রোদরঞ্জন পর্ব-১৪+১৫

0
206

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১৪
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

রোদের মিষ্টি আলো ইনানের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। ধীর গতিতে চোখ খুলে ইনান। চোখের পাতা কেমন ভারী ভারী লাগছে, শরীরও অচলাবস্থা। হেডবোর্ড ধরে উঠে বসে সে। কাল সারারাত কান্নার ফলে এখন মাথা ধরে গেছে। ঘড়িতে এখন সকাল সাড়ে নয়টা। সাদা কালো মেঘ আকাশে বিদ্যমান, তার মাঝে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। ধরণীতে ধেয়ে আসা হলুদ আলো কিছুক্ষণ পর কালো মেঘেদের কারণে রূপ নিবে বারিধারায়।

ইনান আজ ভার্সিটি যাবে। ফ্রেন্ডদের মুখোমুখি হবে, শরৎএর মুখোশও খুলবে সেই সাথে। ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসল। জেহফিলকে কোথাও দেখতে পারছে না সে, তার পায়ের কাছেও আজ ঘুমোয়নি। সচরাচর জেহফিল এত দেরিতে ঘুম থেকে উঠে না। জেহফিল একজন মর্নিং বার্ড, তবে আজ কোথায়?

ইনান জেহফিলের রুমে কয়েকবার নক করল, সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে দেখল রুমটা ফাঁকা। জেহফিলের থাকার জায়গা আর একটাই, তা হচ্ছে তার আর্ট রুম। রুমটা সবার শেষে। লম্বা করিডোর পেরিয়ে যেতে হয়। করিডোরে রুম দুইটা, ইনান কখনোই কোনো রুমে প্রবেশ করেনি অবশ্য, তাই বলতে পারবে না রুমের অবস্থা। আর এই করিডোর‌ রাত হোক দিন হোক সবসময় অন্ধকার লেগে থাকবেই।

ইনান যখন রুমের দরজাটা খুলতে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই ওপাশ থেকে দরজাটা খুলে জেহফিল ইনানের সামনে চলে আসল। আচমকা ঘটনায় ইনান প্রায় ভয় পেয়ে পিছু হটে গিয়েছিল। বুকে থুতু দিয়ে জেহফিলের দিকে তাকাল।‌ চুল উস্কখুস্ক, ধূসর চোখজোড়া সবসময়ের মতোই শুন্য। গত রাতের শার্ট এখনো পরনে, কয়েকটা বোতাম খোলা। না চাইতেও ইনানের অবাধ্য চোখ জেহফিলের ব্যায়াম করা শরীরের ভাঁজে গিয়ে পড়ছে।

‘মর্নিং বাটারফ্লাই।’ জেহফিল হেসে বলল, তবে ইনানের মনে হলো সেই হাসিটা জেহফিলের চোখ ছুঁতে পায়নি।‌

‘মর্নিং। ডিস্টার্ব করলাম?’

‘আমি কখনোই তোমার ডাকে ডিস্টার্ব হই না বাটারফ্লাই, আর না কখনো হবো‌।’ জেহফিল স্মিত হাসল, এবারও তার হাসি চোখে পৌঁছাল না, চোখ দুটো নির্লিপ্ত।

ইনান জেহফিলের নিরাবেগ চোখে কিছু একটা খুঁজতে লাগল, কিন্তু জেহফিলের চোখের অতলে ব্লাক হোল ছাড়া কিছুই দেখল না। জেহফিলের চোখের ভাষাটাকে সবচেয়ে কঠিন ভাষা মনে হলো।‌

জেহফিল ইনানের হাত ধরে করিডোর থেকে বেরিয়ে আসল।

‘সরি বেবি, ব্রেকফাস্ট রেডি করতে পারলাম না বলে, তুমি দশ মিনিট ওয়েট করো, কুইক কিছু বানাচ্ছি।’

ইনান রুমে গেল না, জেহফিলের সাথেই রান্নাঘরে চলে আসল জোর করে। জেহফিল অনেকবার বারণ করল কিন্তু ইনান কানেই তুলল না।

ইনান যখন ব্রেড টোস্টারে দিচ্ছিল জেহফিল তখন দক্ষ হাতে অ্যাভোকাডো কাটছিল। স্কিল্ড শেফদের মতো সেকেন্ডের মাঝেই অ্যাভোকাডোটি চিকন চিকন পিসে পরিণত হলো। ইনান আড়চোখে জেহফিলের কাজ দেখছিল‌। একটা সত্যি কথা যা সে নিজেও অস্বীকার করতে পারবে না, তা হলো সে জেহফিলের কাজকে মনে মনে হিংসে করে। সে মেয়ে হয়েও ঘর ঝাড়ু দিয়েই টায়ার্ড হয়ে যায় আর সেখানে জেহফিলের ছোট থেকেই পড়াশোনা, আর্নিং, রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সামলানো দেখে ইনানের হিংসেই হচ্ছে বৈকি। সারাদিন তিড়িং বিড়িং করা ছাড়া তো তার আর কোনো কাজ নেই।

নাহ! এসব হিংসে করে লাভ নেই। সে এখন আর বাচ্চা নেই। জেহফিলকে তার সাহায্য করা প্রয়োজন। একা একটা ছেলে আর কত করবে? এখন সংসারটা তারও। সে পায়ের উপর পা তুলে আদেশ করবে আর জেহফিল খেটে মরবে তা তো হয় না। বাহিরের মানুষ শুনলে ছি ছি করবে।

হুট করে সে জেহফিলের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিলো। দ্রুত গলায় বলল,

‘আমি‌ কাটছি, আপনি গিয়ে রেস্ট নিন।’

‘পারবে না তুমি। দাও আমাকে।’

জেহফিলকে ঠেলে সরিয়ে দিলো ইনান, ‘পারব, দুই মিনিট লাগবে। সরুন আপনি।’

‘জেদ করো না সোনা, হাত কাটবে।’

‘আমি বাচ্চা না।’

ইনান আনাড়ি হাতে অ্যাভোকাডো কাটতে লাগল আর জেহফিল বুকের উপর হাত ভাঁজ করে ইনানের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগল। অ্যাভোকাডোর অর্ধেক কাটতে গিয়ে ইনান চার মিনিট ব্যয় করল, তাও সাইজের কোনো ছিড়ি নেই, একটা মোটা সাইজ আরেকটা চিকন, যেইখানে জেহফিলের সবগুলো সমান। তাও ইনান হাল ছাড়ল না।

