#রেড_হার্ট❤️
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
#পর্ব_পাঁচ
ভ্রমের আচমকা এমন বিহেভিয়ারে চরম বিরক্ত হলেন বাবা। ডান হাতটা ঝাড়া মেরে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার হাত ভাত এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেল। প্রশ্ন ছুড়েন ভ্রমের দিকে,
-“তোমার সমস্যা কি ভ্রম? বলবে প্লিজ? বাবা হয়ে অনুরোধ করছি। সবটাই তো শুনলে। তারপরেও বিয়েটা মানছো না কেন? আর না মানলে বিয়ে করলে কেন?”
বাবার এমন কথায় দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। হাত মুষ্টি করে বাবাকে শোধায়,
-“এই বয়সে মায়ের সতিন আনতে দিতাম?”
-“সেটা তোমার ব্যাপার!”
-“অবশ্যই আমার ব্যাপার। বিয়েটা করা তোমার ডিসিশন আর… ”
-“আর কি?”
-“ডিভোর্স দেওয়াটা আমার ডিসিশন।”
ভ্রমের কাঠিন্য গলায় বলা কাঠকাঠ উত্তর। শুকনো ঢোক গিলে বকুল। এতোক্ষণ নিশ্চুপে ভাতের দিকে চেয়ে থাকলেও এবার আর পারলোনা। মাথা তুলে তাকালো খালেকুজ্জামানের দিকে। শেষ অবধি তাকে মানুষ করুণা করছে? ব্যাপার টা বেশ অবাক লাগলো তার। তবে এটাই বাস্তব কিন্তু বিশ্বাস করতে মন চাইলোনা তার বাউন্ডুলে মন। তখনই কর্ণকুহর হয় ভ্রমের বাবার কণ্ঠ,
-“বকুল কে তুমি ডিভোর্স দেবে?”
-“হ্যাঁ!”
ছেলের একগুয়ে স্বভাব খালেকুজ্জামানের অজানা নয়। তাই তিনি কিছু সময় নিলেন। সেকেন্ড কয়েক পর গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন,
-“ওকে অযোগ্য ভাবছো?”
-“কথা অযোগ্যের না। আমি ওকে বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারবো না।”
-“তোমার স্বীকৃতি গোটা ইন্টারনেট দখল করে নিয়েছে। কি হবে তোমার প্রেস্টিজে?”
ভ্রম চুপ মেরে গেল। সত্যি কথাই তো এইটা। ইন্টারনেট জগতে ভ্রমের অনেক ফ্যান ফলোয়ার। অলরেডি সকলেই জেনে গিয়েছে। তার উপর ডিভোর্স দিলে তো ইমেজের বারোটা বাজবে! এই ভেবে চুপ থাকতে চাইলেও চুপ থাকলো না। বাবাকে হারিয়ে দিতে বললো,
-“আমি তবুও ডিভোর্স দেবো।”
-“আর ইউ শিউর?”
-“কান পরিষ্কার করে আসুন মিস্টার খালেকুজ্জামান। নাহলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথাই শুনতে পাবেন না।”
‘ভ্রম’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠেন খালেকুজ্জামান। ছেলেটা দিনদিন বেয়াদবে পরিণত হচ্ছে। এঁটো হাত নিয়েই তেড়ে গেলেন ছেলের কাছে। প্রহার করতে গিয়েই অসফল হলেন। কারন তার আগেই ফুফু, মা-চাচি ফিরিয়ে নিয়েছে। ছোট ভাই শামলানোর চেষ্টা করলেন আর বাকীরা ভ্রম কে আড়াল করলেন। খালেকুজ্জামান বুঝতে পারলেন মেরে কাজ হবে না। তবে কথায় মাত দিতে হবে। তাই তিনি রাগান্বিত কন্ঠস্বরে চেঁচিয়ে শোধালেন,
-“এই বাড়িতে থাকতে হলে বকুলকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে থাকতে হবে তোমাকে অন্যথায় তুমি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে পারো। কিন্তু বকুল, কোত্থাও যাবে ও। এখন যা করবে ভেবে করো। ডিসিশন তোমার।”
বলেই বড় বড় পা ফেলে রান্না ঘরের দিকে ছুটে গেলেন। ততক্ষণে ভ্রম তেড়ে আসে বকুলের দিকে। বকুলের পেছন থেকেই ধমকে বলে উঠে,
-“এই মেয়ে, এই! অন্যের বাড়িতে ভাগ বসাচ্ছো লজ্জা হচ্ছে না? এই পারিবারিক শিক্ষা তোমার? মা-বাবা এই পড়িয়েছে, শিখিয়েছে? বিবেক বোধ জাগায় নি? নাকি মেডিকেলের রেকর্ড ভেঙে দেওয়া টাই জীবনে অর্জন করেছো?”
