রক্তিম পূর্ণিমা পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
179

#রক্তিম_পূর্ণিমা
#পর্ব_২০(অন্তিম)
#লেখিকাঃদিশা_মনি

পলক নিজেকে মহাশূন্যে ভাসমান অবস্থায় আবিষ্কার করে। সে ভেবেছিল তার জীবনপ্রদীপ বুঝি একেবারেই নিভে গেছে৷ তবে ভাগ্য তাকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে। পলক চোখ খুলতেই দেখল তার সামনে সেই চেনা বৃদ্ধ মহিলাটিকে। এতদিনে পলক তার পরিচয় পেয়েছে। তাই তো মৃদু হেসে বলে,
“আপনিই তাহলে আমাদের ছোটবেলায় পড়া সেই চাঁদের বুড়ি?”

চাঁদের বুড়ি স্মিত হেসে বলে,
“এতদিনে আমায় চিনতে পারলি মেয়ে!”

“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ চাঁদের বুড়ি। আজ আপনার সাহায্যের মাধ্যমেই আমি সবার জীবন এত সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে পেরেছি।”

“আর তোর জীবনের কি হবে?”

পলকের মুখটা মলিন হয়ে যায়। সে বলে,
“আমার জীবন প্রদীপ তো নিভেই গেছে!”

“পাগলী মেয়ে! অতীত শোধরানোর সুযোগ পেয়ে নিজের বাদে আর সবার কথা ভাবলি..আর তোর কথা একটিবারও ভাবলি না! এতটা নিঃস্বার্থও কি হওয়া যায়?”

পলক স্মিত হেসে বলে,
“সবার খুশিতেই আমার খুশি। আমি শুধু এটুকুই চাই যে, সবাই ভালো থাকুক।”

পলকের কথা শুনে এবার চাঁদের বুড়ি মুচকি হেসে বলে,
“তুই সবার কথা ভাববি আর তোর কথা কেউ ভাববে না এমনটা কি হতে পারে? আমি তো আছিই তোর কথা ভাবার জন্য।”

“মানে?”

“তোর জীবন এখনো শেষ হয়ে যায়নি পলক, আমি তোকে রক্ষা করেছি। এই সময়ের পরিক্রমা হয়তো আজ এখানেই শেষ হলো তার থেকে শুরু হলো তোর নতুন জীবনের সূচনা।”

বলেই চাঁদের বুড়ি হাসলেন। অতঃপর তার শরীর থেকে লাল রক্তিম দ্যুতি বের হলো। যা আবারো পলককে এক সময়ের চক্রবুহ্যে প্রবেশ করালো। নিমেষেই পলক চাঁদের বুড়ির সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেল।

চাঁদের বুড়ি মুচকি হেসে বললো,
“পলকের সময় অভিযান তো আজ শেষ হলো কিন্তু রক্তিম পূর্ণিমার সমাপ্তি এখনো ঘটেনি। এই পৃথিবীর বুকে আবারো নেমে আসবে রক্তিম পূর্ণিমা তবে এবার অন্য কারো জীবনে, অন্য কাউকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে। তো আপনারা কি চান? আবারো কেউ এমন সুযোগ পাক? তাহলে আপনাদের জন্য তার কাহিনিও নিয়ে আসা হবে।”

বলেই একটা ফিচেল হাসল চাঁদের বুড়ি।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পলকের যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে নিজেকে নিজের ঘরে আবিষ্কার করল। তার সামনে বসে আছে তার বাবা-মা এবং ভাই-ভাবি। পলককে উঠতে দেখেই তো তার ভাবী জান্নাত বলে ওঠে,
“তুমি হঠাৎ করে জ্ঞান হারালে কিভাবে পলক?”

পলক বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। এদিকে পারভেজ বলল,
“অধিক খুশিতে বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছে।”

বলেই হাসল। জান্নাতও হেসে উঠল৷ নূর বেগম বললেন,
“একদম আমার মেয়েটাকে নিয়ে মজা করবি না। ওর উপর দিয়ে যা ঝড় গেছে তা বলার মতো না। দুই বছর আগে তো মরতে মরতে বেঁচে গেছিল। ওর সামান্য কিছু হলেও আমার বুক কেপে ওঠে।”

এমন সময় ফারিয়া পলকের রুমে প্রবেশ করে বলে,
“আপনাকে এত চিন্তা করতে হবে না আন্টি। পলকের খেয়াল রাখার মানুষটা এখন চলে এসেছে।”

পারভেজ ইসলাম বলে ওঠেন,
“ওহ, তাহলে এতদিনে মহাশয়ের আমেরিকা থেকে ফেরার সময় হলো?”

পলক তো কিছুই বুঝতে পারছিল না যে সবাই কার কথা বলছে। তাই সে অবাক হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ একটু পরেই রুশাদ রুমে প্রবেশ করে। রুশাদের পিছন পিছন রুমে এমন একজন প্রবেশ করে যাকে দেখেই পলক অবাক হয়ে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“মেহরাজ ভাই!”

মেহরাজকে এভাবে ঠিকঠাক দেখে পলক নিজেকে সামলাতে পারে না। দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। মেহরাজও পরম আবেশে বলে,
“একদম চিন্তা করো না, এখন আমি যখন এসে গেছি তো সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“কোথায় ছিলেন আপনি এতদিন?”

