লীলাবালি পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0
353

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫৮
আফনান লারা
.
বাবার একটা জরুরি কাজ মনে আসায় তিনি ভেতরের রুমে চলে গেছেন।এদিকে জুথি কাছে এসে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,’তখন না চলে গেলেন?আবার আসার মানে কি?আর বাবাকে কি বললেন যেন?আমি আপনার খোঁজ নেইনা?আমি অকৃতজ্ঞ?? ‘

মৃদুল মুচকি হেসে বললো,’আসলে সেটা না।তোমার বাবার সামনে একটু নিজেকে দায়িত্ববান,কেয়ারিং সাজালাম।তার মেয়ে তো আমায় বোঝেনা।
কেমন অকৃতজ্ঞ সে সেটাকে একটু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম’

জুথি কোমড়ে হাত রেখে বললো,’যাবেন আপনি?’

মৃদুল উঠে দাঁড়িয়ে চুলগুলোকে ঠিক করে দিয়ে হালকা কেশে বললো,’আবার আসবো!
বারান্দা!!!খোলা কাঠিবিহীন চুল!!ঐ বিনা লিপস্টিকের ঠোঁট!’

জুথি ধাক্কা মেরে ওকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে ফেলেছে।
এরপর দম ফেলে মুচকি হাসলো সে।ওকে পাগল বলে রুমে ফেরে গেছে।

অর্ণবের রুমের পাশে যে সরু বারান্দাটা আছে সেটার বর্ণনা তো দেওয়াই হলোনা।সেটার গ্রিল আবার ছাদ থেকে ফ্লোর ছুঁই ছুঁই।অর্ণব কুসুমের হাত ধরে ওকে সেখানে নিয়ে এসে বললো গ্রিল দিয়ে পা বের করে পা ঝুলিয়ে বসতে।কুসুমের কাছে ব্যাপারটা শুরুতে কেমন লাগলেও ওর কথামতন সেরকম করে দেখলো আসলেই অনেক ভাল লাগে।অর্ণব নিজেও ওর পাশে বসলো তবে সে পা ঝোলাতে পারেনি।কুসুমের পা চিকন বলে গ্রিল দিয়ে ঢুকেছে।কিন্তু অর্ণবের গেলোনা।তাই সে গোল হয়ে বসে পড়লো।
দুজনেই চুপ এখন।রাতের আকাশে কোটি তারার গেট- টুগেটার বসেছে।নিচে তারা দুজন দর্শনার্থী। তারা দেখা অনেক হওয়ায় কুসুম তেমন মনযোগে দেখছিলনা।কিন্তু অর্ণব গভীর মনযোগে দেখছে তারাগুলো।পড়াশোনার চাপে অনেকদিন তারা দেখা হয়না তার।
মোট কথা আকাশের দিকেই তাকানো হয়না।আর আজ তাকিয়ে মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটা সে দেখছে।ওকে চুপ করে থাকতে দেখে কুুসুম বললো,’আপনি গান পারেন?’

‘নাহ।ভাঙ্গা গলায় আবার গান!গাছের পাতা ঝরে যাবে’

‘গেয়ে দেখুন পাতা এত সহজে ঝরবেনা’

‘শীতকাল শেষ।বসন্তের শুরু।পাতা সব ঝরে নতুন উঠছে।এখন গাইলে গাছ আমার গলাট স্বরকে দোষ দেবে’

কুসুম ফিক করে হেসে ফেললো।ওর হাসি দেখে অর্ণব হাত বাড়িয়ে ওর নাকের উপর রেখে বললো,’এত জোরে হাসবেনা।নাক থেকে কয়েক মিনিট আগে রক্ত ঝরেছিল মনে আছে?’

‘হুম।কেন ঝরেছিল জানেননা?’

‘নাহ।বাদ দাও ওসব,তারা দেখো।দেখবে নিজেকে তারার খুব কাছে মনে হয় যেন ছোঁয়া যাবে এমন।দেখো দেখো’

কুসুমের চোখ ছিল অর্ণবের দিকে।ওর কথার উত্তরে সে বললো,’জানি।এই তারা আমি আরও অনেক দেখেছি।হয়ত আপনি আমার মতন করে প্রতিদিন দেখেন না।দেখবেনই বা কি করে।সময় পেলেই তো ফোন নিয়ে বসেন।অথচ যারা ফোন চালায় না তারা প্রকৃতির সব কিছু উপভোগ করে।যেমন ধরুন এই তারা।শেষ কবে দেখেছিলেন হয়ত আপনার মনে নেই।কিন্তু ফোন দেখেছিলেন বড় জোর এক ঘন্টা আগে’

অর্ণব কুসুমের দিকে ফিরে বললো,’আমার ফোন ধরাতে হিংসে হয় তোমার?তোমাকে হিংসা কে শিখিয়েছে?’

‘হিংসা কেন করতে যাবো?কেউ শেখায়নি।কিছু স্বভাব ভেতর থেকে তৈরি হয়।কেউ শেখাতে হয়না।যেমন ধরুন আমার নাকের রক্ত মুছে দেওয়া,আমার মাথা টিপে দেওয়া এগুলো কি কেউ শিখিয়েছিল আপনাকে?কিন্তু আপনি করছেন।’

‘তর্কে আমি ফেল।চলো খাবে’

‘আমি পরে খাবো।খিধে নেই বললেই চলে।যেকোনো সময়ে বমি এসে যাবে’