ইনানের জেদ দেখে জেহফিল ছোট্ট শ্বাস ফেলে তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। ইনানের ঘাড়ে চিবুক রেখে দুহাতে ছুরি সমেত ইনানের হাত ধরে। ইনানের হাত থমকে গেল। জেহফিলের হুট করে এত কাছে আসাতে হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে তার। জেহফিল ইনানের হাত ধরে নির্দেশনা দিচ্ছে কীভাবে কাটতে হয়, কিন্তু ইনানের কি সেই খেয়াল আছে? জেহফিলের বুকে ইনানের পিঠ ঠেকানো, তার পারফিউমের ঘ্রাণে মাতাল হয়ে পড়ে যাবে যাবে অবস্থা ইনানের। জেহফিলের উষ্ণ নিঃশ্বাস, শরীরের ঘ্রাণ তাকে পাগল করে দিচ্ছে যেন। ইনানকে আর মাতোয়ারা হতে না দিয়ে জেহফিল ইনানকে ছেড়ে সরে গেল। এটা ইনানের ভালো লাগলো না মোটেই, সে জেহফিলের বাহুডোরে আরো কিছুক্ষণ বন্দী থাকতে চেয়েছিল। তাকিয়ে দেখল কাটাকুটি শেষ, তাই জেহফিল চলে গিয়েছে। ইনানের ইচ্ছে করছিল জেহফিলকে ডেকে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ওর ঘ্রাণ নেয়।

জেহফিল ইনানকে উস্কে দিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে হেসে ডাইনিংএ চলে আসলো। ইনান দৌঁড়ে আসল জেহফিলের পেছন পেছন। জেহফিলের হাত ধরে থামাল। জেহফিল ভনিতা করে বলল,

‘কিছু বলবে?’

জেহফিলকে এবার সত্যিই সত্যি অবাক করে দিয়ে ইনান বলল, ‘সরি।’

‘ফর হোয়াট?’

ইনান প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল, ‘আপনাকে নিয়ে আমার মজা করা উচিত হয়নি। আমি আমার এবং ফ্রেন্ডদের তরফ থেকে ক্ষমা চাইছি।’

জেহফিল বিরক্ত হলো কিছুটা। ইনানের কাছ থেকে অন্যকিছু আশা করেছিল, কিন্তু তার ফ্রেন্ডদের হয়ে সরি বলাটা জেহফিলের মেজাজ গরম করে দিলো। মেজাজ সংযত রেখে বলল,

‘আমি এসব ছোটোখাটো ব্যাপারে মাথা ঘামাই না। তুমি কি এতক্ষণ এসবই চিন্তা করেছিলে?’

ইনান মাথা উপর নিচ দুলিয়ে বলল, ‘আসলে কালকে আপনি ওভাবে কথাটা বললেন তাই ভেবেছি রাগ করে আছেন আমার উপর।’

জেহফিল গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। ইনানের গাল হাতের আঁজলায় নিয়ে সফ্ট কণ্ঠে বলল,

‘আমি তোমাকে না, তোমার ফ্রেন্ডদের বলেছি। তোমার কোনো ফ্রেন্ডকেই আমি বিশ্বাস করিনা। ইভেন আশেপাশের কাউকেই না।’

‘আমাকেও না?’

জেহফিল ঝুঁকে এসে ইনানের মুখে ফু দিয়ে ছোট ছোট চুল সরাল, ক্ষীণ গলায় বলল,

‘তুমি যদি আমাকে বিষ দিয়ে বলো এটা চকলেট, আমি চোখ বন্ধ করে খেয়ে ফেলব- এতটা বিশ্বাস করি তোমাকে বাটারফ্লাই।’

জেহফিলের এই কথায় ইনানের শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। হৃদকম্পন সৃষ্টি হয়। অপলক চেয়ে থাকে জেহফিলের চোখের দিকে। জেহফিল তাকে এতটা বিশ্বাস করে, এতটা ভালোবাসে, তার বিনিময়ে কি জেহফিলের কিছু পাওয়ার কথা না? সেটা না দিলে যে ইনান দায়গ্রস্ত থেকে যাবে সারাজীবন।

জেহফিলকে দ্বিতীয়বারের মতো অবাক করে দিয়ে ইনান জড়িয়ে ধরল তাকে। শক্ত করে। জেহফিলের প্রথমে বিশ্বাস হলো না ইনান তাকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরেছে কিনা, যখন ইনানের কোমল হাত জেহফিলের পিঠকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করল তখন তার বিশ্বাস হলো যে এটা আসলেই সত্য, কল্পনা না। জেহফিল ইনানকে ধরল না প্রথমে। যখন ইনান জেহফিলের বুকে মিশে শক্ত করে ধরল, জেহফিল বুঝে গেল ইনান চাইছে তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য। দেরি না করে জেহফিল জড়িয়ে ধরল ইনানকে। ইনানের থেকেও দ্বিগুণ জোরে চেপে ধরে।

ইনানের দম বন্ধ হয়ে আসছিল, কিন্তু জেহফিলকে সরাল না। জেহফিল এই খুশিটুকু উপভোগ করুক। জেহফিলের বুকে মাথা রেখে শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ইনান।

প্রায় অনেকক্ষণ কেটে গেল এভাবে। জেহফিলকে ছাড়ার জন্য ইনান যখন হাত আলগা করল তখন জেহফিল ফিসফিস করে বলল,

‘বাটারফ্লাই।’

‘হুম?’

‘আমাকে কেউ কখনো জড়িয়ে ধরেনি। কয়েক মিনিট আগেও ওয়ার্ম হাগ কী সেটা আমি জানতাম না।’

ইনান বিস্মিত চোখে চায়। জেহফিলের এই পঁচিশ ছাব্বিশ বছরেও কেউ তাকে জড়িয়ে ধরেনি এটা আসলেই অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার।

‘সিরিয়াসলি?’

