রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-১৩+১৪

0
12

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৩
জাওয়াদ জামী জামী

ঘুমের মধ্যেই আশফি অনুভব করল ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ভারী কিছু ওর শরীরে চেপেছে। সেই সাথে বইছে ঝড়। বাতাস ওর চোখমুখে আছড়ে পড়ছে। ছটফট করতে করতে চোখ খুলল সে। প্রায় সাথে সাথেই বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যায় চোখজোড়া। ওর খুব কাছে পুলককে দেখে চমকে উঠল। ওকে জাপ্টে ধরে রেখেছে সে। দু’জনের মুখের মাঝে এক ইঞ্চিও ফাঁক নেই। আশফি ঘুমের ঘোরে যাকে ঝড়ো বাতাস ভেবেছিল, আসলে সেটা পুলকের নিঃশ্বাস। ওরা দু’জনে এক বালিশে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল!

আশফি পুলকের থেকে ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে। অনেক চেষ্টার পরও আশফি পুলকের বাঁধন থেকে আধ ইঞ্চিও ছাড়া পেলোনা। বিরক্ত হয়ে আশফি পুলকের বুকে জোড়ে ধাক্কা দেয়।

বুকে ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে যায় পুলকের। ও চোখ রগরে উঠে বসল। ঢুলুঢুলু চোখে তাকায় আশফির দিকে।

” কি ব্যাপার এভাবে ধাক্কাধাক্কি করছ কেন! আমি ভালো করেই জানি তুমি বোবা নও। তো মুখ ব্যবহার না করে, হাতের এরূপ অপব্যবহার করছ কেন? নাকি আমাকে তোমার আলুর বস্তা মনে হয়? তুমি ধাক্কা দিয়ে বুকের খাঁচা ভাঙ্গবে আর আমি ব্যথা পাবোনা। ” ঘুম জড়ানো গলায় বলল পুলক।

পুলকের এহেন কথায় আশফি লজ্জায় মাথা নিচু করল। রাগের বশে ও একটু জোড়েই ধাক্কা দিয়েছিল লোকটার বুকে। নিজের দোষ ঢাকতে এবার মুখ খুলল আশফি।

” আপনি আমাকে চেপে ধরে ছিলেন কেন? আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এমন করে ধরে থাকলে ঘুমানো যায়? আমার ঘুমের চৌদ্দটা বাজিয়ে আবার আমাকেই কথা শোনাচ্ছেন? আপনার সাথে এক বিছানায় শোয়ার কোন ইচ্ছেই নেই আমার। কাল থেকে আপনি ঐখানে গিয়ে ঘুমাবেন। তবেই আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারব। ” আশফি ইশারায় ডিভান দেখিয়ে দিল।

আশফির কথা শুনে পুলকের ঘুম ছুটে গেল। এই মেয়ে বলছে কি! ওর রুমে এসে ওকেই বিছানা থেকে তাড়িয়ে দিতে তৎপর হয়েছে! ও বালিশের পাশে থাকা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। হাঁই তুলে খাটে হেলান দিয়ে বসল। বালিশ রাখল কোলের ওপর।

” সরি। তোমার কথায় আমি বিছানা ছাড়তে পারবনা। গত সাতাশ বছর যাবৎ একা বিছানায় কাটিয়েছি। কোল বালিশই ছিল সুখ-দুঃখের ভাগীদার। এতদিনে ভাগ্য মুখ তুলে চেয়েছে। অবশেষে কপালে একটা বউ জুটেছে। এতদিন বউহীনতায় ভুগে আমার ভেতর বাহিরে ডিহাইড্রেশন সৃষ্টি হয়েছে। এই ডিহাইড্রেশনের কপালে জুতার বারি দিতে আমার বউকে প্রয়োজন। তাই আমি এখানেই থাকছি। বউয়ের থেকে জীবনিশক্তি নিয়েই আমি ডিহাইড্রেশনের সাথে যুদ্ধ করব। মনে রেখ, এবারের সংগ্রাম ডিহাইড্রেশন ভাগানোর সংগ্রাম। এবাবের সংগ্রাম প্রোডাশনের সংগ্রাম। ”

