রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-৪৫+৪৬

0
9

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৪৫
জাওয়াদ জামী জামী

সকাল হতে না হতেই মির্জা মহলে ডক্টরের আগমন হয়েছে। মল্লিকা মির্জা আশফিকে নিয়ে ভিষণ চিন্তিত। তিনি বারবার আশফিকে ধমক দিচ্ছেন, কেন ওর অসুস্থতার কথা তাকে জানায়নি। আশফি নতমুখে তার মধুর ধমক সহ্য করছে। এই মানুষটার ধমকও আশফির কাছে ভালোবাসাই মনে হয়।

ডক্টর আশফিকে ভালোভাবে চেক-আপ করলেন। আশফির কাছ থেকে শুনলেন ওর সমস্যার কথা। তিনি বুঝতে পারছেন কি হয়েছে আশফির। তবে নিশ্চিত হতে দুইটা টেষ্ট করাতে বললেন। মল্লিকা মির্জা আধাঘন্টার মধ্যেই আশফিকে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে টেষ্ট করালেন।

মির্জা মহলের প্রতিটি কোনায় খুশির আমেজ বইছে। এই পরিবার তাদের উত্তরসূরী পেতে চলেছে। মল্লিকা মির্জা কাঁদছেন। এমন একটা খুশির খবর আতিক মির্জা শুনে যেতে পারলেননা। তার নাতি-নাতনীরা দাদুর আদর পাবেনা। দাদুর ভালোবাসর স্পর্শ তাদের কখনোই পাওয়া হবেনা। কখনো দাদুর কাঁধ পাবেনা দুনিয়া দেখতে। এমনই হতভাগ্য তারা।

পুলক আশফিকে কোলে নিয়ে বসে আছে। ও কয়েক মুহুর্ত পরপর চুমু দিচ্ছে আশফির চোখে, মুখে, গলায়, পেটে। খবরটা শোনার পর আনন্দে কেঁদেছে পুলক মির্জা। জীবনে এত খুশি ও বোধহয় আজ প্রথমবার হয়েছে।

” আমার বোকা পাখি, তুমি কি চাও বল? আজ তুমি যা চাইবে আমি তা-ই দেব তোমাকে। আজ তুমি আমাকে পূর্ণ করেছ। আমাকে সুখের সন্ধান দিয়েছ তুমি। বল কি চাই তোমার? ”

আশফি ঘুরে তাকাল পুলকের দিকে। তার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখতে পাচ্ছে আশফি। খবরটা শোনার পর আশফি ভয়ে ভয়ে ছিল, মানুষটা যদি রেগে যায়? কিন্তু ওর ভাবনা ভুল প্রমান করে পুলক খুশি হয়েছে, ভিষণ খুশি হয়েছে সে। সে খুশিতে আশফিকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেঁদেছে। আশফি তাকে যতই দেখে ততই অবাক হয়। একটা মানুষ এত ভালোবাসতে পারে কিভাবে, সেটাই ওর বোধগম্য হয়না। আর পাঁচজন মেয়ের মত নয় আশফি। ওর চেহারাও আহামরি কিছুই নয়। শ্বশুর বাড়িতে জামাই আদর পায়না বললেই চলে। পড়াশোনাতেও মোটামুটি মানের। কিন্তু মানুষটার ভালোবাসার এসব কিছুই বাঁধা হয়ে উঠতে পারেনি কভু। তার ভালোবাসার কাছে হেরে গেছে সবকিছুই। আবেগে আশফির চোখে জমা হল অশ্রুবিন্দু। রুদ্ধ হয়ে গেছে কণ্ঠা। তবুও সে ভাঙা গলায় বলল,

” আমার কিছুই লাগবেনা। শুধু সারাজীবন আমাকে এমনই ভাবে ভালোবাসবেন। আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপনার পাশে থাকতে চাই। আমার ছায়া হিসেবে আপনাকে চাই, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় হয়ে আপনি আমাকে আগলে রাখুন সেটাই চাই। আপনার সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে আপনার সাথে পথ চলতে চাই। আপনার বুকটাকে চাই আমার সুখের আবাসস্থল হিসেবে। আর কিছুই চাইনা আমি। ”