‘হ্যাঁ। আমার জীবনে এত গভীর স্নেহে জড়িয়ে ধরা মানুষ তুমিই প্রথম এবং তুমিই শেষ। আমার জীবনে আর কেউ না আসুক, লাগবে না কাউকে আর, শুধু তুমি থাকলেই চলবে।’

জেহফিলের কথাটা শুনে ইনানের যতটা মায়া লাগল ততটা কষ্টও লাগল। ঘাড় উঁচু করে জেহফিলের দিকে চেয়ে বলল,

‘একা বসবাস করাটা অনেক টাফ তাই না?’

‘ছিল, এখন আর নেই। এখন তুমি আছো না? তুমি থাকতে একাকীত্ব কিসের?’ ইনানের গালে আঙ্গুল বুলিয়ে বলল জেহফিল।

জেহফিলের হৃদয়স্পর্শী কথায় ইনানের চোখ টলমল করতে লাগল। আবারও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল জেহফিলকে, উষ্ণ বাঁধনে। এই মানুষটা এখন তার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। তার একটু কাছে থাকাটা জেহফিলকে সবচেয়ে বেশি খুশি রাখে। এই সামান্য কাজটা ইনান করতে না পারলে তো আসলেই সে সেলফিশ হয়ে যাবে।

.

.

খাবার শেষ করে ইনান রেডি হতে লাগল ভার্সিটির জন্য। জেহফিলকে কিচেনে দেখে সে বলল,

‘ভার্সিটি যাবেন না?’

‘নাহ, ছেড়ে দিয়েছি।’ প্লেটগুলো তাকে রেখে বলল।

‘কীহ! কেন?’ ইনান ব্যাগ রেখে জেহফিলের কাছে আসল।

টিস্যু দিয়ে হাত মুছে জেহফিল ইনানের দিকে ফিরল,

‘আমার যেটুকু পড়ার দরকার ছিল সেটুকুর চাইতেও বেশি পড়েছি। আর লাগবে না পড়ালেখা। এখন আমি ফুল টাইম আর্টিস্ট।’

‘কিন্তু সার্টিফিকেট তো অর্জন করা লাগবে তাই না?’

কিচেন কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়াল জেহফিল, ইনানের চোখে চোখ রেখে বলল,

‘কিসের জন্য? আমি তো আর কোনো চাকরি বা বিজনেসে ঢুকছি না যে সার্টিফিকেট দরকার হবে। যেটা আমার কখনো কোনো কাজে লাগবে না সেটা অর্জন করে কী লাভ? নরমালি একজন চাকরিজীবীর বাৎসরিক যা বেতন তা আমি আমার দুইটা পেইন্টিংয়েই আর্ন করে ফেলতে পারি। যেটা করতে আমার ইচ্ছে নেই তারচেয়ে ভালো নয় কি যেটায় আমার লাভ এবং ইচ্ছে দুটোই আছে, সেটা করার?’

জেহফিলের যুক্তিসঙ্গত কথার কাছে ইনান কোনো কথা খুঁজে পেল না। জেহফিল যা বলছে তা জেহফিলের দিক থেকে আসলেই সঠিক। তার অলরেডি একটা ক্যারিয়ার আছে, তাহলে অবশ্যই তার উচিত সেটায় বেশি ফোকাস করা। ইনান মাথা নাড়াল। জেহফিলের সাথে সে একমত।

‘তুমি ভার্সিটি যাবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘দুই মিনিট অপেক্ষা করো, রেডি হয়ে আসছি।’

‘আমি যেতে পারব।’

‘তোমাকে একা ছাড়ছি না আমি।’

জেহফিল চট করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল ইনানকে নিয়ে।

.

ইনান ক্লাসে যেতে যেতে বারবার ফোন দেখতে লাগল।‌ ফারা বা মুগ্ধর কোনো কল এসেছে কিনা দেখতে। গ্রুপেও কোনো ম্যাসেজ আসল না, ব্যাপারটা কী?

ক্লাসে যেতেই দেখল পুরো ক্লাসে কোলাহল। তারা সবাই কিছু একটা নিয়ে দলে দলে ভাগ হয়ে আলোচনা করছে। কারো চোখে আতঙ্ক, কারো চোখে উত্তেজনা।

ইনান ক্লাসের একজনকে বলল, ‘কী হয়েছে রে? কী নিয়ে এত গসিপ চলছে?’

‘তুই জানিস না?’ আশ্চার্যান্বিত গলায় বলল মেয়েটি। যেন ইনান না জেনে খুব বড় একটা ভুল করেছে।

‘কী জানব?’

‘ফারার আর মুগ্ধর খবর?’

ইনান ভ্রুকুটি করে তাকাল, ‘কী খবর?’

‘ভাই অনেক লম্বা কাহিনী।’ খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ভঙ্গিতে মেয়েটা নড়েচড়ে বসে।

‘ফারা আর মুগ্ধর সাথে ভৌতিক কাহিনী ঘটে গেছে। ফারারটা বলি আগে। ওই মেয়ে রাতের বেলা ঠিকঠাকভাবেই ঘুমাতে গেছে, সকালে উঠে দেখে ওর চুল নেই, পুরাই টাক মাথা, সব চুল খাটের পাশে পড়ে আছে, শুধু তাই না, ওর ভ্রুও নেই, এমনকি চোখের পাপড়িও নেই। কী ভৌতিক কাহিনী তাই না? না কারো কোনো চিহ্ন পাওয়া গেছে আশেপাশে, কে করেছে না করেছে কিছুরই হদিস পাওয়া যায়নি। বেচারির লম্বা চুলগুলো সব কেটে ফেলা। ফারা মেয়েটার অবস্থা ভালো না নাকি। মিনিটে মিনিটে অজ্ঞান হয়ে যায় কান্না করতে করতে, আয়নায় চেহারা দেখে আর অজ্ঞান হয়।’

ইনান হা করে মেয়েটির কথা শুনছিল। কী যা তা বলছে? কী ভৌতিক এবং অদ্ভুত! ফারার চুলগুলো পা অবধি লম্বা, এই একটা জিনিসই ছিল যেটা দিয়ে ফারা অহংকার করতে পারত। তার এই লম্বা চুলের জন্য সে প্রপোজাল পেয়েছিল তেল এবং শ্যাম্পুর অ্যাড করার। যার শুটিং শুরু হওয়ার কথা সামনের মাসে। আর এখন কিনা তার সেই চুলই নেই? আবার ভ্রু, আইল্যাশও নেই? এ আবার কেমন ঘটনা? ভুতের যদি চুল পছন্দ হতো চুল নিলো না কেন? পাশে ফেলে রেখে গেল কেন?

