#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৭৯
আফনান লারা
.
‘নানু তুমি কি জানতেনা,আমি মৃদুল ভাইয়াকে বলে যাব না দেশে?এটা কি করলে!’
‘সরি,ভুল হয়ে গেলো’
নানু হাঁটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছে।ঐ হাঁড়ি আর জোড়া লাগবেনা।
‘এদিকে যত যাই হয়ে যাক না কেন মা আমাকে ছাড়া দেশে যাবেনা আর ওদিকে মৃদুল ভাইয়া সমস্ত জোগাড় করে ফেলতেছে আমাকে রিসিভ করতে আসার।এত বড় ভুল কি করে হয়ে গেলো।আমি ভাবতেও পারিনি নানু এ সময়ে এই কথাটা বলে দেবে।এখন কি করে কি হবে!ধুর ভাল্লাগেনা’
—-
অর্ণব চেয়েছিল আরও কিছুক্ষণ ধমকে ধামকে কুসুমকে ভয় দেখাবে,কিন্তু সেই সময়ে হঠাৎ শেয়ালের ডাকে তার ভাবনায় ছেদ হয়ে গেলো।আপাতত শেয়ালের ভয়ে কুসুমকে ধরে দৌড় মেরেছে।কোনদিকে দৌড় মেরেছে তা সে জানেনা,কুসুম তো জানেইনা। অন্ধকারে ঠিক কোন রুমে চলে এসেছে তারা বুঝলোনা।বিছানায় হাত রেখে দুজনে চুপচাপ বসেছে।তখন কুসুম ফিসফিস করে বললো,’এটা মনে হয় আমাদের না,চাদর দেখেন, খসখস করে।নরম না তো’
‘আমারও মনে হলো।কার রুমে এসেছি বুঝতেছিনা’
‘অর্ণব বাবা নাকি?’
কুসুমের বাবার কণ্ঠস্বর শুনে দুজনে আর দেরি না করে সামনের দিকে ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।কুসুম বিরক্তি নিয়ে হাত ছাড়িয়ে বললো,’আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা।দেখে শুনে বাবার ঘরটাই পেলেন ঢুকার জন্য?’
“আরে অন্ধকারে কিছু দেখতে পাইনা, কি করি বলোতো?’
দুজনে ঝগড়া করছিল সেসময়ে কারেন্ট এসে যাওয়ায় তাদের ঝগড়ার ইতি ঘটলো শেষে।
দুজনে এবার ভালমতন হেঁটে রুমে চলে এসেছে।কুসুম ভাবলো অর্ণব বুঝি ভুলে গেছে ওকে বুড়ো বলবার কথা।চোখ বুজে ওটাই ভাবছিল নিরবে।
পরে নিশ্চিন্ত মনে পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখলো অর্ণব চেয়ে আছে।ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ব্রু নাঁচিয়ে বললো,’কি বলছিলে তখন?’
‘ভুলে যাননি?’
‘প্রশংসা ভোলা যায়,খোঁচা ভোলা যায়না’
‘আর বলবোনা কখনও।একেবারে আক্কল হয়েছে আমার’
‘এই তো মেধাবী ছাত্রীর মতন কথা বললে।একেবারে বুঝদার।ঘুমাও এবার।আমাকেও ঘুমোতে দাও’
—-
‘এই বিমানে আমার জুথি হবেনা সিওর’
‘তোমার মাথা একেবারে হেট হয়ে গেছে মৃদুল ভাইয়া’
‘কবে ভাল ছিল?’
‘আজ জথিপু আসবেনা দেখো’
‘ওটা আমিও জানি।খবর নিছি।সিঙ্গাপুরের যে একটা ফ্লাইট ছিল সেটা আসতেছে।আর আমি মাত্র জুথির সাথে কথা বললাম, সে তার ঐ সাদা চামড়ার অবফের সাথে আলাপ করছিল’
‘অবফ কি আবার?’
‘মানে বফ না,কিন্তু হইতে চায়’
‘ভাইয়া তুমি না একটা জিনিস!!যে পাবে সে জিতবে কিনা এটা বুঝতে তার বছর খানেক লেগে যাবে’
তমালের গলা জড়িয়ে মৃদুল এয়ারপোর্ট থেকে চলে আসতে আসতে বললো,’বুঝলি আমাকে পাইলে জুথি জিতবে এটা যদি সে জানতো তবে এত অবহেলা,অনাদর করতোনা রে।মেয়েটা একটা অবুঝ’
‘জুথি আপুকে অবুঝ বললে কুসুম ভাবীকে কি বলবে?’
