#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৫
জাওয়াদ জামী জামী
মল্লিকা মির্জা আশফিকে নিচে ডেকে পাঠালে আশফি নিচে আসল। সিঁড়িতে পা দিয়েই ড্রয়িংরুমের দিকে তাকাতেই ও মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পুলকের গ্যাং ড্রয়িংরুম মাতাচ্ছে।
” হায় আল্লাহ, দুইদিন আগেও এরা আমাকে ভাবী ডেকে মুখ দিয়ে ফেনা তুলত। তখনতো আমি ঐ বদ লোকের বউ ছিলামনা। তখনই এদের সেবায় অতিষ্ঠ হয়ে যেতাম। এখনতো আমি এই বদ লোকের বউ। এবার বুঝি এদের ডাকে, সেবা-যত্নে আমি পাগল হয়ে যাব! আল্লাহ এই বান্দরের দলের হাত থেকে বাঁচাও আমাকে। ” আশফি বিরবির করতে করতে নিচে নামে।
” ভাবী, আমাদের ভাবী, কেমন আছেন? ”
” আসসালামু আলাইকুম, ভাবী। ” ড্রয়িংরুমে বসা আট-দশজনের প্রত্যেকেই একে একে আশফিকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল।
আশফিও চেষ্টা করল সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে।
” ভাবী, এটা নেন। আগে নাহয় সমস্যা ছিল, তাই আমরা কিছু দিলে নেননি। যদিও সেগুলো ভাই-ই দিত। ” সাকিব এসে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিল আশফির দিকে।
আশফি প্যাকেটটা নিতে ইতস্তত করছে।
” আরে ভাবী, নিন না। এরপর আমাদের পালা। ” সবাই একযোগে বলল।
” কি ব্যাপার, তোমরা কি এনেছ? যেখানে তোমরা নিজেরাই দশ টাকার জন্য বাবার ওপর নির্ভর কর, সেখানে কেন এসব করতে হবে? ” মল্লিকা মির্জা এসে ছেলেদের কৃত্রিম ধমক দিলেন।
” আন্টি, আমরা কিন্তু বেকার নই। বাড়ি থেকে আর একটা টাকাও নিইনা। ভাই আমাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ” সাকিব বলল।
” তোমরা কাজ কর! তাহলে মাস্তানী-গুণ্ডামি কর কখন? তোমাদের কাজ বলতে তো একে মারা, তাকে ধরা এসবই আমি জানি। ”
” এভাবে বলবেননা, আন্টি। জানেননা, কানাকে কানা বলতে নেই, খোঁড়াকে খোঁড়া বলতে নেই, বধিরকে কানে খাটো বলতে নেই? ” রকি একটু ন্যাকা স্বরে বলল। ও একটু মেয়েলি স্বরে কথা বলে।
রকির কথার টান শুনে আশফি হেসে উঠল। এবার নিজেকে কথা বলা থেকে বিরত রাখতে পারলনা।
” কানা, খোঁড়া, বধির এরা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। আপনারাও কি তাই? মানে গুণ্ডা-মাস্তানরাও কি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের তালিকায় পরে! প্রতিবন্ধী কার্ড করেছেন? নিয়মিত ভাতা পান? আপনাদের লিডারেরও কি প্রতিবন্ধী কার্ড আছে? সে-ও কি ভাতা পায়? ”
আশফির কথা শুনে পুলক রাগে ফুঁসছে। নিজের বউ হয়ে জামাইকে কেমন সবার সামনে অপদস্ত করছে! অন্যের বউ এমন করলে নাহয় মানা যেত।
এদিকে আশফির কথা শুনে পুষ্পিতা পারলে হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি খায়। কিছুতেই ওর হাসি থামছেনা। আর পুলকের ছেলেরা আশফির করা হেনস্তায় গুটিয়ে গেছে। ওরা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে পুলকের দিকে। যার অর্থ, ভাই কিছু কর।
” পুষ্পিতা তুই কি থামবি, নাকি কানের নিচে চটকানা দেব? ” পুলকের ধমকে পুষ্পিতা হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কাজ হচ্ছেনা। বাধ্য হয়ে ও নিজের রুমে চলে যায়। সেখানে গিয়ে ইচ্ছেমত হাসতে থাকে।
” বউমা, তুমি আমার সাথে এস। তোমাকে আমাদের রান্নাঘর দেখাই। আর এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বাহিনীর জন্য নাস্তাও বানাই। তার আগে এই উজবুকগুলোর কাছ থেকে গিফ্ট নিয়ে নাও। ” মল্লিকা মির্জাও হাসছেন। তিনি মনে মনে ভাবছেন, আশফি ওদের বেশ জব্দ করেছে।
