#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী জামী
পুলক মির্জা সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র। চারদিকে বাঁধভাঙা উল্লাসে মেতেছে আতিক মির্জার অনুসারীরা। তারা আতিক মির্জার স্থানে পুলক মির্জাকেই চেয়েছিল। পুলকের সাঙ্গপাঙ্গরা পুরো শহর জুড়ে মিষ্টি বিতরন করছে। শাহেদ পুলকের পাশে বসে দেখছে সবার উল্লাস। হাসছে ওরা দু’জনে।
” তুমি পেরেছ, ভাই। আশা করব মামার আদর্শে নিজেকে উজ্জীবিত করবে। মামার মতই দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসবে। তোমার পথচলার শুরু হল কেবল। ধীরে ধীরে তুমি বড় মামাকেও ছাড়িয়ে যাবে এই আশা করি সর্বদা। ”
” বাহ্ শাহেদ, তুই তো দেখছি দার্শনিকের মত কথা বলছিস! বিয়ে করে দর্শন ব্যপারটাকে আত্মস্থ করেছিস নাকি? অবশেষে তোরও উন্নতি হচ্ছে। তোর বউ ভাগ্য ভালো সেটা স্বীকার করতেই হবে। ”
” প্লিজ ভাই, অয়েলিং করোনা। তুমি কপাল গুণে একটা বউ পেয়েছ, সেটা স্বীকার করতে ভয় পাও নাকি? উন্নতি কি তোমার হয়নি? ”
” বিষয়টা হচ্ছে দুই বোনের। একজন ভালো হলে আরেকজনও ভালো হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এটা অস্বীকার করলে চলবেনা যে, তাদেরও স্বামী ভাগ্য বেশ ভালো। ”
” নিজের প্রশংসা করতে কে না চায়, ভাই। তুমিও তাদেরই দলে। যাহোক বিষয়টা আমি ভাবীকে জানাব। তারও জানার অধিকার আছে, তার হাজবেন্ড নিজেকে ভালো হাজবেন্ড হিসেবে মনে করলেও, বউকে খুব একটা তোল্লাই দিতে চায়না। ”
” তুই কি আমার ভাই নাকি শত্রুরে, শাহেদ? ভাই হয়ে তুই আমার এতবড় ক্ষতি করতে পারবি! এদিকে তোকে আমি এতদিন পরম মিত্র ভেবে মনের কথা বলে গেছি! একজন মেয়র যদি নিজের ভাইয়ের মনে কি চলছে সেটাই বুঝতে না পারে, তবে জনগণের মন পড়বে কিভাবে। আমি চরমভাবে হতাশ। আর এর জন্য দায়ী তুই। বাই দ্য ওয়ে, তুই যে ক্লাস নাইনে পড়তে জুনিয়র একটা মেয়ের প্রেমে পরেছিলি এটা কি তিয়াসা জানে? ”
পুলকের কথা শুনে শাহেদ ওর দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। পুলক যে ওকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিল সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু ও এতটাই চমকেছে যে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলনা। অনেকক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ খুলল।
” তুমি ব্ল্যাকমেইল করছ, ভাই! একটা নাদান বাচ্চার উঠতি বয়সের আবেগের কথা তিয়াসাকে বলতে তোমার একটুও খারাপ লাগবেনা? এই তোমাকে আমি এত ভালবাসি! তোমার কথা আমি কত ভাবি। তুমি যখন বিদেশ থাকতে, তখন ভিক্টোরিয়া রুথ নামের একটা মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করতে সেটাতো আমি ভাবীকে বলিনি। ইনফ্যাক্ট ঐ কথাটা আমার মনেও আসেনি। কিন্তু তুমি আমার সাথে গাদ্দারি করলে। কিভাবে পারলে, ভাই? ” শাহেদ কথাগুলো বলে আঁড়চোখে তাকায় পুলকের দিকে। পুলককে ওর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাজের ভান করে পুলকের গ্যাংয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করল।