‘ওটা তো দুধের শিশু।ওটা তো আওতাধীনই না।ম্যাচিউরদের সাথে ম্যাচিউরদের কথা খাটে।আমরা একে অপরকে অবুঝ বলবো,বয়স্ক বলবো।কিন্তু এর মাঝে শিশুদের কোনো জায়গা নাই।তাদের একটাই পরিচয় সেটা হলে তারা শিশু ‘
তমাল মুচকি হেসে বুক ফুলিয়ে বললো,’কুসুম ভাবীর যদি মেয়ে হয় ঐ মেয়েকে আমি বিয়ে করবো।আমি জানি তার মেয়ে তার মতনই সুন্দরী হবে’
‘অর্ণব তোর কাছে তার মেয়েকে বিয়ে দেবেনা।আর ওর মেয়ে যুবতী হইতে হইতে তোর দাঁত পড়ে যাবে সব এক এক করে।অর্ণব অন্তত দাঁত শূন্য জামাই ঘরে আনবেনা’
—-
‘কিরে জুথি?কোনো বিষয়ে ডিপ্রেসডৃ নাকি তুই?এমন মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন সকাল থেকে।মোরকো বললো তুই নাকি আজ ওর সাথে দু মিনিটের বেশি কথা বলিসনি,কথার মাঝ দিয়ে নাকি দরজা বন্ধ করে চলে এসেছিলি?ওর সাথে ঝগড়া হলো নাকি?’
‘আর কি বলবো তোমায়।নানুর কারণে মৃদুল ভাইয়া জেনে গেছে আমরা দেশে ফিরতেছি।এখন প্রতি এক ঘন্টায় ভাইয়া ভিডিও কল দিচ্ছে’
‘ব্লক করতে বুকে বাঁধে?’
মায়ের কথা শুনে জুথির কথা হাওয়া।কথাটা মা কি প্রসঙ্গে বললেন শুরুতে বোঝা যায়নি।পরে যখন সে বুঝতে পারলো তখন চট করে সোফা থেকে উঠে রুমের দিকে ছুটে এলো।
‘আম্মু কি ভাবছেন আমাকে আর মৃদুল ভাইয়াকে নিয়ে??’
—–
কুসুমের হাসি মুখ দেখলে অর্ণব ভুলে যায় ওর কঠিন রোগটার কথা।একেবারে ধুয়ে মুছে যায় ঐ কথা স্মৃতি থেকে। সকালে উঠার পর কুসুমের শরীর খারাপের কথা শুনে আবার মনে পড়ে গেলো ওকে জলদি বিদেশ নিতে বলেছে ডাক্তার।মুখটা কোনোরকমে ধুয়ে ছুটে গেছে সে বাবার কাছে।বলবে জমি পানির দামে হলেও বিক্রি করে দিতে।টাকার বড্ড প্রয়োজন
কিন্তু তার আগেই বাবা কুসুমের শরীর খারাপ শুনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন জমি বিক্রি করার,এবং সেটা আজই।জমির সব কাজ সাগর করবে।কারণ জমিটা সাগরের নামে।
সব বন্দবস্ত হয়েছে শুনে অর্ণব রুমে ফেরত চলে এসেছে।মুখে হাসি ফুটেছে কুসুম সুস্থ হয়ে যাবে ভেবে। কত কি স্বপ্ন বুনা হয়ে গেছে তার।
কুসুমের মা ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলেন।ওর চোখ দুটো বন্ধ।আস্তে আস্তে বলছে তার নাকি অসহ্যকর যন্ত্রনা হচ্ছে মাথার ভেতর।
অর্ণব ওর মাকে ইশারা করে নিজে তার জায়গায় বসেছে।কপালে অর্ণবের হাতের ছোঁয়া লাগতেই কুসুম বুঝে গেলো এটা ওর হাত।চোখ না খুলেই বললো,’কেন সুখের পরমূহুর্তেই কষ্ট চলে আসে জানেন?’
‘জানিনা।আমার জানা থাকলে আমি সুখী মানুষ হতাম’
‘আপনি তো সুখী।অসুখ যার সে জানে সুখ কি নেয়ামত’
অর্ণব তাচ্ছিল্য করে হেসে ফেললো।সুন্দর করে বিলি কেটে কেটে বললে,’নিজের স্ত্রী অসুস্থ হলে স্বামীর মন অসুস্থ হয়ে পড়ে।চাইলেই সে নিজেকে সুস্থ দাবি করতে পারেনা।কারণ টান চেনো টান??’
কুসুম আর কিছু বলেনি।ও সবসময় ছুঁতো খোঁজে একটি কথা বলার।আর তা হলো অর্ণব তাকে ভালবাসেনা,সে অনুভব করেনা যেটা সে অনুভব করে।
অর্ণবের মনে কি আছে তা কেবল সে জানে।যতদিন না প্রকাশ করবে ততদিন সেটা সবার কাছে অজানা থাকবে।আর কুসুমের কাছে মনে হবে কেবল রোগের কারণে দেখানো সহানুভূতি।
‘আর কত?’
‘কি আর কত?’
‘আর কতদিন আপনি আপনার কাজ,পড়াশুনা ফেলে রেখে আমার সেবা করে যাবেন?আগে তো করতেন না এমন।আগেও দিন চলতো’
‘আগে তোমার এই অসুখটা ছিলনা।এখন আছে।আমার কাছে সবার আগে তোমার সুস্থতা তারপর বাকি সব।
কাজ পরে করা যাবে,চাকরির পড়াশুনা পরে করা যাবে।কিন্তু তোমার দেখাশুনা পরে করলে….
‘পরে করলে?’