অর্ণব উঠে চলে গেলো বাবা মাকে খেতে ডাকতে।কুসুম পেছনে তাকিয়ে তাদের সবাইকে খেতে দেখছে।বাহিরে থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে আছড়ে পড়ছে বারবার।অর্ণবের বন্ধুসুলভ আচরণ কুসুমের কেমন যেন হজম হচ্ছেনা।তার মনে হয় তার অসুস্থতার জের ধরে অর্ণব তাকে পছন্দ করছে।এমনিতে তো সে কখনওই ওকে পছন্দ করতো না,সহ্যই করতে পারতোনা আর সে কিনা এখন কত যত্ন নেয়।
সে চেয়েছিল অর্ণব মন থেকে তাকে পছন্দ করুক,সুখে দুঃখে পাশে থাকুক।কিন্তু এভাবে পাশে থাকা তার কাছে অসহ্যকর লাগে মাঝে মাঝে।অসহ্যকর লাগে নিজের রোগের প্রতি।সে তো এমনটা চায়নি।
সে চেয়েছিল অর্ণব তার মোহে পড়ে মন থেকে ভালবাসবে তাকে, আপন করে নেবে।
কিন্তু এটা তো তার উল্টোটা হচ্ছে।এমনটা কেন হয়!
‘রোগের বাহানা দিয়ে আমি তার মনে জায়গা নিতে চাইনা।কোনোদিনও না।এটাতে তো ভালবাসা প্রকাশ হচ্ছেনা।একজন রুগীর সেবা সবাই করে।এটা তো স্বাভাবিক।কিন্তু এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা আমার মাথায় বিষের মতন লাগে।রোগটা যেন আজই ভাল হয়ে যায়।তারপর দেখবো উনি সত্যি সত্যি আমার দায়িত্ব পালন করতে চান নাকি পরিস্থিতিতে পড়ে এমনটা করে যাচ্ছেন’

যখনই সে উঠে দাঁড়ালো ঠিক তখনই অর্ণবের মা এসে দাঁড়ালেন সেখানে।হাতে এক প্লেট খাবার।তিনি নিজ হাতে ওকে খাইয়ে দিতে এসেছেন।শুরুতে কুসুম অনেক মানা করলেও তার জোরাজুরিতে হার মেনে গেলো।
ওকে পেট পুরে খাইয়ে দিয়ে তবে তিনি ছাড়লেন।
রাতে পান সুপারি খেতে খেতে তারা আবার তাদের রুমে চলে যাবার পর অর্ণব নিজেও একটা পান নিয়ে এসে বসেছে কুসুমের পাশে।কুসুম বললো সেও একটুখানি খাবে।অর্ণব দিতে চাইলোনা কিন্তু ওর আগ্রহ দেখে পানের অর্ধেকটা দিয়েছে।কুসুম পান চিবোতে চিবোতে বললো,’আমি এর আগেও খেয়েছি, যখন বাড়িতে ছিলাম তখন।জর্দা দিয়ে,মাথা ঘুরতো অনেক।এখানে জর্দা আছে?’

‘তোমায় সামলাবে কে?আমি পারবোনা’

‘আমাকে সামলাতে হবেনা।আমি সোজা হয়ে শুয়ে পড়বো’

‘দরকার নেই।চুপচাপ মুখে যেটা আছে ওটা চিবাও।কোনো জর্দা পাবেনা’

কথাটা বলে অর্ণব নিজের মুখেই জর্দা দুই চিমটি পুরে দাঁত কেলিয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে।
কুসুম গাল ফুলিয়ে তার পানের চিবানো অংশটা ফেলতে বাহিরে গেছে।ফিরে এসে দেখলো অর্ণব মরার মতন বিছানায় শুয়ে আছে।দুই হাত দিয়ে বিছানার চাদর খাঁমছে ধরে চোখ বড় বড় করে উপরের ছাদ দেখছে।কুসুম এগিয়ে এসে বললো,’ঘুরছে মাথা?পান ফেলে দেন।আচার খাবেন একটু?’

‘সরো তুমি!ছাদ ঘুরতেছে।ভেঙ্গে মাথায় পড়বে এখন।সরো সরো’

কুসুম ওর কাছে বসে কপালে হাত দিয়ে বললো,’জর্দা বেশি খেয়েছেন এই পান গিলিয়েন না।ফেলে দিন, নাহলে অবস্থা আরও খারাপ হবে’

অর্ণব মাথা ঘুরিয়ে কুসুমের দিকে তাকিয়ে বললো,’কোঁকড়া চুলের মেয়েটা এতগুলো কেন!একটারে সামলাইতে আমার রফাদফা হয়ে যায়, এখানে এতগুলো কেন!সরো তুমি ছাদ ভেঙ্গে পড়বে’

কুসুম হাসবে নাকি কাঁদবে তা বুঝতে পারছেনা।অর্ণব বিছানার চাদর রেখে ওর হাতটা খাঁমছে ধরেছে এবার।এত খারাপ লাগবে জানলে জীবনেও মুখে দিতোনা সে। ছোটবেলায় নাকি একবার পাউরুটির সাথে মিশিয়ে জেলির মতন করে খেয়ে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছিল ওকে। সেই ঘটনার কথা তার মনে নেই,মা বাবা বলেছে ওকে।এখন নিজেকে ম্যাচিউর মনে করে সে তাই জর্দা মুখে পুরেছে তাও বেশি করে।কুসুম হাত ছাড়াতে গিয়েও পারলোনা।অর্ণব নখ চামড়াতে ঢুকিয়ে খামঁছে ধরে আছে।চোখ বন্ধ করে কুসুমকে চলে যেতে বলছে সে শুধু।
এদিকে ওর হাত যে শক্ত করে ধরে আছে সেটা সে নিজেও জানেনা।কয়েক মিনিট পর জর্দার রেশ শেষ হতেই সে উঠে বসলো।কুসুম গালে হাত দিয়ে ওর হুশ ফেরার অপেক্ষা করছিল।অর্ণব যখন টের পেলো সে ওর হাত চেপে রেখেছে তখন সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দিয়েছে।কুসুম নিজের হাতটা ধরে দেখে বললো,’আমাকে খেতে দেননি।এরপর নিজে খেলেন কেন?’

