রাঙা আলোর সন্ধ্যা পর্ব-৫৩+৫৪

0
131

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৫৩
জাওয়াদ জামী জামী

” শাহেদ বাবা, তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় আইসা পর। নতুন বউ মাথা ঘুইরা পইরা গেছে। এখনো জ্ঞান আসেনাই। ”

খাদিজা আন্টির কথা শুনে শাহেদের পায়ের নিচের মাটি নড়ে উঠল। ভয়ে ওর সর্বশরীর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় আন্টিকে জিজ্ঞেস বলল ,

” আপনি ওর পাশেই থাকুন, আন্টি। ওর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করুন। আমি এ্যাম্বুলেন্সে ফোন করছি। আমার ফ্রেন্ড ডক্টর। ওর হসপিটালেই নেয়ার ব্যবস্থা করছি। ”

” তুমি আসবানা, বাবা? আমি একা কেম্নে কি করমু? ”

” আমার যেতে এক ঘন্টার বেশি সময় লাগবে। ততক্ষণে এ্যাম্বুলেন্স পোঁছে যাবে। আমি এখান থেকে সোজা হসপিটালে যাব। দাদুকে সাবধানে থাকতে বলে দিন। প্রয়োজনে পাশের ফ্ল্যাটে চাবি দিয়ে যাবেন। ”

” আইচ্ছা, বাবা। তুমি এ্যাম্বুলেন্স আইতে কও। ”

হসপিটালের করিডোরে অস্থির হয়ে পায়চারী করছে শাহেদ। তিয়াসার জ্ঞান এখনো ফেরেনি।

” তিয়াসার কি হয়েছে, দৃষ্টি? হঠাৎ করেই ও সেন্সলেস হয়ে গেল কেন? ” শাহেদ ডক্টর দৃষ্টির কাছে উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল। ডক্টর দৃষ্টি ওর ছোটবেলার বন্ধু।

ডক্টর দৃষ্টি মনযোগ দিয়ে তিয়াসার রিপোর্ট দেখছে। ওর ভ্রু সামান্য কুঁচকে আছে। শাহেদের কথা শুনেও সে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালনা। এদিকে শাহেদ অধৈর্য্য হয়ে তাকিয়ে আছে দৃষ্টির দিকে। দৃষ্টি কিছু বলছেনা দেখে ও আবারও জিজ্ঞেস করল,

” তুই কথা বলছিসনা কেন? আমার এবার কিন্তু বেশ চিন্তা হচ্ছে। প্লিজ কিছু বল। ”

শাহেদের প্রশ্নে এবার নড়েচড়ে বসল দৃষ্টি। চোখ থেকে চশমা খুলে আবারও চোখে পরল সে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল বেশ জোড়েই। এরপর মৃদু গলায় বলল,

” আমি এখন যা যা বলব, তুই মনযোগ দিয়ে শুনবি। কোন রিয়্যাক্ট করবিনা। প্রমিজ কর। ”

শাহেদ কোনকিছু না ভেবে এক নিঃশ্বাসে বলল,

” তুই বল। আমি কোনও রিয়্যাক্ট করবনা। ”

” ছোটবেলায় তিয়াসার একটা অপারেশন হয়েছিল এটা তুই জানিস? ”

” হুম, জানি। ওভারিতে সিস্ট এর অপারেশন হয়েছিল। ”

” এবং সেখান থেকেই সমস্যার শুরু। যার দরুন তিয়াসা কখনোই কনসিভ করতে পারবেনা অন্তত রিপোর্ট সেটাই বলছে। ”

নিজের মাথায় বাজ পরলে ততটাও আঘাত পেতনা, যতটা আঘাত শাহেদ দৃষ্টির কথায় পেল। ও নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকল দৃষ্টির দিকে। অনেকক্ষণ পর নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