‘কিছুনা। বলো আমার হাতের কি খাবে?আমি দেখেছি,আমি তোমায় পোড়া,কাঁচা যাই বানিয়ে দেইনা কেন তুমি সেটা তৃপ্তি সহকারে খাও।সেখানে আম্মুর কিংবা তোমার মায়ের বানানো খাবারটা অতোটা তৃপ্তি নিয়ে খাওনা’
কুসুম হেসে বললো,’ডিম ভাজিটা করে আনেন তাহলে।রুটি খেতে ইচ্ছে করেনা।শুধু ডিম খাব’
কুসুমের মা কাঁদছিলেন আড়ালে থেকে।কেঁদে কেঁদে বলছিলেন,’আপা আমার মেয়ের সুখে কার নজর লেগেছিল বলবেন!ছোট থেকে তার যেন কপালটাই একটা কলংক।
এত এত বাধা বিপদ কেটে শেষে কিনা মরণব্যাধি হলো।এত ভাল স্বামী,এত ভাল সংসার পেয়ে কিনা তার জীবন হুমকিতে পড়ে আছে!’
‘আপনি চিন্তা করবেন না বোন।দেখবেন ও ভাল হয়ে যাবে।অর্ণবের ভালবাসায় ওর রোগ সেরে যাবে’
‘এই ভালবাসা যদি তিন বছর আগে দেখতে পারতাম আমরা,আহারে কার কপালে কি আছে তা বুঝি এত আগ থেকে ঠিক হয়ে থাকে!’
—
আজ ডিম ভাজাটা খুব সুন্দর হয়েছে।একটুকুও ডিমের খোসা পাওয়া যায়নি ভাজিতে।এর সম্পূর্ণ ক্রেডিট মায়ের।কারণ ডিমটা মা ভেঙে দিয়েছিলেন।বাকিসব অবশ্য অর্ণবের করা।
কুসুম ডিমটা খেয়ে বললো,’যাক,তাহলে রান্না শিখে ফেললেন ‘
‘এই আর এমন কি।আর কি খাবে বলো?আমি সব বানিয়ে খাওয়াবো।হাওয়াই মিঠাই খাবে?’
—-
আজ আর কুসুম অর্ণবের রুমের ধারের কাছে কেউ যায়নি।যেন এই দিনের অপেক্ষায় ছিল সকলে।তাদের আলাদা সময় সবাই দিতে চান বলেই ওদের সাথে দরকার হবার পরেও কেউ কথা বলতে আসেননি।তারা চান ওদের ভালবাসাময় দিনটায় যেন কোনো প্রকার ত্রুটি না যুক্ত হোক।
পারলে দিনটাকে তারা আরও সুন্দর করে দিতেন।
চলবে♥
#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮০
আফনান লারা
.
টাকা হাতে এসে গেছে।সেই টাকা নিয়ে সাগর ভাইয়া আর মিশু ভাবী ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।
একটা কথা সবার মাথা থেকে চলেই গিয়েছিল।আর সেটা হলো পাসপোর্ট।
না অর্ণবের পাসপোর্ট আছে আর না কুসুমের।পাসপোর্ট তৈরি করতে অনেক সময় লেগে যাবে।এই কথা যখন মাথায় আসলো তখন অর্ণবের চিন্তা হাজারগুন বেড়ে গেলো।শুধু তাই নয়।বিদেশে যাবার যে পাসপোর্ট খরচ সেটা তো হিসাবই করেনি কেউ।
চিন্তায় তার মুখে যে হাসি ছিল সকালের দিকে, সেই হাসিটা গায়েব হয়ে গেছে এখন।মাথায় হাত রেখে মৃদুলকে ফোন করলো সবার আগে।সে তখন ভার্সিটিতে ছিল,স্যারদের সাথে একটা সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিল বলে ফোন সাইলেন্টে রেখেছে।
ওকে না পেয়ে অর্ণব কুসুমকে রেখে একাই পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।পরে বাবা বললো যেহেতু কুসুমেরও পাসপোর্ট লাগবে হয়ত ওর ও প্রয়োজন পড়তে পারে অফিসে।
বাবার কথামতন কুসুম তৈরি হয়ে নিয়েছে যাবে বলে।অর্ণব ওকে নিতে চাচ্ছিলো না,কারণ তার শরীর এতই খারাপ যে ঠিকভাবে বসতেও পারছেনা।
—-
‘মৃদুল ভাইয়া একটু দাঁড়ান’
মৃদুল সেমিনার রুম থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছিল।একটা মেয়ের ডাক শুনে হাত ভর্তি ফাইল থেকে মাথা তুলে সামনে তাকিয়েছে।
গায়ে হলুদ রঙের লং ফ্রক আর গলায় ওড়না ঝুলিয়ে একটি মেয়ে ছুটে এসে দাঁড়ালো ওর সামনে।হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,’ভাল আছেন?’
‘খারাপ ছিলাম কবে?’
‘কি করছেন?’
‘মধু খাচ্ছি’
মেয়েটা এবার কপাল কুঁচকালো।কোমড়ে হাত রেখে বললো,’তোর এত কি সমস্যা আমার সাথে?ঠিক করে কথা বলতে পারিস না?অসভ্যের শেষ সীমা কোথাকার!’