” এই আমিটাকেই তোমাকে দিয়েছি অনেক আগেই। নতুন করে দেয়ার মত এই শরীর ছাড়া আর কিছুই নেই। কিন্তু এই শরীর নিয়ে কি করবে তুমি, যেখানে আমার প্রতিটি হৃৎস্পন্দনই তোমার নামে লিখা! তুমি চাইলে এই প্রানও তোমার নামে উৎসর্গ করতে পারি। ”

” যাহ্ এসব কি বলছেন! প্রান নিব কেন! আমারতো শুধু আপনাকে চাই। ”

” সে আমি অনেক আগেই তোমার হয়েছি। ভালো কথা, আমার চ্যাম্পের আগমনের সংবাদ তার মামাকে এখনো দেয়া হয়নি। একমাত্র মামা তার ভাগ্নের আগমনের সংবাদ জানবেনা এটা কি করে হয়! আমি আগে বউয়ের ভাইকে সুসংবাদটা জানাই। ” পুলক ফোন বের করল।

***

রিফাত অফিসে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এই কয়েকটা দিন ওকে কনফারেন্স, ট্রেনিং এসব করেই কাটাতে হবে। কনফারেন্সের জন্য পেপারস রেডি করছিল রিফাত। তখনই পুলকের ফোন আসল। রিফাত ফাইল একপাশে রেখে ফোন রিসিভ করল। কিন্তু ও কথা বলার আগেই পুলক কথা বলল,

” আসসালামু আলাইকুম, বউয়ের ভাই। কেমন আছেন? আমার এ্যাকাউন্টে পাঁচ হাজার টাকা পাঠান জলদি। মিষ্টি কিনতে হবে। ”

পুলকের এমন খাপছাড়া কথা শুনে রিফাত ভ্যাবাচ্যাকা খায়। যে ছেলে আজ পর্যন্ত ওর কাছ থেকে একটা চকলেট নেয়নি, সেই ছেলে হঠাৎ করে টাকা চাইছে কেন!

” কিসের মিষ্টি কিনবে? আজ কি তোমার জন্মদিন? ”

” উঁহু, আজ আপনার ভাগ্নের আগমনের সুসংবাদ পাওয়ার দিন। এই খুশির দিনে আপনি মামা হয়ে মিষ্টি খাওয়াবেননা এটা কিভাবে হতে দিতে পারি বলুন? ”

পুলকের কথা প্রথমে বুঝতে না পারলেও একটু পরেই ওর কথার অর্থ বুঝতে পারল রিফাত। খুশিতে ওর হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। ওদের পরিবারে নতুন অতিথি আসছে! যে ছোট ছোট হাত-পা নেড়ে খেলা করবে। একটু বড় হলেই ওকে ‘ মামা ‘ বলে ডাকবে! আনন্দে রিফাতের চোখের কোন বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরল। চোখ মুছে ও হাসিমুখে বলল,

” আমি এখনই টাকা পাঠাচ্ছি। তবে পাঁচ হাজার নয়, বিশ হাজার। তুমি নিজের সাথে সাথে সবাইকে মিষ্টি মুখ করিও। ”

রিফাতের গলা শুনে পুলক বুঝতে পারছে সে ভিষণ খুশি হয়েছে। আনন্দে পুলকের ঠোঁটের কোন প্রসারিত হল।

” বউয়ের ভাই, টাকা লাগবেনা। আপনি আপনার ভাগ্নের জন্য দোয়া করবেন তাতেই হবে। ”

” তুমি কি শিওর আমার ভাগ্নেই হবে? ”

” আমার একটা ছেলেই লাগবে। যে জুনিয়র আতিক মির্জা হয়ে আসবে। আমার বাড়িটা আবারও মুখরিত হবে তার আগমনে। আমার আম্মুর হারানো হাসি আবার সে ফিরিয়ে আনবে। ”

” তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক। এখন রাখছি। কনফারেন্স শুরু হবে এখনই। আমি দশ মিনিটের মধ্যে টাকা পাঠাচ্ছি, তুমি মিষ্টি কিনে নিও। ”

” ভাইয়া, প্লিজ টাকা পাঠাবেননা। আমি আপনার সাথে মজা করেছি। আপনি টাকা পাঠালে আমি নিজের কাছে ছোট হয়ে যাব। আশফির কাছেও। ”

পুলকের কথা শুনে রিফাত আর টাকা পাঠালোনা। তবে বিশ হাজার টাকা রেখে দিল ভবিষ্যৎ ভাগ্নের জন্য।

***

” শ্বাশুড়ি আম্মা, কি করছেন? ” রিনা আক্তারের পেছনে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল নিলাশা। হঠাৎ নিলাশার কথা শুনে চমকে উঠল রিনা আক্তার। তার হাত থেকে একটা ব্যাগ নিচে পরে গেল। সে হাঁচড়েপাঁচড়ে ব্যাগটা আবারও হাতে নিয়ে লুকানোর চেষ্টা করল।

” পেছনে আইসা এম্নে ভুতের মতন ডাক কেন? আমি চমকাইছি তোমার ডাক শুইনা। তোমার কি আক্কেল জ্ঞান কিছুই নাই? ” ঝাঁঝিয়ে উঠল রিনা আক্তার।

” ঐটা ভুত হবেনা, পেত্নী হবে, শ্বাশুড়ি আম্মা। আর বরাবরই আমার আক্কেল জ্ঞান খুবই কম। আপনি কি লুকাচ্ছেন দেখি? ” নিলাশা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করল।

” কি লুকামু! তুমি ঘরে যাও, এখানে কি কাম তোমার? ”

” এখানেই তো আমার আসল কাজ, শ্বাশুড়ি আম্মা। এটা আমার শ্বশুর বাড়ি। তাই ইচ্ছে করলেই যেখানে খুশি যেতে পারি। দেখি আপনার হাতের ব্যাগে কি আছে? ” নিলাশা রিনা আক্তারের হাত থেকে ব্যাগ প্রায় ছিনিয়ে নিল। এরপর সে সেটা খুলে দেখতে থাকে।

” তোমার এতসব সাহস, আমার হাত থাইকা ব্যাগ কাইড়া নেও? আইজকা আসুক পৃথার বাপে। তোমারে আমি দেখায় দিমু আমার হাত থাইকা ব্যাগ কাইড়া নেওয়ার মজা। দেও আমার ব্যাগ। আমার সংসারে আগুন জ্বালাইতে আসছে!” গজরাতে থাকে রিনা আক্তার।

” সে আপনি পৃথার বাপকেই ডাকুন আর পৃথার মামাকেই ডাকুন, আই ডোন্ট কেয়ার। কিন্তু আপনি আমাকে না বলে রিফাতের নিয়ে আসা ফলমূল, মিষ্টি ব্যাগে রেখেছেন কেন? আবার সেদিন রিফাত সেমাই এনেছিল, সেই সেমাইয়ের প্যাকেটও দেখছি। আচ্ছাআআআ এগুলো তাহলে বাপের বাড়িতে পাচার করছেন? আমার স্বামীর টাকায় কেনা জিনিসপত্র আপনি কার হুকুমে নিজের বাপের বাড়িতে দিচ্ছেন? এগুলো কোথাও যাবেনা। ” নিলাশা ব্যাগ উপুর করে সবগুলো জিনিস খাবার ঘরের মেঝেয় ঢালল।

” আমি কি করমু না করমু, সেইডা তোমার কাছ থাইকা শুনমু? খবরদার কইতাছি আমার সংসারে মাতব্বরি করবানা। নতুন বউ নতুনের মতন থাক। ” রিনা আক্তার আঙ্গুল তুলে শাসাল নিলাশাকে।

