুষ তাকে দাম দেয়না তার জন্য সে কেন না খেয়ে থাকবে? কোনো মানেই হয়না। নিজেকে অনেক বুঝিয়ে অফিস বিল্ডিং এর ভেতর থেকে বের হলো ফারাহ। কড়া রোদে চোখমুখ খিঁচে এলো। অথচ একটু আগেও আকাশ মেঘলা ছিল। আকাশেরও মতিগতি বোঝা দায়। সানগ্লাস বের করে পরতে নিতেই সামনে শৌভিককে দেখে পাথরের ন্যায় স্তম্ভিত হলো ফারাহ। মুহূর্তের লোচন দুটিতে যেন ভেসে উঠল শৌভিকের করা কর্মকাণ্ড। ফারাহ মুখ ঘুরিয়ে সানগ্লাস চোখে লাগিয়ে নিয়ে রাস্তার অন্যপাশ দিয়ে যেতে উদ্যত হলো। শৌভিক রাস্তা পার হলো উদ্ভ্রান্তের মতো। ফট করে ফারাহর হাত ধরে ফেলল সে। ফারাহ কোনো কথা মুখে না এনে হাত মুচড়ে ছাড়াতে চাইল। শৌভিক তার দুটো হাত ধরে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনুতাপ নিয়ে বলল,
“আমি স্যরি, ফারাহ জান। শুধু কি আমার দোষটা দেখবে বলো? তুমিও তো আমার মেসেজ পড়ো নি। আমি তো মেসেজ দিয়েছিলাম।”
ফারাহর রাগের আগুনে ঘি ঢেলে ফেলল শৌভিক। চোখমুখ শক্ত করে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, আমারই তো দোষ। আপনার কেয়ার করা আমার দোষ, আপনার প্রতি আমার ইমোশন প্রকাশ করা আমার ভুল। আমার হাত ছাড়ুন নয়ত খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। লাঞ্চ টাইম বেশিক্ষণ নয়। আমি লাঞ্চ করতে যাব।”
“এর থেকে বেশি আর কী খারাপ হবে? আমাদের সম্পর্কে দূরত্ব চলে আসছে। এটাই তো সবচেয়ে খারাপ। এটা হতে দিও না ফারাহ প্লিজ!”
“হাত ছাড়ুন আমার।”
শৌভিক হালকা আলগা করে হাত ধরে থাকায় নিজের হাত এক টানে ছাড়িয়ে নিলো ফারাহ। শৌভিকের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে আবারও তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শৌভিক। অন্যপাশ গেলে ফের তার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। কয়েকবার এমন হওয়ার পর কটমট করে চাইল ফারাহ। শৌভিক কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে তার হাত এবার শক্ত করে নিজের মুঠোয় নিয়ে জোর করেই নিজের গাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। ফারাহ শুধু পেছন দিকে টান দিতে থাকে নিজেকে। নাছোড়বান্দা শৌভিক চোখ বড়ো বড়ো করে বলে ওঠে,
“দেখো, ভরা রাস্তায় কোলে নিলে কিন্তু তোমারই লজ্জা লাগবে। আমার কিন্তু বিন্দুমাত্র কিছু যাবেও না আসবেও না।”
ফারাহ নিজের হাত মোচড় দিতে দিতে চোখ রাঙিয়ে ফুঁসে বলল,
“খবরদার ফাইজলামি করবেন না আমার সঙ্গে।”
“পরনারীর সঙ্গে ফাইজলামি করলে খুশি হবা?”
ফারাহর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। গাড়ির কাছে তাকে টেনে নিয়ে আসতেই দুজন যুবক সবটা পর্যবেক্ষণ করে ফারাহর কাছে এসে উত্তেজিত হয়ে জানতে চায়,
“আপা, আপনাকে কি এই লোকটা বিরক্ত করছে নাকি? রাস্তার মধ্যে টানাহেঁচড়া করতেছে লোকটা দেখলাম। কোনো সমস্যা?”
ফারাহ রেগেমেগে বলে ফেলল,
“অনেক বড়ো সমস্যা। আমি এই লোকের সাথে কোথাও যাব না। তবুও আমাকে জোর করে নিয়ে যেতে চাইছে।”
বিষম খেলো শৌভিক। আঁড়চোখে যুবক দুটোর দিকে চেয়ে দেখল তাদের চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। একজন তেড়ে এসে বলল,
“এই বেডা, দিনের বেলায় মেয়ে মানুষের হাত ধরে টানাটানি করিস? সাহস দেখি কম না।”
শৌভিক থতমত খেয়ে একবার ফারাহর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরে ভাই, আমি আমার বউয়ের হাত ধরে টানাটানি করব না তো আপনার বউয়ের হাত ধরে টানাটানি করব নাকি?”
আরেকজন যুবক ক্ষেপে উঠে বলল,
“তোদের মতো লাফাঙ্গা পোলাপানরা যারে দেখে তারেই নিজের বউ ভাবা শুরু করে। দেখে তো ভালো ঘরেরই মনে হয়। চেনা চেনাও লাগতেছে। কোথাও দেখছি মনে হয় তোরে।”
“আরে, এটা তো মন্ত্রী মীরের পোলা। সেদিন সেমিনারে দেখলাম। ভদ্রলোকের আড়ালে এই অবস্থা? দাঁড়া, লোকজন জড়ো করি।”
ফারাহর হুঁশ এলো এবার। ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি ব্যাপারটা এত বাজে হয়ে যাবে। শুধু শৌভিককে শায়েস্তা করার উপায় খুঁজছিল সে। ফারাহ হকচকিয়ে উঠে বলল,
“আরে ওয়েট, কী বলেন এগুলা? এই লোক আমার হাজবেন্ড। সামান্য ব্যাপার এতদূর নিয়ে যান কেন?”
প্রথম যুবক এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
“কী আজব! একটু আগে না বললেন এই লোক আপনাকে বিরক্ত করতেছে?”
ফারাহ তেজ নিয়ে প্রত্যুত্তর করল,
“কী আশ্চর্য! হাজবেন্ড কি বিরক্ত করতে পারে না নাকি? উনাকে কিছু বলার চেষ্টা করলে কিন্তু আপনাদের খবর আছে।”
দুটো যুবক এবার ব্যাপারটায় অতিষ্ঠ হয়ে চোখাচোখি করে বিড়বিড় করতে করতে চলে যাবে। শৌভিকের চাপা হাসিতে চোখ বড়ো বড়ো করে চাইল ফারাহ। হাত দিয়ে শৌভিকের বুকে চাপড় মে/রে বলে উঠল,
“সব আপনার জন্য হয়েছে। অসহ্যকর লোক আপনি।”
“ওকে, ওকে। সব মেনে নিলাম। এখন সময় যাওয়ার আগে প্লিজ গাড়িতে বসুন। আমারও খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে কিছু খেতে পারিনি। গলা দিয়ে নামেনি। কোথাও থেকে খেয়ে আসি লাঞ্চ টাইম শেষ হবার আগে?”
ফারাহ কিছুক্ষণ ভেবে গম্ভীর মুখে নিজে নিজে গাড়িতে উঠে বসল। মুচকি হাসল শৌভিক।
তারা রেস্টুরেন্টে এলো। খাবার অর্ডার করার পর খাবার এলে নিজের কাটা আর পোড়া হাত খাওয়ার জন্য সামনে নিলে তা খেয়ালে আসে শৌভিকের। হাতটা নিজের সামনে ধরে ভালো করে দেখল শৌভিক। ক্ষত অনেকটা গভীর। এবার আরো ভালো মতো অনুভব করতে পারল মেয়েটার কষ্টটা ঠিক কোথায়! যে কখনো রান্নার কাজে হাত দেয়নি সে যখন নিজের সবটা দিয়ে শুধু তার প্রিয় মানুষের জন্য রান্না করল তখন সেই মানুষটা খাবার মুখে দিলো না। ফারাহ মুখ ভার করে নিজের হাত সরিয়ে নিতে চাইলে হাতটা নিজের হাতে নিয়ে পোড়া আর ক্ষত জায়গায় গভীর চুম্বন আঁকে শৌভিক। অনুতপ্ত হয়ে বলে,
“আই এম স্যরি। আমি তোমার অনুভূতিতে অনুভব করতে ব্যর্থ হয়েছি। তোমার অনুভূতিকে আঘাত করেছি। আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করতে পারবে?”