***
রুমের জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে সূদুরে তাকিয়ে আছে তিয়াসা। সামনের দিনগুলোর কথা চিন্তা করছে মেয়েটা। বাকিটা জীবন কিভাবে কাটবে ওর? ও কখনোই শাহেদকে ভালোবাসতে পারবেনা এটা মোটামুটি নিশ্চিত। শাহেদ কি এসব মেনে নেবে? বিয়ে নিয়ে প্রতিটা মানুষের মনেই ফ্যান্টাসি থাকে,স্বপ্ন থাকে। শাহেদও নিশ্চয়ই এর ব্যাতিক্রম নয়। কিভাবে সামলাবে ও শাহেদকে? নানায় চিন্তায় তিয়াসার শরীর অবসন্ন হয়ে গেছে।
” কি দেখছ এভাবে? ” নিজের খুব কাছে শাহেদের গলা শুনে চমকে একধাপ পিছিয়ে যেতেই জানালার গ্রীলে পিঠ ঠেকে যায় তিয়াসার।
” ছোঁবেননা আমাকে। ” নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বলে ফেলল।
তিয়াসার এহেন কথায় থমকে যায় শাহেদ। সে তো তিয়াসাকে ছুঁতে চায়নি।
” তোমাকে ছুঁতে চাইনি আমি। আর ছুঁলেই বা দোষ কোথায়? তুমি আমার স্ত্রী। অধিকার আছে আমার। ”
” নাহ্! ” তিয়াসার গলা কাঁপছে।
” কেন? ”
” আমি এখনও মন থেকে প্রস্তুত নই। আমার সময় লাগবে। ”
তিয়াসার কথায় মৃদু হাসল শাহেদ। ও বুঝতে পারছে তিয়াসার এমন কথা বলার কারন। ঠকেছে ও। আর ঠকেছে নিজের বোকামির কারনে। কেন হুটহাট তিয়াসাকে ভালোলাগার কথা জানিয়েছিল মামীকে! কেন আগে জানতে চায়নি তিয়াসার একান্ত কেউ আছে কিনা!
” মামীর প্রস্তাব শোনার পর কেন জানালেনা, তুমি কারও কাছে প্রতিজ্ঞানবদ্ধ? তাহলে অন্তত তোমাকে কষ্ট পেতে হতোনা। ”
শাহেদের কথা শুনে তিয়াসার সর্ব শরীর কাঁপছে। যে ভয়টা ও পাচ্ছিল, সেটাই সত্যি হল। কি জবাব দেবে ও শাহেদের কথার? অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে কথা গুছিয়ে নিল তিয়াসা। ধরা যেহেতু পরেই গেছে, সেহেতু লুকিয়ে লাভ নেই। তবে ওর ভয় হচ্ছে রিফাতকে নিয়ে। তিয়াসা কোনভাবেই এই সম্পর্কের টানাপোড়েন লুকিয়ে রাখতে পারবেনা। প্রকাশ একদিন হবেই। আর সেদিন কি হবে সেটা ভাবতেই ওর ভয় হচ্ছে।
ও পুলক আর তার গ্যাংকে ভালো করেই জানে। ওরা শাহেদের জন্য রিফাতের ক্ষতি করতে এক মুহূর্তও ভাববেনা। হয়তো পুলক আশফির কথা ভেবে এসবে জড়াবেনা। কিন্তু ঐ গ্যাং এ শাহেদের ভূমিকাও কম নয়। পুলক রিফাতকে কিছু না বললেও অন্যেরা ঠিকই বলবে। অনেক ভেবেচিন্তে মুখ খুলল তিয়াসা। যাই হয়ে যাক না কেন ও রিফাতের কথা কাউকে বলতে চায়না।
” আমি স্বেচ্ছায় বিয়েতে রাজি হয়েছি। হয়তো একসময় কারও কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু বিয়ের সাথে সাথে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। হয়তো আপনাকে মেনে নিতে আমার সময় লাগবে। আই হোপ, সে সময়টুকু আমাকে দেবেন। ”
অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রাখল শাহেদ। তিয়াসার কথার ধরনই বলে দিচ্ছে, ওর ভালোবাসা সহজে ভুলতে পারবেনা। শাহেদ বরাবরই ঠান্ডা মাথার ছেলে। রাগ ওর ধাতে নেই। তবে তিয়াসা যদি একবার ওর মুখের দিকে তাকাতো তবে ওর চোখেমুখে ফুটে ওঠা কষ্ট ঠিকই অনুধাবন করতে পারত।
শাহেদ দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সেই সাথে বেড়িয়ে গেল বাড়ি থেকে। ওর মন-মস্তিস্কে ঝড় বইছে। ও বুঝতে পারছেনা এই ঝড় সামাল দেবে কিভাবে।
***
” আম্মু, ভাবীকে নিয়ে একটু শপিংয়ে যাই? আগামী পরশু অয়নের বাবা-মা’র এনিভার্সারি। আংকেল-আন্টির জন্য গিফ্ট কিনতে হবে। ”
আশফির সাথে গল্প করছিলেন মল্লিকা মির্জা। তখনই পুষ্পিতা এসে ওর মা’কে রিকুয়েষ্ট করল।
