রাজনীতির রংমহল পর্ব-২৩

0
745

#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_২৩

★★★
বিনামেঘে বজ্রপাত পড়ার ন্যায় স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো সরদার পরিবার।একে অপরের দিকে বারবার চাওয়া-চাওয়ি করে অভিব্যক্তি মেলানোর চেষ্টা করছে।ভীষণ ঘাবড়ে গেছে আরাফ।তারপরেও নিজেকে সামলে আমতা-আমতা করে রাহুলের উদ্দেশ্যে বললো-

এই এই কে আপনি?আর কি সব বাজে কথা বলছেন?আমি বিয়ে করেছি তার প্রমাণ কি?সোভাম,এই বানোয়াট কথা বলে বরাবরের মতো আমাকে অপমান করার মানে কি?

অবাক হয়ে গেল রাহুল।কিন্তু দমলো না।দু -পা আরো সামনে এগিয়ে আরাফের মুখোমুখি দাড়ালো।বুক উচু করে গলায় তেজ এনে বললো-

আপনি এই কিছুক্ষণ আগে আপনার স্ত্রীয়ের সাথে কথা বলেন নি।কি যেন আপনার স্ত্রীর নাম(মনে করার ন্যায় অন্যদিকে তাকিয়ে)ওহ হ্যা,ছোছিয়া।কি মিঃ?

কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে আরাফের।মির্জা আফতার যেন আরো বিপাকে পড়ে গেলেন।ছেলে তো তার বিয়ে সত্যি সত্যিই করেছে।এখন এই মুহুর্তে সে স্বীকার না করলে মানসম্মান কিচ্ছু থাকবে না।কোনোমতে ধরা পড়লে ব্যাপারটা জনগণের মধ্যে ছড়াতে সময় লাগবে না।সবাই বলবে মন্ত্রী সাহেব একজন বাটপার।মুখে আলতো হাসি এনে শামসুল সরদারের দিকে তাকিয়ে বললেন-

সেকি,আরাফ আপনাদের বলে নি যে ও বিবাহিত।আমি তো ভেবেছিলাম সব বলেছে।কি রে তুই এনাদেরকে না বলেই সম্বন্ধতে জড়িয়েছিস।আসলে ব্যাপার টা আমি আপনাদের খুলে বলছি।ঘটনাটা ও লন্ডনে যাওয়ার পরেই ঘটেছে।ওখানেই ও সেটেল হতে চেয়েছিলো।তাই ওখানকার নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ছোছিয়া কে বিয়ে করেছিলো।কিন্তু ও ই ভিনদেশী কোনোমতেই বাংলাদেশে আসবে না। আর আরফের ও ওখান টা আর ভালো লাগছিলো না।তাই দেশে চলে এসেছে।এখানেই ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে সংসার করতে চেয়েছিলো।আমিই সত্যিই দুঃখিত!ও ব্যাপারটা আপনাদের কাছে বলে নি।

শামসুল সরদার গম্ভীর কন্ঠে বললেন-

আপনার ছেলে তো বললো ও আবার ওখানে যাবে।

হেসে দিলেন আফতার।বললেন-

আরে সেতো যেতেই হবে চাকরি করছে তো ওখানে।

ব্যাস!গর্জন ছেড়ে উঠলেন শামসুল সরদার। মুহুর্তেই রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার।সামনের নাস্তার প্লেট ছুড়ে মারলেন ফ্লোরে।আরাফ কিছু বলে উঠতেই ঠাস করে থাপ্পড় মারলেন গালের উপর।রাগে কাপতে কাপতে বললেন-

তোমার সাহস তো কম না।এই জন্যই বিয়ের এতো তাড়া ছিলো তোমার।বিদেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য বিয়ে করেছো।এখন দেশে মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসবে বলেও একটা বিয়ে করে রেখে যাবে।অসভ্য ছেলে।বের হও আমার বাড়ি থেকে।এক্ষুণি,নইলে খুন করে ফেলবো তোমায়।

আফতার দ্রুত ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।মানসম্মান যা যাওয়ার তা গেছে।বাকিটা বাচানোর জন্য দ্রুত ঢাকায় ব্যাক করতে হবে।

.

.

.

.