অর্ণব চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।পান খাওয়ায় লাল টুকটুকে হয়ে আছে ওর ঠোঁটজোড়া।আজ সেই লাল জবা ফুল অনেক মিস করছে সে।এখন কানে জবা ফুল হলে যেন সব কিছু পূর্ণতা পেতো।কুসুম ওকে ওমন করে চেয়ে থাকতে দেখে হাত বাড়িয়ে বললো,’ঘুমাবেননা?কুলি করে আসেন নাহলে সারা রাত মাথা ঘুরাবে’

অর্ণব চুপচাপ রোবটের মতন হেঁটে চলে গেছে ওয়াশরুমের দিকে।কুসুম বিছানার চাদর টেনেটুনে এক কোণায় গিয়ে বসে বসে নিজের হাতটা দেখছিল।ব্যাথা পেয়েছে তবে কেন যেন অনেক ভালো লাগা কাজ করছে।
হাত মুখ ধুয়ে অর্ণব পুনরায় বিছানায় এসে শুয়ে আছে।কুসুম পাশেই বসে ছিল।শুরুতে তার কখনও ঘুম আসোনা।ড্রিম লাইটের আলোয় সে অর্ণবের দিকে চেয়ে বসেছিল।অর্ণব চোখ বুজে আছে।তার যে ঘুম এসেছে তা নয়।সেও জেগে তবে নিরব।
প্রতিদিন শুরুতে কুসুমের বসে থাকার একটা অন্য কারণ আছে, সেটা হলো অর্ণবের গায়ের গন্ধটা বসে বসে নেওয়া।শুয়ে থাকলে যেন ঠিকঠাক ভাবে উপভোগ করা যায়না তাই বসে বসে গন্ধটা নেবে।এই মানুষটা জানেওনা তার তায়ের গন্ধে কত জোর।এত জোর যে মাঝে মাঝে অনেক ইচ্ছে হয় জড়িয়ে ধরে ঘুমের নেশায় মত্ত হয়ে যেতে।খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছা হয় কিন্তু সেটা সম্ভব না।
তবে গায়ের গন্ধ পাবার সৌভাগ্য হয়েছে এটাই বা কম কিসের?
জীবনে কুসুম যেটাই পেয়েছে সেটাকেই আপন করে নিয়েছে। কমতিগুলোকে বড় করে দেখেনি।যেটা পেয়েছে সেটাতে ঐ কমতির ভরণপোষণ খুঁজে নেয় সবসময়।

অর্ণব হঠাৎ মাথা তুলে বললো,’কি??ঘুমাবেনা?নাকি অন্ধকারে ওমন ফ্যালফ্যাল করে সারারাত ধরে আমায় দেখে যাবে?’

‘আমার তো প্রথমেই ঘুম আসেনা।আপনি ঘুমান।একটা সময়ে আমিও ঘুমাবো’

‘শোও।শুয়ে পড়লে ঘুম আপনা আপনি এসে যায়।এত টালবাহানা করতে হবেনা তোমায়’

কুসুম অর্ণবের ধমক শুনে ওর পাশে শুয়ে পড়েছে।অর্ণব একটা হাত নিয়ে ওর মাথার উপর দিয়ে বালিশের ওপারে রাখলো।কুসুমের এবার কেমন কেমন লাগা শুরু হয়ে গেলো।সে সোজা হয়ে শুয়ে থাকতে পারছেনা আর।কি যেন তাকে বারবার করে খোঁচা মেরে বলছে উঠে বসতে।অর্ণব আগে কখনও এমন করেনি বলে হঠাৎ করে এটা নিতে পারছেনা সে।এদিকে অর্ণব এমন ভাব ধরে আছে যেন এটা কিছুইনা।সিম্পল একটা ব্যাপার
চলবে♥

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৫৯
আফনান লারা
.
সকাল সকাল অর্ণব বেরিয়ে পড়েছে।প্রথমে ভার্সিটিতে যাবে তারপর হাসপাতালে গিয়ে রিপোর্ট নেবে।
অর্ণবের বাবা মা আরও কিছুক্ষণ পরে চলে গেছিলেন বাসা থেকে।আরও কটা দিন থাকতে চেয়েছিলেন তবে সেটা হলোনা দেশের বাড়ি ফাঁকা বলে।
কুসুম বাসায় একা একা মাথায় যা আসে তাই ভেবে রান্নায় নেমেছে।পেঁয়াজ কেটে কড়াইয়ে দেওয়ার সময়টাতে কলিংবেলের আওয়াজ শুনে কাজ রেখে গিয়ে দরজা খুললো সে।
একজন ডেলিভারিম্যান এসেছে।কুসুমের হাতে পার্সেল দিয়ে বললো সই করে দিতে।কুসুম জানালো সে সই করতে পারেনা।তাই লোকটা চলে গেলো উপায় না পেয়ে।
পার্সেলটা ভেতরে এনে ছিঁড়ে ভেতর থেকে হাসপাতালের রিপোর্ট বের করলো সে।এটা হলো কুমিল্লার ডাক্তারের রিপোর্ট।লেখা কিছুই বুঝতে পারলো না সে তাই টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আবার কাজে চলে গেছে।

