রিমঝিম বৃষ্টি পর্ব-৬+৭

0
9

রিমঝিম বৃষ্টি

কাজী জেবুন্নেসা

পর্ব ৬

একটা পাখি এক সুরে দূরে কোথাও ডেকে যাচ্ছে। ঘরের দাওয়ায় বসে আয়নায় মুখ দেখছে ময়না। সকলে বলে অনেক সুন্দরী সে, গরীবের ঘরে চাঁদের আলো। কিন্তু তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লাই যে ভারী। স্কুলে পড়ত ময়না ছাত্রীও ভালো ছিল। কিন্তু প্রস্তাব আসে প্রবাসী ছেলের জন্য। বড়লোক দেখে বাবা মাও তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়, তখন বয়স কত পনেরো বছর হবে। তবে সংসার এক বছর ও করা হয় নি। স্বামী বয়সে পনেরো বছরের বড় ছিল, সে যতদিন দেশে ছিল ময়নার মনের চেয়ে শরীরের দখল নিয়েই তার ব্যাস্ততা ছিল বেশি। সে চলে যাবার পর শুরু হয় শশুর বাড়ির অত্যাচার, যৌতুকের চাপ। সব মিলিয়ে ময়না অল্প বয়সে একদম হাঁপিয়ে যায়। তবুও সংসার করতে চেয়েছিলো সব মেয়েই চায়। কিন্তু তারা ওকে একদিন এত মারে যে ময়না আধমরা হয়ে যায়। পুরো একদিন অভুক্ত থাকার পরে মর মর অবস্থায় বাড়িতে ফোন করে। ওর বাবা ওর এই অবস্থা দেখে নিয়ে আসতে চাইলে ওর শাশুড়ি এক কথায় বলে উঠে,

“মাইয়াটারে একবার লইয়া গেলে, অই মাইয়ারে আর ঘরে তুইলা আনার কাম নাই।”

ময়নার বাবাও প্রতিউত্তর দেয়,

“না আনলে, তাই বইলা কি মাইয়াটারে মইর্যা ফালাইমু?”

ব্যাস সেদিন ই ওর ভাগ্যের ফয়সালা হয়ে যায়। বাড়ি আসার কিছুদিনের মধ্যেই ওর তালাক হয়ে যায়। ওর বর ভদ্রলোকের তেমন কোন হেলদোল ছিল না। অনেক আশা নিয়ে কষ্ট করে ফোন করে শুনতে হয় ও বেয়াদব, সংসারের যোগ্য না, তার বাবা মায়ের কথাই শেষ কথা।

বেঁচে থাকার ইচ্ছা সেদিনই মরে যায় ময়নার, তবুও জীবনটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি বাবা-মায়ের কথার খোঁচা ওরা সহ্য হয় না তাই একদিন আত্মহত্যার প্রয়াসে নিজের হাতের রগ কেটে ফেলে। সেদিন মৃত্যু মুখ থেকে ওকে ফিরিয়ে আনে ডাক্তার রুবায়েত। শুধু নতুন জীবন নয় নতুন আশা ও দেখতে পায় ময়না। ডাক্তার রুবায়েতকে খুব ভালো লাগে, মনে মনে উনাকে ভেবে কত গান করে কত কবিতা লেখে। নিজেকে প্রশ্ন করে এগুলো কি পাপ! একদিন খাবার দিতে গিয়ে শুনে ফেলেছিল ডাক্তার সাহেব কাউকে বলছিল স্ত্রী উনাকে তালাক দিতে চাচ্ছেন। মনে, মনে সেদিন ময়না উনার স্ত্রীর উপর রাগ হয়েছিল অনেক, কি বোকা মেয়ে৷ আবার কেমন যেন খুশিও লেগেছিল।

কিন্তু আবার ফিরে আসলো কেন উনার বউ? মনে মনে নিজের ভিতর একটা পরিবর্তন টের পায় ময়না। ক্রমাগত যেন ডাক্তার রুবায়েতের স্ত্রীর উপর কেমন ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে। ডাক্তারের প্রতি একটা অদম্য টান অনুভব করে। প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে উনার যাওয়া আসা দেখে। লোকমান মিয়ার বউ তরু আপা কিছু আন্দাজ করছে মনে হয়। উনাদের ঘর রাস্তার পাশে কিনা!

_____________________

আজকের দিনটাও রৌদ্রজ্জ্বল, সকালে উঠানব্যাপী আলোর খেলা। রুবায়েত আজকে একটু বাজারে গিয়েছে। কই মাছ খুঁজবে রিমঝিমের খুব পছন্দ। তারপর একটু কাছাকাছি যে শহর সেখানে যাবে। কিছু ওষুধ কিনতে হবে, বর্ষা এখন পানি বাহিত রোগের ছড়াছড়ি। বিশ্রী একটা এলার্জিও এসেছে বাচ্চাদের হচ্ছে বিশেষ করে।

রিমঝিমের আপাতত কাজ নেই। ঘরের কাজ শ্যামলী বলে একজন করে দেয়। সব মেয়ে, মনে মনে ঠোঁট বাঁকায়, বেশ হয়েছে আয়নায় নিজেকে ভেংচি কাটে রিমঝিম। স্বামীকে নিজের মুঠিতে পুরতে চেয়েছিলে, আর স্বামী মহাশয় এদিকে এসে পুরো নারী দ্বারা বেষ্টিত। ময়নার মা, ময়না, শ্যামলী, গিট্টুর নানী….আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজে এখন হেসে কুটি কুটি হয়ে যাচ্ছে। হায়রে রিমঝিম গিট্টু নানীকেও ছাড়লি না।

রান্নাঘরে গিয়ে সকালের বেঁচে যাওয়া চা গরম করলো। আজকে কি রুবায়েত ওকে গ্রাম দেখাতে নিয়ে যাবে? কাল রাতে তো রিমঝিম এটাই বলল। তাছাড়া আর কি বলতো, ইশ! বাসে উঠিয়ে দিবে! রিমঝিম গেলে তো! কাল রাতে, ভদ্রলোকের আলিঙ্গনে নিজেকে তো হারিয়ে ফেলেছিল রিমঝিম। রুবায়েতই বা কম কি তেলাপোকার ভয় দেখিয়ে ছাড়ার নাম করছিলো না একদম। তাই আজকে সকালে মনটা অনেক ফুরফুরে।

