রূপসাগরে মনের মানুষ পর্ব-০৩

0
75

#রূপসাগরে_মনের_মানুষ
#কলমেঃ ইশা আহমেদ
#পর্ব_৩

বাইরে ঝুম বৃষ্টি, সাথে ক্ষণে ক্ষণে আকাশ আলোকিত হয়ে বজ্রপাত হচ্ছে। বৃষ্টির তেজ যেমন ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে তেমনই বাড়ছে একজন প্রেমিকের হৃদয়ের অতলের দহন, যন্ত্রণা। বিরহে পুরছে তার অন্তর। একজন মা কখনোই নিজের চোখে সন্তানের এমন অবস্থা দেখতে পারেন না। নাহিদা সুলতানা ও পারলেন না। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। যুবক মাহাদ ছোট বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে মাকে জড়িয়ে। একটা ছেলে কতোটা ভালোবাসলে একটা মেয়েকে হারানোর ভয়ে পাগলের মতো কাঁদে। মাহাদ বেসেছে তার অবনীকে, তাও পাগলের মতো। নাহিদা সুলতানা ছেলেকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। সে জানেন যে ভালোবাসার মানুষকে হারানোর যন্ত্রণাটা কতটা। মাহাদ বিরবির করে আওড়ালো,,

“তুমি অন্য কারো হইও না অবনী। তুমি সুখ হইয়ো না দুঃখ হও, তবুও আমারই হও। তোমার দেওয়া আঘাত যন্ত্রণা সব মেনে নিতে পারবো, শুধু তোমারে অন্য কারো সঙ্গে দেখতে পারবো না”

নাহিদা সুলতানা বুঝলেন ছেলের গাঢ় অনুভূতি। এই নিয়ে কত শত রাত রাগ করে বাড়ি ফিরেনি। তারাও কি খুব সহজে মেনেছে? মোটেও না! নাহিদা সুলাতানা ছেলের মানিব্যাগে একদিন দেখেই ফেললেন অবনীর হাসিমাখা ছবি। এই নিয়ে মাহাদকে জিজ্ঞেস করতেই সে অকপটে স্বীকার করলো মেয়েটা তার প্রেমিকা। এই নিয়ে ঝামেলা হলো, মাহাদ বাড়ি ফিরলো না পুরো এক রাত। এরপর! না পেরে নাহিদা সুলতানা আর জহিরুল হাসান ছেলেকে শান্ত করার দরুন বলেন তারা মেনে নিয়েছেন। এরপর সে কথা আর উঠেনি। তবে গতকাল থেকে পাগলামি করছে। এরপর ইমাদের থেকে বাকি কাহিনিটা জানা। নাহিদা সুলতানা ছেলেকে বহু কষ্টে শান্ত করে রুমে পাঠায় জামাকাপড় পাল্টাতে।
নাহিদা সুলতানা সোফাতে ধপ করে বসে পরেন। ছেলের মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। কি করবেন তিনি। তার কি উচিত হবে, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া? কিছু ভেবে পেলেন না তিনি। আজ নিজের স্বামী আসলে এ বিষয়ে আলাপ করতে হবে। ছেলেকে এভাবে দেখতে পারবেন না। একটা মাত্র ছেলে তার কিছু হলে তিনি বাঁচবেন না। খুব ভালোবাসেন কি না! নাহিদা সুলতানা দ্রুত উঠে রান্না ঘরে গেলেন। দু’টো রুটি আর গোশ গরম করে ছেলের রুমে আসলেন। মাহাদ সবে মাত্র গোসল করে বের হয়েছে। নাহিদা সুলতানা ছেলেকে দেখে বললেন,,,

“এদিকে আয় মাহাদ। খেয়ে নে”

মাহাদ নির্জীব কন্ঠে উত্তর দিলো,,“ক্ষুধা নেই আম্মু”

নাহিদা সুলতানা ছেলেকে জোর করে বসিয়ে নিজেই খাইয়ে দিতে লাগলেন। মাহাদ একটা রুটিও পুরোপুরি খেতে পারলো না। তার মাঝেই মনে পরলো তার প্রিয়া খেয়েছে কি না।গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইলো না। মাহাদ বলল,,
“গলা দিয়ে নামছে না আম্মু আর। খাবো না নিয়ে যাও”

“কি খেলি? আরেকটু খা বাপ”

“আম্মা জোর কইরো না। আমি একটু ঘুমাই তুমি একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও?”