ফারাহ শৌভিকের চোখের দিকে বেশ খানিকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল। তারপর বড়ো শ্বাস নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ পারি। শুধু এরপর এমন আঘাত কখনো করবেন না প্লিজ। আমি ভেঙে যাই। বারবার নিজেকে জোড়া লাগাতে পারব না।”
“আমি তোমায় কখনো ভাঙতে চাইনা। তোমাকে সাজাতে চাই নিজের ভেতরের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে।”
ফারাহ উত্তর করল না। শৌভিক নিজ হাতে খাবার তুলে খাওয়ালো তার হৃদয়ের রানিকে। এই মেয়েটাকে সে আর সামান্যতম কষ্ট দিতে চায় না।
দুদিন কেটে যাওয়ার পরেও মোহের মনের গভীর চলতে থাকা ব্যাপারগুলো কিছুতেই সরানো গেল না। সে নিজেকে সবার সামনে স্বাভাবিক দাবি করল। কিন্তু তার হাসিতে সবসময় এক জড়তার খোঁজ পেল স্বচ্ছ। তার ঘোলাটে চোখে ধরা পড়ল মোহের ভেতরের অসুস্থ চিন্তাভাবনা। অবশেষে স্বচ্ছ একটা ফন্দি আঁটে। রাতেই সে মোহকে বলে রেখেছে সকাল থেকে ব্যাগ গোছাতে। স্বচ্ছ মোহ আর ইথানের সাথে কোথাও একটা যেতে চায় কয়েকদিনের জন্য। কিন্তু কোথায় সেটা মোহের জানা নেই। দুপুরের খাবার খাওয়াদাওয়া সেরে বের হওয়ার জন্য তৈরি হতে লাগল তারা। ইথানকে সুন্দর কালো রঙের শার্ট পরিয়ে দিলে তার সঙ্গে ম্যাচিং করে নিজেও কালো শার্ট পরল স্বচ্ছ। ইথান অনেক আনন্দ নিয়ে বলল,
“বাবা আর আমি ম্যাচিং ম্যাচিং।”
স্বচ্ছ ইথানের গালে হাত দিয়ে আদুরে গলায় বলল,
“ইথানের বাবা আমি সেটা সবাইকে বুঝতে হবে না? বাবা ছেলেকে একরকম হ্যান্ডসাম লাগতে হবে তো।”
ইথান প্রখর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
“তুমি তো আমার মতোই হ্যান্ডসাম।”
“জানি তো বাবু। নিচে গিয়ে সৌমিত্র কাকুকে টাটা দিয়ে আসো তো যাও। তাড়াতাড়ি যাও।”
কথামতো ইথান আগ্রহ নিয়ে সৌমিত্রের ঘরের দিকে চলে গেল। অতঃপর ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল স্বচ্ছ। মোহ সাদা লং জামার সাথে একটা অদ্ভুত রকমের কানের দুল পরছে। ভালো করে খেয়াল করে দেখল দুলের ভেতরে কদমের ছোটো পাপড়ি দিয়ে রেজিন দিয়ে আটকানো। চুড়িও কিছুটা এমন ধরনেরই। ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,
“এসব তো ফুলের… ”
“আপনার দেওয়া কদম ফুলের বানানো এসব। আমি চাইনি আমাদের বিয়ের প্রথম রাতে আপনার দেওয়া ফুলগুলো নষ্ট হোক। অনলাইনে একটা পেজ দেখেছিলাম ফুল দিয়ে এত সুন্দর জুয়েলারি বানিয়ে দেয়। তাই এসব বানিয়ে নিয়েছি। সুন্দর না?”
“জি। আপনার পরিধান কৃত হতে পেরেছে জন্য বোধহয় বেশিই সুন্দর লাগছে।”
মোহ মৃদু হাসে। স্বচ্ছ গভীর চিন্তায় পড়ল যেন। অনেকক্ষণ ভাবতে গিয়ে মোহ তা লক্ষ্য করে বলল,
“কী ভাবছেন?”
“ভাবছি এসব সংরক্ষিত ফুল দিয়ে যদি জুয়েলারি বানানো যায় তবে নির্যাস থেকে সুগন্ধিও তো বানানো যেতে পারে। অনেকেই তার প্রিয় মানুষের দেওয়া ফুল অনেকভাবে সংরক্ষণ করতে চায়।”
মোহ স্বচ্ছের দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে বলল,
“হঠাৎ এই ভাবনা?”
“আমার ফ্রেন্ডের জন্য ভাবছিলাম। সে নতুন বিজনেস শুরু করতে চাইছিল। ইউনিক আইডিয়া চাইছিল আমার থেকে। একা পারবে না তাই আমাকেও পার্টনার বানাতে চাইছিল। অল্পের মধ্যে কিছু শুরু করতে চাইছিল। খুঁজে পাচ্ছিলাম না কী করা যায়। তোমার জন্য এটা মাথায় এলো। থ্যাংক ইউ মাই ডিয়ার লাভ।”
কোনোকিছু না ভেবেই মোহের মাথা চেপে ধরে তার গালে চুমু খেয়ে বসে স্বচ্ছ৷ মোহ তার কাঁধে দুহাত রেখে তার চোখে চোখ রেখে বলে,
“ইউ নো হোয়াট? ইউ আর আ ব্রিলিয়ান্ট!”
“তোমার প্রশংসা পেতে আমার আরো ব্রিলিয়ান্ট হয়ে যেতে ইচ্ছে করে মোহময়ী।”
মোহ এখন একটা সেফটিপিন উঠিয়ে স্বচ্ছের হাতে দিয়ে বলে,
“এখন সেফটিপিন দিয়ে ওড়না আঁটকে দিয়ে আমায় উদ্ধার করুন।”
স্বচ্ছ হাতে সেফটিপিন নিয়ে মোহের পেছনে দাঁড়িয়ে তার চুল সরিয়ে দিয়ে ওড়না নিয়ে এসে আটকানোর চেষ্টা করল। কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ায় বিরক্তবোধ করল মোহ।
“কী সমস্যা? হচ্ছে না কেন?”
স্বচ্ছ বেশ সময় নিয়ে মনঃসংযোগ দিয়ে একাগ্রতা নিয়ে বলল,
“কিছু একটার কমতি আছে এখানে।”
মোহ অধৈর্য হয়ে জানতে চাইল,
“মানে?”
তার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে আকস্মিক মোহের কাঁধের কাছে নিজের ওষ্ঠদ্বয় মেলায় স্বচ্ছ। পরক্ষণেই মোহকে পেছন থেকে জড়িয়ে কাঁধে থুঁতনি ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে থেকে বলে,
“ইউ ফরগট দিস।”
“আমাদের যেতে দেরি হচ্ছে না?”
“স্বামী-স্ত্রীর প্রেম ভালোবাসার জন্য কোথাও যেতে দেরি হলে সেই দেরি জায়েজ আছে। দেরি শব্দটাই এজন্য আবিষ্কার হয়েছে জানো?”
ফিক করে হেসে দিলো মোহ। এতসব আজগুবি কথা স্বচ্ছ কী করে বলে কে জানে? স্বচ্ছ আয়নায় মোহের হাসিতে পরিপূর্ণ মুখের দিকে চেয়ে নরম সুরে বলে,
“এভাবেই হাসিখুশি থাকবে প্লিজ? তোমার হাসি আমাকে উৎসাহ জাগায়। আমার মনের রোগের সব প্রতিকার তোমার খুশিতে আঁটকে গেছে।”
মোহের হাসি গাঢ় হয়। নিজেকে ছাড়িয়ে স্বচ্ছের নাক টিপে ধরে বলে,
“আপনার আক্রান্ত মনটাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া উচিত।”
“হসপিটালের নাম মোহ?”
মোহ বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে স্বচ্ছকে আলতো ধাক্কা দিয়ে চুল আঁচড়াতে আরম্ভ করে আর শুধায়,
“কোথায় যাচ্ছি আমরা বললেন না তো?”
স্বচ্ছও নিজের চুল ঠিকঠাক করে বলল,
“তা তো বলব না। গেলে তবেই জানবে।”
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ইথান সবার আগে দৌড়ে মিসেস জেবার কাছে গেল। ইথান উনাকে জড়িয়ে ধরলে কিছুটা চমকালেন তিনি। বাচ্চা ছেলেটা কেন বারবার তার কাছে আসে ভেবেই পান না। এড়িয়ে যেতে চেয়েও ব্যর্থ হোন। তিনি বসে থেকে ইথানের মাথার চুল নেড়ে দেন। ইথান মুখ ফুলিয়ে বলে,
“স্যরি, আমি কয়েকদিন তোমার সাথে ঘুমাতে পারব না। তুমি কষ্ট করে কয়েকদিন একা থাকো। আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব। ঠিক আছে?”
মিসেস জেবার এবার আশ্চর্য হলেন। কেমন বড়োদের মতো কথা বলছে পিচ্চি ছেলে! যেন ইথানই উনার অভিভাবক। ইথান এবার মিসেস জেবার গালে চুমু দিয়ে খিলখিল করে হেসে বলল,
“টাটা!”