‘তারপর শুন মুগ্ধর কাহিনী।’ চোখ বড় বড় করে বলল মেয়েটি, ‘মুগ্ধ সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি, ও যখন চোখ খুলল ও দেখে ওর দুইটাশে দুই হাতে তিনটা করে রড বাঁধা, হাত নাড়াতে পারেনাই। আর ওর গলার আর বুকের উপর মোট পাঁচটা মোটা রড দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। ভাবতে পারিস?’

‘কী?’ প্রায় চিৎকারের স্বরে বলে উঠল ইনান, ‘ও শ্বাস নিয়েছে কীভাবে?’

‘ওর পা দুইটা খোলা ছিল। যখন দম বন্ধ হয়ে আসছিল ও পা দিয়ে খাটে জোরে জোরে আঘাত করা শুরু করলে ওর বাবা আসে, আর দেখে ওর এই অবস্থা। ওর সারা মুখ, হাত লাল হয়ে গিয়েছিল। ও তো ঠিকমতো কিছুক্ষণ শ্বাসই নিতে পারে নাই। কথা বলা তো দূরের কথা। ওর বাবা যদি একটু লেট করে আসতো ও কিন্তু সত্যি মা’রা যেত রে।’

ইনানের মাথা চক্কর মারছে। তার মনে হচ্ছে যা শুনছে এগুলো সব গল্প। এসব সত্যি হতে পারে না! ইনান ক্লাস না করে বেরিয়ে গেল। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। মুগ্ধ আর ফারার সাথে হওয়া ঘটনা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। যতই হোক তার তার ফ্রেন্ড। ফারা শুটিং নিয়ে কত এক্সাইটেড ছিল আর এখন??

ইনান ফারার বাড়িতে গেল আগে। কিন্তু দেখা করতে পারল না। ও কিছুতেই রুমের দরজা খুলল না। তার বাবা মাকেও রুমে ঢুকতে দেয়নি। শুধু দরজার ওপাশ থেকে জোরে জোরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। হতাশ হয়ে ইনান মুগ্ধর বাড়িতে গেল, তবে কাউকেই পেল না। শুধু পাশের বাড়ি থেকে শুনল হসপিটালে নিয়ে গেছে। ইনান টয়াকে ফোন লাগাল, অন্তত ও তো জানবে কোন হসপিটাল। কিন্তু টয়া ফোন তুলল না। কয়েকবার কল দিল ইনান তাও বারবার ব্যস্ত দেখাচ্ছে।

ইনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত শরীরে চলে গেল ভার্সিটিতে। ক্লাস শেষ হওয়া পর্যন্ত টয়াকে লাগাতার কল দিতেই লাগল, কোনো কাজে আসল না। সারাটা ক্লাস ইনান নিরবে কেঁদে গেল। সবকিছু কেমন উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছে, তার ফ্রেন্ডরা সব কেন তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে?

ক্লাস শেষে ইনান রাস্তায় আসলে আরেক ঝামেলাকে চোখে পড়ে তার। পলক। গেটের পাশেই উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে, চোখের নিচে কালি পড়ে তার চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। যেন কয়দিন না খেয়ে আছে। ইনান জানে পলক এখানে তার খোঁজেই এসেছে। কিন্তু সে পলকের সামনে যাবে না। কেন যাবে? যাওয়ার কোনো কারণ আছে? এমনিতেই তার মন ভালো নেই।

তখন ইনান দেখল জেহফিলের গাড়ি। রাস্তার বিপরীত মাথায় জেহফিল গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইনান ওড়নাটা মুখে জড়িয়ে পলকের চোখের আড়াল হয়ে দ্রুত গাড়ির কাছে চলে গেল।

গাড়ির দরজার বন্ধের আওয়াজ শুনে জেহফিল গাড়ির ভেতরে তাকাল, দেখল ইনান বসে আছে। জেহফিল গাড়িতে ঢুকে ইনানের চোখ মুখের অবস্থা দেখে কিছুটা অস্থির হলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তাকে বলল,

‘চোখ মুখ এমন শুকনো কেন?’

ইনান সবটা খুলে বলল জেহফিলকে। যখন ইনানের কথা শেষ হলো, জেহফিল পানির বোতল হাতে ধরিয়ে দিলো তার। ইনানের কথাগুলোকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে বলল,

‘সামনেই নিউ একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে, তোমাকে ট্রিট দিবো আজ।’

ইনান মুখ বেজার করে বলল, ‘মন চাইছে না। বাড়ি চলুন।’

জেহফিল ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘রেস্টুরেন্টটা তিন ঘন্টার জন্য ভাড়া করেছি, রেস্টুরেন্টের প্রথম কাস্টমার তুমি হবে বলে। তুমি কি চাইছো পুরো টাকাটা জলে যাক?’

অগত্যা ইনানকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জেহফিলের সাথে যেতে হলো।

.
.
চলবে…

#রোদরঞ্জন
#পর্ব_১৫
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা

[অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। কার্টেসি সহ কোনো পেজেও কপি করা যাবে না।]
.
.

পলক গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। ইদানীং চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় ইনানকে। চাকরিসূত্রে ইফাজ সাহেবের সাথে বেশ ভাব হলেও ইনানকে নিয়ে ওনার সাথে একটা কথাও বলতে পারে না সে। গত এক সপ্তাহের মতো ইনান লাপাত্তা। না ফোন না মেসেজ কোনো কিছু করেও ইনানের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ইফাজ খানকে সে বলতে পারছে না ইনান কোথায়। একবার শুধু ইফাজ খান বলেছিল ইনান পড়াশোনার জন্য কোথাও থাকছে। কিন্তু কোথায় সেটা বলার সাহস হয়নি পলকের। পাছে ইফাজ সন্দেহ করেন। পলক ইনানের বাড়িতে একবার যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল, গিয়ে ইনানকে দেখতে না পাওয়ায় সে কথাটি বলতে পেরেছিল, তবে ইফাজের থেকে ইনানের আরও খোঁজ নেওয়ার স্পর্ধা করল না।

