যে শ্রাবণে প্রেম আসে
তোনিমা খান
||০৭||
ছোট্ট শ্রবণের জীবন থেকে হঠাৎ হঠাৎ মাতৃদুগ্ধ হারিয়ে যাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা তার মনে এখন ভীতি সৃষ্টি করছে। ছোট্ট মনটি ভেবে নিয়েছে মাকে ছাড়লেই মা হারিয়ে যাবে। তাই তো মাঝরাতে উঠেও সে অঝোরে কাঁদতে লাগলো আর মাকে খুঁজতে লাগলো। যখন কাঙ্খিত চাওয়াটুকু পেলো তখন গিয়ে শান্ত হয়। কিন্তু মায়ের শাড়ির আঁচল টুকুও ছাড়লো না আর না সরলো মায়ের বুক থেকে। ইরামের দোলনায় ঘুমানোর অভ্যাস নেই; মায়ের বুকে ঘুমানো তার অভ্যাস। মাঝরাতে তার ও ঘুম ভেঙে গেলো মায়ের খোঁজে—তবে তার স্থান হয় এক প্রশস্ত বক্ষে। যেখানে কি-না স্নেহ, ভরসা আর একটা শক্ত আশ্রয়স্থল রয়েছে। ঘুমে কাতর ইরা অজানা কারণে চোখ খুলতে পারছিলো না, তখন নিশ্চিন্তের এক নিঃশ্বাস ফেললো মেয়েকে কারোর বক্ষমাঝে দেখে। অবচেতনে এতোটুকু স্বস্তি মিলে মানুষটা সামলে নেবে। রাতটুকু সেভাবেই ভালোবাসার স্থানগুলো অদল বদলের মধ্যে কেটে যায়। সৃষ্টিকর্তা এভাবেই আমাদের সকল শূণ্যতা একদিন পূরন করে দেয়। শুধু প্রয়োজন একটু ধৈর্য্য আর সহনশীলতার।
সকাল আটটা। মায়ের আঁচল ছাড়তে নারাজ ছেলেটি আর্লি রাইজার। ঘুম থেকে উঠেই মায়ের আঁচল ধরে খেলা করছে সে। কেউ যদি হাতের মুঠোয় থেকে মায়ের আঁচল ছাড়াতে আসে, তবে সে এক বিকট চিৎকারে ঘরটি ঝনঝনিয়ে ওঠে। আর কেউ চেষ্টা করেনি শ্রবণকে মায়ের থেকে সরাতে।
বুকের উপর গাল দাবিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শ্রেয়ান সরু চোখে তাকায় ছেলের দিকে। আড়চোখে তাকায় ঘুমন্ত স্ত্রীর পানে। শাড়ির আঁচলের বেহাল অবস্থা করে রেখেছে তার ছেলে। সে ফিসফিসিয়ে সতর্ক কণ্ঠে বলল,
–“এই ছেলে মায়ের আঁচল ধরে টানাটানি করছো কেনো? পরে দোষ তো তোমার বাপের হবে।”
শ্রবণ মাথা কাত করে তাকায় বাবার দিকে। বাবাকে কিছু বলতে দেখে সে স্বশব্দে চিৎকার জুড়ে দিলো। আ উ শব্দ করে রাজ্যের গল্প জুড়ে দেয় বাবার সাথে। শ্রেয়ান হড়বড়িয়ে বলে,
–“বদ ছেলে! ধীরে ধীরে। মাকে পেয়ে যে তুমি আকাশে উড়ছো তা বোঝাই যাচ্ছে; তাই বলে অন্যের ঘুম নষ্ট করবে কেনো? তোমার আপা ঘুমাচ্ছে দেখছো না?”
বাবার নিষেধাজ্ঞা শোনার মতো বয়স শ্রবণের হয়নি তাই সে তার কাজে বহাল থাকলো। বোনের ঘুম ভাঙিয়েই দম নিলো শ্রবণ। শ্রেয়ান মেয়েকে দোল দিতে লাগলো। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। আলসেমি কাকে বলে তা যেনো শেখা উচিৎ ইরামের থেকে। শ্রেয়ান কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। যে কি-না চোখ খুলে চাতক পাখির মতো একদৃষ্টিতে কোনদিকে তাকিয়ে আছে। আর তার খুলে রাখা শার্টের টপ বোতাম দুটো ভেদ করে বুকের লোমগুলো ধরে অলস হাতে টানছে। একদম পুতুলের মতো নিশ্চল! মস্তিষ্ক এখনো সচল হয়নি। শ্রেয়ানের ঠোঁটের কোনে স্নেহের হাসি প্রগাঢ় হয়। সে দেখতে লাগলো মেয়ের কর্মকাণ্ড। অলস হাতে বাবার বুকের লোম টানতে টানতে সেগুলো ছোট্ট ইরামের পূর্ণ মনোযোগ কেড়ে নিলো। সে বাবার বুকে উবু হয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে বসলো আর ইচ্ছেমত লোমগুলো টানতে লাগলো। শরীরে যত শক্তি ছিলো। অন্যদিকে শ্রেয়ানের বেহাল দশা! সে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে নিচ্ছে তবুও টু শব্দটি করলো না। কিয়ৎকাল বাদ ইরাম যখন ব্যর্থ হলো লোমগুলো তুলতে তখন সে আড়মোড়া ভাঙতে লাগলো। দিলো এক গড়াগড়ি কিন্তু সংকীর্ণ জায়গা থেকে পড়ে যেতে নিলে কেউ বুকে জড়িয়ে নেয়। ইরাম চকিতে চোখ তুলে তাকায় শ্রেয়ানের মুখপানে। ওমনি তার ঘুমঘুম ভাব ছুটে গেলো। সে চোখ বড়োবড়ো করে তাকায় শ্রেয়ানের পানে। আবার সেই নাছোড়বান্দা বিরক্তিকর মুখটি? শ্রেয়ান ঠোঁটের কোনা ঠিকরে হাসি বের হয় মেয়ের কঠোর দৃষ্টি দেখে। সে চট করে গালে ঠোঁট দাবিয়ে দিলে ইরাম ক্যাত করে উঠলো। শ্রেয়ান আদুরে গলায় বলে,