কিছু বলার মতো ভেবে পেলেন না মিসেস জেবা। স্বচ্ছ, মোহ আর ইথানকে বিদায় জানালেন তিনি।
অবশেষে মোহের গ্রামের বাড়ির দরজায় এসে থামে স্বচ্ছরা। মোহ অবাকই হয়েছে বটে। ভাবেনি স্বচ্ছ তাকে তার দাদির কাছে নিয়ে আসবে। গ্রামের পথ দিয়ে আসার সময় অনেকে তাদের দিকে আঁড়চোখে তাকিয়েছে। কেউ কেউ তাদের পেছনে কানাকানি করেছে। এসবের কারণ মোহ এবার তার স্বামীর সঙ্গে গ্রামে পা রেখেছে। এতদিন শুধু তার সঙ্গে ইথানকে দেখেছে সবাই। আজ অনেকেই বিস্মিত সবই দেখেছে মোহ। তবে সে আগের থেকেই এসব বিষয়ে আপোষহীন। দরজার কাছে এসে মোহ বলল,
“আগে বললেই পারতেন এখানে আসব আমরা।”
স্বচ্ছ স্মিত হেসে জবাব দিলো,
“তাহলে তোমার চোখে যে বিস্ময় সেটা দেখা হতো না। হানিমুনে যাওয়ার বাজেট নেই এখন। তাই ভাবলাম এখানেই আসি। তাছাড়া গতকাল দাদিমা কল করে সে কী গালাগালি! আমি নিজেও বিয়ের পর উনার কাছে আসছি না তোমাকেও নাকি আসতে দিচ্ছি না বলে কতশত অভিযোগ করলেন। তাই উনাকে বলেছি আজ আসব আমরা উনার কাছে।”
দরজা ধাক্কিয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিতেই যতটুকু সময় লাগল স্বচ্ছদের। কিন্তু দরজা খুলতে সময় লাগল না। রাবেয়া বেগমের চোখজোড়া চকচক করে উঠল। খুশিতে চিৎকার দিয়ে মোহকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“আরে আমার মোহ সুন্দরী আর সুন্দরীর সুন্দর জামাই আইছে রে।”
ইথান লাফিয়ে উঠে রাবেয়া বেগমের হাত ধরে বলল,
“আমিও আসছি। আমাকে দেখো।”
রাবেয়া বেগম হেসে নিজের হাত চুমু দিয়ে তা ইথানের কপালে ঠেকিয়ে বলে,
“তোমার কথা আর আলাদা কইরা কী কমু বাজান! তুমি তো আমাগো সবার চোখের মনি।”
এরপর তিনি স্বচ্ছের পানে সরু দৃষ্টি রেখে বললেন,
“তা কামের কাম কইরা ফেলাইছ? আমার সুন্দরীরে নিয়া নিছো নিজের কইরা?”
স্বচ্ছ একগাল হেসে রাবেয়া বেগমের দিকে উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে বলে উঠল,
“আপনিই তো আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন দাদিমা। আপনি বলেছিলেন যদি ভালোবাসি আপনার সুন্দরীকে তাহলে আপনার বাড়িতে যেন ওকে বিয়ে করে তবেই পা রাখি৷ দেখেন আমি আপনার কথা রেখেছি। এখন বলেন, প্রথমবার তো লাঠির বাড়ি দিয়ে আমাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এবার কী দিয়ে নাতজামাইকে স্বাগত জানাবেন?”
“আসো আগে। ভিতরে আসো। আমার নাতজামাইয়ের জন্য আমি নিজের হাতে সন্দেশ বানাইছি। কোনো কমতি রাখমু না আর।”
স্বচ্ছ হাসে। বাঁকা দৃষ্টিতে মোহের পানে মনোযোগ দেয়। খুঁজে পায় নারীটির মুখে অমূল্য সেই মাধুর্য। সেই জাদুকরী হাসি। যার প্রতিটা ঝংকার স্বচ্ছকে উন্মাদ বানিয়ে দেয়। ব্যস…এতটুকুই তো স্বচ্ছ চাইছিল।
নদীর পাড়ে নানানরকম মানুষের ভিড়। কপোত-কপোতীর ভিড়টা বেশি। কোথাও কোথাও বন্ধুরা আড্ডা দেয়। শহর থেকে সামান্য দূরে এই জায়গাটা বেশিই স্নিগ্ধ। যান্ত্রিক কোলাহল অনেক কম। একারণেই হয়ত তানিয়া বারবার সৌমিত্রকে এখানে ডাকে। আজ অবশ্য সৌমিত্র ডেকেছে তাকে। কতদিন মন-প্রাণ ভরে সেই মনের রানিকে দেখতে পায়না সে। ছটফট করে। কিন্তু মিস গোলাপি তার উল্টো। বেশ নির্দয়। দেখা না করার অযুহাত খুঁজে বেড়ায়। আজ নদীর পাড়ে এসে হঠাৎই নিজের কলেজ জীবনের পুরোনো বন্ধুদের দেখা পেয়েছে সৌমিত্র। আড্ডায় মেতে উঠে গান গাইছে তারা মন খুলে। তাদের মাঝে একজনের কাছে গিটার আছে। গিটারের তালে তালে সবাই একে একে গান বলছে। পালা এসেছে সৌমিত্রের। তানিয়ার কথা মনে অভ্যন্তরে রেখেই গলা ছেড়ে গান গায় সে।
“মিলন হবে কত দিনে
মিলন হবে কত দিনে,
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে…!”
গানের মাঝে তার দৃষ্টি কাঁড়ে পার ঘেঁষে একপা দুইপা করে এগিয়ে আসা তার প্রিয় নারী। গান শুনে সে চোখ বড়ো বড়ো করে হেঁটে এসে দাঁড়িয়েছে খানিকটা দূরে। সৌমিত্র উঠে গিয়ে তার সামনাসামনি এসে হাত দুদিকে ছড়িয়ে উন্মাদের মতো তানিয়াকে ইঙ্গিত করে গাইল,
“ও প্রেম যে করে সেই জানে
ও প্রেম যে করে সেই জানে,
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে।”
তানিয়ার মুখশ্রী লাল বর্ণ ধারণ করল। আশেপাশের কোনো মানুষের দিকে তাকানোর পরিস্থিতিতে রইল না। এমনটা নয় তার খারাপ লেগেছে। তার মধ্যে অদ্ভুত ভালো লাগা বিরাজ করছে। সেটা সে বলে বোঝাতে পারবে না। চাপা অনুভূতি যা দম ফেটে বেরিয়ে যেতে চাইছে। তার কলেজের বন্ধুরা তো হাততালি দিয়ে বসল। তানিয়া নিজের মুখ চেপে ধরে ভেতরের লাজুক হাসি লুকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আপনি পাগল।”
“আসলেই পাগল। এতটা পাগল হয়ে যাব কখনো ভাবিনি। আমাকে ভালো করে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন তো!”
“কী করে?”
“আপনি আমার হয়ে।”
তানিয়া লজ্জায়, সংকোচে প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
“কী কারণে জরুরি তলব সেটা বলুন। আজকাল মা খুব কড়া আচরণ করছে। কয়দিন পর বাবা আর ভাই আসবে সেকারণে নাকি সবসময় আমার বাহিরে বের হওয়া যাবে না।”
সৌমিত্র হতবাক হয়ে বলে উঠল,
“সে কী! আপনি বললেন নি আপনি স্টুডেন্ট পড়াতে আসছেন?”
তানিয়া দ্বিগুণ হতভম্ব হয়ে থেমে থেমে বলল,
“স্টুডেন্ট।”
সৌমিত্র বসে গিয়ে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল,
“জি, স্টুডেন্ট। আপনি তো আমাকে স্টুডেন্টই মানেন। এইযে আমরা এখানে দেখা করছি। এখানে আপনি না হলেও বিশ বার পড়াশোনা করার পরামর্শ দেবেন।”
তানিয়াও সামান্য দূরত্ব রেখে তার পাশে বসে নদীর দিকে মনোযোগ দিয়ে বলল,
“তা তো অবশ্যই। আচ্ছা, পড়াশোনা কি আদেও ঠিক করে করছেন?”
সৌমিত্র নিরাশা ভরা সুরে বলে ওঠে,
“আপনি কি আমায় একটুও বিশ্বাস করেন না? আমি যখন আপনাকে বলেছি তখন এই সৌমিত্র আপনাকে একদিন চমকে দেবে নিজের যোগ্যতা দিয়ে।”
“বিশ্বাস আপনাকে করি বলেই অপেক্ষা করছি আপনার জন্য। আপনাকেই বিশ্বাস করি পৃথিবীতে এত মানুষ থাকা সত্ত্বেও।”
সৌমিত্রের বুকের ভেতর শীতলতা ছেয়ে যায়। মধুর বাক্যগুলো যেন কানে ঝংকারের মতো বাজে। আচানক তাদের কথোপকথনে ঢুকে পড়ে একটা মেয়ে। সৌমিত্রের নাম ধরে ডেকে বলে ওঠে,
“আরে সৌমিত্র না?”