এত ফুরফুরে আজকে রুবায়েতকে এমন কি নাচ ও দেখাতে পারে। সেই বিয়ের পর একবার দেখিয়েছিল সেরকম। রুবায়েত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, –তুমি তো মারাত্মক মেয়ে, কত কিছু পারো।
রিমঝিম উত্তর দিয়েছিল, “ আমি আমার প্রিয় মানুষটার জন্য সব পারি, শুধু তাকে আমার হয়ে থাকতে হবে। এদিক সেদিক উঁকি বাজি করা যাবে না।”

রুবায়েত অনেক হেসেছিল সেদিন, অথচ তার কিছুদিন পরে ওদের ঝামেলা শুরু হয়েছিল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকানো, পুকুরটাতে পানি থই থই করছে। আজ মাছ ধরবে, ময়না বলেছে বরশি নিয়ে আসবে। এই ময়না মেয়েটা বেশ রহস্যময়। এর আগে রুবায়েতকে যতবার সন্দেহ করেছে ততবার ঠকেছে। কিন্তু এবার ওর মন অন্য কিছু বলছে, তবুও নিজেকে নিজেই কাউন্সিলিং করছে। ডাক্তার শিখিয়ে দিয়েছে। কাজের জিনিস। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করো উত্তর দাও, এবং পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না।

চা নিয়ে দরজার ঠেস দিয়ে বসলো গতকালের মত, শ্যামলী আরেকটু পরে আসবে। শ্যামলীর বর নৌকা চালায়, কাল মেয়েটা মুখে মারের চিহ্ন নিয়ে কাজে এসেছিলো। আচ্ছা ওর বর ওর কাছে মাফ চেয়েছিলো কি? একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেল বুকচিরে। ডাক্তার রাবেয়া যে ওর কাউন্সিলর সে আক্ষেপ করেই বলেছিলো, “ আমাদের অনেক সমস্যার মুল আলহামদুলিল্লাহ বলতে না পারা।”

হঠাৎ রিমঝিমের কি হয়ে গেল, ফোনটা হাতে নিল, বাচ্চাদের একটা মেসেজ করল রুবায়েতকে,

“তোমার না বলা কথাগুলো কে
একদিনের ছুটি দিও
তারা যেন আমার কানে কানে
ফিসফিস করে বলে
অনেক ভালোবাসা নিও।”

তারপর সন্তুষ্ট হয়ে ডায়েরি খুলে বসলো–—-

কোন তারিখ নেই শুধু লেখা

মজার ঘটনা ১:

রিমঝিম আমাকে একদিন সিগারেট খেতে দেখে ফেলে। আমি সিগারেট খোর না তেমন। তবে মাঝে মাঝে খাই। ডাক্তার হয়ে বিপদ হয়েছে, রোগীদের খেতে নিষেধ করি আবার নিজেই খাই। কেমন যেন লাগে। বাসায় তো খেতেই পারি না। একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেয়ে, চকলেট মুখে পুরে বাসায় আসলাম। ঢুকেই বুঝলাম কিছু একটা সমস্যা, রিমঝিমের মুখ পুরা থমথমে। এই যে আমি আসলাম একটা হাসিও দিল না। আমি কথা বাড়ালাম না, শাওয়ার নিয়ে, চুলগুলো সোজা ওর মুখের উপরে ঝেড়ে দিলাম। এটা করলে রিমঝিম খুব খুশি হয় খিল খিল করে হাসে। কিন্তু আজ ভ্রুকটি করে বলল, “ আপনার লজ্জা লাগে না?”

মানে টিনের চালে কাক আমিতো অবাক। আমি তো জামা কাপড় পড়েই বাথরুম থেকে বের হয়েছি, লজ্জা লাগার কি আছে বুঝলাম না।

“মানে?”

“রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন, আপনি সিগারেট খান না আমাকে বলেছিলেন। মিথ্যে একটা কথা বলেছেন লজ্জা করে না?’’

আমি ঢোক গিলে বললাম, “ছেড়ে দিব সত্যি।”
“কবে?”
আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধির কারখানা, মুখটি দেখে বোঝার উপায় নেই। ভাবলাম এই সুযোগ বদলা বদলি করি।
“আমাকে তুমি বলতে হবে আর আমার সামনে শাড়ি পরে থাকা লাগবে।”

রিমঝিম, এত সহজে মানতে চাইলো না। “ যাহ! তুমি বলতে পারব না। আর শাড়ি পরতেই পারি না।আজাইরা।”

“তাইলে আমিও সিগারেট ছাড়তে পারবো না, হোক আমার ফুসফুস ক্যান্সার, তোমার তাতে কি?”

আমার ওভার থিংকার বউ সারারাত চিন্তা করে সকালে রাজি হয়ে গেল। তারপর দুইজন অনেকগুলো শাড়ি কিনে আনলাম। শুধু শাড়ি না সেদিন তাকে অনেকগুলো গাছও কিনে দিলাম, তবে বলা হলো না ফুলের রেনুতে আমার এলার্জি।

মজার ঘটনা ২

মন খারাপ ছিল সেদিন কারন একটা বিসিএস এর রেজাল্ট দিয়েছে ভাইবাতে টিকি নাই। চুপচাপ বসে ছিলাম ঘরে। রিমঝিম কাজ করছিলো, ওর চুড়ির আওয়াজ পাচ্ছিলাম। হঠাৎ ঘরের বাতি জ্বলে গেল।

“তুমি এমন ঘর অন্ধকার করে বসে আছো কেন?”

আমি উত্তর দিলাম না, ভালো লাগছিল না। উঠে দাঁড়ালাম ইচ্ছে একটু বাইরে যাব।রিমঝিম আমার কাছাকাছি আসলো। ওর দুই হাত আমার কাঁধে রাখলো, “মন খারাপ?”

চোখে কাজল দিয়েছে লক্ষ্য করলাম, মৃদু হাসলাম, “ হুম। বিসিএস এর ভাইভা অব্দি গিয়ে টিকলাম না।”

রিমঝিম একটু অবাক হলো, চোখ দুটো বড় করে তাকালো আমার দিকে। তারপর হালকা ধমকের সুরে বললো,
“এই যে ডাঃ সাহেব, একটায় হয় নাই তাই বলে দুনিয়া থেমে যাবে নাকি?”