” আমার স্বামী যেখানে তার টাকায় কেনা মাছ-মাংস, ফলমিষ্টি খেতে পারেনা, সেখানে আপনি সেসব জিনিসপত্র নিজের বাপের বাড়িতে পাঠাবেন সেটা আমি কিভাবে হতে দেই? আপনি যদি বুনো ওল হন, তবে আমি বাঘা তেঁতুল। আপনার বিষদাঁত ভাঙতে আমার দুই মিনিটও লাগবেনা। তাই নিজের ভালো চাইলে এসব জিনিস যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিন। আজকের পর এই বাড়ির কোন জিনিসপত্র আপনার বাপের বাড়িতে যাবেনা। এখানে যেমন আপনার অধিকার আছে, তেমনি আমারও আছে। এত বছর রিফাত, আশফি চুপচাপ আপনার অত্যাচার সহ্য করেছে বলে আমিও যে সহ্য করব এমনটা নয়। মনে রাইখেন, আমি কোন ফকিরের মেয়ে নই যে আপনার আপনার অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করব। আমার বাবা চাইলে এক তুড়িতে আপনাকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারে। তাই আমার সাথে কথা বলতে গেলে হিসেব করে কথা বলবেন। কথা ক্লিয়ার? ” নিলাশা রিনা আক্তারকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে নিজেই মেঝেতে পরে থাকা খাবারগুলো তুলতে শুরু করল।

নিলাশার কথা শুনে রিনা আক্তারসহ তার বাপের বাড়ির সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। তারা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারও মুখে কোন কথা নেই।

বিঃদ্রঃ আপনারা অনেকেই জানেন আমি পুরোদস্তুর গৃহিণী। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে শখের বশে টুকটাক লিখি। তাই প্রতিদিন গল্প দেয়া হয়ে ওঠেনা। এতে আপনারা অনেকেই অভিযোগ করেন। কিন্তু আমি নিরুপায়। সংসার স্বামী, সন্তান সামলে প্রতিদিন লিখতে পারিনা। আমার যারা একনিষ্ঠ পাঠক আশা করছি তারা সমস্যাটা বুঝবেন।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৪৬
জাওয়াদ জামী জামী

” তোর জন্য বিরিয়ানি এনেছি, ভিক্টর। ওপস সরি, রেমো। আজকে আমি ভিষণ খুশি। কয়েক মন মিষ্টি খাইয়েছি শহরবাসীকে। তুই বাদ যাবি কেন! সাকিব, এর হাতের বাঁধন খুলে দে। ” পুলক বেসমেন্ট এসেছে। ওর সাথে সাকিব নামের ওর এর চ্যালাও এসেছে।

পুলকের হুকুম শুনে সাকিব বন্দীর হাত – পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। এরপর তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে ভিক্টর খাওয়া শুরু করল। গত সাতদিনে শুধু একবার ভাত জুটেছে তার কপালে। আর পনের দিনে খাবার জুটেছে তিনবেলা। পেটে ক্ষুধা থাকায় উচ্চবাচ্য না করে গোগ্রাসে খেতে থাকে। তবে খেতে খেতে সে পুলককে লক্ষ্য করছে। আজকে তার চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে আছে। ঠোঁটের কোনে লেগে আছে সরু হাসির রেখা। হয়তো সে কোন কারনে বেশ খুশি। গত পনেরদিনের মধ্যে আজই প্রথমবার তাকে হাসতে দেখল মাহমুদ হাসান। এই পনের দিনে পুলক মির্জা সম্পর্কে বেশ কিছু ধারনা জন্মেছে তার। সে নিজেও একজন খুণী হবার সুবাদে আরেক খুণীর চোখ চিনতে ভুল করার মত মানুষ নয় সে। সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে পুলক মির্জা ঠান্ডা মাথার খুণী। কিন্তু হঠাৎই আজকে তার খুশির কারন ভাবাচ্ছে বন্দীকে। সেই সাথে একটু একটু ভয়ও হচ্ছে।

