রিটেক পর্ব-৪+৫

0
178

#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪ (প্রথমাংশ)

– কে বলবে? আমিই বলছি। তুমি যাবে না?
– না।

যারপরনাই অবাক হলো ফাহাদ। অবাক হওয়ার সীমা পরিমাপের কোনো যন্ত্র থাকলে সেটা মাপা যেতো। আচ্ছা তার একক কি হতো? গ্রাম নাকি কেজি?

– কেনো যাবে না? এটা আমাদের হানিমুন ট্রিপ।

শান্ত চোখে তাকিয়ে দীপ্তি বললো,

– এটা কি তুমি প্ল্যান করেছো?
– সরাসরি আমি না। নীরব গিফট করেছে।
– আমি যাবো না।
– আশ্চর্য! কেনো?
– আমার ঘুরতে ভালো লাগে না।
– আমার সাথেও না?
– না কারো সাথেই না।

ওয়াশরুমে ঢুকে দরোজা আটকে দিলো দীপ্তি। আহত অনুভূতি জমা করে বিছানায় বসলো ফাহাদ। তার উত্তেজনার রঙিন পাহাড় ছাই রঙ্গা হয়ে ধুলোয় উড়ছে। দীপ্তিকে দেখা গেলো রেডি হয়ে বের হতে। চোখ উঠিয়ে দেয়া খেয়াল করলো ফাহাদ।

– কোথায় যাচ্ছো তুমি?
– এক ফ্রেন্ড দাওয়াত দিয়েছিলো। ওর ওখানে।
– একা?
– না। আরো কিছু ফ্রেন্ড ওদের হাজবেন্ড নিয়ে যাবে। আচ্ছা থাকো তুমি। আমি বের হলাম।
– দাঁড়াও। এটা পড়ে যাবে তুমি?
– কেনো কি সমস্যা এই জামায়?
– কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এটা বাইরে পড়ার মতো না। অন্য কিছু পড়।
– আমি বুঝলাম না ফাহাদ যেখানে আমার সমস্যা হচ্ছে না সেখানে তুমি কেনো এই বিষয়ে নাক গলাচ্ছো?
– দীপ্তি জামাটা শরীরের সাথে অনেক বেশি এটে আছে। ভালো দেখাচ্ছে না। বোঝার চেষ্টা করো।
– আমি বুজতে চাচ্ছি না ফাহাদ। শেষমেষ তুমি যে এসব ব্যাপারে খবরদারি করবে এটা আমি এক্সপেক্ট করিনি। যাইহোক তুমি খবরদারি করলেও আমি শুনছি না। আমি এটা পড়েই যাচ্ছি। বাই!

দীপ্তির প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইলো ফাহাদ। তার ফ্রেন্ডরা হাজবেন্ডের সাথে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই সেখানে ফাহাদেরও দাওয়াত ছিলো। দীপ্তি কি তাকে মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করে? নিজেকে নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করলো ফাহাদ। সে কি এতটাই ফেলনা? তার কথার কি কোনো মূল্যই নেই দীপ্তির কাছে? ভাঁজ করা টিকিট দুটোর দিকে সে চেয়ে রইলো। নিষ্পলক।

•• •• ••

ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিলো রূপা। স্ক্রিনে আসমার ছোট্ট একটা মেসেজ ভাসছে। হাসি ফুটে উঠল রূপার ঠোঁটে।

“নামাজ পড়ে নিস রূপা।”

আড়মোড়া ভেঙে উঠলো রূপা। বেলকনিতে গিয়ে কিছুক্ষণ ভোরের নির্মল সুন্দর রূপ উপভোগ করলো। হুট করে তার মনে হলো তার ছেলে হলে নাম রাখবে রূপ। কেমন হবে? রূপার ছেলে রূপ। আচ্ছা হিমেল কি মানবে? হিমেলের কথা মনে হতেই সূর্যের ভোর সকালের লালিমা তার মুখে দেখা গেলো। লজ্জালু হাসিতে তাকে স্মরণ করে ফোন হাতে নিলো।

– হ্যালো!