তমাল মৃদুলের মতন ফাইল কতগুলো নিয়ে বেরিয়েছিল রুম থেকে।মেয়েটার মুখের ভাষা শুনে বললো,’এ্যাই তুমি জানো ও কে?এটা কি ধরনের ব্যবহার?একদম বিভাগীয় প্রধানের কাছে নালিশ করবো,আর ভাইয়া তুমি হা করে কি দেখছো?নালিশ করবে চলো’
‘প্রথমত, আমার ভাষা একেবারে ঠিক ছিল,টিট ফর ট্যাট যাকে বলে।দ্বিতীয়ত, আমি এই ভার্সিটির না।ভার্সিটি কেন,আমি তো কলেজেরই না।আমি ক্লাস টেনে পড়ি।এবার গিয়ে নালিশ করেন, যান’
তমাল চোখ কপালে তুলে বললো,’ওমা এই দুধের শিশু আমাদের ভার্সিটিতে এলো কি করে?এরে কে ঢুকতে দিয়েছে?’
মৃদুল পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল,মেয়েটা দেয়ালে হাত রেখে ওর পথ আটকে চোখ রাঙিয়ে বললো,’আপনি জানেন আমি আপনাকে পছন্দ করি,তাহলে কেন এমন করছেন?আমাকে পাত্তা দিতে আপনার কিসের এত কিপটামো?’
‘ভাইয়া তুমি ওরে চিনো?’
মৃদুল বিরক্তির স্বরে বললো,’আমার মুখের ভাষা খারাপ করবেনা।সামনে থেকে সরো।’
‘সরবোনা,কি করবেন?’
‘মৃদুল নিজের হাতের ফাইলগুলো তমালের ফাইলের উপরে রেখে দিয়ে পাঞ্জাবির হাতা তুলে বললো,’কি করবো?’
‘আপনাকে আমি ভয় পাইনা’
‘ছেলেরা হাতা তোলে মারার জন্য এটা ঠিক,তবে মৃদুল হাতা তোলে ভাষণ দেওয়ার জন্য।তো আমার ভাষণ শোনো।
যাকে বলে জরুরি তথ্য।
আমি বাচ্চা মেয়ে এজ অ্যা গার্লফ্রেন্ড হিসেবে পছন্দ করিনা।সবসময় ম্যাচিউর মেয়ে পছন্দ করতাম।এখনও করি।আগে সিক্সে পড়তে,এখন টেনে পড়ছো।তাও তুমি আমার কাছে বাচ্চাই থাকবে।বিয়ে করার জন্য বাচ্চা মেয়ে আমার এক বিন্দুও পছন্দ না।কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও’
‘একজন ধোকা দিয়েছে বুঝলাম।তাই বলে আমি ধোকা দেবো সেটা কি করে ভাবেন?’
‘ধোকা দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?সরো তো।আজাইরা সময় নাই আমার হাতে ”
তমাল দশটা ফাইল একসাথে ধরে কাঁপা কাঁপা কদম ফেলছিল।মেয়েটার গাল ফুলা দেখে যেতে যেতে বললো,’আচ্ছা তুমি ভাইয়াকে চেনো কি করে?’
মেয়েটা গাল ফুলিয়ে বললো,’আমি অনামিকার বোন’
কথাটা শুনে তমাল হাত থেকে সব ফাইলই ফেলে দিয়েছে।চোখ বড় করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,’একই মাচার কুমড়োর স্বাদ একই রকম।এই কথা মৃদুল ভাইয়া জানে বলেই তুমি অল্প বয়সে পেকে যাবার পরও মেনে নেয়নি।বাই দ্যা ওয়ে,আমি পিচ্চি!! তুমিও পিচ্চি!চলো আমাদের পিচ্চি আনার প্ল্যানিং করি এবার।কি বলো?দেখো তুমি অতীতে একজনকে পছন্দ করতে এটা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘শাট আপ!আপনাকে আমি বিয়ে করবো?বডি দেখেছেন নিজের?আমাকে কোলে নিলেই তো ধপাস করে পড়ে যাবেন। এসেছে বাচ্চাকাচ্চার প্ল্যানিং নিয়ে।
‘বডি দিয়ে প্রেম হয় নারে পাগলী। ভাইয়া আসলে ঠিক বলেছিল,তুমি একটা দুধের শিশু।তোমার সাথে ব্রেক আপ।বাই’
‘আশ্চর্য! প্রেম হলো কখন যে ব্রেক আপ বলে চলে গেলো!’
—-
অর্ণব অফিসের কর্মচারীর সাথে কথা বলছে।এসময় টাতে কুসুমকে একটা চেয়ারে বসিয়ে রেখে এসেছিল সে।
বসে থাকাকালীন ওর হাতে একটা কাগজ আর একটা কলম লেগেছে।পাশের টেবিল থেকে তুলেছিল।
তাতে অর্ণবের নাম লিখলো।নিজের নাম ও লিখলো।তারপর তাতে কলমের কালি মোটা করে এঁকে ফুল আঁকলো।কি মনে করে জুথির নামটাও লিখলো।লিখেছে মিননয়ি।
তারপর সেই নামটা আবার কেটে দিলো।এরপর ফিক করে হেসে কাগজটা হাতের মুঠোয় লুকিয়ে ফেলেছে।
সে যেখানে বসে আছে তার ঠিক সামনেই দেয়ালে লাগানো বিশাল আয়না।কাগজটা লুকানোর সময় তার চোখ পড়েছিল ওটাতে।
আজ অনেকদিন ওর আয়না দেখা হয়না।অসুখ হলে কোন মানুষটা আয়না দেখার সময় পায়?