আমি আবার একটু হাসলাম, কিন্তু সেটা যেন নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা। বললাম,
“অনেক দিনের প্রস্তুতির ব্যাপার ছিল। কষ্ট লাগে।”

রিমঝিম আর কিছু বললো না। শুধু আমার হাতটা ধরলো, টেনে বসাল বিছানায়। তারপর আমার চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে গান গেয়ে উঠলো, “ আ যা প্রিয়া তোহে পেয়ার দু… কিস লিয়ে তু ইতনা উদাস…তু সুখ মেরে লে লে ম্যায় দুখ তেরি লে লু…”

আমি তাকিয়ে রইলাম, রিমঝিম এবার নাচতে লাগলো দুষ্টু- মিষ্টি নাচ, নাচের চেয়ে আমার গাল আর চুল ধরে টানাটানি করলো বেশি। আমি পুরাই হতভম্ব হয়ে গেলাম।

আমি বলে উঠলাম,
“এই নাচ কোথা থেকে শিখলা? তুমি তো মারাত্মক মেয়ে, কত কিছু পারো।”

রিমঝিম দুম করে আমার পাশে বসে বললো, “আমি আমার প্রিয় মানুষটার জন্য সব পারি, শুধু তাকে আমার হয়ে থাকতে হবে। এদিক সেদিক উঁকি বাজি করা যাবে।”

“আমি তোমার প্রিয় মানুষ?”

রিমঝিম উত্তর দেয় আমার গালে হঠাৎ আদরে। ঘরটা তখন অনেক বেশি আপন লাগছিলো। বুঝলাম, বিসিএস একটা পরীক্ষা, হার-জিত থাকবে। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া আমার জন্য রিমঝিম।

এতটুকু পড়ে ডায়েরি বন্ধ করে নেয় রিমঝিম। এরপর সব লজ্জার কথা, রিমঝিমের অনর্থক সন্দেহ আর ঝগড়ার, মৃদু বাতাস ছুঁয়ে দেয় রিমঝিমকে, রুবায়েত তো মাফ চেয়ে নিয়েছে এবার পালা রিমঝিমের। তক্ষুনি দেখলো কচি একটা ব্যাগ হাতে এগিয়ে আসছে, পেছনেই শ্যামলী। বুঝতে পারলো রুবায়েত বাজার পাঠিয়েছে।

____________________

সকালের আলোটা গ্রামটা জুড়ে মায়াময়ভাবে ছড়িয়ে ছিল। রুবায়েত সাইকেলটা নিয়ে প্রথমে স্থানীয় বাজারে গিয়েছে। অল্প করেই মাছ নিয়েছে। ফ্রিজ নেই, এই এক জীবন মন্দ না। আশ্চর্য লাগে রিমঝিম পর্যন্ত মানিয়ে নিয়েছে। টুং করে ম্যাসেজ আসলো, বিরক্ত লাগে মোবাইল কোম্পানি সারাদিন ম্যাসেজ পাঠায় যেন রুবায়েতের বিয়ে করা বউ। মাছ সহ আরও কিছু কিনে কচিকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল বাসায়। ও এখন একটু সুনামগঞ্জ শহরে যাবে।

সুনামগঞ্জ জেলার গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পেরিয়ে সে শহরের দিকে রওনা দিল। পাশ দিয়ে ধানের খেত, সোনা রোদ ছুয়ে যাচ্ছে সব জায়গা। কোথাও কোথাও বকের দল উড়ে যাচ্ছে, লেক আর পুকুরে মাছরাঙার দেখা মিললো।রুবায়েতের মনটা হালকা লাগছে আজ। কাল রাতের কথা ভেবে হেসে ফেললো রিমঝিম একটু বেশি সরল। এজন্য হয়তো কথা প্যাচাঁতে জানে না, সোজাসাপ্টা সব বলে দেয়।

শহরে এসে হকারের দোকানগুলোর দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করলো না। ও জানে, রিমঝিম একটু সুন্দর সুতি বা তাতের শাড়ি পছন্দ করে।

একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকে গেল রুবায়েত। সরু গলির দুই পাশে কাপড়ের দোকান। দোকানটি মাঝারি আকারের হলেও সাজসজ্জা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। দোকানের সামনের দিকে একটি বড় সাইনবোর্ড রয়েছে, যেখানে দোকানের নাম আর মোবাইল নম্বর পরিষ্কারভাবে লেখা।

ভিতরের অংশে কাপড়গুলো সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখা আছে।একদিকে শাড়ি, অন্যদিকে সালোয়ার কামিজের কাপড়, আবার একটি কোণে পাঞ্জাবি এবং লুঙ্গির জন্য আলাদা শেলফ। রুবায়েত টুলে বসে পরলো। দোকানের কর্মচারী ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো কি লাগবে। শাড়ির কালেকশন বেশ বৈচিত্র্যময়—ব্যানারসী, জামদানি, কাতান, তাঁত, সুতি,সিল্ক।সবই পাওয়া যায়। তবে সুতি মনের মতো শাড়ি পেতে রুবায়েতকে বেগ পেতে হল। একদম সাদামাটা মার্জিত এরকম শাড়ি খুঁজে নিয়ে নিল। গোলাপি আর সাদার মিশেল। তারপর কল্পনা করলো রিমঝিম যদি খোঁপায় কাঠগোলাপ দেয় তবে বেশ হবে। সাইকেল চালাতে চালাতে, ভাবছিল রুবায়েত কখনো, কখনো দূরত্ব কাছে আসার বেশ কাজে লাগে। তবে ডিভোর্স পেপারের বিষয়টা ও ভুলেনি। এই বাড়াবাড়ি টুকুর শাস্তি রিমঝিমের পাওনা।
___________________

ময়না এসে দরজার পাশে বসে আছে, এই মেয়ে কখনো খালি হাতে আসে না আজ নিয়ে এসে আমড়া মাখা। রিমঝিম অবশ্য এখন ব্যস্ত হয়ে রান্না করছে, আজ দুপুরে রান্না করতে একটু দেরি হয়ে গেছে। কই মাছের দো-পেয়াজা আর ডাল ব্যাস। রুবায়েত সেই সকালে বের হয়েছে আসছে না কেন?এখন চিন্তা লাগছে রীতিমত। এদিকে ময়না বক বক করেই যাচ্ছে।

“ডাক্তার সাব আমার রান্না যে কি ভাল কইতো।”

রিমঝিম দায়সারা উত্তর দিলো “তাই।” মাথাটা গরম হচ্ছে।

“না তো কি? আমি তো কত এসে চা বানিয়ে দিতাম।” গা দুলিয়ে হাসছে ময়না। “ অনেক ভালো ডাক্তার সাব।”