আজ ভার্সিটিতে প্রচুর ভীড়।কেন ভীড় তা বুঝতেছেনা অর্ণব।রেসাল্ট তো ঐদিন দিয়েছিল তবে আজ এত ভীড় কেন?
হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো মৃদুলের সাথে।সে তো অর্ণবকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরার পর থেকে আর ছাড়ছেইনা।ওকে ছাড়িয়ে অর্ণব জানতে চাইলো ব্যাপার কি।এত ভীড় কেন।পরে মৃদুল জানালো একজন স্যারের বিদায় অনুষ্ঠান।
সে তো এতদিন ভার্সিটিতে আসে নাই তাই এই ব্যাপারে জানেনা।
মৃদুলের সাথে হাঁটতে হাঁটতে সবার কথা জিজ্ঞেস করছিল সে ঠিক তখনই মৃদুল হঠাৎ জুথিকে ডাক দিলো।জুথি তার একটা বান্ধুবীর সাথে বসে ভেলপুরি খাচ্ছিল।সে অর্ণবকে দেখেনি।মৃদুলের ডাক শুনে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসেছে।
মৃদুল এগিয়ে গিয়ে ওর বান্ধুবীকে সরিয়ে পাশে বসে জুথির হাত থেকে একটা ভেলপুরি ছিনিয়ে মুখে পুরে বললো,’কিরে অর্ণব আয় বোস’

জুথি অর্ণবের নাম শুনে সামনে তাকিয়েছে।অর্ণব চেয়ার টেনে বসে বললো,’আমাকে কেউ ভেলপুরি খাওয়াবেনা?’

জুথি কিছু বলছেনা শুধু অর্ণবকে দেখছে।মৃদুল টপাটপ ওর প্লেটের সব ভেলপুরি মুখে পুরে নিয়েছে, এখন কথাও বলতে পারছেনা।অর্ণব আরও তিন প্লেট অর্ডার দিয়ে এসে আবার বসেছে জুথির সামনে।ওর এমন চুপ হয়ে থাকা লক্ষ কর সে বললো,’জুথি মনে হয় ভাবতে পারেনি আমি হুট করে সামনে চলে আসবো।বিশ্বাস দেওয়ার জন্য চিমটি কাটবো নাকি?’

মৃদুল জুথিকে একটা খোঁচা মারলো নখ দিয়ে।জুথি এবার নড়েচড়ে বসেছে।জোর করে মুখে হাসি ও ফোটালো সে।চোখে হঠাৎ করে পানি চলে আসলো তখন।হাত দিয়ে মুছে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে।মৃদুল কথা কাটাতে অট্টহাসি দিয়ে বললো,’অনেক ঝাল দিয়েছে মামা।জুথির তো চোখে পানিই চলে আসলো।তুমি বুঝি ঝাল কম খাও?’

অর্ণব শক্ত চোখে তাকিয়েছিল।
মৃদুলের কথা শুনে হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে ফিরে বললো,’জুথি হাঁড় ভাঙ্গা ঝাল খায়।ভেলপুরির ঝালে ওর চোখে পানি আসার কথা না।তবে আমার মনে হয় আমি এখানে আসায় ও সহজবোধ করছেনা।তোরা খা।আমি একটু ঘুরে আসি’

‘দাঁড়ান ভাইয়া,বসুন।যে অর্ডার দিয়েছেন সেটা কে খাবে?আমি তো বলিনি আমি সহজবোধ করছিনা।বরং আমি চলে যাই’

মৃদুল গাল ফুলিয়ে বললো,’কাউকে কোথাও যেতে হবেনা😒বেশি কথা বললে আমিই চলে যাব।যাবার সময় ভেলপুরি ও নিয়ে যাব”

ভেলপুরি এসে গেলো তখন।মৃদুল নিজের প্লেট রেখে বারবার জুথির প্লেটের সব ভেলপুরি সাবাড় করতে চাইছে।জুথির খাওয়ার প্রতি ইচ্ছেই উঠে গেছে।এদিকে অর্ণব ও খেতে পারছেনা।ওদের দুজনের এমন ভাব দেখে মৃদুল বললো,’ভাই তোরা খাইস না।আমাকে দিয়ে দে।খাবার সামনে নিয়ে নাটক ভাল লাগেনা আমার’
—-
কুসুম দুপুরের রান্না শেষ করেছে।মা যেমন শিখিয়েছিল সেগুলো কিছু কিছু মনে ছিল।সেই স্মৃতি ধরে আজ সে পটল দিয়ে টেংরা মাছ রেঁধেছে,বাবা সকালে যাবার সময় বাজার করে দিয়ে গেছিলেন।
খাবার সব ঢাকনা দিয়ে রেখে নিজের শাড়ীগুলো থেকে বেছে একটা লাল শাড়ী বার করলো সে।এটা তাকে তার নানি দিয়েছিলেন,ছোট কালে।মা বলেছিল এটা।শাড়ীটা মূলত মায়ের কাছেই ছিল।
পড়া হয়নি কারণ এটা অনেক ভারী।কোনো কারুকাজ নেই তাও সুতোয় ভারী লাগে অনেক।
গোসল করে বেরিয়ে জবা ফুল গাছটার পাশে অনেকক্ষণ বসেছিল সে।একটা ফুল কানে দিয়ে দেখবে কেমন লাগে।লাল শাড়ী,লাল জবা,দৃশ্যটা একবার দেখার অনেক ইচ্ছা।আজ কেন যেন মনে হলো ফুল ছিঁড়লেও অর্ণব বকবেনা।যদিও বকেও জবা ফুলের ক্ষেত্রে কুসুম আজ পর্যন্ত ওকে ভয় পায়নি।ও হাজারবার বকলেও ঘুরেফিরে সে জবা ফুল নিয়ে কানে গুজবেই।
উত্তরের বাতাস এসে গায়ে লাগতেই কাল রাতে অর্ণবের মাথার উপর দিয়ে হাত রাখার কথাটা মনে পড়ে গেলো ওর।মুচকি হেসে দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকলো সে।সকালে ঘুম থেকে উঠার পরও ওর হাতটা সেই একই জায়গাতেই ছিল।কুসুমের ইচ্ছে করছিল একটিবার ওকে জড়িয়ে ধরতে।অর্ণব ঘুমাচ্ছে দেখে আলতো করে ওর বুকে কপালটা ছুঁয়ে সঙ্গে সঙ্গে সে সরে গিয়েছিল।এত বড় সাহস দেখিয়েছে ভেবে এখনই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার।
তারপর দাঁত কেলিয়ে শাড়ীর আঁচল ঘুরাতে ঘুরাতে দরজা খুলে বের হলো বাসা থেকে।সোজা এসে দাঁড়ালো জবা ফুলগাছটার নিচে।কত কত ফুল ফুটে আছে।নিচে ঘাসের উপর বসে সবুজগাছে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে থাকা জবা ফুলের সমাহার দেখছে সে।
—-
রিপোর্ট হাতে অর্ণব অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল ডাক্তারের সিরিয়ালের অপেক্ষায়।শেষে তার ডাক পড়ায় হাঁপ ছেড়ে ভেতরে ঢুকেছে।
ডাক্তার রিপোর্টের পাতা উল্টেই চশমা ঠিক করে নড়েচড়ে বসলেন।
সামনে থাকা পানির গ্লাসটা থেকে দু ঢোক পানি খেয়ে বললেন,’ওহ আচ্ছা এটা সেই ফাইলটা।কুসুমের ফাইল।আপনি ওনার কি হোন যেন?’

