রুশো পর্ব-০২

0
22

রুশো

__________________

এরপর থেকে রুশোর সামনে পড়ে গেলে আমার অস্বস্তি বেড়ে যেত। মনে হতো এই লোকটা আমার দিকে তাকালেই ভেতরের সব গড়গড় করে পড়ে ফেলছে। আমি লুকতে পারছি না তার থেকে নিজের একাংশও। ঠিক যেন দমকা হাওয়ায় মেলে যাওয়া খাতার পৃষ্ঠার মতো একে একে জানিয়ে দিচ্ছি ভেতরে লেখা সব গল্প, সব কথা।

আমাদের অনুষ্ঠানের যোগ ছিল বোধহয়। যতবার একে অপরের সাথে ঘটা করে কথা বলেছি সব ছোটোখাটো কোনো অ্যারেঞ্জমেন্টের বাহানায়৷ এইত সেবার, দোতলার ভাড়াটের মেজো মেয়ের বিয়ে। হলুদ, মেহেদি থেকে আকদ পর্যন্ত ওদের সমস্ত প্রোগ্রামে ডেকোরেশনের দায়িত্ব পড়ল আমার কাঁধে। আর্টিস্ট বলে সুনাম আছে কিনা! এসব কাজে কখনো ক্লান্তিবোধ না করলেও কাজ করতে গিয়ে যখন দেখলাম সব দায়িত্বের বোঝায় আমি একা একটা মেয়ে, আমার সাথে কেউ নেই সাহায্য করার। তখন একটু চাপ লেগে গেল। কিন্তু কথা দিয়ে ফেলেছি। শেষ মুহুর্তে টার্ন করা সম্ভব নয়। অগত্যা, জিনিসপত্র কেনাকাটা থেকে শুরু করে সব প্ল্যান রেডি করে ইমপ্লিমেন্টও করতে লাগলাম একা হাতে। কাজের ভার দেখে মানবিকতার দোহাইয়ে মাঝখানে দু একজনকে পেয়েছিলাম হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে, কিন্তু কারোর কাজ পছন্দ হচ্ছিল না আমার। শেষে কাজ না নষ্ট হয় এই ভয়ে সক্কলকে তাড়িয়ে একা হাতেই চতুর্দিক সামলাতে লাগলাম।
এরপর যা হওয়ার, তাই। সারাদিন খেয়ে না খেয়ে, চরকির মতো বাজার টু বাসা ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যায় হুট করে শরীর খারাপ করতে শুরু করল। অবস্থা এমন, প্রচন্ড মাথা ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম আমি। কাজ বাকি তখন সামান্য, গাঁদা ফুলের মালা গেঁথে হলুদের স্টেজটায় সাজিয়ে দিলে কাজ শেষ। অতটুকুই আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। মুখ ফুটে যে কাউকে বলব অসুস্থতার কথা! সবার হাসিখুশি মুখ আর হৈ হুল্লোড় দেখে ইচ্ছে করল না। বাধ্য হয়ে মেঝের একদিকে বসে মাথা নামিয়ে দ্রুত হাতে মালা গাঁথতে গাঁথতে ব্যথাটাকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছি, অমনি আকাশি রঙের একটা বোতল কে যেন বাড়িয়ে ধরল আমার দিকে। চমকে উঠে মুখ তুলে দেখি রুশো। আমি তাকাতে মৃদু হেসে বলল,

— অ্যানার্জি বুস্টার। খেলেই জোশ ফিরে আসবে। তারপর সারারাত ডিজে গানে নাচলেও শরীর খারাপ লাগবে না।

শেষ বাক্যে স্পষ্ট খোঁচা বুঝতে পেরে রাগতে গিয়েও শেষ মুহুর্তে হাসি পেয়ে গেল আমার। সুঁই সুতো নামিয়ে রেখে বোতলের জন্য হাত পাততেই সে আয়েশ করে বসে উজ্জ্বল হাসি দিয়ে বোতলের সিপি খুলে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। টিপ্পনী কাটার মতো অবিশ্বাসের গলায় বলল,
— রাগী মেয়ে রাইনা হাসতেও জানে?