রিমঝিমের হঠাৎ রাগ লাগছিল, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ময়নাকে চেষ্টা করেও সন্দেহের আওতামুক্ত রাখতে পারছে না, ফলে মনে মনে একটা দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব বাড়ছে। “ ময়না, আমি এখন গোসলে যাব তুমি বাসায় চলে যাও আমি দরজা লাগাবো।”
ময়না স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে চলে গেল তবে মুখে একটা রহস্যময় হাসি লেগে রইলো।

রিমঝিম অশান্ত মন নিয়ে, গায়ে পানি ঢালতে লাগলো। নিজেকে নিজেই বলতে লাগলো, তুমি এখানে সম্পর্ক ঠিক করতে এসেছ। নতুন কোন প্যাচ লাগাতে না, সবর কর। রুবায়েত শুধু তোমার। গোসল সেরে, তাঁতের একটা শাড়ি পরে নিল। হালকা সাজগোছ করলো। মনের ভিতর খচ খচে অনুভূতি নিয়েই আবার ডায়েরি খুলে বসলো,

২৫.২.২০২৫

এই দিনটি আমি কখনো ভুলতে পারবো না। এদিন আমি আবিষ্কার করি রিমঝিম দারুন সন্দেহপ্রবণ একটা মেয়ে। আমি বেশ স্বাভাবিকভাবে রিমঝিমকে আমার প্রথম ভালবাসা, প্রেম অথবা ভালো লাগা নিয়ে বলেছিলাম। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি পাশের বাসার একটা মেয়েকে ভালো লেগেছিলো। নাম ছিল মিতা। দুইজন সমবয়সী ছিলাম। বারান্দা দিয়ে, ভাব বিনিময় হতে হতে একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সম্পর্কটার মাস না পেরোতেই ওর বাবা ওকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। তারপর আমরা বাড়ি ছেড়ে দেই, খারাপ লেগেছিল কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু এতোটুকুই। হয়তো সেটা একটা মোহ ছিল মাত্র। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিমঝিম বাড়িতে কেয়ামত নামিয়ে আনলো।

এইটুকু শুনেই রিমঝিমের মুখের রঙ বদলে গেল কেমন, চোখ বড় বড় করে বলল

“তুমি আমাকে আজ এতদিন পর এসব বলছো? এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলে? সেটা কি তাহলে তোমার প্রথম প্রেম? এখনো ভাবো তাকে?”

আমি অবাক হয়ে গেলাম,
“না, মানে… আমি ভাবিনি এটা বলার মতো কিছু। অল্প বয়সের একটা ভাল লাগা মাত্র।”

কিন্তু আমার উত্তর রিমঝিমকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এরপর লাগাতার সে আমার উপরে ঝাল ঝাড়তে থাকে। একসাথে থেকে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আমরা যেন দুই মেরুর দুই বাসিন্দা হয়ে যাই।

আমি যা করি তাতেই ওর সন্দেহ চুপ থাকলে এসে বলবে, “ মিতাকে ভাবছো?” এমন কি হাতে মোবাইল দেখলেও সন্দেহ। অতিষ্ঠ হয়ে
ফেসবুকের পাসওয়ার্ড পর্যন্ত দিয়ে দিতে হয়েছিল। তারপরেও রিমঝিম যেন সন্তুষ্ট না। একদিন বললো,
“তুমি ভাবো আমার কেমন লাগে?আমি কেমন অনুভব করি?যাকে আমি আমার প্রথম এবং শেষ বলি, সে কিনা আগেই অন্য কাউকে ভালোবেসে এসেছে!”

সেদিন সত্যিই মনে হয়েছিল, বাড়ির ভেতর একটা ছোটখাটো কেয়ামত নেমে এসেছে। আমি যেন কোনো অপরাধ করে ফেলেছি, অথচ রিমঝিমের প্রতি আমার ভালোবাসা গুলো রিমঝিম বুঝতে পারছিলো না। দিনে দিনে যেন আরো খ্যাপা হয়ে যাচ্ছিল। সারাদিন যেন এগুলো চিন্তা করে।
আমি হয়তো মুখে অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারি নাই, কিন্তু তাই বলে রিমঝিম আমার নিশ্চুপ ভালবাসা বুঝবে না? আমার যে এত কষ্ট হচ্ছে সেগুলো ওকে স্পর্শ করে না?

রিমঝিম, জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো, বেশ বেলা হয়ে এসেছে, রুবায়েত এখনো আসে না কেন?

এই বিষয়টা ডাক্তার রাবেয়াকে বলার পরে অনেকক্ষণ চুপ ছিলো। তারপরে বলেছিল—- “আমাদের হৃদয়ের অসুখের ঔষুধ আমাদের নিজেদের কাছেই আছে। আপনার স্বামী টিনেজ বয়সে একজনকে ভালোবেসে ছিল অথবা মোহ ছিল। আপনি সেটাকে এত কেন খোঁচাখুঁচি করছেন? কোন প্রমাণ তো পাননি? তাহলে? সেই অতীত ঘেটে কি হবে যা এখন বর্তমান নয়? আপনার কষ্ট, আপনি তার প্রথম নন কিন্ত সে আপনার প্রথম । আসলে কি জানেন এভাবে ভালোবাসা মাপা যায় না। যতটুকু শুনলাম আমার মনে হলো আপনার স্বামী আপনাকে অনেক ভালোবাসে। আপনি অনেকগুলো ভুল করেছেন, আপনি কিভাবে তার ফেসবুকে পাসওয়ার্ড নিতে পারেন?”

সেদিন রিমঝিম অনেক লজ্জা পেয়েছিল। রিমঝিম নিজেকেই শোনালো, “ আমি আর নিজের মনের ফাঁদে পা দেবো না, আমার সমস্ত বিশ্বাস আমি রুবায়েতকে দিতে চাই।”

ঠিক তখনই দরজায় কেউ আঘাত করলো। দরজা খুলে ঘামে ভেজা রুবায়েতকে দেখে রিমঝিম এর হৃদয় একটা কেমন করুনার ঝড় উঠলো। দরজায় দাঁড়ানো রুবায়েতকে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রিমঝিম। তারপর ফিসফিস করে বলল, “একমাত্র আমি মারা গেলে তুমি অন্য কারো হাতে চা খাবে, এর আগে না! বুঝলা?”