” একথা যেন তিয়াসা কিছুতেই জানতে না পারে। ওকে যেকোন একটা অসুস্থতার কথা বলবি। কথাটা শুনলে ও ভীষণ কষ্ট পাবে। ওর জীবনটা আঁধারে ছেয়ে যাবে। হয়তো কখনোই স্বাভাবিক হতে পারবেনা। ওর আঁধারে ছাওয়া মুখটা আমাকে পোড়াবে ভীষণ। আমার নিজের ভালো থাকবার জন্য তিয়াসাকে ভালো রাখতে চাই আমি। ”

” তুই সত্যিই অনন্য রে, শাহেদ! প্রতিটা মেয়ে যেন তোর মত জীবনসঙ্গী পায়। আমি খুব করে চাইছি এই রিপোর্ট ভুল হোক। আচ্ছা শোন, তুই চাইলে একবার তিয়াসাকে নিয়ে দেশের বাহিরে যেতে পারিস। সেখানেই ওর ট্রিটমেন্ট করিয়ে দেখ। যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়, তবে তুইও সন্তানের মুখ দেখতে পাবি। ”

” দুই মাস পর ইন্ডিয়ায় একটা ট্রিপ আছে। তিয়াসাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। যদিও ওকে কথাটা বলা হয়নি। এই সুযোগে ওকে বলব। ”

” ভালো সিদ্ধান্ত। এবার বল, তিয়াসাকে ওর অসুস্থতার ব্যপারে কি বলব? মানে ওকে তো কিছু একটা বলতে হবে। ”

” তুই ডক্টর আমি নই। এমন কিছু একটা বলবি যেন ও আগামী তিন-চার বছর বেবি নেয়ার কথা মাথায় না আনে। ”

” ওকে, দোস্ত। আমি ওকে বলব, ওর ওভারিতে আবারও সিস্ট হয়েছে। সে কারনেই ওর সমস্যা হচ্ছে। আমি কয়েকটা মেডিসিন দেব, ও যেন নিয়ম করে খায়। ”

” ওকে। ”

***

” সরি, বোকা পাখি, তোমার খেয়াল রাখতে না পারার জন্য। যে সময় তোমার আমাকে প্রয়োজন, সে-সময় আমি তোমার মুখাপেক্ষী হয়ে রুমে শুয়ে বসে দিনরাত কাটাচ্ছি। তোমাকে টেনশনে রেখেছি। বিরক্ত করছি। ” পুলক আশফির হাত ধরে ওকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল।

” কে বলল আমি বিরক্ত হচ্ছি! আপনাকে নিয়ে আমার চিন্তা হয় ঠিকই, কিন্তু কখনোই বিরক্ত হইনা। আপনি এভাবে আর কখনোই বলবেননা। আমরা একে-অপরের পরিপূরক। একজনের বিপদে আরেকজন পাশে থাকব, এটাই তো হওয়া উচিত। আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর আমার খেয়াল রাখবেন। ততদিনে আপনার প্রিন্স আরেকটু বড় হোক। ” আশফি গলায় দরদ ঢেলে বলল।

” ভালোবাসি, বউ। তোমার মত করে কেউ আমাকে বোঝেনা। অবশ্য আম্মুও বোঝে। আমার জীবনে তোমরা দু’জন গুরুত্বপূর্ণ নারী। যাদের আমি কখনোই ভালো না বেসে থাকতে পারবনা। ” আবেগে পুলকের গলা কেঁপে উঠল।

” আপনার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে। এবার একটু চুপ করে বসুনতো। ” পুলকের কথায় আশফির ভেতরটা আনন্দে ছলকে উঠল। মানুষটা ওকে সত্যিই ভালোবাসে সেই প্রমান ও অনেক আগেই পেয়েছে। তবুও কথাটা বারবার শুনতে ওর ভালো লাগে।

” মির্জা মাশরুর আয়াস নামটা কেমন, বউ? ” পুলক সানন্দে জিজ্ঞেস করল।

” খুব সুন্দর। কার নাম? ”

” আমাদের প্রিন্সের। ”

