রাজনীতির রংমহল পর্ব-৩৩+৩৪

0
602

#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_৩৩

★★
বিয়েটা যেভাবেই হোক,যে পরিস্থিতিতেই হোক,তাদের মধ্যকার সম্পর্ক যেমনই থাকুক কিন্তু সেটা তাদের দুজনের মধ্যেই থাকুক।অন্যকাউকে জানাতে নারাজ রাহুল।এ জন্যই শাশুড়ীর সামনে অসস্তিতে পড়েছে সে।সোনালী বেগম যেন জামাইকে দেখেই তার ভেতর’টা পড়ে ফেললেন।ছেলে-মেয়ে দুটো যে এতো তাড়াতাড়ি নিজেদের কে মানিয়ে নিতে পারবে না সে ব্যাপারে নিশ্চিত সে।আলতো হেসে রাহুল’কে বললো-

আমার কষ্ট হবে কেন বাবা?আমি পালটে দিচ্ছি।

রাহুল যেন স্বস্তি পেল।মাথা নাড়িয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল।শামসুল সরদারের রুমের সামনে যেতেই থমকে দাড়ালো।এ বাড়ির সমস্ত টাই সে জিহানের কাছ থেকে বাসে বসে জেনে নিয়েছে।দরজা’য় আলতো করে টোকা দিয়ে বললো-

আংকেল,আমি রাহুল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুললেন তিনি।আলতো হেসে রাহুলের সাথে কুশল বিনিময় করতে করতে বিছানায় বসলো।তার চোখ দুটো ভয়ংকর ভাবে লাল হয়ে আছে।পুরুষ মানুষের এটাই দোষ।রাগলেও তাদের চোখ লাল দেখায় আবার কষ্ট পেলেও চোখ দুটো অশ্রুর পরিবর্তে রক্তের ন্যায় হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ বসে শান্ত কন্ঠে রাহুল বললো-

আংকেল,যাই হোক না কেন?সোভাম তো আপনার নিজের ছেলে।ওকে দাফন টা তো করাতে হবে।আপনি যাবেন না লাশ আনতে?

বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো শামসুল।ভেঙে যাওয়া কন্ঠে বললো-

পারি না বাবা।নিজেকে একদম সামলাতে পারি না।আমি মানুষ হয়ে একটা জানোয়ারের জন্ম দিয়েছি।যখনই ভাবি ওর লাশ আনতে যাবো।তখন’ই ওই ছোট্ট মেয়েটার অবয়ব সামনে ভেসে ওঠে।ওই মেয়েটা তো আমার আর্শির মতোই।আর্শির থেকেও অনেক ছোট ও।মাত্র এইটে পড়ে। সদ্য কিশোরী জীবনে পা দিতেই জীবন’টা শেষ করে দিল আমার জন্ম দেওয়া জানোয়ার’টা।

রাহুল আর কিচ্ছু বললো না।চুপ চাপ বের হয়ে গেল ঘর থেকে।বৃদ্ধ লোকটাকে আবারো নিজের কষ্টের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া তার উচিত হয় নি।

রুমে ঢুকতেই দেখলো আর্শির পোশাক চেঞ্জ করা। আর আশেপাশে সোনালী ও নেই।খুব খিদে পেয়েছে তার। টেবিলে বসে খাবার মুখে দিতেই দেখলো দেয়ালের উপরে কয়েকটা কাগজ আটকানো।উপরের সাদা কাগজটার নিচ থেকে নিচের লাল অবয়ব টা চোখে বিধছে।কাগজ’টা উল্টাতেই দেখলো নিচের কাগজ টার উপর শুকিয়ে যাওয়া একটা লাল গোলাপ পেরেকের সাথে ঝোলানো।গোলাপ’টা সরাতেই কাগজে লেখা বড় বড় অক্ষর গুলো ভেসে উঠলো।

“আর্শি,তোকে প্রচুর পড়তে হবে।পরিক্ষায় পাস করতে হবে।নইলে পাভেল ভাই তোকে বিয়ে করবে না।সে বারবার লেখাপড়া নিয়ে তোকে সাবধান করেছে।তুই লেখাপড়া’টাকে পাভেল ভাই মনে করে হামলে পড় বইয়ে’র উপর।”

