রক্তিম পূর্ণিমা পর্ব-০৫

0
56

#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

পলক পাভেলের সাথে ভার্সিটি প্রাঙ্গনে এসে উপস্থিত হয়। পাভেল বাইক থামিয়েই পলকের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তুই চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাক। আমি না আসা পর্যন্ত এক পা নড়বি না। নাহলে কেউ ধরে র‍্যাগ ট্যাগ দিলে তখন আমায় বলতে পারবি না। আমি বাইকটা পার্ক করে রেখে আসছি।”

বলেই পাভেল চলে যায়। পলক পাভেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার অতীতের এই দায়িত্বশীল, যত্নশীল ভাইয়ের সাথে ২০২৪ এর পাভেলকে মেলানোর চেষ্টা করে। দুজনের মধ্যে কতই না তফাৎ! সত্যিই সময় এবং পরিস্থিতি মানুষকে অনেকটা বদলে দেয়। তবে পলক এখন একটা শপথ করে নেয় নিজের কাছে। সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে মনে মনে বলে,
“এবার যখন জীবন আমাকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে তখন আমি চেষ্টা করবো আমার ভাই যাতে না বদলে যায় সেই চেষ্টা করার।”

পলক এসবই ভাবছিল এমন সময় পেছন থেকে কেউ এসে তার চোখ দুই হাত দিয়ে ঢেকে ফেলে। পলক বিরক্তিতে মুখ দিয়ে “চ” জাতীয় শব্দ করে বলে,
“ফারিয়া আমার চোখ থেকে হাতটা সরা।”

ফারিয়া হাতটা সরিয়ে অবাক হয়ে বলে,
“তুই কিভাবে বুঝলি এটা আমি?”

পলক একটা স্মিত হাসি দেয়। ৫ বছর আগেও ঠিক এই ঘটনা ঘটেছিল। ফারিয়া এভাবেই তাকে চমকে দিয়েছিল। সেবার সে বোকা বনে গেলেও এবার আগে থেকে সব জানায় ফারিয়াকেই হতবিহ্বল করে দিলো। পলক একটু হেসে বলল,
“তোর নাকি ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স হয়েছে। তো তুই জগন্নাথ ভার্সিটিতে কি করছিস? ভুলে চলে এলি নাকি?”

ফারিয়া আমতা আমতা করে বলে,
“এমনি ঘুরতে এসেছি।”
পলক আবারো হেসে বলল,
“নাটক কম করো পিও,আমি খুব ভালো করেই জানি তোমার এই ভার্সিটিতেই চান্স হয়েছে।”

ফারিয়া তো আরো অবাক। পলক এত কিছু কিভাবে জানলো। এদিকে পলক খুব আনন্দ পাচ্ছে ফারিয়াকে এভাবে বিড়ম্বনায় ফেলে। কারণ ৫ বছর আগে ফারিয়া তাকে মিথ্যা বলে কতই না ঠকিয়েছিল! এসব ভাবতে ভাবতে পলকের মুখে হঠাৎ আঁধার নেমে আসে। তার মনে পড়ে বর্তমান সময়ে ফারিয়া মোটেই ভালো নেই। পলকের মতো সেও জীবনে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যা তার জীবন একদম তছনছ করে দিয়েছে বাজেভাবে। এমনকি বর্তমান ফারিয়ার অবস্থা পলকের থেকেও খারাপ৷ এসব ভেবেই পলক হঠাৎ ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি এবার শুধু নিজের না, তোর জীবনটাও শুধরে দেব। তোকে আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে দেব না।”

ফারিয়া তো পলকের এমন কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। ফারিয়া হলো পলকের বাল্যকালের বান্ধবী। হাইস্কুল থেকে তাদের বন্ধুত্ব শুরু এমনকি তারা একই কলেজেও পড়াশোনা করেছে। একে অপরের সেরা বন্ধু তারা। ফারিয়া একটু দুষ্টু, মিথ্যা বলে বোকা বানাতে পছন্দ করে তবে মনের দিক থেকে অনেক ভালো এবং পরোপকারী।

