রক্তিম পূর্ণিমা পর্ব-০৩

0
66

#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি

পলক সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে চলে এসেছে রান্নাঘরে। পলককে রান্নাঘরে দেখে তার ভাবি রুহানি বলল,
“তুমি এখানে কি করছ?”

পলক হালকা হেসে বললে,
“গতকালকেই তো তুমি বললে ভাবি যে, তোমার নাকি সবার জন্য রান্না করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাই আমি ভাবলাম আমিই রান্নাটা করে দেই। এতে যদি তোমার কষ্ট একটু কমে।”

রুহানি খানিকটা অপমানিত বোধ করল। বেশ কড়া গলায় বলল,
“এখন রান্না করছ ঠিক আছে কিন্তু এরপর তো আবার আমাকেই রান্নাটা করতে হবে। তোমার অসুস্থ মা তো কিছু করবে না। তাই একদিনের জন্য এসব না করলেও চলবে।”

“একদিনের জন্য কেন? আমি নাহয় প্রতিদিনই তোমাদের রান্না করে দেব।”

“প্রতিদিন!”

“হুম, প্রতিদিন। শুধু রান্না নয়, ঘর গোছানো, কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে সবকিছু নাহয় আমিই করব। তুমি শুধু পায়ের উপর পা তুলে বিশ্রাম নিও।”

“আর তোমার শ্বশুর বাড়ির কাজ কে করবে?”

“আমি নাহয় আর শ্বশুর বাড়ি ফিরব না।”

“বেশ ভালোই মজা করতে পারো।”

“আমি মজা করছি না ভাবি।”

পলকের কথা শুনে এবার রুহানির মুখে আঁধার নেমে এলো। এবার রুহানি বেশ গম্ভীর স্বরে বললো,
“সত্যি করে বলো তো কি হয়েছে? তোমার শ্বশুর বাড়ির লোক কি তোমায় বের করে দিয়েছে নাকি? যদি এমন হয়েও থাকে তাহলে আমি বলব, তুমি যদি ভেবে থাকো এখানে আশ্রয় পাবে তাহলে তুমি ভুল ভাবছ। আমরা এখানে ধর্মশালা খুলে রাখিনি যে,জনে জনে লোক পুষব। এমনিতেই তোমার বাপ-মা বসে বসে আমাদের অন্ন ধ্বংস করছে। তার উপর কি তুমিও আমাদের ঘাড়ে বসে খেতে চাচ্ছ নাকি?”

রুহানির মুখে এমন কথা শুনে পলকের ভীষণ খারাপ লাগে। তার বুকে তীব্র রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পলক এবার খানিক হেসে বলে,
“তুমিও না ভাবি। আমার মজাকে সিরিয়াস ভাবে নিচ্ছ। আমি তো আজই এখান থেকে ফিরে যাব।”

বলেই পলক রান্নাঘর থেকে বের হয়। রুহানি পলকের বেরিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“আপদ বিদায় হলেই বাঁচি।”

পলক রুহানির ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের জামা-কাপড় গোছাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। নূর বেগম পলকের কাণ্ড দেখছেন। তার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হচ্ছে। পারভেজ ইসলাম হন্তদন্ত হয়ে রুমে ছুটে এসে বলেন,
“তুই এই অবস্থায় কোথায় যাবি, মা?”

পলক নির্লিপ্ত হেসে বলে,
“যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকেই যাব।”

পারভেজ ইসলাম কাদো কাদো স্বরে বলেন,
“আজ আমার তোর বাবা হিসেবে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। তোর এরম পরিস্থিতি অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না।”

“তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করিও আব্বু..এটাই আমার জন্য যথেষ্ট হবে।”

নূর বেগম বলে ওঠেন,
“তুই কোথাও যাবি না পলক। তুইও আমাদের মেয়ে। তোরও এই বাড়িতে অধিকার আছে।”

পলক পারভেজ ইসলামের দিকে তাকায়। পারভেজ ইসলাম একদম চুপ। পলক বলে,
“তুমি কি সব সম্পত্তি ভাইয়াকে লিখে দিয়েছ আব্বু?”

পারভেজ ইসলাম আর কিছু বলার মতো খুঁজে পান না। পলক পারভেজ ইসলামের নীরবতার উত্তরটা বুঝতে পারে। তাই সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“এখন এই বাড়িতে কে থাকবে, কে থাকবে না সব সিদ্ধান্ত ভাইয়া আর ভাবিই নেবে। কারণ এই বাড়িটা এখন তাদের।”

নূর বেগম ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলেন,
“তাই বলে আমরা নিজের মেয়েকে এই সময়ে নিজেদের কাছে আশ্রয় দিতে পারব না! এ কেমন নিয়তি!”