–“আসসালামুয়ালাইকুম আম্মাজান। শুভ সকাল। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সকাল সকাল আপনাকে বুকে নিয়ে বসে আছি।”
শ্রেয়ানের কথায় ইরাম ঠোঁট উল্টাতে উল্টাতে দ্রুত আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগলো। শ্রেয়ান বুঝে নেয় এখন মায়ের আহ্লাদ প্রয়োজন। তবে মা যে ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার জানিয়েছে ইরার পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রামের প্রয়োজন। তার শারীরিক সামার্থ্যের চেয়ে পরিশ্রম বেশি হয়। তাই তো গতরাতে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। সে মেয়েকে কোলে নিয়ে বিছনা থেকে নামতে নামতে বলল,
–“আপনার এখন দুদু চাই? ওয়েট, পাপা এখনি তোমার দুদুর ব্যবস্থা করছি।”
সে ঘর থেকে বের হয়ে সুস্মিতাকে ডাকলো। সুস্মিতা ব্যস্ত পায়ে আসলে সে বলল,
–“ও দুধ খাবে। তুই গিয়ে একটু ব্যবস্থা কর।”
–“আমাকে বারবার ডাকছো কেনো? তুমি করলেই তো পারো।” , সুস্মিতা বিরক্ত হয়ে বলল। শ্রেয়ান চোখ ছোট ছোট করে থমথমে মুখে ইরামকে সুস্মিতার কোলে দিয়ে দিলো। মাথায় চাটি মেরে বলে,
–“যা তাড়াতাড়ি। ওর তৃষ্ণা পেয়েছে, কেঁদে দেবে।”
সুস্মিতা হাসিমুখে ইরামকে দোল দিতে দিতে পা বাড়ায়। আদুরে গলায় বলে,
–“আমার মা উঠে গিয়েছে? ঘুম ভালো হয়েছে? পাপা তোমায় ডিস্টার্ব করে খুব? তুমি বিরক্ত হও পাপা তোমায় ছুঁয়ে দিলে? ফুপিমনি পাপাকে বকে দেবো, ঠিক আছে?”
বলতে বলতেই সুস্মিতা ইরার ঘরে ঢুকলো। সকাল থেকে ঘুমন্ত ইরার থেকে শ্রবণ এভাবেই ফুপির সাহায্যে দুধ খাচ্ছে। ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ইরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুস্মিতা ইরামকে নিয়ে মায়ের পাশে শুইয়ে দিয়ে দুধ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। ইরাম সুস্মিতাকে অবুঝ নেত্রে দেখতে দেখতে মায়ের বুকে সেঁটে গেলো। শ্রেয়ান গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। সুমনা ছেলেকে দেখে শুধায়,
–“কি লাগবে? দাদুমনি উঠেছে?”
–“উঠেছে মামনি। তার জন্য খাবার বানাতে এসেছি।”, শ্রেয়ান ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল নিতে নিতে বলল।
–“আমায় দে আমি করে দেই। আপেল পিউরি করবো?”, সুমনা ব্যস্ত কণ্ঠে বলল। শ্রেয়ান নাকোচ করে বলল,
–“না, আমিই করছি।”
শ্রেয়ান আপেল পিউরি করলো। ততক্ষণে ইরামের দুধ খাওয়া শেষ। শ্রেয়ান ঘরে ফিরে মেয়েকে নিয়ে ওয়াশরুমে যায়। মুখ ধুয়ে তারপর ডায়পার চেইঞ্জ করে বসার ঘরে বসলো। এখন খাওয়াবে। ইরাম থমথমে মুখে বসে আছে শ্রেয়ানের কোলে। শ্রেয়ান সেই থমথমে মুখ উপেক্ষা করে তার গালে শব্দ করে চুমু দেয়। চরম বিরক্তিকর কাজে ত্যাক্ত ইরাম নিরূপায় কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে রইলো। ইরামকে দেখতেই শাহেদ চৌধুরী ছুটতে ছুটতে আসলেন। আবদারের সুরে বললেন,
–“ওকে এখন আমার কাছে দাও শ্রেয়ান।”
শ্রেয়ান সরু চোখে তাকিয়ে বলে,
–“ওকে আমি এখন খাওয়াবো। তুমি শ্রবণকে কোলে নাও।”
–“দাদুভাই এতক্ষণ আমার কাছেই ছিল। মাত্র তোমার মা নিলো। ওকে একটু দাও। কালকে থেকে আমি তোমার জন্য ওকে একবারো কোলে নিতে পারিনি, ঠিকমতো।” শাহেদ চৌধুরীর কণ্ঠে ক্ষোভ। শ্রেয়ান বাবার আক্রোশ বুঝে থমথমে মুখে মেয়েকে বাড়িয়ে দিলো। মেয়েকে হাতছাড়া করার ইচ্ছা মোটেই তার নেই। এমনিতেই সুন্দরী গম্ভীর মেয়েটার মনে জায়গা করতে পারছে না তারমধ্যে আবার যদি থাকে ভাগ বসানোর মতো এতো এতো মানুষ! শাহেদ চৌধুরী খপ করে নিয়ে নিলেন। হাসিমুখে বড়ো বড়ো নেত্রে দেখে অপার্থিব সৌন্দর্যের নাতনিকে। বিস্ময় নিয়ে বলে,
–“শ্রেয়ান, এতো সুন্দর বাচ্চা হয় নাকি?”