***
মির্জা বাড়িতে উৎসব চলছে৷ পুলকের বিজয় উপলক্ষে কয়েকদিন চলবে উৎসব। মল্লিকা মির্জা কাঠের পুতুলের মত সব দেখছেন। ছেলে মেয়র হওয়ায় তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলনা৷ তিনি উদাস নয়নে সবকিছু দেখছেন। আতিক মির্জার মৃত্যুর সাথে সাথে তার মুখ থেকে হাসি হারিয়ে গেছে। তিনি আজকাল খুব একটা কথাও বলেননা। শুধু নির্বিকার চিত্তে সবকিছু দেখে যান। তিনি চাননি পুলক নির্বাচন করুক। কিন্তু ছেলের উৎসাহ দেখে নিষেধ করতে পারেননি। তিনি জানতেন পুলক তার এই কথা মানবেনা। তাই নিজের ইচ্ছেকে বুকের গভীরেই মাটিচাপা দিয়েছেন তিনি।
মল্লিকা মির্জার মত আশফিও পুলকের মেয়র হওয়ায় খুশি হতে পারলনা। ও চায়নি পুলক রাজনীতিতে জড়াক। অনেকবার নিষেধও করেছে তাকে। অনুরোধ, অনুনয়ও করেছে। কিন্তু পুলক ওর এই অনুরোধ মানেনি। আশফি থেকে থেকেই কেঁদে উঠছে। ওর মনে ভয় বাসা বেঁধেছে। পুলককে হারানোর ভয়। চোখের সামনে শ্বাশুড়িকে দেখে ওর বুক কাঁপে বারেবার। একটা সংসারের সুখ হারিয়ে যেতে দেখেছে ও। রাজনীতি কেড়ে নিয়েছে এই সংসারের সুখ। কেড়ে নিয়েছে সকলের মুখের হাসি।
” এমন উদাস হয়ে বসে আছ কেন, ভাবী? তোমার কি মন খারাপ? ” পুষ্পিতা আশফিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল।
” একটু খারাপ । ”
” ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হয়েছে? ”
” আমার সাথে ঝগড়া করার সময় আছে তার! ”
” আহা কি অভিমান। আমার বোকা ভাবীটাও আজকাল দেখছি অভিমান করে। এটা উন্নতির লক্ষণ। ”
” কিসের উন্নতি শুনি? ”
” যত বেশি অভিমান তত বেশি ভালবাসা। অভিমান ভালবাসার ভীত মজবুত করে। ”
” তুমি এত কিছু জানো কেমন করে! তোমার তো বিয়ে হয়নি। ”
” প্রেম তো হয়েছে। প্রেমে পরলে মানুষ অনেক কিছুই জেনে যায়। প্রেম হলো নর-নারীর প্রত্যক্ষ বিদ্যাপিঠ। যে বিদ্যাপিঠ তুমি স্বচক্ষে কখনোই দেখতে পাবেনা। শুধু অনুভব করতে পারবে। কিন্তু এই অদৃশ্য বস্তুটিই তোমাকে দিনশেষে অনেককিছুই শেখাবে। ”
” বাব্বাহ পুষ্পিতা, তুমি এতকিছু জানো! ”
” হুম জানি। চাইলে আমার কাছ থেকে একটু জ্ঞান ধার নিতে পার। ”
” লাগবেনা আমার এত জ্ঞান। এত জ্ঞান দিয়ে আমি কি করব শুনি? ”
” না ঠিক আছে। তুমি বোকা আছ এটাই ভালো। কিছু কিছু মানুষকে বোকা হলেই মানায়। ভালো কথা আজকের পার্টিতে তুমি যাবেনা? বিশাল পার্টি দিচ্ছে ভাইয়া। ”
” সত্যি করে একটা কথা বলবে, পুষ্পিতা? ”
” আমি যথাসম্ভব মিথ্যা না বলারই চেষ্টা করি, ভাবী। আর তোমার সাথে তো কখনোই নয়। বল কি বলবে। ”
” তুমি কি খুশি? মা যে মোটেও খুশি নন সেটা আমি বুঝতে পারি। ”