পারভেজ ইসলাম নিজের স্ত্রীর পাশে বসে বলেন,
“এটাই বুঝি আমাদের কপালে লেখা ছিল নূর। আমরা হলাম এই দুনিয়ার সবথেকে অসহায় মা-বাবা! যাদের তার সন্তানের পাশে দাঁড়ানোর মুরোদ নেই।”

নূর বেগম বুঝতে পারেন না এই অবস্থায় কি করবেন। পলকও নিজের সব জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত। নূর বেগম বলেন,
“অন্তত আজকের রাতটা এখানে কাঁটা। তারপর আমরা দেখছি কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা।”

“আমি চাইনা না আম্মু, আমার জন্য তোমাদের বিপদ বাড়ুক। বাড়ির যা পরিস্থিতি দেখছি আমার জন্য না তোমাদেরকেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। তার থেকে ভালো আমি নিজেই চলে যাই।”

নূর বেগম তবুও মানতে চান না। কিন্তু পলকও একরোখা। অবশেষে তিনি হার মেনে নেন। পারভেজ ইসলামকে বলেন,
“যাও আমার আলমারী খুলে আমার সোনার কানের দুল আর কিছু নগদ টাকা আছে সেটা নিয়ে এসো।”

পারভেজ ইসলাম চুপচাপ তাই করেন। নূর বেগম পলকের হাতে সেই সোনার কানের দুল আর কিছু নগদ টাকা তুলে দেন। অতঃপর বলেন,
“একজন ব্যর্থ মায়ের এই সামান্য ক’টা সাহায্য নিজের কাছে রাখ। এটা দিয়ে যতদিন চলতে পারিস চল। যদি কোন একটা ব্যবস্থা হয়..”

পলক এসব নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে,
“এসবের কোন দরকার নেই আম্মু। তোমরা এসব নিজেদের কাছে রাখো, তোমাদের অবস্থাও তো ভালো না। যদি তোমাদের কোন বিপদে এসব কাজে লেগে যায়।”

নূর বেগম শক্ত গলায় বলেন,
“না, এসব তোকে রাখতেই হবে।”

পারভেজ ইসলামও বলেন,
“তোর মা যা বলছে তাই কর। এখন সময়টা আবেগের নয়, বিবেকের। আমাদের দুই বুড়ো-বুড়ির জীবন তো কোন ভাবে চলে যাবে এখানে। তোর সামনে তো এখনো একটা পুরো জীবন বাকি। আমরা তো এটাও জানি না,আমাদের অবলা মেয়ে কিভাবে চলবে সামনের দিনগুলো। দেখ যদি কোন নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র বা আশ্রমে যদি থাকার কোন ব্যবস্থা করতে পারিস। তাহলে অন্তত আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারি।”

পলক আর না করতে পারে না। বাধ্য মেয়ের মতো এসব কিছু নিজের কাছে রেখে দেয়।

★★★
মা-বাবার জোরাজুরিতে সেদিনটা বাড়িতেই কাটায় পলক। যদিও এর জন্য পাভেল এবং রুহানির অনেক তিক্ত কথা শুনতে হয়েছে কিন্তু সেসব সে গায়ে মাখেনি। সেদিনটা কোনভাবে কাটায়। সন্ধ্যার দিকে পারভেজ ইসলাম যখন বাজারে যান এবং নূর বেগম ঘুমে আছন্ন এমন সময় পলক একাকী বাড়ি থেকে বের হয়। কেননা, সে জানে। মা-বাবা তাকে বের হতে দেয়ার ভরসা পাবে না। কিন্তু এখানে থেকে সে তাদের বিড়ম্বনায় ফেলতে চায় না।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে পলক চোখের জল মুছে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে।

ধীরে ধীরে রাত বাড়তে থাকে। একা এক নারীর জন্য যে এই রাত নিরাপদ নয়। পলকের সাথেও হলো তাই। সে লক্ষ্য করছিল কে বা কারা তার পিছু নিচ্ছে। পলক ভয় পেলো না। তার মতো নারীদের যে ভয় পেতে নেই। নিজের সাথে আনা ছুরিটা বের করে নিলো। এটা আত্মরক্ষায় কাজে দিতে পারে। অতঃপর সামনে হাটা শুরু করল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝত পারল ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। অনেকগুলো ছেলেই হয়তো তার পেছনে পড়ে আছে। এবার আর পলকের কাছে কোন উপায় ছিল না। সে দৌড়াতে শুরু করে। প্রাণপনে ছুটে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে প্রবেশ করে। অতঃপর সোজা সেই বাড়ির ঈশান কোণে অবস্থিত একটি রুমে যায়। সৌভাগ্যক্রমে রুমটিতে দরজা ছিল। পলক দরজা লাগিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। নিজের সাথে ঘটা সব ঘটনা মনে করে কাঁদতে থাকে। সে নিজের ভাগ্যকে ভৎর্সনা করে বলে,
“আমার সাথে কেন এমন হলো? জীবনে কি আরেকবার সুযোগ পাব আমি? যদি একবার সুযোগ পেতাম অতীতে ফিরে যাবার তাহলে নিজের অতীতে করা সব ভুল শুধরে ফেলতাম। তাহলে হয়তো আজ আমায় এই দিন দেখতে হতো না। কিন্তু আমি কি আর সেই সুযোগ পাবো?”

বলেই কাঁদতে থাকে। এমন সময় পলক লক্ষ্য করে তার মুখে রক্তিম আলো এসে পড়ছে। সে রুমের জানালা দিয়ে দেখতে পায় আজ আকাশের চাঁদটা বেশ বড় এবং রক্তিম। পলকের মনে পড়লো আজই সেই বিশেষ “রক্তিম পূর্ণিমা” যা ১ হাজার বছরে এক বার হয়। রক্তিম আলোর তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়ল। পলক আর বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারল না। আলোর চোটে চোখ বন্ধ করে নিলো৷ এমন সময় সে লক্ষ্য করল তার আশেপাশের সবকিছু ঘুরছে। সে যেন হাওয়ায় ভাসছে। রক্তিম আলোর ঘূর্ণিপাক যেন তাকে কোন এক অন্ধকূপে নিয়ে যাচ্ছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