তানিয়ার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়। সৌমিত্র উঠে দাঁড়ায়। একটু সময় নেয় মেয়েটাকে চিনতে। ইতিমধ্যে মেয়েটা নিজের পরিচয় দেয়,
“আরে আমি ইরিন। ভুলে গেলি? কলেজের প্রথম প্রেমকে?”
সৌমিত্রের স্মরণে আসে ইরিনকে। তানিয়ার বুকটাই ধক করে ওঠে। কোথাও গিয়ে তীব্র ব্যথা জাগে প্রথম প্রেম শব্দটা শুনে। অস্বস্তিবোধে নুইয়ে পড়ে। ইরিন আগের থেকে মোটা হয়েছে বলে চিনতে কষ্টই হচ্ছিল সৌমিত্রের। একপলক তানিয়ার দিকে তাকিয়ে ইরিনকে বলে,
“চেহারা পাল্টে গেছে তোর। তাই সময় লাগছিল চিনতে। কেমন আছিস? হঠাৎ এখানে?”
“চেহারা পাল্টাবে না? দুই বাচ্চার মা আমি এখন। আর আমার বাড়ি এদিকেই। প্রতিদিন বিকালে হাঁটতে আসি বাচ্চা নিয়ে।”
সৌমিত্র ছোটো করে উত্তর দেয়,
“ওহ।”
সৌমিত্র নিজেও অস্বস্তিতে পড়েছে। কিন্তু বলতে পারছে না। ইরিন আবার হেসে হেসে বলল,
“তুই কি সেটেল হয়েছিস? বিয়েশাদি করেছিস? নাকি প্রেম করেই জীবন পার করে দিচ্ছিস?”
এবার সৌমিত্রের ইচ্ছে করল মাটির নিচে ঢুকে যেতে। উপায়ন্তর না পেয়ে হালকা কেশে বলল,
“প্ল্যানিং করছি সেটেল হওয়ার।”
“ওহ হো! তাও তোর কথা বিশ্বাস হওয়া কষ্টকর। মনে আছে তোর প্রতি কত পাগল ছিলাম আমি। আর তুই প্রেমের সাতদিনের মাথায় ব্রেকআপ করে ফেলেছিলি। পরে দেখি আরেক মেয়ের সাথে ঘুরছিস। এতটা মেয়েবাজ ছিলি তুই।”
বলেই হো হো করে হেসে দিলো ইরিন। সৌমিত্রের হাসি এলো না। কথা বের হওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। তবুও প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,
” আরে বইন আগের কথা ছাড়। তোর বাচ্চারা কই?”
“ওইতো,খেলছে। তুই আমার প্রতি সিরিয়াস থাকলে ওদের বাপ তুই হতিস। আচ্ছা, এই মেয়ে কে? তোর নিউ টাইমপাস?”
তানিয়াকে দেখিয়ে প্রশ্ন করল ইরিন। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল তানিয়ার। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল যেন সে গরম চুলোয় বসে আছে। মাথায় রক্ত উঠে গেল এবার। সৌমিত্রের দিকে একবার তাকাল সে। তারপর দ্রুত গতিতে হাঁটা ধরল। সৌমিত্র অসহায় বোধ করে বারবার ডাকল,
“মিস গোলাপি, প্লিজ থামুন।”
সেই সময় সৌমিত্রের মনে তীব্র ইচ্ছে জাগল ইরিনের গলা টিপে দিতে। সে ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“তুই একটা হারামি। ওরে আমি অনেক ভালোবাসি রে ভাই। বিশ্বাস কর। এখন যদি তোর জন্য ও আমারে ছেড়ে দেয় তোরে দেখে দিব। বলে দিলাম।”
সে দ্রুত ছুটল তানিয়ার পিছু পিছু। কিন্তু দেরি হয়ে গেল। অনেকটা দূরে গিয়ে তানিয়া একটা সিএনজি ধরে উঠে গেল। সৌমিত্র চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
“মিস গোলাপি, আই লাভ ইউ। রিয়েলি রিয়েলি লাভ ইউ।”
চলবে…
#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪২ [দ্বিতীয় খণ্ড]
ভোরের দিকে বৃষ্টি হওয়ার পর এখনো বিস্তর আকাশ মেঘের আস্তরণে নিজেকে ঢেকে রেখেছে। যেন মনে হচ্ছে এখনো সকালই হয়নি। সন্ধ্যা, সন্ধ্যা ভাব। অথচ এখন প্রায় সাড়ে ছয়টা বাজে। মোহের ঘুম ভেঙেছে। খুব শখ করে সাদা করে কুঁচি ছাড়া শাড়ি পড়েছে। শাড়িটা গতকাল তার দাদিমা উপহার দিয়েছে। সাদা সুতির শাড়িতে লাল পাড়। সাধারণে অপূর্ব! হালকা বাঁকা করে খোঁপা করেছে। পর্যাপ্ত ঘুমে স্নিগ্ধতা এসেছে তার মুখে। এতদিন ঘুমোতে পারত না সে। কখনো স্বচ্ছের বুকে মাথা রেখে কাঁদত।
খোলা উঠান থেকে সামান্য দূরত্বে রাবেয়া বেগমের চুলার ঘর। মোহ সেখানে উঁকি দিয়ে দেখল ইতিমধ্যে তার দাদিমা ঘুম থেকে উঠে চুলা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রান্না করতে বসবেন বলে। মোহকে দেখেই তিনি চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে ছুটে এসে মোহের গাল মুখ নেড়েচেড়ে বলে,
“কত্ত সুন্দর লাগে রে তোরে! নজর লাইগা যাইব আমার নিজেরই। কালো টিকা লাগা জলদি যা।”
মোহ শব্দ করে হেসে দিয়ে বলল,
“তোমার মতো সুন্দর মানুষের নাতনি বলে কথা। সুন্দর না হয়ে যাব কই?”
“তোর জামাইডাও এক্কের সুন্দর। চোখ দুইডার দিকে তাকান যায় না।”
“সেটাই তো কথা! ওই চোখে আমি আঁটকে গেলাম কী করে বলো তো? আরো সুন্দরী কাউকে আটকানো উচিত ছিল না?”
রাবেয়া বেগম ধমক দিয়ে বললেন,
“সুন্দর অসুন্দররে ভালোবাসায় মাপতে চাইয়া নিজের জামাইয়ের ভালোবাসা ছোটো করিস না। মানুষ ভালোবাসে সুখের আশায়। যে যার মধ্যে সুখ খুঁইজা পায়, নিজের দুনিয়া খুঁইজা পায় সে তারে ভালোবাসে।”
মোহ নীরব থাকে। দাদিমাই তো ঠিক। সেও তো নিজের দুনিয়া খুঁজে পেয়েছে। হাফ ছেড়ে সে বলল,
“আচ্ছা, ওরা দুজন এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। আমি একটু আশেপাশে হেঁটে আসি? বৃষ্টির ঠাণ্ডা কাঁদায় কতদিন হাঁটি না।”
“সাবধানে যাইস।”
মোহ খালি পায়ে বেরিয়ে পড়ে বাহিরে। গন্তব্য ধানের ক্ষেত। সেখানে মাঝখানে একটা মাঝারি সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ আছে। অদ্ভুতভাবে মাঝখানে আছে কয়েকটা বেলি ফুলের গাছ। বড়োই সুন্দর লাগে জায়গাটা।
কাঁদা পায়ে মাঠের মাঝে এসে দাঁড়ায় মোহ। বেলি ফুল সহ গাছগুলোর গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা লেগে আছে। মুগ্ধ পানে চেয়ে থাকে মোহ। অনেকটা দূরে গুটি কয়েক কৃষক জমিতে কাজ করছেন। দুই তিনজন ছোটো ছেলে বাঁশি নিয়ে টানাটানি করছে। কয়েকটা পড়ে থাকা ফুল তুলে একটা কানে গুঁজে বাকিগুলো হাতে নিয়ে জমির একেবারে সরু রাস্তা ধরে হাঁটা আরম্ভ করে সে। ঘাসে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু জলের কোণা তার পায়ে লেগে যাচ্ছে। শাড়ির নিচটা খানিকটা ভিজেছে। এক দৃষ্টিতে ধানগাছের দিকে চেয়ে থাকে সে। গ্রামের অপরূপ ছবির মতো দৃশ্য মোহের মনে শান্তি দেয়। সব যাতনা ভুলিয়ে দেয়। ধানগাছ হালকা হাওয়ায় দুলছে। মোহও হালকা দুলতে শুরু করল বাঁশির আওয়াজে। বাঁকা চোখে তাকিয়ে দেখল একটা ছেলে চোখ বুঁজে সুন্দর করে বাঁশিতে সুর তুলছে। চোখ বন্ধ করে মোহ। প্রকৃতির নির্মল হাওয়া শ্বাস নিয়ে নিজের মাঝে ভরে নেয়। প্রকৃতির শীতল ঘ্রাণের মাঝে হঠাৎই অন্য এক ঘ্রাণ অনুপ্রবেশ করে। মোহ তা উপলব্ধি করে চোখ বুঁজেই হাসে। এই সৌরভ তার বড্ড প্রিয়। চোখ খোলার আগেই ব্যক্তিটি তার মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দেয়। ঘাড় ঘুরিয়ে ডাগরডাগর চোখে তাকায় মোহ। স্বচ্ছকে দেখে মৃদু হাসে। মোহের এমন কোমল, লাস্যময়ী রূপ স্বচ্ছের বুকে জোরদার আঘাত হানে। হৃদকম্পন বাড়তে থাকে যেন ঘোড়া ছুটছে। সরাসরি নিজের বুকের বাম পাশে হাত রেখে মোহের দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে রয় স্বচ্ছ। মোহ শুধায়,
“আপনি কখন ঘুম থেকে উঠলেন আর এখানে এলেন?”