” খুশি না হলেও ভাইয়ার জন্য এতটুকু অভিনয় করতেই হবে। আজ যদি আব্বু বেঁচে থাকত তবে ভাইয়ার এই অর্জনে আমার থেকে বেশি খুশি বোধহয় কেউ হতোনা। আব্বুকে হারিয়ে হাসতে ভুলে গেছি। কিন্তু ভাইয়ার জন্য সেই ভুলে যাওয়া হাসিকেই ফিরিয়ে এনেছি। এছাড়া আর উপায় কি বল? ”
পুষ্পিতা হু হু করে কেঁদে উঠল। কাঁদছে আশফিও। ওরা এখনো ভয়ের একটা অদৃশ্য বলয়ে আটকে আছে। যেখান থেকে বেরোতে অনেক সময় লাগবে।
***
” দাদু ভাই, তুমি ঢাকা যাচ্ছ কবে? ” শাহেদের দাদু জানতে চাইলেন।
” আর দুই-এক দিন আছি, দাদু। ”
” দিদি ভাইকে সাথে নিয়ে যাবে কবে? ”
” তুমি যেদিন আমার কাছে যেতে রাজি হবে। ”
” আমি জীবনের শেষ কয়টা দিন এখানেই কাটাতে চাই, দাদু ভাই। তুমি আমার কথা ভেবে দিদি ভাইকে নিজের কাছে নিতে চাচ্ছনা, এটা কিন্তু অন্যায়। দিদি ভাই কি ভাববে বল? ”
” তিয়াসা কিছুই ভাববেনা, দাদু। ও বুঝদার মেয়ে। ওর পড়াশোনাও শেষ করুক এরমধ্যে। তারপর বিষয়টা নিয়ে ভাবব। কিন্তু তুমি যদি আমার কাছে যেতে চাও সেটা আলাদা কথা। তখন আমি তিয়াসাকে ঢাকা নিব। ”
” তুমি এমন অবুঝ হয়েছ কবে থেকে? আগে কখনোই এমন অবিবেচকের মত কাজ করোনি। আগের শাহেদের সাথে এখনকার শাহেদের মিল খুঁজে পাইনা আমি। স্ত্রীকে নিজের কাছে নিয়ে রাখবে কিন্তু তারমধ্যেও আমাকে টানছ। এটা কি ভালো দেখায়? এমনতো নয় আমি আগে কখনোই এখানে একা থাকিনি। কিংবা আমাকে দেখার কেউ নেই। তুমি দিদি ভাইকে নিজের কাছে নিয়ে যাবে এটাই আমার শেষ কথা। ” দাদু এবার একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন।
শাহেদ নিরবে দাদুর রাগ হজম করল। সে হৃদয়ে জমা গোপন কথাটুকু কাউকে বলতে পারেনা। তিয়াসাকে নিজের কাছে নিতে ওর ও মন চায়। কিন্তু সে কথা তিয়াসাকে বলার সাহস করে উঠতে পারেনি এখনো। প্রত্যাখ্যানের ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বিয়ের পর তিয়াসার একটা প্রত্যাখ্যান ওকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। যেখান থেকে ও এখনও নিজেকে গড়ে তুলতে পারেনি। আরও একবার ভাঙনের স্বীকার হতে চায়না কিছুতেই। তবে ওদের কথপোকথনের মাঝেই হুট করেই তিয়াসার আগমন হলো। আর ওকে অবাক করে দিয়ে তিয়াসা বলে উঠল,
” দাদু ভাই, আমাকে নিয়ে এত চিন্তা কেন করছেন বলুনতো? নাকি আমি এখানে থাকায় কোন সমস্যা হচ্ছে? আমারতো আপনার কাছে থাকতে ভালোই লাগে। আমার দাদু সেই কবেই মারা গেছেন। আপনাকে দেখলে দাদুর কথা মনে হয়। শান্তি পাই। তবে আপনি ঢাকা গেলে আমিও আপনার সাথে যাব। আপনাকে ছাড়া ঐ ফ্ল্যাটে আমি থাকতে পারব? আপনার নাতি অফিসে গেলে আমি কার সাথে আড্ডা দেব! ” তিয়াসা দাদুর দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। তবে ও যদি একবার শাহেদের দিকে তাকাত তবে দেখবে পেত অবিশ্বাস্য চোখে শাহেদ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
” দাদু, এবার বল কি বলবে? ” অনেকক্ষণ পর শাহেদ কথা বলল। ওর বুকে সুখের পাগলা ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটছে।