এতো গুলো কঠিন প্রশ্নে থেমে যায় বকুল। তখন খাবার রেখেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল কিন্তু এবারে প্লেটের অবশিষ্ট খাবার খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। একটা পুরুষ! যে কিনা তার স্বামী। তার সাথে প্রথম মত বিনিময় যখন এতোটা বাজেভাবে হলো তখন সেও নিজেকে ধাতস্থ করলো। ঘুরে তাকালো ভ্রমের দিকে। চোখে চোখ রেখে উত্তর দিলো,
-“মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ মিস ভ্রম!”
মেয়েটার উঁচু গলা শুনে চরম অবাক হয় সে। ভেবেছিলো মেয়েটা দুর্বল, কিন্তু এ’তো বারুদ পুরো! কিন্তু ওকে মিস….। সময় নষ্ট না করে ফিরতি উত্তর দিলো,
-“এক্সকিউজ মি?”
-“কিছুই না।”
-“আমাকে মিস কেন বলেছো তুমি, হ্যাঁ? ”
-“দেখতে তো আস্ত একটা ছেলে মানুষ না না বর মানুষ কিন্তু আপনার স্টাইল দেখেছেন? পুরাই মেয়ে মানুষ। মেয়েদের মতো নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ান কেন বলুন তো? নাক প্রতি বছরে লম্বা হয় নাকি, যে নাকের রাগ না ঝাড়লে নাক থেকে তরল পদার্থ বের হয়?”
-“হোয়াট?”
-“শুনুন! সেরম হলে ওষুধ খেয়ে নেবেন। তবুও মেয়েলি আচরণ বাদ দিন। সেই দুপুর থেকে অযথা ঝগড়া ঝাটি শুনছি আমি। কিচ্ছুটি বলিনি বলে এই না যে এখন বলব না।”
মেয়েটার সাহস যেন বেড়েই চলেছে ক্রমশ। ভ্রম নাক সিটকালো। মেয়েটা তারই বাড়িতে দাঁড়িয়ে তাকেই অপমান করছে? রাগ লাগলো তার। তেঁতে উঠে বললো,
-“এই মেয়ে এই!”
ভ্রমের এমন সম্বোধনে বকুল মৃদ্যু চিল্লিয়ে বলে,
-“এই! একদম এই মেয়ে এই মেয়ে করবেন না। মা-বাবা আকিকা দিয়ে নাম রেখেছে বকুল। আমি বকুল আহমেদ। বকুল ডাকতে যদি মুখে চিকার গন্ধ আসে তাহলে ওই মুখে বউ ডাকবেন। মিষ্টি মিষ্টি সুবাস বের হবে।”
সব শুনে ভ্রম কিংকর্তব্যবিমুঢ়! এইটা কে ভাই? এতোগুলো মানুষের সামনে তাকে এইভাবে শুকনোর মধ্যে ধুঁয়ে দিলো? গলা নিচু থেকে উচু করে বকুলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“এই! একদম ভাব নেবে না।”
-“আপনিও। আপনার লজ্জা করেনা নিজের বাবার সাথে এইরকম ব্যবহার করেন? লজ্জা হয়না বাবার উপরে গলা উঁচু করে কথা বলতে? আমার তো মনে হয় আপনার পারিবারিক শিক্ষার অভাব। উম…তা না, পারিবারিক শিক্ষা থাকলেও কাজে লাগাতে পারেননি। আর অন্যের অন্য ধ্বংস না অন্যের বাড়িতে ভাগ বসাচ্ছি বলছিলেন? তো বেশ তো আমাকে আপনি কামাই করে খাওয়ান।”
-“হোয়াট?”