★★★★★
থমথমে সরদার বাড়ি।কাজি এক কোনায় বসে আছেন।তিনি ঠিক বুজতে পারছেন না কি করা উচিত।আদোও চলে যাবে নাকি এখানেই বসে থাকবে।একটু আগেই হনহন করে নিজের রুমে চলে গিয়েছেন শামসুল সরদার।রাহুল সোফায় বসে নির্বিকার ভাবে ফোন স্ক্রল করছে।সোভাম এক কোনায় দাড়িয়ে ফুসছে।আরাফ যতই খারাপ হোক না কেন এই মুহুর্তে তার কাছে আর্শির বিয়ে ভাঙাটাই মুখ্য।

বিদেশে থাকলে এরকম দু-একটা বিয়ে করতেই পারে সেখানে সেটেল হওয়ার জন্য।এটা তার কাছে দোষের কিছু না।কিন্তু বিয়েটা ভাঙার পরে আর্শি যে, যেকোনো মুহুর্তে পালিয়ে যেতে পারে সেটাই আসল চিন্তা।যত রাগ,জেদ সব একমুহূর্তে রাহুলের উপর পড়ছে।দ্রুতবেগে হেটে রাহুলের সামনে গেল।হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে সোফার উপর ফেললো।বললো-

তোমার সাহস কি করে হয় আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটারে নাক গলানোর?তোমার জন্য আর্শির বিয়েটা ভেঙে গেল।

সাময়িক ভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রাহুল।পরবর্তীতেই সোজা হয়ে বুক ফুলিয়ে দাড়ালো সোভামের সামনে।লম্বায়,চওড়ায়,গায়ের রঙে সে সোভামের থেকে এগিয়ে।বিশালদেহী, প্রতিনিয়ত জিম করা বডির সামনে সোভাম তুচ্ছ।ভ্রু কুচকে সোভামকে বলল-

লজ্জা করা উচিত তোর।একটা বিবাহিত,চরিত্রহীন ছেলের সাথে নিজের ওইটুকু বোনের বিয়ে দিচ্ছিলি।এতো তেজ কোথায় পাস তুই?

সারা গায়ে যেন আগুন ধরে গেল সোভামের।চিবিয়ে চিবিয়ে বললো-

আহাহাহাহা!মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশী।আমার বোনকে কার সাথে বিয়ে দেব সেটা আমি ঠিক করবো।তুমি নাক গলানোর কে?নিজে বিয়ে করবে নাকি ওকে।পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো-

হাহ!তুমি আর বিয়ে।তোমার মতো বেহায়া তো আর দুটো নেই।স্পর্শীর পেছনে তো পা চাটা কুকুরের মতো দৌড়িয়েছো।সেই আদোও কোনো লাভ হলো।শেষ অবধি মুখের উপর জুতো মেরে এমপি বিয়ে করে নিলো।আর তোমাকে বিয়ে করবেই বা কেন?আধবুড়ো একটা।মাথার চুল তো অর্ধেকের বেশী পেকে গেছে।প্রয়োজনে আর্শিকে চারটা বিয়ে করা লোকের সাথে বিয়ে দেব তবুও তোমার মতো আধবুড়োর সাথে নয়।

মুহূর্তে’ই মাথাশূন্য হয়ে গেল রাহুলের।মাত্র দু বছরের বড় সে সোভামের থেকে।সেই স্কুলে থাকতেই তার মাথার দু-একটা চুল পাকতে শুরু করেছে।অজস্র ডাক্তার দেখিয়েও লাভ হয় নি।এখনো যে খুব একটা পেকে গেছে তাও না।পুরো মাথা জুড়ে দশ টা চুল ও পাকে নি গোনা গোনা।

অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেল তার।কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।নিজের রাগকে বরাবরই কন্ট্রোল করতে পারে না রাহুল।চিবিয়ে চিবিয়ে বললো-

এই আধবুড়ো টাকেই তোর বাপ নেচে নেচে মেয়ে তুলে দেবে।আজ এক্ষুণি,তোর চোখের সামনে।পারলে বাধা দিস।

বলেই শামসুল সরদারের রুমের মধ্যে ঢুকলো।সোভাম দাত কেলিয়ে হাসলো।সে বাধা দিবে?কেন দিবে?সেতো ইচ্ছে করেই রাহুলকে রাগিয়ে দিয়েছে। কোনোভাবে আর্শিকে বিদায় করতেই মাতোয়ারা সে।পরশ সিকদারের সাথে কোনোমতেই হারবে না এবার।

.

.

.

.

★★★★★

আংকেল আসবো।

তড়িৎ বেগে দরজার দিকে চাইলেন শামসুল সরদার। মাথা নাড়িয়ে ভেতরে বসতে বললো। বসলো না রাহুল।কাঠকাঠ গলায় কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো-

আংকেল আমি আর্শিকে বিয়ে করতে চাই।আপনার কোনো আপত্তি না থাকলে বলুন।কাজি বসে আছে,এই মুহুর্তেই বিয়ে করবো আমি।

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শামসুল। রাহুল ভীষণ ভদ্র একটা ছেলে।এ বিষয়ে তার মোটেও সন্দেহ নেই।সেটা ভেবেই তো স্পর্শীর সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন।কিন্তু ভাগ্যে ছিলো না।আজ আবার ছোট মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে।কিন্ত কেন?

সন্দেহ কাটিয়ে উঠতে না পেরে বলেই উঠলেন-

তুমি তো স্পর্শীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে।এখন হঠাৎ আর্শিকে কেন?

