রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা
পর্ব–১৪.
রিমঝিম রুবায়েতকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে, কান্নার দমকে কথা জড়িয়ে আসছে, জড়ানো কন্ঠে বলছে -”আই হেট ইউ”, “আই হেট ইউ।” রুবায়েত কিছু বলছে না শারীরিক ব্যাথা যেন একটু কম। রিমঝিম এ চোখ হঠাৎ ময়নার দিকে যায়, মেয়েটা মাটি থেকে কিছু কুড়িয়ে নিচ্ছে মুহুর্তে রুবায়েতকে ছেড়ে দিল।
ময়না এত হট্টগোলের মধ্যে নিজের কর্তব্য স্থির করে নিয়েছে, সবাই তো ওর সত্য জেনে গেল। ছি: এই মুখ নিজেকেই তো দেখাতে পারবে না। চোখ গেল উঠানে পরে থাকা একটা ধারালো কিছুতে…চোখে মৃত্যু আকাঙ্খা.. তুলে নিতেই এক ঝটকায় কেউ ওর হাত থেকে সেটা ফেলে দিল। চোখ তুলে দেখলো রিমঝিম ভাবী। নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।কথা বলতে পারছে না।
রিমঝিম ময়নাকে জড়িয়ে ধরে আছে, “ শান্ত হও…মৃত্যু কোন সমাধান বা জবাব না। তুমি শেষ পর্যন্ত তো সত্য বলেছো।”
ময়না ভাঙা গলায় বলে, “ আমি ভুল আছিলাম, আমি..আমারে মাফ কইরা দেন…আমি…”
রিমঝিম ময়নাকে ছেড়ে রুবায়েতের দিকে তাকায়, রুবায়েতের দৃষ্টি কঠিন। ময়নাকে সে মাফ করতে রাজি না।
রিমঝিম ময়নার মাকে দেখতে পায় তক্ষুনি সে দৌড়ে আসে এবং এসেই নিজের মেয়েকে পাগলের মত মারতে থাকে। রিমঝিম হতবুদ্ধি হয়ে যায়। জোর করে ছাড়িয়ে নেয়,
“এসব না করে মেয়েকে আবার পড়ান। কিছু শেখান। একটা মেয়ের জন্য বিয়েই সব কিছু না। ও অনেক ছোট। আপনারা আগলে রাখবেন, যত্ন করবেন।”
ময়নার মা এরপর মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়৷ রুবায়েতের কাছাকাছি এসে কিছু বলতে চাইলে রুবায়েত সরে যায়। বিষয়টা রিমঝিমের ভালো লাগেনা, কিন্তু কিছু বলতেও পারে না। রুবায়েতের রাগ ও স্বাভাবিক, একটা মানুষকে এত বড় অপবাদ দেওয়া।
গ্রামের রাস্তা ধরে, রিমঝিমা আর রুবায়েত হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। রুবায়েতের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, রিমঝিম ধরে,ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক রাত, শিয়ালের ডাক, প্যাঁচার ডাক, ঝিঝিঁ পোকার একটানা আর্তনাদ আর কোথাও কোথাও জোনাকি পোকার মিট মিট আলো। রুবায়েত রিমঝিমের দিকে তাকালো, “ ভয় পাচ্ছো।”.
“আজকে আমি যে ভয় পেয়েছি, তার কাছে এইসব ভয় কিচ্ছু না। ভেবেছিলাম তোমাকে হারিয়ে ফেলবো।” গলাটা বুজে আসলো, এক হাতে রুবায়েতের আহত মুখে হাত বুলিয়ে দিল। “ আই লাভ ইউ।”
রুবায়েত হেসে ফেলল, “ আমিও ভেবেছিলাম, আর দেখা হবে না। তোমাকে ধন্যবাদ জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় তুমি আমাকে তোমার বিশ্বাস দিয়েছো। যখন তোমার কাছে কারন ছিলো আমাকে অবিশ্বাস করার।”
রিমঝিম কিছু বলে না, মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট হয়, “আই লাভ ইউ টু” বললে কি মুখটা খসে যেত!