এমন না যে পলক ইফাজ খানকে ভয় পায় বা কিছু। ইনানকে বিয়ের কথা বলতে তার কোনো সঙ্কোচ নেই। তবে ইফাজ খানের সাথে যতদিন কাজ করেছে তাতে এটুকু বুঝেছে তিনি মেয়ের সাথে কোনো পুলিশের বিয়ে দিবেন না। অবশ্য যৌক্তিক কারণ আছে। বিয়ের পর ছেলে যদি সারাদিন ডিউটি নিয়েই পড়ে থাকে তবে তার মেয়েকে দেখবে কখন? ইফাজ তার মেয়েকে কোনোদিন তেমন একটা সময় দিতে পারেননি তার চাকরির জন্য, এখন যদি তার স্বামীও একই রকম হয় তবে মেয়েটা সময়ের জন্য কার কাছে যাবে? পলক বুঝে ইফাজ খানের মনে কী চলে। কিন্তু সেও যে নিরুপায়। ইনান প্রথম দেখাতেই তার মনে জায়গা করে নিয়েছে, জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো কাউকে ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছে, আর তা সহজেই হারিয়ে যাবে- এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে।

কোনো অযুহাতে সে ইনানের বাড়িতে যেতেও পারেনি যে ইনান কেমন আছে দেখবে। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকবার ইনানের বাসার রাস্তার সামনে থেকে ইনানের বেলকনিতে চেয়ে থাকে। তাও পায় না ইনানের দেখা। বারান্দায় থাকা গাছগুলো শুকিয়ে মা’রা গেছে তাও মেয়েটির খবর নেই?

গত সপ্তাহের প্রতিটাদিন সে কাজের ফাঁকে এসে ইনানের ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। ইনানকে একটু দেখবে এই আশায়। কিন্তু সেখানেও পলককে হতাশ করে দিয়ে ইনানের দেখা পেল না। এভাবে কতক্ষন সে ইনানকে না দেখে থাকতে পারে? ইনান কি বুঝে না? বুঝে তো, অবশ্যই বুঝে, বুঝে বলেই তো পলককে প্রতিবার ইগ্নোর করে।

পলক শুষ্ক ঢোক গিলে আকাশের দিকে তাকায়। ইনানের ডাকা পাখির পালক ডাকটা খুব মিস করছে সে। তাকে দেখলেই ইনানের ভেংচি কাটাও মিস করছে, ইনানের চোখ, ঠোঁট, গাল, চোখের বড় বড় পাপড়ি, চুল সব.. সব মিস করছে সে।

‘আহ ইনান, আমার দিলরুবা, এতটা কেন পোড়াও আমাকে? এই শাস্তি কি আমার প্রাপ্য?’

ধরা গলায় অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠল পলক। ছেলে মানুষ হওয়ায় সহজে কান্না করতে পারছে না সে। বুকের গহীনে যে অসহ্য দহন, এত যন্ত্রণা সহ্য করবে কীভাবে সে?

.

সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছিল ইনান। ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কদম গাছের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিল। গাছটা বারান্দার সাথে লাগোয়া হওয়ায় হাত বাড়িয়ে একটা কদম ছিঁড়ে নেয়। কদম ফুলের গায়ে লেগে থাকা ফোঁটা ফোঁটা পানিগুলো হীরকের মতো জ্বলজ্বল করছে। ফুলটা নিয়ে গালে ছোঁয়ায় সে, কী শীতল পরশ!

‘বাটারফ্লাই!’

ইনান পেছন ফিরে তাকায়। জেহফিল ইনানের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,

‘বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? ঠাণ্ডা লাগবে।’

এই বলে ইনানের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসে, কিন্তু ইনান জেহফিলের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে যায়।

‘বৃষ্টি পছন্দ আমার।’ এই বলে রেলিংয়ে হাত রেখে অন্ধকার জঙ্গলে দৃষ্টিপাত করল ইনান।

হাত খুব স্বাভাবিকভাবেই ইনান ছাড়িয়েছে, না ঝাটকা মেরে আর না রাগ করে, একদম নরমাল ভাবেই জেহফিলের হাত সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা জেহফিলের গায়ে লাগল খুব। ইনানের অবহেলা সে মেনে নিতে পারে না, সে ভালোবেসে ইনানের হাত ধরেছে আর ইনান হাত ছাড়িয়ে নিলো! এই সামান্য ঘটনায় জেহফিলের রক্ত ছলকে উঠল। জেহফিল নিজ থেকে না ছাড়লে ইনান হাত ছাড়ালো কোন সাহসে? সে ইনানের পেছনে গিয়ে দুইহাতের মাঝেখানে ইনানকে আটকে দিলো। রেলিংয়ে রাখা ইনানের হাতের উপর হাত রাখল শক্ত করে।

‘কী করছেন? ব্যথা পাচ্ছি।’

জেহফিল ইনানের কানের কাছে মুখ এনে গভীর গলায় বলল,

‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে বাটারফ্লাই।’

জেহফিলের উষ্ণ নিঃশ্বাস ইনানের ঘাড়ে এসে পড়ছে। ইনান কিছু না বললেও তার গাল লাল হয়ে গেছে মুহুর্তেই। জেহফিলের বিপরীতে ফিরে থাকায় ভেবেছিল সে দেখবে না, কিন্তু জেহফিলের চোখ এড়াল না ইনানের রাঙা মুখ।

জেহফিল গাঢ় স্বরে বলল, ‘লুক লাইক আ রেড লিটল চেরী। আই ওয়ানা বাইট ইউ সো ব্যাড।’

সাথে ইনানের হাতের উপর রাখা হাত শক্ত হলো। ইনানের ব্যথা লাগল, তবে জেহফিলের বলা কথাগুলোয় ব্যথা ছাপিয়ে লজ্জাটাই মুখ্য হয়ে উঠল। ইনান তার লাজুক হাসি ঠোঁট কামড়ে চেপে চোখ স্থির করল তাদের বাড়ির পাশে থাকা পুকুরের অপর প্রান্তে কাজ চলা নতুন বাড়িটার দিকে।

‘ঐখানে কে বাড়ি করছে আবার?’ ইনান স্বগোতক্তি করল।

এই জঙ্গলের মাঝে কার বাড়ি করার শখ জেগেছে? জেহফিলের বাড়ির এবং ঐ বাড়িটার মধ্যে একটা ছোট পুকুরের ব্যবধান শুধু। যদিও এখনো বাড়ি হয়নি, মাত্র পিলার বসানো হয়েছে।

ইনানের কানে গুঁজা সতেজ ফুলের দিকে জেহফিলের চোখ গেল। জীবন্ত এক ফুলের কানে রাখা আরেকটা ফুল। ইনানকে সুন্দর লাগছিল, সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া ফুলের মতো স্নিগ্ধ। জেহফিলের হিংসে হলো খুব, ফুলটাকে। যেখানে জেহফিল এখনো ইনানকে গভীর করে ছোঁয়ার অনুমতি পায়নি‌ সেখানে কয়েকদিনের ফুল এসে ইনানের চুলে-গালে লেপ্টে ইনানকে চুমু খাচ্ছে – এটা হাজব্যান্ড হয়ে কীভাবে সহ্য করবে?