শ্রেয়ানের চোখ সরু হয়ে গেলো। সে কড়া দৃষ্টিতে তাকায় বাবার দিকে। শাহেদ চৌধুরী ভড়কে গেলেন ছেলের এমন দৃষ্টিতে। সে অবুঝ কণ্ঠে শুধায়,
–“কি হলো এভাবে তাকাচ্ছো কেনো?”
শ্রেয়ান জবাব দেয় না। ধুম করে সোফা ছেড়ে উঠে এক ছুটে নিজের ঘরে যায়। সেন্টার টেবিল খুঁজে কাজল বের করে আবার ছুটে আসলো বসার ঘরে। আঙুলের ডগায় কাজল লাগিয়ে ঠিক মেয়ের গাল বরাবর একটা ফোঁটা দিয়ে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
–“এই তোমাদের মতো ছ্যাঁচড়া লোকদের জন্য আমায় আমার মেয়েটাকে নিয়ে যে বেশ বেগ পোহাতে হবে, তা বোঝাই যাচ্ছে। আমিও কম না। এই শ্রেয়াংশু চৌধুরীকে টপকে তার মেয়ের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাক! আমি তাকে দেখে নেব। আমার মেয়ের দিকে চোখ দেবে না।”
শাহেদ চৌধুরী বিরক্তি নিয়ে তাকায় ছেলের পানে। ইতিমধ্যেই সে ইরামকে নিজের কোলে নিয়ে নিয়েছে। সে খানিক ক্ষোভ নিয়ে বলল,
–“হুট করে মেয়ের বাবা হয়ে মস্তিষ্ক অচল হয়ে গিয়েছে নাকি? উল্টাপাল্টা বকছো কেনো?”
–“বলবো না? আমার মেয়েকে সুন্দর বললে কেনো? নজর লেগে যাবে।”
–“নাতনি আমার, আমার নজর লাগবে আমার নাতনির উপর? মেয়ের বাবা হয়ে তোমার অহংকার বেড়ে গিয়েছে দেখছি। এতো বেশি বাড় বেড়ো না। একদিন তোমার এই মেয়েকেই অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে।”
–“ঘর জামাই বানিয়ে রাখবো। তবুও মেয়ে আমি হাতছাড়া করবো না। মেয়ে নিয়ে আমার রাজ্যের অহংকার!”, শ্রেয়ান শান্ত স্বরে বলল। শাহেদ চৌধুরী থমথমে মুখে বসে রইল। বউ বাচ্চা পেয়ে ছেলের দাম্ভিকতা যে একদিনেই আকাশচুম্বী!
****
ইরা’র স্বপ্নরা দীর্ঘস্থায়ী হলো পুরো একটা দিন। তবুও দুঃখী ইরার জীবন শঙ্কিত! এই স্বপ্নরা মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ী হবে তো! এক রাতের মাঝে কারোর সংস্পর্শে ইরার জন্মলগ্ন থেকে বয়ে চলা দুঃখরা ফিকে পড়লো। এতো দীর্ঘ আর চিন্তামুক্ত আরামের ঘুম ইরা কবে ঘুমিয়েছিল মনে নেই। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর , কর্নকুহরে সর্বদার নেয় নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গতার আধিপত্য। বালিশে মুখ ডুবিয়ে ইরা জড়ানো চোখ খুললো। নিশ্চল দেহে সাফেদ দেয়ালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নিশ্চল মস্তিষ্কে ঘুরে বেড়ায়, কেমন হতো যদি হঠাৎ এক সকলে ইরা ঘুম থেকে উঠে পৃথিবীর সকল আওয়াজ শুনতে পেতো? ঘুম জড়ানো চোখে ইরা মলিন হাসলো। সে জেগে জেগেও স্বপ্ন দেখছে। গতরে অলসতা আরামের রেশ ধরেই কাত ফিরলে, তার ঘুম ছুটে গেলো খালি দোলনা দেখে। এতক্ষণে মস্তিষ্ক সঠিক জায়গায় আসলো। তার যে দু’টো বাচ্চা আছে, সে যে বিবাহিত! আর আজ তার বিবাহিত জীবনের প্রথম দিন ছিল শশুর বাড়িতে। সে কি কোন কান্ড ঘটিয়ে ফেললো নাকি? বাজে কয়টা? অনেক দেরি হয়েছে কি? কতোটা সাতটা নাকি আটটা? ইয়া আল্লাহ! ইরা ছুটে বিছানা থেকে নামলে পায়ে মৃদু ব্যথার অনুভূতিতে চোখমুখ কুঁচকে নেয়। সে কি ভুলে গেলো না-কি তার পা পোড়া! চাইলেই সে যেমন তেমন করে হাঁটতে পারবে না। সে সতর্কতার সাথে পা ফেললো।
