#রেড_হার্ট❤️
#পর্ব_চব্বিশ
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
মিহানের শারীরিক অবস্থার উন্নতি গতকাল রাতেই হয়েছে। আজ সারাফাত আর মিহাদ চলে যাবে। সেটারই প্রস্তুতি নিয়ে তারা দুইভাই ড্রয়িংরুমে এসে হাজির। বিন্তি মুখ ভার করে বসে আছেন। মিহাদ টা সারাদিন এই বাড়িটা কে মাতিয়ে রাখতো। ও চলে গেলে এই বাড়ি মাতিয়ে কে রাখবে শুনি? যাওয়া না যাওয়া নিয়ে সারাফাতের আব্বুর সাথে অনেক কথা হয়েছে। ভদ্রলোক সম্মতি দিলেও থাকতে অনিহা দেখাচ্ছে সারাফাত। এতে বকুল কিছুটা আশ্চর্য আর অভিভূত। যে ছেলেটা এই বাড়ি বলতে পাগল সে ছেলেটা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও থাকবেনা? চলে যাবে! একি কাণ্ড!
সারাফাত হাতের ট্রলি টা এক কোণায় রেখে বিন্তির নিকট এগিয়ে গেল। হাটু ভাঁজ করে বসে পড়লো। শান্ত কণ্ঠস্বরে শোধালো,
“মামণি! ছেলের বিদায়ে মন খারাপ করে থাকবে?”
বিন্তি কথা বললেন না। সেভাবেই বসে রইলেন। সারাফাত দেরি করতে চাইলো না। অনেক কাজ তার। অনেক মানে অনেক! তাই কালবিলম্ব না করে বিন্তির হাত টা নিজের কাছে টেনে নিল। করুণ সুর তুলে বললো,
“আমায় ভুল বুঝো না প্লিজ? আজ থেকে যাওয়ার সুযোগ থাকার পরেও কেন থাকছি না, এইটাই তো ভাবছো? বলো! শোনো, এইটার উত্তর আমার কাছে আছে তবে আমি এখন দিতে পারবোনা। কি করছি কেন করছি তার ও কৈফিয়ত দিতে পারবো না। কেবল বলবো, এই বাড়িতে আমি অনেক কিছু ফেলে যাই! কখনো সেটা হয় প্রিয় জিনিস কিংবা প্রিয় মানুষ। এবার তো আস্ত একটা কলিজা ফেলে চললাম!”
সারাফতের কথাটা শুনে বিন্তি চমকে উঠলেন। মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন ছেলেটার দিকে। ওর চোখগুলো টলমল করছে। চোখগুলো লাল। ছেলেটা কি ঘুমোয় নি গতরাতে? এই চিন্তা করেই জিজ্ঞাসা করলেন,
“কি বলছিস এইসব বাবা! আর চোখ এতো লাল কেন? ঘুম হয়নি? চিন্তা করেছিস অনেক?”
তার কাছে মামণির অনেক অনেক প্রশ্ন। কিন্তু সারাফাত উত্তর দিল না। কেবল নিজেকে শামলানোর প্রয়াস চালালো। মামণি কে তার কষ্ট দেবার অধিকার নেই। তবুও আজ সে দায়ে পরা! এই মায়াজাল থেকে তাকে মুক্ত হতেই হবে! নাহলে বিপদই বিপদ!
সারাফাতের উত্তর না পেয়ে এবার বকুল মুখ খুললো।
“কি ব্যাপার! ফুপু এতো করে বলছে থেকে যান নাহয়! কি এমন হবে? নাকি ফুপুকে অবজ্ঞা করছেন?”
বকুলের সোজা উত্তর। শুনতে কাঠকোঠ্যা ঠেকলেও এইটাই সত্য কথা। পরপুরুষের সাথে বকুল যেন একটু বেশিই রুড! তাইতো কত সহজে ওমন কথাখানা বলতে পারলো।
উঠে এগিয়ে এল সারাফাত। বকুলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উত্তর দিলো,
“দায়িত্বের বেড়াজালে আটকে গিয়েছি। তাই চলে যেতে হচ্ছে। তোমরা’ও তো এমন নও! আজ তবে এমন করছো কেন? আজ আমি বোঝাতে চাচ্ছি আর তোমরা অবুঝের মতোই বিহেভ করছো। বলছি তো আজ যাচ্ছি, কোনো একদিন পারমানেন্টলি ফিরে আসবো? মামণি! বিদায় দেবে না?”