“আচ্ছা আব্বু তুই দাড়া আমি প্লেটটা এখনই রেখে আসছি”

নাহিদা সুলতানা রুম থেকে বের হতেই মাহাদ হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলো। হৃদয়ের দহন কমবে কি করে, এ দহন যে একমাত্র অবনীই পারে কমাতে। নাহিদা সুলতানা এক গ্লাস পানি আর নাপা ওষুধ নিয়ে রুমে আসলেন। মাহাদকে ডেকে তুলে জোর করে ওষুধটা খাইয়ে দিলেন। মাহাদ খেয়ে আবারও শুয়ে পরলো। নাহিদা সুলতানা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন বেশ কিছু সময়। তিনি ভাবেন ছেলে হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। এই ভেবে তিনি লাইট বন্ধ করে, দরজা চাপিয়ে চলে যান। নাহিদা সুলতানা চলে যেতেই মাহাদ ধপ করে আঁখি জোরা খুলল। প্রেয়সীর খবর কি জানে না সে! ঠিক আছে কি না তাও জানে না। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও বাড়ছে। মাহাদের বড্ড ইচ্ছা করলো অবনীকে একবার কল করবার। তবুও ভয় আশঙ্কা থেকে করলো না। খোলা জানালা দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছে মাহাদ। আঁখি জোড়ায় অশ্রু কণার দেখা পাওয়া গেলো। বিরবির করে আওড়ালো,,,

“এমন যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে পাখি? তুমি তো আমার কেউ না তবুও কেনো এতো ভালোবাসি তোমারে। তোমার সাথে কথা বলার জন্য হৃদয়খান ক্যান এমন ভাবে পুড়ছে। ও পাখি একটু ধরা দাও না। আর কত যন্ত্রণা দিবা আমারে, সহ্য হচ্ছে না আর”

দরজা ধাক্কানোর তীব্র আওয়াজে ঘুম ভাঙলো অবনীর। মাথা যন্ত্রণা করছে প্রচন্ড। মাথা চেপে ধরে উঠে বসলো। জানালা দিয়ে দমকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। শীত শীত অনুভব করলো অবনী। দু মিনিট স্থির হয়ে বসে রইলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই হুরমুর করে প্রবেশ করলো তার মা ওয়াহিদা বেগম। এসেই ক্ষিপ্ত গলায় বলল,,

“বসার ঘরে আয় তোর বাপ ডাকছে”

অবনী কোনো দিক না তাকিয়ে টলমল পায়ে এগিয়ে গেলো বসার ঘরের দিকে। বসার ঘরে আসতেই চোখে পরলো তার বাপ ভাইকে। শওকত হোসেন অতন্ত্য ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। তিনি গতকাল বাড়িতে ছিলেন না। একটু আগেই ফিরেছেন। স্ত্রীর কাছে সব শুনেছেন তিনি। অবনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“অবনী এখানে এসে বসো”

অবনী নিশ্চুপ হয়ে সামনের সোফাতে বসলো। শওকত হোসেন ভালো করে মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করলেন। উষ্কখুষ্ক চুল, ফোলা লাল আঁখি জোড়া জানান দিচ্ছে মেয়েটা কেঁদেছে। তিনি শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,,
“তোমার এই অবস্থা কেনো মা?”