পুরো ঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। ঘরের এক পাশের দেয়ালে একটা আয়তাকার হোয়াইট বোর্ড দেখে তার কপাল কুঁচকে গেলো। কিন্তু সে সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ঘড়ি খুঁজতে লাগলো। ঐ তো সদর দরজার উপর ঘড়ি কিন্তু ঘড়ির কাঁটা দেখতেই তার চোখ কপালে। একটা বত্রিশ! সে চোখ ডলতে লাগলো। না তখনো একটা বত্রিশ ই দেখা যাচ্ছে। ভয়ে, লজ্জায় ঘেমে উঠলো ইরা। সবাই নিশ্চয়ই তার উপর রেগে গিয়েছে? কি ভাবছে? আর বাচ্চারা? রাগে দুঃখে ইরার কান্না চলে আসলো। সে দরজার দিকে যেতে নিলে বারান্দার থাই ভেদ করে একটা পা দেখাগেলো। সে দ্রুত বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। থাই ঠেলে খুললে ভেসে উঠলো চারটা মুখ। ইরার দেহ শ্রান্ত হয়ে আসে দৃষ্টি নন্দনীয় দৃশ্য দেখে। রোদে বসা মিলা শ্রবণের গায়ে ময়েশ্চারাইজার মাখছে। অদূরে বাথটাবের পাশে বসা শ্রেয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলছে ইরাম আর গলা ফাটিয়ে কাঁদছে, রাগ দেখাচ্ছে। অন্যদিকে শ্রেয়ান গা দুলিয়ে হাসছে মেয়ের উদাম দেহ বুকে জড়িয়ে। হাসতে হাসতেই শ্রেয়ানের চোখ যায় দরজার দিকে। এলোমেলো শাড়িতে অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী এক নারী দাঁড়িয়ে। নারীটিকে শাড়িতে দেখে গতকাল যতোটা মুগ্ধ হয়েছিলো তার থেকেও বেশি মুগ্ধ হয় এই সাদাসিধে সুতির শাড়িতে তার স্ত্রীর বেশে ঘুরে বেড়ানো দেখে। সে হাসিমুখে বলল,
–“গুড নুন বিবিজান। ঘুম ভেঙেছে?”
ইরা তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। এগিয়ে এসে আ উ করে কিছু বলে ইরামকে নেয়ার জন্য হাত বাড়ালো। শ্রেয়ান দিলো না। বরং আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে ইরার দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–“ইরা ম্যাজিক দেখবেন?”
ইরা বুঝলো না। শ্রেয়ান ইশারায় বললো তাকে ইরামকে দেখতে। বলেই শ্রেয়ান মেয়ের পা দুটো জোরপূর্বক বাথটাবের পানির ভেতর রাখলো; ওমনি ইরাম ভয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো। বিলম্বহীন এক লাফে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে বসলো। শ্রেয়ান আবারো উচ্চস্বরে হেসে উঠলো মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে। কৌতুহলী ইরা নিজেও হেসে ফেললো মেয়ের লাফ দেখে। মেয়েটা তার পানি ভয় পায়। তাকে কোনভাবেই পানিতে নামানো যায় না।
শ্রেয়ান মেয়ের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
–“আচ্ছা মা, পাপা স্যরি। পাপা আর দুষ্টু করবো না। এখন আমরা ভদ্র বাচ্চাদের মতো গোসল করবো। পাপা তোমায় পানিতে নামাবোই না।”
ইরাম শুনলো না সে কোনমতেই শ্রেয়ানের গলা ছাড়বে না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। শ্রেয়ান ছাড়াতে চাইলেও ইরাম কেঁদে উঠছে। ইরা এবার মেয়েকে আনতে চাইলো কিন্তু সে তার সাথেও যাবে না। মোটকথা সে কারোর কোলেই যাবে না; গেলেই সবাই তাকে পানিতে ছেড়ে দেবে এই ধারণা তার মনে। অগত্যা শ্রেয়ান বুকে জড়িয়েই নিজের গায়ে পানি ঢালতে লাগলো। বাবা মেয়ে দু’জন একসাথে গোসল করে উঠলো।
ইরা এগিয়ে যায় ছেলের কাছে। মাকে দেখতেই শ্রবণের উৎফুল্লতা বেড়ে গেলো। সে হাত পা নাড়াতে লাগলো। ইরা স্মিত হেসে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। মিলার থেকে তার প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে নিজেই তৈরি করে দিলো। কিন্তু মাকে পেতেই সে মেকি কান্না জুড়ে দিলো দুধ খাওয়ার জন্য। ইরা দ্রুত তাকে দুধ দেয় সকাল থেকে খায়নি যে!