এবার তিনি সোফা থেকে উঠে দাড়ালেন। সারাফাতের পূর্ণাঙ্গ কথাটা বিন্তিও শুনেছেন। তাই আর কথা বাড়ালেন না। চোখের কার্ণিশে জমা হওয়া জলটুকু মুছে নিলেন। সারাফাতের কপালটুকু নিজের নিকটে এনে চুমু খেলেন। আর বললেন,
“সাবধানে যাস বাবা! আর পৌঁছে কল করবি কিন্তু! নাহলে তোর হবে!”
“এই মামণি খালামণি আমাকেও আদর দাও? আমি’ই বা কম কিসে? নাকি আমি ওর মতো সানামানা করছি না বলে হালকা করে নিচ্ছো? কোনটা হুম?”
বিন্তির মুখের হাসিটা আরো প্রসারিত হলো। ‘দুষ্টু বাবা’ বলে এগিয়ে এসে কানটা মুলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ মিহাদকে আদর করে দিলেন।
“তুমি কিন্তু ভুলে যাবে না ছোট জনাব! প্রতিদিন কলে কথা বলা চাই!”
“জো হুকুম মামণি খালামণি! ”
অতঃপর বিদায় দেওয়া হলো দুই রাজপুত্র কে! বিন্তি আর আয়না ওদের সাথে সাথে গিয়েছে, এগিয়ে দিতে। বকুল তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। কোলে থাকা মিহানের দিকে একপলক তাকালো। ছেলেটা তার ঘুমিয়ে গিয়েছে। উপরে যেতে।আর ইচ্ছে হলো না। তাই সোফার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে বসলো। পা লম্বা করে বসে তাতে বালিশ পেতে মিহান কে শুইয়ে দিল। আস্তে করে পা দুটো দুলাতে লাগলো। স্মরণ করতে লাগলো সারাফাতের বলা তখনকার কথাগুলো। লোকটা তবে আসলেই রহস্যময়। কি রহস্য ভরা কথাগুলো বলে গেলেন!
•
সেদিনের পর তিনদিন এগিয়েছি। বাসার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েও হয়না। আজ আবার বকুল কলেজে যাবে। বাবুকে রেখে যাবে ফুপুর কাছে। তাই সকাল সকাল উঠে পড়েছে। ফজরের সালাত আদায় করে একটু পড়তে বসেছিল। আধা ঘন্টা যেতেই মিহান কান্না করে উঠে। তার আর পড়া হয়নি। বিচ্ছুটা এ অব্ধি জেগেই আছে। বকুল টেবিল থেকে তার ব্যাগ টা নিয়ে মিহানকে কোলে নিল। উদ্দেশ্য ফুপুর রুম!
“ফুপু। মিহান এসেছে। কোলে নাও!”
ফুপু সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করছিলেন। বকুলের গলার আওয়াজ পেয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গিয়ে বললেন,
“ওরে বাবারে, কে এসেছে? আমার মিহান বাবুটা! এসো এসো!”
বলেই বকুলের কল থেকে নিজের কাছে নিয়ে নিলেন তিনি। আলতো করে চুমু খাইলেন মিহানের কপালে। বকুলে কি এসে ছেলের কপালে চুমু দিয়ে,
“আসছি বাবা? একদম দুষ্টু করবে না! ভালো ছেলে হয়ে থাকবে। ঠিক আছে? মা আসি!”
বলেই সে দ্রুতপায়ে প্রস্থান করলো। হাতে তার একটু’ও সময় নেই। ক্লাস মিস দিলেই শাস্তি ধরিয়ে দেবে! তার ওপর আজ পুরনো বাড়িতে যেতে হবে তাকে। ফুপুকে বললে অবশ্যই তিনি বাধা দিতেন, তাই না জানিয়েই এই প্রচেষ্টা আর উদ্যোগ! তবে সেখানে সে একা যাবেনা। সঙ্গে রিমিকে নিয়ে যাবে। দ্যা অনলি ওয়ান ব্রেইভ গার্ল!