আমি তার টিপ্পনীর ধার দিয়ে গেলাম না। বোতল দু’হাতে আগলে ধরে অল্প অল্প চুমুক দিয়ে বুস্টারটা খাচ্ছিলাম। এত আরাম লাগছিল ঠান্ডা পানিগুলো গলায় ঢালতে! মনে হচ্ছিল চোখ বুঁজে এখানেই শুয়ে থাকি। অন্যদিকে ওপাশের মানুষটা পুরোটা সময় ধৈর্য নিয়ে গালে হাত রেখে আমায় বুস্টার খেতে দেখল। তারপর ওটা শেষ করতেই প্যান্টের পকেট থেকে দুটো কেকের প্যাকেট বের করে খুলে আমার সামনে দিয়ে বলল,

— এবার এই দুটো। খালি পেটে বুস্টার খেয়ে পুরো আরাম হবে না। কিছু দানা পেটে পড়লে তারপরেই নাচের জন্য ফুল রেডি।

আমি খানিক অবাক হলাম। টের পেলাম সেই সকাল থেকে অভুক্ত আমার পেট দুটো কেক দেখে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিয়েছে। বারণ করার সাধ্য আর আছে? বোতল নামিয়ে একদিকে রেখে একটা কেক ভেঙে মুখে পুরতে পুরতে ক্লান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে সেই প্রথম সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি আমাকে কোনো সম্বোধন করে ডাকেন না। না আপনি, না তুমি। সবসময় অবজেক্টিভ টোনে কথা বলেন। কেন?

আমার প্রশ্নে সে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। এরপর ঠোঁট কামড়ে মাথা দুলিয়ে বলল,

— ইটস হার্ড টু এক্সপ্লেইন। বাট হোয়াট ডু ইউ এক্সপেক্ট মি টু কল ইউ?
— আ’ম নট শিওর।

খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রতুত্তর করলাম আমি। শুনে সে হাসল। কি ভেবে আবারও মাথা দুলিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে এক সাইডে রেখে দেয়া সুঁই সুতো টেনে নিলো হাতে। বলল,
— কতটা ফুল দিয়ে মালা গাঁথতে হয়?

আমি বারণ করলাম তাকে। বললাম, পারবেন না। বিনিময়ে সে শান্ত চোখে একবার পেছনের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
— অলরেডি সাড়ে সাতটা বাজে। আটটায় প্রোগ্রাম শুরু। ডোন্ট ওয়ারি, আই ক্যান ড্যু ইট।

বারণ ধোপে টিকল না। সত্যি বলতে আমার জন্য ভালই ছিল বিষয়টা। গোটা দিনের শেষে দানাপানি পেটে পড়ে হাত পা ছেড়ে দিয়েছিল। বিন্দুমাত্র নড়ার শক্তি আমার আর ছিল না। পেছনে সোফায় মাথা এলিয়ে শুধু ভাবছিলাম, ব্যস্ততার ফাঁকে কেউ এদিকটায় না চলে আসে। মিস্টার ব্যাচেলরের সাথে এভাবে দেখলে যদি উল্টোপাল্টা কিছু ভেবে ফেলে!
____________________

ব্রেইনের মতো হাতের কাজও তার ভীষণ শার্প। একটুখানি দেখিয়ে দেয়ার পর খুব দ্রুত হাতেই মালা গেঁথে সবটা গুছিয়ে উঠতে চাইছিল আমার সাথে ডেকোরেশনের বাকি কাজ কমপ্লিট করতে। আমার শরীর ততক্ষণে বেশ ঝরঝরে হয়েছে। শত্রুর থেকে একসাথে এত ফেভার নেয়া বেমানান দেখায় টের পেয়ে তাড়াহুড়ো করে উঠে বারণ করে দিলাম।
যদিও সে শুনত না, তবু লোকে দেখলে খারাপ ভাববে এসব বুঝিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলাম তার দৃষ্টিসীমার থেকে অনেকটা দূরে।
এরপর সেদিনের প্রোগ্রামে দেখাসাক্ষাৎ আর হলো না। এমনকি পরেরগুলোতেও আমি বেশ নজর বাঁচিয়ে চললাম তার। কখনো ভুলবশত চোখে চোখ পড়ে গেলে সে শান্তভাবে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। তার শান্ত দৃষ্টি, সে দৃষ্টির জিজ্ঞাসা আমাকে খুব নাজেহাল করে দিত। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতাম না। বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠে একটা প্রতিধ্বনির মতো ভেসে আসত,
— কি পুষে রাখছে সে ভেতরে? রাগ, অভিমান নাকি…