রুবায়েত পুরাই অবাক আর অপ্রস্তুত হয়ে গেল। “আমি এই কয়দিন অন্য কারো বানানো চা খাইনি তো।”

রিমঝিম মাথা তুললো চোখে জল চিকচিক করছে, “সত্যি?”

রুবায়েত ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সব সময় সত্যি বলি কিন্তু তবুও তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না।” কন্ঠে অভিমান ছলকে উঠলো।

চলবে…

রিমঝিম বৃষ্টি
কাজী জেবুন্নেসা

পর্ব-৭

সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। জানলার কাঁচ বেয়ে টুপটাপ জল গড়িয়ে পড়ছে। বাইরে তাকিয়ে রিমঝিমের মন খারাপ হয়ে আছে। আজ তো তাদের ঘুরতে যাবার কথা ছিল! রুবায়েত বলেছিল, কাল সে ওকে লেকের পাড়ে নিয়ে যাবে। পাহাড়, জল, আকাশ আর সবুজ ঘাস… এমনিতেই এই গ্রামটা অপূর্ব সুন্দর। প্রকৃতির এত কাছে এসে মন জুড়িয়ে যায়, কিন্তু আজ সেই পরিকল্পনাই মাটি।

কাল অবশ্য সাইকেলে চেপে মৎস্যপল্লীতে গিয়েছিলো। রাস্তার উপর ময়নাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, আচ্ছা চা নিয়ে মিথ্যেটা কে বলল? একটা নি:শ্বাস ফেললো, জানতে হবে। ছেলেবেলায় পড়া রহস্য গল্পের মত চালাতে হবে অনুসন্ধান। আজ খিচুড়ি করছে….উঁকি দিয়ে দেখলো রুবায়েত মোবাইলে পড়ছে। কালও সরি বলা হয়নি ওকে। মনে মনে কয়েকবার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু ঠিক কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারেনি।একটা পরিকল্পনা করেছে আজ সকালে বসে বসে। মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

জানলা দিয়ে গাছের পাতা বেয়ে টুপটাপ বৃষ্টি ঝরা দেখে একটা কথা মনে হল, ওর কাল অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছে, প্রতিটি মানুষ রুবায়েতকে কি যে ভালোবাসে। সবাই কত দুয়া করে। কেমন একটা গর্ব হয়েছে। আর একটা মেয়েকে যে চেয়ারম্যানের খপ্পর থেকে বাঁচিয়েছিলো সেই গল্প সবার মুখে মুখে। এইসব শুনে একটা অন্যরকম আবেগে ভরে যায় মনটা। অথচ ঢাকায় থাকা অবস্থায় দোলন আপা যখন এমন প্রশংসা করত রুবায়েতের, তখন রিমঝিমের ভেতরে হিংসের অজানা কাঁটা বেঁধে যেত। কী ভুলটাই না করেছিল ও।

রুবায়েত রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ালো, রিমঝিম জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। একটু বাদেই বের হতে হবে ভাবলো রুবায়েত, আরও কিছু এলাকায় পানিবাহিত চর্ম রোগের প্রকোপ দেখা গেছে। এদিকে এই ভদ্রমহিলা তো হারিয়ে গেছে কোথাও। খুক খুক করে কাশি দিল।

রুবায়েতের উপস্থিত টের পেয়ে নড়ে উঠলো রিমঝিম, “নাস্তা হয়ে গেছে। তুমি বসো, আমি ডিম ভেজে নিয়ে আসি,” রিমঝিমের গলায় যেন একরকম উদাস ভাব। অদৃশ্য একটা দুরত্ব জমে আছে কথার ফাঁকে।

রুবায়েত এগিয়ে গিয়ে ওর পেছনে দাঁড়ালো, “আজ বেড়াতে নিয়ে যাব, বৃষ্টি হলেও। যেন ঢাকায় গিয়ে কোন আফসোস না থাকে।”

“আমি ঢাকায় চলে গেলে তোমার খুব খুশি লাগবে? সিগারেটকে আমার জায়গা দেবে, নাকি অন্য কেউ…?” রিমঝিম ধীরে ঘুরে তাকাল। চোখে একটু প্রশ্ন, একটু অভিমান।

“আমার কথা কেন আসছে? আমি তো পুরো বিষয়ে ভিকটিম মাত্র!” সহজ গলায় বললো রুবায়েত, খিচুড়ির ঘ্রান নিয়ে একটা সুন্দর মুখভঙ্গি করলো।

রিমঝিম আর কিছু বলল না। চুপচাপ মাথা নিচু করল। তবে মনে মনে ঠিক করেছে, সব কথা আজ খোলাখুলি বলবে। একটু নাটকীয় হবে ঠিকই, কিন্তু সত্যি হল রিমঝিম ঠিক এমনিই নাটকীয়তা ওর পছন্দ।

______________________

আজ তেমন রান্নাবান্না করল না, কে যেন তার পোষা কবুতরের মাংস পাঠিয়েছে গিট্টুর হাতে, নাম রহিম শেখ, গিট্টু বললো তার ছোট ছেলের নাকি খুব জ্বর হয়েছিল একদিন রুবায়েত অনেক রাতেই তার বাসায় গিয়ে চিকিৎসা করে, সেই থেকেই মাঝেমধ্যে এটা সেটা পাঠায়। তারপর মুখ গোল করে বলল,

“ডাক্তার সাব তো অনেক রাগ করেন। কিন্তু আপনার কথা শুনে, আজ জোর কইরা কবুতরের মাংস দিয়া দিছে। রাখেন, ভালোবেসে দিছে বইলা।”

এতটুকু ছেলের মুখে এই রকম কথা শুনে রিমঝিম হেসে ফেললো, “ আচ্ছা গিট্টু ময়না বুঝি খুব আসতো এই বাসায়?” তারপর সাবধানে সহজ গলায়, “ ডাক্তার সাহেব কে রান্না করে দিতে বা চা…”

“কি যে বল ! নানী ছাড়া আর কাওরে ঘরে ঢুকতেই দিত না ডাক্তার সাব, শ্যামলী’বুও না।”
তারপর একটু চুপ করে থাকলো, “তয়, ময়না’বু দুই তিন দিন খাবার লইয়া আইছিল যখন ওর মায়ের অসুখ আছিল। ক্যান কি হইছে?”

“এমনি জিজ্ঞেস করলাম, একা ছিল কে কি করে দিত খবর নিলাম আরকি! এসব কিন্তু তোমার আর আমার সিক্রেট, সিক্রেট অর্থ জানো?”