পুলকের কথা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে আশফি। ও পুলকের শেষের কথা বুঝতে পারেনি। অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারলনা। তাই দুম করে বলেই বসল,

” ডিহাইড্রেশন ভাগাবেন কিভাবে? আর বিছানায় শুয়ে কিভাবে প্রোডাকশনই বা দেবেন? বেশি করে স্যালাইন খেলেই তবে ডিহাইড্রেশন যাবে। সেটা নাহয় বিছানায় বসেই খেলেন। কিন্তু বিছানায় শুয়ে প্রোডাকশন তো আর বিছানায় শুয়ে দিতে পারবেননা। আপনার মাথা ঠিক আছে? নাকি মাঝরাতে বুকে ধাক্কা খেয়ে মাথার তার ছিঁড়েছে! আপনার মাথার তার কি চায়না প্রোডাক্ট? ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি কি নেই? ”

আশফির কথা শুনে পুলক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ওর ঠোঁটগুলো ঈষৎ ফাঁকা হয়ে গেছে। এই মেয়ে বলছে কি! সত্যিই নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। এই মেয়ের সাথে বাকি জীবন কিভাবে কাটাবে, সেই চিন্তা ওকে পেয়ে বসল। তবে বেশিক্ষণ নিরুত্তর থাকলনা।

” এই প্রোডাকশন সেই প্রোডাকশন নয়, সুন্দরী। কিছু কিছু কাজ আছে যেগুলোর জন্য বিছানাই পারফেক্ট। কিন্তু কাহিনী কি বলতো? তুমি কি জেনেই নাদান সাজছ, আমার কাছ থেকে শোনার জন্য? নাকি জানোইনা? যদি জেনেও অবুঝ সাজ তবে আমি কি জিনিস সেটা তোমাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাইয়ে দেব। আর না জানলে ভালোবেসে বুঝিয়ে দেব। এবার বল কোনটা চাও তুমি? অপশন আমার, চয়েস তোমার। ”

এবার আশফির হুঁশ ফিরল। ও চমকে দু হাতে মুখ চেপে ধরল। ঝোঁকের বশে কি বলে ফেলেছে এখন বুঝতে পারছে। তাই বলে এই অসভ্য লোকটা ওকে এভাবে শুনিয়ে দেবে? ছিহ্ কি লজ্জা। ও সিদ্ধান্ত নিল, এই লোকের সাথে আর কথা বলবেনা। পুলকের কোল থেকে বালিশ নিয়ে আশফি শুয়ে পরল। উত্তেজনার বশে খেয়ালও করলনা, ওর মাথার কাছে একটা বালিশ আছে।

” কি ব্যাপার নাদান বালিকা, আমার বালিশ নিচ্ছ কেন? এক মিনিট, তুমি কি তবে ইন্ডাইরেক্টলি চাইছ, আমরা আবারও এক বালিশে শুই? মাই গড, এর মানে প্রোডাকশন শুরু করতে আর কোন বাঁধা থাকবেনা! পুলক মির্জা, তুই তোর বউকে যা ভেবেছিলি, আদৌও সে তা নয়। ”

মনের আনন্দে পুলক গান গেয়ে উঠল,

” আজ রাত তোমাকে যেতে দেবনা,
তুলতুলে গদি আছে, আছে বিছানা। ”

এমনিতেই পুলকের কথা শুনে আশফির হাত-পা কাঁপছিল, তারওপর ওর গান শুনে ভয়ে আধমরা হওয়ার দশ। ও তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। বালিশ ছুঁড়ে মারল পুলকের দিকে।

” অ..অসভ্য লোক একটা। একটা অচেনা মেয়ের সাথে কিভাবে কথা বলছে! লাজলজ্জা বলতে কিছুই নেই। ” পুলকের আনন্দে নিমেষেই জল ঢেলে বলল আশফি।

” তুমি আবার অচেনা হলে কবে! গত কয়েকমাস যাবৎ তোমাকে চিনি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমার চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে। আর বিকেলে বান্ধবীদের সাথে কখনো বাগানে, কখনো পুকুর পাড়ে বেড়াতে। কখনোসখনো সন্ধ্যার পর বাহিরের উঠানে কিংবা চাচার বাড়ির ছাদে তিয়াসার সাথে খিলখিলাতে। যাকে সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাতে নিয়মকরে দেখতাম সে আবার অচেনা হয় কিভাবে? ”

পুলকের কথা শুনে আশফির মাথা ঘুরছে। এই লোক বলে কি!