বাকিটুকু ভাবার দুঃসাহস আর হতো না। আমি আসলে জানতাম না এমন পরিস্থিতিতে পড়ে গেলে কীভাবে রিয়্যাক্ট করতে হয়। কীভাবে সামলাতে হয় পরিস্থিতিগুলোকে। আমার জীবনে তো সিক্রেটের কোনো জায়গা নেই। হ্যাঁ আমি নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করতে পারি, কিন্তু কাউকে আড়ালে কল্পনা তো করতে পারি না। ইজ দিস ইভেন ফেয়ার?

খুব কঠিন প্রশ্ন। যার উত্তর খোঁজার দুঃসাহস আমার তখন হতো না। অন্যদিকে রুশো কিছুটা ইম্পালসিভ হয়ে পড়ছিল। আমি টের পাচ্ছিলাম, কিন্তু তাকে সরাসরি বলতে পারতাম না, চার্জ করতে পারতাম না।
ভয় পেতাম, তা নয়। মনে হতো আমার ভেতরের একটা দুর্বল রাইনা, যাকে পৃথিবীর কেউ চেনেনা, দেখেনি কোনোদিন, সে বোধহয় একটু একটু করে অ্যাক্সেপ্ট করছে ওকে। ওর আমার দিকে অনুরাগ মেশানো শান্ত দৃষ্টি, দূর থেকে বোঝানো আকাঙ্ক্ষা সব মেনে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। ওয়াজ শী ফিলিং প্লিজড টু বি ডিজায়ার্ড বাই সামওয়ান?
মেইবি। শক্ত খোলসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঐ রাইনা হয়তোবা, হয়তোবা অ্যাকসেপ্ট করতে চাইত দীর্ঘ বাইশ একা কাটানোর পর তেইশের প্রথম বসন্তকে। কিন্তু বাইরের রাইনা ভয় পেত। আমি তো জানতাম না ওপাশের মানুষের এক্সিস্টেন্সের পুরোটা। আদৌ কোমল রাইনা যেভাবে ভাবছে, সেভাবেই কি সে আকাঙ্ক্ষা করছে তাকে?
দিন গড়াতে গড়াতে প্রশ্নের উত্তর জানা একটু যেন জরুরী হয়ে গেল আমার জন্য। রোজ ভাবতাম তাকে জিজ্ঞেস করব। যখন আমার আর্টের ক্লাসের বাইরে ছাদের ঐ কর্নারটায় দাঁড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিত রুশো; যখন সরাসরি না তাকিয়েও বোঝাতে চাইত সে সবসময় আছে আমার সাথে ছায়ার মতো, তখন। কিন্তু কিছু একটা দ্বিধা কাজ করত আমার ভেতরে। ওকে এড়িয়ে পারতাম না নিজেকে পুরোটা মেলে ধরতে।

