রেড হার্ট পর্ব-০৬

0
9

#রেড_হার্ট❤️
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
#পর্ব_ছয়

বকুল নিজের গলার স্বর যথেষ্ট রেখেই চেঁচাচ্ছে যা কেবল রুমের ভেতরে থাকা মানুষটা শুনতে পাবে। শুনতেও পেলো ভ্রম। বিরক্ত লাগলো তার। ল্যাপটপের স্ক্রিনে অপলক দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে সে। সেকেন্ড কয়েক নিজের শ্বাস আটকে রেখে ফের ছাড়লো। সোশ্যাল মিডিয়াতে তোলপাড় এখন তারা দু’জন। ভ্রমের ফ্যানগ্রুপে চলছে মাতামাতি। একের পর এক পোস্ট চোখে আটকাচ্ছে। প্রত্যেকটা পোস্টের ক্যাপশন একদম নজরে লাগার মতো। মাথায় হাত দিয়ে বসে সে। তখনকার ওইটুকুতে এই অবস্থা না জানি বাইরের ওইসব ভিডিও ভাইরাল হলে কি হবে। দ্রুত উঠে দাঁড়ায় সে। এর মাঝেই বকুকের গলার আওয়াজ আসে।

-“খুলবেন নাকি পোস্ট করে দিবো হ্যাঁ?”

সে চেচিয়ে উত্তর দিলো,

-“আসছি রে জন্তু! এতো জ্বালাচ্ছিস কেনো তুই?”

বলতে বলতে দরজা খুলে দেয় সে। সাথে সাথে হুড়মুড়িয়ে ভ্রমের প্রশস্ত বুকে ধাক্কা খায় বকুল। ভ্রম আরোও বিরক্ত হয়। সোজা ভাষায় বলে,

-“কি সমস্যা? আমার বাড়িতে আমাকেই আমার মর্জি মতো চলতে দেবেনা?”

-“হুম! সে হিসেব টানতেই এসছি।”

ভাবুক হয় ভ্রম। মেয়েটা কি বলতে চাইছে তাকে? ব্যাপার টা ক্লিয়ার করার জন্য নিজ থেকেই বলে,

-“ঘুড়িয়ে প্যাচিয়ে না বলে সোজাসাপটা প্রশ্ন করো কিংবা কথা বলো।”

-“আমি আপনাকে ডিভোর্স দেবো।”

বকুলের কথায় সে কিছুই বুঝলো না। এতো রাতে এতো কাহিনী করে কি এই মেয়েটা ওকে এগুলো বলতে আসবে?
ভ্রম কে চুপ থাকতে দেখে দায়িত্ব নিয়েই তাকে শোধায়,

-“ তবে আমার কিছু কন্ডিশন আছে।”

তেঁতে উঠে ভ্রম। রাগী স্বরে বলে উঠে,

-“তুমি আসলেই একটা জন্তু।”

-“এ্যা?”

-“হ্যাঁ।”

মুখে কুলুপ এটে বিছানার একটা কোণে ল্যাপটপ টা নিয়ে ফের বসলো। পাত্তাই দেবে না বকুল কে, ভাবটা খানিকটা এইরকম। বকুল’ও বুঝতে পেরেছে বেয়াদব ব্যাট্যা মনে মনে ভাব নিচ্ছে। সেও পাত্তা দিলো না। বিছানার অন্য সাইডে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আগ বাড়িয়ে ভ্রম কে শোধালো,

-“কন্ডিশন শুনলেন না তো, আর ডিভোর্স ই পাবেন না।”

চমকে উঠে ভ্রম। সে ভেবেছিল মেয়েটা নিজ থেকেই বলবে কিন্তু এখন তো ঘটলো উল্টো! যদি মেয়েটা সত্যিই তাকে ডিভোর্স না দেয়, তাহলে? তাই আর দেরি না করেই খানিকটা নড়ে বকুলকে শোধায়,

-“হ্যাঁ বলো তোমার কন্ডিশন।”

বকুল উত্তর দিলো না। ভ্রু কুচকে নিলো সে। কথাটার আবারো বললো, সাথে সাথে উত্তর আসলো,

-“আমি ঘুমাচ্ছি।”

রাগ উঠে ভ্রমের। নাকের ডগায় রাগ নিয়েই জিজ্ঞাসা করে,

-“মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথাও বলে?”