বন্দীর খাওয়া শেষ হলে পুলক মির্জা প্যান্টের পকেট থেকে ট্রেজারারের প্যাকেট বের করল। সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে ছুঁড়ে মারল বন্দীর দিকে। সে নিজেও ধরাল একটা, বন্দীর সিগারেটেও আগুন দিল।

” তুই কি ভাবছিস, মাহমুদ, হঠাৎই তোকে কেন এত আপ্যায়ন করছি, এটাই তো? আজকে আমার মনটা ভিষনই ভালো আছে। তো এবার ভালো ছেলের মত বলে দে, তোর গডফাদার কে? কে তোকে আমার আব্বুকে মারার কন্ট্রাক্ট দিয়েছিল। ”

মাহমুদ পরপর কয়েকটা সুখ টান দিয়ে নাকমুখ ভর্তি করর ধোঁয়া ছাড়ল। চোখ বন্ধ সে সিগারেটের স্বাদ উপভোগ করছে। এই ব্রান্ডের সিগারেটের নাম আগে শুনলেও কখনো খাওয়া হয়নি। কয়েক টান দেয়ার পর সে মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল, সাধেই এটা বিশ্বের দামী ব্রান্ড হয়নি। পুলক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে-ও বন্দীকে সময় দিচ্ছে। সেই সাথে নিজের পরবর্তী লক্ষ্য স্থির করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে পুলক মির্জার দিকে তাকায় বন্দী। মধুর হেসে বলল,

” আমাকে কেউ-ই কন্ট্রাক্ট দেয়নি। আমি নিজ থেকেই মেরেছি আপনার বাবাকে। ”

” তুই রায়হানকে চিনিসতো? যে তোর জিগরী দোস্ত। সে কিন্তু অন্য কথা বলেছে। ” পুলকও ততোধিক মধুর হেসে বলল।

রায়হানের নাম শুনতেই মুখ থেকে হাসি মুছে গেল মাহমুদের। সেই স্থানে জমেছে কালো মেঘ। রায়হানের কথা জানার সাধ্য কারও নেই। সে রায়হানকে সযতনে লুকিয়ে রেখেছে তার আত্মীয়, পরিচিত, বন্ধুবান্ধব সকলের কাছ থেকেই।

” ক..কে রায়হান! ” এতটুকুই বলতে পারল মাহমুদ।

” তোর সকল অন্যায়ের সাথী। যাকে তুই নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করিস। তুই এখানে মিশনে আসার আগে যাকে সবটা জানিয়ে এসেছিলি। ” পুলক হাসিমুখেই কথা বলছে।

মাহমুদ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকল। আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়তে পুড়তে প্রায় শেষের দিকে এসেছে। যেকোনো মুহূর্তে তার আঙ্গুলে ছ্যাঁকা লাগবে। তার চোখমুখ জুড়ে শুধুই হতাশা। আর বুঝি শেষরক্ষা হলোনা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে তাকাল পুলক মির্জার দিকে।

” রায়হানের খোঁজ যখন পেয়েছেন, তখনতো বাকিটাও আপনার জানার কথা। আর কি শুনতে চান! ”

মাহমুদের কথা শুনে পুলক ভ্রু জোড়া নাচিয়ে বলল,

” গুড, এইতো পথে এসেছিস। আমি রায়হানের কাছ থেকে নয় তোর মুখ থেকে সবটা শুনতে চাই। যেহেতু তুই আমাদের পরিবারকে ছন্নছাড়া করেছিস, সেহেতু তুই-ই বলবি। ”

” তারমানে রায়হান আপনাকে কিছুই বলেনি? সবকিছু বলে দিলে আমি কি ছাড়া পাব? আমার একটা পরিবার আছে। আমি ছাড়া সেই পরিবার পথে বসবে। ” মাহমুদ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল। ওর চোখ দুটো জলে পরিপূর্ণ।