” রিসিপশনের আগে বউমাকে বাহিরে যেতে দেবোনা। যা শপিং করার তুমি একাই করো। আর অয়নের বাবা-মা’কে আংকেল, আন্টি ডাকছ কেন? এখন থেকেই অভ্যাস কর, নয়তো বিয়ের পরও এই বদ অভ্যাস থেকে যাবে। ”
আশফি অবাক হয়ে গেছে শ্বাশুড়ির কথা শুনে। পুষ্পিতা কাউকে পছন্দ করে, আর সেটা ওর বাড়িতেও জানে! আবার বিয়ের আগেই সেই বাড়ির অনুষ্ঠানেও যাবে! আশফি ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকল ওদের দিকে।
” কি আম্মু, তুমি ব্যাকডেটেড শ্বাশুড়ির মত কথা বলতে শুরু করলে যে! কি হবে এখন যদি ভাবী শপিংয়ে যায়? আমি চিন্তা করেছি, অয়নদের বাসায় আমি ভাবীকেও নিয়ে যাব। তাই অযথাই পুরোনো দিনের শ্বাশুড়ি হওয়ার চেষ্টা করোনা। ”
” আমি যেটা বলেছি সেটাই হবে। শুধু নিজের শ্বাশুড়ির সংস্কার মানার চেষ্টা করছি আমি। নতুন বউ সাতদিনের আগে বাবার বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও যাবেনা। তোমার দাদিও সব সময়ই বলতেন, নতুন বউদের সাতদিন বাড়ি থেকে বের হতে নেই। এর মধ্যে তারা শুধু বাবার বাড়িতে যাবে। এতে যদি আমি পুরোনো দিনের শ্বাশুড়ি হই তো হলাম। ”
” আম্মু, প্লিজ। ” অনুনয় করল পুষ্পিতা।
” চুপ কর, কোন কথা হবেনা। বউমা, তুমি আমার ওপর রাগ করোনা কেমন? গতরাতেই তোমার শ্বশুরকে নিয়ে মেহমানদের লিষ্ট করেছি। আজকে চেইক দেব কেউ বাদ পরল কিনা। আজকে রবিবার। মঙ্গলবার তোমাদের রিসিপশন। বুধবার তোমার বাবার বাড়িতে যাবে। এরমধ্যে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, বউমা। ”
” আমি রাগ করিনি, মা। আমাদের গ্রামেও নতুন বউদের বাড়ি থেকে বের হতে দেয়না। গুরুজনরা বলে, এতে নাকি সমস্যা হয়। খারাপ নজর লাগে। ”
পুস্পিতা বুঝল ওর সকল আশায় পানি ঢেলে দিল ভাবী। আজকের দিনের জন্য কত প্ল্যান ছিল ওর। ভাবীকে নিয়ে ঘুরবে, রেস্টুরেন্টে যাবে। ও মন খারাপ করে একাই শপিংয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
রাত দশটা বেজে গেছে। আশফি এতক্ষণ পুষ্পিতার সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। পুষ্পিতা ওর হবু শ্বশুর-শ্বাশুড়ির জন্য কি গিফ্ট কিনেছে সেটা আশফিকে দেখায়। এছাড়াও আশফির জন্য অনেক কেনাকাটা করেছে মেয়েটা। এত শপিং দেখে আশফি তব্দা খেয়ে গেছে। ওর বিশ বছরের জীবনে ওর এত কেনাকাটা কেউ করেনি। অনেক সময় এমনও হয়েছে ঈদেও কোন পোশাক পায়নি। ভাইয়া ওদের দুই ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খেত। তাই বছরে খুব বেশি হলে দুই সেট থ্রিপিস পেত ও। আর সেটা ভাইয়াই দিত। অবশ্য প্রতি ঈদে চাচী একটা করে পোশাক দিত। আর বড়মা বছরে দুই-তিনটা জামা দিত। তাই আজ চোখের সামনে দশটা থ্রিপিস, দশটা শাড়ী দেখে কেঁদে ফেলল আশফি। আশফিকে কাঁদতে দেখে মল্লিকা মির্জা ওকে জড়িয়ে ধরলেন। পুষ্পিতার ডাকে তিনিও এসেছিলেন আশফির জন্য নিয়ে আসা পোশাক দেখতে।
” তুমি কাঁদছ কেন, বউমা? তোমার কি এসব পছন্দ হয়নি? পছন্দ না হলে বল, আমি কালকেই তোমার জন্য আরও সুন্দর পোশাক নিয়ে আসব। ” মল্লিকা মির্জা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন।
” সবগুলোই আমার পছন্দ হয়েছে, মা। আসলে জীবনে একসাথে কখনো এত পোশাক পাইনিতো তাই আবেগে কেঁদে ফেলেছি। ”
মল্লিকা মির্জা একজনের কাছ থেকে আশফির ছোটমা সম্পর্কে শুনেছিলেন। তার কথার সত্যতা আশফির চোখের পানিতেই প্রমান হয়ে গেল। তিনি এবার আশফির কাছে জানতে চাইলেন তার পরিবার সম্পর্কে।
