রঙ বেরঙে প্রণয় পর্ব-০৪

0
85

#রঙ_বেরঙে_প্রণয়
#পর্ব_৪
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত।)

মেয়ের ভবিষ্যতে নিয়ে আলোচনায় মশগুল খান দম্পতি। ফাহিম খান স্ত্রী’কে বললেন,
” আমি কথা বলবো তাহমির সাথে। নিশ্চয়ই আমাকে হতাশ করবে না আমাকে। ”
” হতাশ না হতাশার চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিবে তোমার গুনধর মেয়ে, হুহ্! ”
জাহানারার কথায় বিশেষ পাত্তা দিলেন না ফাহিম। জাহানারা নিজের খাবারের অংশটুকু খেয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কী একটা ভেবে ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন,
” যেমন বাপ তেমনি তার মেয়ে। মাথায় সব গোবর ভর্তি! ”
স্ত্রী’র কথায় হকচকিয়ে গেলেন ফাহিম। খাওয়াদাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে আঙুল নাচিয়ে শুধলেন,
” এই জাহানারা কীসব বলছো? ”
” কী বলছি বুঝতে পারছো না? তারিকুল ভাইয়া যেমন লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন , সহন আর ফাইজাও তেমন হয়েছে। আর তুমি? বলবো আরকিছু? ”
জাহানারার কথায় বিষম খেলেন ফাহিম। জাহানারা আর না দাঁড়িয়ে নিজের বেডরুমের দিকে গেলেন। সামনে রাখা পানি ভর্তি গ্লাসে চুমুক দিয়ে কিছুটা শান্ত হলেন ফাহিম। কী দিনকাল আসলো রে বাবা! নিজের একমাত্র বউ মেয়ের জন্য নিজের স্বামীরই মানসম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে।

কলিংবেলের শব্দে বসার ঘরের সবাই নড়েচড়ে উঠলো। রাত আটটা ছুঁইছুঁই এখন। এ সময় তাহমি প্রতিদিন সহনদের বাসায় থাকে। ফাইজার সাথে টুকটাক আড্ডা দেয়। মাঝে মধ্যে মনের মতো তরকারি হলে আবার খাওয়াদাওয়া সেড়েও যায়।
” ভাইয়ার স্টুডেন্টরা এসেছে হয়তো। আপু তুমি বসো আমি গিয়ে খুলে দিয়ে আসি। ”
ফাইজা উঠে দাঁড়ালো। তাহমি বুঝতে পারছে না কোন স্টুডেন্ট বাসায় এলো আবার!
” আরে কোন স্টুডেন্ট? ”
” নতুন ব্যাচ। প্রাইভেট পড়বে। আসছি।”
তাহমি নিজের জায়গায় বসলো। ফাইজা এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। আইমান প্রতিদিনের মতোই রাতের রান্না করতে রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সহন নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে। চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংও করে ও।
” আসসালামু আলাইকুম। আমরা আসলে সহন স্যারের কাছে পড়তে এসেছি। ”
আতিকা মিষ্টি কণ্ঠে বললো। ফাইজা হেসে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করে।
” হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। ভেতরে এসো তোমরা। আমি তোমাদের ভাইয়ার রুমে নিয়ে যাচ্ছি। ”
” ধন্যবাদ আপু। ”
শায়লা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো। দরজা আঁটকে ওদেরকে নিয়ে সহনের ঘরের দিকে এগোলো ফাইজা। এতক্ষণ চিলের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো তাহমি। শায়লাকে ঠিক সুবিধার মনে হলোনা। তাছাড়া এই রাতে দুটো মেয়ে সহনের ঘরে গিয়ে বসে থাকবে সেটাও ভালো লাগছে না তাহমির।
” নাহ তাহমি! সবাই বলে তুই টক্সিক! শান্ত হ তুই। ”
নিজের মনকে শাসাল মেয়েটা। মনোযোগ অন্য দিকে নিতে বড়ো আম্মুর কাছে গেলো।