” আপনি কি নিশ্চিত আমাদের ছেলেই হবে! ” আশফি এবার অবাক হয়।

” একশো দশ পার্সেন্ট। ” পুলক হাসছে।

” তাই যেন হয়। ”

***

” ও শাউড়ী আম্মা, আজকে কি রান্না করব? ” রান্নাঘরে এসে নিলাশা রিনা আক্তারকে জিজ্ঞেস করল।

” তোমার কিছুই করন লাগতনা। যা করার আমিই করমুনে। তুমি ঘরে যাও। ”

” এটা কেমন কথা, শাউড়ী আম্মা! এতদিন পর আমি গ্রামে আসলাম কিন্তু রান্না করবনা! এমন অলস ছেলের বউ আমি নই। আপনি বরং রুমে গিয়ে বেশি বেশি স্টার জলসা দেখুন আর দজ্জাল শাশুড়ী কিভাবে হতে হয় সেটা শিখুন। আমি ততক্ষণে রান্না করে নিই। ”

” এই মাইয়া, একদমই চালাকি করবানা। তোমার চালাকি আমি বুঝবার পারিনা মনে করছ? আমার হাত থাইকা সংসার কাইড়া নেওনের ধান্দা করতাছ, সেইডা আমি ঠিকই বুঝি। তোমার ইমুন আশার মুখে ঝাঁটার বারি দিই আমি। এইডা আমার সংসার। তুমি এই সংসারে একজন কুটুম। বছরে দুই-একবার আইবা আর আমার কথামত চলবা। ”

” সংসার কি চিরটাকাল আপনারই থাকবে, শ্বাশুড়ি আম্মা? চিরকাল ছিলও কি? এই সংসার একদিন আপনার শ্বাশুড়ির ছিল। যেটা আপনি তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। আমাকে আপনি অতিথি মনে করতেই পারেন। কারন আপনি রিফাতের নিজের মা নন। আর যে মহিলা একজন মা হারা ছেলের নিজের মা হয়ে উঠতে পারেনা, সে সেই সৎ ছেলের বউয়ের নিজের শ্বাশুড়িও হয়ে উঠতে পারেনা কোনদিন। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার নিজের গর্ভের একটা ছেলে আছে। এমন দিন যেন না আসে, যেদিন আপনার ছেলের বউ আপনার কাছ থেকে এই সংসার কেড়ে নিল। যদিও এটা অবশ্যম্ভাবী। আপনাকে একদিন এই সংসারে উচ্ছিষ্ট হয়েই বাঁচতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, দুনিয়াতেই মানুষ নিজের কর্মফল ভোগ করে। আপনি নিজের শ্বাশুড়ির সাথে যেটা করেছেন আপনার পুত্রবধূও আপনার সাথে ঠিক তেমনটাই করবে। অবশ্য আরও বেশি করবে। ” নিলাশা আজ কথাগুলো না বলে পারলনা।

নিলাশার কথা শুনে রিনা আক্তার কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এরপর সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রিনা আক্তার বেরিয়ে গেলে নিলাশা রান্নার আয়োজন করতে শুরু করল। আফজাল হোসেন ওর কাছে কাতলা মাছের দোঁ পেঁয়াজা খেতে চেয়েছেন।

নিলাশা মন দিয়ে কয়েকরকম তরকারি রান্না করল। একবারের জন্যও রিনা আক্তার রান্নাঘরে উঁকি দেয়নি। এতে অবশ্য নিলাশার কোন আফসোস নেই। বরং রিনা আক্তার রান্নাঘরে থাকলেই ওর কাজে বাগড়া দিত। ঠিকমত রান্না করতে দিতনা।

গোসল শেষ করে রুমে আসতেই নিলাশার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে রিফাতের নাম দেখে হাসি ফুটল নিলাশার ঠোঁটের কোনে।

” সোয়ামী, একটামাত্র বউকে বুঝি মিস করছিলেন? আহা কি ভালোবাসা। এমন ভালোবাসা যেন প্রতিটা জামাইয়ের বুকে জন্মায়। ধন্য নিলাশা, তুই ধন্য। ”