কুসুম ও পায়নি।এখন নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারলোনা।
এই মেয়েটা কে?চোখের নিচে কালো দাগ।ঠোঁট মুখ শীর্ণ।কেমন রোগা লাগে।যেন কতদিন কিছু খাওয়া হয়না।
‘এমন হাল হলো কেন আমার?আমি কি তবে মরে যাব?আমি মরলে উনি কি কাঁদবেন?এখন যেমন করে কাঁদেন?
তারপর কি বিনু খালার স্বামীর মতন আরেকটা বিয়ে করবেন?
সে ঘরে বাচ্চাকাচ্চা হবে।আরও কত কি!
যদি উনিও এমন করেন,সেটা নিশ্চয় আমি দেখবোনা।কিন্তু এমনটা যে করবেন তাই ভেবেই তো অশান্তি লাগছে।
তার স্ত্রী হতে পেরে কত খুশি হয়েছিলাম, সে খুশি শেষ হয়েছিল মিননয়ি আপু আর তার সম্পর্কের কথা জানার পর।এরপর আবারও আমার বোকা মাথায় ভালবাসার ফুল ফুটেছিল।ভেবেছি এইসব আমারই।আমিও সুখী হতে পারি।সময় আছে অনেককককক।
কিন্তু আজকাল মনে হয় সময় নেই বললেই চলে।বুঝি এখনই ঢলে পড়বো মৃত্যুর কোলে।আচ্ছা আমি যে মরবো বাবা মায়ের পরে আর কে কাঁদবে?
মিননয়ি আপু কাঁদবেন?উনি তো খুব ভাল।হয়ত কাঁদবেন।আমি মরেছি বলে না,আমার উনি কাঁদছেন দেখলে তারও কান্না এসে যাবে।
যদি উনাকেই বিয়ে করেন তিনি??’
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে খালি পা দিয়ে টাইলসে ঘঁষতে ঘঁষতে কুসুম আবার ভাবলো।উনি বিয়ে করলে মন্দ হবেনা।
আমার কারণে তাদের মাঝে যে দেয়াল খাড়া হয়েছিল,সেই আমার কারণেই ঐ দেয়াল বিলীন হয়ে যাবে।কি সুন্দর নিয়তি।মানে আপুর কপালে আমার তিনিই ছিলেন।মাঝখানে আমি এসেছি অতিথি পাখি হয়ে।মৌসুম শেষ,আমারও যাওয়ার পালা।
যদি তিনি মিননয়ি আপুর সাথে সুখে থাকেন তবে আমি চাইবো আমি যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে যাই।আমাকে তাহলে আর কষ্ট পেতে হবেনা,আর কাউকেও আমার অসুখ বয়ে কষ্ট পেতে হবেনা।একদিনে কাঁদুক,পরেরদিন সুখে থাকুক’
হঠাৎ পায়ে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে ভাবনার বাহিরে চলে আসলো কুসুম।চেয়ে দেখলো অর্ণব হাঁটু গেড়ে বসে ওর পায়ে জুতো পরিয়ে দিচ্ছে।কুসুম ওকে দেখে পা সরিয়ে নিয়ে বললো,’ছিঃ!পায়ে হাত লাগাচ্ছেন কেন’
‘ফ্লোর কত ঠাণ্ডা দেখেছো?খালি পায়ে যে থাকছো এত,জ্বর হলে কি হবে জানো?’
‘আমি পরে নিচ্ছি।আপনি হাত লাগাবেন না দয়া করে’
‘জুতো পরানো শেষ’
উঠে ওর পাশে বসলো অর্ণব।কুসুম মাথা নিচু করে বসে আছে।অর্ণব বললো,’অপেক্ষা করতে বললো।তোমার কিছু সই লাগবে।নিজের নাম লিখতে পারবে তো?’
কুসুম মাথা নাড়ালো।অর্ণব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে চলে যাচ্ছিল।সেসময়ে কুসুম ওর হাতঘড়িটা ধরে ফেললো।
অর্ণব থেমে ওর দিকে চেয়ে আছে এখন।
‘এগুলো কেন করেন?’
‘বললাম না,যেদিন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবে আমি সব দায়িত্ব ভাবি সেদিন বলবো এসব কেন করি’
কুসুম হাত ছেড়ে দিলো।ও চলে যাবার পর সে কাগজের আরেকটা পৃষ্ঠা নিলো টেবিল থেকে।সেটাতে অর্ণব,কুসুম নাম দুটো লিখছেই তো লিখছেই।থামাথামি নেই।
অর্ণব কলা,পাউরুটি নিয়ে এসে পড়তেই ও কাগজটা লুকিয়ে ফেলার বৃথা চেষ্টা করলো।অর্ণব দেখে ফেলেছে।খাবারগুলো ওর কোলে দিয়ে বললো,’কি লুকালে?’