“আপনি যখন বের হচ্ছিলেন তখনি উঠে ছুট লাগিয়েছি আপনার পিছু পিছু। আপনি খেয়াল করেন নি বোধহয়।”
মোহ খেয়াল করে স্বচ্ছের চোখে এখনো ঘুমের রেশ কাটেনি। সে হাত বাড়িয়ে চোখের উপরে আলতো মুছে দিয়ে বলে,
“কেন এত হুটোপুটি করে আসতে গেলেন?”
“ওমা, তো আসব না? যেভাবে আপনি রাস্তায় বেরিয়েছেন স্বামী হিসেবে আমার বুক ধরাস ধরাস করছিল। আপনাকে যে কেউ তুলে নিয়ে যেতে এক সেকেন্ডও ভাববে না। তখন কী হবে?”
মোহ চাপা হাসি দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
“আমার গ্রামে আমাকে তুলতে আসবে এমন সাহস কার আছে?”
“আমার।”
কথা মুখ থেকে শেষ করা মাত্র এক হাত মোহের পায়ে রেখে পাজ কোলে তুলে ফেলল স্বচ্ছ। মোহের দম ফেটে যাওয়ার উপক্রম। স্বচ্ছের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“আরে, আপনার হাতের ব্যথা ঠিক হয়নি।”
“বাম হাতের ব্যথা আছে একটু। ডান হাত ঠিকঠাক। তাছাড়া এমন সুন্দরী স্ত্রীকে কোলে নিতে ভাঙা হাতের হাড়ও সেকেন্ডের মধ্যে জোড়া লেগে যাবে।”
মোহ স্বচ্ছের কথার জোরে না পেরে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠল,
“আপনি একটা যা-তা। আস্তে হাঁটুন নয়ত একসাথে পাঁজরের হাড় ভাঙবে।”
স্বচ্ছ সেই বেলি ফুলের মাঠের দিকে এগোতে এগোতে বলল,
“তা সকাল সকাল এদিকে আসার কারণ?”
“এমনিই। আমার বের হয়ে হেঁটে হেঁটে গ্রামটা দেখতে ইচ্ছে করছিল। এখানে অনেক বছর কাটিয়েছি। ইথানের মা হিসেবে গ্রামে পরিচিত হওয়ার পর তো বাধ্য হয়ে গ্রামটা ছাড়তে হয়েছিল। তাই অনেক মনে পড়ছিল এদিকের কথা।”
“আমাকে ডাকলে একসাথেই আসতাম।”
মোহ ভালোভাবে স্বচ্ছের কাঁধ চেপে ধরে বলল,
“ঘুমন্ত মানুষকে ডাকতে ইচ্ছে করেনি। ইথান এখনো ঘুমোচ্ছে?”
“হ্যাঁ। সাহেব বাবুর তো নয়টার আগে ঘুম ভাঙে না।”
কথা বলতে বলতে মোহকে মাঠের কাছে নামিয়ে দিলো স্বচ্ছ। মোহ ঘাসের উপর বসে বলল,
“বসুন এখানে। ভালো লাগবে।”
“ওয়েট আ মিনিট।”
স্বচ্ছ বেলি গাছের দিকে এগিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিচে পড়ে থাকা কতগুলো ফুল হাতে তুলে নিয়ে মোহের কাছে এসে বসল। তারপর ফুলগুলো নিয়ে কিছু একটা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একের পর এক ফুলগুলো জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। প্রথমে না হলেও মোহের শাড়ির আঁচলের নিচে ঝুলে থাকা কয়েকটা সুতা কেটে তা দিয়ে পেঁচিয়ে ফুলগুলো জোড়া লাগাতে থাকে স্বচ্ছ। মোহ অনেকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করে,
“কী করছেন এগুলো?”
স্বচ্ছ ব্যস্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করে,
“হুঁশশ। কিছুক্ষণ চুপ থাকো। কাজ করছি।”
ফুলকে আংটির আকৃতি দিয়ে তা মোহের অনামিকা আঙ্গুলে সাবধানে পরায় স্বচ্ছ। দুহাতে চুড়ির মতো করে বেঁধে দেয় ফুলগুলো। সবশেষে মাথায় গোল করে খোঁপার সাথে গুঁজে এবং বাকি ফুল মুকুটের মতো পরিয়ে দেয়। মোহ নির্বাক হয়ে দেখে। তার চোখে বিস্ময় ধরে না। সবশেষে মোহের মুখোমুখি হয়ে বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে বসে স্বচ্ছ। মোহকে দেখাচ্ছে প্রকৃতির রাজকন্যার মতো। সামান্যতম কৃত্রিমতা যার মুখশ্রীতে নেই। নিজের চোখ কোনোদিকে সরাতে সফল হতে পারছে না স্বচ্ছ। মোহ স্বচ্ছের হাত ধরে নেত্রপল্লব বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন লাগছে আমায়?”
স্বচ্ছ কিছু বলে না। কাঁপা হাতে ফের বুকের বাম পাশে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে। এতটুকুই তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য যথেষ্ট ছিল। মোহ ফের বলে,
“আমাকে কেমন লাগছে আমি দেখব না?”
স্বচ্ছ তার পকেট থেকে ফোন বের করে মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটা ছবি তুলে মোহের সামনে তুলে ধরে। সে নিজেকে এক ফুলকন্যা রূপে দেখে কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকে। আসলেই আলাদা লাগছে তাকে। স্বচ্ছ মোহের কানের পাশে চুল গুঁজে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“তোমায় দেখে আমার একটা গান মনে পড়ছে।”
পরক্ষণেই বাঁশির সুরের সাথে সে হালকা সুরে ধীর গলায় মোহের দিকে চেয়ে নিজের বুকে হাত রেখে গাইতে আরম্ভ করে,
“দুধে আলতা গায়ের বরণ
রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা!
আচল দিয়া ঢাইকা রাইখো
চোখ যেন পড়ে না
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম
মন যে আর মানে না…..!”
বাঁশি বাজানো ছোটো ছেলেগুলোর কানে পৌঁছায় স্বচ্ছের মোটা সুরের গান। তারা আরো মধুর বাঁশি বাজায়। স্বচ্ছ মোহের হাত ধরে তাকে আরেকটু নিকটে টেনে আবারও গায়,
“কাছে আইসো আইসো রে বন্ধু
প্রেমের কারণে।
ভালোবাইসো বাইসো রে বন্ধু
আমায় যতনে!”
কিছুক্ষণ সময় অতিক্রম হবার পর বাড়ির দিকে রওনা দেয় তারা। স্বচ্ছ জুতা পরে এসেছে। ফলে কাঁদামাটিতে জুতা বসে যাচ্ছে। তা দেখে মোহ বলে,
“জুতা খুলে হাঁটুন।”
স্বচ্ছ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“যদি পড়ে যাই?”
মোহ মুচকি হেসে বলে,
“আমি আছি। ধরে নেব। আর গ্রামের মাটিতে খালি পায়ে হাঁটতে মজাই আলাদা। ট্রাই করে দেখুন।”
জুতা এক হাতে নিয়ে অন্য মোহের হাতটা ধরে ধীরে চলতে শুরু করে স্বচ্ছ। কাঁদা পায়ে যেন মজা লাগতে শুরু করে তার। মোহ স্বচ্ছের মুখ দেখেই বুঝে নেয় খালি পায়ে হাঁটা তার ভালো লেগেছে। বাড়িতে ঢুকতেই রাবেয়া বেগম তাদের দুজনকে দেখে বলে ওঠে,
“সব ঠিক আছে। কিন্তু জোড়াডা হয় নাই। কীরে, নাতজামাই তোমারে যেই পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি কাল রাইতে দিলাম। ওটা পইরা আইসা তোমার বউয়ের পাশে খাঁড়াও। দেখবা কেমন মিলে।”
স্বচ্ছ মাথা চুলকে বলে,
“পাঞ্জাবি ঠিক আছে দাদিমা। কিন্তু লুঙ্গি? আমি কখনো পরিনি।”
“একদিন পইরা দেখো। এইগুলা প্যান্টের লগে পাঞ্জাবি মানায় নাকি?”
