#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_৮
#লেখিকাঃদিশা_মনি
পলক আজকে সকালে উঠে নানান চিন্তা ভাবনা করেছে। অতঃপর ভার্সিটির উদ্দ্যেশে রওনা দিয়েছে। ভার্সিটি পৌঁছেই তার সাথে দেখা হয়ে গেলো ফারিয়ার। ফারিয়া পলককে দেখামাত্রই তার কাছে ছুটে এসে বলে,
“কি রে! তোকে এমন মনমরা লাগছে কেন?”
ফারিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমার যে অনেক দায়িত্ব ফারিয়া। এতগুলো দায়িত্ব কিভাবে সামলাব সেটা ভেবেই আমি হাপিয়ে উঠছি।”
“কিসের দায়িত্ব আবার তোর? আমরা স্টুডেন্ট মানুষ। খাব, দাব, চিল করব ব্যস, এটা নিয়ে এতো ভাবার কি আছে?”
“আমার দায়িত্বটা অনেক বড় করে। ভবিষ্যতকে সুন্দর করার দায়িত্ব। জানিস, আমাদের জীবনের নেয়া কিছু ভুল সিদ্ধান্ত যা ছোট থেকে বড় হতে পারে কিন্তু এর পরিণাম অনেক ভয়ানক হতে পারে। তাই কোন কাজ করার আগে হাজারবার ভাবতে হয়।”
“উফ, ইদানীং তুই যে এসব কি দার্শনিকদের মতো কথা বলিস, আমি বুঝিনা। চল ওদিকে ফুচকা খাই।”
বলেই ফারিয়া সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ কিছুদূর এগিয়ে যেতেই সে কারো একটা সাথে ধাক্কা খায়। ফারিয়া ধাক্কা খেয়ে কিছুটা দূরে সরে এসে বলে,
“কোন খাম্বা আমায় ধাক্কা দিল রে? চোখ নেই নাকি?”
“নিজের চোখে চশমা আর আমাকে বলছে আমার চোখ আছে কিনা!”
পরিচিত কন্ঠস্বরটা শুনেই ফারিয়া চোখ তুলে তাকালো। হতবাক স্বরে বলল,
“রুশাদ তুই!”
পলক হাসিমুখে এগিয়ে এসে রুশাদকে বলল,
“তোরও তো জগন্নাথ ভার্সিটিতে চান্স হয়েছে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। এম আই রাইট?”
“হুম, কিন্তু তুই কিভাবে জানলি? আমার তো তোদের সাথে এইচএসসির পর আর কথাই হয়নি!”
পলক একটা রহস্যের হাসি দেয়। ফারিয়া রুশাদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এই হারামি! তোর বিচার আছে। একে তো তুই, কলেজের পর আমাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখিস নি আর এখন আমাকে চশমা পড়া নিয়ে খোটা দিচ্ছিস।”
রুশাদ ভাব নিয়ে বলে,
“এইচএসসির পর আমি এডমিশন নিয়ে সিরিয়াস হয়ে গেছিলাম। তাই কারো সাথেই কথা বলিনি এই কয়মাস। নিজেকে ঘরে বন্দি করে রেখেছিলাম একদম। বুঝলি?”
“আহ, এলেন আমার বিদ্যাসাগর! খুব তো বড় মুখ করে বলেছিলি বুয়েট কনফার্ম তো এখন সেসবের কি হলো?”
রুশাদ থতমত খেয়ে গেলো। এদিকে পলক চুপচাপ এদের দুজনের ঝগড়া দেখে আনন্দ পেলো। ঠিক যেন অতীতের সোনালি অধ্যায় ফিরে পেল। হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই পলকের মন বিষন্নতায় ছেয়ে গেল। সে মনে মনে বলল,
“তোরা দুজন যদি একসাথে থাকতি তাহলে জীবনে কতোটা সুখী হতি। তোরা যে একে অপরকে মনে মনে কতটা ভালোবাসিস, কতটা চাস তার প্রমাণ আমি অতীতে পেয়েছি। কিন্তু ভাগ্য তোদের সঙ্গ দিল না। তোদের জীবন তছনছ করে দিলো। কিন্তু এবার কোন চিন্তা নেই। আমি আছি তো, আমি তোদের জীবনও সুন্দর করে গড়ে দেব।”
ফারিয়া পলককে অন্যমনস্ক দেখে বলে,
“কিরে! তুই আবার কি ভাবছিস?!”
