রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-২৭+২৮

0
8

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_২৭
জাওয়াদ জামী জামী

মিম চলে যাওয়ার দু’ঘন্টা পরও তিয়াসা স্বাভাবিক হতে পারলনা। ওর মন-মস্তিস্কে কেবলই মিমের বলা কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। সেই চার বছর আগে থেকেই ওকে চেনে শাহেদ! ওকে দেখার জন্য ছুটে আসত ঢাকা থেকে! গার্লস কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত! অথচ এত বছরে একবারও সামনে আসেনি! তিয়াসার অবচেতন মন বলছে, মানুষটা সত্যিই ওকে ভালোবাসে। আবার সে যখন তিয়াসাকে নিজের করেই নিয়েছে, তবে কেন ওকে রেখেউ ঢাকা গেল? তবে কি তিয়াসার ওপর রাগ কিংবা অভিমান থেকেই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে?

” ও নতুন বউ, তুমি এম্নে বইসা রইস কেন? দুপুরে খাইবানা? আব্বায় তোমার লাইগা খাবার টেবিলে বইসা রইছে। ” খাদিজা আন্টির ডাকে হুঁশ ফিরল তিয়াসার।

” ডাকলেন, আন্টি? ”

” ওমা আমি কতগুলান কথা কইলাম, তুমি শোননাই! ”

এবার অপ্রস্তুত হয় তিয়াসা।

” আসলে কিছু একটা চিন্তা করছিলাম, তাই বুঝতে পারিনি। ”

” চল খাইয়া নিবা। আব্বায় তোমার জন্য বইসা রইছে। ”

তিয়াসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দুইটার বেশি বেজে গেছে। এবার ও সত্যিই লজ্জা পায়। এত বেলা হয়েছে, অথচ বুঝতেই পারেনি!

” আন্টি, আপনিই সব রান্না করেছেন? আমাকে ডাকলেননা কেন? ”

” তুমি মিমের সাথে কথা কওনের সময়ই সব জোগাড় কইরা, রান্না বসাইছিলাম। রান্নার অনেক সময় পাইবা, নতুন বউ। কিন্তু এই দিনগুলান আর ফিরা পাইবানা। এখন আসো। ”

” আমি যে গোসল দেইনি, আন্টি? এদিকে দাদুরও বোধহয় ক্ষুধা লেগেছে। কি করি বলুনতো? ”

” তুমি গোসল কইরা আস। আমি ততক্ষণে টেবিলে খাবার দেই। দশ মিনিটে আসবা কিন্তু। ”

তিয়াসা মাথা নাড়িয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।

খাবার পর তিয়াসা ড্রয়িংরুমে বসেই দাদুর সাথে গল্প করছে। সকালের পর থেকে দাদুর সাথে কথা বলাও হয়নি, আবার তার খোঁজও নেয়নি তিয়াসা। তাই স্বভাবতই অপরাধবোধে ছেয়ে যায় ওর মন। তাই দাদুর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে সকল অপরাধবোধ দূর করতে চাইছে।

সোফার পাশে সাইড টেবিলের ওপরে থাকা কর্ডলেস বেজে উঠলে খাদিজা আন্টি এসে ফোন ধরল। আন্টির কথা শুনে তিয়াসা বুঝল শাহেদ ফোন দিয়েছে। আন্টি কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলে দাদুকে ফোন দেয়। তিয়াসা নিরবে দাদুর কথা শুনছে। আবারও ওর মনে চিন্তারা হানা দেয়। মন বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, শাহেদ ওকে অনেক আগে থেকেই চেনে।

***

দুপুরের খাবার খেয়ে আশফি নিজের রুমে এসেছে। ফোন হাতে নিয়ে অলস সময় পার করছে। মল্লিকা মির্জা নিজের রুমে রেস্ট নিচ্ছেন। পুস্পিতা কোন বন্ধুর বাসায় গেছে। পুলকও বাসায় নেই। সে আজকাল বাসায় খুব একটা থাকছেনা। দলের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে বেরিয়ে যায়। বাসায় আসে রাত দশটার দিকে। আশফির খারাপ লাগলেও এ নিয়ে কখনোই অভিযোগ করেনি। আজকাল পুলকের সবকিছুই ওর ভালো লাগে। সব সময়ই পুলকের আশেপাশে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে বর্তমানে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ফোন আশফির হাতে থাকা অবস্থায়ই বেজে উঠল। ‘ ভাইয়া ‘ স্ক্রীনে ভাসতেই হাসিতে ওর চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে যায়।