মুহূর্তে’ই হাসির চোটে খুক খুক করে কেশে উঠলো।একটা মেয়ে কতটা আবেগী হলে এমন বাচ্চামো করে।খেয়ে দেয়ে রুমের লাইট নিভিয়ে চুপচাপ আর্শির পাশে এসে শুয়ে পড়লো।


ঘড়ির ঘন্টার কাটা’টা তখন তিনটার ঘরে উপস্থিত হয়েছে।কানের মধ্যে অজস্র হাহাকার,চিৎকার, চেচামেচির আওয়াজের রেশ ঢুকছে।আচমকাই ধড়াস করে উঠে বসলো আর্শি।ঘরের লাইট জ্বলছে।লাইটের কড়া আলোয় চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে।বারকয়েক চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো।ধীরে ধীরে কান্না,চিৎকারে’র আওয়াজ টা স্পষ্ট ভাবে কানে যাচ্ছে।আশেপাশে তাকাতেই ত্রস্ত পায়ে ভেতরে ঢুকলো রাহুল।আর্শি তার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার পলক ঝাপটা দিয়ে বললো-

কি হয়েছে ভাইয়া?সবাই এতো কাদছে কেন?আবার চিৎকার কেন হচ্ছে?

ঘুমন্ত আর্শির পলক ঝাপটে ঘুম ঘুম কন্ঠে কথাগুলো শুনতেই থমকে দাড়ালো রাহুল।কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে।পরক্ষণেই নিজেকে কড়াভাবে শাসিয়ে বললো-

নিরব হস্পিটালে বসেই মারা গেছে।এই আড়াইটার দিকে।

অবাক হয়ে আর্শি বললো-

নিরব ভাইয়া ও মারা গেছে।পরক্ষণেই বিরবির করে বললো”ভালোই হয়েছে।ওটাকে একদম সহ্য হয় না আমার❞।

রাহুল ভ্রু কুচকালো।সে স্পষ্ট”ই আর্শির কথা শুনতে পেরেছে।থমথমে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-

কেন?

ঘুমের রেশ এখনো কাটে নি আর্শির।উৎফুল্ল মনে রাহুলের দিকে তাকিয়ে বললো-

ওনার নজর খুব খারাপ।একদম চোখ দিয়েই গিলে খাবে মনে হয়।আমিতো ওনার সামনে খুব কম পড়ি।স্পর্শী আপু আসার পরে ওর দিকেও অনেক বাজে ভাবে তাকিয়েছিলো।

চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রাহুলের। দাতে দাত পিষে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই।আর্শি আলতো পায়ে বিছানা দিয়ে নামতেই পরিচিত রুমটাকে খেয়ালে এলো।সে এখানে কেন?এই অভিশপ্ত বাড়িতে আবার কেন নিয়ে আসা হয়েছে তাকে।ছলছল চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে বললো-

আমরা না পাভেল ভাইদে’র বাড়িতে যাচ্ছিলাম।তাহলে এখানে কেন এসেছি?

চমকে তাকালো রাহুল।ধীর কন্ঠে বলল-

কিছুক্ষণ আগেই আমরা পিরোজপুরে পৌছেছি।এতো রাতে কোথায় যেতাম?তাই এখানে আসতে হয়েছে।সকাল হতেই আমরা এখান থেকে চলে যাব।

চেচিয়ে উঠলো আর্শি।রাহুলের বলিষ্ঠ শরীর টার সামনে এসে আঙুল নাড়িয়ে দাতে দাত চেপে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললো-

আপনাকে আমি বলেছিলাম না এই বাড়িতে আমি আর পা ও রাখবো না।তাহলে কেন নিয়ে এলেন আমাকে?