” তোমার আব্বা-আম্মা তোমাকে শপিং করে দিতনা? আমি শুনেছি তুমি যাকে আম্মা ডাক, সে নাকি তোমার সৎ মা? সে কি তোমাদের দুই ভাইবোনকে আদর করেনা? তুমি যদি চাও নিজের মা ভেবে আমাকে সবকিছু বলতে পার।”
মল্লিকা মির্জার প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে বসে থাকল আশফি। কিভাবে নিজের পরিবার সম্পর্কে নেগেটিভ কথা বলবেও! অবশ্য আজকে ও না বলল, এক সময় ইনারা ঠিকই জেনে যাবেন। তাই সত্যিটা বলারই সিদ্ধান্ত নিল।
” আমার আট বছর বয়সেই আম্মা মা রা যায়। ভাইয়া তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। আম্মার মৃ ত্যু র ছয়মাস পর আব্বা ছোটমাকে বিয়ে করে। এরপর ধীরে ধীরে আব্বা পাল্টে যায়। বদলটা প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু ভাইয়া যখন বুঝতে পেরেছে, তখন থেকেই নিজে কিছু করার চেষ্টা করেছে। ক্লাস টেনে ওঠার পর থেকেই ভাইয়া টিউশনি করাতো। সেই টাকাতেই চলত আমাদের দুই ভাইবোনের পড়াশোনা। সংসারে ছোটমা কর্তী হয়ে উঠেছে ততদিনে। আমাদের ঠিকমতো খেতে দিতনা। আবার সে কথা কাউকে বলতেও পারতামনা। কিন্তু বড়মা ঠিকই বুঝে যেত। প্রতিদিন তার ঘরে আমাদেরকে ডেকে খেতে দিত। বড়মা না থাকলে আমরা হয়তো কবেই শেষ হয়ে যেতাম। ভাইয়া শুধু টিউশনি করে আমাকে প্রয়োজনীয় পোশাক দিতে পারতনা। তাই বড়মা বছরে দুই-তিনটা জামা দিত। বড়মা না থাকলে হয়তো আমরা কবেই শেষ হয়ে যেতাম। ”
আশফির কথা শুনে মল্লিকা মির্জা আর পুষ্পিতা বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। মল্লিকা মির্জা যা শুনেছেন তার সবটাই সত্যি। পুষ্পিতা ভাবছে, সবার জীবন একরকম নয়। কেউ বড় প্রাচুর্যতার মাঝে, কেউবা বেড়ে উঠে অভাব-অনটনকে সঙ্গী করে, আবার কেউবা সংসারে অবহেলা, নির্যাতন সয়ে বড় হয়। একটাই পৃথিবীতে কত রকমের মানুষের বাস। মানুষের কত রকমের সমস্যা।
” ভাবী, তোমরা প্রতিবাদ করতেনা? আর তোমার বাবাই বা কেমন! তিনি এসব জানতেননা? ”
” ভাইয়াকে প্রতিবাদ করতে দেখেছি। ভাইয়ার দেখাদেখি আমিও প্রতিবাদ করতে গেছি। কিন্তু তার ফল ভালো হতোনা। এরপর আস্তে আস্তে প্রতিবাদ করতে ভুলে যাই। আব্বা সারাদিন স্কুলে থাকত। স্কুল শেষে সেখানেই ছাত্র পড়াত। তাই আব্বা কিছুই জানতনা। তবে এক সময় ছোটমার হাতের পুতুল হয়ে যায় সে। আমাদের কোন কথাই বিশ্বাস করতনা। তাই তার কাছে কোন অভিযোগ করা বন্ধ করে দিই। ”
মল্লিকা মির্জা পরম স্নেহে আশফিকে কাছে টেনে নিলেন। চুমু দিলেন ওর কপালে।
” আজকের পর থেকে তুমি আগের জীবনের সব কথা ভুলে যাবে। এবার থেকে প্রতিমাসে তোমার জন্য পুষ্পিতার আজকের কেনা পোশাকের থেকেও বেশি পোশাক আসবে। আর হ্যাঁ, প্রতিমাসে তোমার বাবা-মা’কে দাওয়াত করবে। রাঁধুনিকে বলে দিবে কি কি রান্না করতে হবে। তুমি নিজ হাতে তাদের খাওয়াবে। প্রতি বছর তাদের দামী পোশাক কিনে দিবে। এটাই হবে তোমাদের প্রতি করা তাদের অন্যায়-অত্যাচারের জবাব। মনে রেখ, কাউকে তার অন্যায়ের শাস্তি দিতে হলে সব সময় তাকে কথার আঘাত না করলেও চলে। আঘাত না করেও অপরাধীর গালে চপেটাঘাত করা যায়। ”
আশফি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর শ্বাশুড়ির দিকে। ওর সামনে বসে থাকা মানুষটা যে মন্দ নয় এটা ও বুঝে গেছে।
” আমার প্রতিমাসে নতুন পোশাক লাগবেনা, মা। এগুলো না ছেঁড়া পর্যন্ত নতুন পোশাক আনবেননা কিন্তু। এগুলো দিয়েই আমার কয়েক বছর চলে যাবে। ”