অপরপাশে কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করল। এরপর রিফাত কথা বলল,

” অনেকক্ষণ থেকে ফোন করছি। কোথায় ছিলে? ” রিফাত গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল।

” পুকুরে গিয়েছিলাম। ” নিলাশা ভাবলেশহীন গলায় বলল।

” পুকুরে কেন! ” রিফাত বেশ অবাক হয়েছে।

” পাশের বাড়ির কুদ্দুস মিঞার সাথে সাঁতার প্রতিযোগিতা করলাম। কে জিতেছে বলুনতো? ” নিলাশা উচ্ছ্বসিত গলায় জিজ্ঞেস করল।

” কিহ! কুদ্দুসের সাথে সাঁতার প্রতিযোগিতা করেছ! কিন্তু এই কুদ্দুস কে? ” রিফাত হায় হায় করে উঠল।

” আপনিই খুঁজে বের করুন কুদ্দুস কে। আপনার বউ অচেনা কারও সাথে পুকুরে নেমে গোসল দিচ্ছে, সাঁতার কাটছে, কিন্তু কেন সে এসব করছে সেটা খুঁজে বের করার দ্বায়িত্ব আপনার। যদি খুঁজে বের করতে পারেন, তবে আমি বুঝব আপনি সত্যিকারের পুরুষ। ” নিলাশা ইচ্ছাকৃত খোঁচা দিল রিফাতকে।

” তোমার মাথা ঠিক আছে? কিসব আজেবাজে বকছ! ” রিফাতে মাথা ঘোরাচ্ছে নিলাশার হেয়ালিপূর্ন কথা শুনে।

” টাটা, বাই, বাই, বিদায়, রাখলাম। কুদ্দুস কে সেটা খুঁজে বের করতে পারলেই তবে আমাকে ফোন দেবেন। ” নিলাশা রিফাতের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোন কেটে দিল।

ঠিক দশ মিনিট পর আবারও নিলাশার ফোন বেজে উঠল। নিলাশা ফোনে রিফাতের নাম দেখে রিসিভ করতে গড়িমসি করল। চারবার ফোন বেজে কেটে গেল। পঞ্চম বারে নিলাশা ফোন রিসিভ করল। তবে এবার নিলাশাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কথা বলল রিফাত ,

” আমাদের পাড়ায় কুদ্দুস নামের কেউ নেই। আর তুমি আজ সারাদিন পুকুরের আশেপাশে যাওনি। অযথা আমার সাথে মিথ্যা বলার জন্য তোমার শাস্তি পাওনা রইল। আর আমি পুরুষ কি না সেটাও একদিন তুমি বুঝতে পারবে। তবে প্রে কর সেইদিন যেন খুব নিকটে না আসে। কারন তুমি একটু বেশিই অন্যায় করেছ। ”

” আমি সর্বদা প্রে করি, সেইদিন যেন খুব তাড়াতাড়িই আসে। আপনার শাস্তি পেতে আমি উন্মুখ হয়ে আছি। আপনার শাস্তি পেতে আমি ইচ্ছে করেই হাজারবার অন্যায় করব। দেখব আপনি কত শাস্তি দিতে পারেন৷ ”

নিলাশার কথা শেষ না হতেই রিফাত ফোন কেটে দিয়ে বুকে হাত দিয়ে বসে থাকে। মেয়েটার সাথে কথায় কখনোই পেরে উঠেনা ও। মেয়েটা বারবার ওকে বুঝিয়ে দেয় ওকে কত ভালোবাসে। এই ভালোবাসা তুচ্ছ করার সাধ্য ওর নেই।

