রিটেক পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব

0
190

#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৩১

রূপার ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দাটি মাঝারি ধরণের। গত ছয় মাসের নীরব ঝড়ে এই জায়গাটুকু ছিলো তার মন খারাপের সঙ্গী।আহামরি ভাব এতে নেই। কিন্তু কিছু কারসাজি জায়গাটির পুরো রূপ পাল্টে দিয়েছে। রূপা শখ করে একদিন বাগান বিলাসের একটি গাছ এনেছিলো। তমার সাহায্যে ছোট্ট একটি টবে লাগিয়ে সেটি ঝুলিয়ে দিয়েছিলো বিরান বারান্দার এক কোণে। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় সবটুকু নীরবে সয়ে গেছে সেই চারাটি। একসময় ফুল দিয়েছে। তিনটি গোলাপী পাতার মাঝে একটু সাদার ছোঁয়া। কি যে সুন্দর লাগে রূপার কাছে! আস্তে ধীরে পুরো গ্রীল ছেয়ে গেছে গোলাপী রঙে। রূপা নির্নিমেষে ফুলগুলো দেখে। ফুলের আড়ালে উঁকি দিয়ে থাকা আকাশটুকু দেখে। কি ভীষণ স্নিগ্ধ লাগে! বাতাসের ঝাপটায় ছোট্ট চারাটি উপড়ে যায় নি। শিকড়টুকু আঁকড়ে ধরে রেখেছে প্রাণপণে। তুমুল বৃষ্টি অথবা কাঠ ফাঁটা রোদ, কোনোটাতেই হার মানেনি শিশু গাছটি। বেড়ে ওঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে থেকে গেছে। একসময় দানব রোদ, ঝড়ো হাওয়া সবটাই হার মেনেছে। যে যার দিক থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে শিশু চারা গাছটির বুকে ফুল ফুটিয়েছে।
ভাবতে ভাবতে চমকে ওঠে রূপা। চারপাশের পরিবেশ বেঁচে থাকার অনুকূল নয়। সবাই তাকে ছি ছি করছে। দেখলেই গা বাঁচিয়ে চলছে। যেনো সে অশুচি। সে কি চারা গাছটির মতো দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে পারে না? কিছুদিনের জন্য নাহয় কান দুটো বন্ধ রাখলো। বিদ্যুৎ চমকের মত যে কথাগুলো তার হৃদয়কে ঝাঁঝরা করে দেয় সেগুলো নাহয় না শোনার ভান করলো। সে কি পারবে না? হয়তো এক সময় এই কথাগুলো, এই মানুষগুলোই হবে তার বিরান মরুভূমিতে ফুল ফোটানোর নিয়ামক। রূপা মনে জোর পায়। কোমল-কঠিন এক জোর।

ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। রূপা ভেবেছিলো আজ হয়তো ফাহাদরা আসবে না। কিন্তু তার অনুমানকে মিথ্যে করে দিয়ে সকলেই এলো। বাড়িতে ঢোকার মুহূর্তে রাসেলের একটি জরুরী ফোন কল আসে। তৎক্ষণাৎ তাকে বিদায় নিতে হয়। তবু রিমনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে ভোলে না। ফাহাদের আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে নেয় রিমন। ফাহাদ সেই ধারালো দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি বোধ করলো।

রূপাকে সামনে আনা হয়। আনোয়ারা বেগম, কামরুন্নাহার দুজনেই খুশি। তবে ফাহাদের কাছে মনে হলো রূপা আজ বড় বেশি নির্জীব। একসময় তাদের দুজনকে কথা বলতে দেয় হয়। তাদের সাক্ষী হয় থোকা থোকা বাগান বিলাস।

রূপার মনে আলাদা কোনো উত্তেজনা নেই। সে জানে তার কথাগুলো শোনার পর ফাহাদ পিছু হটবে। খুবই স্বাভাবিক। তাই হাওয়ায় ঘর বানানোর স্বপ্ন সে আর দেখে না।

– কেমন আছেন রূপা?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
– কিন্তু আপনাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে।
রূপা কেমন করে হাসলো! ফাহাদের কাছে হাসিটি বড় করুণ দেখালো। ঠিক যেনো স্বপ্ন ভাঙ্গা হাসি।
– আপনি কেমন আছেন?
রূপার প্রশ্নে ফাহাদের ধ্যান ভাঙ্গে।
– আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছেন।
– আপনাকে কিছু বলার আছে। আশা করি শুনবেন।
– অবশ্যই।
ঢোক গিললো রূপা। বার দুই পলক ফেলে আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। তার জীবন নামক ডায়েরির নষ্ট পাতাগুলো কারো সামনে মেলে ধরতে হচ্ছে। মানুষটি কি বুঝতে পারছে রূপা যে নিদারুণ লজ্জায় ভুগছে!