রুবায়েত আস্তে করে রিমঝিমের কাধ আঁকড়ে থাকা হাতের চাপ বাড়ায়, “ আই লাভ ইউ টু রিমঝিম।”
গভীর রাত, রুবায়েতের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে রিমঝিম। রুবায়েত গভীর ঘুম। ঠোঁট ফুলে আছে কপালে ক্ষত। শরীরের বিভিন্ন স্থানে কালসিটে। রিমঝিমের ঘুম নেই। আল্লাহকে অনেকবার শুকরিয়া জানিয়ে ফেলেছে। জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো, কে জানে কাল গ্রামবাসীর কি হবে?
রুবায়েত অবশ্য বলেছে, “কিছুই হবে না। এটাকে বলে মব লিঞ্চিং। হয়রানি হবে হয়ত।”
রিমঝিম বলেছিলো, “কিন্তু সংবিধান তো বলে, প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার সুরক্ষিত। তাহলে এসব ঘটনার বিচার হবে না কেন?”
“সেটা ঠিক।আমাদের সংবিধান অনুযায়ী মানবাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও বাস্তবে গণপিটুনির ঘটনায় বিচার প্রায় হয় না বললেই চলে। মামলা দায়ের হলেও, যদি বিষয়টা আলোচনায় না আসে বা মিডিয়ায় না আসে, তাহলে পুলিশের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায় না।”
রিমঝিম নিশ্চিত হয়ে বলে, “তাহলে যারা এইসব গণপিটুনিতে অংশ নেয়, তারা কি ধরাও পড়ে না?”
রুবায়েত, “ধরার ঘটনা খুব কম। কারণ এক্ষেত্রে সাধারণত অনেক লোক জড়িত থাকে, কত লোক ধরবে পুলিশ? তাছাড়া তদন্ত ব্যবস্থায় দুর্বলতা আছে, অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ অনেক লোক জড়িত ছিল বলে বিষয়টা এড়িয়ে যায়। আর চেয়ারম্যানের পরিবার কোন মামলা করবে না। কিছু প্রভাবশালী ব্যাক্তি যারা পরবর্তীতে চেয়ারম্যান হতে আগ্রহী, তারাই ঘটনা ধাঁমাচাপা দিয়ে দিবে। গ্রামবাসীর আস্থা অর্জনে। হ্যাঁ কয়দিন একটু হয়রানি হবে বটে, এসব চিন্তা বাদ দিয়ে তুমি ঘুমাও।”
রিমঝিম এখন, রুবায়েতের, আহত জায়গাগুলোতে আদরে এঁকে দিচ্ছে, একবার ভাবল জেগে আছে কিনা, ডায়েরিতে যেমন লিখেছে। আস্ত ফাজিল, চেহারার দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো রিমঝিমের। সারা মুখে আদর দেওয়া হলে, ব্যথা পাওয়া ফোলা ফোলা ঠোঁটের কাছে যেতে, রুবায়েতের মুখে হালকা একটা হাসির রেখা যেন ফুটে উঠলো, দেখার ভুল কিনা, রিমঝিম ভাবছিল।কয়েক মিনিট কেটে গেল।
হঠাৎ রুবায়েত বলে উঠলো, “ আমি অপেক্ষায় আছি এত দেরি করছ কেন?”