” ভাইয়া, কেমন আছো তুমি? কালকে ফোন দাওনি কেন? শরীর ঠিক আছে তো তোমার? ” হড়বড়িয়ে জানতে চাইল আশফি।

” ধীরে পাগলী ধীরে। আমি ভালো আছি। গতকাল খুব ব্যস্ত ছিলাম, তাই ফোন দিতে পারিনি। তুই কেমন আছিস? আর পুলক, সে ভালো আছে? ”

” আমরা সবাই ভালো আছি, ভাইয়া। দুপুরে খেয়েছ? ”

” হুম খেয়েছি। শোন, আমি আগামীকাল রাতের গাড়িতে রওনা দিচ্ছি। সকালেই নাটোর পৌঁছে যাব। তোর শ্বশুর বাড়িতে যাব ভাবছি। তোকে দেখেই তবে গ্রামে যাব। তোদের সবার জন্য কম-বেশি কেনাকাটা করেছি। তোর জন্য শাড়ী, সালোয়ার কামিজ কিনেছি। আর কি কিনব বল? ”

রিফাতের আসার কথা শুনে খুশিতে চিৎকার করল আশফি। ও কাঁদছে। কতদিন সে ভাইয়াকে দেখেনি।

” আমার কিছু লাগবেনা, ভাইয়া। বিয়ের পর আমার শ্বাশুড়ি আমার জন্য অনেক শপিং করেছে। এছাড়াও অনেক পোশাক গিফ্ট পেয়েছি। আগামী পাঁচ বছর আমার কোন পোশাক না কিনলেও চলবে। শুধু তুমি আসলেই হবে। কতদিন তোমাকে দেখিনা। ” ফুপিয়ে কাঁদছে আশফি।

বোনের কান্নার শব্দ রিফাতের কানে যেতেই ওর বুকের ভেতর মোচড় দিল।

” এই পাগলী, তুই কাঁদছিস কেন? চোখ মোছ। তুই এভাবে কাঁদলে আমি কিন্তু সোজা নিজের বাড়িতে চলে যাব। ” কথাটা ঔষধের মত কাজ করল। আশফি চোখ মুছে স্বাভাবিক হল।

” আমার কত ভালো লাগছে জানো? আমার শ্বাশুড়িও খুশি হবেন শুনলে। ”

” তোর জন্য আর কি কিনব, বললিনাতো? তারাতারি লিষ্ট কর। আজ অফিসের পর আমি আরেকবার শপিংয়ে যাব। ”

” বললামতো কিছুই লাগবেনা। তুমি বরং আব্বার জন্য কিছু কিনো। সেই সাথে পৃথা আর পিয়াসের জন্যও। আম্মার জন্যও একটা শাড়ী নিও। ”

আশফির কথা শুনে হাসল রিফাত।

” সবার জন্যই কিনেছি। বড়মা, বড় চাচার জন্যও নিয়েছি। ”

” তিয়াসার জন্য কিছু কিনোনি, ভাইয়া? ”

” হুম। শাড়ী নিয়েছি। ওর হাজবেন্ড জন্যও। ” মলিন হাসল ম্লান গলায় বলল রিফাত।

” তাহলেতো অনেক টাকার শপিং করেছ! কিন্তু নিজের জন্য কি কিনেছ? ”

” আমার আবার কি লাগবে! আমার প্রয়োজনের থেকে বেশি পোশাক আছে। ”

” আমি জানি তোমার কি আছে। সব সময়ই শুধু আমাদের কথা ভাবলে, নিজের কথা একবারও ভাবোনা। তুমি আজকেই নিজের জন্য কয়েকটা শার্ট, টি-শার্ট, প্যান্ট কিনবে। কালকে আমি তোমার ব্যাগ চেইক করব। যদি নতুন পোশাক না দেখেছি, তবে আমি কিছু নেবোনা। ”

আশফির গলায় জিদ লক্ষ্য করল রিফাত। রিফাত বুঝল, আশফি যা বলল, সেটাও করবে। এখন অযথাই নিজের জন্য কয়েকটা পোশাক কিনতে হবে!