গিট্টু মাথা ঝাকালো, “ জানি!”

রিমঝিম ওকে দুইটা বিস্কুট খেতে দেয়।

গোছল করতে যাবে, কাপড় নিতে ড্রয়ার খুলেই একটা প্যাকেট আবিষ্কার করলো। কি সুন্দর একটা শাড়ি, একটা চিরকুট — “ কাউকে কোনদিন বলা হয়নি গোলাপি আমার প্রিয় রঙ, তবে নিজে পরব বলে না, প্রিয় মানুষ পরবে তাই।” রিমঝিমের মুখে অপার্থিব একটা হাসি ফুটে উঠলো। গোছল সেরে, এক বাটি পেয়ারা কাটা নিয়ে প্রতিদিনের মত ডায়েরি নিয়ে বসলো রিমঝিম, আজ পুকুর পাড়ে বসেছে। ভেজা ভেজা বাতাস আর ফুল গুলোর টুপটাপ মাটির সাথে দোস্তি খুব মনমুগ্ধকর বিষয়।

২০.০৩.২০২৫

রিমঝিম আর আমার দাম্পত্য সম্পর্ক মোটামুটি চলছিল। রিমঝিমকে বুঝতে পারা একটু কঠিন। খুব উচ্ছ্বল প্রানবন্ত একটা মেয়ে। আবার কখনো এই মেয়েটই কেমন জানি অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবন হয়ে যায়, রহস্যময় আচরণ করে। অতিরিক্ত আগলে রাখার প্রবনতাও আছে।
মিতাকে নিয়ে আমাকে সন্দেহ করা শুরু করেছিল, অথবা আমার উপরে যে রাগ অভিমান ছিল সেটা এখন কেটে গেছে আলহামদুলিল্লাহ। মাঝেমধ্যে আর কিছু খোঁচা দেয় আমি এড়িয়ে যাই। আমি বুঝে গেছি রিমঝিমের সাথে খুব বুঝে কথা বলতে হবে, সরল মনে কিছু বলে ফেলব তারপর প্রতিক্রিয়া চলতেই থাকবে।

এতোটুকু করে রিমঝিম পুকুরে একটা ঢিল মারলো, পেয়ারার টুকরো মরিচ মাখিয়ে মুখে তুললো।

ডাক্তার রাবেয়া বলেছিল, আপনি কিন্তু আপনার স্বামীর কথা বলা বা কোন কথা ভাগ করে নেওয়ার বিষয়টাকে গলা টিপে নিজে হত্যা করেছেন। তবে এটা আপনার দোষ না, আপনার মনে যে সন্দেহ দানা বাঁধে সেগুলোর উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই। আপনি একজন অতিরিক্ত চিন্তাশীল এবং সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি। আপনি সব কিছু বিশ্লেষণ করতে,করতে এমন কিছু নিয়েও সন্দেহ করেন, যেগুলো আসলে তেমন গুরুতর না। সন্দেহ আপনার ভেতরে এমনভাবে গেঁথে বসেছে যে অনেক সময় আপনার নিজেরই নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যাদের এমন প্রবণতা থাকে, তারা প্রায়ই অন্যদের আচরণে গোপন উদ্দেশ্য খোঁজে, মনে করে সবাই যেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে,তাই না? তবে সুখের কথা আপনি বুঝেছেন আপনার সমস্যা।বোঝাটাই হলো সমাধানের প্রথম ধাপ।
আবার পড়া শুরু করলো,

৫.৪.২০২৫
আমার সাথে রিমঝিমের দিনগুলো আবার ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ যেন আবার আমার জীবনে কালবৈশাখী আনাগোনা শুরু হলো, এবার যাকে নিয়ে রিমঝিম কথা তুলল সে হচ্ছে দোলন আপা। আমার মনে হচ্ছিল রিমঝিমকে কষিয়ে একটা থাপ্পর দেই। দোলন আপা আর আমরা ছেলেবেলা থেকে এক এলাকায় বেড়ে উঠেছি। দোলন আপা আসলে আমার বন্ধু সুমনের বড় বোন। সুমন মালয়েশিয়ায় গিয়ে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তারপর থেকে আমি ওদের বাসায় যাতায়াত করতাম, বিশেষ করে খালাম্মার শরীরের বিভিন্ন খোঁজখবর নিতে। দোলনা আপার হাজবেন্ড সৌদি প্রবাসী, ছোট একটা মেয়ে আছে। আমরা একই বিল্ডিং এ থাকি আজ প্রায় তিন বছর। যাই হোক, আমি ডাক্তার এবং খালাম্মা আমাকে নিজের ছেলের মত জানে, তাই ছোটখাটো বিষয় হলেও আমার ডাক পড়ে যায় দোলনা আপার বাসায়। রিমঝিম বিষয় গুলো জানে। আর দোলনা আপার সাথে ওর বেশ ভালো গল্প হয়, তারপরও একদিন রাতে দোলন আপা যখন ফোন দিয়ে বলে আমাকে একটু উপরে যেতে খালাম্মার প্রেশার টা আপডাউন করছে। তখন রিমঝিম আমার হাত চেপে ধরে।

ঠান্ডা গলায়, “তুমি কি তাদের ফ্যামিলি ডাক্তার? কখনো দোলন আপুর সমস্যা, কখনো তার মেয়ে কখনো আন্টি। আচ্ছা, তুমি কী কখনো সময়টা দেখো? রাত ১১টা ৪৩ বাজে, রুবায়েত। এই সময় খালাম্মার প্রেসারই কেবল ওঠানামা করে, না কি কিছু সম্পর্কও?

আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম, “ আমি একজন ডাক্তার রিমঝিম! তুমি আমাকে কী বোঝাতে চাও? আমি কি খারাপ কিছু করছি? নিজেকে এত ছোট কর না প্লিজ!”

“ যতবারই ওর বাসায় যাও, কেন যেন ঘন্টা পার হয়ে যায়! প্রেসার মাপতেই কি এত সময় লাগে?”

আমি ক্লান্ত কন্ঠে বললাম, রিমঝিম, প্লিজ—তুমি জানো দোলন আপা সুমনের বোন, আর খালাম্মা আমাকে নিজের ছেলের মত দেখেন! উনি বিভিন্ন গল্প বলেন আমি….