” তুমি মির্জা বাড়ির বউ। এই কয়টা পোশাক দিয়ে তুমি কয়েক বছর চলার চিন্তা করছ! শোন পাগলী মেয়ে, তুমি না চাইলেও পোশাকের স্তুপে তোমাকে হাবুডুবু খেতে হবে। তুমি শুধু হুকুম করবে, দেখবে চোখের পলকেই তোমার সামনে সবকিছু হাজির হয়ে যাবে। ”
পুলক চলে আসায় ওদের গল্পে ব্যাঘাত ঘটল।
” আম্মু, তোমরা কি অনলাইনে বিজনেস চালু করেছ? বেশ ভালো। চালিয়ে যাও। আমিও তোমার বিজনেসের প্রচার করব। ” পুলক রুমে ঢুকে বিছানায় কাপড়ের স্তুপ দেখে বলল।
” ফাজিল ছেলে, বিজনেস করলে এই কয়টা আইটেম নিয়ে করব! এসব বউমার জন্য। পুষ্পিতা নিচে চল। টেবিলে খাবার দেই। বেটা, তুমি ফ্রেশ হয়ে বউমাকে নিয়ে নিচে এস। ”
মল্লিকা মির্জা মেয়েকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলে পুলক একটা প্যাকেট বাড়িয়ে ধরল আশফির দিকে। কিন্তু আশফি সেটা না নিয়ে তাকিয়ে থাকল।
” কি হলো নিচ্ছনা কেন? নিবেনা এটা? ”
” কি আছে এতে? ”
” খুলে না দেখলে বুঝবে কিভাবে। খুলে দেখ পছন্দ হয় কিনা। ”
আশফি প্যাকেট হাতে নিয়ে খুলে চোখ বড় করে তাকায় পুলকের দিকে।
” এটা আমার! ”
” হুম। ”
” এটাতো আইফোন! আমি এত দামী ফোন দিয়ে কি করব? ”
” প্রতিদিন সকাল, বিকাল,সন্ধ্যায় আইফোন পানিতে চুবিয়ে সেই পানি খাবে। এতে তোমার ব্রেইন আইফোনের মত শার্প হবে। ”
” পানিতে ফোন নষ্ট হয়ে যাবেনা! ”
আশফির কথা শুনে পুলক কপাল চাপড়ায়।
” আল্লাহ, একটু বুদ্ধি এই মেয়ের ঘটে দিলে কি হত! আরে ম্যাম, আপনার কাছে ফোন নেই তাই, আপনার জন্য এটা এনেছি। এটাতে সিমকার্ডও আছে। এটা দিয়ে আপনি সবার সাথে কথা বলবেন। আগের ফোনের কথা ভুলে যাবেন। ”
পুলক আশফির হাতে ফোন দিয়ে কাবার্ড থেকে টি-শার্ট, ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।
চলবে…
#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_১৬
জাওয়াদ জামী জামী
” বউমা, ইনি তোমার চাচা শ্বশুর। তোমার শ্বশুরের চাচাতো ভাই। ভাইজান ঢাকা থাকেন।দ পরিবার নিয়ে। আজকেই এসেছেন তোমার রিসিপশনের জন্য। ” পঁয়ষট্টি-সত্তর বছরের ভদ্রলোককে আশফি সালাম দিল। তিনিও আশফির সাথে মনখুলেই কথা বললেন।
একসাথে খেতে বসেছে সবাই। নতুন বাড়ি, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশে আশফি একটু ইতস্তত করছে। লজ্জায় সকাল থেকে একবারও পেট পুরে খায়নি। ওর এই এক সমস্যা। নতুন কোথাও গেলে, কিংবা বেশি মানুষজনের সামনে খেতে পারেনা।
রাতেও খাবার টেবিলে দুই-তিনবার খাবার মুখে দিয়ে আর খেতে পারলনা। শ্বাশুড়িকে বলে রুমে চলে গেল।
” এগুলো খেয়ে নাও। কিছুইতো খেলেনা দেখলাম। ” পুলক ট্রেতে করে খাবার নিয়ে আসল রুমে। ও সেন্টার টেবিলে ট্রে রেখে আশফিকে খেতে বলল।
” আপনি লক্ষ্য করছেন আমি খাইনি! ” আশফি সত্যিই অবাক হয়েছে পুলকের কাজে।
” তুমি আমার স্ত্রী। তোমার ভালোমন্দ, সুবিধা-অসুবিধা দেখার দ্বায়িত্ব আমার। সবার সাথে খেতে সমস্যা হলে আমাকে অথবা আম্মুকে বলবে। মনে রেখ, এটা তোমার নিজের বাড়ি। এখানে কোনরকম সমস্যা হলে আমাদের বলবে। অথবা নিজে থেকে সমাধানের চেষ্টা করবে। এখানে কেউ তোমার কোন কাজে বাঁধা দেবেনা। এখন এগুলো খেয়ে আম্মুর রুমে যাও। আমার বড় মামী, মামাতো বোন শপিংয়ে গেছে। তুমি রিসিপশনে কি ড্রেস পরবে সেগুলো বোধহয় কিনতে গেছে। আম্মু তাদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। তুমি গেলেই সব সিলেক্ট করবে। ”
” আমি এসবের কি বুঝি! জীবনে কখনো শপিংয়ে যাইনি, নিজের পছন্দমত একটা পোশাকও কিনিনি। সব সময়ই ভাইয়া কিনে দিত। ” মুখ ভার করে বলল আশফি।