হিমেলের ঘুম জড়ানো স্বর শোনা গেলো।

– গুড মর্নিং!
– মর্নিং! কি ব্যাপার! আজ এতো সকালেই যে মহারানী আমাকে স্মরণ করেছেন।
– তোমার সাথে ভোর হওয়া দেখতে মন চাইছে।
– ভোর হবে এটা আবার দেখার কি আছে? তার চেয়ে আর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও।
– তোমার যতো বেরসিক কথা! ভোর হওয়া দেখতে কি দারুন লাগে তুমি জানো? আমার কতদিনের ইচ্ছে এমন সময় একদিন তুমি আর আমি হাত ধরে হাঁটবো। চারপাশে গাছগাছালি থাকবে। একটা সুন্দর খাল বা বিলের পাশে হাটবো। মৃদুমন্দ বাতাসে তুমি আর আমি। দারুন লাগবে না!

হিমেলের আওয়াজ পাওয়া গেলো না। রূপা আবার ডাকলো।

– হিমেল?

হিমেল ঘুমিয়ে গেছে বুঝতে পেরে এক অদ্ভুত ব্যথা গ্রাস করলো তাকে। যতবারই নিজের শখগুলো হিমেলের কাছে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে ততবারই তার নীরব প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। কখনও উচ্ছ্বসিত হয়ে উৎসাহ দেখায়নি। আস্তে করে ফোন কেঁটে আকাশের দিকে তাকালো রূপাম ততক্ষণে সূর্য সমহিমায় নিজ অস্তিত্ত্বের জানান দিয়েছে। দুঃখবিলাস করতে করতে রূপা ঠিকই পেলো না ফজরের সময় ছুটে গেছে। ঐ নিখুঁত আকাশের সৃষ্টিকর্তা যে তাকে এক নির্জন সাক্ষাতে ডেকেছিলেন সেটা সে বেমালুম ভুলে গেলো।

চলমান।

#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৪ (শেষাংশ)

তমা নতুন বউ। কিন্তু এই বাড়িতে এসে প্রচলিত নিয়মের যাঁতাকলে তাকে পিষ্ট হতে দেননি কামরুন্নাহার। সাথে সাথেই তার উপর সংসারের গুরুভার চাপিয়ে দেন নি। সাথে নিয়ে কাজ করেছেন। সময়ের চাহিদা বুঝে ছেড়ে দিয়েছেন। তার অভিজ্ঞতা বলে এখন সময়টা তাদের বন্ধন দৃঢ় করার। যার সুতো ধরে সংসারের জাল বোনা সেই সেলাই শক্ত না হলে তো সবই বৃথা। তাই তিনি ছেলে রিমনের সাথে তমাকে সময় কাটানোর সুযোগ করে দেন। মেয়েকেও কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। সকালে বিকালে ঘরের কাজে যেনো সে উপস্থিত থাকে। ভাবির আশায় যেনো হাত পা গুটিয়ে কোনোদিনই বসে না থেকে। রূপা সবই মেনে নিয়েছে। ছোটো থেকেই তাকে ঘরের টুকটাক কাজ শিখিয়েছেন কামরুন্নাহার। বড়ো হয়ে বাকিটা নিজ আগ্রহেই শিখেছে রূপা। সে বোঝে মায়ের নির্দেশের সারমর্ম। তাতে ওর সায় আছে শতভাগ। সেই নির্দেশের তৎপরতায় রান্নাঘরের দিকে ছুট দেয়। অন্যদিন রান্না করলেও কাজে কিছুটা আলস্য মেশানো থাকতো। আটটার কাজ সাড়ে আটটা বাজতো। কিন্তু ভাইয়ের বউ আসার পর সেটা সাড়ে সাতটায় চলে গেছে। তার প্রাণপণ চেষ্টা মায়ের আদেশের একটুও যেনো এদিক ওদিক না হয় এবং ভাবি মানুষটা যেনো দাম্পত্য জীবনের প্রথম প্রহরগুলো নির্ভার হয়ে কাটাতে পারে।