“আমি তো এখানে ছিলাম তোমার মনে..”

বলেই পলকের বুকের দিকে ইশারা করে মেহরাজ। পলক লাজুক হাসে। এদিকে পারভেজ ইসলাম এবং নূর হোসেনের লজ্জা পাচ্ছিলেন তাই রুম থেকে বেরিয়ে যান। তাদের সাথে সাথে জান্নাত আর পাভেলও। ফারিয়া হালকা কেশে বলে,
“আরে এটা তো খেয়াল রাখা উচিৎ যে রুমে আরো কেউ আছে।”

পলক এবার লজ্জা পেয়ে দূরে সরে আসে। ফারিয়া বলে,
“থাক! আর এত লজ্জা পেতে হবে। আগামীকালই তো তোদের বিয়ে। তারপর তোদের নতুন জীবন শুরু হবে। আপাতত আমার আর রুশাদের তরফ থেকে রইল প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। তোদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হোক।”

বলেই ফারিয়া বাইরে বেরিয়ে যায়। রুশাদও যায় তার পিছন পিছন। তারা বেরিয়ে যেতেই মেহরাজ পলকের সামনে এসে বলে,
“অবশেষে তুমি রক্তিম পূর্ণিমার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে আমার জীবনে ফিরলে!”

পলক তো একেবারেই অবাক হয়ে যায়। হতবাক স্বরে বলে,
“তুমি কিভাবে জানলে যে আমি…”

“আমি সবটাই জানি। চাঁদের বুড়ি সেদিন আমায় সব বলেছে।”

এটা বলেই মেহরাজ মনে করে সেই দিনটা যেদিন পলক ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিল। এরপরই চারিদিক রক্তিম আভায় ছেয়ে যায় এবং সেই রক্তিম আভায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় আশরাফ। অতঃপর সেই রক্তিম আলোর মাধ্যমে পৃথিবীতে নেমে আসে চাঁদের বুড়ি। মেহরাজ সেদিন অবাক হয়ে গেছিল। তখন চাঁদের বুড়িই তাকে সবটা খুলে বলেছিল যে পলকের সাথে কি কি ঘটেছে এবং কিভাবে সে বারবার সময়ের ভ্রমণ বা টাইম ট্রাভেল করছে। সব শুনে মেহরাজের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকলেও পারিপার্শ্বিকতা তাকে বুঝিয়ে দেয় এসবই সত্য।

এরপর মেহরাজ চাঁদের বুড়িকে বলে পলকের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে। চাঁদের বুড়ি রাজি হয় তবে একটা শর্ত দেয় যে তাদেরকে কিছু বছরের বিচ্ছেদের মধ্যে থাকতে হবে। মেহরাজ পলককে রক্ষা করার জন্য সেই শর্তে রাজি হয়ে যায়। এরপর চাঁদের বুড়ি মেহরাজকে আবারো একটা সুযোগ দেয়। এবার সে রক্তিম পূর্ণিমার আলো দিয়ে মেহরাজকে অতীতে পাঠিয়ে দেয় এবং মেহরাজ পলকের গুলি লাগার আগেই তাকে রক্ষা করে। তবে এবারো আশরাফ যথারীতি রক্তিম পূর্ণিমার আলোয় পুড়ে ভষ্ম হয়ে যায়। কারণ তার মতো পাপীর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

এরপরই চাঁদের বুড়িকে দেওয়া শর্ত পালনে চাঁদের বুড়ি মেহরাজকে আর পলককে আলাদা করে দেয়। আর আজ দুই বছর পর তাদের মিলনের পালা এসেছে।

মেহরাজ আবেগাপ্লুত হয়ে বলে,
“আজ আমি খুব খুশি। আমাদের মধ্যে আর কোন বাঁধা রইল না। সব বাঁধা অতিক্রম করে আজ আমরা এক হতে পারব।”

পলকও মেহরাজের কথায় সমর্থন জানিয়ে বলে,
“আজ আমাদের জীবনে আর কোন সমস্যা নেই। আজ সত্যিই আমরা বাঁধাহীন জীবনে পা রাখতে চলেছি।”

পরের দিন ধুমধাম করে তাদের দুজনের বিয়ে হয়ে যায়। তাদের বিয়ের দিনটাও ছিল পূর্ণিমার। তবে আজ আর রক্তিম পূর্ণিমা নয়। আকাশে স্বাভাবিক এক চাঁদ। পলক ও মেহরাজ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাশ করছে। পলক বলে,
“আজ চাঁদটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, তাইনা?”

“হুম, তবে আমার রক্তিম পূর্ণিমাক্ত বধূর মতো নয়”

বলে দুজনেই একসাথে হেসে ওঠে। উপর থেকে চাঁদের বুড়ি তাদের দেখে হেসে বলে,
“রক্তিম পূর্ণিমা তোমাদের জীবনে সুখ নিয়ে আসুক।”

এরপরই চাঁদ আবারো রক্তিম হয়ে ওঠে। যা নবদম্পতির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ!

সমাপ্ত ✨