জেহফিল ইনানের পেটে হাত রাখল আচমকা। দুজনেই তখন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গেছে। ইনানের কানে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে জেহফিল তপ্ত গলায় বলল,

‘এখানে নাকি রুমে?’

ইনানের পিলে চমকায়। শরীর শিরশির করে উঠে। এই ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও তার শরীর উষ্ণ হয়ে উঠল। জেহফিলের আবেশিত কণ্ঠে চোখ বন্ধ হয়ে গেল তার। শরীরের শক্তি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে লাগল। হাঁটু ভেঙে আসতে লাগল। এমন কেন হচ্ছে তার? জেহফিল কী এমন জাদু করল? এই তিন অক্ষরের বাক্যে কি নেশা ছিল?

ভাবতে ভাবতেই জেহফিলের উপর সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিলো সে। ইনানকে নিজের বুকে মাথা রাখতে দেখে জেহফিল পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিলো। ইনানের শক্তি এতটাই কমে গেছে যে জেহফিলের গলা জড়িয়ে ধরার জন্য হাতটাও উঠাতে পারল না সে। শুধু পিটপিট করে জেহফিলের শান্ত মুখশ্রীতে চোখ স্থির রাখল। জেহফিলের কপালে থাকা চুল থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টির জল ঠোঁট গিয়ে চিবুক বেয়ে পড়ছে। যা দেখে তৃষ্ণা বেড়ে গেল ইনানের। ইচ্ছে করছিল জেহফিলের ঠোঁট থেকে সমস্ত জল শুষে নিয়ে পিপাসা মেটায়।

জেহফিল ইনানকে এনে ভেজা অবস্থায়ই ডিভানে বসায়। রুমের লাইট বন্ধ ছিলো। অন্ধকারেও জেহফিল ইনানের চোখের ভাষা খুব সহজেই বুঝতে পারছে। ইনান সম্মোহিতের ন্যায় জেহফিলের চোখে চেয়ে আছে। জেহফিল ইনানের টপের উপরের কটিতে হাত রাখে। ইনানের চোখে চোখ রেখেই একটা একটা করে কটির বোতাম খুলে। ইনান বাঁধা দেয় না। তার চোখে জেহফিলকে কাছে পাওয়ার কামনা ভেসে উঠছে। কতদিন আর এত সুদর্শন স্বামীর থেকে দূরে দূরে থাকবে? ইনানের কটি খুলে জেহফিল ছুঁরে ফেলে দেয় ফ্লোরে। ইনানের দুইপাশে হাত রেখে ধীরে ধীরে ইনানের তিরতির করে কাঁপতে থাকা ওষ্ঠের দিকে ধাবিত হয় সে। ইনান শক্ত করে জামা চেপে ধরে হাতের মুঠোয়। জেহফিলকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে ক্রমশ।

ঘোর লাগা চোখে জেহফিলের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে নেয় ইনান। অপেক্ষা করে কাঙ্ক্ষিত মুহুর্তের জন্য। কিছুক্ষণের মাঝেই কাঙ্ক্ষিত জিনিসের ছোঁয়ার বদলে নরম তুলতুলে তোয়ালের ছোঁয়া পেতেই চমকে তাকায় ইনান। জেহফিল ইনানের চুল মুছে দিচ্ছে যত্ন সহকারে। তার চোখে দুশ্চিন্তা। ইনানকে বকা দেয়ার সুরে বলল,

‘এইজন্যই বলেছি বৃষ্টিতে ভিজবে না। দুষ্টু মেয়ে আমার কথা না শুনে না একদম। এখন তো ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছো না। আর যদি কোনোদিন বৃষ্টিতে ভিজেছো!’

ইনানকে বকতে বকতে জেহফিল ইনানের চুল মুছে দিতে লাগল। এদিকে জেহফিলের কথা শুনে ইনানের ঘোর ভেঙে গেল। সাথে রাগে দুঃখে কান্না পেল। জেহফিল এত অবুঝ কেন? সে কি বুঝেনি ইনানের কেন সব শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে? সে কি বুঝেনি ইনানের চোখে ভাষা? তার চোখের ভাষা কি এতটাই কঠিন?

জেহফিলের হাত থেকে তোয়ালেটা টান দিয়ে ছুঁড়ে মারল ফ্লোরে। জেহফিলের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে পা আছড়ে আছড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। অসভ্য লোকটা সারাদিন ইনানকে টিজ করবে আর এখন ইনানের ইঙ্গিত বুঝতে পারছে না?

ইনানকে চলে যেতে দেখে জেহফিলের অধরে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। ফ্লোর থেকে ইনানের কটি উঠিয়ে নাকের কাছে নিয়ে ইনানের ঘ্রাণ নিতে লাগল। বিড়বিড় করে বলল,

‘নিজ মুখে যেদিন আমাকে কাছে টানার কথা বলবে সেদিনই এই জেহফিল এহসান ধরা দেবে তোমার নিকট। একটাবার শুধু বলে দেখো বাটারফ্লাই…’ কটি থেকে গভীর শ্বাস টেনে নিল জেহফিল,

‘শুধু একটাবার… তারপর দেখবে এই জেহফিল তোমাকে প্রতিটা মুহুর্ত কীভাবে বেঁধে রাখে নিজের সাথে, প্রতিটা মুহুর্ত, অ্যান্ড ইটস আ প্রমিস।’