দুই ভাইবোন আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখল।

***

মল্লিকা মির্জা নিজ রুমে বসে বই পড়ছেন। আশফি রুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।

” মা, ভেতরে আসব? ”

আশফির গলা পেয়ে তিনি ঘুরে তাকালেন।

” দেখেছ মেয়ের কাণ্ড! মা’য়ের রুমে মেয়ে আসবে এতে হুকুম নেয়ার কি আছে, হুম? ভেতরে আয়, মা। ” এই কয়দিনে শ্বাশুড়ি ছেলের বউয়ের বন্ডিং বেশ মজবুত হয়েছে। মল্লিকা মির্জা আশফিকে নিজের ছেলেমেয়ের চাইতে কোন অংশে কম ভালোবাসেননা।

” কারও রুমে তার অনুমতি ছাড়া ঢোকা ঠিক নয়, মা। সেই ছোটবেলায় আমার আম্মা আমাকে এটা শিখিয়েছিল। ” আশফি রুমে এসো মৃদু গলায় বলল।

” তোর মত মেয়েকে যে মা জন্ম দিয়েছেন, সেই মা ভুল কিছু শেখাতেই পারেনা। এবার বল, এত খুশি খুশি লাগছে কেন? ”

” আপনি কিভাবে বুঝলেন! আমিতো আপনাকে কিছু বলিইনি! ” আশফি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

” মেয়ে খুশি হয়েছে, আর মা হয়ে আমি বুঝতে পারবনা এটা কিভাবে হয়? ”

খুশিতে কেঁদে ফেলল আশফি।

” কাল রাতের গাড়িতে ভাইয়া আসবে। আগে এখানে আসবে। আমাকে দেখে তবেই বাড়িতে যাবে। ”

” শুধু তোকে দেখতে আসবে? আমাদের নয়? আমরা তার কেউই নই? ” মুখ ভার করে বললেন মল্লিকা মির্জা।

শ্বাশুড়িকে মন খারাপ করতে দেখে থমকায় আশফি। ভয় পায় মেয়েটা। হিতে-বিপরীত হয়ে গেলনাতো?

” না না আমাদের সবার সাথেই দেখা করতে আসবে। রাগ করলেন, মা? রাগ করবেননা। ” আশফি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।

আশফির চুপসানো মুখ দেখে হা হা করে হেসে উঠলেন মল্লিকা মির্জা। মেয়েটাকে তিনি ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।

” বোকা মেয়ে, আমিতো তোর সাথে মজা করছিলাম। এত বোকা হলে চলবে? মনে রাখিস, দুনিয়ায় বোকা মানুষের বিপদ বেশি। তুই যত বোকা হবি, ততই তোর চারপাশে সমস্যা এসে ঘিরে ধরবে। এখন থেকে চালাক হবার চেষ্টা কর। ”

শ্বাশুড়িকে স্বাভাবিক হতে দেখে হাসল আশফি।

” আচ্ছা, মা। ”

” এবার বল, রিফাত কি কি খেতে পছন্দ করে? কতদিন পর ভাইকে দেখবি, তার ওপর তোর বাড়িতে সে আসবে। আপ্যায়নের কোন ত্রুটি থাকা চলবেনা কিন্তু? রিফাতের যেন মনে না হয়, তার বোনকে এখানে বিয়ে দিয়ে ভুল করেছে। ”

” আমার ভাইয়া তেমন মানুষই নয়। আর তার তেমন কোন চাহিদাও নেই। বাঙ্গালী খাবার খেয়েই অভ্যস্ত। ভাইয়ার খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা। ”

” বলবিনাতো? ঠিক আছে আমিই সব ব্যবস্থা করব। ”