বুকের ভেতরটা স্পর্শীর নাম শুনতেই চিনচিন করে উঠলো।তারপরেও নিজেকে সংযত করে বললো-

আংকেল স্পর্শী বিবাহিত।ওর স্বামী আছে।আমি ওকে নিয়ে আপাতত ভাবতে চাইছি না।আর্শিকে নিয়ে কোনো আপত্তি থাকলে বলুন।

হেসে দিলেন শামসুল।রাজি হয়ে গেলেন বিয়েতে।বসার ঘরে পুনরায় সব আয়োজন হলো।নতুন করে কাজি লিখতে বসে গেলেন নাম পরিচয়।আর্শি এখনো নেশার ঘোরে রয়েছে।চোখ টেনেও খুলতে পারছে না।হঠাৎ জিহান রাহুলকে বললো-

আপনি এখানে বসুন রাহুল ভাই।

চমকে উঠল আর্শি।মুখে বললো-
ভাই,পাভেল ভাই।পাভেল ভাই এসেছে।

এরইমধ্যে কাজি কবুল বলতে বললো আর্শিকে।নেশাগ্রস্ত আর্শি চোখের সামনে পাভেলকে দেখছে।কানের কাছে বারবার ধ্বনিত হচ্ছে পাভেল ভাই।কাজি আবারো তাড়া দিল।ধীর কন্ঠে কাজির সম্মোহনী কথার সাথে তাল মেলালো সে।ছোট ছোট স্বরে বলল-

কবুল কবুল কবুল।

বিয়ে সম্পন্ন হতেই তড়িৎ বেগে উঠে দাড়ালো রাহুল।এই বাড়িতে আর এক মুহুর্ত ও থাকবে না সে।কথাটা শামসুল সরদারের কানে যেতেই আতকে উঠলেন তিনি।বারবার নাকোচ করলেও দমাতে পারে নি রাহুলকে।আর্শিকে নিয়ে তখনই চলে গেল বাস কাউন্টারে।যদিও বাড়ির গাড়িতে যাওয়ার জন্য বেশ জোর করেছিলেন।কিন্তু রাহুল শোনে নি।তার একটাই কথা-

বেকার ছেলে দেখেই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন।আমাদেরকে আমাদের মতো ছেড়ে দিন।যদি মেয়েকে নিয়ে টেনশন হয়,তো আমি একাই চলে যাচ্ছি।ওকে আপনাদের বিলাসবহুল গাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন।

কথাগুলো শুনতেই দমে গিয়েছিলো সবাই।ঘুমন্ত আর্শিকে কোলে নিয়ে চলে এসেছে রাহুল।বাসে উঠে আর্শিকে একটা সিটে বসিয়ে পাশেই বসল ।আর্শিকে এক হাত দিয়ে আগলে ধরে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো-

তোকে এক পলক দেখা হলো না রে স্পর্শী।

মুহুর্তে’ই চোখ ফিরালো আর্শির মুখের উপর।বাবার কিছুটা আদল দু-বোন ই পেয়েছে।এই যে আর্শির নাক টা একদম স্পর্শীর মতো।চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চাইলো রাহুল।বাড়িতে গিয়ে কি বলবে সে?


বিকেল বেলা।ব্যাগপত্র গুছিয়ে গাড়ির পেছনে রাখলো পাভেল। সবার থেকে বিদায় নিয়ে ধীর পায়ে বাইরে এলো স্পর্শী।পরশ গাড়িতেই বসা। স্পর্শী আরেকটু এগোতেই ঠোট উলটে পরশকে বললো-

আমরা না গেলে হয় না।আমার কেমন জানি লাগছে।

আহাম্মক বনে গেল দু ভাই।পরবর্তীতেই পাভেল ধমকে ধামকে স্পর্শীকে গাড়িতে উঠালো।দুজন বডিগার্ড এসে গাড়িতে বসতেই আতকে উঠলো স্পর্শী।চিৎকার দিয়ে বললো-

একি!এনারা কোথায় যাচ্ছেন?

পাভেল স্পর্শীকে ব্যাঙ্গ করে বললো-

তোমাদের হানিমুন দেখতে।

পরশ শান্ত দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকালো। তারপর বললো-

বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে পাভেল।আমরা হানিমুনে ঘুরবো আর ওরা পাহাড়া দিবে। কি অসস্তিকর ব্যাপার।

স্পর্শী বললো-

পাভেল ভাই,ওরা বাড়িতেই থাকুক।

শেষ পর্যন্ত মানলো পাভেল।গাড়ি ছাড়ার আগে ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললো-

তোকে এতো এতো ছাড় ইচ্ছায় দিচ্ছি না।আমাকে একটা জিনিস দিতে হবে।

পরশ ভ্রু কুচকালো।বললো
কি লাগবে?

পাভেল হাসলো।তারপর বলল-

এখন বলা যাবে না।আগে তুই বাড়িতে আয়,তারপর চাইবো।না করতে পারবি না কিন্তু।

চলবে?