জেহফিলকে মনে মনে বকতে বকতে ইনান ওয়াশরুম থেকে বেরোলো। ফাজিল লোক, বদ লোক, বোকা লোক, গাধা.. ইনানের ভাণ্ডারে যত যত গালি আছে সব জেহফিলকে দিতে লাগল। শালার শালা, এত হাদা কেন হতে হবে একটা মানুষকে? হুহ! ইনান বেরোতেই তার পায়ের কাছে দেখে পিষে যাওয়া একটা কদমফুল। দলে মুচড়ে পিষে ভর্তা হয়ে দুই তিন ভাগ হয়ে পড়ে আছে বেচারা। রুমে ফুল আসলো কীভাবে? বোধহয় তার চুল থেকে পড়ে গেছে! ইনান ফুলটা ফেলে দিয়ে রুমে আসে।

জেহফিল মুচকি হেসে ইনানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইনানের ইচ্ছে করল দুইটা ঘুষি মেরে দেয় ঐ হাসি মুখটায়। হাদার ঘরের হাদা! ইনান ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়।

‘এসো ঔষধ খেয়ে নাও।’

ইনান ঝাড়ি মেরে বলে, ‘আমার কিছু হয়নি যে ঔষধ খাওয়া লাগবে।’

‘হয়নি কে বলেছে? একটু আগেই তো শরীর গরম হয়ে জ্বর এসে গিয়েছিল।’

‘ওরে মাথামোটা। ওটা শরীরের জ্বরে না, মনের জ্বরে শরীর গরম হয়েছিল।’ ইনান মনে মনেই বলল। মুখে বলল, ‘ঔষধ খেতে ইচ্ছে করছে না, কিছু বানিয়ে খাওয়ান।’

‘কী খাবে?’

জেহফিলকে শায়েস্তা করার জন্য ইনানের যা যা খাবারের নাম মাথায় আসল সব বলে দিলো, ‘চিকেন ফ্রাই, চিংড়ি ভর্তা, চিংড়ির কাটলেট, মার্শম্যালো, খিচুড়ি, হট কফি, পাস্তা, ছানার সন্দেশ।’

ইনান থামল।

‘আর কিছু?’ জেহফিলের স্বাভাবিক গলা।

‘না, আপাতত এগুলোই, আর সবগুলো হোমমেড হতে হবে।’ ইনান আদেশের সুরে বলল। সে ভেবেছিল জেহফিল হয়তো প্রশ্ন করবে এই অসময়ে এত কিছু কেন খাবে। এসব তো বললোই না বরং সম্মান জানানোর ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে বলল,

‘জো হুকুম মাই প্রিন্সেস।’

এই বলে জেহফিল চলে গেল। ইনান মনে মনে ভাবল লোকটা কি সত্যিই এসব বানাবে নাকি? যাই হোক, এটা জেহফিলের শাস্তি ইনানকে বুঝতে না পারার। দেড় সপ্তাহের মতো ইনানের সাথে থাকছে আর সে ইনানকে বুঝতে পারল না? এবার ঠেলা সামলাও। হুহ!

ইনান বই নিয়ে বসে পড়ল। আপাতত বইয়ের মাঝে ডুব দেয়া যাক। তার মধ্যে টয়ার সাথে ফোনে কথা হলো একবার। টয়া শুধু রোবটের মতো বলল মুগ্ধ ভালো আছে শুধু কথা বলতে একটু সমস্যা হচ্ছে, আর ফারার রুমের দরজা এখনো বন্ধ। ব্যস এই খবর দিয়েই টয়া ফোন কেটে দিলো। ইনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবার সাথে কথা বলে ফোন অফ করে রেখে দিলো। কিচেন থেকে রান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে শুধু।

বই পড়তে পড়তে কখন রাত এগারোটা বেজে গেল খেয়াল নেই ইনানের। কিছু একটার আওয়াজে বই থেকে মুখ তুলে। তখন জেহফিলের কথা মনে পড়ল তার। এখন কী করছে দেখার উদ্দেশ্যে দরজা ফাঁকা করে উঁকি দিলো। কই জেহফিল?‌ কোথাও তো নেই! ইনান দরজা খুলে ডাইনিংএ আসতেই দেখল টেবিলের উপরে সব খাবার সাজানো শুধু চিংড়ির আইটেমগুলো ছাড়া। বিস্ময়ে ইনানের মুখ হা হয়ে গেল। জেহফিল এসব বানিয়েছে? বিনা বাক্য ব্যয়ে?

টেবিলের উপর হলুদ রঙের একটা চিরকুট পাওয়া গেল। তাতে লেখা ‘বাজারে যাচ্ছি চিংড়ি আনতে। হট কফি খেয়ে ফেলো, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’ ইনান মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। লোকটা কি পাগল? এই রাত এগারোটায় চিংড়ি আনতে যাচ্ছে? বাইরে এখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। এই ঝড়ের মধ্যে জেহফিল বেরিয়ে পড়ল? ইনানকে একবার জানানো গেল না? জানালে তো ইনান জেহফিলকে বেরোতে দিত না। জেহফিলকে ফোন দিলো সে। ফোন বেজে উঠল ড্রয়িং রুমের কাউচে। মোবাইল রেখে গেছে সে। ইনান হতাশ ভঙ্গিতে মাথা পেছনে এলিয়ে দিলো,

‘ওহ গড। এই পাগল লোকটাকে আমার কপালে রাখলে কেন?’

জেহফিলের টেনশন করতে করতে ইনান টেবিলের উপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। গরম তেলের ছলকে ওঠার আওয়াজে ইনানের ঘুম ভাঙে। ধড়ফড় করে উঠে জেহফিলের খোঁজে। ঘড়িতে তখন রাত দুইটা। দেখতে পায় কিচেনে অ্যাপ্রোন পরনে জেহফিল তেলের মধ্যে চিংড়ির কাটলেট ছাড়ছে।

ইনান হন্তদন্ত হয়ে জেহফিলের কাছে যায়। চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘মাথা কি হাফ নষ্ট‌ নাকি ফুল নষ্ট হয়েছে? এই ঝড়ের মধ্যে বেরিয়ে গেলেন কেন? যাওয়ার আগে একবার বলা যেত না আমাকে? বাজে লোক, খালি আমাকে টেনশন দেওয়া।’

জেহফিল ইনানের দিকে ফিরে ঠোঁট চোখা করে চুমু ছুঁড়ে দিলো। এই অসময়ে জেহফিলের মজা করাটা ইনানের রাগ বাড়িয়ে দিলো। জেহফিলের হাত থেকে খুন্তি কেড়ে নিতে চাইল সে,

‘রাখুন রান্নাবান্না। আর শেফ সাজা লাগবে না।’

‘আরে আরে, এটাই বাকি.. বেবি ওয়েট..’