ছেলেকে খাওয়াতে খাওয়াতেই ইরার চক্ষু শীতল হয়ে আসে, লাজ ভর করে— উদাম দেহে বাবা মেয়েকে শুধু তোয়ালে পড়ে বাথরুম থেকে বের হতে দেখে। চোখ নামাতে গিয়েও নামাতে পারলো না ইরা। নির্লজ্জের মতো তাকিয়েই থাকলো। এটা যে তার জীবনের না বলা এক বহুল আকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। অন্তঃস্থল অনবরত প্রার্থনা করছে এটা যেনো স্বপ্ন না হয়, সামনের মানুষটা যেনো এমনি হয়। কখনো তার পরিবর্তিত ভয়ঙ্কর রূপ ইরাকে আর তার মেয়েকে দেখতে না হয়। তার মেয়েটা যেনো একটু বাবার স্নেহ পায়।
শ্রেয়ান ইরামকে তৈরি করতে লাগলো। ইরা দ্রুত শ্রবণের খাওয়া শেষ করলো। কাল থেকে সে এই ঘর থেকে বের হয়নি সকলে কি ভাবছে নতুন বউ কি-না—ছিঃ! নিজেকে ধিক্কার জানায় ইরা। সে শ্রবণকে নিয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। নতুন ঘর সে কিছু চেনে না কোথায় কি? খুঁজতে খুঁজতে মিলাকে পেলো। আ উ শব্দ করে বোঝায় মা কোথায়? মিলা কপাল কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করলো। জিজ্ঞাসা করে,
–“চাচিরে খোঁজতাছেন? আসেন আমার সাথে।”
মিলা নিয়ে গেলো তাকে রান্নাঘরে। সুমনা আর সুস্মিতা রান্নাঘরে ছিল। সুস্মিতা বিকালে চলে যাবে। তাই এখন মায়ের সাথে সময় কাটাচ্ছে। সুমনা ইরাকে দেখেই এক গাল হাসলো। কিন্তু তার হাসি মিলিয়ে গেলো ইরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই। মেয়েটি তেড়ে এসে আ উ শব্দ করে অস্ফুট স্বরে কিছু বলছে। সুস্মিতা আর সুমনা ভড়কে যায়। ইরামকে নিয়ে ইরাকে খুঁজতে খুঁজতে আসা শ্রেয়ান অবাক হলো স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে। সে দ্রুত এগিয়ে যায় ইরার কাছে। একহাত মাথায় রেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
–“কি হয়েছে? ইরা কাঁদছেন কেনো?”
ইরা কাঁদছে আর বড়ো বড়ো নেত্রে কৈফিয়ত দিয়ে যাচ্ছে একাধারে। শ্রেয়ান নিগুঢ় চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। বুঝতে পেরে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো। মাকে বলল,
–“সে এতো দেরি করে ঘুমানোর জন্য কৈফিয়ত দিচ্ছে তোমায়। সে তো জানেই না আমি তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। বলো কিছু, নয়তো কান্না থামবে না।”
সুমনা আর সুস্মিতা হাসলো মেয়েটির সরলতায় সাথেই দায়িত্ববোধ নিয়ে মনের ভেতর গেঁথে যাওয়া ভয় দেখেও ব্যথিত হলো! সুমনা এগিয়ে আসে। ইরাকে এক হাতে আগলে নিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দেন। ইশারা ইঙ্গিত আর শব্দের বুননে বোঝায়,
–“আমি মরলে পর এই সংসারের দায়িত্ব পুরোটা তোর। আপাতত আমার নাতি নাতনি আর ছেলের জীবনটা থেকে সব দুঃখ দূর করে সুখ ফিরিয়ে আন। সংসারের চিন্তা করতে হবে না। এখানে ভাবাভাবির মতো কেউ নেই।”
ইরা তবুও আ উ শব্দ করে যাচ্ছে। শ্রেয়ান বিরক্ত হয়ে মাকে ইশারা করে, তার হাত টেনে রান্নাঘর থেকে বের করে আনলো। বাব মায়ের কোলে থাকা ইরাম আর শ্রবণ গোলগোল নয়নে দেখছে দু’জনকে । মেয়েটিকে ঘরে এনে ঠিক নিজের সামনে দাঁড় করায় শ্রেয়ান। অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
–“হুটহাট এভাবে কাঁদার কি মানে ইরা? সবাই সমান হয় না। আপনাকে আমি নিজের করেছি আপনার চোখের পনি নিষিদ্ধ করার জন্য, কিন্তু আপনি? এখানে কেউ কিছু কি বলেছে আপনাকে? তবে আপনি কাঁদছেন কেনো?”
সম্মুখের লোকটির চেহারায় নম্রতা মিলিয়ে যেতে দেখে ইরা চুপসে গেলো। লোকটি রাগ দেখাচ্ছে? ছেলেকে আঁকড়ে ধরে সে ভয়ে কেমন গুটিয়ে গেলো। শ্রেয়ান মাথা নামিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালো। মেয়েটি হঠাৎ দূরে সরে যাওয়া দেখলো নিরবে। পরপরই তাকায় ভয়ার্ত মুখটির দিকে। মেয়েটির মাঝে সংকীর্ণ ডমিনেটিং সংসার জীবনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া আর ভয় স্পষ্ট! তাকে আর তার পরিবারকেও ইরা এমনি ভাবছে। ভাবতেই শ্রেয়ান নিজের রাগ গিলে ফেললো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সে হাঁক ছেড়ে মিলাকে ডাকলো। মিলা ছুটে আসে। শ্রেয়ান ইরামকে তার কোলে দিয়ে বলে,