অবশেষে পাঁচ মিনিট পূর্বে বকুল ক্লাসরুমে এসে পৌঁছালো। রিমিকে দেখতে পেলো লাস্ট বেঞ্চে বসা। মুখটা ভার করে মেয়েটা দেয়ালের দিক করে কিছু যেন বিরবির করে বলছে। আর বাকী সবাই নিজেদের মতোন ব্যস্ত। বকুলের খুব ইচ্ছে হলো ভাবুক মেয়েটাকে চমকে দেওয়ার! তাই সে আস্তে আস্তে এগিয়ে ‘ভোহ’ বলে ওঠলো। ভীষণ রকমের ভয় পেল রিমি। সাথে সাথে মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে ওঠলো। ব্যাপারটা অধিকাংশের ই নজরে এলো। কেউ কেউ মজা নিল তো কেউ টিটকারি মারলো। তাদের একজন তো বলেই দিল,
“দেখ! যত্তসব ঢং? এক বাচ্চার মা হয়েছে তবুও তেল কমেনি!”
কথাটা রিমি আর বকুল দুজনেরই কানে এলো। সাথে সাথে বকুলের আনন্দিত মুখটা চুপসে গেল। কিন্তু রিমি দমে থাকলো না। উঠে গিয়ে সোজা সেই মেয়েটার বরাবর দাড়ালো। হাত দুটো এপ্রোনের পকেটে ঢুকিয়ে বললো,
“এখনি কি বললে তুমি? অর্ধেক শুনতে পেয়েছি। পুরোটা বলো, শুনে নিচ্ছি!”
রিমির কথা শুনে মেয়েটির পাশে বসে থাকা মেয়েটি বলল,
“কই না তো। ও তো কিছু বলেনি। ”
বান্ধবী যেমন মিথ্যে কথা বলায় সে মেয়েটি তেঁতে উঠল। রাগান্বিত সরে বলে উঠলো,
“কি সমস্যা! মিথ্যে কেন বলছিস? আমি ওকে ভয় পাই নাকি। এই শোন তুই, আমি বলেছি তোর ফ্রেন্ড! ঘরে স্বামী থাকতেও বাহিরের পুরুষকে দিইয়ে মা হয়েছে। এক বাচ্চার মা সে। আর কলেজে এসে ভাব দেখ? যেন বিয়েটাই হয়নি। বলি! ওর বোধহয় নতুন কাউকে পটানোর শখ জেগেছে। ওর মতো চরিত্রহী…. ”
কথাটা শেষ না করার আগেই সজোড়ে থাপ্পড় পড়লো মেয়েটির গালে। তাল সামলাতে না পেরে সে ঢলে পড়ে যায় পেছনে থাকা বান্ধবীর ওপড়। সে আরো রেগে যায়। চিল্লিয়ে এই বলতেই রিমি মুখ খুলে।
“কি ভেবেছিস টা কি? যখন যা মনে হবে যা ইচ্ছা হবে তাই বলবি? সে অধিকার তোকে দিয়েছে কে? তুই জানিস সত্যিটা? সত্য না জেনে এইসব ফালতু রেওয়াজ কেন তুলবি? মেয়েটার স্বামী এখন আর নেই। তোর কোন আইডিয়া আছে এই মেয়েটা কিভাবে তার দিনগুলো কাটায়? তার উপর এটা তার মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষ! তুই নিজেও তো একটা মেডিকেল স্টুডেন্ট, বুঝিস না, জানিস না? ফের যদি বকুলকে কিছু বলতে আসিস তো এই থাপ্পরের দ্বিগুণ টা আমি তোকে দেব। গট ইট!”
রিমির সবগুলো কথাই শুনেছে সেই মেয়েটি। রাগে ফুঁসে ওঠে চুলগুলো পেছনে জহাড়া মেরে বললো,
“তোকে আর বকুলকে আমি দেখে নেব! সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির শত্রু তোদের আমি হবো। মিলিয়ে নিস!”