চলবে…

#রাঙা_আলোর_সন্ধ্যা
#পার্ট_৫৪
জাওয়াদ জামী জামী

” আচ্ছা শাউড়ী আম্মা, আমার নিজের শ্বাশুড়ি মা’য়ের কোন পোশাকআশাক নেই? না মানে অনেকেরই থাকে যেমনটা। যানেন আমার খুব দেখার ইচ্ছে হয় তাকে। তার পোশাকের গন্ধ নিতে ইচ্ছে করে। তাকে ছুঁয়ে দেখার বাসনা কখনোই পূরণ হবেনা তাই তার পোশাক ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। ” নিলাশা আবেগপ্রবণ হয়ে গেছে। ও ভালোমন্দ না ভেবেই রিনা আক্তারকে জিজ্ঞেস করল।

” এগুলান আমারে কও কেন? আমারে কি হের কাপড়চোপড় দেইখা রাখার জন্য কামের বেডি কইরা আনছিল পৃথার বাপে? আর তাছাড়া একজন মরা বেডির কাপড় ধরবার যামু কুন দুঃখে! আমার কি কাপড়ের অভাব পরছে যে, মরা বেডির কাপড় যত্ন কইরা রাখমু। আমার সাথে কতা কইবার ইচ্ছা না করলে কইবানা। তা-ও ঐ বেডির কথা আমার সামনে কইবানা। ” একরাশ ঘৃণা নিয়ে বলল রিনা আক্তার।

রিনা আক্তারের উত্তর শুনে হতভম্ব হয়ে যায় নিলাশা। একজন মৃত মানুষের প্রতি রিনা আক্তারের মনে আকাশসম ঘৃণা দেখে ওর চোখের কোনে অশ্রু জমল। এমন মানুষও হয়!
আফজাল হোসেনের গলা পেয়ে চোখ মুছল নিলাশা। সেই সাথে রিনা আক্তারকে শিক্ষা দেয়ার ফন্দি আঁটল। নিলাশা আর রিনা আক্তারকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হলেন আফজাল হোসেন। তিনি সোৎসাহে জিজ্ঞেস করলেন,

” দুই বিরোধী দল একসাথে বসে আছ যে , ঘটনা কি, বউমা? কি বৈঠক চলছে? ”

আফজাল হোসেনের প্রশ্ন নিলাশাকে নিলাশাকে ওর লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিল। মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়ে ও বলল,

” একে বোধহয় বৈঠকই বলা যায়। আমরা আমার শ্বাশুড়ি মা’কে নিয়ে আলোচনা করছিলাম। মা’য়ের কোন ছবি আছে আপনার কাছে, বাবা? কিংবা তার কোন স্মৃতি? যেগুলো দেখে আপনি কষ্ট লাঘব করেন? ”

নিলাশার কথা শুনে ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করলেন আফজাল হোসেন। এদিকে রিনা আক্তার তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একই সাথে রাগে ফুঁসছে।

” ওর কোন ছবি নেই আমার কাছে। তবে বড় ভাবীর কাছে পাবে। রিফাত, আশফির কাছেও আছে। তার স্মৃতি বলতে তেমন কিছুই নেই আমার কাছে। তার চলে যাওয়ার সাথে সাথে তার সব স্মৃতিগুলোও হারিয়ে গেছে। ওর বেশ কিছু কাপড়চোপড় ছিল। সেগুলোও বোধহয় বড় ভাবীর কাছে আছে। আর গহনাগুলো আছে রিনার কাছে। সেগুলো রিনা ব্যবহার করে। ”

আফজাল হোসেনের কথা শোনামাত্রই নিলাশা রিনা আক্তারের দিকে তাকালো। নিলাশার চোখে ঘৃণা স্পষ্ট। যা রিনা আক্তারেরও চোখে পরেছে।

” কি শাউড়ী আম্মা, একটু আগেই না বলছিলেন, আমার শ্বাশুড়ি মা’য়ের কোনকিছুই আপনার কাছে নেই? একজন মরা বেডির কাপড় আপনি নিজের কাছে রাখতে পারেননা কিন্তু তার গহনা ঠিকই ব্যবহার করতে পারেন! তার কাপড়চোপড় দেখে রাখবার জন্য তো আপনাকে কামের বেডি করে আনেনি বাবা, তবে কি তার গহনা পাহারা দেবার জন্য আপনাকে কাজের মেয়ে হিসেবে নিয়ে এসেছিল? ”