-“আমি বলি।”

-“এই বলবে তুমি?”

বিরক্তিতে কথাটা বললো ভ্রম। তবে বিরক্তিতে দ্বিগুণ ঘি ঢাললো বকুল। আলসেমির সুরে বলে উঠলো,

-“রিকুয়েষ্ট করুন মিস্টার ভ্রম! বউয়ের কাছে আদেশ চলে না। রিকুয়েষ্ট চলে।”

বুকের কোনো এক ছিদ্রবিহীন পথ দিয়ে তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। হতাশ সে। ভীষণ হতাশ! এমন বউ কারোর না হোক। তবে তাকে মুক্তি পেতে হলে আপাতত এই জন্তুকে সহ্য করতে হবে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“প্লিজ, কন্ডিশন বলো। আমি শুনছি।”

বকুল ভ্রমের রিকুয়েষ্টে ওর পাশ ফিরলো। ইনোসেন্ট ফেইস করে বলে,

-“আমাকে প্রচুড় ভালোবাসতে হবে।”

-“এ্যা?”

-“হ্যাঁ! তবেই আপনি ডিভোর্স পাবেন।”

-“ইউ…”

ক্ষেপে গিয়ে কিছু বলতে নেবে তার আগেই থেমে গেলো। রাগ দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হল। সে তো পুরুষ মানুষ, কেন এইভাবে একটা মেয়ের কাছে রিকুয়েষ্ট করবে। ডিরেক্ট সে ডিভোর্স দেবে বাকীটা মেয়ের ব্যাপার। সে দিলে দিক না দিলে নেই। ঝামেলা শেষ।

সোশ্যাল মিডিয়াতে অন থাকা আজ তার পক্ষে সম্ভব হলো না। মেজাজ,মাথা দুটোই চটকে আছে। উঠে গিয়ে লম্বা কোলবালিশ টা নিয়ে বিছানার মাঝে রেখে দেয়। গম্ভীর স্বরে ধমক দিয়ে তাকে শোধায়,

-“এই মেয়ে! কোলবালিশ ক্রস করবে না। নাহলে অবস্থা খুবই খারাপ করবো। যা করিনি তা করবো।”

হঠাৎ ধমকে চমকে উঠে বকুল। মানুষটা আসলেই বহুরূপী। নাহলে একেক সময় একেক রকম মেজাজ আনে কিভাবে? বিরক্তিকর মানুষটা। রসকষহীন একদম। মুখে ভেংচি কেটে অন্য পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মনযোগ দেয়। সামনে আসে শিরোনাম, ‘দুই ব্রিলিয়ান্টের বিয়ে হয়েছে, তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম না জানি কত ব্রিলিয়ান্ট হবে!’ শিরোনাম টা পড়েই খানিক শব্দ করে হেসে ফেলে সে। পরক্ষণেই নিজেকে শামলে নিয়ে ইন্সটাগ্রামে চলে যায়। অনেকগুলো নোটিশ শো করছে নোটিশবক্সে। পাত্তা দিলো না। বকুলের ইন্সটাগ্রাম ফলোয়ার প্রায় ২২ হাজারের কাছাকাছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় সে এক্টিভ। প্রতিদিনের কাজকর্মের টুকটাক ফটোগ্রাফি করে সব রাত ১১ টার পর পোস্ট করতো। পোস্ট করার সাথে সাথে ফ্যানরা হুড়মুড়িয়ে পড়তো। বকুলের লাইফস্টাইলের জন্যই সবাই তাকে ফলো করে। নিত্যনতুন সব জিনিস ইনভেন্ট করতো বকুল। আর শেয়ার করতো সকলের মাঝে।

নিজের প্রোফাইলে গিয়ে প্রাণবন্ত ছবিগুলো দেখতে থাকে সে। বাবা-মা কে ভীষণ মনে পড়ছে তার। ছবি যত দেখছে তত মনে আসছে তার। বাবা আর তার সারাদিনের চঞ্চলতা স্মৃতি তে নাড়া দিচ্ছে। কি সুন্দর দিন ছিলো। কিন্তু আফসোস সে আর এই দিনগুলি ফিরে পাবেনা। চোখের কার্ণিশ বেয়ে একফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। চমকে গিয়ে পাশে তাকালো। অপর পাশের মানুষটা ঘুমিয়ে গিয়েছে। অবাক হলো কিছুটা। চোখের জল মুছে নিলো। মানুষটা এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলো? কি জানি!