” আপনি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেন! এতদিন জেনেছি, আপনি গুণ্ডা। কিন্তু এখনতো দেখছি, আপনি চোর। হায় আল্লাহ, শেষ পর্যন্ত আমার চোরের সাথে বিয়ে হল! ” কপাল চাপড়ে বিলাপ করতে থাকে আশফি।

” এই মেয়ে, থামবে? তোমাকে ভালোবাসি তাই লুকিয়ে দেখতে যেতাম। তাই বলে আমি চোর হয়ে গেলাম? এই তুমি ঘুমাও। তুমি যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবে, ততক্ষণ আমার ব্রেইন ঠান্ডা থাকবে। ” রাগে পুলক ধমক দেয় আশফিকে। এরপর বালিশ মুখের ওপর রেখে সটান হয়ে শুয়ে পরল।

আশফি পুলকের ধমকে ভয় পায়। মনে মনে ভাবতে থাকে, কি এমন বলল যে বদ লোকটা এভাবে ধমক দিল। বিরবির করে কয়েকটা গালি দিল পুলককে।

” গালি দেয়া শেষ হলে ঘুমাও। নয়তো ঘুম না হওয়ার অপরাধে আমাকে কাঠগড়ায় তুলবে। ” মুখ থেকে বালিশ সরিয়ে বলল পুলক।

পুলকের কথায় আবারও চমকালো আশফি। ও ভাবল, এই বদ লোক কি মনের কথাও শুনতে পায়! এর সামনে থাকলে মনে মনেও কিছু বলা যাবেনা। সাংঘাতিক বদ লোক একটা।

” কি এত চিন্তা করছ? এত ভাবলে কূল পাবেনা। তোমার মনের সব কথাই আমি শুনতে পাই। এমনকি কি স্বপ্ন দেখ সেটাও আমি জানতে পারি। তাই এত না ভেবে ঘুমিয়ে পর। ”

পুলকের কথা শুনে এবার আশফির মাথা ঘুরে উঠল। বুকে হাত দিয়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। পুলকের কথামত বালিশে মাথা ঠেকাল। ঠিক তখনই ফজরের আজানের চারপাশ মুখরিত হয়। আশফির আর শোয়া হলোনা। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে যায়।

***

সকালে ঘুম ভাঙ্গলে নিজের পাশে শাহেদকে শুয়ে থাকতে দেখে ঝটপট উঠে বসল তিয়াসা। রাতে দেরি করে ঘুমানোয় আজ ফজরের নামাজ কাযা হয়ে গেছে। খুব সাবধানে শাহেদকে পাশ কাটিয়ে বিছানা থেকে নামল তিয়াসা।

কাযা নামায আদায় করে গুটিগুটি পায়ে বাহিরে যায় তিয়াসা। দরজা খুলে উঁকি দেয় চারপাশে।

” কিছু লাগবো, আম্মা? ” কারও আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল তিয়াসা। পাশে তাকিয়ে দেখল গত কালকের সেই মাঝবয়েসী মহিলা।

” দাদুর রুম কোনটা? ” মৃদু গলায় বলল মেয়েটা।

” আসেন আমার সাথে। ”

খাদিজার সাথে নিচে যায় তিয়াসা। খাদিজা জানায়, দাদু নিচেই থাকেন। তার পায়ে সমস্যা থাকার জন্য ওপর-নিচ করতে পারেননা। অনেক বছর পর তিনি গতরাতে ওপরে গিয়েছিলেন।
দাদুর রুমে ঢুকে তাকে সালাম দিল তিয়াসা।