‘কিছুনা’
অর্ণব ওর হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে দেখলো পুরো কাগজটা জুড়ে বিশ,বাইশবার করে অর্ণব কমা কুসুম লেখা।
কাগজ থেকে মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখলো কুসুম মাথাটা একেবারে নিচু করে ফেলেছে লজ্জায়।
অর্ণব কাগজটা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,’আর কোনো নাম শিখতে হবেনা?’
‘কি নাম?’
‘ধরো, তোমার আমার মেয়ের নাম’
কুসুম এত লজ্জা পেলো যে উঠে চলেই গেলো।অর্ণব বসে থেকে ওর চলে যাওয়া দেখে ভাবছে সামান্য এ কথায় এত লজ্জা পাবার কি আছে।যাবার পথে কুসুম কাগজটা ফেলে গিয়েছিল।মিনিট দশেক পাশের করিডোরে ঘোরাফেরা করে আবার চলে এসেছে সে।অর্ণব খাবারের প্যাকেট গুছিয়ে রেখে অফিসারের সাথে কথা বলতে গেছে।চোরের মতন ওকে দেখতে দেখতে সিটে বসে কাগজটা তুলে হাতে নিয়ে দেখছে।এপাশে তারই লেখা অর্ণব কুসুম।কোনো কিছু খেয়াল না করে কাগজটা রেখে পাউরুটি ধরতে নিল সে, তখনই চোখ পড়লো কাগজটার উল্টো দিকে।
কাগজটার উল্টো পিঠ জুড়ে অর্ণবের হাতে লেখা অর্ণব,কুসুম আর আরও একজনের নাম।একটি মেয়ের নাম।
নামটি হলো”লিলি””
কুসুম নামটা দেখে ভাবছে অর্ণব এই নামটা কেন ঠিক করলো।ওকে আসতে দেখে কাগজটা সে রেখে দিছে।অর্ণব তার পাশে বসে বললো,’জানতে চাইবেনা লিলি নাম কেন রাখলাম?’
‘কেন?’
‘কুসুম নামের অর্থ ফুল,অর্ণব নামের অর্থ সমুদ্র।
আর লিলি হলো এমন একটা ফুল যেটা কিনা বিদেশে সমুদ্রের আশেপাশে ফোটে।মিনি হোয়াইট লিলি।
লিলি অর্থ বিশুদ্ধতার প্রতীক।তোমার সরলতার প্রতীক হবে আমাদের মেয়ে।
বাবা মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে দিতে হবেনা?’
কুসুম মুচকি হেসে কাগজটাকে ভাঁজ করে নিলো।
চলবে♥
#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮১
আফনান লারা
.
পাসপোর্ট অফিস থেকে বের হতে হতে বেশ সন্ধ্যা নেমে গেছে।ব্যস্ত নগরী ঢাকার রাস্তার ব্যস্ততা যেন সবেমাত্র শুরু।কুসুমের হাত শক্ত করে ধরে কদমের পর কদম ফেলছে অর্ণব।উদ্দেশ্য একটা সিএনজি পাওয়া।
বাসে করে যাওয়া যেতো,বাস ভাড়া সিএনজির তুলনায় অনেক কম।যেখানে বাস ভাড়া ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা সেখানে সিএনজি ভাড়া দুইশ টাকা।কিংবা তার ও বেশি।এরপরেও সিএনজি করে যাবার আরও অনেক কারণ আছে।কুসুম বাসে জার্নি করতে পারবেনা এই অসুস্থ শরীর নিয়ে।কষ্ট হবে তার।মূলত এ কারণেই সিএনজির খোঁজ করা।
খুঁজতে খুঁজতে ফুটপাত শেষ হয়েছে,শেষ হয়েছে ব্যস্ত রোড ও।অথচ এখন পর্যন্ত সিএনজির দেখা মিলছেনা।কুসুমকে একটা দোকানের বাহিরে দাঁড় করিয়ে সে নিজেই একটু সামনের দিকে দেখে আসতে গেলো।
প্রেমিক- প্রেমিকা,প্রবীণ,পথশিশু।বলতে গেলে এই জায়গায় মানুষের অভাব নেই।শান্ত হয়ে দাঁড়ানো দায় হয়ে যায়।অর্ণব কোথায় যে গেলো,এখনও আসার নাম নিচ্ছেনা।এদিকে মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সহজবোধ্য ঠেকছেনা।তাই সে একাই ঐ জায়গা ছেড়ে হাঁটা ধরলো সামনের দিকে।যেদিকে অর্ণব গিয়েছে সেদিকে।কিছুটা পথ এসে দেখলো পথ শেষ।বিশাল বড় বাউন্ডারি মাটি থেকে উপর পর্যন্ত।তবে কি তার ভুল হলো কোথাও?পেছনে ফিরে আবার সেই দোকানটা সে দেখলোনা যেটার সামনে এতক্ষণ সে অপেক্ষা করেছে।ঐদিনকার মতন আজও কি সে হারিয়ে গেছে?তবে কি করে আবার খুঁজে পাওয়া যাবে উনাকে?