সাময়িক ভাবে হতভম্ব হয়ে গেল রাহুল।সামনে দাঁড়ানো এইটুকু শরীর’টা যাকে দেখতে হলে নুয়ে তাকাতে হয়,সে কিনা তাকে ধমকে কথা বলছে।হাস্যকর ব্যাপার।গা ঝাড়া দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো-

পা তো রাখো নি।কোলে করে নিয়ে এসেছিলাম।প্রয়োজনে যাওয়ার সময়েও কোলে করে নিয়ে যাব।দরকার পড়লে ওয়াশ রুম অবধি ও তোমাকে কোলে করে দিয়ে আসতে পারি।কি যাবে?

বলেই চোখ টিপ মেরে দাত মেলে হেসে দিলো।আর্শি ভীষণ বিরক্ত এই মুহুর্তে। হতবাক হয়ে রাহুলের দিকে তাকিয়ে রইলো।সে যেতেই ঢুকরে কেদে ফ্লোরে বসে পড়লো।

এই রুমের,এই বাড়ির প্রতিটা কোনায় পাভেল ভাইয়ের স্মৃতি রয়েছে।কখনো এখানে লুকিয়ে,কখনো ওখানে লুকিয়ে কত্ত মেসেজ,কল,ভয়েস পাঠিয়ে জ্বালিয়েছে তার পাভেল ভাইকে।এমনি ডাইনিং টেবিলটার উপরেও ছোট করে P+A লিখে রেখেছে।ছাদ,কলেজের বেঞ্চ,বাড়ির দেয়াল,রুমের দরজা,কাগজ,বই খাতা সব জায়গায় তার পাভেল ভাই রয়েছে।কেন বুজতে চায় না রাহুল ভাইয়া।কেন?

মাথা ঝুকে কাদতে কাদতেই গায়ের দিকে চোখ পড়লো আর্শির।মুহুর্তে’ই চমকে উঠে দাড়ালো।সে তো এই পোশাক পরে আসেনি।তাহলে?তাহলে তার জামা কে বদলে দিলো?রাহুল ভাইয়া না তো।

নানা উনি তো এমন নয়।একটুও এমন নয়।তাহলে কে করলো আমার পোশাক চেঞ্জ?আচ্ছা ওনাকে কি জিজ্ঞেস করবো?মুহুর্তে ‘ই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো আর্শি।

.

.

.

.

.

.

★★★★
সকাল সাতটা।প্রেমাকে খাইয়ে তার চুল আচড়ে বেধে দিলো স্পর্শী।তারপর সামনে এসে হাত দুটো ধরে বলল-

প্রেমা,ভাবি একটু পিরোজপুরে যাচ্ছি।রাতের মধ্যেই চলে আসবো,ওকে।একদম ভয় পাবে না।নার্স রা আছে না। চাচ্চু ও তো এখানে আছে।তোমার ভাইয়া’কে তো পুলিশ নিয়ে গেছে।ওখানেই একটু যাবো আর আসবো।ওকে

প্রেমা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।স্পর্শী সস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো।আলতাফ উদ্দিন কে বুঝিয়ে বলে ব্যাস্ত পায়ে হস্পিটাল থেকে বেরিয়ে আসলো। ন’টার মধ্যেই তাকে থানায় পৌছাতে হবে।ঘন্টাখানেক আগেই সুমন তাকে ফোন দিয়ে নিরবের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে।নিরবের কারনে খারাপ না লাগলেও নেতামশাইয়ের কথা ভেবে বেশ ঘাবড়ে আছে স্পর্শী।দুটো খুন কি যথেষ্ট ছিলো না।এখন আরো একটা খুনের দায় পড়বে নেতামশাইয়ের উপর।থানায় পৌছাতে পৌছাতে সাড়ে ন’টা বেজে গেছে স্পর্শীর।সামনেই বড় রাস্তার মধ্যে সুমন সহ বেশ কিছু দলের লোক দাঁড়ানো।গোল হয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছে।

এখন এদের সাথে প্রত্যহ আলাপ-আলোচনায় মেতে থাকতে হবে স্পর্শীর।ভাবতেই কেমন অসস্তি হলো। তারপরেও নিজেকে সং;যত করে জোরপায়ে হেটে গেল তাদের মধ্যে।সুমন তাকে দেখতেই সামনে এগিয়ে এলো।ব্যাস্ত কন্ঠে বললো-