নিলাশার কথার ধরনে আফজাল হোসেন সবকিছু বুঝতে পারলেন। রিনা আক্তারের মন মানসিকতা দেখে এখন তিনি অবাক হননা। তবে মাঝেমধ্যে আফসোস হয়। নিজেকে ধিক্কার দেন, আবারও বিয়ে করেছেন বলে। রিনা আক্তারের মত মানুষকে স্ত্রী’র মর্যাদা দিয়েছেন বলে।

” বাদ দাও ,বউমা। তুমি বরং বড় ভাবীর কাছে গিয়ে তোমার শ্বাশুড়ির ছবি আর কাপড়গুলো দেখ। ওর কাপড়চোপড় দেখলে তুমি বুঝতে পারবে, ও কতটা রুচিশীল মানুষ ছিল। রিফাত ঠিক ওর মা’য়ের মত হয়েছে। মা’য়ের সব গুণ ছেলেটা পেয়েছে। ”

” মা’য়ের কাপড়চোপড় তো দেখবেই। তার আগে দেখব শাউড়ী আম্মার কাছে থাকা আমার মা’য়ের গহনাগুলো। কি শাউড়ী আম্মা, দেখাবেন তো? চলুন আপনার রুমে গিয়ে দেখি? ” নিলাশা রিনা আক্তারের উত্তরের অপেক্ষা না করে আফজাল হোসেনের রুমের দিকে পা বাড়ায়। আফজাল হোসেনও গেলেন নিরাশার পিছুপিছু। বাধ্য হয়ে রিনা আক্তারও উঠল।

সবগুলো গহনা দেখে নিলাশার চোখ কপালে উঠল। এখানে কম করে হলেও পঞ্চাশ ভরির মত গহনা আছে। রিনা আক্তার প্রথমে সবগুলো গহনা বের করতে চায়নি। কিন্তু আফজাল হোসেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দিয়ে গহনাগুলো বের করে নিয়েছেন।

” বাবা! এত গহনা ছিল মা’য়ের! আপনি সব দিয়েছিলেন? ”

” রিফাতের নানার বাড়ি থেকে দিয়েছিল বিয়ের সময়। তারা ত্রিশ ভরির গহনা দিয়েছিল। আমার আম্মা দিয়েছিল বোধহয় বিশ ভরি। আর আমি বিয়ের পর ছোটখাটো কয়েকটা দিয়েছিলাম। ”

” এগুলোর আসল মালিক কে, বাবা? না মানে, যে মানুষ একজন মৃত মানুষের কাপড়চোপড় নিজের কাছে রাখাকে কাজের মানুষের কাজ মনে করে, তার কি এই গহনাগুলো নিজের কাছে রাখার অধিকার আছে? আচ্ছা শ্বাশুড়ি আম্মা, আপনার কি এই গহনাগুলো ব্যবহার করতে বিবেকে বাঁধা দেয়নি? যার সন্তানদের আপনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন, যার কাপড়চোপড় নিজের রাখতে ঘৃণা করেছেন, তার গহনাগুলো নিজের রাখতে ঘৃণা হলোনা কেন? ” নিলাশা রিনা আক্তারকে জিজ্ঞেস না করে পারলনা। নিলাশা উত্তরের আশায় একে একে শ্বশুর-শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো।

” এগুলোর মালিক আশফি আর রিফাত। ” একবাক্যে উত্তর দিলেন আফজাল হোসেন।

নিলাশা একে একে সব গহনা গুছিয়ে নিল। এরপর কঠিন গলায় বলল,

” আমি এগুলো নিজের সাথে নিয়ে যাব, বাবা। এরপর দেব ভাবীকে। ভাবীর কাছে এগুলো থাকবে। নিজের মা’য়ের সবকিছু থাকা স্বত্বেও এতগুলো বছর ভাবী কিছুই পায়নি। তাই এগুলো তার প্রাপ্য। আমি শুধু এই বালাজোড়া রাখব, মা’য়ের স্মৃতি হিসেবে। ”