” আসসালামু আলাইকুম, দাদু। ”

তিয়াসার গলা পেয়ে বৃদ্ধ ওর দিকে তাকায়। কিন্তু ওকে চিনতে পারার কোন লক্ষ্মণ দেখা যায়না তারমধ্যে। তবুও তিনি সালামের উত্তর দিলেন।

” খাদিজা, এই মেয়েটা কে? একে কখনো দেখেছি বলে মনে হয়না। কি চায় মেয়েটা? ”

দাদুর কথা শুনে অবাক হয় তিয়াসা।

” আব্বা, এইডা আমাগো শাহেদ বাবার বউ। কাইলকা না শাহেদ বাবার বিয়া হইল? আপনে নতুন আম্মারে কতডি গয়না দিলেন। কাইল রাইতের কতা আজকাই ভুইলা বইসা রইছেন? ” খাদিজা বৃদ্ধকে মনে করানোর চেষ্টা করল।

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বৃদ্ধ হাসিমুখে নিজের কাছে ডাকলেন তিয়াসাকে।

” নাতবউ, তুমি ঐখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার কাছে এসে বস। খাদিজা, তুমি আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে এস। আমি ভোরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে তিনবেলাই নাত বউয়ের সাথে খাব। ” দাদুর কথায় হাসল তিয়াসা। এগিয়ে গেল বৃদ্ধের কাছে।

” আন্টি, আপনি টেবিলে আমাদের খাবার দিন। আমি দাদুকে নিয়ে যাচ্ছি। কষ্ট করে এখানে খাবার নিয়ে আসতে হবেনা। ”

তিয়াস দাদুকে ধরে নিয়ে ডাইনিং এরিয়ায় যায়।

” নাতবউ, শাহেদ ওঠেনি? ও আসলে আমরা একসাথে খেতে পারতাম। ”

শাহেদের কথা উঠতেই চুপ হয়ে যায় তিয়াসা। ও আসলে শাহেদের থেকে দূরে থাকতেই দাদুর কাছে এসেছে। কিন্তু সেই দাদুই তার নাতির কথা জানতে চাইছেন।

” উনি ঘুমাচ্ছেন। আপনি বরং এখন খেয়ে নিন। দুপুরে উনার সাথে খাবেন। ”

দাদু মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৪
জাওয়াদ জামী জামী

ঘুম ভাঙ্গলে পুলক আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসল। পাশে তাকিয়ে শূন্য বিছানা দেখে ভুরু কোঁচকায়। বিরবিরিয়ে বলল,

” মেয়েটা গেলো কোথায়! ” এরপর চারপাশে তাকায়।

ডিভানে আশফিকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়।

” কি ব্যাপার, বউটা আমার ডিভানে ঘুমাচ্ছে কেন? আমি তো ওকে বিছানায় শুতে বারণ করিনি! ” এক লাফে বিছানা থেকে নেমে আশফির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

মেয়েটা বেকায়দায় শুয়ে আছে। হাতদুটোকে মাথার নিচে দিয়ে বালিশের কাজ চালাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই মেয়েটা কপাল কুঁচকে রেখেছে। যেন রাজ্যের বিরক্তি ওর মন-মস্তিষ্কে চেপে বসেছে। চোখ বন্ধ করে দুদণ্ড কিছু একটা ভেবে পুলক টুপ করে চুম দিল আশফির কপালে। দুই সেকেন্ড দীর্ঘ হলো চুমুর স্থায়িত্ব।

দরজা লাগানোর শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো আশফির। এক ঝটকায় উঠে বসল। শব্দের উৎস খুঁজতে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখল পুলক সবেমাত্র ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। যড়িও পুলক ইচ্ছে করেই শব্দ করেছে, তবে সেটা বুঝতে পারলনা আশফি।

ফজরের নামাজ আদায় করে ও ডিভানে শুয়েছিল। গতরাতে পুলকের অসভ্য কথাগুলো শুনে ওর সাহস হয়নি বিছানায় যাওয়ার। পুলককে এতটুকুও বিশ্বাস করতে পারছেনা।