রিমঝিমের ইচ্ছে করছিল না, রুবায়েতের সাথে ঝগড়া করতে অথবা তাকে অপেক্ষায় রাখতে। আজকে রুবায়েতের জন্য শুধুই ভালোবাসা আর ভালোবাসা।
__________________
ডিসেম্বর মাসের শুরু হয়ে গেছে, অল্প অল্প শীত পড়েছে। গ্রামে তো এই সময় প্রচুর শীত কিন্তু ঢাকায় শীত তেমন জাকিয়ে বসেনি। ডাক্তার রুবায়েত, ঠিকানাটা দেখল। কাউন্সিলর রাবেয়া আক্তারের চেম্বারের ঠিকানা ওর হাতে। আজ প্রায় সাত দিন রিমঝিম নিজের বাবার বাসায়, রাগারাগি করে গিয়েছে। রুবায়েত ভাবছে একবার নিজের ও কাউন্সেলিং করাবে।
ডা: রাবেয়া রুবায়েত কে দেখে অমায়িক হাসি দিল সালাম আর কুশল বিনিময়ের পরে–
“ডা:রুবায়েত, আপনাকে স্বাগতম। আচ্ছা আগে বলুন তো, আপনি কেন মনে করলেন, এই সেশনের প্রয়োজন?”
অস্বস্তিতে নড়ে চড়ে বসলো রুবায়েত,
“আসলে আমার স্ত্রী রিমঝিম খুব বেশি ওভারথিঙ্ক করে, অনেক কিছুতে সন্দেহ করে। সেগুলো নিয়ে আমাদের মাঝে টুকটাক সমস্যা ছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমার ভিতরেও কোন সমস্যা আছে সেটা জানতে আসলাম।”
“ভালো, এই উপলব্ধিটাকে আমি প্রশংসা করছি। আপনি কি নিজেকে কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট মনে করেন? নাকি অন্য কিছু?”
“হ্যাঁ, আমি বেশি কথা বলি না। নিজের জায়গায় শান্ত থাকতে পছন্দ করি। আর আসলে ইদানিং যে সমস্যা হয়েছে সেখানে আমারও দোষ ছিল। আচ্ছা খুলে বলি, আমি তো ডাক্তার, আপনি হয়তো জানেন একটা ডাক্তারের ডিউটি। কিন্তু আমার স্ত্রী চায় তার সাথে সময় কাটাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাই।”
ডা: রাবেয়া মুচকি হাসলো, “আসল বিষয় হল স্ত্রীরা, স্বামীর মনোযোগ চায়, তাই আপনি যখন চুপ থাকেন, রিমঝিম সেটা “উপেক্ষা” বা “লুকানো কিছু আছে” বলে ধরে নেন। সন্দেহ বা ওভারথিঙ্কের উৎসটা অনেক সময়ই “অনিশ্চয়তা” থেকে আসে। আপনি তাকে নিশ্চিত করতে পারছেন না। চেষ্টা করবেন।”
একটু থেমে একটু পানি পান করে নিল।
“আর আপনার স্ত্রী তো চাইবেই আপনি তার সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যান। এই চাওয়ার মধ্যে আমি কোন দোষ দেখি না। আপনি নিজের পেশার দোহাই দিয়ে, এটা এড়িয়ে যেতে পারেন না।” ডাক্তার রাবেয়া এবার একটা পেপার ওয়েট ঘুরাতে লাগলো তারপর বললো, “আপনার সঙ্গীর সঙ্গে আপনার খোলামেলা কথা বলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারপর কি হয়েছিল বলুন?”