“কিছু না। রুশাদ, আমরা একটু ক্যান্টিনে যাব তুই যাবি আমাদের সাথে?”
রুশাদ কিছু বলার আগেই ফারিয়া বলে ওঠে,
“এই খাম্বা টাকে আমাদের সাথে নেয়ার দরকার নেই। শালা যা কিপ্টা একে সাথে নিলে এক টাকাও খরচ করবে না উল্টো আমাদের পকেট ফাঁকা করবে।”
রুশাদ রেগে বলে,
“কি এতবড় অপমান, চল আমার সাথে। কি খেতে চাস না তোরা সব টাকা আমি দেব।”
পলকের হঠাৎ অতীতের কথা মনে পড়ে৷ সে বলে,
“তুই টাকা না দিয়ে পালাবি তারপর আমরা বিড়ম্বনায় পড়ি আরকি! এসব ফন্দি বাদ দে।”
রুশাদ তো অবাক হয়ে যায়, যে পলক কিভাবে তার মনে কি চলছে সেটা বুঝল। এদিকে পলকের চোখ ক্যাম্পাসজুড়ে কাউকে একটা খুঁজছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির দেখা মিলল না।
★★★
পলক ক্লাস শেষ করে বাইরে বের হতেই আরাফাত এসে তার পথ আটকে দাঁড়ালো। পলক রাগী দৃষ্টিতে আরাফাতকে পরখ করছিল। আরাফাতের চোখে অন্যরকম চাহনি পলকের প্রতি। পলক ভীষণ রেগে বলে,
“আমার পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন কেন?”
আরাফাত বলে,
“রেগে গেলে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগে।”
অতীতের পলক আরাফাতের এসব কথা শুনেই আস্তে আস্তে গলে গিয়েছিল। কিন্তু এবার তো আর সে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না। তাই আরাফাতের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“নিজের এসব ফালতু কথা নিজের কাছেই রাখো আর আমাকে আমার কাজে যেতে দাও। আমার এত ফালতু সময় নেই যে, তোমার সাথে কথা বলে নষ্ট করব।”
এই বলে পলক সামনে পা বাড়াতে নিতেই আরাফাত তার হাত টেনে ধরলো। পলকের মাথা ভীষণ গরম হয়ে গেল। সেই আগুনে ঢি ঢেলে দিয়ে আরাফাত আবার বললো,
“এত ভাব কেন তোমার? আমার মতো এত সুদর্শন একটা ছেলে তোমার সাথে যেচে কথা বলতে চাইছি আর তুমি আমায় ইগ্নোর করছ!”
পলক ভীষণ রেগে আরাফাতের অণ্ডকোষ বরাবর একটা লাথি দিয়ে বলে,
“ভবিষ্যতে আমার সাথে কথা বলার আগে এইটা মনে রাখবেন।”
আরাফাত ব্যাথায় ছটফট করতে লাগল। পলক নিজের মতো সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। খোঁজ নিয়ে জানল, আজ মেহরাজ চৌধুরী ভার্সিটিতে আসেনি। তার মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল।
কোনরকমে সবগুলো ক্লাস করে ফারিয়াকে নিয়ে পলক রওনা দিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের উদ্দ্যেশ্যে যাওয়ার জন্য। ফারিয়া পথিমধ্যে পলককে জিজ্ঞেস করল,
“আমরা হঠাৎ ঢাকা মেডিকেল কলেজে কেন যাচ্ছি?”