অনেক কথা গুছিয়ে রেখেছিলো রূপা। নিজের অজান্তেই নিজের পক্ষে কিছু সাফাইও ছিল সেখানে। কিন্তু বলতে যেয়ে দেখলো শব্দ ভান্ডার শূন্য। আতিপাতি করে খুঁজেও একটু কথার দেখা মিলল না।
– রূপা?
– হুঁ!
ফাহাদের দিকে তাকালো রূপা। পলকেই চোখ নামিয়ে নিলো। শুকনো খরখরে গলায় বলল,
– আমার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল।
হঠাৎ এক নিস্তব্ধতা নেমে এলো ধেয়ে আসা কালো মেঘের মতো। চারদিকে শুনশান নীরবতা। বৃষ্টির গতি কমেছে। মাঝে মাঝে দুই একটা মোটরসাইকেল সাই করে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। চড়ুইগুলো পাতার ফাঁকফোকর থেকে বের হয়ে গা ঝাড়া দিচ্ছে। পানিগুলো ছিটকে চলে যাচ্ছে। আহা! রূপা যদি এমন করে, ঠিক এমনই করে নিজের ভেতরের সকল পঙ্কিলতা ঝেড়ে ফেলতে পারতো!
– কই কেউ তো বলল না?
যেনো খুব খুঁজে তারপর এই প্রশ্নটা পেলো ফাহাদ।
– কেউ জানে না।
– কেউ না?
ফাহাদের দিকে তাকালো রূপা। তার চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে।
– আমার পরিবারের কেউ জানে না। শুধু দুই একজন বান্ধবী জানে।
– আপনি বলছেন হয়েছিল। বিয়েটা কি বলবৎ নেই?
– না। আরো ভালো কাউকে পেয়ে সে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে।
মুহূর্তে ফাহাদের মুখটা শক্ত হয়ে গেলো। নিজেকে সামলে নিলো ফাহাদ। এই অনুভূতি প্রকাশের সঠিক সময় এটা নয়।
– আচ্ছা। তো আপনি কি আমাকে একটা চান্স দেয়ার কথা ভাবছেন?
রূপা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। এবার কিছুটা সিরিয়াস দেখালো ফাহাদকে। সে বলল,
– দেখুন রূপা মানুষ মাত্রই ভুল করে। এতে ভুলকে জাস্টিফাই করা হয় না, মানুষের ন্যাচারটা বোঝানো হয়। জীবনে কমবেশি আমরা সবাইই ভুল করেছি। কিন্তু সেই ভুল থেকে কতোটা শিখেছি সেটাই আসল প্রশ্ন। কিছু ভুল আমাদের পো-ড়া-তে আসে। একদম খাঁটি সোনায় পরিণত করে। কিন্তু অনেকেই পোড়ার কষ্টটুকু সহ্য করতে পারে না। হয় আরো বিপথে যায় নয়তো আত্মাহুতি দেয়। আপনি কতটুকু নিজের ভুলের ব্যাপারে অনুতপ্ত। অনুশোচনা আপনাকে কতোটা পরিবর্তন করেছে আমি শুধু সেটুকুই জানতে চাই।
– এটা আমি কিভাবে জানাবো?
– আপনি শুধু কবুল বলবেন। বাকিটুকু বুঝে নেয়ার দায়িত্ব আমার।
– এই বিষয়টা যদি কখনও সামনে আসে? আপনার পরিবার নিশ্চয়ই আমাকে মেনে নেবে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফাহাদ। বলল,
– আমি আমার আপার সাথে বিষয়টা শেয়ার করেছি। প্রথমটায় ও বেশ আপসেট হয়ে গিয়েছিল। কারণ আপনার থেকে এমন বোকামি আশা করেনি। কিন্তু পরবর্তীতে ও নিজেই এগিয়ে এসেছে। আপার স্কুল জীবনের এক বান্ধবী এরকম একটা ঘটনার ফলে সু-ই-সা-ই-ড করেছিল। জিনিসটা ওর ভেতরে গভীর ছাপ ফেলেছে। আপার তাড়াহুড়া দেখে মনে হচ্ছে ওর সেই বান্ধবীর সাথেই আমার বিয়ে হচ্ছে। যাকে হারিয়ে আপা একদম মুষড়ে পড়েছিল।
– আপনি এই বিষয়ে জানতেন?
রূপার গলায় বিস্ময়। ফাহাদ হাসলো। সেই হাসিতে রহস্য দেখলো রূপা। মনে হলো ফাহাদ জানে। সবটা। হয়তো কিছু বেশি। ফাহাদ বলল,
– জীবন সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না রূপা। আপনি আমি দুজনেই সেটা পেয়েছি। আপনি পেয়েছেন নিজের ভুল শুধরে নেয়ার সুযোগ আর আমি পেয়েছি নতুন করে সংসার সাজানোর। এই সুযোগ হেলায় হারানো উচিৎ হবে? আমরা দুজনেই রিটেক পরীক্ষার স্টুডেন্ট। মরণ কামড় দিয়ে হলেও আমাদের পাশ মার্ক আনতে হবে।
রূপা শব্দ করে কেঁদে উঠলো। তার কবুলকৃত দুয়াগুলো এভাবে সামনে আসবে সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। হতাশ কণ্ঠে ফাহাদ বলল,
– হয় কান্না মুছে দেয়ার অধিকার দিন নয়তো বিদায় দিন চলে যাই। এভাবে আপনার কান্নাকাটি দেখতে পারছি না।