“আসলে আমার ওয়াইফের, বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে ছিল। একটা অনুষ্ঠানেও আমি যেতে পারিনি, বিয়ের দিন যাবার আপ্রান চেষ্টা করেছিলাম।আমি ডিউটি বদল করে নিয়েছিলাম, কিন্তু একটা ইমারজেন্সি চলে এসেছিল।আমি এনেস্থিসিয়া নিয়ে কোর্স করেছি, দিতে পারি, স্ট্যান্ডবাই থাকতে পারি। একটা মারাত্মক রোগী এসেছিল প্রেগন্যান্ট। এনাস্থিসিয়ার ডাক্তার যিনি তিনি ছিলেন রাস্তায়। তাই আমাকে থাকতে হয়েছিল। জানেন হয়তো অপারেশনের পুরো সময়টাতেই থাকা লাগে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো, “ আমার স্ত্রী সেদিন অনেক কান্নাকাটি করেছিল, ওর বন্ধুরা নাকি ওকে অনেক খোঁচা দিয়েছে, ওর অনেক শখ ছিল, একসাথে ম্যাচিং করে দুজন জামাকাপড় নিয়েছিলাম। সেদিন বিয়ের পর সে আর বাসায় ফিরে আসে নি।”
“ইস আপনার স্ত্রী অনেক কষ্ট পেয়েছে, আপনি কি তাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন আপনার পরিস্থিতি? কতদিন হলো গিয়েছে? আনতে গিয়েছিলেন?”
“ না মানে, সে কিছু শুনতে নারাজ, ফোনে ক্যাজুয়াল কথা হয়, আনতে চাইনি। মনে হচ্ছিল মাঝেমধ্যে দূরত্ব ভালো কাছে আসার জন্য।” বোকা হাসি দিল রুবায়েত।
ডা: রাবেয়া শব্দ করে হাসলো, “আপনারা পুরুষরা কি এত অবুঝ নাকি বুঝতে চান না। আপনার স্ত্রী যে ওদিকে আপনার অপেক্ষায় বসে আছে সেটার কি হবে? আপনারা স্বামীরা এরকম কেন? স্ত্রীদের কিছুই বুঝতে দিতে চান না। ঝগড়া লাগার পরে কেন, আগে কেন তাকে অল্প অল্প নিজের পেশা কাজের ধরন সম্পর্কে বলেন নি? শোনেন ইমোশন এক্সপ্রেস করার টেকনিক আছে যেমন: “আমি অনুভব করি…”, “আমার ভালো লাগে যখন তুমি…” জানো হাসপাতালে… এই ধরনের বাক্য ব্যবহার করবেন।”
রুবায়েত একটা নার্ভাস হাসি দেয়, ”মানে, আমার কি কি পরিবর্তনের দরকার?”
“সম্পর্ক মানে একসাথে বদলানো। দুইজন চেষ্টা করবেন।আপনি যদি কিছুটা খোলামেলা হতে পারেন, বুঝিয়ে বলতে পারেন তাহলে সহজ হবে। আপনার বাসায় কে কে আছে?”
“ আপাতত কেউ না দুই মাস পর আমার বাবা-মা আসবেন, তারা আমেরিকা আমার বড় ভাইয়ের কাছে।”
“আচ্ছা আপনি কি কখনো ভেবেছেন, সারাদিন স্ত্রী বাসায় একা, একা কি করে? আপনি তো কাজে থাকেন সময় কেটে যায়, যেভাবেই হোক। সে সারাদিন আপনার অপেক্ষায় থাকে। তারপরে যদি আপনি চুপচাপ থাকেন কথা শেয়ার না করেন। তার কি দম বন্ধ লাগবে না? আপনাকেই একসাথে সময় কাটানো ও একা সময় কাটানোর ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। আবার,আপনি যদি বিরক্ত হন, তখনই প্রতিক্রিয়া না দিয়ে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পরে আলোচনা করুন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিজেকে বোঝা ও নিজের সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়া—এটাই সম্পর্কের প্রথম ধাপ।”
রুবায়েত কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে, তারপর মুখ তুলে বলে , “ আমি কিছুটা বুঝতে পারছি, আমার স্ত্রী আসলে আমার সঙ্গ কামনা করে, তাই চায় সাথে আমি সব জায়গায় যাই। আমার স্বভাব এবং পেশা তার অন্তরায়।”