এভাবে কেটে যাচ্ছিল দিন, সপ্তাহ, মাস। আমাদের দ্বিধাগুলো জমতে জমতে মহীরুহ আকার ধারণ করছিল। যেটাকে না আমরা সরাতে চাইছিলাম, না এটার ছায়া থেকে বেরতে চাইছিলাম। এবং আমাদের অগোছালো গল্পের লাইনগুলো এভাবেই এগতে লাগল গতিহীন।
ওদিকে বাবার আসার সময় হাতে গোনার মতো এগিয়ে এলো। একটা করে দিন যাচ্ছিল আর ভয়ে আমি সিঁটিয়ে যাচ্ছিলাম এই ভেবে, বাবা এলেই তো আমাদের জমা গল্পের শেষ। ঠিকভাবে শুরু না হয়েই খুব বাজেভাবে সমাপ্তি টেনে হয়তো চিরকালের মতো আলাদা করতে হবে নিজেদের পথকে। কিন্তু বাবা না এলেও, আমাদের পথ এক হওয়ার কি সুযোগ আছে? অস্থিরতা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছিল আমার মনে, মস্তিষ্কে, হয়তো শিরায় শিরায়। সেসব অস্থিরতা প্রায়ই প্রতিফলিত হতো আচরণেও। আমি চাইতাম, খুব করে চাইতাম আমার বলার আগে সব জেনে যাওয়ার মতো অস্থিরতাটুকুও জেনে যাক রুশো। তারপর এগিয়ে এসে বলুক এই অস্থিরতার অসুখ সারানোর ঔষধ।

কে জানে! সত্যি সত্যি আমার চাওয়ার মতো রুশো বুঝে গিয়েছিল নাকি সবটা। একদিন আর্টের ক্লাস শেষে নেমে যাওয়ার সময় স্তব্ধতা ভেঙে ডেকে উঠল,
— রাইনা?

কতদিন পর, কতদিন পর তার কণ্ঠে সরাসরি আমার নাম। পা জোড়া কেঁপে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। ফিরে তাকানোর সাহস হলো না পাছে অনুভূতির প্রাবল্যে টলমল চোখগুলো ও দেখে ফেলে।

রুশো বোধহয় অপেক্ষা করল। তবে কিছু সময় কেটে যাওয়ার পরও ফিরে না তাকালে ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বলল,
— কাল ভোরবেলা, কেউ জেগে ওঠার আগে এখানটায়, এই ছাদে..

এবারে আমি ফিরে তাকালাম ওর দিকে। কিছুটা শক্ত হয়ে বাক্য সম্পূর্ণ করে বললাম,
— আসবে?

ও থেমে আমার চোখে চোখ রাখল। শুকনো ঢোক গিলে আমার মতো করেই জানতে চাইল,
— আসবে?

কত দিনের আকাঙ্ক্ষিত একটা প্রশ্ন। আমি আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। চোখ বুঁজে ফুঁপিয়ে উঠলাম। রুশো এগিয়ে আসত সামলাতে, কিন্তু নিজের দুর্বলতা পুরোটা ওর সামনে দেখিয়ে ফেলার পর আমার পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না ওখানটায়। যেন কারোর থেকে নজর বাঁচাচ্ছি, এমনি করে পালিয়ে গেলাম ঘরের দিকে।

তারপর? একটা স্বপ্নালু রাত কাটল। খোলসের ভেতরে সদ্য জন্মানো অনুভূতির প্রাবল্যে ভেসে যাওয়া রাইনা কতশত রঙিন স্বপ্নের জাল বুনে নিজেকে কল্পনা করছিল রামধনুর বর্ণিল পৃথিবীতে। এতটুকু জীবনে যে পৃথিবীর হদিস পায়নি সে একফোঁটা, এক রাতে সে পৃথিবীকে ঘিরে তার পরিকল্পনার সীমা পরিসীমা রইল না। কিন্তু কোমল রাইনা জানত না, তার হঠাৎ পাওয়া স্বপ্নের পৃথিবীর বর্ণিল রঙের পেছনে একটা কালো ছায়া ছিল। যে ছায়া রাত পোহালেই নতুন রাতের রূপে তাকে গ্রাস করবে বলে তৈরি হয়েছিল একটু একটু করে।