স্বচ্ছ দাদির মন রাখতে বলে বসল,
“আচ্ছা, আচ্ছা। সকালে খাবার খেয়ে তোমার পছন্দ মতো জামাকাপড় আমি আর ইথান পরব। ঠিক আছে?”
রাবেয়া বেগম খুশি হলেন। মোহ পাশ থেকে জানতে চাইল,
“সকালের খাবারে কী করছ দাদিমা? রান্না তুলে দিয়েছ? আমি সাহায্য করব?”
“আমারে রুটি করে দে একটু। মাংস তুলে দিছি চুলায়। জামাই মাংস, রুটি খাও তো?”
স্বচ্ছ একটু ভেবে বলল,
“উমম.. খাই তো। কিন্তু দাদিমা আমি তো আপনার কাছ থেকে এসব খেতে আসিনি। আমি এসেছি আপনার করা ঐতিহাসিক ভর্তাগুলো গরম ভাত খেতে। আগেরবার চুরি করে আপনার নাতনি খাইয়েছিল। তখন তেমন পেট কিন্তু ভরেনি। তখনি পণ করেছিলাম এই বাড়ির নাতজামাই হয়ে আমার সুন্দরী দাদিশাশুড়ির হাতের ভর্তা দিয়ে ভাত পেট ভরে খাব।”
রাবেয়া বেগম কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললেন,
“জামাইরে কেউ ভর্তা দিয়া ভাত দেয় নাকি? পাগল হইছ? ওসব খাইবা পরে। এহন না।”
স্বচ্ছ কিছুটা অসন্তোষ হয়ে বলল,
“তাহলে কিন্তু এখনি চলে যাব এখান থেকে। বাকিটা আপনি জানেন আর আপনার সুন্দরী জানে।”
অনেক তর্কের পরেও স্বচ্ছ অটল থাকল নিজ সিদ্ধান্তে। রাবেয়া বেগম অবশেষে নিজের নাতজামাইয়ের জন্য শুঁটকি ভর্তা, মরিচ ভর্তা, শাক ভর্তা সহ অনেক পদের ভর্তা বানাতে লাগলেন। স্বচ্ছ খুশি আমেজে ভর্তা বানানো দেখতে থাকল।
পড়ার টেবিলে বসে প্রায় সারারাত ধরে তানিয়াকে কল আর মেসেজ করেই সময় কাটিয়ে দিলো সৌমিত্র। ভোরের দিকে টেবিলেই মাথা লাগিয়ে দিলো সে। চোখ লেগে এলো। প্রায় সকাল সাতটার দিকে তার ফোনের রিংটোনে হকচকিয়ে উঠল সে। তার অন্তর থেকে বলল তার মিস গোলাপি কল করেছে নিশ্চয়। কোনোকিছু না ভেবেই কল রিসিভ করে বসল। দুর্বল স্বরে বলল,
“হ্যালো, হ্যালো! শুনছেন?”
ওপরপাশ থেকে ভেসে এলো পুরুষালি কণ্ঠ। হৃদয় ভেঙে গেল সৌমিত্রের। থমকে গিয়ে ফোনটা কান থেকে সরিয়ে স্ক্রিন দেখল। তার এক বন্ধু কল করছে। সৌমিত্রের কণ্ঠস্বর না পেয়ে বারবার হ্যালো বলছে সে। কথা বলার জন্য আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ জাগে না স্বচ্ছের। তবুও অনাগ্রহ নিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, বল।”
“তুই সেদিন ইংরেজি নোটস চাইলি আমার থেকে। আমি বলেছিলাম আজ দিতে পারব। ভার্সিটিতে আসছিস তো?”
সৌমিত্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“হুমম, যাব। ক্যাম্পাসেই থাকিস।”
আর কিছু না শুনে কল কাটে সৌমিত্র। নিজের কললিস্ট, মেসেজ লিস্ট চেক করে। কোথাও তার মিস গোলাপির কোনো রেসপন্স নেই। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সৌমিত্র আবার মেসেজ করে,
“আই নো, ইউ আর ডিপলি হার্ট। আই এম স্যরি, মিস গোলাপি। বিশ্বাস করুন, আপনি ছাড়া আমার জীবনে আর কেউ নেই, কেউ না। আমি খুব খারাপ ছিলাম। কিন্তু আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ শুধু আপনাকে ঘিরে।”
মেসেজের টোনে ধ্যান ভাঙে তানিয়ার। ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজের অতীত জীবনের ধোঁকা নিয়ে ভাবছিল এতক্ষণ। সে আবার ধোঁকা খেতে পারবে না। একজন তার অর্ধেকটা শেষ করে চলে গেছে। আরেকজনকে দেখে উপলব্ধি করেছিল এই বোধহয় তার ভেতরে ফুরিয়ে যাওয়া বিশ্বাস ফিরে এলো। অনুভূতিগুলো বিশ্বস্ত হলো। কিন্তু তারপর ফের লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সবকিছু। ফোনটা নিয়ে মেসেজটা পড়ে তার কান্না পায়। সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর থেকে নিজের ঘরে নিজে বন্দি ছিল সে। রাতভর ফুঁপিয়ে কেঁদে চোখমুখ লাল করে ফেলেছে। ফোনটা সরিয়ে রাখে সে। কোনোমতে সৌমিত্রের সাথে যোগাযোগ করতে চায়না এখন। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াতেই তানিয়া নিজের মাকে দেখতে পেল। বেশ সন্দিহান হয়ে তাকিয়ে আছেন তিনি তানিয়ার দিকে। এবার সরাসরি প্রশ্ন করলেন মেয়েকে,
“এত সকালে ছাঁদে ফোন নিয়ে কী করছিস?”
তানিয়ার ভ্রু কুঁচকে যায়। আজকাল তার মা বড্ড সন্দেহ নিয়ে চলেন। বিষয়টা তানিয়াকে ভাবায়। তপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এখন ছাঁদে উঠলেও সমস্যা? কী হয়েছে তোমার কয়দিন ধরে? এমন ব্যবহার করছ কেন? মনে হচ্ছে আমি চোর আর তুমি পুলিশ। সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখছ যেন মনে হচ্ছে আমি কোথাও পালিয়ে যাব।”
তানিয়ার মা খানিকটা আমতা আমতা করে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
“কাল তোর বাবা আর ভাই আসবে দেশে। সন্ধ্যার মধ্যে হয়ত পৌঁছে যাবে।”
শত দুঃখের কারণ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও আঁখি দুটিতে প্রফুল্লতা দেখা যায়। কতগুলো বছর বাবাকে কাছ থেকে জড়িয়ে ধরে বায়না করা হয়না! অনেকদিন ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করা হয়না। তার মনটা সজীব হয়ে ওঠে।
খাওয়াদাওয়া সেরে বড়ো উঠানে বসে দাদির সাথে গল্প জুড়েছিল মোহ। রাবেয়া বেগম মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন উনার শহরে থাকা ছেলের কথা। খবরাখবর নিচ্ছিলেন সবার। হঠাৎ সামনের ঘরের দরজা খুলে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো স্বচ্ছ আর ইথান। রাবেয়া বেগম আর মোহ উভয়ই উৎসুক হয়ে চেয়ে রইল সেদিকে। মোহ বাবা আর ছেলের আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করল খুঁটে খুঁটে। স্বচ্ছ আর ইথান এই প্রথম লুঙ্গি পরিধান করেছে। দুজনেই শক্ত করে লুঙ্গি ধরে অসহায় পানে মোহের দিকে তাকিয়ে আছে। উপরে পরেছে খয়েরী পাঞ্জাবি। মোহ মুখে হাত রেখে নিজের বেরিয়ে আসা হাসি আটকায়। স্বচ্ছ বলে,
“দাদিমা, শুধুমাত্র আপনার চাওয়াতে এই ডেঞ্জারাস জিনিস পরেছি। বিশ্বাস করেন, আপনার সুন্দরীও যদি জীবনে আমাকে এটা পরতে বলত আমি পরতাম না। এটার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। এমন জিনিস কেউ পরে?”