অবনী কিছু বলল না। সে এক দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। শওকত হোসেন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবারও জিজ্ঞেস করলেন,,,
“তুমি কি খুলে বলবে আব্বুকে? কি হয়েছে বলো তুমি”

নিজের আব্বুর এমন নরম কন্ঠ স্বর শুনে অবনী নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। শওকত হোসেন হতভম্ব হলেন। কাছে গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,,,

“শান্ত হও মা। কেঁদো না। বলো কি হয়েছে”

অবনী কান্না থামিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। এরপর ভাঙা গলায় বললো,,
“আব্বু আমি জানি তুমি সব জানো,আম্মু সব বলেছে তোমায়। আব্বু আমি মাহাদকে ভীষণ ভালোবাসি আব্বু। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। আম্মু এমন করছে কেনো আব্বু? মাহাদ কোন দিক দিয়ে খারাপ?”

“সবই বুঝলাম। এখন এটা বলো মাহাদ কি করে?”

“ও কিছু করে না, বেকার যাকে বলে। আমার সাথেই পড়ছে।”

শওকত হোসেন শান্ত কন্ঠে বললেন,,“বিয়ে করে খাওয়াবে কি?”

“এখন তো বিয়ে করছি না আমরা। দু’জনই চাকরি পাই এরপর বিয়ে। আর যদি তোমরা না মানো তবে আমি বের হয়ে যাচ্ছি”

“ওয়াহিদা ওকে ফোন দিয়ে দাও। আর আগামী কালকে তাকে আসতে বলো”

“কিন্তু অবনীর আব্বু….”

“থামো। আমি দেখছি বিষয়টা। মা তুমি যাও এখন বিশ্রাম নাও। ওকে ফোনটা ফিরিয়ে দাও ওয়াহিদা”

ওয়াহিদা বেগম ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠলেও স্বামীর সামনে কিছু প্রকাশ করলেন না। ওয়াহিদা বেগম গটগট করে রুমে গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসলেন। ফোনটা পেতেই অবনী নিজের রুমে চলে আসলো। দরজা আটকে বিছানায় বসে ফোন অন করে সবার প্রথমে কল করে তার প্রিয় পুরুষকে। অপর পাশ থেকে কল রিসিভ হতেই অবনী মৃদু কন্ঠে শুধালো,,,

“মাহাদ ঠিক আছো তুমি?”

মাহাদ কে কল করেছে না দেখেই রিসিভ করেছে। অবনীর কন্ঠ শুনে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো অবনী নামটা জ্বলজ্বল করছে। মাহাদ বলল,,
“তুমি ঠিক আছো তো পাখি?”

“আমি ঠিক আছি মাহাদ। একটা খুশির খবর আছে। আব্বু তোমাকে কালকে আসতে বলেছে। শুনো যদি তারা রাজি না হয় আমি এক কাপড়ে তোমার সাথে বের হয়ে যাবো। আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি মাহাদ।”

“পাখি কি শুনাইলা তুমি। কালকেই আমি তোমারে আমার কাছে আনবো পাখি। আমার এই দূরত্ব সহ্য হচ্ছে না। তোমায় একটু জড়িয়ে ধরতে চাই পাখি। এই দূরত্ব আমি খুব তাড়াতাড়ি ঘুচাবো পাখি। এখন ঘুমাও জান। অনেক রাত।”

“তুমি ও ঘুমাও মাহাদ। কাল একটু সকাল সকাল আইসো”

“আচ্ছা পাখি। ও পাখি শুনো না”

মাহাদের আদুরে কন্ঠস্বর বলে দিলো কিছু একটা আবদার সে করবে। অবনী মৃদু হেসে বলল,,,“বলো”

“কাল একটু মেরুন রঙের জামদানিটা পরবে?”

“আচ্ছা ঠিক আছে পরবো। তুমি কালো পাঞ্জাবিটা পড়ো কিন্তু!”

“ঠিক আছে পাখি। এখন ঘুমাও আল্লাহ হাফেজ। শুভ রাত্রি”

#চলবে~