–“বাইরে থেকে পাঁচ মিনিট ঘুরিয়ে আন। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।”
মিলা মাথা নেড়ে ইরামকে নিয়ে চলে যেতেই, শ্রেয়ান এক পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় মেয়েটির কাছে। শ্রবণকে কোল থেকে নিয়ে বিছনায় শুইয়ে দেয়। পুনশ্চঃ মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে ছাড়িয়ে নেয়া হাতটি আবার আঁকড়ে ধরলো। ইরা সচকিত হয়। জড়তায় গুটিয়ে যাওয়া দেহটি আর সরতে দিলো না শ্রেয়ান। বরং আরো নিবিড়ভাবে আগলে নেয় নিজের সাথে। অনাকাঙ্ক্ষিত আলিঙ্গনে কেঁপে ওঠে ইরার ভয়ার্ত বদন। সেই কাঁপনে পিঠ জড়িয়ে রাখা আঁচল অনাদরে পড়ে গেলো। মেয়েটির দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকতে থাকতেই শ্রেয়ানের দৃষ্টি হকচকায়, সরে যাওয়া আঁচলের আড়ালে থাকা ভয়ের কারণ দেখে। ম্লান হয়ে আসে অন্তঃস্থল। তার ধারণার থেকেও কি শোচনীয় ছিল ইরার জীবন? মেয়েটির ক্রন্দনরত চোখে যে স্পষ্ট পুরুষ মানুষ আর সংসার জীবনের প্রতি ভয়। ভয়ের কারণ ও ততক্ষণে শ্রেয়ানের নিকট স্পষ্ট। শ্রেয়ানের চোখের সামনে থাকা সেন্টার টেবিলের আরশিতে ভেসে উঠেছে এক লতানো দেহের পৃষ্ঠদেশ। গভীর ঐ ক্ষতগুলো যে ঠুনকো পোশাক ঢাকতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফাঁকা ঢোক গিললো শ্রেয়ান। লালচে, টলমলে আঁখি নিয়ে পড়ে যাওয়া আঁচলটা দিয়ে আবার পিঠটা ঢেকে দিলো।
ক্রন্দনরত মুখপানে তাকিয়ে একহাতে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। কপালের এলোমেলো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে চোখে চোখ রেখে, ক্ষীণ স্বরে বলে,
–“ইরা, এতো ভয় কেনো মনে? কেনো মনে হয় সুখ অসম্ভব আপনার জন্য? দুঃখের পালা শেষ ইরা। আমাদের জীবনে আসা সব মানুষ এক হয় না। জীবনে ক্ষত যদি সৃষ্টি হয় তবে সেই ক্ষত পূরন করার জন্য ও সৃষ্টিকর্তা কোন না কোন উপায় ভেবে রাখেন। সৃষ্টিকর্তা এতোটা নির্দয় নয় যে আজীবন কাউকে শুধু দুঃখ’ই দিয়ে যাবে। সে যদি দুঃখ দেয় তবে তার থেকে দ্বিগুণ সুখ ফিরিয়ে দেয়। এই জীবনে আর কখনো আপনার মন আর দেহে কখনো কোন ক্ষত সৃষ্টি হতে দেবো না। কি করলে আপনি এটা বিশ্বাস করবেন আর আপনার মন থেকে ভয় সরে যাবে?”
কর্নকুহর সর্বদা নিস্তব্ধতা আঁকড়ে ধরে থাকায় মেয়েটি অগোচরেই থেকে গেলো আশ্বাসের বানী গুলো থেকে। কিন্তু চোখেমুখের নম্রতা আর শান্ত দৃষ্টিতে যে অঢেল আদর ছিল। অবুঝ ইরা বহুকষ্টে অস্ফুট উচ্চারণ করলো,
–“এহ্!”
শ্রেয়ার ম্লান হাসলো। দু হাতের আজলায় ছোট্ট মুখটি নিয়ে, বদ্ধ নেত্রে ঠোঁট এগিয়ে কপালে দীর্ঘ এক সময় নিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। প্রথম সেই স্পর্শে রাজ্যের নমনীয়তায় মেয়েটির ভয়ার্ত অন্তঃস্থল শ্রান্ত হয়। নত মস্তকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। শ্রেয়ান সরে আসে। একহাতে জড়িয়ে নিয়ে পা বাড়ায়। দাঁড়ায় গিয়ে হোয়াইট বোর্ডটির সামনে। মার্কার হাতে নিয়ে বোর্ডে লিখলো।
–“এতো কষ্ট করে কিছু বোঝানোর প্রয়োজন নেই। যা বলার এখানে লিখবেন।”
ইরা উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকায় বোর্ডটির দিকে। চঞ্চল হাতে মার্কার টা হাতে নিয়ে বোর্ডে লিখলো,
–“আমি এতো ঘুমালাম কি করে?”
শ্রেয়ান আরেকটা মার্কার তুলে তার নিচে লিখলো,
–“আপনার ঘুমের প্রয়োজন ছিল তাই ঘুমিয়েছেন।”
–“আমি এতো বেলা করে এই জীবনে কখনো ঘুমাইনি। এটা স্বাভাবিক ঘুম নয়। আমি কিভাবে এতো ঘুমালাম, সত্যি করে বলুন?”, ইরা আবার লিখলো। শ্রেয়ান নিচে লিখলো,
–“ওষুধের প্রভাবে?”
ইরা অবাক পানে তাকায়। লিখলো,
–“মানে?”