চলবে ইন’শা’আল্লাহ।
কেমন হয়েছে তা ছোট্ট করে জানিয়ে দেবেন। আর আমি নিতান্তই ছোট্ট মানুষ। শব্দ, ছন্দ, তালে ভুল থাকলে ক্ষমা করে দেবেন।
#রেড_হার্ট❤️
#পর্ব_পঁচিশ
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
বকুল এগিয়ে এসে রিমি কে শান্ত করলো। পিঠে হাত বুলিয়ে নিজেদের অবস্থানে ফিরে এল।
“এতো রেগে গেলে চলবে? এতো রাগ ভালো না!”
বিরক্তি বোধ করলো রিমি। এদিকে তাকে যাচ্ছে নয় বলে অপমান করছে কোনোরকম প্রতিবাদ করছে না আর তাকে বলছে রাগ করা ভালো নয়! বিরক্তিকর খুব বিরক্তিকর!
রিমির ভাবনা শেষ। বকুলও আর কিছু বলছে না। আগে যখন তাকে কিছু বলতো তখন সে প্রতিবাদ করতো কিন্তু এখন আর সে করেনা। তার পরিবর্তে এখন রিমি প্রতিবাদ করে। ব্যাপার টা তার কাছে দারুণ লাগে। তার মনে হয় রিমি কে পেয়ে জীবনের দ্বিতীয়তম সুখ সে পেয়েছে। দিন যত যাচ্ছে এই মেয়েটার প্রতি তার ভালোবাসা টা বেড়েই চলেছে! আগ বাড়িয়ে রিমিকে কিছু বলতে নেবে আর তখনই ক্লাসে প্রবেশ করে প্রিন্সিপাল৷ প্রিন্সিপালের সাথে আরেকজন এসেছেন। তবে তার মুখে মাস্ক দেওয়া। হয়তো নতুন টিচার।
“স্টুডেন্টস! এনি তোমাদের নতুন টিচার। আজ থেকে অধিকাংশ ক্লাস ই এনার পাবে।”
স্যারের কথা শেষ হতেই লোকটি নিজের মাস্ক খুলে বলতে শুরু করে,
“হ্যালো! আমি ধ্রুব মুশফিক। তোমাদের নতুন টিচার। আশা করি তোমরা আমাকে কো-অপারেট করবে।”
লোকটির কথা শেষ কিন্তু শেষ হলোনা ক্লাসে উপস্থিত সকলের রিয়াকশন। বকুলের গা টা ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। বড় বড় শ্বাস নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটার মুখের আদলে চেয়ে রইল অনিমেষ। একই চেহারা, একই কণ্ঠের ব্যক্তির আলাদা নাম কেন? ক্লাসের অধিকাংশ দের মধ্যেই চরম উত্তেজনা। প্রিন্সিপাল স্যার সকলকে থামতে বললেন।
“স্টপ! তোমরা ভুল ভাবছো। সর্বপ্রথম ওনাকে দেখে আমার রিয়াকশন টাও তোমাদের মতন ছিল। কিন্তু এট লাস্ট এইটাই প্রুভড হলো যে এনি ভ্রম নন ধ্রুব। ধ্রুব মুশফিক।”
বকুল নামটা বারকয়েক আওড়ালো,
“ধ্রুব মুশফিক। ধ্রুব! ভ্রম, ধ্রুব?”
রিমি আসতে করে বকুলের হাতে হাত রাখলো। সাথে সাথে বকুল বলে উঠলো,
“রিমি! আমার অনেক শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বাহিরে যাবো! প্লিইজ!”
“একটু বোস! নে পানি টা খা। শান্ত হয়ে যা। এদিকে মোটিভ দিলে হবে না, আমরা আজ তোদের পুরনো বাড়িতে যাচ্ছি। মাথায় রাখিস।”
বলেই অয়ানির বোতল টা বকুলের দিকে এগিয়ে দিল। বকুল সাথে সাথে ঢকঢক করে পুরো বোতলের পানি টা শেষ করলো। তারপর নতুন টিচার ধ্রুব ক্লাস নিল। এক এক করে সকলের পরিচয় জানতে শুরু করলো। পালা এলো বকুলের। বকুল বলার আগেই দাঁড়িয়ে গেল।
“আমি বকুল তালুক ওরফে মিসেস ভ্রম।”
এই প্রথমবার, প্রথমবার! বকুল প্রকাশ্যে স্বীকার করলো ভ্রমের অস্তিত্ব। এর আগে সবসময়ই নিজেকে পরিচয় করিয়েছে বকুল আহমেদ দিয়েই। কিন্তু আজ ইচ্ছে করেই সে এই পরিচয় দিল। এতে কিন্তু অপরপাশের ব্যক্তির মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা দিলনা। তিনি স্বাভাবিকভাবেই রিমির কাছে গেলেন।
“আপনি?”