ডাক্তার রাবেয়া হেসে ফেলল, “ পেশা তো আপনি চেঞ্জ করতে পারবেন না, নিজেকে অল্প চেঞ্জ করুন। আর শোনেন ডাক্তারদের ছুটি থাকে। সেরকম ছুটিতে বউকে নিয়ে বেড়াতে যান, বউয়ের বন্ধুদেরকে দাওয়াত দেন। এভাবেও আপনি ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন।”
“ধন্যবাদ চমৎকার বুদ্ধি দিয়েছেন।” রুবায়েত চলে যাবে উঠে দাঁড়ালো।
“আচ্ছা শুনুন।”
রুবায়েত ফিরে তাকালো, “ আমি আপনার স্ত্রীর কাউন্সিলিং করেছিলাম, উনি আপনাকে অনেক ভালোবাসেন। আর একটা কথা, আপনার স্ত্রী নাটকীয়তা পছন্দ করেন। টিপস দিলাম কাজে লাগাবেন।”
রুবায়ের হেসে ফেলল।
_________________
রিমঝিম আজ সাত দিন নিজের বাপের বাড়ি, একটু ও মাফ করবে না ঐ লোককে। কিন্তু এদিকে ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। সারাক্ষণ শুধু কাজের দোহাই দেয়। বান্ধবীরা ওকে নিয়ে কত হাসাহাসি করেছে। প্রত্যেকের কাপল ছবি আছে, শুধু ওর নেই। বিয়ের পর একটা মেয়ে একা একা অনুষ্ঠানে যাওয়া খুবই অপমানের।
প্রতিদিন অবশ্য ফোনে কথা হয় এক দুই মিনিট, অথচ ওকে নিতে আসছে না।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো, অপরিচিত নাম্বার।
ফোন তুলতেই অপর পাশ থেকে–
“হ্যালো আস সালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? আপনি আমাকে চিনবেন না।”
রিমঝিমের হাসি পেয়ে যায়, বোকা ডাক্তার। মুখে রুমাল চেপে ধরে কথা বললেই কি রিমঝিম এর কন্ঠ বুঝবে না, “ অলাইকুমুস সালাম, না চিনলে কথা বলব কেন?”
“আমি আসলে আপনার স্বামী সম্পর্কে কিছু বলবো।”
“আচ্ছা বলুন কি বলবেন?”
“আসলে উনি আমার খুব ভালো বন্ধু, আপনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পরে খুব কষ্টে আছে। মিটমাট করে ফেলুন প্লিজ।”
“আপনার মুখচোরা বন্ধুকে বলবেন, নিজের কথা নিজে বলতে শিখতে, কখনো ডায়েরি কখনো বন্ধু, এগুলো কোন কাজের কথা না! আর এত কষ্ট পাবার কোন কারণ নেই, তার প্রথম স্ত্রী তার সাথেই আছে।”
“আল্লাহ তাই! কি বলছেন এসব। আমি তো জানি না।” অপর পাশের কণ্ঠটা অবাক।
“হ্যাঁ তার পেশা আর হাসপাতাল হচ্ছে তার প্রথম স্ত্রী। এখন ফোনটা আমি রাখছি, ছ্যাঁচড়া কথা বলার জন্য আমাকে ফোন দিবেন না। আপনার বন্ধুকে বলে দিবেন—-”আই হেট হিম।”
ফোনটা রেখে রিমঝিমের খুব মজা লাগছিল, জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো, ডিসেম্বর মাস আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। বৃষ্টি নামবে সম্ভবত। একটা শাড়ি পরল, নীল শাড়ি সাদা পাড় হাল্কা সাজগোছ করছে, তখনই ফোনটা আবার বেজে উঠলো। রিমঝিম নাম্বারটা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। বোকা ডাক্তারের তো ভালো উন্নতি…
“আবার ফোন করলেন কেন?”
“আপনি না ধরলেই পারতেন?”
রিমঝিম একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল, “ কি বলবেন জলদি বলেন।”
“আপনার স্বামী আপনাকে, ছাদে আসতে বলেছে, এখানে নাকি আপনাদের প্রথম কথা হয়েছিল?”