ভাবী,ইনস্পেকটর সাহেব তো দেখা করতে দিচ্ছে না।আমরা বেশ অনেকক্ষণ ধরে তাকে বোঝাচ্ছি।কিন্তু কিছুতেই রাজী হচ্ছে না।

স্পর্শী থমকালো।কিছুক্ষণ ভেবে বললো-

ঠিকাছে।আপনারা ওর দলের লোক তাই হয়তো দেখা করতে আপত্তি জানাচ্ছে।কিন্তু আমি তো ওনার স্ত্রী।নিশ্চয়ই বাড়ির লোকদের বারণ করবে না।আপনারা এখানেই থাকুন আমি আসছি।

বলেই ত্রস্ত পায়ে ভেতরে ঢুকলো।স্পর্শীকে দেখেই এগিয়ে এলো ইনস্পেকটর।কিছুটা বিনয়ী কন্ঠে বললো-

দেখুন ম্যাডাম।এমপি সাহেব বর্তমানে তিন তিনটা খুনের আসামী।আরো দুজন অলরেডি হস্পিটালে এডমিট আছেন।আদোও আমরা জানি না সে দুজন বাচবে কিনা।একজন জনগণের প্রতিনিধির থেকে এমন টা সরকার কখনোই আশা করেন না।উপরমহল থেকে প্রচুর চাপ আসছে আমার উপর।প্লিজ আপনারা আমাকে এভাবে জোর করবেন না।আমার চাকরী নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।ওনাকে আনার পর থেকে থানার সামনে লোকজনের ভিড় লেগেই আছে।রাতের মধ্যেই ওনাকে চালান করা হবে।এর মধ্যে কোনোভাবেই দেখা করা যাবে না,সে যেই হোক।অনুমতি নেই।প্লিজ আসতে পারেন আপনি।

স্পর্শী অনেক অনুরোধ করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসতে হলো।চোখ দুটো টলমল করছে তার।এতো দূর থেকে কত আশা নিয়ে এসেছিলো নেতামশাই কে এক পলক দেখবে বলে।কিন্তু পারলো না।

নিজেকে ধাতস্থ করে পুনরায় চললো শিকদার মঞ্জিলের দিকে।গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেল।সামনেই সোফার উপর পিয়াশা কে বসিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে বিপাশা।আর পিয়াশাও তাকে ধরে কাদছে।খালামনিকে দেখে যেন পুনরায় ভেঙে পড়লো স্পর্শী।সব কষ্ট,ব্যাথা,যন্ত্রনা যেন অশ্রু হয়ে ঝরে পড়লো মা রুপি খালামনির উপর।ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো স্পর্শী।পিয়াশা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো।এই মেয়েটাকে তো এতো বিপদের মধ্যেও কখনো নিজ চোখে কাদতে দেখেনি।

বিপাশা দুহাত দিয়ে স্পর্শীকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলো।এতোক্ষণে হুশ ফিরলো পিয়াশার। দ্রুত বেগে স্পর্শীর সামনে এসে প্রেমার কথা জিজ্ঞেস করলো-

আমার প্রেমা কোথায়?আমার মেয়ে?

–স্পর্শী শান্ত চোখে শাশুড়ীর দিকে তাকালো।ক্লান্ত কন্ঠে বললো-

ও হস্পিটালে আছে।চাচ্চু ও ওখানে আছে। আমাকে থানায় আসতে হয়েছিলো দেখে চলে এসেছি।বিকালেই আবার যাবো।

এতোক্ষণে পরশের কথাও মাথায় এলো পিয়াশার।কান্নারত অবস্থায় বললো-

আমার পরশের সাথে দেখা হয়েছে?

ফুপিয়ে উঠলো স্পর্শী।ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো-

নাহ,ওরা দেখা করতে দিলো না।রাতের মধ্যেই ওনাকে চালান দিবে।কাল -পরশুর মধ্যেই কেস আদালতে উঠবে।

থেমে,

আপনি চিন্তা করবেন না মা।যথেষ্ট চেষ্টা করবো আমি।

কথাগুলো বলেই উপরে নিজের রুমে দ্রুতপায়ে ছুটলো স্পর্শী।গোসল করতে হবে।

.