রিমঝিম ঠাণ্ডা হেসে বললো,অবশ্যই জানি। আরও জানি যাদের হাসব্যান্ড প্রবাসী তাদের কত কাহিনি থাকে… ফেসবুকে দেখি তো কত পরকিয়ার গল্প।”

আমি বুঝতে পারি কি বোঝাতে চাচ্ছে রিমঝিম, একটা থাপ্পড় দেওয়ার ইচ্ছে দমন করতে নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু করে দেই, “তুমি আমাকে অপমান করছো এখন!”

এরপর আমি চেষ্টা করি দোলন আপুদের এড়িয়ে যেতে। আপুরাও হয়ত বুঝে তাই তো খালাম্মার গুরতর শরীর খারাপেও আমার আর ডাক পরে না।

রিমঝিম ডাইরি বুকে নিয়ে কাঁদতে লাগলো। ও কাউকে বোঝাতে পারে না, ফেসবুকে একটা গ্রুপে এরকম অনেক গল্প পড়েছে। প্রতিটি গল্প ওর আত্মা কাঁপিয়ে দিতো। এতটা নিচে নামতে চায়নি, কিন্তু দোলন আপু ছাদে গেলেই ওর সাথে শুধু রুবায়েতের গল্প করত। রুবায়েতের চেয়ে উনি বছর চারেকের বড়। রিমঝিম সহ্য করতে পারত না। মনে কিসের যেন কাটা বিঁধে থাকতো।

৬.৬.২০২৫

এখন আমি যাচ্ছি, সুনামগঞ্জ, আমাদের বিয়ের ছয় মাস পূর্তির দিন এমন কিছু হয় যাতে আমাদের বিয়ে ভাঙার দোড়গোড়ায়। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না, আমার হাতে সত্যি রিমঝিমের পাঠানো ডিভোর্স লেটার। একে আমার ভিতর সীমাহীন অনুশোচনা নিজের রুগীকে সময়মতো চিকিৎসা দিতে না পারার, অপরদিকে আমি রুবায়েত নিজের স্ত্রীর গায়ে শেষ পর্যন্ত হাত তুলেই ফেলি।

আমাদের বিয়ের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে রিমঝিম বিয়ের শাড়ি পড়ে খুব সুন্দর করে সেজেছিলো। রিমঝিমের মানসিক কিছু দুর্বলতা থাকলেও একজন স্ত্রী হিসেবে সে খুবই চমৎকার। রান্নাবান্না করেছিল নিজ হাতে কেক ও বানিয়েছিল। অপেক্ষা রাত বারোটা বাজার। হঠাৎ দোলন আপু ফোন দিল, পাগলের মত কান্নাকাটি করছিল। খালাম্মার আমার অবস্থা মোটেও ভালো না। আমি তখনই যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু এই বিপদেও রিমঝিম আমাকে ওর বিশ্বাসটা দিল না।

আমি ডাইনিং টেবিলের উপর লাল টুকটুকে কেকটা দেখি,একপাশে পাশে একটা ছোট চিরকুট:
“ছয় মাস তোমার সাথে—আমার জীবনের সেরা সময়।এ সফর জান্নাত পর্যন্ত দীর্ঘ হোক প্রিয় স্বামী।” আমারও খারাপ লাগছিলো, কত আয়োজন করেছে মেয়েটা। কিন্তু একজন ডাক্তারের কাছে রুগি অগ্রগন্য। আমি দ্রুত তৈরি হচ্ছিলাম,

রিমঝিম একটু কাঁপা গলায় বলল, “তুমি এখন কোথায় যাবে?”

আমি কি বলব? এত অসহায় লাগছিলো, “রিমঝিম শোন, খালাম্মার শরীরটা খুব খারাপ, শুনে মনে হচ্ছে ডায়বেটিস ফল করেছে। আমার যাওয়াটা খুব দরকার একটু বোঝার চেষ্টা করো!”

“অন্তত আরও দশ মিনিট।” ঘড়ির দিকে তাকালো, এই তো বারোটা বেজে যাচ্ছে।” রিমঝিমের গলা যেন কেমন করে উঠল।

আমি বিরক্ত হই, “রিমঝিম, একজন রুগী মরতে বসছে! তুমি বুঝতে পারো না?”

রিমঝিম থেমে গেল, কিন্তু চোখে ছিল একরাশ অবিশ্বাস। “দোলন আপুর আম্মা কি সত্যিই অসুস্থ?”এরপর নিজের মাথার খোঁপা খুলে ফেললো, কেক টা উলটে দিয়ে বললো, “ সব উনার ষড়যন্ত্র, আজ বিকেলে এসেছিল মেয়েকে নিয়ে আমাকে কেক বানাতে দেখে গেছে।”

আমি স্তম্ভিত হয়ে ওর কান্ড দেখলাম, “ তুমি কি বলছ এসব? পাগল হয়ে গেছ?”

এই এক প্রশ্ন যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিল। “ হ্যা, রুবায়েত ঠিক তাই। উনার স্বামী বিদেশ তাই উনি সহ্য করতে পারছেন না আমি স্বামী নিয়ে সুখে আছি। আর তুমিও যে তাকে…”

আমার মাথায় কিছু একটা বিস্ফোরণ হল, “চুপ করো!”

“করব না, আমি ঠিক সন্দেহ করেছি, কিছু একটা চলছে…

আমি জানি না কিভাবে কি হয়ে গেল,ঘরের নিস্তব্ধতায় শুধু সেই শব্দটাই রয়ে গেল। একটা চড়, যার ওজন যার মূল্য ব্যাথার চেয়ে ঢের বেশি।
রিমঝিম এক হাতে গাল চেপে ধরে চুপ করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। চোখে জল, কিন্তু কোনো চিৎকার না, অভিযোগ না শুধুই ঘৃনা।

আমি ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেলাম।

এই যে দেড়ি করলাম তার ফল ভোগ করলো খালাম্মা। উনার একটা স্ট্রোক হয়ে যায় ইতিমধ্যে। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয় যেন কীটপতঙ্গ। আমার নিজের স্ত্রী কি ভীষণ অবিশ্বাস করে আমাকে। উনি যখন আই সি ইউ তে আমি তখন বোকার মত সব ঝাপসা দেখছি চোখে।