“জি আমি মাহবুবা খানম রিমি।”
তারপর এক এক করে সবার পরিচয় নেওয়া হলো৷
~~
আজ কলেজের দুটো ক্লাস অসুস্থতার বাহানা দিয়ে মিস দিয়েছে রিমি বকুল দু’জনেই। এখন যাবে তাদের পুরনো বাড়িতে। মেডিকেল থেকে যার দূরত্ব দশ মিনিটের। তাই তারা রিকশা নিয়ে নিল।
দশ মিনিট পর যখন তারা এসে পৌঁছালো তখন কিছু বাচ্চাদের বাড়ির সামনে খেলতে দেখলো। একপল সেদিকে তাকিয়ে বকুল ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। প্রবেশদ্বারে পা দিতেই মনে পড়ে যায় প্রথমদিনের চিত্র! মিডিয়ার ভীড়, তাকে নিয়ে বাবার অভিব্যক্তি, ভ্রমের জোরপূর্বক স্বীকৃতি। আরোও কত কিছু। মুহূর্তের মধ্যেই বকুলের চোখ অশ্রুবাষ্পে ভরে উঠলো। যা রিমির চক্ষুগোচর হলোনা। সে বকুলের হাতটা শক্ত করে ধরলো। প্রবেশ করলো আধপোড়া বাড়িটায়।
“বকুল! কোথা থেকে শুরু করবি?”
“ব্লাস্টের উৎস থেকে!”
“হুম চল!”
অতঃপর তারা এক এক করে পুরো বাড়ি তল্লাশি চালালো। লাভের লাভ কিছুই পেল না। হতাশ হয়ে হাটু ভাঁজ করে বসে পড়লো মেঝেতে। রিমি বকুলের কাধে হাত রাখলো। তাতে বকুল ফুপিয়ে ওঠলো।
“এই রহস্য আমি কোথা থেকে সমাধান করবো, রিমি? আমার যে প্রথমদিনেই ঘাম ছুটে গেল। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের সমাপ্তি হতে চললো। কিছুই কি পাবোনা?”
রিমি খানিকক্ষণ চুপ মেরে থাকলো। কিয়ৎক্ষণ ভেবে বলে ওঠলো,
“তোর আর ভ্রমের বেডরুম টাই তো চেক করিস নি। চল! আল্লাহ চাইলে শেষবারের মতোন কিছু একটা পেয়ে যাবো!”
বকুল দূর্বল কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“ওখানে যাওয়ার মতোন সামর্থ্য আমার নেই রিমি। আর গেলেও পাবোনা। হয়তো ওর দেহটা অতিরিক্ত আগুনের স্পর্শে সবটুকু নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে? তাই পুলিশেরা পাইনি!”
“বকুল! ইমোশনাল কথাবার্তা বলার উপযুক্ত সময় এইটা নয়। লজিকালি ভেবে দেখ, তদন্ত করতে এসেছিস আর যা ভয় পাস তাই তদন্ত করিসনি। অথচ কেউ সেটা না জেনে, না বুঝে সুযোগ ভেবে কাজে লাগালো? হতেও তো পারে রহস্য সেখানেই আছে?”
বকুল এবার উঠে দাড়ালো। হাতের উল্টোপিঠে মুখের ঘামটুকু মুছে নিল। বড় একটা শ্বাস নিয়ে ইন-শা-আল্লাহ বলে সিড়ির দিকে পা বাড়ালো। তখনই রিমি তাকে থামিয়ে দিল।
“বকুল দাড়া!”
“কি?“
“এখানে ওঠার আগে চেক করতে হবে সিড়িগুলো মজবুত আছে কিনা!”