” তোমরা দু’জন আমাকে নিয়ে এত টানাটানি করছ কেন? আচ্ছা আমাকে ভাবার সুযোগ দাও। ” দাদুও নিতান্তই অনিচ্ছায় বললেন।
” আগামীকাল রাতের মধ্যেই তোমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবে। তবেই আমি ঢাকা গিয়ে বড় দেখে ফ্ল্যাট নিব। ”
” ঠিক আছে, দাদু ভাই। ”
” ও নতুন বউ, তোমার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ার দিন ঠিক হইছে? গত মাসেই তো বিয়া হওনের কথা আছিল। আহারে আতিক ভাই বাঁইচা থাকলে বিয়া কি পিছাইতো। হেয়ও মইরা গেল, সাথে সাথে বাড়ির সকলের মুখ থাইকা হাসি নিয়া গেল। মানুষটা কত ভালো আছিল। ” খাদিজা আন্টি আঁচলে চোখ মুছলেন।
” বোধহয় এই মাসেই হবে। আম্মুতো তেমনই বলল। ” তিয়াসা ছোট্ট করে বলল।
” তোমরা বিয়াশাদী শেষ কইরাই ঢাকা যাইয়ো। দেখা গেল যাইতে না যাইতেই আবার বিয়ায় আসতে হইবো। ঠিক কইছিনা, শাহেদ বাবা? ”
” ঠিকই বলেছ। কিন্তু তুমি কি আমাদের সাথে যাবেনা? ”
” কেডায় কইছে যাবনা? আমি না গেলে আব্বার দেখাশোনা করবো কে? ”
” তাহলে যে বললে, তোমরা বিয়েশাদী শেষ করে ঢাকা যেও? ”
” ঐডা তো কথার কথা কইছি। ”
” গুড। তোমার উত্তর যদি না হত, তবে আমি জোড় করে তোমাকে নিয়ে যেতাম। আচ্ছা দাদু, আমি একটু বেরোচ্ছি। ফিরতে রাত হবে। তোমরা খেয়ে নিও আমার অপেক্ষা না করে। ”
শাহেদ কারো প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে বেড়িয়ে গেল।
রাত বারোটা পনের। শাহেদ এখনো বাসায় ফেরেনি। তিয়াসা ওর অপেক্ষা করছে। হাতে থাকা বইয়ের পাতায় মনযোগ দিতে পারছেনা। এক সময় বিরক্ত হয়ে বই রেখে, খাতা, কলম নিয়ে বসল। মনযোগ দিয়ে কিছু লিখতে শুরু করল।
” এখনো জেগে আছ যে? ” শাহেদ রুমে ঢুকে তিয়াসাকে জেগে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল।
” কাজ করছি। ” শাহেদের গলা শুনে তিয়াসা ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল।
” ওহ। ”
” খেয়ে এসেছেন? ”
” হুম। তুমি খেয়েছ? ”
” হুম। আমি কি কাজ করছি সেটা জিজ্ঞেস করলেননাতো? ”
” লিখছ দেখলাম। তাই জিজ্ঞেস করিনি। ”
” কি লিখছি জানেন? ”
” কিভাবে জানব! আমিতো দেখিনি। ”
শাহেদের এমন ছাড়া ছাড়া কথায় রাগ হয় তিয়াসার। সে তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠে,
” জিজ্ঞেস না করলে জানবেন কিভাবে? জিজ্ঞেস করেছেন? ”
” কি লিখছিলে? ” তিয়াসাকে রাগতে দেখে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল।
” লিস্ট। ”
” আচ্ছা। ”
” শুধুই আচ্ছা? আর কিছুই নয়? ” তিয়াসা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
তিয়াসার দিকে তাকিয়ে শাহেদ বুঝল ও আবারও একটা ভুল করেছে। কিন্তু এবারে সেই ভুলটাকে বাড়তে দিলনা।
” কই দেখি কিসের লিষ্ট করেছ? আমাকে চেইক করতে দাও। কোনকিছু বাদ গেছে কিনা দেখি। ”
শাহেদের কথা শেষ হওয়া মাত্রই তিয়াসা ওর হাতে লিষ্ট দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। শাহেদ মনযোগ দিয়ে লিষ্টটা পড়ল। এরপর আবারও কথা বলল।