” আগে করোনি, এখন করবে। ভুলে যাচ্ছ কেন, তোমার আগের জীবনের সাথে এখনকার জীবনের অনেক পার্থক্য। সেই জীবনে তুমি ছিলে কারও খেলার পুতুল। কিন্তু বর্তমান জীবনে তুমি আমার রানী। আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যৎ। মির্জা বাড়ির সম্মান তুমি। ”
আশফি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল পুলকের দিকে। কেউ কখনো ওকে এভাবে বলেনি। ছোটবেলা থেকেই ছোটমা ওর সাথে দুরদুর আচরণ করেছে, আব্বা অবহেলা করেছে। পৃথা, পিয়াস কারনে-অকারনে অপমান করেছে। একদিন হয়েছে এই বাড়িতে পা রেখেছে আশফি। কিন্তু এই একদিনেই যেন কতকালের জমে থাকা ভালোবাসা উগরে দিচ্ছে এরা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা এখন আর এতটাও খারাপ মনে হচ্ছেনা। আবেগে চোখ ভিজে আসল আশফির।
” এই তুমি কি খাবে? নাকি আমার হাতে খেতে চাচ্ছ? মতলব কিন্তু খারাপ নয়। এসো খাইয়ে দেই। ” আশফিকে চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বলল পুলক।
” এই না, আমি একাই খেতে পারব। ” চমকে উঠল আশফি।
” উঁহু, সেটিতো আর হচ্ছেনা। একবার আমার মনে হয়েছে, তুমি আমার হাতে খেতে চাও, তাই এখন সেটাই হবে। এস এখানে বস। ” পুলক আশফির হাত ধরে বিছানার এক কোনে বসিয়ে দিল।
পেটে ক্ষুধা থাকায় আশফি কোন উচ্চবাচ্য করলনা। তৃপ্তিসহ খেতে থাকল। মাঝেমধ্যে চোরা চোখে তাকিয়ে দেখছে এই গুণ্ডা ছেলেটাকে। এই ছেলেটার নামে নাকি এলাকা কাঁপে! অথচ সেই মানুষটাই ওকে পরম ভালোবেসে খাইয়ে দিচ্ছে! এই মানুষটাকে এখন ওর মোটেও ভয় লাগছেনা। মা’য়ের মৃ’ত্যু’র পর এত ভালোবাসা ওর কপালে জোটেনি।
” এভাবে তাকিওনা। প্রেমে পরে যাবে। আর একবার আমার প্রেমে পরলে দুনিয়াকে তুচ্ছ মনে হবে। এক মুহূর্তও আমাকে না দেখে থাকতে পারবেনা। আর আমাকে সব কাজ ফেলে তোমার সামনে বসে থাকতে হবে। আর একটামাত্র বউয়ের আবদার কখনোই ফেলতে পারবনা আমি। ”
পুলকের কথা শুনে আশফি লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে হাসল বেশ খানিকক্ষণ।
খাবার শেষ করে আশফি যায় মল্লিকা মির্জার রুমে। সেখানে গিয়ে দেখল পুষ্পিতা আর মল্লিকা মির্জা ফোনের স্ক্রীনে চোখ রেখে কিছু একটা মনযোগ দিয়ে দেখছে। আশফিকে দেখে মল্লিকা মির্জা হাত বাড়িয়ে কাছে ডেকে নিলেন। আশফিও তার পাশে গিয়ে বসল।
” নিলাশা, এই যে দেখ আমার বউমাকে। দেখ কি মিষ্টি দেখতে আমার বউমা। ” নিলাশা মল্লিকা মির্জার ভাইয়ের মেয়ে।
নিলাশা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল আশফির সাথে।
” এই এখন গল্প বাদ দিয়ে আমার বউমাকে লেহেঙ্গা, শাড়ী দেখাও। আশফি, তুমি পছন্দ করে বল কোনগুলো নিবে। ”
” মা, আজকেই তো পুষ্পিতা আপু অনেকগুলো শাড়ি এনেছে আমার জন্য। আবার কেন? ”
” ঐগুলো তো আর রিসিপশনে পরার জন্য আনেনি। অল্প সময়ের মধ্যে যেহেতু আমি আমি ঢাকা যেতে পারিনি, তাই এই ব্যবস্থা। তুমি পছন্দ কর। ”
” আমি এসব সম্পর্কে কিছু জানিনা, মা। আপনিই পছন্দ করুন। জীবনে কখনো শপিংয়ে যাইনি। ”
মল্লিকা মির্জা দুঃখী চোখে তাকালেন এই মা মরা মেয়েটার দিকে। একদিনেই তিনি বুঝতে পারছেন মেয়েটা একটু বেশিই সরল। কোন কথা লুকাতে জানেনা। কিংবা সত্য বলতে একটুও দ্বিধা করেনা।
” আজকের পর থেকে তোমার প্রয়োজনীয় সবকিছু তুমি নিজে পছন্দ করে কিনবে। নিজের পছন্দ, মতামত সবার সামনে প্রকাশ করবে। নিজেকে সমাজের সামনে যোগ্য বলে প্রমান করবে। আর সেজন্য যা যা করতে হবে, তোমাকে সব শিখিয়ে দেব। সব সময়ই আমাদের তোমার পাশে পাবে। ”