.

.

.

★★★★
সদ্য মাটি দ্বারা তৈরীকৃত কবর টি আকড়ে ধরে বসে আছে আর্শি।এ যেন তার পাভেল ভাইকেই জড়িয়ে ধরে বসে আছে।চেনা অনুভূতি,পরিচিত গন্ধ যেন সে পাচ্ছে।পাশেই রাহুল দাঁড়িয়ে আছে।আর্শির এই বোবা কান্না তার একদম সহ্য হচ্ছে না।নিজ স্ত্রী তার পুর্ব প্রেমিকের জন্য এতটা আকুল এ যেন সহ্য করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।হিংসারা দলা পাকাচ্ছে মনের ভেতর । প্রায় আধ ঘন্টা ধরে এখানেই বসে আছে তারা।সহ্যহীন হয়ে ধমকে উঠলো রাহুল।

-এতো কান্নাকাটির কি আছে বুঝলাম না।এবারে ওঠো।
ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত,অসহায় টলমলে চোখ দুটো নিয়ে আর্শি রাহুলের দিকে তাকালো। কেমন খারাপ লাগলো তার। নিজেকে সং যত করে রাহুল বললো-

মৃত মানুষের জন্য কাদতে হয় না আর্শি।এতে ওরা কষ্ট পায়।তার থেকে বরং তুমি ওর জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করতে পারো।ও খুশি হয়, এমন কাজ গুলো করতে পারো।এই যেমন তোমার পাভেল পাই তোমাকে বারবার পড়ার জন্য চাপ দিতো।ক-দিন পরেই তোমার এক্সাম।অথচ তুমি পড়া তো দূর এক্সাম ও দিবে না।এতে তো কষ্ট পাচ্ছে ও।তুমি যদি এখন মন দিয়ে পড়াশোনা করে একটা ভালো রেজাল্ট করো।তাহলে তো পাভেল ই খুশি হবে তাই না।

কান্নারত অবস্থায় অস্পষ্ট কন্ঠে আর্শি মাথা উচুনিচু করলো।রাহুল অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে কবরের পাশ থেকে সরিয়ে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো।এ বাড়িতে রাহুলের স্ত্রী হিসেবেই তাকে পরিচয় দিয়েছে।এতো এতো বিপদের মধ্যে ঠিকভাবে কেউ খেয়াল করেনি তাকে।আর করলেও এতটা গুরুত্ব দেয় নি।

চলবে?

#রাজনীতির_রংমহল
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_৩৪

★★★
চেয়ারে বসে টেবিলের উপর রাখা বইয়ে মাথা রেখে ঝিমুচ্ছে আর্শি।মন-মেজাজ কিচ্ছু ভালো নেই।একে তো সারাবছর বইয়ের ধারে-কাছে না যাওয়ার কারনে সম্পুর্ন অচেনা বস্তু এগুলো।তার উপর পড়তে গেলেও পাভেল ভাইকে নিয়ে নানা জল্পনা -কল্পনায় মেতে থাকে।একজন মৃত মানুষকে নিয়ে এমন কল্পনা করা বরাবর’ই অনুচিত। তা জেনেও মন বারবার ভেসে যাচ্ছে অযৌক্তিক কল্পনায়।

এই যেমন পাভেল ভাই বেচে থাকলে তাদের বিয়ে হতো,খুব সুন্দর একটা সংসার হতো,আর্শি সারাক্ষণ দুষ্টুমি করতো তার সাথে, তাদের একটা ছোট্ট বাচ্চা থাকতো।পরক্ষণেই বাস্তবে আসতেই বিষাদে ছেয়ে পড়ে পুরো মুখমন্ডল।আবারো ভাবনায় মশগুল হয় সে।আচ্ছা,যদি এখন হুট করে পাভেল ভাই বেচে উঠতো।তার কাছে এসে চিৎকার করে বলতো “আর্শি আমি তোমার ভালোবাসার জোরেই ফিরে এসেছি।তখন?তখন দেশ-বিদেশের মানুষ ছুটে আসতে আর্শি নামের এই প্রনয় প্রেয়সীকে দেখতে। ইশশ এটা তো কেমন সিনেমাটিক ভাবনা হয়ে গেল।