___________________

গোটা রাত নির্ঘুম কাটানোর পর ভোরের আলো ফুটতেই আমি সবকিছুর ভয় পেছনে ফেলে ছুটে গিয়েছিলাম ছাদে পরিকল্পনামতো। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম রুশো ইতোমধ্যে উপস্থিত। কিন্তু আমার মধ্যে যতটা উচ্ছ্বাস বাঁধ ভেঙে পড়তে চাইছিল, ঠিক তার বিপরীতে অস্থিরতার ভয়াল থাবা তাড়িয়ে মারছিল ওকে। সেই প্রথম ভোরের আলো ছাপিয়ে দু আঙুলের ফাঁকে জলন্ত একটা সিগারেট খুব বিদঘুটে হয়ে ধরা দিল আমার চোখে। অশনির সংকেত পেয়ে গিয়েছিলাম তখুনি। তবু কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে ওর মুখোমুখি দাঁড়ানোর আগ্রহকে দমাতে পারিনি।
আমাকে দেখার পর একটু যেন থমকাল রুশো। হাতের সিগারেট ছাদ থেকে নীচে ফেলে দিয়ে অস্থিরভাবে চুলে আঙুল বোলালো। আমার খুব ভয় লাগছিল ওকে দেখে। যতটা ওর আচরণে ভয় পাচ্ছিলাম, তার চাইতে কয়েকগুণ অশনির আশঙ্কা করে অসহ্য লাগছিল আমার। সেই অসহ্য ভাবটাকে দূরে সরাতেই নীরবতা ভেঙে ডেকে উঠলাম,
— রুশো?

এতক্ষণ যে করে হোক নিজেকে সামলাতে পারছিল রুশো। আমার ডাকটার পর আর বোধহয় পারল না। চোখ বুঁজে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হুট করে বাহু ধরে টেনে নিলো আমাকে নিজের কাছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমি যখন তাকালাম মানুষটার দিকে, তখন অদ্ভুতভাবে ওর দু’চোখে টলমল বিষাদ। কোনোরকমে নিজেকে সামলে ওর বুকে হাত রেখে সরে যেতে চাইলাম আমি হাতের শেকল থেকে। রুশো দিলো না। বরং জেদি বাচ্চাদের মতো আরো শক্ত করে আগলে ধরে টেনে নিলো আমায় পুরোটা বুকের কাছে। মাথার তালুতে ঠোঁট চেপে রেখে ফিসফিস করে বলল,
— স্যরি, স্যরি রাইনা। প্লিজ ফরগিভ মি। প্লিজ।

ওর কণ্ঠের আকুতি আমার কানে বাজল নির্মমভাবে। পাজলড হয়ে মুখ তুলে আরও একবার তাকাব তখুনি বিকট কতগুলো শব্দে কেঁপে উঠল স্তব্ধ প্রকৃতি। পরপর কয়েকটা অচেনা শব্দে তাকানো হলো না আমার মানুষটার দিকে। ভয়ে কেঁপে উঠে আঁকড়ে ধরতে চাইলাম আমি তাকে খড়কুটোর মতো। সেও যেন পৃথিবীর সমস্ত খারাপ ছায়ার থেকে বাঁচাবে বলে শক্ত আলিঙ্গনে বেঁধে নিলো আমায় বুকের সাথে।

অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ কেটে গেল আমাদের অচেনা শব্দের ভৌতিক তাড়ায়। তারপর সময় গড়িয়ে সব যখন থেমে গেল, আশেপাশের লোকের ভয়ার্ত আর্তনাদে যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম তখন আর বুঝতে বাকি রইল না আমাকে হারানোর ভয়ে দু’হাতে আগলে রাখা আহত, ক্লান্ত মানুষটার হুট করে “স্যরি” বলার মূল কারণ।

আমার কি ভেঙে পড়া উচিৎ ছিল তখন? প্রথম বসন্তের বর্ণিল আলোর পেছনে নোংরা ছায়াটাকে চিনে ফেলার পর বিট্রেইড ফীল করার কথা ছিল? নাকি উচিৎ ছিল এতদিনে অল্প অল্প করে জমা হওয়া সবটুকুকে দু’হাতে ঠেলে দিয়ে গোটা পৃথিবীর সামনে সমস্ত সত্যি উন্মোচন করে দেয়া? ঠিক কোনটা করলে সেদিন মানুষ রাইনা আর রুশোর প্রেমিকা রাইনার মুখোমুখি সংহাত এড়ানো যেত? কোনটা করলে?

চলবে,
Sinin Tasnim Sara