কক্ষটি ফুলে ফুলে সজ্জিত হলেও সেখানে বধূর চিহ্নটি নেই। ফারিস ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে কাঁদছে। তার কান্নার কারণ উদঘাটনে ব্যস্ত তিন মানবী। সেখানে আছে বধূ নিজেও। নিজের ঘরের অন্যরূপ ফাহাদকে ভাবুক করে তুলল। ঠিক এরকমই একটা সময় সে কাঁটিয়েছে দীপ্তির সাথে। মেয়েটির সাথে জীবন যাত্রা শুরু করলেও গন্তব্যে পৌঁছার আগেই সে ছুটি নিলো। ফাহাদ দুয়া করে। অন্তঃস্থল থেকে। দীপ্তি ভালো থাকুক। মহামহিমের ক্ষমাটুকু লাভ করুক।
ব্যক্তিগত ডায়েরিটি বের করছিল ফাহাদ। কিন্তু এক টুকরো কাগজ তার মনোযোগ কেড়ে নিলো। পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা রাখা কাগজের টুকরোটুকু খুব যত্ন করে কেউ রেখেছে। হাতে নিয়ে ভাঁজ খুললো ফাহাদ। পড়তে শুরু করলো নিঃশব্দে।

“আপনি আমার লেবাস, আমার পোশাক। একদম আল্লাহর কাছ থেকে নির্ধারিত। পরম করুণাময় খুব যত্ন করে এই উপহারটা আমাকে দিয়েছেন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো সেই উপহারের মর্যাদা রক্ষা করতে।

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে, অনেক বড় একটা ভুল করেছি। ঘা সেরে গেলেও দাগটা থেকেই গেছে। সেই দাগসহ আপনি আমাকে গ্রহণ করেছেন। এর বিনিময়ে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করা সাজে না। বিনিময়টুকু আল্লাহ আপনাকে দিবেন। গ্রহণ যখন করেছেন আরেকটু সাহায্য করুন। আমার উপরে একটু বিশ্বাস রাখবেন। একটু ভরসা আমি আপনার থেকে চাই। এর বেশি কিছু না। সত্যিই না।”

ফাহাদের মনে হলো মেয়েটি চিঠি লিখতে চেয়েছিল। শব্দ স্বল্পতায় সেটি চিরকুট হয়ে গেছে। নিচে ইতি টেনে কিছু লিখেছিল। সেটুকুও এমনভাবে কাটাকুটি করেছে যে কিছুই বোঝার উপায় নেই। ডায়েরিটি রেখে দিলো ফাহাদ। আজ থেকে সম্ভবত তাকে আর লিখতে হবে না।

পরিশিষ্ট: পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবর অনেক বেশি জায়গা দখল করে লেখা হয়েছে। ফাহাদ দেখলো অঙ্গ পাচারকারী হিসেবে একজন ডাক্তারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মানুষটিকে চিনতে পারলেও চমকালো না সে। প্রকৃতির স্রষ্টা প্রকৃতিকে একটি ভারসাম্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সেখানে কখনও উনিশ বিশ হয় না। হিমেল আজ কারাগারে। তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়েছে। পরিবারে নিত্য অশান্তির কারণ হিমেল আশরাফ দুইবার আ-ত্ম-হ-ত্যা করার চেষ্টা করেছে। সফল হয়নি। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে চাকরি হারিয়েছে। তারপর জীবিকা অন্বেষণের জন্য বেছে নিয়েছে এই অঙ্গ পাচারের কারবার। ফাহাদ সেদিকে আর আগ্রহ দেখালো না। তার সকল আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হয়েছে এক মানবীর মাঝেই। টুং করে একটা মেসেজ এলো। ফোন হাতে নিতেই ফাহাদের মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেলো।

“আজকে দেরি করে আসলে আমি দরজা খুলবো না। খুলবো না মানে খুলবোই না। দাদাকেও বলে দিয়েছি। কেউ দরজা খুলবে না। যার বাইরে এত ভালো লাগে সে সারারাত বাইরেই থাকুক। আর কেউ জেনে রাখুক। তাড়াতাড়ি এলে তার জন্য স্পেশাল সারপ্রাইজ আছে।”

ফাহাদ হাসলো। অনুশোচনার অনলে পুড়ে যাওয়া এক সোনার খনি পেয়েছে সে। ড্রয়ার থেকে রূপার রিপোর্ট বের করলো ফাহাদ। পজেটিভ লেখা জায়গাটুকু সে হাইলাইটার দিয়ে দাগিয়ে রেখেছে। গোপন কথাটি রূপা আজও তাকে আগে জানাতে পারলো না।

সমাপ্ত।