শ্বাশুড়ির বাচ্চাপনা দেখে হাসল আশফি। মনে মনে ভাবল, কতটা ভাগ্যবতী হলে কোন মেয়ে এমন শ্বাশুড়ি পায়! এতদিন যেখানে সৎমায়ের অবহেলা, অত্যাচারে জর্জরিত ছিল। সেখানে পঙ্খীরাজে চড়া রাজকুমার হয়ে ওর জীবন এসেছে পুলক মির্জা। ঘুচিয়ে দিয়েছে সকল দুঃখ। আশফি এতদিনে পেয়েছে একজন স্বামী, বন্ধু, সুখ-দুঃখের ভাগীদার। আরও পেয়েছে মা’য়ের মত শ্বাশুড়ি। আরে মা’য়ের বলছি কেন? মা পেয়েছে। পেয়েছে একটা ছোট বোন। আর বাবা রূপী শ্বশুর। ছোটবেলা থেকেই যেখানে অর্ধাহারে দিন কেটেছে। ছেঁড়া পোশাকে ঢেকেছে শরীর। কখনো ভাবতেই পারেনি সেই মেয়ে হয়ে ও এমন একটা বাড়িতে নিজের ভবিষ্যৎ লুকিয়ে ছিল।

আশফি আবেগে জড়িয়ে ধরল মল্লিকা মির্জাকে। মা’য়ের মুখ আজকাল মনে পরেনা। ঝাপসা হয়ে গেছে। হয়তো কোনদিন পুরোটাই হারিয়ে যাবে। কিন্তু এই মা’কে পেয়েছে। তাই আফসোস নেই। এই মা’য়ের বুকের বাকিটা জীবন কাটাতে চায়।

***

আশফির কাছে রিফাতের আসার কথা শুনে তিয়াসার মন-প্রাণ আন্দোলিত হচ্ছে। কতদিন পর দেখবে তাকে! কিন্তু যখন শুনল, রিফাত ওর আর শাহেদের জন্য পোশাক কিনেছে। তখন ভিষণ অভিমানে ছেয়ে যায় বুক। মন বারবার একই কথা বলছে, কেন সে ওদের জন্য পোশাক কিনল? তবে কি সে তিয়াসাকে ভুলে গেছো চিরতরে? শুধু বড় ভাইয়ের দ্বায়িত্ব পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে? পরক্ষণেই আবার মনে পরল, ও তো একজনের স্ত্রী। আর সেই মানুষটা ওকে রিফাতের আগে থেকেই ভালোবেসে এসেছে। ওর জন্য নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছে। চাচারা তাকে কানাডা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সেখানের ভার্সিটিতে ভর্তির ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সে নাকি তিয়াসার জন্যই যায়নি! মিম আপুর মুখে এসব শোনার পর, নিজেকে তিয়াসার ভিষণ অপরাধী মনে হয়।

দুই পুরুষের মধ্যে কম্পেয়ার করতে চাইছেনা তিয়াসা। কিন্তু ও না চাইতেও অগোচরেই সেটা করে ফেলছে। কখনো রিফাতের দিকে পাল্লা ভারী হচ্ছে, আবার কখনো শাহেদের দিকে। সংশয়ের দোলাচালে ওর মন দুলছে। ও জানে শেষ পর্যন্ত শাহেদকেই বেছে নিতে হবে। কিন্তু তিন বছরের প্রেম এত সহজে কি ভুলতে পারবে? আবার শাহেদও ওর খোঁজ নেয়না। ওর সাথে কথা বলেনা। সে তিয়াসাকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। কি করবে তিয়াসা? কিভাবে তিনজন ভালোবাসার আগুনে জর্জরিত মানুষকে স্বাভাবিক জীবন দেবে? কিভাবে সে ভুলবে রিফাতকে?