” এটাতো পুরো সংসারের লিষ্ট। কার সংসারে লাগবে এগুলো? ”
” ঢাকায় আমাদের নিয়ে গিয়ে কি মেঝেতে রাখবেন? নাকি না খাইয়ে রাখবেন? ”
আর কিছুই বলতে হলোনা তিয়াসার। শাহেদ বুঝে যায়, নতুন ফ্ল্যাটের আসবাবসহ নানান জিনিসপত্রের লিষ্ট করেছে মেয়েটা। ও গাল ভর্তি হাসি নিয়ে তাকায় তিয়াসার দিকে।
” আগামী পনের দিনের মধ্যে তোমার নতুন ফ্ল্যাট আর ফার্নিচার সব রেডি হয়ে যাবে। আমি শো-রুমে গিয়ে তোমাকে ভিডিও কল দেব। তুমি তোমার নতুন ফ্ল্যাটের সব ফার্নিচার পছন্দ করো। ”
” মনে থাকে যেন। ”
” এটা কি ভোলার কথা! আমি নিজেকে ভুলে যাব কিন্তু কখনো এই লিষ্ট কিংবা তোমার কথা ভুলবনা। ”
শাহেদের কথা শুনে তিয়াসা মৃদু হেসে শুয়ে পরল। মানুষটার বলা শেষের কথাগুলোর কোন উত্তর নেই ওর কাছে।
চলবে…
#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৩৮
জাওয়াদ জামী জামী
রিফাতের বিয়ের শপিং করতে আশফি আর পুষ্পিতা ঢাকা গিয়েছে। রিফাত আশফিকে কেনাকাটার দ্বায়িত্ব দিয়েছে। বিয়ের আগে সে ছুটি পাবেনা। আশফি ওকে নিয়ে পুলককে ঢাকা যেতে বলেছিল। কিন্তু পুলকের সময় না থাকায় আশফি পুষ্পিতাকে নিয়ে ঢাকা গিয়েছে। ওরা ওদের ফ্ল্যাটে উঠেছে। এদিকে নিলাশা আবদার করেছিল আশফিদের সাথে শপিংয়ে সে-ও যাবে। সেটা শোনার পর মল্লিকা মির্জা একবাক্যে নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি নিলাশাকে বলেছেন, ওর শ্বশুর বাড়ি পক্ষ থেকে পছন্দ করে যেসব জিনিসপত্র দেয়া হবে, সেগুলোই ওকে নিতে হবে। ফুপুর কথা শুনে নিলাশা আর কিছু বলেনি। তবে ওর মন আঁইঢাঁই করছে আশফি কি কি কিনেছে সেগুলো দেখার জন্য।
পাঁচদিন পর ওরা ঢাকা থেকে ফিরে আসল। বিয়ের আর দশদিন বাকি আছে। এই দশদিনে বাকি কাজগুলো আশফিকেই সামাল দিতে হবে। আশফি জানে ছোটমা বিয়ের কোন কাজেই হাত লাগাবেনা। তাই সকল দ্বায়িত্ব ওর কাঁধে এসেছে। ও তিয়াসা আর পুষ্পিতাকে নিয়ে সাতদিন আগেই গ্রামে যাবে। অবশ্য আশফি চেয়েছিল মল্লিকা মির্জাকেও সাথে নিতে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। তিনি বিয়ের আগের দিন আশফির গ্রামে যাবেন।
***
বাগানবাড়ির বেজমেন্টে চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নেতিয়ে বসে আছে একজন। তার মুখও বেঁধে রাখা হয়েছে। পুরো বেজমেন্ট অন্ধকারের গহবরে ডুবে আছে। হাত, পা, মুখ বাঁধা ব্যাক্তি ভয়ে অচেতনও হয়েছে বেশ কয়েকবার। তাকে কে বা কারা এখানে এনেছে সে সম্পর্কে কিছুই জানেনা সে। এদিকে তার প্রচন্ড পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু কাউকে যে ডাকবে সে উপায়ও নেই। হঠাৎই মৃদু শব্দ শুনে সচকিত হয় সে। কারও পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এদিকেই এগিয়ে আসছে বোধহয় কেউ। মিনিট খানেক পর এক চিলতে সরু আলোর রেখা ঢুকল বেজমেন্টে। বন্দি বুঝল কেউ বেজমেন্টের দরজা খুলেছে। এবং দরজা খোলার প্রায় সাথে সাথেই বন্ধও হয়ে গেল। কারন আলোর রেখাটুকু আর নেই। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেনা বন্দি। হঠাৎ করেই তার বুকে কাঁপন ধরিয়ে আলোয় ভেসে গেল বেজমেন্ট। লাইট জ্বেলেছে কেউ। হঠাৎই চোখে আলো পড়ায় চোখ খিঁচে বন্ধ করল বন্দি। বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে চোখ খুলল সে। ততক্ষণে আলো চোখে সয়ে এসেছে। চোখের সামনে দীর্ঘদেহী কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হল। সে যখন চিনতে পারল, মানুষটি আর কেউ নয় স্বয়ং পুলক মির্জা তখন আতঙ্কে তার শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। পুলক মির্জার হাতে একটা লোহার ডান্ডা। বন্দির কপাল বেয়ে ঘামের সরু রেখা দেখা দিল।
” ওয়েলকাম টু মাই এম্পায়ার , ভিক্টর। নাকি রেমো ডাকব? নাকি কৌশিক রয়? নাকি ফুয়াদ খান? যে নামে তুই স্বাচ্ছন্দবোধ্য করবি সে নামেই তোকে ডাকব। ” বন্দীকে আরও একবার চমকে দিয়ে গমগমে আওয়াজ তুলে বলল পুলক মির্জা। এরপর সে একটানে খুলে ফেলল বন্দির মুখের বাঁধন।
” আমাকে কেন ধরে এনেছেন? প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে। আমি আপনাকে চিনিনা। ” অনুনয় ঝরছে বন্দির গলায়।
” আমার আব্বুকে চিনতিস, আতিক মির্জা তার নাম? ”
জোড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল বন্দি,
” না। আমি তাকেও চিনিনা। ”
” চিনিসনা যখন, তখন তাকে মারলি কেন? ” পুলক গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল।
” আমি কাউকে মারিনি। আমি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। দু’বেলা দুমুঠো ভাতের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয় আমাকে। কাউকে মারার ক্ষমতা আমার নেই। ” বন্দি নানাভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার চেষ্টা করছে।
” তুই কি ভেবেছিস, তোকে সম্পূর্ণভাবে স্টাডি না করেই আমি তোকে এখানে এনেছি? আমাকে এতটাই বোকা মনে হয় তোর? তোর জন্মস্থান নরসিংদির বেলাবো। তোর বাবার নাম, আব্দুর রশিদ। জন্মসূত্রে তোর নাম, মাহমুদ হাসান। আর পেশার জন্য তুই ঢাকায় ভিক্টর, নারায়ণগঞ্জে রেমো, রাজশাহীতে কৌশিক রয়, চিটাগং এ ফুয়াদ খান নামে পরিচিত। তোরা তিনবোন, দুইভাই। তুই বাবা-মা’র তৃতীয় সন্তান। পড়াশোনা করেছিস সিলেট এমসি কলেজে। বাংলায় স্নাতক। আর কিছু শুনতে চাস? ”
পুলকের কথা শুনে ভয়ে কয়েকবার ফাঁকা ঢোক গিলল মাহমুদ হাসান। সে ভাবছে, তার সম্পর্কে এত কথা কিভাবে জানল পুলক মির্জা? ভয়ে তার কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে।
” আ..আমি কিছু করিনি। ছেড়ে দিন আমাকে। ” কাতর হয়ে বলল সে।
” আমার আব্বুকে মারলি কেন? কে তোকে কন্ট্রাক্ট দিয়েছিল? আমি ভালো করেই জানি, তুই আব্বুকে আগে থেকে জানতিস না, চিনতিস না। কার কথায় নরসিংদী থেকে এখানে এসে তুই।আব্বুকে মেরেছিস? ”