জেহফিল খুন্তি না দিয়ে তেল থেকে কাটলেট উঠিয়ে বাটিতে রাখল। ইনানকে এক হাতে জড়িয়ে বাটি নিয়ে টেবিলে আসল।

ইনানকে চেয়ারে বসিয়ে সে টেবিলে এবং রুমের চারিধারে কতগুলো মোম জ্বালিয়ে লাইট নিভিয়ে দিলো। নরম আলোয় ছেয়ে গেল রুম। পাশের চেয়ার টেনে ইনানের পাশে এসে বসল জেহফিল। সাথে আনা কতগুলো গোলাপ টেবিলের উপর ফুলদানিতে রাখল। এখন একদম ডিনার ডেটের মতো লাগছে পুরোটা।

‘নাও, তোমার পছন্দের সব বানানো শেষ। কোনটা খাবে?’

ইনান হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। জেহফিলের থেকে নিজের উপর বেশি রাগ লাগছে। জেহফিল ক্লান্ত চেহারাতেও কী সুন্দর হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। সব তার জন্য, সে কেন জেহফিলকে এই রাতের মধ্যে শাস্তি দিতে গেল। আর জেহফিল কেন সব মাথা পেতে নিলো? কেন বাঁধা দিলো না? এসব ভেবেই ইনান হুট করে জেহফিলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।

‘বাটারফ্লাই, কাঁদছো কেন? রান্না‌ পছন্দ হয়নি?’

ইনান কান্না করতে করতে জবাব দিলো, ‘আপনি খুব খারাপ জেহফিল। চিংড়ি মাছ নেই বলে বাজার থেকে আনতে কে বলেছে? বৃষ্টির মধ্যে কেন বেরিয়ে গেলেন? গেলেন তো গেলেন মোবাইল নেননি কেন?’

জেহফিল ইনানের মুখ সামনে নিয়ে এসে চোখের জল আঙুল দিয়ে মুছে বলে, ‘মোবাইল নিলে তো তুমি আবার আদেশ করতে ফিরে আসার। তখন তো তোমার আদেশ ফেলে দিতে পারতাম না। আবার তোমার জন্য চিংড়ির ভর্তা, কাটলেটও বানাতে পারতাম না, তাই নেইনি।’

ইনান হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,

‘আপনি একটা পাগল।’

‘তোমার জন্যই তো!’ জেহফিল ইনানের নাক টেনে বলল।

‘এবার বলো কোনটা খাবে? কোনটা আগে সার্ভ করব প্রিন্সেস?’ জেহফিল নরম সুরে বলল।

ইনান টেবিলের দিকে তাকালো। সব কিছু সুন্দর করে সাজানো। সেই সন্ধ্যা থেকে জেহফিল এত কষ্ট করে এসব বানিয়েছে, শুধু তার জন্য। ভাবতেই ইনানের কান্না দ্বিগুণ হলো। সাথে জেহফিলের প্রতি সম্মান আর ভালোলাগাও দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

জেহফিলের বানানো সবগুলো আইটেম ইনান খেল। সাথে জেহফিলকেও খাওয়ালো। নিজ হাতে। ইনান খাইয়ে দেওয়ার সময়ও জেহফিল বলল, ‘আমাকে কেউ কোনোদিন হাতে তুলে খাইয়ে দেয়নি বাটারফ্লাই।’

ইনানের কষ্ট লাগলো অনেক, কান্না আটকে বলল, ‘আপনার সাথে আর কী কী করা হয়নি বলুন তো! সব আমি করার চেষ্টা করবো।’

জেহফিল মৃদু হেসে বলল, ‘কেউ কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি।’

সাথে সাথেই ইনান জেহফিলের মসৃণ চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।

‘কেউ কখনো আমার অসুস্থতায় কাছে থাকেনি।’

‘এখন থেকে আমি থাকব।’

‘কেউ কখনো আমার সাথে মুভি দেখেনি।’

‘এখন থেকে আমি দেখব।’

‘কেউ কখনো পাশে থাকেনি।’

‘আমি থাকব।’

জেহফিল ইনানের কানের কাছে মুখ এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বলল,

‘আমাকে কেউ কখনো ভালোবাসেনি।’

মোমের ক্ষীণ আলোয় জেহফিলের হলুদ আভাযুক্ত ধূসর চোখে চোখ রেখে মোহগ্রস্তের ন্যায় ইনান বলল,

‘আমি বাসি তো।’

ইনানের জবাবে জেহফিল প্রশান্তির হাসি হাসল। আর ইনান নিজের জবাব কানে যেতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। সে নিজ থেকে কনফেস করেছে? জেহফিলের নিকট কনফেস করেছে? চোখ বড় বড় হয়ে হতবাক জেহফিলের দিকে চেয়ে থাকল ইনান। টনক নড়তেই হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। লজ্জায় ইনান কথা বলতেই ভুলে গেল। দৌঁড়ে নিজের রুমে এসে দরজা আটকে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ল। কীভাবে কী হলো? সে কীভাবে নিজ থেকে জেহফিলের নিকট কনফেস করল? ইনান কান চেপে বসে রইল। নিজের কথাটা বার বার কানে বাজছে, “আমি বাসি তো।”

সে কখনো জেহফিলকে ভালোবাসার কথা মনে আনেনি, অথচ জেহফিল কী সুন্দর ইনানের মুখ থেকে ভালোবাসার কথাটা কৌশলে বের করে নিলো!! ইনান বুকে হাত দিয়েই ফ্লোরে শুয়ে পড়ল। বুক ধুকপুক করছে। যেন হার্ট বুক চিরে বেরিয়ে আসবে। কীভাবে কীভাবে এত কিছু হয়ে গেল? কীভাবে কীভাবে মনের ভেতর জেহফিল বসবাস করা আরম্ভ করল? ইনান লাজুক হাসতে হাসতে ফ্লোরেই গড়াগড়ি খেতে লাগল। হায়!! কী লজ্জা! আর কী সুন্দর কনফেশন!

.
.
চলবে…