কালকে থেকে বিয়ের শাড়ী পরে থাকায় আশফির অস্বস্তি লাগছে। তাই লাগেজ থেকে একটা শাড়ী বের করে নিয়ে ওয়াশরুম ঢুকল।

আশফি ওয়াশরুমে ঢুকতেই পুলক কাউকে ফোন করতে করতে রুমের দরজা খুলল।

পনের মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আশফি যারপরনাই অবাক হয়েছে। কিছুক্ষন আগেও ডিভান যেখানে ছিল, সেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে আছে। ও ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকল পুলকের দিকে। এই মুহূর্তে ওর বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তবে পুলক আশফির দিকে তাকিয়েই যা বোঝার বুঝে গেছে।

” এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আমি জানি পুরুষ হিসেবে আমি সুদর্শন। তাই এভাবে কু-নজর দেয়ার দরকার নেই। তোমার কু-নজরে আমি ভস্ম হব নিমেষেই। ”

আশফি ঝটপট চোখ নামিয়ে নেয়। এই মানুষের সাথে সংসার জীবন খুব একটা সহজ হবেনা, ও এক রাতেই বুঝে গেছে। তারপরও অনেক চেষ্টা করে একটা বাক্যই বলতে পারল,

” ডিভান কোথায়? ”

” দারোয়ানের রুমে। বেচারার নাকি অনেকদিনের শখ ওর রুমে একটা ডিভান থাকবে। তাই তার শখ পূরণ করেই দিলাম। ”

” কিন্তু আমি কোথায় ঘুমাব? ” মুখ ফসকে পুলকের অপ্রিয় কথাটা বলেই বসল আশফি।

” কেন বিছানায় ঘুমাবে। যদি না পার, তবে আমার বুকে ঘুমাতে পার। বিয়ে করেছি বউকে ডিভানে রাখার জন্য? বউয়ের সর্বোচ্চ সুখ-শান্তির ব্যবস্থা স্বামী হিসেবে আমাকেই তো করতে হবে। ”

দরজার বাহিরে থেকে পুষ্পিতা ওকে ডাকছে। তাই আশফি আর কথা না বাড়িয়ে বাহিরে যায়।

***

শাহেদ ডাইনিং এরিয়ায় এসে দেখল তিয়াসা দাদুর সাথে বসে খাচ্ছে। ও এসে একটা চেয়ার টেনে দাদুর পাশে বসল।

” দাদু, আজকে আমাকে ছাড়াই খাচ্ছ! কষ্ট পেলাম। ”

” দাদু ভাই, তোমার আসতে দেরি হচ্ছিল, তাই আমরা খেতে শুরু করে দিয়েছি। রাগ করোনা, দাদু ভাই। খাদিজা, আমার দাদু ভাইকে খাবার দে। ”

দাদুর কথা শেষ হওয়ার আগেই খাদিজা খাবার শাহেদের প্লেটে একে একে খাবার তুলে দিল।

শাহেদ মাংস দিয়ে এক টুকরা পরোটা মুখে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। এরপর আরেকটু ভুনা মাংস মুখে দেয়।

” খাদিজা আন্টি, ছোট মামী খাবার পাঠিয়েছে? এগুলোর টেস্টই বলছে মামী রান্না করেছে। ” শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা এক ঝলক তার দিকে তাকায়। এরপর চোখ নামিয়ে নেয়।

” ছোট ভাবী নিজেই আইছিল খাবার নিয়া। তোমগোরে ঘুমাইতে দেইখা চইলা গেল। তয় যাওয়ার সুময় কইয়া গেছে, বিকেলে আরেকবার আইব। ”

” খুব সকালে এসেছিল? মামী যে কেন এত কষ্ট করতে যায়! ”

” মল্লিকা তোমাকে ভালোবাসে তাই কষ্ট করে। এমন মামী পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার বুঝলে, দাদু ভাই? ”

শাহেদ হেসে মাথা নাড়ায়। ও ভালো করেই জানে, মা-বাবার মৃ’ত্যু’র পর এই মামীই মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা ওকে দিয়েছে।