‘হাসবেন্ড’

‘বিয়ের কতদিন?’

‘এক মাস হতে চললো’

‘নিউলি ম্যারিড।বলতে আমার খারাপ লাগছে কিন্তু এই বিষয়টা রোগীর আগে তার আপনজনের জানার অধিকার সব চাইতে বেশি আর আপনি তো ওনার হাসবেন্ড।দেখুন ভেঙ্গে পড়বেননা।সু চিকিৎসায় এটা ভালও হয়ে যেতে পারে’

অর্ণবের কপাল ঘেমে গেছে।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপাল মুছে বললো,’কি হয়েছে ওর?’

‘ব্রেইন টিউমার’

অর্ণবের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো।বুকে হাত রেখে সে মাথা নিচু করে আছে। ডাক্তার পানির গ্লাসটা এগিয়ে বললেন,’আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা।কিন্তু এখন আফসোস করার সময় না।জলদি চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।আপাতত কেমোথেরাপি, সার্জারি দিব আমি।সেটার ব্যবস্থা শুরু করবো শীঘ্রই। আপনারা রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসবেন কালকের মধ্যে।এমনিতেও বড্ড দেরি করে ফেলেছেন।টিউমার আকারে অনেক বড়।ওয়েট আ মিনিট।আমি আপনাকে সিটি স্ক্যানের রেসাল্ট দেখাচ্ছি।
কথাটা বলে ডাক্তার সিটি স্ক্যানের রিপোর্টটা সামনে ধরলেন লাইট অন করে।
অর্ণব মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে আছে।কথা বলতে পারছেনা।বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে বললো,’বাঁচবে তো?’

ডাক্তার ওর কথা শুনে রিপোর্টটা টেবিলে রেখে হেলান দিয়ে বসলেন।চশমাটা খুলে বললেন,’গ্যারান্টি দিতে পারছিনা।আপনারা অনেক দেরি করে ফেলেছেন।রোগের লক্ষণ শুরু হয়েছে আজ থেকে আট/নয় মাস আগেই।এক বছর হতে চললো কিংবা তার ও বেশি।তখন যদি আসতেন তবে এতদিনে চিকিৎসা অনেকদূর এগিয়ে আসতো।
তারপরও আমরা হাল ছাড়বোনা।চেষ্টা চালিয়ে যাব।আপনি যত জলদি পারেন রোগীকে হাসপাতালে এডমিট করান।আর এক মিনিট দেরি করাও রিস্কি ‘
——
কুসুম তার শাড়ীর আঁচল ধরে চরকার মতন ঘুরছিল জবা ফুলগাছটার তলায়।খালি পায়ে নরম ঘাসে ঘুরতে তার অনেক অনেক ভাল লাগছিল।ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ অর্ণবকে দেখে থেমে গেলো সে।দূরে গেটের কাছে সে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে রিপোর্ট।
কুসুম চট করে কান থেকে লাল জবাটা নিচে ফেলে দিয়ে চোরের মতন দাঁড়িয়ে থাকলো।অর্ণব ধীরে ধীরে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।কুসুম মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’আমি এখনও খাইনি,আপনার সাথে খাব বলে।এত দেরি করলেন যে?
ওহ হ্যাঁ।আজ একজন লোক এসেছিল।কিসের যেন কাগজ দিয়ে গেলো।টেবিলে রেখেছি
দেখবেন চলুন’

অর্ণব যেন কুসুমের কোনো কথাই শুনতে পেলোনা।নিচু হয়ে ঘাসের উপর থেকে লাল জবাটা তুলে কুসুমের কানে গুজে দিল সে।কুসুম অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।অর্ণব ওর মুখের দিকে একটিবার তাকিয়ে আরও কাছে এসে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলেছে।
কুসুম অবাকের পর অবাক হয়ে যাচ্ছে।অর্ণব হঠাৎ এমন কেন করছে সে বুঝতেছেনা।অর্ণব কাঁদছে।
ওর কান্নার আওয়াজ শুনে কুসুম অর্ণবের বুকে হাত দিয়ে ঠেলে সরাতে চাইলো কিন্তু পারলোনা।রিপোর্ট ফেলে অর্ণব দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে কুুসুমকে।
কুসুম ওকে সরাতে সরাতে বললো,’কি হয়েছে?বলবেন তো!আপনি কাঁদছেন কেন?আমাকে বলুন’