কপালের ঘাম মুছে উল্টো পথে হাঁটা ধরলো সে।কোথাও অর্ণবকে দেখা যাচ্ছেনা।এদিকে মাথা ঘুরছে জোরে জোরে।যেন এক্ষুনি নিচে পড়ে যাবে।
মাথায় হাত দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলাকে সে জিজ্ঞেস করলো উনি সাদা পাঞ্জাবি পরা কাউকে দেখেছেন কিনা।ভদ্র মহিলা প্রথমে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে ছিলেন।
এই শহরে শত শত ছেলের গায়ে সাদা পাঞ্জাবি দেখা যায়।তবে এই মেয়েটা কোন ছেলের কথা জানতে চাইছে??
তিনি উত্তর দিতে চাইলেন কিন্তু তার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে কুসুম।
অর্ণব একটা সিএনজিকে দাঁড় করিয়ে আগের জায়গায় ফিরে এসেছে কুসুমকে নিয়ে যেতে। এসে দেখলো কুসুম ওখানে নেই।এই জায়গায়,এই সিচুয়েশনে ওকে হারিয়ে ফেললে বিষয়টা কত মারাত্নক হবে তাই ভেবে মাথায় হাত চলে গেছে তার।
ওর চিন্তায় বিভোর হয়ে ফুটপাত ছেড়ে মেইনরোডে নেমে পড়েছে সে।
ওর নাম ধরে কয়েকবার ডাকার পর কিছুদূর আসতেই মানুষের ভীড় নজরে পড়লো।কুসুম হতে পারে কিনা,তার কিছু হয়েছে কিনা এসব ভাবনার সঙ্গে যুদ্ধ করে সে ঐ ভীড়ের কাছে এসে উপস্থিত হলো।ঐ ভদ্র মহিলা কুসুমের মাথা তার কোলে রেখে বোতল থেকে পানি নিয়ে ছিঁটাচ্ছিলেন।অর্ণব সামনে থেকে মানুষ সরিয়ে নিচে বসে এক টানে কুসুমকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।ওর মুখে ছিঁটানো পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,’কি হয়েছে ওর?’
‘আমাকে হয়ত তোমার কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, আমি কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে গেলো।ওর কি হও তুমি?’
‘স্বামী’
কথাটা বলে অর্ণব ওকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো।দাঁড় করিয়ে রাখা সিএনজিতে এনে তুললো ওকে।ওরা এখন যে জায়গায় সেখানে দূর দূরান্তেও কেনো হাসপাতাল নেই।থাকলেও সেটা বহুদূর। কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় বাবাকে কল করে জানতে চাইলো এই মূহুর্তে কি করবে সে।বাব ওকে জলদি বাসায় চলে আসতে বললেন কুসুমকে নিয়ে।তাই করেছে সে।ওকে নিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসলো।মিশু ভাবী আর মা মিলে ওর হাত পা ঘঁষে,চোখ মুখে পানি দিয়েও জ্ঞান ফেরাতে পারলেন না।
বাধ্য হয়ে কাছের একটা ফার্মেসী থেকে ছোটখাটো একজন ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছে সাগর ভাইয়া।
অর্ণব কুসুমের ডাক্তারকে দু তিনবার ফোন করেছে।তিনি ব্যস্ত থাকার ফলে রিসিভ করলেননা।
ব্রেইন টিউমার শুনে সাগর ভাইয়ার আনা ডাক্তার ভয়ে কোনো চিকিৎসা করেননি।বললেন যে হাসপাতালে ওর চিকিৎসা করানো হয়েছিল সেটাতেই নিয়ে যেতে।এখন কিছু করলে যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে তো সবাই ওনাকেই দোষারোপ করবে।
অর্ণবকে কুসুমের কাছে রেখে সবাই বাহিরে বসে কথা বলছিল।সাগর এম্বুলেন্সে খবর দিচ্ছে।কুসুমের মা চিৎকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন।
—-
‘কুসুম!শুনতে পাও!!কি হয়েছে তোমার?বলবেনা?দেখো আমি তোমার পাশে।তোমার হাত ধরেছি।তাকাবেনা?লজ্জা পাবেনা?তোমার শরীর নড়ছে তো,বেশ দেখছি।ঠিকঠাক শ্বাস নিচ্ছো তাহলে কেন চোখ মেলে তাকাওনা কুসুম?’