বেশি ভাবতে গেলেই তিয়াসার কান্না পায়। আজও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। হু হু করে কেঁদে উঠল।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_২৮
জাওয়াদ জামী জামী

তিনমাসেরও বেশি সময় পর রিফাতকে দেখে কেঁদে ফেলল আশফি। ভাইয়ার চেহারার হাল দেখে ওর ভিষণই কষ্ট হচ্ছে। ভিষণ রোগা হয়ে গেছে রিফাত।

” এই পাগলী, কাঁদছিস কেন? ” বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরল রিফাত।

” তুমি বড্ড রোগা হয়ে গেছ, ভাইয়া। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করোনা? ”

” বুয়ার রান্না সম্পর্কে ধারনা থাকলে, তুই আফসোস করতিস। ”

রিফাতের আসার কথা শুনে পুলক বাসস্ট্যান্ডে ওর জিপ পাঠিয়েছিল। আগেই সে রিফাতকে বল রেখেছিল। সকাল সাড়ে সাতটায় রিফাত মির্জা মহলে আসল। মল্লিকা মির্জা হাসিমুখে এগিয়ে এসে রিফাতের সাথে কথা বললেন। আতিক মির্জাও সেখানে ছিলেন। কামরান মির্জা ঢাকা গেছেন। আর পুলক সে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বেলা দশটায় তার সকাল শুরু হয়।

” পুলক কোথায়, ওকে দেখছিনা যে? ” রিফাত মল্লিকা মির্জার কাছ থেকে জানতে চাইল।

” তার কথা জিজ্ঞেস করোনা, বেটা। সে দেশসেবক। বেলা এগারোটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সে দেশের কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই বেলা দশটার আগে তার ঘুম ভাঙ্গেনা। ” মল্লিকা মির্জা জবাব দেয়ার আগেই আতিক মির্জা বললেন। তার উত্তর শুনে রিফাত হাসল।

ব্রেকফাস্টের পর কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসল রিফাত। ও গ্রামে যেতে চাইলে মল্লিকা মির্জা জানিয়ে দিলেন, আজকে কিছুতেই গ্রামে যাওয়া যাবেনা। কিন্তু এভাবে ছোট বোনের বাড়িতে থাকতে বাঁধছে রিফাতের। একটু লজ্জাও পাচ্ছে।

আশফি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শপিংয়ের দিকে। রিফাত ওদের সবার জন্য শপিং করেছে। মল্লিকা মির্জা এ নিয়ে শাসনও করলেন রিফাতকে। তিনি বারবার বলছেন, কেন এত টাকা খরচ করেছে? রিফাত ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে হাসল। ইনি যেন ওর মায়েরই প্রতিচ্ছবি। মা ঠিক এমনিভাবেই শাসন করত ওকে। রিফাত তার কথার জবাব না দিয়ে হাসল। কিছু কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে নেই। তাহলে প্রশ্নের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। আর প্রশ্নকারীরও অসম্মান হয়।

” আশফি,তুমি গিয়ে পুলককে ডেকে তোল। যদি না উঠতে চায়, তবে এক বালতি পানি ঢেলে দেবে ওর শরীরে। ” মল্লিকা মির্জা সহাস্যে বললেন।

” কিন্তু মা, পানি ঢাললেতো বিছানা নষ্ট হয়ে যাবে। আপনার ছেলে ঠিকই শরীর মুছে, কাপড় পাল্টে নিবে। কিন্তু বিছানার তো সেই উপায় নেই। ” আশফি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল।

আশফির কথা শুনে হাসতে হাসতে মূর্ছা যাবার দশা মল্লিকা মির্জার। রিফাত চোখ সরু করে তাকিয়ে আছে আশফির দিকে। এদিকে আশফি বুঝতে পারছেনা, ও ভুল কি বলেছে?

” দেখেছ রিফাত, আমার বুদ্ধিমতী বউমার বুদ্ধি? আজকালকার মেয়েরাও যে এক বোকা হয়, সেটা আমার বউমাকে না দেখলে জানতামনা। তুই এমনি ওকে ঘুম থেকে টেনে তোল, মা। তোর আর পানি ঢালার দরকার নেই। ” মল্লিকা মির্জা তখনো হাসছেন।