ভাবনাতে মশগুল থাকতেই হঠাৎ করে খালি পায়ের উপর চিকন বেতের বাড়ি পড়লো।আতকে উঠে লাফ দিয়ে চেয়ারের উপর দাড়ালো আর্শি। পা টা বারকয়েক ঝাড়ি দিয়ে ছলছল চোখে রাহুলের দিকে তাকালো।মুহুর্তেই অশ্রুরা হানা দিলো বড় বড় মায়াবী চোখ দুটোতে।পায়ের উপর টা লাল হয়ে গেছে।রাহুল ধমকে সামনের চেয়ারে বসলো।কন্ঠে কাঠিন্য এনে বললো-

কি ভাবছিলে তুমি?কতটুকু পড়েছো?

আর্শি নাক টেনে অন্য দিকে তাকালো।এটা তো তার জামাই।অথচ ভাব দেখো,যেন একে বেতন দিয়ে হোম টিউটর হিসেবে রেখেছে।তার উপর এতো বড় মেয়ে সে।তার গায়ে কথায় কথায় হাত দেয়।অসভ্য শিক্ষক।এর নাকি ভার্সিটিতে চাকরি হয়েছে।দু-দিন ও টিকবে না এই চাকরী।কান ধরে টেনে গেটের বাইরে বের করে দেবে স্টুডেন্ট রা।থমথমে মুখে বললো-

হয়েছে তো প পড়া।

রাহুল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বই হাতে নিলো।গ্রামারের রুলসের মধ্যে অসংখ্য A+P লেখা।ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।ইচ্ছে করছে আরো দুটো দিতে।নিজেকে ক্ষান্ত করে ত্যাড়া কন্ঠে বললো-

শোনো আর্শি,সকাল সাতটা থেকে এগারোটা,আবার সন্ধ্যা সাতটা থেকে এগারোটা।অন্তত এই আট ঘন্টা পড়ায় মন দাও।বাকি পুরো ষোলো ঘন্টা তোমার মরে যাওয়া প্রেমিককে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করো আমার কিচ্ছু যায় আসে না।এতো বড় মেয়ে অথচ গ্রামারের গ ও পারো না।কে পাস করাইছিলো এসএস সি তে।মাথায় ঢুকিয়ে নিয়ো,যদি কোনো রকমে এইচএসসি তে ফেল করো বা করার আশাও থাকে।তাহলে তোমায় পিরোজপুরো ছুড়ে মারতে আমার দু মিনিট ও লাগবে না।সেখানে যাওয়ার পর আরো তো দুইটা ভাই আছে বেচে।এবারে ওরা ধরে বিয়ে দিয়ে দিবে।

যদি এখানে শান্তিমতো স্বাধীন ভাবে থাকতে চাও তাহলে লেখাপড়ায় মন দাও।নইলে দরজা খোলা আছে সোজা চলে যাও।আমি চাই না পাড়ার কেউ বলুক রাহুলের বউ ফেল করছে। মাথায় রেখো।

এগুলো দশ মিনিটের মধ্যে মাথায় ঢুকিয়ে নাও।নইলে ওই মাথা আবার ফাটাবো।

বলেই হনহন করে বাইরে বেরিয়ে গেল রাহুল।আর আর্শি।সেতো টলমল করা চোখ নিয়ে রাহুলের দিকে তাকিয়ে রইলো।

কি করে এতোগুলো কথা তাকে শোনালো সে?থাকবে না সে এই বাড়িতে।চলে যাবে।

মুহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল আর্শির।নাহ,মরে গেলেও ওই বাড়িতে সে আর হুশ থাকতে পা রাখবে না।প্রয়োজনে এখানে সবার কটু কথা শুনে তার পর বসে থাকবে।না না,সে মন দিয়ে পড়বে।এই বুড়ো ব্যাটাকে ভালো রেজাল্ট করে তারপর দেখিয়ে দেবে।হুহ।

.

.

.

