#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_১০(ধামাকাদার পর্ব)
#লেখিকাঃদিশা_মনি
আজ জান্নাতের সাথে আশরাফের বিয়ে। সকাল থেকে পলক খেয়াল করছে পাভেলকে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে। একদিকে তার প্রিয়তমার অন্য কারো সাথে বিয়ে ঠিক হচ্ছে আর অন্যদিকে আজ আবার বাড়ি থেকে তার জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা। সবমিলিয়ে পাভেলের উপর দিয়ে এখন কি চাপ যাচ্ছে সেটা পলক বুঝতে পারছে। এদিকে মেহরাজ সেদিনের পর পলককে আর কিছু জানায়ও নি৷ বরং তাকে সবসময় এড়িয়ে চলেছে। তাই পলকের এখন ভীষণ অসহায় বোধ হচ্ছে। সে নিজেই নিজের কপালে চাপড় দিয়ে বলছে,
“আমারই ভুল হয়েছে ওনার ভরসায় থাকা। যা করার এখন আমাকেই করতে হবে। যেকোন কিছুর বিনিময়ে আমি ভাইয়াকে সুখী দেখতে চাই।”
একথা বলেই পলক বেরিয়ে পড়ে জান্নাতদের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে। “আহসান ভিলা” শহরের অন্যতম বনেদী বাড়ি। এখানেই জান্নাতদের আবাস। এই বাড়িতেই আজ ধুমধাম করে জান্নাতের সাথে আশরাফের বিয়ের আয়োজন চলছে। পলক বাড়ির বাইরে থেকেই আড়চোখে তাকিয়ে ছিল জুয়েলের দিকে। জুয়েল, জান্নাতের আপন ভাই। তবে নিজের বোনের থেকে তার নিজের চাচাতো ভাই আশরাফের প্রতিই টান বেশি৷ ভার্সিটিতেও তো জুয়েল আশরাফের ডান হাত বলেই বেশি পরিচিত। পলক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই জুয়েলকে সে বেশ ভালো করেই চেনে। অতীতের অনেক তিক্ত স্মৃতি যে জড়িয়ে। তাই রাগও হলো ভীষণ। পলক বিড়বিড় করে বলে,
“এতদিন আমি ভাবতাম জুয়েল শুধু অন্য মেয়েদের জীবনই নষ্ট করে এখন তো দেখলাম ও নিজের বোনের জীবনও নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছে। ভালোবাসার মানুষকে না পেলে কেউ কি সুখী হয়?”
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পলকের হঠাৎ মনে পড়ে গেলো আরাফাতের কথা। সেও তো আরাফাতকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। কিন্তু…নিজের ভাবনা থামালো পলক। নিজেই নিজেকে বুঝ দিলো,
“আমার ভাইয়া ঐ আরাফাতের মতো নয়। ভালোবাসা না পাওয়ার দুঃখে যে এতটা বদলে যেতে পারে সে নিশ্চয়ই নিজের ভালোবাসাকে পেলে তাকে সর্বোচ্চ সুখী রাখবে। কিন্তু তার জন্য যে করেই হোক আমার ভাইয়ার ভালোবাসার পূর্ণতা দিতেই হবে।”