” তুমি এগুলান কি কও? এইগুলান আমার। আমি তোমারে কোনদিনও দিমুনা এইগুলান। ফকিন্নির বেডি আমার সংসারে আগুন জ্বালাইতে আইছে। আমার সবকিছু গ্রাস করবার চায় এই ফকিন্নির বেডি। এখন বুঝছি, রিফাত এরে পাঠাইছে। যুক্তি-বুদ্ধি কইরাই এইবার গাঁয়ে আইছে। ” রিনা আক্তার খেঁকিয়ে উঠল।

” মুখ সামলে কথা বলবেন। কাকে আপনি ফকিরের মেয়ে বলছেন! আমি যদি ফকিরের মেয়ে হই, তবে আপনি কার মেয়ে? আপনার ভাইবোনদের দেখেছি আমি। আমার বাবার বাড়ির কাজের ছেলেমেয়েরাও তাদের থেকে ভালো পোশাক পরে। তাদের থেকেও ভালো ভাষায় কথা বলে। আপনি যদি কখনো আমার বাবার বাড়িতে যান, তবে অন্যেরা আপনাকেই আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে ভাববে এটা আমি নিশ্চিত। আমি ভেবে পাইনা, বাবা কি দেখে আপনারমত মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। কি দেখে ঐ পরিবারে আত্মীয়তা করেছিলেন। ভবিষ্যতে অপমানিত হতে না চাইলে নিজের মুখ বন্ধ রাখবেন। সরি বাবা, আপনি কষ্ট পেলে সরি এগেইন। আজকে মুখ বন্ধ রেখে আমার বাবা-মা’কে অপমান করতে চাইনি। ”

” তুমি ভুল কিছু বলোনি, বউমা। সব ভুল আমার। আমি যদি সেদিন নিজের কিংবা নিজের পরিবারের সমকক্ষ কাউকে ঘরে আনতাম, তবে এরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতোনা৷ তুমি নিশ্চয়ই জানো, শিক্ষার অভাব মানুষকে নিচ আর অমানুষ বানিয়ে দেয়। ”

” আমি কালকেই চিটাগং ফিরব। এবার পৃথা, পিয়াসকেও নিয়ে যাব। আপনার ছেলেও সেটাই চাইছে। পৃথা, পিয়াসও রাজি। তবে সে আপনাকেও যেতে বলেছে। আপনি কি যাবেন? ”

” কেন যাবনা, বউমা! আমার ছেলের সংসার আমি দেখতে যাবনা? তোমার শ্বাশুড়ি বেঁচে থাকলে তোমাকে সাথে করে নতুন সংসারে নিয়ে যেত। সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে আসত। সে যখন নেই, তার দ্বায়িত্ব এখন আমাকেই পালন করতে হবে। ”

” আমার পোলা মাইয়া কোথাও যাইবনা। তুমি যেইখানে খুশি যাও। ইচ্ছা হইলে তুমি জাহান্নামেও যাইতে পার। ” রিনা আক্তার খেঁকিয়ে উঠল আফজাল হোসেনের ওপর।

” ওরা তোমার একার সন্তান নয়। ওরা আমারও সন্তান। তাই ওরা কি করবে, কোথায় যাবে সেটা আমিই বুঝব। তোমার যদি ভালো না লাগে, তবে তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পার। ” আফজাল হোসেনও ছেড়ে দিলেননা।

স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে চুপসে গেল রিনা আক্তার। বিয়ের এত বছরেও আফজাল হোসেন তার সাথে এভাবে কথা বলেননি। রাগে দলা পাকাচ্ছে তার ভেতরে।