বকুল যে পা বাড়িয়েছিল তা ফেলে নিচে নেমে এল। দুজনেই যথেষ্ট দূরত্বে থেকে সিড়িগুলো চেক করলো। কেবলমাত্র একটা সিড়ি নাড়াতেই সেটা ধসে পড়ে গেল। বকুল মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে ওঠে। কারণ ও’ ই এই সিড়িটায় হাত দিয়েছিল। যা দেখে রিমি বললো,
“সাবধানে!”
অতঃপর বেশ সতর্কতা অবলম্বন করে রিমি আর বকুল উপরের তলায় উঠে গেল। বন্ধ রুমগুলো চেক করে সন্দেহভাজন কিছু পেলনা। শেষমেশ প্রবেশ করলো তার আর ভ্রমের বেডরুমে। বেড টা পুড়ে ছাই হয়ে সেভাবেই রয়ে গেছে। ড্রেসিন টেবিলের আয়নাটা ভাঙা। আলমারি টা থেতলে আছে।
বকুল আর রিমি। দু’জনেই প্রচণ্ড অবাক হয়। ঘর পুড়েছে তাই বলেছে জিনিসপত্রের এইরম ক্ষতি হবে তা তো অসম্ভব কিছু! তবে?
এটুকু ভাবতেই কয়েকজনের পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় তারা। বুকটা সাথে সাথে ছেত করে উঠলো। কোথায় লুকোবে কোথায় লুকোবে এই করে বেলকনিতে চলে আসে বকুল। নজরে আসে ভ্রমের হাতে লাগানো গাছের টব। রিমি কে এক টানে বেলকনিতে আনতেই টবে বকুলের পা লেগে যায়। ফলস্বরূপ টব টা গড়িয়ে পেছনে যাবার বদলে সামনে গড়িয়ে যায়। আশ্চর্য হয়ে যায় বকুল। এরুপ হবার কারণ? রিমির হাত ধরেই টব রাখার স্থানে সে পা বাড়ায়। সাথে সাথে টাইলস ভেদ করে বকুল একটা বক্সে চলে যায়। আচমকা এমন টা হওয়াতে রিমি বোকা বনে যায়। বকুল না তার হাত ধরে ছিল? তবে গেল কোথায়? এই ভাবতে ভাবতে সেও সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়। ফলে সেও গিয়ে পৌঁছায় বকুলের কাছে। লম্বালম্বির বক্স টা বেশ বড়সড়। তবে বক্স টা কাঁচের, তবুও কিছু নজরে আসছে না তাদের, সবই ফাঁকা দেখাচ্ছে কাঁচে। দুজনেই ইশারায় চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর মিনিট খানেক পর বক্সের মুখ খুলে এল। রিমি বকুল দুজনেই পা বাড়ালো বাহিরে। বক্সের বাহিরে পা রাখতেই গায়ে হিমশীতল হাওয়া লাগলো। গা ঝাড়া মারলো দুজনের ই। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো এখানকার রুমগুলো দেখে। প্রত্যেক দরজার সামনে পাসওয়ার্ড বক্স। বোধহয় সঠিক পাসওয়ার্ড দিলে দরজা গুলো খুলে যাবে। এখানে এসে কোনো এক অজানা কারণে রিমি আর বকুল দুজনেই চোখে চোখে কথা বলছিল। তবে এবার একে অপরের কাছাকাছি এসে জিজ্ঞাসা করলো।
“কি এইটা?”
“কোনো সিক্রেট রুম?”
“তা তো অবশ্যই! কিন্তু এইটা কার?”
“ ভ্রমের রুম থেকে যেহেতু, অবশ্যই ভ্রমের!”
রিমির কথায় বকুল চিন্তিত হয়ে পড়লো। যা দেখে রিমি গলা ঝেড়ে বকুলের কানের কাছে আসলো।
“আমার মনে হয় এখানে আমাদের বেশিক্ষণ থাকাটা সেইফ হবেনা। চল, একবার এখানের দরজাগুলোর প্যাটার্ন আর দরজার ওপারে কি আছে তা দেখে যাই!”
“আজ দেখেই চলে যাবো? দরজা খোলার ট্রাই করবো না?”