আলু ভাজি নামিয়ে রেখে বেলে রাখা পরোটাগুলো সেঁকতে শুরু করলো সে। আরেক ফ্রাই প্যানে চটপট তিনটে ডিম ভেজে ফেললো। নিজের জন্য একটা সেদ্ধ করে নিলো। সেসময় তমা এলো রান্নাঘরে।

– আরে! তুমি দেখি সব করে ফেলেছো!
– তুমি আবার আসতে গেলে কেনো? এইতো প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
তমার বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল রূপা।
– আমি তো এলাম কিছু রান্না করতে। কিন্তু তুমি যে সব করে রাখবে তাতো ভাবতেই পারিনি।
– এখন তোমাকে এসব ভাবতে হবে না ভাবি। এসব ভাবার দিন পড়ে আছে। তখন ভাবনার আগে কাজ করতে হবে। এখন কয়েকটা দিন তুমি শুধু বলবে আর আমরা করবো। ঠিকাছে?
তমার অবাক হওয়া দেখে মজা পেলো রূপা। কাউকে চমকে দিতে, অপ্রত্যাশিত কাজ করে ভরকে দিতে তার ভীষণ ভালো লাগে।
– মা কিছু মনে করবেন না?
– আরে মায়েরই তো আদেশ! এখন যেনো তোমাকে কোনো কাজে চাপ না দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে এসবই তোমার হয়ে যাবে। এখন আপাতত তুমি একটু ভাইয়ার সাথে সময় কাঁটাও।
চোখ টিপে বলল রূপা। তমা ঝাপসা হেসে বিদায় নিলো। যাওয়ার আগে আরো একবার পেছন ফিরে পরোটা সাজাতে থাকা রূপাকে দেখে নিলো।

কিছুক্ষণের মাঝেই রিমনের আওয়াজ পাওয়া গেলো।
– মা! মা!
রুম থেকে বেরিয়ে এলেন কামরুন্নাহার। রিমন তখন খেতে ব্যস্ত। খাবার মুখে নিয়েই বললো,
– বসো।
বিরক্ত হলেন কামরুন্নাহার। ছেলেকে ধমকে বললেন,
– কতদিন বলেছি খাবার মুখে নিয়ে কথা বলবি না! আমার একটা কথা যদি মনে থাকে।
মুখ ঘুরিয়ে তমাকে দেখে হেসে বললেন,
– তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনো মা? তুমিও ওর সাথে খেয়ে নাও। কিছু লাগলে রূপা এনে দেবে। এসো বসো।
অগত্যা তমাকে বসতে হলো। স্ত্রীর সামনে মায়ের কাছে বকা খেয়ে বেশ ইতস্তত বোধ করলো রিমন। সেটা খেয়াল করলো তমা, তবে কিছু বললো না। গলা খাঁকারি দিয়ে রিমন বললো,
– মা! তমার ফুপাতো ভাইয়ের কথা ও বলেছে না?
– হ্যাঁ বলেছে তো।
সচেতন হলেন কামরুন্নাহার। রূপা যে রাজি হয়নি সেটা সতর্ক ভাবে বলতে হবে। কোনোভাবেই যেনো তমা কষ্ট না পায়।
– তুমি রূপাকে বলেছিলে? এই রূপা! এদিকে আয়।
বিরক্ত হলেন কামরুন্নাহার। তার ছেলের এই একটা সমস্যা। কোনো কথার শেষ নামায় না। মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করেছিস একটু অপেক্ষা কর! না উত্তর দেওয়ার আগেই তার আরেকটা কথা বলা শেষ। ততক্ষণে রূপা এসে দাঁড়িয়েছে নিজের প্লেট হাতে সেখানে রাখা সেদ্ধ ডিম চোখে পড়লো তমার।
– বলো। এমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছো কেনো?
– ঠিক করে কথা বল অসভ্য মেয়ে!
বারবার স্ত্রীর সামনে এরূপ কথায় রিমনের রাগ হলো। ভেংচি কাটলো রূপা।
– মা তোকে একটা পাত্রর কথা বলেছে না?
সাথে সাথে না বলে উঠতে চাইলো রূপা। কিন্তু কামরুন্নাহারের চোখের ইশারায় তাকে থেমে যেতে হলো। ধীরে মাথা নাড়িয়ে বললো,
– হ্যাঁ।
– কেমন লাগলো?
এবার কামরুন্নাহার কথা বললেন,
– আমাদের তমার ভাই, খারাপ লাগবে কেনো? কথা সেটা না। কথা হলো তোর বোন এখন বিয়ে করতে চাচ্ছে না। নাহলে তো আমার বেশ লেগেছিলো ছেলের কথা শুনে।
মিথ্যে নয়। প্রকৃতই ছেলের বর্ণনা শুনে খুশি হয়েছিলেন কামরুন্নাহার।
– কেনো কবে বিয়ে করবি? চাকরি পেলে?
– না সেরকম না। আর দুই বছর পর।
– একজ্যাক্ট দুই বছরই কেনো?
– ইয়ে..মানসিক প্রস্তুতির একটা বিষয় আছে না?
– সেজন্য দুই বছর লাগবে?
মাথা নিচু করে খেতে থাকলো রূপা। কোনো উত্তর করলো না। রিমন আর কথা বাড়ালো না। তমার ভাইটার কথা শুনে তার ভালো লেগেছিলো। ছেলে ভালো চাকরি করে, ফ্যমিলি ভালো, আর্থিক অবস্থাও উন্নত। কিন্তু বোনের ইচ্ছা না থাকলে আর কোনো কথা নেই। তবে বড়ো ভাই হিসেবে একটা উপদেশ দিতে ভুললো না। খাওয়া শেষ করে উঠে বললো,
– সব দিকে খেয়াল রাখতে হবে রূপা। পড়াশোনা করছিস। তুই শিক্ষিত মেয়ে। অতো ভেঙে বোঝাতে হবে না নিশ্চয়ই? আই গেস তুই সময়ের কাজ সময়ে করতে জানিস।
কথাগুলো কানে ঢুকলেও রা করলো না রূপা। কামরুন্নাহার উঠে গেলেন। এখনও তার খাওয়ার সময় হয়নি। খালি টেবিলে তমা তার সূক্ষ্ম দৃষ্টি তাক করলো রূপার অবনত মাথার দিকে। তিন কামড়ে রূপা ডিম সেদ্ধ শেষ করে ফেললো।