” আমি মারিনি আপনার আব্বুকে। ” স্তিমিত গলায় বলল মাহমুদ হাসান।
” তোর গলার স্বরই বলে দিচ্ছে তুই মিথ্যা বলছিস। কষ্ট করে তোকে মিথ্যা বলতে হবেনা। সত্য স্বীকার কর। আর আমাকে বল কার হুকুমে তুই কাজটা করেছিস? আমি এক কথা বারবার বলতে ভিষণ অপছন্দ করি। শুধু নিজের বাবাকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দিতে তোকে অনেকবার প্রশ্নটা করেছি। এরপর আর জিজ্ঞেস করবনা। সোজা কপালের মাঝখানে ত্রিনয়ন এঁকে দেব। ” পুলক মির্জা ক্রমেই অধৈর্য্য হয়ে উঠছে।
” আ…পনি কিভাবে আমাকে ট্রেস করলেন? আমি কোন প্রমান রাখিনি। কেউ আমাকে চেনেনা। ” সাহস করে জিজ্ঞেস করল মাহমুদ হাসান।
” সত্যিই তোর বুদ্ধি আছে বলতে হবে। কোন ফাঁকফোকর রাখিসনি তুই। আমি পুরো জেলা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, কিন্তু কোন সামান্যতম ক্লুও পাইনি। তখনই বুঝে যাই কালপ্রিট এলাকার কেউ নয়। তারপর নতুনভাবে শুরু হল তোকে খোঁজার অভিযান। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কালপ্রিট আব্বুকে খুব ভালোভাবে স্টাডি করেছে। তাই আব্বুর মৃত্যুর আগের দুইমাস সে কোথায় কোথায় গেছে, সেসব জায়গায় খুঁজতে শুরু করি। আশেপাশের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে থাকি। এবং একসময় কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে যাই। কয়েক জায়গার সিসিটিভি ফুটেজে তোকে দেখা যায়। ব্যাস আমি দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেই। তারপর শুরু হয় তোকে খুঁজে বের করার মিশন। ” বেজমেন্টে গমগম করছে পুলক মির্জার কণ্ঠস্বর।
” তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়, পুলক মির্জা! তুমি আসলেই বুদ্ধিমান এবং ধুরন্ধর। আমার সোর্স তোমার সম্পর্কে একটুও বাড়িয়ে বলেনি দেখছি। আ’ম ইমপ্রেসড। ” হঠাৎই বন্দির সম্ভাষণ পাল্টে যায়। সেও উদ্ধত গলায় বলল। সে আরও কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই পুলক মির্জার থাপ্পড় খেয়ে চেয়ার সুদ্ধ মেঝেয় হুড়মুড়িয়ে পড়ল।
” আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস তুই কোথায় পেয়েছিস? তোর সোর্স তোকে এটা বলেনি, যে আজঅব্দি পুলক মির্জার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ উঁচু গলায় কথা বলেনি, তার চোখে চোখ রাখেনি? তারা তোকে জানায়নি, এই এলাকার সিংহ পুলক মির্জা, তার রাজত্ব চলে এখানে? আর তার রাজত্বে সে-ই শুধু সিংহ, বাকি তোর মত সবাই কুকুর, বিড়াল। ”
রাগে পুলকের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। শক্ত হয়েছে চোয়াল। ওর দিকে তাকিয়ে ভয় পায় বন্দি লোকটি। পুলক মির্জার একটা থাপ্পড়ে তার মাথা ঝিমঝিম করছে, মস্তিস্কের কিছু অংশ বোধহয় বিকল হয়ে গেছে। চোখে সবকিছু হলুদ দেখছে। সে মনে মনে ভাবছে , একেই বুঝি বলে চোখে সর্ষে ফুল দেখা?