“উনাকে বলেন আমার কোন ঠেকা নাই, ফোন রাখেন।”
“আরে,আরে ম্যাডাম শোনেন, আপনার স্বামী কি করেছে জানেন? অনেকগুলো কেঁচো একটা বোতলে ধরেছে,ডাক্তার তো ঘেন্না নাই। আমাকে বলেছে আপনি যদি আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা রেইনকোট পড়ে ছাদে না আসেন, সে আপনার বাসায় এসে আপনার মাথার উপরে বোতলটা খালি করবে।”
রিমঝিম আঁতকে উঠে, “আসছি, তাকে বলবেন, আজকে রিমঝিম তার উপরে বজ্র নিক্ষেপ করবে, তৈরি থাকতে।”
রিমঝিম যতই সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, ওর কেমন একটা ফিল হচ্ছিল। বোকা ডাক্তার, ভালো উন্নতি হয়েছে। বিষয়টা রিমঝিম খুব এনজয় করছে। কিন্তু বান্ধবীদের বললে বিশ্বাস করবে?
ঐতো সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ইস আবার একটা নীল পাঞ্জাবী পরেছে। রিমঝিমকে দেখে হাসলো, কিন্তু রিমঝিম একটুও হাসির জবাব দিবে না মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে।
“আস সালামু আলাইকুম, আপনি কি চা খান?”
সেই প্রথম দিনের মত, রিমঝিম চোখ তুলে তাকালো, “জি খাই, তবে চিনি বেশি খাই না।”
পাগলা বাতাস বইছে, বৃষ্টির পূর্বাভাস। রিমঝিমের গায়ে তো রেইনকোট, বোকা ডাক্তার কি করবে। ও আচ্ছা বোকা ডাক্তারের হাতে তো ছাতি আছে, ভালো চালাক হয়ে গেছে।
“আমার চিনি লাগে না জানেন, যদি আমার স্ত্রী চায়ের কাপে একটু চুমুক দিয়ে দেয়।”
এখনো রিমঝিম হাসছে না, একটা কড়া দৃষ্টি দিল, “শোন রুবায়েত, খুব সস্তা একটা জোকস হয়ে গেল।”
“তাই নাকি?” বেড়ে যাওয়া চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে দিল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি মনে হচ্ছে যেন সেভ করে না। “ আমার কাছে তো এটাই সত্যি মনে হয়।”
রিমঝিম বলল, “ চুল দাড়ি কাটনি কেন কেমন দেখা যাচ্ছে?”
“তোমার বিরহে!”
“ফাজলামো কথা রাখো, আমাকে অনেক অপমান করেছো তুমি।” রিমঝিম এবার রেগে যাচ্ছে, অভিমানে ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে, কন্ঠে অভিমানের ছোঁয়া।
“আচ্ছা সরি, এখন এত রাগ করো না তো, আমি এমনিতেই স্ত্রীর শোকে কাতর। ছুটি নিয়েছি দুই দিন। এই সপ্তাহের মধ্যেই তোমার বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত দিবে, তোমার চাঁদের মত জামাই টা দেখিয়ে তাদের খুব হিংসা লাগাবে ঠিক আছে?”
রিমঝিম এর মুখে হাসি ফুটে উঠলো,একটা মুখ ভেংচি দিল, “ আমি বন্ধুদের হিংসা লাগাতে চাইবো কেন? নিজেকে কি মনে কর তুমি? তুমি কোথাকার টম ক্রুজ!”