.

.

★★★★★★
দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ঢুকরে কেদে উঠলো স্পর্শী। হাতের ঘড়িতে চেয়ে দেখলো ১০:৪৭ বাজে।চোখের কোন মুছে সামনের দিকে তাকালো।লম্বা জ্যাম।তাহলে কি সে পারবে না নেতামশাইয়ের সাথে দেখা করতে?ওদিকে কি হলো কিচ্ছু জানে না সে।টানা আধ ঘন্টা ধরে সে জ্যামে আটকে রয়েছে।

এরইমধ্যে জ্যাম ছেড়ে দিলো।দ্রুত গাড়ি চলতে লাগলো জেলা জজ আদালতের উদ্দেশ্যে।গাড়ি থামতেই দ্রুত ভেতরে ছুটলো স্পর্শী।অজস্র উকিল,পুলিশ, আসামীদের আনাগোনা।সে তো কিছুই চেনে না।এতটা লম্বা ভবনগুলোর মধ্যে কিভাবে খুজে পাবে সে।একজন পুলিশের কাছে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো কাঙ্ক্ষিত ভবন টি।দ্রুত সেদিকে ছুটলো।আদালতে জাস্ট দশটায় কেসটা ওঠার কথা।বরিশাল থেকে আসতে আসতে যে এতটা দেরী হয়ে যাবে সেটা ক্ষুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি স্পর্শী।কে জানতো আজকে রাস্তায় এতটা জ্যাম হবে।

হঠাৎ আলতাফ শিকদার,মহীউদ্দীন শিকদার, সুমন সহ দলের অন্যান্যদের ম্লান মুখে বের হতে দেখেই পিলে চমকে উঠলো স্পর্শীর।ছুটে তাদের সামনে যেতেই সুমন ম্লান মুখে বললো-

ভাবি , আসতে এতো দেরী হলো কেন?

নিজেকে সংযত করে থমথমে কন্ঠে বললো-

জ্যাম ছিলো রাস্তায়।ওদিক টায় কি হলো?

বিতৃষ্ণায় উকিলের দিকে তাকালো সুমন।উকিল রাগত স্বরে বললো-

আমি না থাকলে ফাসি না হয় জেল হয়ে যেত।আসামীর খুনের ভিডিও ফুটেজ সহ অসংখ্য লোকের সাক্ষী আছে।তার উপরে এমপি সাহেব নিজে দোষ স্বীকার করছে।এখানে আমার আর কি করার ছিলো।তাও তো অনেক টেকনিক খাটানোর পর বাইশ বছর সাজা দিলো জজ সাহেব।

থমকে গেল স্পর্শী।অস্পষ্ট কন্ঠে মুখ দিয়ে আওড়ালো –

বাইশ বছর।

পরক্ষণেই উত্তেজিত কন্ঠে বললো-

নেতামশাই কোথায়?আমি ওনার সাথে দেখা করবো।

উকিল সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললো-

একটু পরেই পুলিশ নিয়া আসবে ওনাকে।এখান থেকে হাজতে নিয়ে যাবে।

আচমকা দূর থেকে চারজন পুলিশের মাঝখানে হ্যান্ডকাফ বাধা পরশ কে দেখেই ছুটলো সেদিকে। মাত্র তিনদিনের মধ্যে একদম শুকিয়ে ম্লান হয়ে গেছে মুখটা।গায়ে আসামীদের সাদা কালো ডোরাকাটা পোশাক। পুলিশের সামনে যেতেই স্পর্শী গম্ভীর কন্ঠে বললো-

আমি ওনার স্ত্রী।মাত্র পাচ মিনিট কথা বলবো। প্লিজ।

ইনস্পেকটর মাথা নাড়িয়ে একটু সাইডে গেলেন।তবে ওনাদের কঠোর দৃষ্টি আসামীর দিকে।যতই সম্মানীয় হোক না কেন সে,যদি পালিয়ে যায়।

পরশ স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো।মনে মনে এই মুখ টা দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো তার। আদালতে ঢুকতেই সমস্ত পাবলিকের মধ্যে চোখ জোড়া চাতক পাখির ন্যায় এই তোতা পাখি টাকে খুজছিলো।কিন্তু আফসোস!পায় নি।