” তোর সন্তান আর রক্ষিতাও কি সেই পরিবারের মধ্যে পরে? এখন তুই নিজের পরিবারের কথা ভাবছিস। কিন্তু আমার আব্বুকে মারার সময় তোর একবারও মনে হয়নি, তারও একটা পরিবার আছে? তার মৃত্যু সেই পরিবারকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে? তোর সব কথা শোনার পর আমি সিদ্ধান্ত নিব তুই ছাড়া পাবি কিনা। ” রাগে পুলকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।

” আমার টাকা প্রয়োজন, অনেক টাকা। টাকার জন্যই আমি এসব করি। তাই অতশত ভাবার প্রয়োজন পরেনা। আর আপনি দেখছি আমার গোপন সম্পর্কের কথাও জানেন! আমার ভয় হচ্ছে আপনি অন্তর্যামী কিনা। ” ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল মাহমুদ।

” কোন মানুষই অন্তর্যামী নয়। তোর ইমানও দেখছি নড়বড়ে! আগেই বলেছি, তোর সম্পর্কে আমি স্টাডি করেছি অনেকদিন। এবার শুরু কর। আমি অনেকদিন অপেক্ষা করেছি আর নয়। ”

” আগে আমার জীবনের নিশ্চয়তা চাই। নিশ্চয়তা পেলেই তবে বলব। আর সবকিছু শোনার পর সহ্য করতে পারবেন তো? ” মাহমুদ এবার পুলকের সাথে একটা গেইম খেলার চেষ্টা করল।

” কিছু না বললেও তুই মরবি। তোকে আমি বাঁচিয়ে রাখবনা। তুই না বললেও আমি ঠিকই তাকে খুঁজে বের করব। হয়তো একটু দেরি হবে এই যা। কিন্তু বের আমি তাকে করবই। ” পুলক মির্জাও দমে যাবার পাত্র নয়। সে-ও উল্টো হুমকি দিল।

মাহমুদ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ডাক পরল পুলকের। সাকিব ওকে ডাকছে।

” ভাই, শাহেদ ভাই ফোন করেছে। আপনার সাথে কথা বলবে। ”

” আসছি। আজ তাহলে এতটুকুই থাক? আমি ঠিক তিনদিন পর আবার আসব। এই তিনদিন তুই কোন খাবার পাবিনা। শুধু একবার পানি দিয়ে যাবে আমার ছেলেরা। আনটিল দেইন এনজয় লাইফ ইন ক্যাপটিভিটি। পুলক মির্জা বেরিয়ে গেল বেজমেন্ট থেকে।

***

” বউ দেখছি রাগ করে আছে! ঘটনা কি? আমি আবার কি করলাম! ও বউ, কিছুতো বল? ” শাহেদ তিয়াসার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। কিন্তু তিয়াসা ওর দিকে তাকিয়েও দেখছেনা। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে থাকতে পারলনা। শাহেদের খোঁচাখুঁচিতে তার দিকে মনযোগ দিতেই হল।

” কি হয়েছে, এভাবে ষাঁড়ের মত ডাকছেন কেন? ” তিয়াসা রেগে গেছে।

” ওমা ষাঁড়ের মত ডাকব কেন! ষাঁড় কি তার বউকে বউ বলে ডাকে! নাকি ষাঁড় কথা বলে? ছিহ বউ তুমি আমাকে ষাঁড়ের সাথে তুলনা করলে! অথচ আমি এতদিন জেনে এসেছি আমি পুরুষ সিংহ। “শাহেদ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলল।

” ভুল জেনেছেন। আপনি ষাঁড়। আপনি হরেন কাকার গোয়ালের ষাঁড়। ” তিয়াসা রাগ উগড়ে দিচ্ছে শাহেদকে।