পলক ফারিয়াকে ছেড়ে দিতেই ফারিয়া বলে,
“এখানে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি? চল একটু সামনে থেকে ঘুরে আসি।”

“আগে তোর বিচারটা করি,,কেন আমায় মিথ্যা বলেছিলি।”

“ভেবেছিলাম তোকে চমকে দেব কিন্তু এখন তো নিজেই চমকে গেলাম! তুই সব ধরে ফেললি।”

পলক বাঁকা হাসে। হঠাৎ করেই তাদের কানে হট্টগোলের আওয়াজ আসে। ফারিয়া সামনে তাকিয়ে দেখে সেখানে বেশ ভীড় লেগেছে। তাই সে বলে ওঠে,
“পলক ঐ দেখ, ওখানে কেন জানি অনেক ভীড়। চল তো গিয়ে দেখি কি হয়েছে।”

বলেই সে সামনের দিকে পা বাড়ায়। পলকও তার পিছু পিছু যায়। গিয়েই পলক যা দেখে তাতে তার মানসিক শান্তি অনুভূত হয়। কয়েকজন সিনিয়র ছেলে-পেলে আরাফাতকে ঘিরে ধরেছে। তারা সবাই তাকে র‍্যাগ হিসেবে কান করে ১০০ বার উঠবস করতে বলছে কিন্তু আরাফাত তাদের সাথে তর্ক করে চলেছে। আরাফাতকে দেখেই পলকের মাথায় রাগ উঠে যায়৷ এই শয়তানটা তার সাথে যা করেছে তার প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা জাগে। সাথে পলকের এটাও মনে পড়ে, আজ থেকে ৫ বছর আগে এই দিনেই সে সিনিয়রদের সাথে আরাফাতকে এভাবে র‍্যাগ দেয়া নিয়ে তর্ক করছিল। এই আরাফাতের হয়ে আওয়াজ তুলেছিল, যেখান থেকে আরাফাতের সাথে তার সখ্যতার শুরু যা আদতে তার জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে। অতীতের কথা ভেবে পলক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। ফোঁস ফোঁস করতে করতে সম্মুখপানে এগিয়ে যায়।

সবার সামনে গিয়ে বলে,
“কি হচ্ছে এখানে?”

তখনই সিনিয়রদের মধ্যে শ্যামবর্ণের বেশ সুদর্শন এক ছেলে যার নাম হাসিব সে বলে ওঠে,
“তুমি কে? আমাদের মধ্যে ইন্টারফেয়ার করো না,,এই ছেলেটা ভার্সিটি নতুন এসে মাস্তানি দেখাচ্ছে। সিনিয়রদের মুখে মুখে তর্ক করছে। একে আমরা উচিত শিক্ষা দিব।”

আরাফাত একটা মাসুম ফেস করে পলকের দিকে তাকায়। ৫ বছর আগে এই মাসুম ফেস দেখেই পলক গলে গিয়েছিল এবং আরাফাতের হয়ে তর্ক করেছিল। তবে এখন তো পলক সেই আগের মতো নেই। তার মনে এখন আরাফাতের জন্য প্রবল ঘৃণা। তাই সে বলে ওঠে,
“একদম ঠিক করছেন আপনারা ভাইয়া। ক্যাম্পাসে নতুন এসে মাস্তানি,,সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি এসবের জন্য এই রাবিশটাকে উচিৎ শিক্ষা দিন। যেন আর কখনো এমন করার সাহস না পায়। আমি তো বলব, কান ধরে উঠবস করানো কম হয়ে যায় ওকে আপনারা হলরুমে নিয়ে গিয়ে উচিৎ শিক্ষা দিন।”