রাবেয়া বেগম হালকা কেশে জোর গলায় বললেন,
“ধুর, পাগলা। এটাই তো এই দেশের মাইনষের আসল জামাকাপড়।”
ইথান দুটো হাতে লুঙ্গি ধরে গুটি গুটি পায়ে মোহের কাছে এগিয়ে গিয়ে মিনমিন করে বলে,
“এটা বাবা আমাকে কী পরিয়েছে মাম্মা? খুলে যাচ্ছে শুধু। আমাকে খারাপ লাগছে দেখতে।”
মোহ একটু হেসে ভালো করে ইথানের লুঙ্গির গিঁট ভালো করে বেঁধে বলে উঠল,
“অনেক ভালো লাগছে তোমাকে বাবু। যেমন তুমি তেমন তোমার বাবা। দুজনেই একদম একই৷ কারোর লুঙ্গি পরার ছিঁড়ি নাই।”
বলেই মোহ স্বচ্ছের দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসল। তারপর খেয়াল করল পাঞ্জাবির নিচে বেল্ট আকৃতির কিছু উঁচু হয়ে আছে। ফট করে সে বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল,
“পাঞ্জাবির নিচে কী ওটা? বেল্ট দিয়ে লুঙ্গি পরেছেন?”
লজ্জায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো স্বচ্ছ। গলা খাঁকারি দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,
“আর কী করব? নিজের ইজ্জত নিয়ে ক্রিকেট খেলব? এত বড়ো রিস্ক আমি নিতে পারব না।”
রাবেয়া বেগম আর মোহ দুজনেই উচ্চস্বরে হেসে ফেলল। মোহ হাসতে হাসতে থেমে থেমে বলল,
“তাই বলে লুঙ্গির সাথে বেল্ট?”
হাসিতে লজ্জা আর অস্বস্তি বেড়ে গেল স্বচ্ছের। ফর্সা ত্বক লাল হয়ে এলো। সহ্য হলো না তার কষ্ট নিয়ে এত মজা। ইথানের হাত ধরে রাগে গজগজ করে বলল,
“ইথান, চলো তো। আমরা এখনি চেঞ্জ করব।”
ইথানও সম্মতি দিয়ে স্বচ্ছের হাত ধরে একটু জোরে লাফ দিয়ে উঁচু জায়গা থেকে নামতে গিয়ে বিপর্যয় ঘটে গেল। ইথানের লুঙ্গিটা খুলে গিয়ে মাটিতে লুটোপুটি খেল। সবাই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল থম মেরে। ইথান ছোটো থেকেই অনেকটা লাজুক। সবার এমন দৃষ্টি দেখে তার চোখে পানি ছলছল করতে লাগল। রাবেয়া বেগম তো আর না পেরে হাসতে লাগলেন। ইথানকে ফট করে কোলে তুলে নিলো স্বচ্ছ। তার প্রধান জায়গা পাঞ্জাবি দিয়ে ঢেকে দিয়ে ইথানের কষ্টে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
“জানতাম এটা হবে। আগেই ভাগ্যিস বেল্ট দিয়ে নিজেরটা সিকিওর করেছিলাম। কাঁদিস না বাপ। তোর ইজ্জত বাঁচানোর জন্য তোর বাপ আছে। চিন্তা করিস কেন? এই মেয়ে মানুষগুলো চোখ বন্ধ করো।”
ইথান যাতে জোরে কেঁদে না ফেলে সেকারণে মোহ চোখ বন্ধ করার ভান করল। স্বচ্ছ তড়িঘড়ি করে ইথানকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলে মোহও আর নিজের হাসি লুকাতে পারল না।
আয়নার সামনে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে ফারাহ। অফিসের জন্য তাড়া আছে তার। কয়দিন ধরে খুব পেরেশানিতে আছে সে। শৌভিক নিজের নেভি ব্লু পাঞ্জাবি পরে সেটার বোতাম লাগাতে গিয়ে ফারাহকে ডাকল।
“আপনার সময় হলে আমার পাঞ্জাবির বোতামগুলো লাগিয়ে দিয়ে যাবেন ম্যাডাম?”
ফারাহ ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে লাগাতে বলল,
“আমার তো সবসময় সময় থাকে। আপনারই বোধহয় থাকে না।”
“খোঁটা দিলে?”
ফারাহ শৌভিকের কাছে এসে তার বুকের বোতামে হাত রেখে বলে,
“জি, না। সত্যি বললাম। সত্যি কথা দিনে একশবার বলা যায়।”
ফারাহ পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে ব্যস্ত হলো। শৌভিক কিছু একটা ভেবে ফারাহর কোমড় দুহাতে কোমলভাবে জড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে। তাহলে আজকে রেডি থেকো সন্ধ্যার পর।”
“কেন?”
“আপনাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাব। তারপর ডিনার করব বাহিরে।”
ফারাহ ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে বলল,
“আর ইউ সিওর? পরে মত বদলাবেন না তো?”
“উঁহু, একদম না। যতই কাজ থাকুক সব একদিকে ফেলে চলে যাব তোমার অফিসে।”
ফারাহর হাসি প্রগাঢ় হয়। শৌভিকের কাঁধে দুটো হাত দিয়ে জড়িয়ে খানিকটা উঁচু হয়ে বলল,
“আই উইল ওয়েট ফর ইউ।”
“ওয়েট করার সুযোগই পাবে না শত্রুর মেয়ে। তার আগেই উপস্থিত হবো।”
“তা দেখা যাবে। এখন বলুন তো, আমার হালকা হলুদ পোশাকের সাথে এই লিপস্টিক মানাচ্ছে কিনা? নাকি গাঢ় লিপস্টিক ভালো লাগবে? আমি না লিপস্টিকের ব্যাপারে অনেক কাঁচা।”
ফারাহ নিজের চিকন ঠোঁট দেখিয়ে জানতে চাইল। শৌভিক সহসা তার কোমড় জড়িয়ে উঁচু করে ধরে বলল,
“এভাবে বোঝা যায় নাকি? আরো কাছে এলে তবে না বুঝব!”
তৎক্ষনাৎ শৌভিক অপ্রত্যাশিত কাজটি করে বসল। চমকে উঠল ফারাহ। তার ওষ্ঠদ্বয়ে গভীর চুম্বন করে তাকে ছেড়ে দিয়ে শৌভিক বলল,
“ভালো টেস্ট আছে মানে লিপস্টিক ঠিকঠাক আছে।”
ফারাহ হতবাক হয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখল তার লিপস্টিক ঠোঁট জুড়ে ছড়িয়ে গেছে। সে শৌভিককে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“অসহ্য লোক। আমার লিপস্টিকটাই ঘেঁটে গেছে।”
শৌভিক ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে মন খারাপের ভান করে বলল,
“একেই বলে যার জন্য চুরি করি সে-ই বলে চোর। এখন আমি অপবাদ পাচ্ছি। অবশ্য ঠিকই আছে। শত্রুর মেয়ের উপকার করতে গিয়েছিলাম যে। তার তো এই পরিণতিই হবে।”
ফারাহ ক্রোধে আরো ফুলে উঠল যেন। পরক্ষণেই আবার হাসি পেয়ে গেল। কী যে এক দোটানা! তার হাসি লক্ষ্য করে শৌভিক তার সামনে দাঁড়িয়ে তার থুঁতনিতে হাত রেখে বলল,
“আমার লিপস্টিক চেক করার ধরণটা তাহলে আপনারও ভালোই লেগেছে।”
ফারাহ কোনো শব্দ না বলে ফট করে বিদ্যুতের গতিতে শৌভিকের ঠোঁটে নিজ থেকে চুমু খেয়ে সরে গিয়ে টিস্যু দিয়ে লিপস্টিক মুছতে মুছতে দৌড়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,
“যাওয়ার আগে নিজের ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে যাবেন। নাহলে কিন্তু আপনার মানসম্মানের গ্যারান্টি আমি দিতে পারব না।”
কথা শেষ করেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ফারাহ। শৌভিক আয়নায় দেখল তার ঠোঁটেও লিপস্টিক লেগেছে। উদাস মনে বলল,
“হায় রে! মেয়ে মানুষকে চুমু খেলেও কত জটিলতা সহ্য করতে হয়।”
সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। আকাশের রঙিন আবরণ মুছে যাচ্ছে একটু একটু করে। তানিয়া ডাইনিং টেবিলে বসে মায়ের সাথে কিছু কাটাকুটি করছিল। কাল আসবে তার বাবা আর ভাই অথচ আজ থেকেই রান্নাট তোড়জোড় শুরু করেছে তার মা। তানিয়াও সাহায্য করছে। অসময়ে বাড়ির কলিংবেল বাজে। কাজে ব্যাঘাত ঘটে মা-মেয়ের। তানিয়া বিড়বিড়িয়ে বলে,
“এ সময় কে এলো আবার!”
তানিয়ার মা সেখান থেকে চেঁচিয়ে ওঠেন,
“কে?”
ডাইনিং টেবিল থেকে সদর দরজার দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। ফলে দরজার অন্যপাশে থাকা পুরুষালি মোটা গলা উত্তর দিলো,
“ডেলিভারি এসেছে।”
তানিয়ার কাজ করা থেমে গেল। একমনে বসে ভাবল কণ্ঠস্বরটা চেনা কেন? তানিয়ার মা কপাল কুঁচকে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কীরে, কিছু অর্ডার করেছিলি অনলাইনে?”