” ও ছোটবেলা থেকেই এমন, আন্টি। একটু মানিয়ে নিবেন। কম কষ্ট, অবহেলা, অনাদর পায়নি ও। আমি না থাকলে হয়তো কবেই হারিয়ে যেত। ছোটবেলা থেকেই চাপের মধ্যে থেকেছে। তাই বুদ্ধি খোলেনি। ও সেজন্যই ভীতু প্রকৃতির। নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা কাউকে জানাতে পারেনা। মন খুলে কারও সাথে কথা বলতে পারেনা। এমন অনেক সমস্যাই ওর আছে। হয়তো ওর জন্য আপনাদের লজ্জা পেতে হবে। তবুও বলব, ওকে বুঝিয়ে বলবেন, ওর ভুল ধরিয়ে দেবেন। দেখবেন ও ঠিক শুধরে নিবে। ” রিফাত অকপটে সত্যিটাই বলল। বোনের জীবনটা ও মিথ্যায় ভরাতে চায়না।

” তুমি কোন চিন্তা করোনা। আমার বউমা কথাবার্তায় একটু বোকা ঠিক আছে। কিন্তু সে কাজেকর্মে পারদর্শী। রান্নাঘরের দ্বায়িত্ব ও নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। সবার পছন্দ-অপছন্দ মাথায় রেখে রান্না করছে। কাউকে কোন অভিযোগের সুযোগ দিচ্ছেনা। একটা কথা জেনে রেখ, আমি ছেলের বিয়ে দিয়ে আরেকটা মেয়ে এনেছি। ছেলের বউ কিংবা কাজের মেয়ে আনিনি। ওর যা ভালো লাগবে সেটাই করবে। কেউ কখনো কোন কাজে ওকে বাঁধা দেবেনা। ” মল্লিকা মির্জা মন থেকেই কথাগুলো বললেন।

” আরে বেয়াই! আপনি এসে গেছেন! কি দুর্ভাগ্য আমার। আমি চেয়েছিলাম এই বাড়িতে আপনাকে স্বাগত জানাতে পুষ্পবৃষ্টি হবে। সে মত সব জোগাড়ও করে রেখেছিলাম। কিন্তু হতভাগা মাইগ্রেনের কারনে সেটা আর হয়ে উঠলনা। রাতেই অ্যাটাক করল হতভাগা। মেডিসিন নিয়ে সেই যে ঘুমালাম, ঘুম ভাঙ্গলো এখন। বাই দ্য ওয়ে, আমার দর্জ্জাল মাম্মি আপনাকে ঠিকঠাকমত স্বাগত জানিয়েছে তো? ” পুষ্পিতা হঠাৎই ওদের সামনে উদয় হয়ে বলল।

পুষ্পিতার এমন কথা শুনে রিফাত একটু বিব্রত হয়। ও আগে পুষ্পিতাকে না দেখলেও বুঝতে পারছে এটাই পুলকের বোন। তবে এটাও বুঝতে পারছে ছটফটে, চঞ্চল এই মেয়েটার সাথে সাবধানে কথা বলতে হবে। নতুবা এ রিফাতকে ঘোল খাওয়াবে।

” এখন মাথাব্যথা কমেছে? না কমলে কড়া এক কাপ কফি খান। দেখবেন ভালো লাগবে। ”

” ও আম্মু, ভাবীর ভাই বেয়াই আমাকে আপনি বলছে কেন! আমি কি তার পর বলো? কোথায় আমি প্ল্যান করে আছি, বেয়াইকে নিয়ে টো টো করে ঘুড়ব। কিন্তু বেয়াই আমাকে আপনি ডেকে সব প্ল্যানে জল ঢেলে দিল গো। ” পুষ্পিতা কান্নার ভান করল।

” পাজি মেয়ে, ছেলেটাকে শুরুতেই ঘাবড়ে দিওনা। ও তোমার মত পাজি নয় বুঝলে? মাথাব্যথা থাকলে রান্নাঘরে যাও। রুমি কে বল কফি বানিয়ে দিতে। তুমি ওর কথায় কিছু মনে করোনা, রিফাত। ও একটু চঞ্চল। হয়তো তোমাকে বিরক্তও করবে। ”

” না আন্টি, আমি কিছু মনে করিনি। ”