” শাহেদ বাবা, আইজকা সকালে তোমার চাচা-ফুফুরা ফোন দিছিল। আমি না কইলে তো আব্বা তোমারে কইতনা। হেয় বোধহয় ভুইলা বইসা রইছে। ”

” কেমন আছে সবাই? কি গল্প করলে তাদের সাথে? ”

” তারা তোমার বিয়ার কথা শুইনাই ফোন দিছিল। বউমার সাথে কইতে চাইছে। হেরা নাকি দুইমাস পর আইব বউমারে দেখনের লাইগ্যা। ”

” দাদু , তোমার ছেলেমেয়েরা আসছে। এই দুইমাস ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া কর। সুস্থ থাকতে হবে কিন্তু। ”

শাহেদ কথার ফাঁকে ফাঁকে তিয়াসাকে লক্ষ্য করছে। তিয়াসা চুপচাপ খাচ্ছে। ওদের কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছেনা। ”

” দাদু ভাই, তোমার চাকরির কি হল? কতদিন এভাবে ঘুরে বেড়াবে। পড়াশোনা শেষ করেছ অনেক বছর হয়েছে। এবার কিছু একটা কর। ”

” দাদু, এক বছর হয়ইনি আমার পড়াশোনা শেষ হয়েছে। এত ভুলে যাও কেন বলতো! ”

” আমি ভুল বলেছি? তাহলে হয়তো তা-ই। আজকাল খাদিজা সব সময়ই অভিযোগ করে, আমি নাকি ভুলে যাই। কি করব বল? বয়স হয়েছে তো। ”

” কে বলেছে দাদু, তোমার বয়স হয়েছে! তুমি তো সেই আঠারো বছরের যুবকই আছ। এবার একটা সুসংবাদ শোন, কিছুদিনের মধ্যেই একটা জব হচ্ছে আমার। তিনমাস আগেই একটা জায়গায় এ্যাপ্লিকেশন করেছিলাম। সেখান থেকে ডেকেছিল পনের দিন আগে। এখন শুধু জয়েন করার পালা। ”

” শাহেদ বাবা, তুমি চাকরি পাইলে এই বাড়িতে থাকবানা? ”

” কোথায় যে পোস্টিং হবে আন্টি, সেটা জানিনা। ভালো কথা, আন্টি, আপনিতো গ্রামে যেতে চেয়েছিলেন। কবে যাবেন? চাচ্চু, ফুপি আসার আগেই গ্রাম থেকে ঘুরে আসেন। তারা আসলে কিন্তু দুই মাস কোথাও বেড়োতে পারবেননা। ”

” এইসব কি কও, বাবা! বাড়িতে নতুন বউ আইছে, আর আমি এহনই যামুগা? হেগোর আসতে আরও দুইমাস বাকি। আমি একমাস পর যাইয়া সাতদিন থাইকা আমুনে। ”

” আচ্ছা, তুমি যেটা ভালো মনে কর। দাদু, আমি বেড়োব। তোমার জন্য কিছু আনতে হবে? ”

” না দাদু ভাই, আমার কিছু লাগবেনা। নাতবউয়ের কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস কর। ও নাতবউ, তোমার কিছু লাগবে? কিছু লাগলে শাহেদকে বল। ”

” না দাদু, আমার কিছু লাগবেনা। ”

শাহেদ কোনরকম নাস্তা শেষ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

***

নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে রিফাত। ও পণ করেছে, তিয়াসার কথা আর ভাববেনা। তিয়াসা এখন অন্যের বউ। ও মন থেকে চায় তিয়াসা ভালো থাকুক, সুখে থাকুক।

সকালে বাড়িতে ফোন দিয়ে জেনেছে তিয়াসা, আশফি দু’জনেই ভালো আছে। ও আশফির সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলকের ফোন বন্ধ পেয়েছে। আশফিও ফোন সাথে করে নেয়নি। বাড়িতে আরেকবান ফোন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রিফাত। আশফির শ্বাশুড়ির নম্বর নেয়া দরকার। কিন্তু কাজের চাপ বেশি থাকায় তৎক্ষণাৎ ফোন দিতে পারলনা রিফাত। ব্যস্ত হয়ে পরল অফিসের কাজে।