” আমাকে নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি জানতে পারি? ” জানতে চায় বন্দি।
” প্রথমে তোর বাপের নাম জেনে নেয়া, পরে তোকে খুন করা। এর বেশি কোন পরিকল্পনা নেই। তবে তুই যদি বাপের নাম জানাতে গড়িমসি করিস, সেক্ষেত্রে তোকে আপ্যায়ন করা হবে। আর আমার আপ্যায়ন মানেই ইউনিক কিছু। ” পুলক হেসে জবাব দিল।
” আমার কোন বাপ নেই। আমি নিজের মনের কথা শুনে আতিক মির্জাকে মেরেছি। ” দৃঢ়ভাবে উত্তর দেয় সে।
” তবে থাক কিছুদিন এখানে। আমিও সেই সুযোগে তোকে আপ্যায়ন করি। আপাতত তিনদিন খাবার এবং পানি ছাড়া আঁধার বিলাস কর। তিনদিন পর তোর সাথে দেখা হবে। ” বন্দিকে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে যায় পুলক মির্জা।
***
” নিজের বাড়ির কথা মনে আছে আপনার! বাড়িতে মা, বোন, বউ আছে সেটাও নিশ্চয়ই ভুলে যাননি! কি সৌভাগ্য আমার। দাপুটে মেয়র তার পরিবারের কথা মনে রেখে একদিন পর বাসায় এসেছে। ” রুমে আসতেই আশফির কটাক্ষের মুখে পরল পুলক মির্জা।
আশফির মুখের দিকে তাকিয়ে পুলক বুঝল মেয়েটা বড্ড রাগ করেছে। ও বেশ কিছুদিন থেকে আশফিকে সময় দিতে পারছেনা। ওর সাথে ঠিকঠাক কথাও হয়না। সেই সাথে পুলক এটাও বুঝতে পারছে গত কয়েকমাস যাবৎ সে আশফির সাথে অন্যায়ই করে চলেছে। পুলক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আশফিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। এরপর গলায় আবেগ ঢেলে বলল,
” আমার বোকা পাখিটার বুঝি অভিমান হয়েছে? সরি আমার বোকা পাখি। আর কখনোই এমন ভুল করবনা। এবারের মত ক্ষমা করে দাও। ”
” ছাড়ুন আমাকে। এতদিন পর এসেছে দরদ দেখাতে। এত ঢং করতে হবেনা। ” ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল আশফি।
” বলছিতো এবারের মত ক্ষমা করে দাও। আমার একটামাত্র বউয়ের মুখ ভার দেখে আমার কলিজা ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে। মন চাচ্ছে, এক গ্লাস পানিতে ডুব দিয়ে মরি। তুমি হুকুম দিলে এখনই ডুব দেব। দেব ডুব? ”
” ফাজিল লোক, এক গ্লাস পানিতে ডুবলে কেউ যে মরেনা সেটা আমি ভালো করেই জানি। অভিনয় না করে বেরিয়ে যান রুম থেকে। ” আশফির রাগ একটুও কমলনা। বরং বেড়ে গেছে।
” এক গ্লাস পানিতে যদি মানুষ ডুবতে পারে, তবে মরবেনা কেন! এটা কিন্তু পানির সাথে অবিচার করা হচ্ছে। এত বড় অপবাদ দিলে পানি কষ্ট পাবে বলে দিলাম। ”
পুলকের কথা শুনে আশফি ওর দিকে ক্যাবলার মত তাকিয়ে থাকল। রাগের বশে ও যে ভুল কথা বলে ফেলেছে সেটা বুঝতে পেরেছে। এখন রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। যেইনা চুলে হাত দিতে যাবে, তখনই ও খেয়াল করল পুলক ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। সেই বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার সাধ্য ওর নেই। যতক্ষণ না পুলক চাইবে ততক্ষণ ওকে পুলকের এই কামনার বাঁধনে আটকে থাকতে হবে।
চলবে…