উঠে গিয়ে সে রুমের লাইট টা অফ করে দেয়। আলোতে তার ঘুম হয়না। ফিরে আসে নিজের অবস্থানে। বিছানায় শুয়ে থাকা পুরুষ মানুষটির দিকে চোখ চলে যায় নিজের অজান্তেই। মুহূর্তেই চোখ আটকে গেলো তার। একবার বেলকনির দিকে তাকালো তো আরেকবার পুরুষটির দিকে। দূর থেকে পুরুষ টির মায়াবী মুখশ্রী দারুণ লাগছে। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। জোতস্না ভরা রাত, ঘুমন্ত পুরুষ;যে তার একান্তই। অনুভূতি টা বোধহয় দারুণ। একটু ভিন্ন, একটু ভালোবাসামিশ্রিত।

অতঃপর ব্যাপার টা নিজের ফোনে ক্যামেরাবন্দি করে শুয়ে পরে নিজের মতো। বুকের ভেতর শুণ্যতা নিয়েও পূর্ণতার সুরে তাল মিলিয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে যে!

রাতের একদিকের মানুষ যেমন শান্তিতে ঘুমায়, ঠিক অন্যদিকের মানুষ তখন যন্ত্রনাতে কাতরায়। কেউ প্রিয়জন হারানো যন্ত্রনায় কিংবা কেউ অভ্যাসের নিয়মে। কখনো কখনো কেউ শান্তিতে ঘুমানো লোকেদের দল ছেড়ে স্বেচ্ছায় যন্ত্রনায় ডুব দেয় তো কেউ অনিচ্ছায়!

আমরিন ডুবেছে তাদের কোনো একটায়। বুকের ভেতর তার আগুন জ্বলছে। বাহিরে মা-বাবা দরজাহ ধাক্কাধাক্কি করছে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ করছে না সে। রাগে রুমের সব জিনিস ভাংচুর করছে। সে তো কেবলমাত্র একটা দিন অপেক্ষা করতে চেয়েছিল, এর পরেই তো মনের কথা বলতে চেয়েছিলো বেস্টফ্রেন্ড কে।

‘ বেস্টফ্রেন্ড টু লাইফ পার্টনার হিটস্ ডিফারেন্ট ’ তথাকথিত এই কথাটি তার নোটলিস্টের টপে ছিল। আজও আছে তবে তা রুপ নিয়েছে ভয়ানক রুপে। মা বলেছিলো এক তরফা ভালোবাসা সবসময়ই ঠকে যায়। তাহলে কি ও’ও তাকে ঠকিয়েছে?

-“আরু! মাম্মা দরজা টা খোলো? প্লিজ মাম্মা! পাগলামো করে না।”

মায়ের কথা শেষে বাবার কথাও কানে বাজলো।

-“আরু! বাবা তোমায় কথা দিচ্ছে, আমি কথা বলবো ভ্রমের সাথে। তবুও বের হও তুমি। প্লিজ মা।”

বাবা-মায়ের এই কথাগুলো তার কানে বিষের মতো লাগলো। সহ্য করতে পারলো না। ড্রেসিন টেবিলে কাঁচের জারটা ভেঙে ডান হাতটায় চালিয়ে দিলো। সে বা’হাতি হওয়ায় কাজটা বামহাতে করতে পারলো না। চোখে রাজ্যের অন্ধকার নেমে এলো যেন। একদম ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো। এলোমেলো ঘর, সুদর্শনা কন্যা লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে পড়ে রইলো নিজের মতো।