–কেন করলেন এমন নেতামশাই?কি দরকার ছিলো ওদের এভাবে খুন করার?পুলিশের কাছে বলতেন।ওরা সাজা দিতো।

মুহুর্তেই হাস্যজ্জ্বল মুখটিতে বিষাদ ছেয়ে গেল।চোয়াল শক্ত করে স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলল-

রক্তে টান লাগছে?আমার’ও লেগেছিলো।

থেমে করুন কন্ঠে,

এতোটা স্বার্থপর হো’স না বউ।সইতে পারবো না।

স্পর্শী থমকালো।সে কি সত্যিই স্বার্থপর।পরক্ষণেই ছলছল চোখে পরশের দিকে তাকিয়ে বললো-

আপনি বুজতে পারছেন না নেতামশাই।পাভেল নেই,আম্মু-আব্বু ভীষণ ভেঙে পড়েছে,প্রেমা অসুস্থ, আপনিও নেই।কি ভাবে বাচবে এই পরিবার টা।
আর আমি?আমি আপনাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবো এতটা বছর।এক নয়,দুই নয় পুরো বাইশ টা বছর।

চোয়াল শক্ত করে ফেললো পরশ।দুহাত দিয়ে স্পর্শীর গাল আকড়ে ধরে কঠিন কন্ঠে বললো-

শুধু বাইশ বছর কেন পাখি?প্রয়োজনে আজীবন অপেক্ষা করবে আমার জন্য।যদি কখনো শুনেছি ও না আমার অনুপস্থিতিতে অন্যকারো কারো সাথে জড়িয়েছো।খোদার কসম,আমার হাতের চতুর্থ খুন টা তুমি হবে।

বাক হারা হয়ে গেল স্পর্শী । নেতামশাই কি তাকে অবিশ্বাস করছে?মুহুর্তেই ভালোলাগায় ছেয়ে গেল হৃদয়।সে তো চেয়েইছিলো কেউ একজন এতটা কঠোর ভাবে তার উপর অধিকার ফলাক।তাকে শাসন করুক। লোকজন,পুলিশ সবাইকে অগ্রাহ্য করে পরশের বুকের উপর হামলে পড়লো স্পর্শী।কান্নারত কন্ঠে বলতে লাগলো-

আপনি একদম কোনো চিন্তা করবেন না নেতামশাই।আমি আছি তো।কিচ্ছু হবে না আপনার।প্রয়োজনে আমি হাইকোর্টে আপিল করবো।তাও আপনাকে এতো কষ্ট পেতে দেব না।আর বাড়ি?বাড়ির সবাই কে নিয়ে একদম কোনো চিন্তা করবেন না।প্রেমা এখন অনেকটা সুস্থ।আমি আছি তো।সব সামলে নেব।

এরইমধ্যে ইনস্পেকটর তাড়া দিয়ে নিয়ে গেল পরশ কে।হেচকি তুলে সে দিকে তাকিয়ে রইলো স্পর্শী।আচমকা বসে পড়লো সেখানেই।শরীর যে আর মানছে না।এতটা মানসিক চাপ,যন্ত্রনা,এতটা পথ জার্নি করে আসা -যাওয়া,শরীর টা যে আর মানছে না।

এরই মধ্যে হাতের ফোন টা বেজে উঠলো।অনন্দা ফোন দিয়েছি।রিসিভড করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে তড়িঘড়ি করে বললো-

স্পর্শী,তুই কি আর ভার্সিটি তে আসবি না।এদিকে এক্সামের নোটিশ দিয়ে দিয়েছে।তুই প্রায় তেরো দিন ধরে ক্লাস করিস না।এতটা অনিয়মিত হলে তোর উপর তো চাপ পড়বে।

দেয়ালে মাথা হেলিয়ে দিলো স্পর্শী।অস্পষ্ট কন্ঠে ওকেও বললো-

আমি সামলে নেব অনু।আমি সব টা সামলে নেব।

বলেই ফোন কেটে দিলো।

চলবে?