আরাফাত হতবাক হয়ে পলকের দিকে তাকায়। যেন সে অন্য কিছু আশা করছিল। পলক একটা বাঁকা হাসি দেয় আরাফাতের দিকে তাকিয়ে। এই ছেলে তার সাথে যা করেছে তার কড়ায় গণ্ডায় হিসাব মিলাবেই সে।

সিনিয়রদের মধ্যে পলকের এমন মন্তব্য নিয়ে বেশ কানাঘুষা শুরু হয়। হাসিব বলে,
“এই মেয়ে, তোমার কাছে কেউ পরামর্শ চায়নি। তুমি যাও এখান থেকে।”

পলকের ভীষণ রাগ হলো। সে বলল,
“আমি তো আপনাদের হয়েই কথা বললাম ভাইয়া। এই ছেলেটা আপনাদের সাথে বেয়াদবি করেছে জন্য তাকে উচিত শিক্ষা দিতে বললাম। এতে আমার ফল্ট কি?”

হঠাৎ এক গম্ভীর পুরুষালি স্বর ভেসে ওঠে,
“সিনিয়রদের পরামর্শ দেয়াই তোমার ফল্ট। প্রথমবার জন্য ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিলাম এরপর এমন করলে ডায়রেক্ট একশন নিব।”

স্বরটা অনুসরণ করে সেদিক পানে তাকায় পলক। হাতা ফোল্ড করা কালো শার্ট, কালো সানগ্লাস পরিহিত সুদর্শন শুভ্র তাগড়া এক পুরুষকে দেখতে পেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসে একটাই শব্দ,
“মেহরাজ ভাই!”

ফারিয়া এতক্ষণ দূর থেকে সবকিছু অবলোকন করছিল। পলককে সিনিয়ররা এমন ওয়ার্নিং দিতেই সে সামনে এসে পলকের হাত ধরে টেনে বলে,
“সিনিয়রদের মুখে মুখে তর্ক করতে যাস না পলক। এটা ডেঞ্জারাস হতে পারে। চুপচাপ চল এখান থেকে।”

পলক তবুও এক পাও সরে না। সে শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই সুদর্শন যুবক মেহরাজের দিকে। মেহরাজ পলকের এই দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। পলকের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে বলে,
“মানছি আমি অনেক সুদর্শন। তাই বলে এমন করে হ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকার কিছু হয়নি।”

পলক দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
“দুঃখিত ভাইয়া। আমি জুনিয়র, আমার আপনাদের ব্যাপারে কথা বলা উচিৎ হয়নি। আপনাদের যা ইচ্ছা আপনারা করুন।”

বলেই পলক সামনের দিকে আগায়। মেহরোজ কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। ফারিয়াও আসে পলকের পিছু পিছু। পলকের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তুই কি চিনিস ঐ লোকটাকে?”

“তোর এমন কেন মনে হলো?”

“তুই যেভাবে ওনার দিকে তাকিয়ে কথা বললি তাতে কেমন জানি ডাউট লাগল।”

পলক সামান্য হেসে বলে,
“উনি মেহরাজ চৌধুরী। এই ক্যাম্পাসের একটা পাতাও ওনার আদেশ ছাড়া নড়ে না। পড়াশোনা করছেন অনার্স ফাইনাল বর্ষে। তবে ওনারা ভয়ে এই ক্যাম্পাসে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। সবাই ওনায় মান্য করে চলেন। কারণ উনি একজন ছাত্রনেতা।”

“তুই এতকিছু জানলি কিভাবে?”

“শুভাকাঙ্ক্ষীদের ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর রাখতে হয়।”

“উনি তোর শুভাকাঙ্ক্ষী? কিভাবে?”

পলক চোখ বন্ধ করে বলে,
“একসময় আমিও এটা বুঝিনি যে উনি আমার শুভাকাঙ্খী। কিন্তু আমার কাছে সবটা দিনের আলোর মতো পরিস্কার।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