বলেই পলক বাড়ির ভেতরের দিকে যেতে লাগল। জান্নাতের কিছু বান্ধবীদের সাথে মিশে সে আহসান ভিলাতে প্রবেশ করল। যাদের সাথে পলক আগেই কথা বলে রেখেছিল। আহসান ভিলায় ঢুকেই পলক জান্নাতকে খুঁজতে লাগল কিন্তু কোথাও তার দেখা পাওয়া গেল না। পলক অবাক হয়ে ভাবতে লাগল,
‘বিয়ের কনেকে কেন কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
এমন সময় হঠাৎ করে চারিদিকে রব উঠল বউ পালিয়েছে। পলক তো একদম ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। জান্নাত পালিয়েছে মানে?! বাড়িতে যা গার্ডের ব্যবস্থা করেছে আহসান ভিলার পুরুষেরা তাতে এভাবে পালানো কিভাবে সম্ভব? তাছাড়া জান্নাত যদি সত্যিই বিয়ের দিন পালিয়েই যায় তাহলে তো পাভেলের কাছেই যাবে। কিন্তু যদি সত্যি এমন হতো তাহলে তো পাভেলের সাথে রুহানির বিয়ে হতো না। তাহলে কি জান্নাত আবার ধরা পড়ে যাব? নাকি অতীতের ঘটনা এখন পরিবর্তন হচ্ছে? পলক কোন হিসাবই মিলাতে পারছে না। এমন সময় হঠাৎ পলকের ফোন বেজে ওঠে। পলক ফোনটা রিসিভ করতেই একটা চেনা পুরুষালি কন্ঠ শুনতে পায়,
“এই মেয়ে, শোনো, এখন তো মনে হয় আহসান ভিলা থেকে কাউকে সরাসরি বের হতে দিবে না। তাই তুমি একটা কাজ করো, তুমি জান্নাতের ঘরে প্রবেশ করো। ওর ঘরের মধ্যে দেখবা একটা বড় ফ্রেমের ছবি সেটা সরাতেই একটা টানেল দেখতে পারবে। ঐ টানেল বেয়ে চলে আসো বাইরে। আমি জান্নাতকে নিয়ে কাজি অফিসে যাচ্ছি, আমার বন্ধুরা তোমার ভাইকে নিয়ে আসছে। বাকি কথা কাজি অফিসেই হবে।”
“মেহরাজ চৌধুরী!”
কল কেটে যায়। পলক তো পুরো অবাক হয়ে যায়, সাথে খুশিও হয়। আনন্দের সাথে বলে,
“তার মানে ভবিষ্যৎ পরিবর্তন ঘটবে! এখান থেকেই কি তাহলে সেই পরিবর্তনের সূচনা ঘটল।”
এরইমধ্যে পলক খেয়াল করল চারিদিকে সবার চেকিং চলছে। জান্নাতের বাবা-চাচারা সবাই ভীষণ ক্ষেপে গেছে। সবার অলক্ষ্যে পলক জান্নাতের রুমে প্রবেশ করে বড় ফ্রেমের ছবিটা সরিয়ে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। অতঃপর একটি গাড়ি নিয়ে দ্রুত ছুটল কাজি অফিসের দিকে।
★★
কাজি অফিসে পৌঁছেই পলক দেখল ইতিমধ্যেই জান্নাত এবং পাভেল সেখানে উপস্থিত। পলককে দেখামাত্রই মেহরাজ তার কাছে এসে বলল,
“এই মেয়ে! তুমি এত পাকনা কেন? তোমাকে কে বলেছিল আহসান ভিলায় যেতে? আমি তো বলেই ছিলাম আমি ব্যাপারটা দেখে নেব। তুমি যদি কোন বিপদে পড়তে তখন কি হতো?”