***

আশফি রুমে এসে পুলকে ডাক দেয় কিন্তু তার ঘুম ভাঙ্গার নামগন্ধও নেই। বাধ্য হয়ে আশফি ওকে জোড়ে ধাক্কা দেয়।

” এই যে কুম্ভকর্ণ, আর কত ঘুমাবেন? মা আপনাকে ডাকছে৷ দশ মিনিটের মধ্যে নিচে না গেলে আপনার শরীরে এক বালতি পানি ঢালব বলে দিলাম। ” আশফি পুলককে ধাক্কাধাক্কি করছে৷

আশফির ননস্টপ ধাক্কা আর কথার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় পুলকের। ও তড়িৎ গতিতে আশফির হাত ধরে নিজের বুকে টেনে নেয়৷ এরপর ঘুম জড়ানো গলায় বলে,

” এভাবে ধাক্কাধাক্কি করছ কেন, বউ? চুপটি করে আমার বুকে থাক৷ আর আমাকে ঘুমাতে দাও। ”

পুলকের হাতের শক্ত বাঁধনে আটকা পরে যায় আশফি চেষ্টা করেও ওর হাতের বাঁধন এতটুকুও আলগা করতে পারছেনা৷

” কি শুরু করলেন বলুনতো? ভাইয়া সেই কখন থেকে আপনার অপেক্ষা করছে। তাই বাধ্য হয়ে মা আপনাকে ডাকতে পাঠালো৷ আর আপনি সেই আমাকেই আটকে রেখেছেন! তারাতারি নিচে চলুননা। একদিন না হয় একটু কম ঘুমালেন। ” আশফির কন্ঠে অনুনয় ঝরছে। ওর এমন অনুনয় অমান্য করার সাধ্য নেই পুলকের৷

” ঠিক আছে এখনই তোমাকে ছাড়ব এবং নিচেও যাব। তবে তার আগে আমাকে মর্নিং কিস দিতে হবে। ” গাল বাড়িয়ে দিল পুলক৷

” পারবনা। ”

” তাহলে আমিও নিচে যাবনা। ”

” আপনি এমন কেন! ”

” আমি তোমার বিয়ে করা একমাত্র জামাই। তিনবার কবুল পড়ে বিয়ে করেছি তোমাকে। কাজী ব্যাটাকে অপেক্ষা করার কোন সুযোগই দেইনি। ফটাফট কবুল বলেছি। এরপরও তুমি বলছ, আমি এমন কেন! আমার ওপর কৃতজ্ঞ থাকা উচিত তোমার। কবুল বলতে এক মিনিটও লাগাইনি৷ ”

” আপনার লজ্জা করেনি তারাতারি কবুল বলতে! আমিতো লজ্জা, ভয়ে মরেই যাচ্ছিলাম। ”

” কিসের লজ্জা! প্রত্যেক পুরুষ ঐ মুহূর্তটার জন্য কত ব্যাকুল হয়ে থাকে জান? একটা নিজস্ব নারী পাবে সে, যার সাথে একটা জীবন কাটিয়ে দেবে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মিলিয়ে হবে সে জীবন। যে নারী তার মধ্যে ধারন করবে, একান্ত পুরুষটির অংশ। যে নারীর ছোঁয়ায় একটা সংসার পূর্ণতা পাবে। আমি পুরুষ ধন্য হব, সেই নারীর ভালোবাসায়। এতগুলো সুযোগ আমি হাতের মুঠোয় দেরি করব বলে তোমার মনে হয়? ” পুলকের চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। তার ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি।

পুলকের কথা শুনে আশফি লজ্জা পায়। কিন্তু লজ্জায মুখ লুকায় পুলকের বুকে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই একহাতে পুলকের চোখ চেপে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। ঠিক কয়েক মুহুর্ত স্থায়ী হলো এই চুম্বন। আর কয়েক মুহুর্ত পরই আশফি দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

আশফির এমন কাজে পুলক প্রথমে চমকালেও পরক্ষণেই হেসে উঠল। ও ভাবতেই পারেনি, ওর বোকা বউ এমন সাহসী হয়ে উঠেছে।

চলবে।