–“মানে আমি গতকাল আপনাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলাম।”
–“কেনো?”, ইরা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে লিখলো।
–“ডাক্তার বলেছে তাই।”
–“ডাক্তার বললেই করতে হবে? আমি একদম ঠিক আছি। তারা বেশিবেশি বলে।”
শ্রেয়ান ম্লান হেসে লিখলো,
–“ডাক্তারের কথা অযুহাত মাত্র ইরা। আমি তো নিজের সুখ নিশ্চিত করছি। আপনাকে সুখী দেখলে আমার অস্থির অন্তঃস্থলে প্রশান্তি নেমে আসে। ঘুমন্ত ইরাকে দেখলে আমার শান্তি লাগে। কে কি ভাবলো, কতো কাজ এগুলো ভাবা বাদ দিন ইরা। আপনি শুধু আমাদের তিন জনের ভাগের ভালোবাসাটা আমাদের দেবেন, আর আপনার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দেখার দায়িত্ব আমার।”
ইরা নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় শ্রেয়ানের মুখপানে। পুরুষ মানুষ এভাবে ভালোবাসা চায়? গালে পুরুষালী হাতের উল্টোপিঠ আলতোভাবে ছুঁয়ে যেতেই ইরা সচকিত হয়। শ্রেয়ান হাত নামিয়ে নেয়। বোর্ডে লিখলো,
–“এখন গোসল করতে যান। আপনার খাবার খেয়ে হবে , ওষুধ খেতে হবে।”
ইরা মাথা নেড়ে সায় জানায়। কাবার্ডের কাছে গিয়ে কাবার্ড খুললে এক ঝাঁক কটনের শাড়ি ভেসে উঠলো। সে বাছার জন্য হাত বাড়াতে নিলে কেউ ব্যস্ত হাতে শাড়িগুলো নেড়ে নেড়ে দেখতে লাগলো। শ্রেয়ান বেছে বেছে হালকা মিষ্টি রঙের শাড়িটি ইরার গায়ে ধরলো। হেসে বলল,
–“এটা চমৎকার, এটা পড়ুন।”
ইরা নিরবে শাড়িটি নিয়ে নেয়। বিছানায় শুয়ে থাকা ছেলের দিকে তাকালে ছেলে ফোকলা হাসলো। ইরা এগিয়ে গিয়ে তাকে কোলে নেয়। আদুরে ভাবে তার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। ছোট্ট এই ছেলেটি তাকে দেখলেই শুধু হাসে।
ইরা গোসল করে বের হয়। তখন আঁচলের নিচে মুখ লুকিয়ে দুধ খাচ্ছে ইরাম আর তাদের সামনে বসা প্লেট হাতে বসা শ্রেয়ান। পরবর্তী লোকমাটা ইরার মুখে তুলে দিতেই ইরাম আঁচলের নিচ থেকে মুখ বের করে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায় শ্রেয়ানের দিকে। দৃষ্টি তার চোরা। এমনি চোরা দৃষ্টিতে সে শ্রেয়ানকে পর্যবেক্ষণ করে। শ্রেয়ান তার দিকে তাকাতেই ওমনি সে আবার মুখ লুকায় আঁচলের নিচে। শ্রেয়ান গা দুলিয়ে হাসলো। বলল,
–“দেবো দেবো? আদর দেবো? ইরু বুড়ি কি আদর নেয়ার জন্য পাপাকে খোঁচাচ্ছে?”
ইরাম অস্ফুট স্বরে” উহ” শব্দ করলো। যার মানে সে রাগ দেখিয়েছে। শ্রেয়ান হেসে ছেলের দিকে তাকায়। যে কি-না মায়ের আঁচল নিয়ে শুয়ে শুয়ে খেলছে আর উ শব্দ করে যাচ্ছে।
সেদিনের সেই কান্নাটাই যেনো ইরার জীবনে শেষ দুঃখের কান্না ছিল। এরপর থেকে একে একে তার স্বপ্নগুলো বাস্তবতায় রূপ নিতে লাগলো। শ্রেয়ানের এবং তার পরিবারের আন্তরিকতায় ইরা ভুলতে বসলো বিগত জীবনের তীক্ত অভিজ্ঞতাগুলো। সুখ তখন কেবলি ধরা দিচ্ছিলো ইরার জীবনে। কিন্তু দেখাযাক এই সুখ ইরার জীবনে বাস্তবতা হয়েই থাকে নাকি কোন তমসায় মিলিয়ে যাওয়া দুঃস্বপ্ন হয়ে।
কেটে যায় বিশ দিন। ছোট্ট বাচ্চাদুটির জীবনে সুখ হয়ে আসা, ইরা শ্রেয়ান মাতৃত্ব পিতৃত্বের স্থানথেকে জিতে গেলেও বৈবাহিক সম্পর্কে এখনো পিছিয়ে। বাবা মায়ের কমতি পূরণ করা দুটি সত্ত্বা তখনো বিচ্ছিন্ন ই থেকে গেলো। সংসার জীবনে ইরার কতৃত্ব বাড়ে। প্রথম দিন ইরার হাতে রান্না খেয়ে সকলের মুখ হা। এরপর ঘরের সবাই শুধু সুযোগসন্ধানী! সুযোগ পেলেই বলবে বাচ্চাদের আমরা রাখছি তুমি গিয়ে একটু রান্না করো! মজার মজার! ইরা তখন হেসে ফেলতো! সন্তানদের দেখভাল করেও তার যথেষ্ট সময় অবহেলিত পড়ে থাকে। কেননা তারা বেশিরভাগ দাদা দাদু, মিলা আর বাবার কাছেই থাকে। তারপর থেকে নিজেই রান্না করে।
শ্রবণ নামক আড়াই কেজির রুগ্ন বাচ্চাটির ওজন এখন তিন কেজি। এখনো আন্ডার ওয়েট হলেও বেশ শক্তিসামর্থ্য হয়েছে তার। প্রচুর খেলাধুলা, অস্ফুট স্বরে আ উ শব্দ করা তার লেগেই থাকে। কিন্তু মায়ের আঁচল সে ছাড়তে নারাজ। তেমনি ইরামের মাঝেও পরিবর্তন এসেছে। অবুঝ বাচ্চাটি পরিবর্তিত ঐ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও শ্রেয়ানের প্রতি বিরক্তি তার এক চুল পরিমান কমেনি। কিন্তু দিনশেষে সে শ্রেয়ানের প্রতি তার বিরক্তিটাকেও নিজের অভ্যাস হিসেবে মেনে নিয়েছে। এই যে তার খাওয়া, ঘুম গোসল সবটা শ্রেয়ান করে। মায়ের কাছে থাকে শুধু দুধের তৃষ্ণা মেটানোর সম টুকু। এখন আর সে জেদ দেখায় না তাকে তৈরি করার সময়, গোসল করার সময় বাবার গলা জড়িয়ে ধরে গোসল করতে হয় আর ঘুমানোর সময় বাবার কাঁধে চড়িয়ে চড়িয়ে ঘুম পাড়াতে হয়। এগুলো তার রোজকার অভ্যাস।
দুপুর এগারোটা বাইশ। রান্নাঘর থেকে ব্যস্ত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকলে ললাটে ভাঁজ পড়লো ইরার। সে সরু দৃষ্টিতে হোয়াইট বোর্ডের তাকায় আরেকবার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রেয়ানের দিকে। যে কি-না থমথমে মুখে বাচ্চাদের তৈরি করছে, ঘুরতে যাবে শশুর আব্বুর অফিসে। সে দৃষ্টি সরিয়ে বোর্ডের কাছে যায়। গোটা গোটা অক্ষরে কেউ আক্রোশ নিয়ে লিখেছে,
–“আগেই বলেছি টুকি টাকির মা কে শুধু বাচ্চাদের জন্য বিয়ে করিনি। তবুও টুকি টাকির বাবাকে অবহেলা করা হয় কেনো?”