তানিয়ার মনে তখন খটকা জাগে। হুড়মুড়িয়ে চেয়ার থেকে উঠে বলল,
“আমি দেখছি। তুমি বসো।”
দরজার কাছে গিয়ে দুরুদুরু মনে লক খুলল তানিয়া। কপাট খুলে যেতেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। সামনে স্বয়ং সৌমিত্র দাঁড়িয়ে রয়েছে ডেলিভারি ম্যানের পোশাকে। শুকনো মুখে, এলোমেলো চাহনিতে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আপনার ডেলিভারি ম্যাম।”
তানিয়ার মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কী করে সামলাবে বুঝে উঠতে না পেরে রান্নাঘরে থাকা তার মাকে চিল্লিয়ে বলল,
“মা, ডেলিভারি ম্যান এড্রেস ভুল করেছে। সামনের গলিতে আঁখির বাড়িতে ডেলিভারি ছিল। ডেলিভারি ম্যান চিনতে পারছে না। আমাকে চিনিয়ে দিতে বলছে। আমি এখনি আসছি চিনিয়ে দিয়ে।”
তানিয়ার মা রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকায় বেশি না ঘেঁটে বলে উঠলেন,
“তাড়াতাড়ি ফিরে আয়।”
বিলম্ব না করে সৌমিত্রের হাতটা ধরে ঝড়ের বেগে হাঁটা ধরল তানিয়া। সৌমিত্র খানিকটা চমকালো। এই প্রথমবার তানিয়া তার হাতটা ভালোভাবে স্পর্শ করল। এর আগে শুধু তারা একে অপরের কনিষ্ঠা আঙ্গুল স্পর্শ করেছিল। সেটাই ছিল তাদের অজ্ঞাত সম্পর্কের সীমানা। সেটা তানিয়া নিজেই অতিক্রম করল। তবে সেটা এত চিন্তায় তানিয়ার খেয়াল নেই। সৌমিত্রও বদৌলতে সুযোগের সৎব্যবহার করল। তানিয়ার হাতটা চেপে ধরল। তানিয়া তাদের পাড়ার শেষ প্রান্তের একটা ছোটো মাঠে এসে থামল। বিকেলে এখানে ছোটো ছেলেপেলে ফুটবল খেললেও এখন মাঠ খালি। একপাশে বটগাছ ছিল। সেখানে এসে থেমে হাঁপাতে থাকল তানিয়া। রেগেমেগে তাকাল সৌমিত্রের দিকে। কিন্তু সৌমিত্রের ধ্যান এখনো তাদের দিকে। তানিয়া তা খেয়াল করে ছেড়ে দিয়ে তেড়ে এসে বলল,
“আপনি কি পাগল? আপনার বাড়িতে এভাবে আসার সাহস কী করে পেলেন?”
সৌমিত্র নির্জীব হেসে বলল,
“প্রেমে পড়লে একটুআধটু বুকের পাটা বেড়ে যায়।”
তানিয়া অন্যদিকে ফিরে মুখ ফুলিয়ে খোঁটা দিয়ে বলল,
“সেটাই। আপনি তো অনেক এক্সপেরিয়েন্সড মানুষ।”
একথা বিষের মতো ঠেকল সৌমিত্রের। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে তানিয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বলল,
“আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে আপনাকে ভালোবেসেছি। এটা আপনি মানুন আর না-ই মানুন। আমি জীবনে অনেক প্রেম করেছি। কিন্তু সেখানে কোনো প্রণয়ের অনুভূতি ছিল না। আমরা উভয়পক্ষ ভালো করে জানতাম এটা শুধু একটা টাইম পাস। অপরপক্ষও আমাকে সেভাবে ট্রিট করত। আমি রাত বিরাতে তাদের নিয়ে ভাবতাম না, তাদের নিজের করার জন্য উঠেপড়ে লাগতাম না, তাদের সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করতাম না, তাদের প্রত্যেকটা কথা বেদবাক্য মনে করে শুনতাম না। কিন্তু আমি প্রথম আপনাকে দেখে ভাবতে লাগলাম আপনাকে সারাজীবনের জন্য যদি না পাই তবে আমার জীবন বৃথা হয়ে যাবে। আপনার কথা প্রতি রাতে ভেবে পার করে দিলাম। আমার একেকটা অনুভূতি আমার বুকে তাণ্ডব শুরু করল। তারা আপনাকে চাইল। খুব করে চাইল।”
মনে তোলপাড় শুরু হয় তানিয়ার। চোখ বুঁজে ফেলে পানি গড়িয়ে পড়ে যাবার আগেই। নাক টেনে বলল,
“কিন্তু আমার কষ্ট হয়। আমি মেনে নিতে পারিনা যখন আপনার আগের কথাগুলো শুনতে পাই। এমনিতে আমি একটা ভাঙা মানুষ। সবসময় একটা আতংক আমার ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। মনে হয় আমি আবার মাঝ সমুদ্রে ভেসে যাব না তো?”
সৌমিত্র নিজের কনিষ্ঠা আঙ্গুলটি তানিয়ার আঙ্গুলে ঠেকিয়ে বলে,
“যাবেন না। কারণ সেই সমুদ্রটাই আমি। সেই সমুদ্র জুড়ে শুধু আপনি আছেন মিস গোলাপি। আপনি যতটা না আমার কথা রাখার জন্য অপেক্ষা করেন তার চেয়ে বেশি আমি অপেক্ষা করি যে আমি কবে নিজের কথা রাখতে পারব।”
তানিয়া চুপ করে থাকে মাথা নুইয়ে। তার মনটা ফের আশ্বস্ত হয়। ঠোঁটের কোণে সুপ্ত হাসির রেখা দেখা যায়। সৌমিত্রের চোখে চোখ রাখতেই যেন মনে হয় ছেলেটার চোখ সমস্ত অনুভূতি উগড়ে দিচ্ছে। অনুভূতিগুলো তো তার জন্যই। বড়ো শ্বাস নিয়ে সে বলল,
“তা কয়দিন পর না আপনার পরীক্ষা? এখন এই পোশাকে কী করছেন? কোথায় পেলেন এই ডেলিভারি ম্যানের জামা?”
সৌমিত্র হাফ ছেড়ে মাথার টুপি খুলে বলল,
“এটা আমার এক ফ্রেন্ডের। ধার করে এনে পরেছি। জানি, এমনি এমনি তো আপনার বাড়িতে আসতে পারব না। কাল থেকে একটা শব্দও পড়তে পারিনি। আমার প্রেমিকা টিউটর বেশ রাগ করেছিল তাই। রাগটা কমেছে তো নাকি?”
“হুমম। একটু একটু কমেছে।”
সৌমিত্র নিজের হাতে থাকা ছোটো বক্সটা তানিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“তাহলে এটা গ্রহণ করুন। আপনার রাগ পুরোপুরি কমাতে ছোটো উপহার।”
“কী এটা?”
“পরে খুলে দেখবেন।”
তানিয়া আর কিছু বলার আগেই লক্ষ্য করল টুপি পরে সৌমিত্রের চুলগুলো উলোটপালোট হয়ে গিয়েছে। আগপাছ না ভেবেই তার চুলে হাত দিয়ে বসল তানিয়া। খুব আদুরে ভঙ্গিতে তা ঠিকঠাক করে দিলো। সৌমিত্র চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,
“মিস গোলাপি, অল্প বয়সে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে আমার! বুক ধড়ফড় করছে।”
তানিয়া মৃদু হেসে চুল থেকে হাত সরিয়ে বলল,
“যতসব বাজে কথা!”
“তা হঠাৎ আমার হাত ধরে বসছেন, আমার চুলে হাত দিচ্ছেন। আমাদের বাউন্ডারি অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে না? যদিও এতে আমার অভিযোগ নেই। আই এম ইনজয়িং ইট।”
তানিয়া আনমনে বলে ফেলল,
“কী জানি! আজকে সীমানা অতিক্রম করতে ইচ্ছে করল। কেন জানি না!”
একটু থেমে আবার হুঁশে ফিরে হুড়মুড়িয়ে বলল,
“অনেক দেরি হয়ে গেল। আমাকে এখনি ফিরতে হবে। এমনিতে কাল বাবা আর ভাই আসবে। তাই মা অনেক ব্যস্ত। এতক্ষণ বাহিরে থাকলে খবর হয়ে যাবে আমার। এখন যাই। আপনিও সাবধানে যাবেন।”
সৌমিত্র মাথা নুইয়ে বলল,
“যথাআজ্ঞা!”
তানিয়া বাড়ির পথে পা বাড়ায়। সৌমিত্র গাছে ঠেস দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে দেখতে থাকল। মনটা বলল, মুহূর্ত আরো দৃঢ় কেন হলো না? মিস গোলাপিকে কেন কিছু সময়ের জন্যই সে পায়? সবসময়ের জন্য তাকে দেখার অধিকার কবে পাবে?
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]