অর্ণব কিছু বলতে পারছেনা।শুধু কাঁদছে।কুসুম সরাতে ব্যর্থ হয়ে হাত ছেড়ে দিলো।অর্ণবের চোখের পানিতে ওর কাঁধ ভিজে গেছে।সে কিছুতেই আজ কুসুমকে ছাড়ছেনা।কুসুম শেষে বললো,’রাস্তার মানুষ দেখছে’

কথাটা শুনে অর্ণব ওকে ছেড়ে দিলো।পাঞ্জাবি দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে হনহনিয়ে বাসার ভেতর চলে গেলো সে।কুুসুম নিচ থেকে রিপোর্টটা তুলে ওর পিছু পিছু ছুটেছে।দোতলায় এসে দেখলো অর্ণব ফোন নিয়ে বাবাকে কল করছে ব্যস্ত হয়ে।বাবা ফোন ধরেনি বলে মৃদুলকে ফোন দিল।মৃদুল ও ধরছেনা।শেষে একটা চিৎকার করে ফোনটা ছুঁড়ে মারলো সে।কুসুমের পায়ের কাছে গিয়ে পড়েছে ফোনটা।
নিচ থেকে সেটা তুলে কুসুম ওর সামনে এসে বললো,’কি হয়েছে আমায় বলবেন না?’

অর্ণব বারবার তার কপাল টিপছিল।এক অসহ্যকর যন্ত্রনা তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে।
শরীর খারাপ লাগছে।কি কষ্টের মাঝে সে হাসপাতাল থেকে বাসা অবধি এসেছে তা শুধু সে জানে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর।কুসুমের কাছে পানি চাইলো বাধ্য হয়ে।কুসুম ছুটে গিয়ে পানি এনে ওর সামনে ধরে রাখলো।মাথার চুল টানতে টানতে অর্ণব পানি পুরোটা খেয়ে গ্লাস এক পাশে রেখেছে।
কুসুম ওর এমন ব্যবহারে ভয় পেয়ে আছে।ভয়ের কারণে জিজ্ঞেস করতে পারছেনা আর একবার যে কি এমন হলো।
অর্ণব জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললো,’খেয়েছো?’

‘না’

‘চলো খাবে’

কথাটা বলেই সে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো টেবিলের কাছে।
চলবে♥

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৬০
আফনান লারা
.
অর্ণব নিজের হাতে সব নিচ্ছে।কুসুমকে কিছু ধরতে দিচ্ছেনা। কুসুম এক পাশে দাঁড়িয়ে ওর এমন ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে আছে।
তার কি হলো ভেবে কূল কিণারা খুঁজেই পাচ্ছেনা সে।অর্ণব ওকে জোর করে চেয়ারেও বসিয়ে দিলো এরই মধ্যে।তারপর লোকমা তুললো মুখের সামনে।কিন্তু সে খেলোনা।গাল ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো এমনটা কেন করে।কি কারণ।
অর্ণব উত্তর দেয়নি।অন্য সময় হলে ধমক দিতো এতক্ষণে।কিন্তু এখন দেবেনা,আর কোনোদিন দেবেনা।

আবারও লোকমা তুলেছে সে।অর্ণবের থেকে কোনো জবাব না পেয়ে সে লোকমাটা খেলো।অর্ণব আবারও কাঁদছে।কাঁদতে কাঁদতে লোকমা সাজাচ্ছে। কুসুমের এবার বড্ড রাগ হলো।রাগের চোটে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’কি সমস্যা? কথা বলছেননা কেন?এভাবে কান্না করার মানেটা কি?আমাকে খুলে বলবেন নাকি আমি চলে যাব এখান থেকে?’

অর্ণব চুপ করে আছে।কোনো কথাই বলছেনা। কুসুম রাগ করে চলে যেতে নিতেই সে হাত ধরে আটকালো ওকে।এবার মুখে খুলেছে।

‘আমার হাতে খেতে ইচ্ছে করেনা তোমার?’

কুসুম নির্বাক।অর্ণবের ব্যবহারে সে বারবার অবাক হয়ে যাচ্ছে।কেন সে এমন করে তার কারণ না জানা পর্যন্ত শান্তির দেখা মিলবেনা।মনের ভেতর এই প্রশ্নটা জট পেকে আসে।
চুপচাপ আগের জায়গায় বসে সে ওর হাতে কয়েক লোকমা ভাত খেয়ে নিলো।অর্ণব নিজে খায়নি।প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসেছে।
এরপর সোজা রুমের এক কোণায় গিয়ে বসে আছে এখন।
কুসুম দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ
শেষে শক্ত গলায় বললো’আমাকে তো জোর করে খাওয়ালেন।নিজে খাবেননা?’

‘পরে’

‘তাহলে আমাকে এত ব্যস্ত হয়ে খাওয়ানোর কারণ কি?আপনি যদি না বলেন তবে আমি এখন এ সময়ে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যাব’

অর্ণব ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকালো ওর দিকে।মনে মনে চিন্তা করলো কুসুমকে অসুখের কথা জানানো হয়ত ঠিক হবেনা।তাই কথা কাটিয়ে বললো,’আমার রেসাল্ট খারাপ হয়েছে’

‘তো এত মন খারাপের কি আছে?আসুন খাবেন।আমার হাতে খাবেন?’