আশফি বুঝতে পারছে এই বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষই ভালো। এরা কেউই ওর সাথে নতুন বউয়ের মত আচরণ করছেনা। বরং ওকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে।
আশফি তিয়াসার রিসিপশনের শাড়ী, লেহেঙ্গা, জুতা, থ্রীপিসসহ আরও জিনিসপত্র এবং পুলক ,শাহেদের জন্য স্যুটসহ প্রয়োজনীয় সকল কিছু পছন্দ করলেন মল্লিকা মির্জা, পুষ্পিতা। আশফি চেয়ে চেয়ে দেখল এত শপিং করেও এদের যেন সাধ মিটছেনা।
***
আশফি রুমে এসে দেখল পুলক বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছে। এদিকে ও হাঁসফাঁস করছে তিয়াসার সাথে কথা বলার জন্য। ওদের জন্য এত শপিং করেছে কিন্তু এই কথা তিয়াসাকে বলতে পারবেনা এটা কিছুতেই হয়না।
” একটু রুম বাহিরে যাননা। আমি তিয়াসার সাথে কথা বলব। ” আশফি পুলককে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলল।
” তোমার কথার সাথে আমার বাহিরে যাওয়ার সম্পর্ক কি! কথা বল তুমি। ”
” উঁহু আপনার সামনে বলা যাবেনা। ”
” এজন্যই বোধহয় আমার ছোট মামা বলত, বিয়ে করলে পুরুষদের নিজের বলতে কিছুই থাকেনা। বছরের পর বছর যে রুমকে নিজের ভাবত তারা, বিয়ের পর সেই রুমের মালিকানাও বউয়ের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। আজ ছোট মামার কথার সত্যতা প্রমান পেলাম। পুলক মির্জা আজ থেকে তোর রুমের মালিকানা বউয়ের কাছে হস্তান্তর কর। ”
” আপনি সব সময়ই এভাবে কথা বলেন কেন! মনে হয় আপনি নিঃস্ব, দুঃখী। কয়েক মিনিটের জন্য শুধু রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি। চিরদিনের জন্যতো বলিনি! ”
” আমি নিঃস্বই বুঝলে, সুন্দরী? যেখানে মনই তোমাকে দিয়েছি, সেখানে আমার নিজের বলে আর কি আছে? আজকে রুমের মালিকানা হস্তান্তর করলাম। আজ থেকে আমি ইন্টারন্যাশনাল নিঃস্ব কমিটির সভাপতি। তবে এই নিঃস্ব অবস্থা থেকে তুমিই আমাকে ফেরাতে পার। নিজেকে আমার ভালোবাসার কাছে সমর্পন করলেই আমি আবার পূর্ণ হয়ে যাব। ” কথাগুলো বলেই পুলক রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আশফি মুখ বাঁকা করে ফোন হাতে তুলে নিল।
***
তিয়াসা বেলকনিতে বসে আছে। শাহেদ সেই সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছে, এখন পর্যন্ত আসেনি। দাদু কয়েকবার তার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু কোন সদুত্তর দিতে পারেনি তিয়াসা। কিন্তু একটু চিন্তা ওর হচ্ছে। যদিওবা শাহেদের বিষয়ে মাথাব্যথা ওর নেই। কিন্তু দাদু চিন্তা করছিলেন। সে নাকি কখনোই রাত দশটার পর বাসার বাহিরে থাকেনা। আর এখন রাত বারোটার কাছাকাছি। তাই দাদুর চিন্তা সংক্রমিত হয়েছে তিয়াসার মধ্যে। এর বেশি কিছু নয়।
রুম থেকে ফোনের আওয়াজ ভেসে আসছে। এত রাতে কে ফোন দিল! তড়িঘড়ি করে রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখল আশফির নাম ভাসছে স্ত্রীনে। এতরাতে আশফির ফোন আসায় চিন্তায় পরে যায় তিয়াসা। ও কাঁপাকাঁপা হাতে রিসিভ করে গলায় উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আশফি, তুই এত রাতে ফোন দিয়েছিস কেন? কিছু হয়েছে? ”
” তিয়ুরে, এই বাসায় এসে কতকিছুই দেখছি আর অবাক হচ্ছি। ”
” কি হয়েছে? কি দেখেছিস? তুই ভালো আছিসতো? ”