“সেটা গেলেই জানতে পারবি।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পৌঁছেই পলক ফোন বের করে একটা নম্বরে কল দেয়। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফারিয়া বলে,
“চল, সামনের ক্যান্টিনটায় যাই।”
“আচ্ছা।”
দুজনে ক্যান্টিনে গিয়ে উপস্থিত হলো। কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে তাদের সামনে এসে বলল। মেয়েটার মুখে মাস্ক,গায়ে এপ্রোণ। ভীষণ ফর্সা এই মেয়েটির শুধু চোখ দেখেই বলে দেওয়া যায় যে, মেয়েটি সৌন্দর্য্যে অতুলনীয়া। মুখ থেকে মাস্ক নামানোর পর যেন সেটা আরো পরিস্কার হলো। এত সৌন্দর্য খুব কম মেয়েরই থাকে। পলকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,
“মাশাল্লাহ।”
মেয়েটি হাপাতে হাপাতে বলল,
“তুমিই কি পলক? পাভেলের বোন?”
“জ্বি, আপু। আর আপনি নিশ্চয়ই জান্নাত খান।”
“জ্বি, আমাকে তুমি করেই বলতে পারো সমস্যা নেই।”
পলক বলে,
“বেশ। তো যা বলতে এসেছি বলি?”
“হু, বলো।”
“ভাইয়াকে তুমি কেন এতটা কষ্ট দিচ্ছ আপু? ভাইয়া তোমাকে কতটা ভালোবাসে বোঝো না। শুধুমাত্র তোমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য কত কষ্ট করে একটা চাকরি জোগাড় করল৷ আর এখন তুমি তাকে এভাবে বলছ যে, তুমি তাকে বিয়ে করতে পারবে না!”
জান্নাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আমি বুঝতে পারছি সবটাই। কিন্তু আমারো যে হাত-পা বাঁধা। ছোটবেলা থেকে আমি নিজের পরিবারের কড়া শাসনে মানুষ হয়েছি। কখনো তাদের বিরুদ্ধাচারণ করার সাহস হয়নি। দুঃসাহস তো দেখালাম কলেজে উঠে তোমার ভাইয়াকে ভালোবেসে। তবুও দীর্ঘ ৬ বছর ধরে আমি এই দুঃসাহস দেখিয়ে চলেছি। অতি সাবধানতা অবলম্বন করায় আমার পরিবার ব্যাপারটা জানতে পারে নি।”
“ভালোবাসায় এত লুকোচুরি কেন আপু? আমার ভাইয়া কি খারাপ ছেলে? তুমি তো ভাইয়াকে ভালোবাসো। তুমি জানো না তার ব্যাপারে?”
“আমি সবটাই জানি। কিন্তু তোমরা কিছুই জানো না। তুমি তো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো, রাইট? আমার ভাই চাচাতো ভাই দুজনেই ওখানে পড়ে। ওদের হয়তো তুমি চিনবে। আমার ভাই জুয়েল আর আমার চাচাতো ভাই আশরাফ। আমার চাচা একজন প্রভাবশালী নেতা। আমার ভাইয়েরাও যে কম নয় সেটাও তোমাদের অজানা নয়। আমার সাথে আশরাফ ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহেই আমাদের বিয়ে। আমাকে না চাইতেও এই বিয়েতে রাজি হতে হয়েছে,,”
জান্নাতের গলা ধরে আসে।
“যদি আমার পরিবার পাভেলের ব্যাপারে কিছু জানতে পারে তো ওকে জ্যান্ত কবর দিবে। এই অবস্থায় আমি কি করতে পারি, বলো?”
পলক অনেকক্ষণ ভাবে। তার মনে পড়ে, একদিন রাতে তার ভাই মদ্যপ হয়ে বাড়িতে ফেরে। সেদিন তাকে ভীষণ বিধ্বস্ত লাগছিল। তখন না বুঝলেও এখন তা বুঝতে পারছে। আমরা ছোট ছোট বিষয়কে ইগ্নোর করে দেই, অথচ এটা জীবনে কত বড় সমস্যা তৈরি করে!
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