রুবায়েত রিমঝিম এ চোখে চোখ রাখে, সেই দৃষ্টিতে রিমঝিম কেঁপে যায়। মনে মনে বলে, “এতক্ষণ যা কিছু বলেছি ভুল বলেছি, আমার চোখে তোমার চেয়ে সুদর্শন আর কেউ নেই।”
“আমি যেমনি হই, পৃথিবীতে দুইটা নারীর কাছে আমি সবচেয়ে সুদর্শন। একজন আমার মা, আরেকজন আমার স্ত্রী। তাই অসুন্দর আমি নিজেকে একটু সুদর্শন মনে করতেই পারি। অন্তত তোমার চোখে।”
রুবায়েতের এই কথায় রিমঝিমের খুব কষ্ট হয়, “এই তুমি রাগ করেছো, কষ্ট পেয়েছো? সরি, তুমি অনেক সুন্দর।”
রুবায়েত হেসে ফেলল, “আকাশ এতো মেঘলা, একটা বাজ পড়লেও তো পারে, বল?”
রিমঝিম মুখ টিপে হাসে, ওসব আর হচ্ছে না আমি এখন আর এত ভয়….পুরো কথা শেষ করার আগেই শব্দ করে বজ্রপাত হল। রিমঝিম কাল বিলম্ব না করে রুবায়েতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, রুবায়েত এক হাতে ছাতি মেরে ধরল মাথার উপর। “ চুপচাপ বুকেই থাকো। এই সাত দিন অনেক কষ্ট দিলে। আজ বাসায় যাবে চুপচাপ।”
“আমার আচার খেতে ইচ্ছে করছে!”
“আচ্ছা কিনে দিব ইন শা আল্লাহ।”
রিমঝিম রেগে উঠে, “বোকা ডাক্তার কিছু বুঝে না। কিছুদিন পর বুকে জড়িয়ে নেবার আরও মানুষ আসবে…” মুখ বুকে ঘষে দেয় আদুরে ভঙ্গিতে।
“আম্মা আসছে সেটা বলছ? আরে দূর বড় হয়েছি না লজ্জা লাগে।” রুবায়েতের সহজ কন্ঠ।
“মাথায় পুরাই গোবর, বলছি কি বুঝ না?” তারপর একটা নি:শ্বাস ফেললো, “ আজ টেস্ট করেছি, পজেটিভ এসেছে!”
রুবায়েত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, “কি হয়েছে তোমার? কি টেস্ট? আশ্চর্য! আমাকে বলবে না? কন্ঠে অস্থিরতা, “ তুমি ঠিক আছো?”
“তোমার মাথা! অসহ্য একটা বোকা ডাক্তার।” রিমঝিম রাগ হয়ে সরে দাঁড়ায়।
রুবায়েত কথাগুলোকে জোড়া দেয়, বুঝে ফেলে যেন হঠাৎ।
“আর এই খবর তুমি এখন দিচ্ছ আমায়?” কন্ঠে রাগ।
“আজই টেস্ট করেছি, আর আজ চলেই যেতাম একাই, ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি। তোমার মত আমি এত জালিম, পাষান না।” ঠোঁট উল্টে একটা আদরের ভঙ্গি করল রিমঝিম।
রুবায়েতের মুখে হাসি ফুটলো, বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। আবার বাজ পড়লো দূরে কোথাও। রুবায়েত জড়িয়ে নিল ওর প্রিয় মানুষকে, “ আই লাভ ইউ বাবুর আম্মু।”
রিমঝিম একটা অপার্থিব সুখ অনুভব করলো, গুন গুন করলো…
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবেসে
তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে
ভোরের শিশির ঠোঁট ছুঁয়ে যায় তোমায় ভালবেসে
বৃষ্টির শব্দ আর রিমঝিম এর গান, দুই ভেসে বেড়াতে লাগলো চারিদিকে। আর বোকা ডাক্তার রুবায়েত, নিজের রিমঝিমকে, নিজের প্রশান্তিকে, আগলে রাখল বুকের মাঝে।
এরপরে ওদের মধ্যে, আবার ঝগড়া হবে, আবার মিল হবে। ভালোবাসাই ভালোবাসাকে ফিরিয়ে আনবে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক খুব সুন্দর, যদি সেটার যত্ন নেওয়া যায়।
সমাপ্ত–