‘না।খিধে নেই।যখন খিধে হবে তখন খেয়ে নেবো’
—-
একটা ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে চোখে কাজল লাগিয়ে নিয়েছে জুথি।আজ সন্ধ্যায় তার ফ্লাইট।চলে যাবে অনেকগুলো বছরের জন্য।
ফিরবে কিনা সন্দেহ,তবে বাবার মন রাখতে বলে দিয়েছে এক দু বছর পরেই ফিরবে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ভেবেছে মৃদুল বুঝি আসবে।মৃদুল ভুলে গিয়েছিল আজ জুথির চলে যাবার দিন।যখন মনে পড়েছে তখন থেকে ঘরমুখো হয়ে আছে।তাই হয়ত রাগ করে আসছেনা।নাহলে ঐ পাগলটার এতক্ষণে দশ বার এসে যাওয়ার কথা।
মুচকি হেসে ব্যাগটা খুলে সব আছে কিনা দেখে নিলো সে।ফরহাদ কান্নাকাটি করছে।সে বায়না ধরেছে বুবুর সাথে সেও যাবে।
জুথি অনেক বুঝিয়ে তাকে শান্ত করলো।আজ কেন যেন যেতে ইচ্ছে করেনা।মৃদুলের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত চোখের সামনে জলসার মতন ভেসে যাচ্ছে।মন বলছে থেকে যেতে।কিন্তু মন কি ভুলে গেছে সে কটাদিন আগে ভেঙ্গে গিয়েছিল?সে ব্যাথা তো এখনও আছে।যতদিন না সে ব্যাথা শুকিয়ে চামড়া উঠবে ততদিন মৃন্ময়ী দেশে ফিরবেনা,ভুলেওনা,কোনদিনও না।’
—-
অর্ণব দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে ছিল।কুসুম এই নিয়ে পাঁচবার খাবারের জন্য ডেকে গেছে।
বাবা কল ব্যাক করেছেন,মৃদুল করেছে।ফোন ছুঁড়ে মারায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে কল আসেনি। কুসুম ফোন খুলতে জানেনা।তাই ফোন এনে বললো’আপনার ফোন তো জ্বলে না’

অর্ণব দেয়াল থেকে মাথা তুলে ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে খুললো।সঙ্গে সঙ্গে মৃদুলের কল এসেছে।রিসিভ করে কুসুমের কথা বলার আগেই সে বলে দিলো আর দু ঘন্টা পর জুথি চলে যাবে।সে যেন একবারের জন্য হলেও এয়ারপোর্টে এসে ওর সাথে দেখা করে যায়।

অর্ণব ফোন রেখে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে কুসুমের দিকে চেয়ে বললো,’ঘুরতে যাবে?’

কুসুম মাথা নাড়ালো।ওকে তৈরি হতে বলে রান্নাঘর থেকে পাউরুটির প্যাকেট নিয়ে বিছানায় এসে বসে দুটো পাউরুটি খেলো সে।বাবার সাথে কথা বলতে হবে এই নিয়ে।বাবা যা বলেন তাই হবে।আমার পক্ষে একা এত কিছু করা সম্ভব নাহ’
—–
এয়ারপোর্টে এসে বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছে জুথি।পা চলেনা,মন চায়না,কেউ চায়না আজ সে চলে যাক।অথচ তার দেহ চায় চলে যেতে।আর থাকতে চায়না এই দেহ!

‘মৃদুল ভাইয়া কি আসবেননা?আমার উপর তার এত রাগ?
আমি কি দোষ করেছি?কেন সবাই আমায় দোষী ভাবে?আমাকে কষ্ট দিয়ে তাদের কিসের এত লাভ?একবার দেখা করলে তার ইগো নষ্ট হয়ে যেতো?নাকি ভেলপুরি খেতে গিয়ে যে দেখা হলো সেই দেখাই তার কাছে যথেষ্ট হয়ে গেলো?যাচ্ছি তবে!
আর কোনোদিন মৃন্ময়ী ফিরবেনা।মৃন্ময়ীর ও রাগ আছে,ইগো আছে।সে আর কষ্ট পাবেনা।সবাইকে কষ্ট দেবে। যতক্ষণ না তারা নিজের ভুল বুঝবে ততদিন রাগ দেখাবে সে।ইগোতে অটল থাকবে সবসময়।’

চোখ মুছে পা বাড়াতে যেতেই সামনে এসে দাঁড়ালো এক চেনা মানুষ।ছাই রঙের পাঞ্জাবি তাতে নীল রঙের লেস।বোতাম তিনটে।মানুষটার মুখ দেখা যাচ্ছিলনা।হাতে দুটো হাওয়াই মিঠাই ধরে রেখেছে মুখের সামনে।
জুথি অবাক হয়ে দেখছিল।মৃদুল মুখের সামনে থেকে হাওয়াই মিঠাই সরিয়ে বললো,’একটা তোমার আর আরেকটা আমার না হওয়া শাশুড়ি আম্মুর।নাও ধরো’

জুথি ভ্রু কুঁচকে বললো,’আর কেন আসলেন?কি দরকার ছিল?’

‘চলে যাব?’

‘নাহ।থেকে যান’

মৃদুল হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দিয়ে বললো,’এখনও সময় বাকি, দাঁড়াও তোমায় কয়েকটা হলুদ গোলাপ কিনে দেই।নব থিয়েটারের সামনে দেখেছিলাম নানা রঙের গোলাপ।হাঁটতে হবে তাও পারবো।জাস্ট কিছু সময় ওয়েট করো।আমি যাব আর আসবো।
হলুদ গোলাপ দিয়ে প্রতিশোধ তুলবো আজ।আমিও কম না’

মৃদুল জুথিকে কিছু বলার সুযোগই দিল না।চলে গেলো ফুল আনতে।জুথি হাওয়াই মিঠাই একটা খুলে খেতে গিয়েও পারলোনা।মৃদুলের চোখে সে পানি দেখেছে আজ।
‘মানুষটা এত কষ্ট কেন পাচ্ছে?আমাকে কেন এত দোষের ভাগিদার করে তুলছে।তাকে কষ্ট দিতে চাইনা বলেই তো ভালবাসিনি।
আমার মন যাকে একবার ভাল বেসেছিল সেই মন তো এখনও সেরে ওঠেনি।তাহলে কি করে ঐ দূর্বল মনটা দিয়ে তাকে ভালবাসতাম?কেন বুঝেননা!’