-“কথায় কথায় হোয়াট ছাড়া কি কিছুই বলতে জানেন না?”
-“জানলেও বলবো না।”
-“এইতো লাইনে এসেছেন।”
ভ্রম বকুলের কথায় চরম রেগে গেলো। দু’পা এগিয়ে আসতে নিলেই বকুলের লাগামহীন কথায় থেমে যায়,
-“এই জামাই! স্টপ। ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।”
মেয়েটা বোধহয় লাজ লজ্জার মাথা খেয়েছে। এতো এতো গুরুজনের সামনে কেমন নির্লজ্জের মতো জামাই জামাই ডাকছে। এদিকে বকুল টেবিলে খালেকুজ্জামানের ফোনটা নিয়ে খট করে ভ্রমের একটা ছবি তুলে নেয়। আর বলতে থাকে,
-“জাতীয় মেধায় প্রথম,সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেমাস ব্যক্তির এইরকম ছবি ভাইরাল করলে বোধহয় অনেক বেশিই সুইট হবে ব্যাপার টা।”
ক্লান্ত হলো ভ্রম। শেষমেষ এই কেমন বউ তার কপালে জুটলো? সে তো চেয়েছিলো তার কথায় উঠবস করবে এমন একটা বউ। আর সেখানে এই মেয়েটা তাকে উঠবস করাতে শুরু করে। নাহ! একে জীবন থেকে তাড়াতেই হবে। এ একদমই এক্সেপ্টেবল না। ভুলেও নাহ! তাই শেষ বারের মতো ডিভোর্সের কথা বলতে শুরু করে,
-“এই মে…”
-“জাস্ট কল মি বউ। নাহলে কোনো কথাই শুনবো না।”
এদিকে উপস্থিত বাকিরা মিটমিট করে হাসছে। বদ মেজাজি রাগী ছেলেটা কে তবে কেউ একজন শায়েস্তা করছে। যারা মনে মনে বকুলকে নিয়ে দ্বিধায় ছিলো এই ঘটনার পর দ্বিধার পুরোটাই কেটে গেল। তারা তাদের চোখের সামনেই পানির মতো স্বচ্ছ বকুলকে দেখতে পাচ্ছে। এককথায় একদম নির্ভেজাল।
লজ্জায় অপমানে থমথমে মুখখানা নিয়ে বড় বড় কদম ফেলে দ্রুতই নিজের রুমে যেতে সিড়িতে পা বাড়ায়। বকুল চেঁচিয়ে তাকে শোধায়,
-“চিন্তা করবেন না জামাই। আপনার বউ আপনাকে ছাড়ে ঘুমুবেই না। সে এক্ষুনি আসছে। এবং তার বেড সাইডটা আজকে কষ্ট করে গুছিয়ে রাখুন।”
ভ্রম কেবল উপর থেকে বকুলের পানে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে গটগট করে উপরে চলে যায়। নিজের রুমে গিয়ে প্রকট শব্দ করে দরজা আটকিয়ে দেয়। সাথে সাথে দম ফাটানো হাসি দেয় বাড়ির সকলেই। বকুলের মুখেও হাসি। মানুষ টাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলো, ততোটাও না। লোকটাকে কথায় মাত দেওয়া যায়। মুখের হাসি মিইয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে তাদের সকলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ডাইনিং এ এখন উপস্থিত ভ্রমের মা-বাবা,ফুপু, চাচা-চাচি। ভ্রমের বাবা পুরো ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। রান্নাঘর থেকে হাত ধুঁয়েই তিনি ছেলে-মেয়ে দুটির কথা শুনছিলেন।