চলমান।

#রিটেক
#বিনতে_ফিরোজ
পর্ব:৫

স্বভাবে ফাহাদ শান্ত শিষ্ট। কিছুটা আবেগী। এজন্য তাকে হ্যাপাও কম পোহাতে হয়নি। কলেজ ভার্সিটি পড়াকালীন সময়ে ইমোশনাল ফুল বলে সহপাঠীদের হাস্যরসের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ছোট্ট আঘাত যার কাছে দানব আকৃতি গ্রহণ করে তার কাছে এরূপ আ-ক্র-ম-ণ ছিল বৃহৎ কিছু। হয়তো সে তার দুর্বল হৃদয় নিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে যেতো নিমেষেই। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাকে একটা ঢাল উপহার দিয়েছিলেন। নীরব নীরবেই বন্ধুকে সাহায্য করে গেছে চিরকাল। সংকটময় সেই মুহূর্তে বন্ধুর পাশে দেয়াল হয়ে থেকেছে। যে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়, চিন্তামুক্ত হওয়া যায়। তবে চিন্তা ফাহাদের পিছু ছাড়েনি। দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে ফাহাদকে। এর পূর্বেও চিন্তা ছিলো। কিন্তু সেগুলো ছিলো পরিচিত। নতুন জীবনের নতুন মানুষটার সাথে যেনো সব নতুন চিন্তা এসে ধরা দিলো। হিমশিম খেতে শুরু করলো ফাহাদ। কিছু বন্ধু পরামর্শ দিলো, “ডিভোর্স দিয়ে দে। এমন মেয়ে কতো পাবি!” কিন্তু উল্টো পরামর্শ দিলো নীরব। জীবনকে সে তুলনা করে পরীক্ষা ক্ষেত্রের সাথে। দীপ্তিকে বললো সেই পরীক্ষার নতুন প্রশ্ন। তাকে বাদ দিলে চলবে কেনো? মেনে নেওয়া এবং মানিয়ে নেওয়া যখন জীবনের প্রতিটা স্তরের আবশ্যক শর্ত তখন এটাকেই সম্বল করে চলি না কেনো? একটু মানিয়ে নিয়েই দেখ কতোটা চলা যায়। মেয়েটার ভালো গুণগুলো দেখ, সেটা নিয়ে ভাব। এসবই ছিলো নীরবের কথা। সেগুলোই করার চেষ্টা করেছে ফাহাদ। খারাপ লাগলেও কখনও অসহ্য লাগেনি। তবে সেই অনুভূতিটাও আজ জন্ম নিলো। তার উত্তেজনার তরঙ্গে ছাই ঢেলে যখন দীপ্তি ঘুরতে বের হলো তার কাছে তখন অসহ্যই লেগেছিলো। যখন ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে না নিয়ে যাওয়ার কথাটা বলেছিলো তখন অসহ্যই লেগেছিলো। কষ্ট পেলো ফাহাদ। সে কি দীপ্তির থেকে একটু সম্মানও পেতে পারে না? ছুটিটা অসহ্য লাগলো ফাহাদের কাছে। অফিস খোলা থাকলে সেখানে গেলেও কিছুটা সময় এই কষ্ট ভুলে থাকা যেতো। সন্ধ্যার দিকে দীপ্তি ফিরলো। ফিরেই বললো,

– আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি।
অবাক ফাহাদ কিছুক্ষন কথা বলতে পারলো না।
– এখন কেনো? কাল যেও।
– না আমার ভালো লাগছে না। আমি এখনই যাবো।
– তুমি কি আমার অনুমতি নিয়েছো?
– মায়ের কাছে যেতেও কি আমার এখন অনুমতি নিতে হবে?
– আমি তোমার অভিভাবক। আমার অনুমতি তোমাকে নিতে হবে না?
– অসহ্য! ফাহাদ তুমি এমন করছো কেনো?
– তোমার কি মনে হচ্ছে না যা করার তুমি নিজে করছো?
– আমি একটু আমার মনমতো চলতে চাইছি। তোমার সেটা সহ্য হচ্ছে না কেনো?
– সবসময় মন মতো চললেই ভালো থাকা যায় না দীপ্তি। জীবনে তোমার কিছু দায়িত্ব কর্তব্য আছে। সেদিকে তোমাকে খেয়াল রাখতে হবে। মনমর্জি করতে যেয়ে যেনো স্বেচ্ছাচারিতা না হয়ে যায় সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। আজ সারাদিন আমি না খাওয়া। তুমি সেদিকে একটুও খেয়াল করো নি। এখন যখন তোমার উচিত ছিলো আগে এসে আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করা তুমি তখন আরেকদিকে চলেছো।
– বিয়ে করার আগে কি তুমি খাওনি? এতো লেকচার দিচ্ছো কেনো?
– খেয়েছি। তখন কেউ খাওয়াবে এই আশায় থাকিনি। এখন থাকি। এটাই পার্থক্য।
– আশায় থাকো কেনো? থেকো না। নিজের মতো চলো আমাকেও একটু নিজের মতো চলতে দাও।

আর কিছু বলল না ফাহাদ। কথায় কথা বাড়ে। এমনিতেই অনেকক্ষণ তর্ক করেছে ফাহাদ। যেটা তার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। তাছাড়া ক্ষিদেও ম-রে গেছে। জামাকাপড় পাল্টে শুয়ে পড়ল ফাহাদ। ঘুমালে হয়তো মেজাজ একটু ঠিক হতে পারে।

গভীর ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখছিলো ফাহাদ। দীপ্তিকে নিজের ভাবনার মতো দেখতে পেয়ে ঘুমের মাঝেই খুশি হলো সে। আরো কিছুক্ষন সেই স্বপ্ন দেখতে চাইলো। কিন্তু বিধিবাম। কারো অস্তিত্বের অনুভূতি তাকে স্বপ্নের জগৎ থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করলো। ঘুম ঘুম চোখে দীপ্তিকে দেখতে পেলো ফাহাদ। মিষ্টি কণ্ঠে সে বলছে,

– সরি ফাহাদ! এক্সট্রিমলি সরি!