পরদিন বাসায় এসে রিমঝিম কেন পাইনি। তাই ওকে জানাতেও পারিনি যে খালাম্মার অসুস্থতা মিথ্যা ছিল না। ভদ্র মহিলা এখনো আইসিইউতে। যাইহোক মাথা যখন ঠান্ডা হলো আমি ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম কিন্তু রিমঝিম আমার ফোন ধরে না। আমি আরও কয়েকটা নাম্বার দিয়ে চেষ্টা করলাম, লাগাতার দুই দিন। কিন্তু কোন রেসপন্স নেই। আমারও রাগ আছে, ঠিক করলাম ওকে ফিরিয়ে আনতে যাব না। প্রত্যেকটা মানুষের প্রায়শ্চিত্ত করার অধিকার আছে,করুক। আমার মনে হয় রিমঝিমের কাউন্সিলিং দরকার। মেয়েটা খুব ভালো। মোটেও খারাপ না শুধু খুব প্রভাবিত হয়ে যায় কিছু বিষয় দ্বারা। ভালোবাসা থেকেই ইনসিকিউরিটি এটা আমি জানি৷ আমার বিসিএস টা হয়ে গেলেই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব ইন শা আল্লাহ।

কিন্তু এরমধ্যেই দুর্যোগের মতো বাসায় ফিরে একদিন টেবিলের উপরে একটা খামে ডিভোর্স পেপারটি আবিষ্কার করি। আক্ষরিক অর্থে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। আমার জন্য এটা খুব অসম্ভব একটা জিনিস। আমি এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমি ঢাকা ছেড়ে যাব অন্তত কিছুদিনের জন্য নিজের মাথাটা ঠান্ডা করতে হবে। আমার অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য হলো, ক্ষমা করতে না পারা। পুরনো রাগ, অপমান বা ভুল বোঝাবুঝি সহজে ভুলতে পারি না। এটা অবশ্য ইন্ট্রোভার্ট দের কমন সমস্যা। বিয়েটা ভেঙে যাচ্ছে এ যন্ত্রণা কি শুধু আমার? না আমি রিমঝিম এর সাথে বা ওর পরিবারের সাথে কোন কথা বলবো না!

রিমঝিম ডায়েরি টা বন্ধ করল, জোরে দুইটা নিঃশ্বাস নিল। আকাশ কালো হয়ে মেঘ করেছে বৃষ্টি হবে। সেদিকে তাকিয়ে বিপন্ন বোধ করে।
ওদের বাসায় যেদিন ডিভোর্স পেপারটা দিয়ে আসে রিমঝিম। সেদিন ডায়েরিটা আবিষ্কার করে টেবিলের উপরে। এরপর দিন, গ্রোসারি শপে দেখা হয়ে যায় দোলন আপুর সাথে। রিমঝিমের এত রাগ হয় মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু আপুই সাথে কথা বলেন,
“আম্মা তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলো, গতকাল হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। চলো বাসায় নিয়ে যাই তোমাকে!”

রিমঝিম মানা করতে পারে না, গিয়ে আবিষ্কার করে খালাম্মা আসলেই খুব অসুস্থ। দোলন আপু নাস্তা দিতে দিতে বলেন, জানো না তো আম্মার স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল ওই দিন। ভাগ্যিস রুবায়েত ছিল।

খালাম্মার এই অবস্থা দেখে ও অনুতপ্ত হয় অনেক বেশি, নিজেকে ধিক্কার দেয়।খালাম্মা জড়ানো গলায় বলেন, “ ছেলেটা অনেক ভালো, আমার সুমনের মত। হুট করেই যে ঢাকা ছেড়ে সুনামগঞ্জ চলে গেল?”

“হ্যাঁ একদম। সুমনের মতই, আল্লাহ অনেক বড় করবেন। আরে মা, ডাক্তার মানুষ নিশ্চয়ই কোন কাজেই গেছে।”

রিমঝিম হতবুদ্ধি হয়ে যায়, মনে মনে ভাবে, “রুবায়েত চলে গেল এভাবে?” সেদিন আরও আবিষ্কার করে, দোলনা আপুর সাথে তার বরের সম্পর্ক খুব ভালো। সারাক্ষণ দুইজন মোবাইলে কথা বলছে৷ আপু ঘরে নিয়ে নিজের বিয়ের অ্যালবাম দেখালেন, কত গল্প করলেন ভাইয়ার আর উনার। তারপর বললেন, রুবায়েত মুখে কিছু বলে না কিন্তু আমি আর মা বুঝতে পারি তোমাদের সংসার অনেক সুখের। তোমার রান্নার প্রশংসা করার সময় রুবায়েতের চোখে মুখে একটা প্রশান্তি ফুটে উঠে। আল্লাহ তোমাদের সংসারে এভাবেই তার রহমত ছড়িয়ে রাখুক।

সেদিন বাসায় এসে ডায়েরিটা পড়ে রিমঝিম অনেক কান্নাকাটি করে। আয়নায় নিজের দিকে তাকাতে পারে না। এটা কি করে ফেলেছে…ফেসবুকের সেই গ্রুপ গুলো থেকে লিভ নিয়ে নেয়।

রিতার সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বললে, রিতা বলে উত্তর কিন্তু ডাইরিতেই আছে।

রিমঝিম অবাক হয় “কি?”
“তোর কাউন্সিলিং লাগবে।”

“আমি আগে ওর কাছে যেতে চাই, এই ফাঁকে যদি অন্য কেউ… রিমঝিম ছিটফট করে উঠে।”

“আবার!….না, তুই এখন গিয়ে আবার একই ভুল করবি। আগে অন্তত সাত দিনের একটা কাউন্সিলিং কর। তোর এই স্বভাবের জন্য, তোর তেমন কোন বন্ধু নেই অথচ তুই মেয়েটা খুব ভালো। প্লিজ দোস্ত আগে কাউন্সেলিং করা।”

রিমঝিম ও মেনে নেয়, কিন্তু প্রতিটা দিন ওর জন্য যাচ্ছিল একটা বছরের মত। মন পড়ে ছিল রুবায়েতের কাছে। বাসায় কিন্তু কিছুই বলে নি। রুবায়েতের ঠিকানাটা যোগাড় করতে কষ্ট হয়নি, ও শাশুড়ি দিয়েছিল উনি জানতেন।
এসব ভাবতে ভাবতে… ঝুপ করে বৃষ্টি নেমে গেল, রিমঝিম ঘরের দিকে দৌঁড় দিল। পুকুরের পাড়ে পরে রইলো ডায়েরিটা। কেউ সেটা তুলে নিল…..

চলবে……

#রিমঝিম_বৃষ্টি
#কাজী_জেবুন্নেসা