বকুল খানিকটা অনুতপ্তের মতো চাহনী নিক্ষেপ করে বলে,
-“বলতে গেলে আমি শুরু থেকেই ওনার উদভ্রান্ত ব্যবিহার দেখলাম। এতে যেটুকু বুঝলাম সেটা হচ্ছে ওনার ব্যবহার টাই ওরম কিন্তু বাস্তবে একদম ই ফাঁকা। তাই একটু বাজিয়ে দেখলাম। আজকে ওরম নির্লজ্জের মতো কথা বলে ফেলায় আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত মা-বাবা,ফুপু,চাচা-চাচি। আমাকে ক্ষমা করবেন। কথা দিচ্ছি আপনাদের ছেলে কে একদম ঠিক করে দেবো।”
তার কথা সকলেই আরেকবার হাসলো। তবে অট্টহাসি না মুচকি হাঁসি। এগিয়ে আসেন ভ্রমের মা। বকুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“আর আমি আমার ছেলের তোমার সাথে করা ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছি। করবে?”
-“আরে আম্মু…!”
-“কথা দাও যত যাইহোক ওকে ছেড়ে যাবেনা?”
বকুল থামকালো। মুখে খানিকটা সিরিয়াস এনে জিজ্ঞাসা করে,
-“হঠাৎ এতোটা বিশ্বাস?”
-“মন থেকে আসলো।”
-“তাহলে কথা দিলাম!”
বকুলের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তাকে জড়িয়ে ধরে মিসেস রিনি অর্থাৎ ভ্রমের মা। তখনই এগিয়ে আসেন খালেকুজ্জামান। মুখে প্রশান্তির হাসি টেনে বলতে বলতে আসতে লাগলেন।
-“সাধে কি বকুলকে একটা বলদের সাথে বিয়ে দিয়েছি? তাহলে ভুল করিনি বলো?”
স্বমস্বরে উত্তরেল আসে,
-“একদমই না!”
•
ভ্রমের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বকুল। প্রায় বিশ মিনিট ধরে সে ভদ্রতার সহিত ভ্রমকে ডাকছে। কিন্তু ভ্রমের কোনো নাম গন্ধ দূর সাড়া শব্দই পেলোনা। বুঝেই নিলো এবার তার ওয়ে টা একটু বাকাতেই হবে। তাই জোড়ে জোরে ডাকতে থাকে,
-“জা..মা..ই! এই জামাই। আরে এই জামাই। দরজা খুলেন। আপনার বউ ঘুমাবে। দরজা খুলে দিন।”
ভ্রমের সারাশব্দ পাওয়া গেলনা। কিন্তু বকুল’ও হাল ছাড়ার মতো মেয়ে না। নিজ দায়িত্বে ডাকতে থাকে,
-“এই যে বউ পাগল জামাই! আমি কিন্তু ভিডিও করতেছি। যদি দরজা না খুলেন তো মিডিয়া তে আপনার ইমেজের হাই কোয়ালিটি করানোর দায়িত্ব আ..মা..র!”
কথা শেষ করেই সে বলতে থাকে,
‘হ্যালো এভ্রিওয়ান। আমি ইহান তালুকদার ভ্রমের ওয়াইফ মিসেস ভ্রম বলছি। এখন রাত বাজে সাড়ে ১২ টা। ভ্রম আমাকে রুমে যেতে ডেকেছিলো ১১:৪০ এ। ২০ মিনিট দেরি করেছি বলে আমায় রুমে ঢুকতে দিচ্ছেনা। কি করা যায় বলুন তো? আপনারা তো ওর ফ্যান, দেখি আপনাদের বুদ্ধি কাজে দেয় কিনা।’
#চলবে