ঘুমের আবেশে দীপ্তির কোমল কণ্ঠস্বর ফাহাদের বিক্ষিপ্ত হৃদয়ের আঘাতে প্রলেপের কাজ করলো। স্ত্রীকে শূণ্য হাতে ফেরত পাঠাতে পারলো না ফাহাদ। ঝগড়ার সব রেশ নীরবেই ধুয়ে মুছে গেলো।

সকালের নির্মলতা দেখে ফাহাদ ভাবলো সব ঝামেলা শেষ। দীপ্তি নিশ্চয়ই আর আগের মত ব্যবহার করবে না। তবে তেমন কিছু হলো না। দীপ্তি সে সকালে ফাহাদকে না জানিয়েই মায়ের কাছে ছুটলো। বিস্ময়ের ধোঁয়াকে ধামাচাপা দিয়ে অফিসে গেলো ফাহাদ। সে বুঝল না কিভাবে দীপ্তিকে ভালো করে বোঝা যায়।

• • • • • •

কলেজের কিছু সিনিয়র জুনিয়র মিলে ট্যুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সেই দলে আছে রূপা এবং হিমেলও। সাথে আরও অনেকেই। তবে আসমা নিজ উদ্যোগে সরে দাঁড়িয়েছে। এতটা পথ অল্প পরিচিত বন্ধুদের সাথে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার। রূপাকেও নিষেধ করেছিলো সে। কিন্তু হিমেল যেখানে যাবে সেখানে যে রূপা যেকোনোভাবেই যাবে আসমা জানে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একবার ভাবে রূপার মায়ের সাথে কথা বলার ব্যাপারে। তারপরই মনে হয় সেটা বোধহয় বাড়াবাড়ি হয়ে হবে। রূপা পছন্দ নাও করতে পারে। আর আগালো না আসমা। দুআ করলো যেনো তার বান্ধবীর সুবুদ্ধি হয়।

রূপা মহাখুশি। হিমেলের সাথে প্রথম সফর। খুশি না হওয়ার কোনো কারণ নেই। মাকে বোঝাতে বেগ পেতে হবে না। কিছু একটা বললেই চলবে। কিন্তু ভাইয়াকে বোঝানো কঠিন হবে। সে এসব ব্যাপার বেশি একটা পছন্দ করে না। তখুনি রূপার মন হলো এটাকে যদি সেমিস্টারের বাধ্যতামূলক একটা অংশ বলে তাহলে হয়তো ভাইয়া কিছু বলবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রিমনের কাছে বিষয়টাকে সেভাবেই উপস্থাপন করলো সে। আইগুই করলেও শেষমেষ রাজি হলো রিমন। ঘরে যেয়ে তমা তাকে ধরলো।

– এই তুমি রাজি হয়ে গেলে কেনো?
– রাজি হবো না তো কি করবো? পরীক্ষার অংশ হলে তো আর কিছু বলার নেই।
– জানিনা এটা আবার কি পরীক্ষা। তবে শোনো! বাবার অবর্তমানে তুমি এই বাড়ির কর্তা। তোমাকে ভালো মন্দ বুঝে শুনে চলতে হবে। যা করবে ভেবে চিন্তে।
– আমাদের রূপা কি তেমন মেয়ে নাকি? ওর বুদ্ধি আছে। এমন কিছু করবে না যাতে আমাদের মান সম্মান নষ্ট হয়।
– ও না করলেও কি। বিপদের কথা বলা যায় না। আমার ভালো লাগলো না বিষয়টা।

রিমন কোনো উত্তর করলো না। তমা চেয়ে চেয়ে দেখলো বোনের উপর ভরসা রাখা এক শান্ত ভাইয়ের মুখচ্ছবি।

চলমান।