***

নাস্তা শেষ করে রুমে এসে পুলক দেখল ওর ফোনে চার্য নেই। ফোন চার্যে দিয়ে ইংরেজি ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বিছানায় বসল। এখন আর বাহিরে যাওয়া হলোনা।

আশফি রুমে ঢুকে পুলককে ম্যাগাজিন পড়তে দেখে যারপরনাই অবাক হয়। ও উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করল পুলক সত্যিই পড়ছে নাকি ঢং করছে। কিন্তু পুলকের মুখভঙ্গি দেখে কিছুই বুঝলনা।

চোখের কোনা দিয়ে আশফিকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে পুলকের কপালে ভাঁজ পড়ল।

” কি দেখছ চোরের মতন। কিছু দেখার দরকার হলে আমার কোলে এসে বসবে, সেটা না করে তুমি উঁকিঝুঁকি মারছ কেন! আমার কোলের রিজার্ভ তুমি অলরেডি করে নিয়েছ। ”

পুলকের কথায় ঝট করে সোজা হয় আশফি। চুপ থাকতে চেয়েও পারলনা। মুখ ফসকে বলেই ফেলল,

” আপনি ইংরেজি পড়তে জানেন! নাকি পড়ার ভান করছেন? ”

আশফির কথায় পুলক স্তব্ধ হয়ে গেছে।

” তোমার কি মনে হয়, আমি ব কলম? ”

” আমি শুনেছি আপনি মাঝপথেই পড়াশোনা ছেড়েছেন। নিশ্চয়ই ভালো স্টুডেন্ট ছিলেননা। কারন ভালো স্টুডেন্টরা কখনো পড়াশোনা ছাড়েনা। ”

” চুপ কর, ষ্টুপিড মেয়ে। তোমার এসএসসি, এইচএসসির রেজাল্ট কি ছিল? ”

” জিপিএ ফাইভ। কিন্তু আপনার রেজাল্টের সাথে আমার পড়াশোনার সম্পর্ক কি? নাকি নিজের বাজে রেজাল্ট আমাকে জানাতে চাননা? ”

” আমি এসএসসি, এইচএসসিতে বোর্ডে দ্বিতীয় হয়েছিলাম। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, বুঝলে? ”

পুলকের কথা শুনে হা হয়ে গেছে আশফি।

” তাহলে পড়াশোনা ছাড়লেন কেন? ”

” ইচ্ছে হয়নি তাই পড়িনি। ”

আশফি আর কথা বাড়ালোনা। গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বিশাল বারান্দা জুড়ে অনেকগুলো ফুলের টব রাখা। টবে ফুটে আছে নানানরকম ফুল। রাতেই আশফি ফুলের সুবাস পেয়েছিল। ও ভেবেছিল, এই বাড়ির বাগানে বোধহয় সুগন্ধি ফুলের গাছ আছে। কিন্তু না, বারান্দায় ফুটে থাকা ফুলের সুবাসেই ও বিমোহিত হয়েছিল।

বেশ কিছুক্ষণ বারান্দায় কাটিয়ে রুমে এসে দেখল পুলক তৈরী হচ্ছে। ও বিছানায় বসে এক আঙুল দিয়ে আরেক আঙুল খুঁটছে।

” কি ব্যাপার, এত খোঁচাখুঁচি করছ কেন? কি বলবে বলে ফেল। আমার সাথে কথা বলতে ইতস্তত করবেনা। যখন যেটা বলার ইচ্ছে হবে বলে ফেলবে। ”

পুলকের কথা শুনে আশফি আকাশ থেকে পরল। ও নিশ্চিত হয়ে গেছে, এই লোক মনের কথা পড়তে পারে।

” ঠিক ধরেছ, তোমার মনের কোনের প্রতিটি কথা আমি শুনতে পাই। আমার কাছ থেকে কোন কথা তুমি লুকাতে পারবেনা। এবার বল কি বলবে? ” আশফিকে চুপ থাকতে দেখে পুলক আবারও বলল।