“উহু! আজ নয়। এইটা আমরা অন্য একদিন করি। এমন তো হতে পারে ভুল পাসকোড দিলে অপরপাশের ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ জেনে যাবে কেউ এখানে এসেছিল?“
“যদি সিসি থাকে?”
“এই বাড়ির ইলেক্ট্রিক কানেকশন নেই বকুল! সো এখানে সিসি থাকার প্রশ্নই আসেনা। দেয়ালের চারপাশ দেখেছিস? বদ্ধ! তারপরেও আশা রাখছিস কি করে? সেসব বাদ দে । আগে চল এই রুমের বাহির পথ বের করি। তারপর ছবি আর ভিডিও করে চলে যাবো।”
“কিন্তু সব তো বদ্ধ!”
“শোন বকুল, যেখানে সমস্যা থাকে? সেখানেই সমাধান থাকে! ”
“রেগে যাচ্ছিস ?”
“এখন অন্তত তুই মুখটা বন্ধ রেখে হেটে চল!”
এই বলেই বকুল আর রিমি দেয়ালের কাছে গেল। তারপর বকুলের মনে পড়লো উপরের পায়ের আওয়াজের কথা। রিমিকে জানালে রিমি উত্তর দেয়,
“শোন, এইখানে যারা আসে? তারা উপর থেকে আসে না। অন্য কোনো পথ অবলম্বন করে আসে। কারণ উপর থেকে আসলে ওই সিড়িটা আগে থেকেই ধসে যেত। যেহেতু আসা যাওয়া নেই সুতারাং এখানকার কোনো পথ অবলম্বন করেই আসে!”
রিমির কথা শেষ হতেই হঠাৎই একটা লেজার রিমির ওপর পড়লো। তারপর…..
চলবে ইন’শা’আল্লাহ।
#রেড_হার্ট❤️
#পর্ব_ছাব্বিশ
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
সুসজ্জিত বিশালাকার রুমে নিজের মতোন করে আরাম করে পায়ের ওপর পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে রেখেছে ধ্রুব। চোখে মুখে শীতলতার ছাঁপ। খোচা খোচা দাড়ি গুলো তে পানি চিকচিক করছে। বোধহয় সেটা ঘাম! আশ্চর্য! ঘরে এসি থাকতেও ঘেমে নেয়ে এক হয়ে পড়ার কোনো ছুঁতো খুঁজে পেল না। তখনই দরজায় আওয়াজ হলো। ধ্রুব জানে ব্যক্তিটি কে। তাই কালবিলম্ব করলোনা। বইয়ে মুখ গুঁজেই গলায় গম্ভীরতা রেখে বলল,
“কাম ইন!”
সাথে সাথে দরজা খুলে গেল। প্রবেশ করলো কেউ! নাকে বাজলো মেয়েলি পারফিউমের কড়া সুবাস! যা অল্পক্ষণের মধ্যেই ছড়িয়ে গেল পুরো ঘরে। ধ্রুব শাহাদত আঙুলে নাকটা ঘষে নিল। এক হাতে এসির রিমোট টা নিয়ে এসি টা অন করে দিল। মেয়েটি এসেই ধ্রুব’র মুখ থেকে বইটা সরিয়ে নিল, ফেলে দিল মেঝেতে। খানিকটা ঝুঁকে ধ্রুবের খুব কাছাকাছি তে গেল। হাতটা এগিয়ে ধ্রুবর বুক বরাবর রাখলো। ধীরে ধীরে হাতটা বিচরণ করতে লাগলো ধ্রুবর সর্বাঙ্গে। ধ্রুবর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তার ভাবে বোঝা যাচ্ছে এগুলো তার নিত্যদিনের ঘটনা, যা সে অভ্যাসে নিয়ে নিয়েছে।
মেয়েটা চারিপাশে ঘুরতে ঘুরতে একটা সময় ডিরেক্ট ধ্রুবর পেছনে দাঁড়িয়ে গেল, ধ্রুবর গলায় মুখ রেখে হাত দুটো সামনে এনে একসাথে করে নিল।
“ধ্রুব! আর কত অপেক্ষা করাবে? প্রতিদিন আমার কাকুতি মিনতি করতে ভালো লাগে না! চলো না বেব, আমরা বিয়ে করে ফেলি? তারপর তোমাকে ছাড়া আমার আর একা থাকতে হবে না, উফফফ কি দারুণ হবে বলো? তার ওপর আমি তোমার সাথে তোমারই কলেজে জয়েন করছি!”