ভ্রমকে একের পর এক কল করছে ইয়াদ। কিন্তু ফোন তুলছে না। এদিকে ভ্রম ওয়াশরুমে শাওয়ার করতে গিয়েছে। তার ফোন বেজেই চলেছে। সহ্য করতে না পেরে কলটা রিসিভ করে ফেলে সে। কিছু বলার আগেই অপরপাশ থেকে পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসে,

-“আরেহ ইয়ার, কোথায় ছিলি তুই? কতবার ফোন করছি। শোন না! একটা এক্সিডেন্ট ঘটে গিয়েছে…”

একে তো না বলে কল করেছে তার উপর অন্যের হয়ে কথা শোনাও বাজে কাজ। তাই ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটিকে তার বাণী সমাপ্ত করার আগেই সে বলে উঠে,

-“এক্সকিউজ মি। আমি ভ্রম নই, মিসেস ভ্রম। ওনি শাওয়ারে গেছেন আসলে বলে দেবো।”

মেয়েলি কন্ঠস্বর, তার উপর মিসেস ভ্রম শব্দটায় থ হয়ে যায় ইয়াদ। কথার চোটে ভুলেই যায় সে কি বলতে কল করেছিলো। বুলি আওড়িয়ে কেবল বললো,

-“হু।”

তখনি কান থেকে ফোনটা কেড়ে নেয় কেউ। সাথে সাথে পেছন ফিরে তাকায় বকুল। ব্যক্তিটি ভ্রম। স্কিনে এক পলক তাকিয়ে সে কানে ফোনটা নিয়ে বেলকনিতে যায়।

-“হ্যাঁ ইয়াদ, বল।”

-“ভা,ভাই…”

-“না তোতলিয়ে বল।”

কথা বলতে বলতে হাতের টাওয়াল টা নেড়ে দেয় বারান্দায়। তখনই ইয়াদের বলা একটা কথায় হাত থেকে টাওয়াল টা পড়ে যায়। কথাটা এমন,

-“আমরিন গতকাল সুইসাইড করার ট্রাই করেছিলো।”

কথাটা শোনার সাথে সাথে চিল্লিয়ে বলে উঠে,

-“কি বলছিস এইসব? আমরিন..”

-“তুই আয় ভাই!”

ভ্রমকে কথাটা শেষ করতে দিলো না ইয়াদ। কেটে দিলো কল। ভ্রম’র ভীষণ রাগ লাগলো। রেগেমেগে একাকার হয়ে তেড়ে আসে বকুলের দিকে। তার দুই বাহু চেপে দেয়ালের সাথে মেশায়। শক্ত করে চেপে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে হিংস্র সিংহের ন্যায় গর্জন করতে থাকে।

-“অনুমতি ছাড়া ফোন ধরবে কেনো হ্যাঁ? নরম পেয়ে গিয়েছো আমাকে? চেনো না মেয়ে তুমি আমাকে। খুব খারাপ আমি।”

-“আ,আয়ায়া! লাগছে, ছাড়ুন।”

বকুলের কথায় ভ্রম আরো জোড়ে চেপে ধরলো। এইবার বকুলের দম বোধহয় বেরিয়েই যাবে। জীবনের প্রথমবার এই আঘাত গভীর মনে করলো। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে সে। পাত্তা দেয়না ভ্রম। শাসানোর সুরে কেবল তাকে শোধায়,

-“নেক্সট টাইম আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করকে একদম…। ”

কথাটা শেষ করলো না সে। ফের শোধালো,

-“ভ্রমকে দেখেছো মেয়ে, রোদের মতো তেজ দেখোনি তার।”

অতঃপর বকুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক ধাক্কায় রুমের বাহিরে বের করে দেয়। মেয়েটা আদতেও ঠিক আছে কিনা সেটা ভাবলো না সে। দরজা আটকিয়ে দেয়। তাড়াহুড়ো করে নিজেকে মার্জিত করে বেরিয়ে পড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে। তবে যাওয়ার আগে বকুলের কোনো অস্তিত্ব তার চোখে পড়েনি।

#চলবে