হাওয়াহ মিঠাইয়ের প্যাকেটটা ফেলতে যেতেই জুথি সামনে দেখলো মৃদুল দাঁড়িয়ে হাওয়াই মিঠাই কিনছে।বিষয়টা ওর কাছে অদ্ভুত মনে হলো।সে তো মাত্রই গেছে হলুদ গোলাপ আনতে তবে আবার হাওয়াই মিঠাই কিনছে কেন?এই তো দুটো কিনে দিলো?মাথা খারাপ হলো নাকি?’

কোমড়ে হাত রেখে জুথি সেদিকে যাচ্ছে এখন।হঠাৎ মৃদুলের অশ্রুভরা চোখ মনে আসায় এগিয়ে গিয়ে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সে।যেটা কখনও করেনি সেটা আজ করলো।হয়ত মানুষটা এতে করে নিজের মনকে বোঝাতে পারবে।
পিঠে মুখ ডুবিয়ে জুথি বললো,’আই এম সরি।প্লিজ কষ্ট পাবেন না।আমাকে যেতেই হবে।তা কই আপনার হলুদ ফুল?’

যাকে সে জড়িয়ে ধরেছিল সে মানুষটা হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে বললো,’জুথি!’

মৃদুলের জায়গায় অর্ণবকে দেখে জুথি পিছিয়ে গেছে।মৃদুল যে পাঞ্জাবি পরেছিল হুবুহু একই পাঞ্জাবি আজ অর্ণব ও পরেছে।জুথি চিনতেই পারেনি।
অর্ণব কিছুই বুঝতে পারছেনা।জুথি চোখ মুছে বললো,’সরি আমি ভাবলাম…. ‘

‘ইটস ওকে।আপনার বাবা আসেননি?ফরহাদ কোথায়?’

‘দাদা দাদি একা বলে তাদের আসতে দেইনি এতদূর।যেতে যেতে অনেক দেরি হতো তাই আমি একা এসেছি।আপনি কেন এলেন?’

‘মৃদুল থেকে শুনলাম আজ চলে যাচ্ছেন।তাই দেখতে এসেছি’

‘কেন এসেছেন?কি অধিকার আপনার?’

‘জানি অধিকার নেই।তবে কোনো একদিন আপনি আমার ভাল বান্ধুবী ছিলেন।তার জোরে দেখতে আসা।এরপর আবার কবে দেখা হবে কে জানে।দেখতে আসতে তো ক্ষতি নেই।আপনি খুশি হোননি?’

‘বান্ধুবী??
বান্ধুবীকে মানুষ রেস্টুরেন্টে নিয়ে বারবার খাওয়ায়??বান্ধবীকে মানুষ জঙ্গলে হারিয়ে পাগলের মতন খুঁজে?
তার মোহে পরে বলে সাজিয়ে নেবো??বান্ধুবীর কাছে ক্ষমা চায় অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করার পর!!
বান্ধবীর প্রেমে পড়ে নিজের সদ্য বিয়ে করা বউকে দু চোখের বিষ মনে করা হয়??
মিঃ অর্ণব!আপনি আসলে নিজেই জানেননা আপনার কি চাই!!
আপনি পছন্দ আর ভালবাসার ভেদাভেদ জানেননা।আপনি ভালবাসা চেনেননা।
আপনি যেদিন ভালোবাসার ব্যাখ্যা জানবেন সেদিন আপনার জীবনে কোনো ভালবাসা থাকবেনা।একটুও না,ছিঁটেফোটাও না।আমাকে দেখতে আসার এই নাটক না করলেও হতো!হাওয়াই মিঠাই আপনার বউয়ের জন্য নিচ্ছিলেন তাই না?
লজ্জা করেনা??বউকে সাথে নিয়ে প্রাক্তনকে বিদায় দিতে এসেছেন?
আমার জন্য মন পোড়ে আপনার?
কি পোড়ে??এখানে আসার কারণ জানেন?ওহ হ্যাঁ!অর্ণব তো কিছু জানেনা।সে শুধু পরিস্থিতির স্বীকার হতে জানে।আজ কেন চলে যাচ্ছি জানেন?আপনার কারণে!
আপনার স্মৃতি আমার জীবন তছনছ করে দিয়েছে!আমি আর লড়তে পারছিনা এসবের সাথে।বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছি।’

—-
হাতে হলুদ গোলাপ একটা নিয়ে মৃদুল হেঁটে আসছিল এদিকে।জুথির কাছাকাছি এসে হঠাৎ থেমে গেলো।তার সামনে কুসুম দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখে পানি।ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই সে সামনে দেখতে পেলো অর্ণব আর জুথিকেও।কুসুম একটু দূরে ছিল।গাছগাছালির আড়ালে।মৃদুল ওদের দুজনকে দেখে বুঝতে পারলো তারা কোনো কথা বলেছে যেটা কুসুম শুনেছে যার কারণে কাঁদছে এখন।
সবটা শুনেছে কিনা কে জানে।ওর কান্না করার কারণ কি?কি বলতেছে ওরা!
ওদের সাবধান করতে সে জোরে হেসে বললো,’কিরে অর্ণব! কখন এলি?’

তখনই জুথি হনহনিয়ে চলে গেলো ওখান থেকে।
অর্ণব মৃদুলের দিকে চেয়ে বললো,’ও চলে যাচ্ছে।ফুলটা দিয়ে আয়।আমি যাই।কুসুম মনে হয় অপেক্ষা করছে’
চলবে♥