মেয়েটার উৎফুল্লতার সহিত কথাগুলো শুনেও ধ্রুব কোনোরকম রিয়েকশন দিলনা। যা দেখে মেয়েটা সেকেন্ড কয়েকে চোখ মুখে কাঠিন্যতা রেখে ফের আবেদনময়ী হয়ে উঠলো,
“বেইব! ওয়ান নাইট ফর মি? জাস্ট ওয়ান নাইট। ইউ এন্ড মি!”
ধ্রুবর বোধহয় এই কথাগুলো সহ্য হলো না। তড়িতবেগে উঠে দাড়ালো। চেহারায় তার রক্তিম ভাব স্পষ্ট ফুটে উঠলো। মৃদ্যু আওয়াজ তুলে রাগ সংবরণ করে বললো,
“স্টপ আমরিন! তোমার মা-বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। ওনারা ডেট আরো একমাস বাদে ফিক্সড করেছেন। আর তুমি? কি পাগলামো শুরু করেছো? ইউ নো না? আমার স্ট্রং পার্সোনালিটির উইমেন পছন্দ? আর এটা ভুলে যেও না, যতোই তুমি আমায় আবেদনময়ী রূপে নিজেকে দেখাও না কেন কোনোমতেই আমি আমার শর্ত পূরণ না পেলে বিয়ে টা করবো না!”
“নো বেইব! তোমার মা-বাবা কে আমি এনে দেবো বাট বিয়ে তুমি আমায় করবে, বলো?”
ধ্রুব কঠোর জবাব দিল,
“আগে শর্ত…”
ধ্রুবের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমরিন ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরলো। সামনে এসে দূরত্ব ঘুচায়। ধীরে ধীরে ধ্রুবর ওষ্ঠ দখল করতে নেয়, তখনই ধ্রুবর ফোনে এলার্ট আসে!
__________
একটা লেজার রিমির ওপর এসে পড়লো। সাথে সাথে উন্মোচিত হলো বহিরাগমনের পথ! ‘পথ’ শব্দটা বার কয়েক বার আওড়ালো রিমি। নির্দিষ্ট স্থান থেকে কিছু দূরত্বে সরে আসলো। সাথে সাথে দরজা টা আবার বন্ধ হয়ে গেল। তারপর আবার সে স্থানে গেল। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে নিল। দু’বার পথ শব্দ টা উচ্চারণ করল। তারপর আবার উন্মোচিত হলো পথ! অর্থাৎ এই অংশে এসে পথ শব্দ দু’বার উচ্চারণে পথ হয়েছে। অর্থাৎ পাসকোড হচ্ছে পথ শব্দ। রিমি ঘার বাকিয়ে পেছনে তাকালো। বকুল তার পানেই তাকিয়ে তার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। সে ইশারায় ডাক দিল। ইশারায় সাড়া দিয়ে বকুল এগিয়ে আসলো।
“পথ পেয়ে গিয়েছি, এবার ক্যামেরা অন করে ফুটেজ গুলো নিয়ে আসবো। তুই এইখানেই দাড়া আমি ফুটেজ নিয়ে এই আসছি!”
“না, তুই দাড়া আমি আনছি! অনেক করেছিস তুই, এবার আমার পালা।”
প্রতিত্তুরে রিমি মুচকি হাসলো। মাথা নাড়িয়ে তাকে সম্মতি দিল। নিজের ফোনটা নিয়ে চলে গেল ছবি আর ভিডিও নিতে। অতঃপর প্রত্যেকটা জায়গা পুঙ্খাণু পুঙ্খাণু ভাবে তল্লাশি চালিয়ে ভিডিও নিয়ে তারা সিক্রেট ডোর দিয়ে বাহিরে চলে গেল। কিন্তু তাদের দুজনের কেউই একটা জিনিস লক্ষ্য করলো না যে, তাদের আউট হিস্ট্রি তে দুজনের ফুটপ্রিন্টস রয়ে গিয়েছে!
To be continue…