” দেখ জ্বালা আবারও ষাঁড় বলছে! আর একবার যদি ষাঁড় বলেছ, তবে আমি, তবে আমি, আমি কিছু একটা করব বলে দিলাম। ” শাহেদ কোন কথা খুঁজে না পেয়ে বলল।

” কি করবেন? ” তিয়াসা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে শাহেদের দিকে।

” তোমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করব। কি চলবে? ”

শাহেদ একগাল হেসে জড়িয়ে ধরল তিয়াসাকে। তিয়াসার আগ্রহ তোয়াক্কা না করেই চুমু দিচ্ছে ওর পুরো শরীরে। তিয়াসা কিছুক্ষণ আঁইগুঁই করল। কিন্তু শাহেদের শক্তির সাথে পেরে উঠলনা। বাধ্য হয়ে চুপচাপ সহ্য করতে হয় শাহেদের ভালোবাসার অত্যাচার।

অনেকক্ষণ পর শাহেদের হাত থেকে ছাড়া পায় তিয়াসা। দু’জনেই হাঁপাচ্ছে। তিয়াসা শাহেদের বুকে মাথা রেখে ওর লোমশ বুকে আঙ্গুল চালাচ্ছে। হঠাৎই নিরবতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞেস করল তিয়াসা।

” আয়েশা কে? ”

” আমার দাদীমা। ” শাহেদ নিশ্চিন্ত মনে উত্তর দিল।

” আপনার কত নম্বর দাদীমা তিনি? ” তিয়াসা ছাড়বার পাত্রী নয়। সে আবারও জিজ্ঞেস করল।

” আসতাগফিরুল্লাহ। আমার দাদীমা একটাই। আমার দাদুর চরিত্রে কোনও সমস্যা ছিলনা। তার জীবনে একজন নারীই ছিল। ” এবার শাহেদ একটু চমকে উঠে বলল।

” এই আয়েশা সিঙ্গাপুর থাকে। তার কথাই জিজ্ঞেস করছিলাম। সে-ও আপনার দাদীমা? ” তিয়াসা খামচি দিয়েছে শাহেদের বুকে।

” ডাবল আসতাগফিরুল্লাহ। সিঙ্গাপুরের আয়েশা আবার কে? ” শাহেদ তিয়াসার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল৷

” কেন আয়েশাকে চেনেননা বুঝি? কিন্তু তার কথা শুনে মনে হলোনা সে আপনার অপরিচিত। কি সুন্দর বেইবি বেইবি করছিল। সে নাকি আপনাকে মিস করছে, আপনাকে না দেখে তার চোখে ইনফেকশন হয়েছে, কার হার্টে ঠিকমত অক্সিজেন সাপ্লাই হয়না। আরও কত কি। কে এই আয়েশা? ” রাগে তিয়াসার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে।

এবার শাহেদ সত্যিই ভয় পায়। সে উঠে বসল। কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,

” বিশ্বাস কর বউ , দাদীমা ছাড়া আয়েশা নামের কাউকে আমি চিনিনা। আমাকে বেইবি বলে ডাকার কেউ কোন কালেই ছিলনা। কেউ হয়তো মজা করেছে তোমার সাথে। ”

” আমার সাথে কেউ মজা করেনি। সে আপনার ফোনে ফোন করেছিল। আজকে আপনি ভুল করে ফোন না রেখে গেলে, আমি জানতামইনা আপনাকে না দেখে কেউ বিবাগীনি হয়েছে। যাবেন নাকি সিঙ্গাপুর, তার অক্সিজেনের ঘাটতি পূরন করতে? তার চোখের ইনফেকশন দূর করতে যাবেন? ” তিয়াসা আর একবার খামচি দিল শাহেদের বুকে।

” কিসব নাউজুবিল্লাহ কথা বলছ তুমি, বউ? আমি কেন সিঙ্গাপুর যাব! আর তাছাড়া একজনের অক্সিজেন সাপ্লাই করতে গিয়েই আমার দফারফা হয়ে যাচ্ছে। এখন আবার আরেকজনের অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের দ্বায়িত্ব নিলে আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। ” শাহেদ তিয়াসার হাত ধরে বলল।