” আসলে আমার ফোন বাড়িতেই রেখে এসেছি। কাল থেকে ভাইয়ার সাথে কথা বলতে পারিনি, আব্বার কোন খবরও পাইনি। আবার তিয়াসারও খবর নেয়া হয়নি। ”

পুলক এক মুহূর্ত তাকায় আশফির দিকে। কয়েক পা এগিয়ে এসে আশফির দিকে ফোন বাড়িয়ে দেয়।

আশফি ফোন পেয়ে প্রথমে রিফাতের নম্বরে ডায়াল করল। এরপর আব্বার সাথেও কথা বলল। সবশেষে ফোন দিল তিয়াসাকে।

***

তিয়াসা জানালার গ্রীলে কপাল ঠেকিয়ে অঝোরে কাঁদছে। কয়েকবার ফোন হাতে নিয়েছে রিফাতের সাথে কথা বলবে বলে। কিন্তু যখনই মনে হয়েছে রিফাত ওকে ফোন করতে নিষেধ করেছে, তখনই ফোন ছুঁড়ে ফেলেছে বিছানায়। রিফাতের কথা আগে কখনোই অমান্য করেনি, আজকেও করতে চায়না।

ফোনের শব্দে চোখ মুছে বিছানার দিকে এগিয়ে যায় তিয়াসা। স্ক্রীনে অচেনা নম্বর ভাসছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে রিসিভ করল।

” তিয়ু, কেমন আছিস তুই? ”

আশফির গলা শুনে বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটা। দু’জনেই একই শহরে অবস্থান করছে। অথচ মনে হচ্ছে যোজন যোজন দূরে ওদের বাস।

” আমি ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? কোনরকম বোকামি করছিস নাতো? ” তিয়াসা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল।

” আমি বোকামি করলে কখনো নিজে বুঝতে পেরেছি? তোরাই তো ধরিয়ে দিয়েছিস। এখানে আমার বোকামি ধরিয়ে দেয়ার মত কেউ নেই। ”

” কথা কম বলবি। ভেবেচিন্তে অন্যের কথার উত্তর দিবি। মনে রাখবি, তোকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য আমি সেখানে থাকবনা। ”

” তুই এত চিন্তা করিসনা। খেয়েছিস, তিয়ু? ”

” হুম খেয়েছি। ” কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবারও কথা বলল তিয়াসা।

” রিফাত ভাইয়ার সাথে কথা বলেছিস আজকে? ”

” একটু আগেই বলেছি। আব্বা, ভাইয়া দুজনের সাথেই কথা বললাম। ”

” ভাইয়া কেমন আছে? ”

” মনে হয় ভাইয়ার কিছু একটা হয়েছে। কেমন যেন মনমরা হয়ে কথা বলল। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু ভাইয়া কিছুই বললনা। ”

আশফির কথা শুনে তিয়াসা ডুকরে কেঁদে উঠল। পাছে আশফি শুনতে পায় এজন্য ফোন একটু দূরে সরিয়ে রাখল।

” তিয়ু, এই তিয়ু কি হয়েছে তোর। ” অপরপাশ থেকে তিয়াসার সাড়া না পেয়ে আশফি বারবার ওকে ডাকতে থাকে।

অনেকক্ষণ পর তিয়াসা স্বাভাবিক হয়ে কথা বলল,

” সরি রে, ফোন রেখে পানি পান করছিলাম। ভালো কথা এটা কার নম্বর? ”

আশফি আশেপাশে পুলককে দেখলনা। তাই নির্ভয়ে উত্তর দিল,

” বুড়ো শেয়ালের ফোন থেকে কথা বলছি। আচ্ছা শোন, এখন রাখছি। পরে আবার কথা বলব। ”

” সাবধানে থাকিস। আর আমার কথাগুলো মনে রাখিস। ”

আপনজনদের সাথে কথা বলতে পেরে আশফির শান্তি লাগছে।

চলবে…