” আমি জব্বর আছি। তোর সাথে কথা বলব জন্য বদ লোকটাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছি। এখন মন খুলে তোর সাথে কথা বলব। জানিস, আমাদের রিসিপশনের জন্য কতগুলো শপিং করিয়েছে আমার শ্বাশুড়ি? আমার মনে হয় আগামী পাঁচ বছর আমার কোন নতুন পোশাক লাগবেনা। তোরও তাই। এখান থেকে ভিডিও কলে আমার শ্বাশুড়ি,ননদ সব পছন্দ করেছে। রিসিপশনের দিন আমরা দু’জন একই ড্রেস পরব। জানিসতো, আমাদের বাড়ির সবার জন্যঃ শপিং করেছে। এরা আসলেই অনেক ভালো। আমাকে বুঝতেই দিচ্ছেনা, আমি নতুন বউ। ”
আশফির কথা শুনে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল তিয়াসার।
” কি বললি! তুই পুলক ভাইয়াকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিস! খুব খারাপ কাজ করেছিস। সে কিছু বললনা? রাগ করেনি? ” আপাতত শপিংয়ের কথা বাদ দিয়ে পুলকের কথা জিজ্ঞেস করল তিয়াসা।
” নাহ কিছুই বলেনি। সুরসুর করে বেরিয়ে গেল। জানিসতো, বদ লোকটাকে যতটা বদ ভেবেছিলাম, আসলে ততটা বদ সে নয়। একটু ভালোও আছে। তুইতো জানিস, আমি নতুন কোথাও গেলে খেতে পারিনা। তাই সকাল থেকে পেট পুরে খেতে পারিনি। রাতে বদ লোকটা সেটা খেয়াল করে রুমে খাবার এনে আমাকে খাইয়ে দিয়েছে। ”
” তারপরও তুই ভাইয়াকে বদ লোক বলছিস? ” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল তিয়াসা।
” আগের অভ্যাস রয়েই গেছে। আচ্ছা ভাইয়া কোথায় রে? তোরা ভালো আছিস তো? ”
” হুম ভালো আছি। সে বাসায় ফেরেনি এখনও। ”
” কি বলছিস! মা যে বলল, ভাইয়ার এখানে কোন বন্ধু নেই। সে শুধু এই বদ লোকের সাথে থাকে। আগে কখনো এখানে একমাসও থাকেনি। শুধু নাকি বাবা-মা’ র করব দেখতে মাঝেমধ্যে আসত। সে জন্মের পর থেকে বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থেকেছে। আর সেজন্যই এখানের কাউকে চেনেনা। আজ সারাদিন ভাইয়া এখানেও আসেনি। তবে কোথায় গেছে সে? ”
আশফির কথা শুনে তিয়াসার এবার সত্যিই চিন্তা হচ্ছে। সেই সাথে ভয়ও হচ্ছে। ওর কোন ভুল পদক্ষেপে রিফাতের ক্ষতি হবেনাতো!
” তুই একটু ভাইয়াকে বলে দেখবি? উনার পরিচিত কাউকে একটু ফোন দিতে বল। দেখনা কোথায় আছে? তারও ফোনও বন্ধ। ” উদগ্রীব হয়ে বলল তিয়াসা।
” তুই চিন্তা করিসনা। আমি উনাকে বলছি। ভাইয়ার খোঁজ পেলেই তোকে আমি জানাব। ”
আশফি ফোন কেটে রুমের বাহিরে এসে উঁকিঝুঁকি মেরে পুলককে খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু ছায়া পর্যন্ত দেখলনা আশেপাশে। তাই বাধ্য হয়ে তাকে ফোন দিল। সকালেই নিজের ফোন নম্বর আশফির ফোনে সেইভ করেছিল পুলক।
***
ছাদে বসে বন্ধুদের সাথে চ্যাট করতে ব্যস্ত পুলক।তখনই ফোন বেজে উঠল। আশফির নম্বর দেখে হেসে রিসিভ করল,
” কি ব্যাপার বউ বুঝি আমাকে মিস করছিল? ”
” রাখেন আপনার মিস। কোথায় আছেন? বেরিয়ে গেছেন নাকি বাসা থেকে? ”
” পাগল হয়েছ! আমি এতরাতে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করি! তখন সবাইকে বোঝাতে বোঝাতে একমাস লেগে যাবে যে, বউ আমাকে বউ রুম থেকে বের করে দেয়নি। এত বোকা আমি নই।”
” বকবকানি বাদ দিয়ে রুমে আসেন। ” ফোন কেটে দেয় আশফি।
পুলক দুই মিনিটের মাথায রুমে আসল।
” বল এত জরুরী তলব কেন? নাকি আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারছনা? ”
” বদ লোক, এত বেশি বোঝেন কেন? শাহেদ ভাইয়া নাকি এখনো বাসায় ফেরেনি। তিয়াসা চিন্তা করছে। আপনি একটু দেখুননা।”
আশফির কথা শুনে পুলকের কপালে চিন্তার সরু রেখা দেখা দিল। ও দ্রুতই ফোন করল শাহেদকে। ওকে না পেয়ে কয়েক জায়গায় ফোন করল।
চলবে…