” আপনার ইয়ার্কির গুল্লি মারি। কার কাছে দিয়ে রেখেছেন আপনার কিডনি, ফুসফুস? কে আয়েশা? আজকে যদি সদুত্তর না পেয়েছি তবে আপনার নামে মামলা করব, আমাকে ঠকানোর জন্য। আমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কথা বলে, গোপনে আয়েশার সাথে মন দেয়া নেয়া করবেন, এটা হবেনা। এজন্যই অফিস থেকে আসতে দেরি করেন? তার সাথে মনের সব কথা শেষ করতে গিয়ে বুঝি বাসায় আসতে দেরি হয়? কই দেখি তার ছবি? আমিও দেখি সে কেমন এট্রাকটিভ। ” তিয়াসা শাহেদের দিকে ফোন বাড়িয়ে দিল।

” আমার সোনা বউ, আমার জান পাখি, তুমিই আমার প্রথম এবং শেষ প্রেম। আমাকে বিশ্বাস কর। কই দেখি কোন নম্বর থেকে ফোন এসেছিল? আমি এখনই তোমার কনফিউশান দূর করে দিচ্ছি। তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে, আমার জীবনে তুমি ছাড়া কোন নারীর অস্তিত্ব নেই। ” শাহেদ পারলে কাঁদে। সেই সাথে তিয়াসার দিকে তাকালেই ও ভয় পাচ্ছে।

শাহেদ তিয়াসার বের করা নম্বরে ফোন দেয়। তার আগে ও টাইম দেখে নেয়। শাহেদ লাউডস্পিকার অন করল। কয়েক সেকেন্ড পরই কেউ রিসিভ করল। রিনরিনে গলায় ওপাশ থেকে কেউ কথা বলল,

” মে আই আস্ক হু’জ কলিং? ”

” ইট’স মি, শাহেদ। হু আ ইউ? ”

” আ’ম আয়েশা চৌধুরী। হু’জ শাহেদ? সরি আই ডোন্ট নো ইউ। ”

” আপনি দুপুরে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। আমার ওয়াইফ এ্যাটেন্ড করেছিল। আপনি তাকে কিসব আজেবাজে কথা বলেছেন। কে আপনি? অযথা আমার সুখের সংসারে অশান্তি করছেন কেন, সিস্টার? আমি একজন সরল সাদা মানুষ। নিজের বউকে ভালোবেসেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই। কিন্তু আমার সেই বউটাই আমাকে ভুল বুঝল। ” শাহেদ সোজা বাংলায় বলল।

” আমি ফোন দিয়েছিলাম! জাস্ট আ মিনিট। ” কয়েক মুহুর্ত নিরবতা। এরপর ওপাশ থেকে মেয়েটা কথা বলল,

” সরি, আসলে একটা ডিজিট মিস্টেক হয়েছিল। আমি অন্য একজনকে ফোন দিয়েছিলাম। সরি এগেইন, ডিয়ার। আমি ফাহিম নামের একজনকে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্য আপনার কাছে ফোন চলে গেছে। আপনার ওয়াইফকে একবার ফোন দেবেন, আমি সরি বলে দেব? ” মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে তার ভুলভাল কাজের জন্য।

” ইট’স ওকে। সে আমার পাশেই আছে। এরপর থেকে কোথাও ফোন দিলে নম্বর কয়েকবার চেইক করবেন। নয়তো আমার মত সহজসরল মানুষের সংসার লাটে উঠবে। ”

শাহেদের কথা শুনে ওপাশ থেকে মেয়েটা হাসল। এরপর ফোন রেখে দিল।

তিয়াসার এতক্ষণের রাগ নিমেষেই উধাও হয়ে যায়। শাহেদ কিছু বলার আগেই ও টুপ করে চুমু দেয় শাহেদের ঠোঁটে, লোমশ বুকে। শাহেদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজল।

চলবে…