কুসুমের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথাগুলো বলছিল সে।সেসময়ে মা ঢুকতে চেয়েছিলেন রুমে।ওকে আবেগী দেখে আর ঢুকলেননা।একা থাকতে দিলেন।
অর্ণব কুসুমের হাতের তালু ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,’দেখো আমাকে ভয় দেখাবেনা।আমি জানি তুমি এখনই আমার দিকে তাকাবে।ফ্যাল ফ্যাল করে।তাকাও’
এরপরেও কোনো উন্নতি হচ্ছেনা দেখে অর্ণব কুসুমের আরও কাছে এসে বসলো।ওর ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বললো,’আমি কিন্তু জুথিকে কখনও ছুঁইনি,মোট কথা জীবনে কোনো নারীকে ছোঁয়া হয়নি এমন করে।তোমায় ও ছুঁতাম না।কিন্তু তোমার চোখ বন্ধ অনেক সময় ধরে তো!যেটা আমার সহ্য হচ্ছেনা।আমার অস্বস্তি হচ্ছে।তোমার চোখ মেলাতে হবে।তার জন্য আমার মন আমাকে যে পথ দেখায় আমি সে পথেই চলবো।আমি জানি তুমি রাগ করবেনা আমার এই কাজে।দেখো এখনও সময় আছে চোখ মেলে তাকাও নাহলে যেটা ভাবছি সেটাই করে নেবো’
কুসুম চোখ মেললোনা।অর্ণব ওর মুখটা ধরে তাকিয়ে আছে।
জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে কুসুমের মুখ থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,’আমি এটা পারবোনা যাও।আমাকে দিয়ে হবেনা।তুমি চোখ মেলো।আমাকে দিয়ে এত বড় সাহসের কাজ হবেনা।এত পরীক্ষা নিওনা।দেখো আমি কত কষ্টে আছি।একবার দেখো’
সব রেখে দু মিনিট চোখ বন্ধ করে বসে ছিল সে।কুসুম যেন পাথর হয়ে গেছে।ওর এমন নিস্তব্ধ হয়ে থাকা তার গায়ে আগুনের লাভার মতন ঝরছে।
দম আটকে কুসুমের দিকে ফিরে বসলো পুনরায়।অসহায়ের মতন ওর দিকে আরও কিছু সময় তাকিয়ে থেকে মাথা এগিয়ে এনে ওর ঠোঁটের খুব কাছে গিয়ে থামলো।সিনেমায় দেখে চুমু দিলে নায়িকার জ্ঞান ফিরে।
এটা সিনেমা নয়,বাস্তব।
তবে তাই হোক।সিনেমার মতন না হোক।
কুসুমের পিঠে হাত রেখে ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো সে।
নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আস্তে আস্তে বললো,’আমায় আর একটিবার দেখো,আমি যে তোমার চোখ বন্ধ আর দেখতে পারছিনা।’
‘আমি তো ভাল আছি’
কুসুমের কথা শুনে অর্ণবের অশ্রু ঝরা থামলো।ওকে বুক থেকে সরিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
কুসুম অর্ণবের এমন হাল দেখে অবাক হয়ে আছে।কেমন অবস্থা করে রেখেছে সে নিজের সামান্য কিছু সময়ের মধ্যে, এটা দেখে সে আশ্চর্য হয়ে বসে আছে।
—-
আজ ভোরে রওনা হবে জুথি আর তার পরিবার।বাবাকে কিছু জানানো হয়নি।সারপ্রাইজ দেবে মা তাই।
এদিকে জুথি মৃদুলের চিন্তায় শেষ।সে চায়না মৃদুল জানুক।
এদিকে এয়ারপোর্টের পাশাপাশি একটা হোটেলে রুম ভাঁড়া নিয়েছে মৃদুল।কাল সকালে গিয়ে এয়ারপোর্টে বসে জুথিকে ভিডিও কল দেবে।সে চায় জুথিকে হাতেনাতে ধরতে।হবু শাশুড়ির সাথে আলাপ ও হয়ে যাবে। একটা বুদ্ধি করে আগে থেকে কল করা বন্ধ রেখেছে সে।
এদিকে জুথি ভেবেছে ও হয়ত সব ভুলে কাজে ব্যস্ত বলে আর কল করছেনা।
তার কল না করার কারণ ওর কাছে অজানা।
—-
‘তুমি জানো? আমার তো জানটাই বের হয়ে আসছিল’
‘হুম বুঝতে পারতেছি’
‘কেন এমন ভয় দেখাও বলো তো??আমি তো ভেবেছিলাম!’
‘মরে গেছি,তাই তো?’
‘না,তা কেন ভাববো?।’
কুসুম হাত বাড়িয়ে অর্ণবের চোখের পানি মুছে দিয়ে ওকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরেছে।
তখন কুসুমের মা কাঁদতে কাঁদতে আসতেছিলেন কুসুমকে একবার দেখতে।ওদের এমন অবস্থায় দেখে তিনিও চলে গেলেন অর্ণবের মায়ের মতন।ঢুকলেননা ভেতরে।
‘জানো আমি তোমায় বড্ড ভালবেসে ফেলেছি।তোমার বন্ধ চোখজোড়া আমার জানটা নিয়ে যাচ্ছিল আর একটুর জন্য।
আমার দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।তোমায় ছাড়া কিসের মাঝে ছিলাম এতক্ষণ তা যদি তুমি দেখতে।বিশ্বাস করো!!মৃন্ময়ীর বেলায় আমার এই অনুভূতি হয়নি,তাকে হারিয়ে আমার এই কষ্ট হয়নি যতটা আজ হচ্ছিল।তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমাকেই ভালবেসেছি,এর আগে কাউকে না।’
চলবে♥