পলক রেগে বলে,
“এখন আপনি আমায় দোষ দিচ্ছেন? কই, এতগুলো দিন তো একবারও বলেন নি যে, আপনি কিছু করবেন। আমি তো তাই ভাবছি যে আপনি কিছুই করবেন না। তাই বাধ্য হয়ে নিজে চলে গেছিলাম।”
এরইমধ্যে মেহরাজের বন্ধু হাসিব বলে ওঠে,
“তোরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা বন্ধ কর। আগে দ্রুত এদের বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেল। নাহলে কখন আশরাফ, জুয়েলরা চলে এসে সব বিগড়ে দেয় বলা যায়না।”
“ঠিক বলেছিস তুই। এই মেয়ে শোনো, যা ঝগড়া করার পরে করবো। এখন আপাতত তোমার ভাইয়ের বিয়েটা সেরে ফেলি।”
পলক আর কিছু বলল না।
কাজি অফিসে
জান্নাত ও পাভেলের বিয়ের আয়োজন করা হলো। নির্বিঘ্নেই বিয়েটা সম্পন্ন হলো। এই পুরোটা সময় পলক অবাক চোখে মেহরাজের দিকেই তাকিয়ে ছিল। এই লোকটার জন্য আজ তার ভাইয়ের ভালোবাসা পূর্ণতা পেল। লোকটার কাছে তো পলক অতীতে ঋণী ছিলই। বর্তমানে যেন লোকটা তাকে আরো বেশি ঋণী করে দিলো।
মেহরাজ পলকের দিকে তাকাতেই তাদের চোখাচোখি হয়ে যায়। মেহরাজ হালকা এসে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এসে পলকের দিকে বাড়িয়ে বলে,
“নাও, নিজের ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে মিষ্টি খাও।”
পলক হাসিমুখে মিষ্টিটা খেয়ে নিয়ে বলে,
“আপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারি না! কি সুন্দর এতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে টানেল বানিয়ে বিয়েটা ভেস্তে দিলেন! কাক-পঙখীকেও টের পেতে দিলেন না। এতকিছু কিভাবে করলেন?”
মেহরাজ বাকা হেসে বলে,
“নিজের শত্রুকে শায়েস্তা করার জন্য এই মেহরাজ সব করতে পারে। তুমি ভেবো না, তোমার অনুরোধ রাখতে এত কিছু করেছি। আমার মেইন মোটিভ ছিল ঐ আশরাফকে একটা শিক্ষা দেয়া। আর মাঝখান থেকে উপলক্ষ পেয়ে গেলাম। যদি ঐ মেয়েটার বিয়ে আশরাফের সাথে না ঠিক হতো তাহলে আমি তোমায় কখনো সাহায্য করতাম না!”
মেহরাজের কথা শুনে পলকের মন একটু খারাপ হয়ে গেলেও সে চওড়া হেসে বলে,
“এখনকার পৃথিবীতে নিঃস্বার্থভাবে কেই বা সাহায্য করে? সবাই তো স্বার্থের জন্যই সাহায্যের হাত বাড়ায়। আর যারা নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদের পাশে দাঁড়াতে চায় আমরা তাদেরই ভুল বুঝি।”
কথাটা শুনে মেহরাজ হতবাক হয়ে পলকের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন কিছু বোঝার চেষ্টা করে। পলক মেহরাজের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে,
“এরপর যদি কখনো আমার এমন সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে, যেখানে আপনার স্বার্থ জড়িয়ে আছে তো আমি আপনাকে জানাব। আশা করি, আপনি সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন।”
মেহরাজ কিছুই বলে না। এদিকে জান্নাত এসে পলককে জড়িয়ে ধরে বলে,
“শেষপর্যন্ত আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পেল। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তুমি যদি এতদিন ধরে আমায় সাহস না যোগাতে তাহলে হয়তো আমি এতবড় স্টেপ নিতে পারতাম না।”
পাভেল এগিয়ে এসে মেহরাজকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে,
“তুমি আমার থেকে বয়সে ছোটই হবে। তবে আজ তুমি আমার যা উপকার করলে তা আমি কখনো ভুলব না। তোমার জন্য আমি আমার জান্নাতকে পেলাম। আমার বোনটাও অনেক উপকার করল আমায়। নাহলে তো আমি ভেবেছিলাম এই ভালোবাসা কখনোই পূর্ণতা পাবে না। আমাকে বোধহয় দেবদাস হয়ে যেতে হবে!”
পলক এসব দেখে বলে,
“আজ যে বড় একটা পরিবর্তন ঘটল দুজনের জীবনে। ভবিষ্যতে কি এর কোন প্রভাব পড়বে? এখন ভবিষ্যত যে পুরোপুরি বদলে গেক। কি হবে এর পরিণাম?!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