অনেকক্ষণ ধরে বাড়ির সামনের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরুষ অবয়ব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রতিদিনকার নিয়মমাফিক রুটিন। একটা নির্দিষ্ট সময়ই এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তা-ও একজন নির্দিষ্ট মানুষের জন্য! অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে আগন্তুক। কখন তার প্রেয়সী এসে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তার দিকে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকাবে? হাতঘড়ির দিকে নজর বুলিয়ে দেখলো রাত ন’টা বেজে দশ মিনিট এখন। হঠাৎ সামনের বিল্ডিং এর দক্ষিণ দিকের ঘরে আলো জ্বলে উঠলো। আগন্তুক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এতক্ষণে। অবশেষে সে ঘরে এলো! কিন্তু আসতে পাঁচ মিনিট দেরি করলো কেন? সে কি জানে না তার জন্য একজন রোজ অপেক্ষা করে থাকে!
ফাইজা ঘরের লাইট অন করেই দ্রুত পা চালিয়ে বেলকনির দিকে এগোলো। আশেপাশে নজর বুলিয়ে ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকাতেই দৃষ্টি স্থির হলো ওর। লোকটা দাঁড়িয়ে আছে! ইশ আজকে মনে হয় বেশি অপেক্ষা করিয়ে ফেলেছে তাকে। সে যাগগে ফাইজা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আগন্তুকের দিকে। যদিও এতদূর থেকে কেউ কাউকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু আবছা আলোতে দু’জন দু’জনার অবয়ব ঠিক দেখতে পাচ্ছে। এতেই যেনো দুজনের শান্তি। প্রথম প্রথম বিষয়টা খেয়াল করতোনা ফাইজা। সেজন্য আগন্তুক প্রায় কলেজ যাওয়ার পথে রাস্তার নির্দিষ্ট জায়গায় জায়গায় চিরকুট রাখতো। তবুও দেখতো না ফাইজা। একদিন বাড়ির দেয়াল টপকে লোকটা বাড়ির পেছনে এসে দু’টো চিঠি পাইপের সাহায্যে দোতলায় উঠে ফাইজার রুমের বেলকনিতে রেখে গিয়েছিল। বিষয়টা জানার পর ফাইজা অবশ্য ভয়ই পেয়েছিল। কারণ বেলকনিতে আসা তো মুখের কথা নয়!