” একটা কথা বলি, শাউড়ী আম্মা? আপনার শ্বাশুড়ির তিনটা ছেলে ছিল, তাই আপনি তার সেবাযত্ন না করলেও বাকি দুই ছেলে আর ছেলের বউ ছিল তার সেবাযত্নের জন্য। কিন্তু আপনার তো একটাই ছেলে। আমার বিশ্বাস আপনি নিজের শ্বাশুড়ির সাথে যেটা করেছেন, তার তিনগুণ বেশি ফেরৎ পাবেন। অসময়ে আপনার সেবাযত্ন কে করবে সেটা একবারও ভেবে দেখেছেন? তবে কখনো যদি এমন দিন আসে, তবে কোনকিছু না ভেবে রিফাতের কাছে যাবেন। সে আপনাকে ফেরাবেনা। ” নিলাশা রুম থেকে বেরিয়ে আসল। আজকে রিনা আক্তারের কথায় ও বেশ আঘাত পেয়েছে।

***

” আমার কি হয়েছে সেটা বলছেননা কেন? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে টেনশন করছেন। একবার বলুননা আমার কি হয়েছে? ” তিয়াসা শাহেদকে বারবার অনুরোধ করছে।

” অনেক আগে তোমার যে সমস্যা হয়েছিল এবারও সেটাই দেখা দিয়েছে। তবে এটা আগের থেকে একটু বেশিই কষ্টদায়ক হবে। কিন্তু তুমি এটা বল, বেশ কিছুদিন থেকে তোমার পেটে ব্যথা হচ্ছিল সেটা আমাকে কেন বলনি? ” শাহেদ উল্টো তিয়াসাকে প্রশ্ন করল।

” আমি আপনাকে টেনশনে রাখতে চাইনি তাি বলিনি। আর তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম, এটা গুরুতর কিছুই নয়। ” তিয়াসা মুখ ভার করে বলল।

” এরপর থেকে এমন কিছু হলে আমার কাছে লুকাবেনা। তুমি জানো, আন্টি যখন বলল তুমি অজ্ঞান হয়ে গেছ, তখন আমার কি হচ্ছিল? তোমাকে দেখা না পর্যন্ত পাগল পাগল লাগছিল। তোমার কিছু হলে মরেই যেতাম আমি। ” আবেগে শাহেদের গলা ভারী হয়ে আসল।

তিয়াসা শাহেদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছে মানুষটা গত কয়েকদিন কি পরিমান টেনশন করেছে, কত কেঁদেছে,না খেয়ে থেকেছে। তার চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। শাহেদের দিকে তাকিয়ে তিয়াসারও চোখে পানি আসল। ও একহাতে শাহেদের বাহু জড়িয়ে ধরল। মাথা রাখল তার বুকে।

” কখনোই আপনার কাছ থেকে কোনকিছুই লুকাবনা। আপনি কাঁদবেননা। ” বলতে বলতে তিয়াসাই কেঁদে ফেলল।

তিয়াসাকে কাঁদতে দেখে শাহেদ ওর চোখমুখে চুমু দিল।

” আমরা সামনের মাসে ইন্ডিয়া যাচ্ছি। তোমার পাসপোর্ট করতে দিয়েছি। আমাদের তো হানিমন হয়নি। এটাকে কি হানিমুন মনে করতে পারি? যদি তুমি হ্যাঁ বল, তবে আমার অনেক প্ল্যান আছে। ” শাহেদের কথার মধ্যে দুষ্টুমির ছোঁয়া।

তিয়াসা বুঝল শাহেদ কি বোঝাতে চাচ্ছে। তাই সে-ও দুষ্টুমি করেই উত্তর দিল,

” বাবা হওয়ার বয়সে হানিমুনে যেতে চাচ্ছেন! অশ্লীল পুরুষ। ”

তিয়াসার বলা কথাটা ধাক্কা দিল শাহেদের বুকে। এক মুহূর্তের জন্য ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। কি জবাব দেবে মেয়েটার কথায়? কতদিন ওর কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়ে রাখবে? মেয়েটা যখন জানবে, তখন কিভাবে নিজেকে সামলাবে? তিয়াসার অগোচরে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরল শাহেদের চোখ থেকে।

চলবে…