বাচ্চা বাচ্চা আকুতিতে ইরা মিটিমিটি হেসে পিছু ঘুরে তাকায়। শ্রেয়ান নত মস্তকে কাজ করে যাচ্ছে তার দিকে তাকাচ্ছেও না। সে মিটিমিটি হেসে মার্কারটা তুলে নিয়ে লিখলো,
–“কোথায় অবহেলা করছি?”
লিখে ইরা আবার পিছু ঘুরে তাকালো। লোকটির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য দুই হাত জোরে জোরে নাড়াতে লাগলো। ফলস্বরূপ টুং টাং শব্দে মেতে উঠলো ঘরটি। তবুও ব্যক্তিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলো না ইরা। ইরা হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো হাতে থাকা দুই জোড়া চুরির দিকে। দু’হাতে চারটা চুরি পড়ানোর কারণ—তার উপস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য। হাঁটার তালে যখন চুরিতে শব্দ হয় তখন সকলে বুঝতে পারে ইরা আশেপাশে আছে। ব্যর্থ ইরা এবার বোর্ডে মার্কার দিয়ে শব্দ করতে লাগলো। কিন্তু তবুও রাগী লোকটা তাকাচ্ছে না। নিরূপায় ইরা এবার নিজের উপর জোরজবরদস্তি করে অস্ফুট স্বরে শব্দ করার চেষ্টা করলো,
–“এহ্, এহ্!”
এতক্ষণে শ্রেয়ান চোখ তুলে তাকালো। ইরা একগাল হাসলো তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরে। শ্রেয়ান থমথমে মুখে এগিয়ে আসে। মার্কারটি ইরার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে লিখলো,
–“অবহেলা করা হয় না বলছেন? ঘরের মাঝে এমনভাবে চলাফেরা করেন যেনো আমি নেই এই ঘরে। বাচ্চাদের ব্যতীত আপনার আর কোন দায়িত্ব নেই। এর জন্যই কি বিয়ে করেছি টুকি টাকির মাকে?”
ইরা মিটিমিটি হেসে শ্রেয়ানের থেকে ছিনিয়ে নিলো মার্কারটি। চঞ্চল হাতে লিখলো,
–“তো কিসের জন্য বিয়ে করেছেন টুকি টাকির মাকে?”
শ্রেয়ান ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাকায় হাসতে থাকা মেয়েটির দিকে। থমথমে মুখে মার্কারটি ছিনিয়ে নিয়ে লিখলো,
–“রোজ সকালে যেনো কারোর নরম স্পর্শে ঘুম ভাঙে। সকালে এক কাপ চা করে নিয়ে আমার পাশে বসে। যখন বাইরে যাবো তখন যেনো কেউ প্রয়োজনীয় সবকিছু একটু এগিয়ে দেয়। যখন অসুস্থ হয়ে পড়বো তখন সে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। দৈনন্দিন জীবনে যখন প্রচুর ক্লান্ত হয়ে পড়বো তখন কেউ আমার ক্লান্ত দেহ জড়িয়ে ধরে সকল ক্লান্তি শুষে নেবে। রাতের আঁধারে কাউকে জড়িয়ে ধরে পুরো দিনের ভালো খারাপ শেয়ার করতে পারবো তার জন্য! কিন্তু আপনি? আপনি তো আমায় পাত্তাই দেন না! রাতেও জড়োসড়ো হয়ে কাঠ হয়ে শুয়ে থাকেন।”
ইরা পিটপিট করে তাকিয়ে থাকলো লেখাগুলোর দিকে। শ্রেয়ান রাগ ঝেড়ে আবার লিখলো,
–“বাইরে থেকে আসার পরে এক কাপ চা খাওয়ার অভ্যাস। মায়ের থেকে এই দায়িত্বটা নিয়ে নিবেন। আল্লাহ জানে হাতে জাদু আছে নাকি! চা এর মতো লাল পানিও ও এতো সুস্বাদু কেনো লাগে? কি অদ্ভুত!”
লেখাটির পাশে একটা এংরি ইমোজি এঁকে শ্রেয়ান ইরামকে বেবি ট্রলিতে বসিয়ে বেরিয়ে গেলো। শ্রবণ বুকে ঝুলছে। ইরা অদ্ভুত নয়নে একবার শ্রেয়ানের গমনের পথ আরেকবার লেখাগুলো দেখে। কিয়ৎকাল বাদ সে ফিক করে হেসে ফেললো।
চলবে….