ঘন্টাদেড়েক পরে মাত্র সহনের রুম থেকে বের হলো শায়লা ও আতিকা। নিচে রাস্তায় ওদেরকে নিতে গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে। সেজন্য দ্রুত পা চালিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো দু’জন। ওরা যাওয়া মাত্রই সহনের ঘরে ঢুকলো তাহমি। পিংক কালারের টপস আর ব্লাক কালারের প্লাজু পরনে ওর। চুলগুলো মেসি বান করা, কানে ছোটো অর্নামেন্টস। সহন ল্যাপটপ টেবিলে রেখে কেবল দরজার দিকে এগোচ্ছিল ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে যাবে বলে। এরমধ্যে ঘোড়ার মতো ছুটে ঘরে ঢুকলো তাহমি।
” কী রে! এমন দৌড়ে ঘরে ঢুকলি যে? ”
সহনের কথার কোনো উত্তর দিলো না তাহমি। বুকের দুইপাশে দু-হাত রেখে পেছনে ঠেলতে ঠেলতে একেবারে বিছানায় ফেলে দিলো সহনকে। তাহমির এমন আচরণে চমকাল সহন। এমন করছে কেন মেয়েটা! বিছানায় শুয়ে তাহমির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সহন। তাহমির সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে সহনের হাতদুটো নিজের হাত দিয়ে মাথার উপরের দিকে চেপে ধরে ওর উপর চড়াও হলো। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
” তুই কি ওদের দু’জনের স্যার না-কি চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার মতো কোনো খাদ্যদ্রব্য? ”
” কী বলছিস! আরে গায়ের উপর থেকে সর না। নির্লজ্জ একটা। ”
” চুপ! আমি দেখেছি ওই শায়লা মেয়েটা তোর দিকে কেমন দৃষ্টিতে দেখছিল বারবার। ”
সহন তাহমির হাত সরিয়ে নিজেই ওকে শুইয়ে দিয়ে উল্টো তাহমির হাত চেপে ধরলো।
” ওরা তোর মতো না। ছেলেদের গিলে খায় না। বইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে না। আমার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না, তাকাবে না ভাই। তুই শান্ত হ প্লিজ!”
সহনের অসহায় মুখখানা দেখে মন শান্ত হলোনা তাহমির।
” আমি ছেলেদের গিলে খাই?”
সহন জিহ্বায় কামড় দিয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাহমির দিকে। কী বললো একটু আগে? ইশ পাগল কেউ ক্ষ্যাপায়!
” আরে ধুর আমি তো মজা করেছি। শোন আম্মু কিন্তু আজ তোর ফেবারিট করলা ভাজি করেছে। চল খেয়ে আসি তারপর না হয় এখান থেকেই আবার ঝগড়া শুরু করবো?”
তাহমি কোনো উত্তর না দিয়ে সহনের গলায় একটা কামড় বসিয়ে দিলো। চমকাল, থমকাল সহন। চিৎকার করতেও পারলোনা, কারণ বাসার সবাই শুনলে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি। তবে সহন চুপ করে আছে দেখে তাহমি বেশি জোরে কামড় দিলো না। হঠাৎ করেই ওর মনে হলো একজন পুরুষ ওর খুব কাছে। এতটাই কাছে যে দু’জন দু’জনার নিঃশ্বাসের গতিবেগ টের পাচ্ছে! যতই কাজিন হোক সহন তো একজন পুরুষ মানুষ? তাহমি তড়িৎ গতিতে সহনকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। সহন অবশ্য বুঝতে পারছে না এতো জলদি কীভাবে ছাড়া পেলো?
” তোর ছাত্রীদের বলে দিবি পড়তে আসবে নজর যেনো পড়াশোনার দিকে থাকে। তোর উপর মোটেই না। খেতে যাচ্ছি আমি।”
তাহমি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই উঠে বসলো সহন। একদিনেই এই কুরুক্ষেত্র বাঁধাল তাহমি, এরপর না জানি আরো কী কী করে! এটা ঠিক শায়লা একটু চঞ্চল কিন্তু তাহমি যা বলছিল সেটাও তো ঠিক না। এসব ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে সহন। ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দেখে তাহমি এরমধ্যে ভাত খাওয়া শুরু করেছে। তারিকুল খানও মাত্র বসলেন খেতে। আইমান উনাকে খাবার দিচ্ছে।
” তোর বাবাকে দিয়ে তোকেও খাবার দিচ্ছি। ”
” তুমি বাবাকে দাও আমি নিজেই ভাত নিয়ে নিচ্ছি।”
মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বললো সহন। খাওয়াদাওয়া শুরু করার পর হঠাৎ খেয়াল হলো ফাইজা নেই এখানে।
” মা ফাইজা খেয়েছে? ”
” হ্যাঁ। ও তো নয়টার মধ্যে খেয়ে নেয় এখন। ”
” বাহ! আগে তো দশটার আগে খেতো না। যাক তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া করা ভালো। ”
সহনের কথার মধ্যে তাহমির নজর গেলো ওর গলার দিকে। কামড়ের দাগ না বসলেও লিপস্টিকের দাগ ঠিক বসে গেছে। সামনে বড়ো আম্মু, বড়ো আব্বু বসা! কোনোমতে দেখলে কী ভাববেন তারা? নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ কুকুর বলে মনে হচ্ছে তাহমির। রাগ হয় ভালো কথা কিন্তু কামড়াতে হবে কেন? এটা কেমন লজিক!

চলবে,