লীলাবালি পর্ব-৮২+৮৩+৮৪

0
412

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮২
আফনান লারা
.
অর্ণবের মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনে কুসুম কি বলবে না বলবে ভেবে পাচ্ছিলনা প্রথমে।
মনে হলো সে বুঝি আবেগের বশে কিংবা ওর অসুখে গলে এমনটা বলছে।আজ পর্যন্ত সেসবই তো ভেবে এসেছে সে। কিন্তু আজ ওর অশ্রুসিক্ত চোখ সত্যি কথা বলছে।
ওর চোখের পানি প্রতিটি ফোঁটা বলে দিচ্ছে ওর বলা কথা সত্য, অনুভূতি সত্য!এগুলো আবেগ হতে পারে না।
কুসুম যখন ওর অনুভূতিগুলোকে সত্যি হিসেবে গ্রহণ করে নিলো তখন তার চোখের পানি অর্ণবের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে গেছে।
অর্ণব ওকে কাঁদতে মানা করার পরও সে তার কান্না বন্ধ করতে পারেনি।
কিছু সময় বাদে ভাঙ্গা গলায় কুসুম বললো,’আমি আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি নিজের অজান্তেই।আমায় মাফ করে দিয়েন,আমি আপনাকে বুঝতে পারিনি’

অর্ণব মুখে হাসি ফুটিয়ে ওর থুঁতনি টেনে দিয়ে বললো,’তুমি যে অবুঝ! ভালোবাসার কথা এতদিনে বুঝতে পেরেছো এইতো অনেক! না বুঝলে তো এখন আমার বসে বসে তোমায় বুঝাতে হতো। এমনিতেও ক’দিন ধরে কম জ্বালাওনি, খালি এক কথা… তার অসুখ বলে তার কেয়ার করি আমি। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে চড় মেরে গালের বারোটা বাজিয়ে ছাড়তে, পরে মনে পড়ে এমন সাধের গাল দীর্ঘ এক বছর ধরে লাল বর্ণ ধারণ করে থাকবে ‘

সেসময়ে অর্ণবের মা দরজার ওপাশ থেকে বললেন,’ রাজ্যের কথা বলার জন্য সারারাত পড়ে আছে। মেয়েটা না খেয়ে আছে। ওকে খাওয়াতে হবে,তুই হাত মুখ ধুয়ে আয় যা। কুসুমের মা ওকে খাইয়ে দেবে ততক্ষণে’

অর্ণব কুসুমের হাত ছেড়ে নেমে জুতা পরছিল।তখন কুুসম ওকে দেখে মিটমিট করে হাসছিল।
সেটা বুঝতে পেরে অর্ণব ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,’ তাহলে এতদিন পর আপনার নজরে পড়েছে সুন্দর বরটাকে’

‘আমি সবসময় আপনাকে দেখি, তফাৎ হলো আপনি লক্ষ করেন না কখনই। হয়তবা লক্ষ্য করেন কিন্তু জানেন না কি লক্ষ করেন।
ঠিকভাবে বলতে পারবেন আমি কাল কি রংয়ের দুল পড়েছিলাম?? ‘

‘উমমমমমম…লাল?’

‘না’

‘ নীল? গোলাপী?’

‘ আসলে আমি এক সপ্তাহ ধরে কোনো দুলই পরি না।’

কথাটা শুনে অর্ণব চোরের মতো একটা লুক নিয়ে ওইখান থেকে পালিয়ে চলে গেলো।
কুসুমের তাতে একটুও খারাপ লাগেনি। ওর অন্য কোনো দোষই তার কাছে দোষ বলে মনে হয় না কখনোই। সেই অনেক বছর আগ থেকেই অর্ণবে সকল দোষ ভুলে যাবার খাতায় রাখে।
—-
মা লোকমা তুলছিলেন আর হাসছিলেন।কুসুম প্রথমে খেয়াল করেনি।পরে মাকে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করে বসলো।

‘হাসছি কারণ জামাই তো তুই বলতে পাগল’

কুসুম অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো পাগলের কি দেখেছে মা।

‘দেখা লাগে??তোর অজ্ঞান হওয়া নিয়ে সে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলো।আমরা তোকে নিয়ে কি কান্নাকাটি করবো তার অবস্থা দেখে আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি থেকে কি হবে।খেতে না বললে সে এখনও তোর হাত ধরে বসে থাকতো।জানিস রে মা,তোর বাবা আর আমি ভেবেছিলাম অর্ণব বাবা বুঝি আর কখনও তোকে মেনে নেবেনা,কিন্তু আজকালকার দৃশ্য একেবারে আলাদা কথা বলে।সে তো তোর জন্য পাগল হতে বসলো।
আমি জানতাম তুই ওকে তোর প্রেমে ফেলতে বাধ্য করবি’

‘আমি তো কিছু করিনি’

‘তুই যেটা করিসনি সেটাতেই মুগ্ধ হয়েছে।আর কিছু করতেও হবেনা।যে পাগল হবার সে কাশি দিলেও পাগল হয়।’

কুসুমের মাথার উপর দিয়ে গেলো সব।চুপচাপ খাবারটা খেয়ে অপেক্ষা করছে অর্ণবের আসার।
ওখানে অর্ণবের মা ওকে জোর করে আটকে রেখে পেট পুরে রাতের খাবার খাওয়াচ্ছেন।দুই ছেলেকে একসাথে পেয়ে আজ রান্নার পদে এলাহি কান্ড।
যদিও মিশু রেঁধেছে সব।অর্ণবের খাওয়াতে মন ছিল না একটুও।সে বারবার ছুঁতো খুঁজছিল কুুসুমের কাছে গিয়ে বসার।কিন্তু তাকে কেউ এক বিন্দু নড়তেও দিচ্ছেনা।একের পর এক পদ এনে হাজির করছে সামনে।
টেংরা মাছ,মুরগী,চিংড়ি ভুনা।
ভাত খাওয়া শেষ হবার পর এবার খেতে লাগিয়ে দিয়েছে ফিরনি।
পেটে খিধে থাকায় সবার জোরাজুরি কাজে দিয়েছে।তাকে যা যা দিচ্ছে সেসবই সে খেয়ে ফেলছে।
ফিরনির শেষে দম ফেলে অবশেষে রেহায় মিললো তার।সোজা কুসুমের রুমের দিকে এসে ঢুকতে যাওয়া ধরতেই দেখলো দরজা বন্ধ।
আশ্চর্য হয়ে এদিক সেদিক তাকালো একবার।হঠাৎ দরজা বন্ধ করার কি কারণ তাই তো মাথা দিয়ে ঢুকছেনা।কলি দু পাশে দুটো বেনি করে নামতা পড়তে পড়তে যাচ্ছিলো।অর্ণব ওকে থামিয়ে জানতে চাইলো দরজা বন্ধ কেন।

‘বুবু তো গোসল করে’

‘তাই বলে রুমের দরজা বন্ধ রেখেছে কেন?’

‘বাহহ রে আপনি জানেন না??আপনার বাথরুমের দরজার ছিটকিনি ভেঙ্গে গেছে।আপনার আম্মা আজকে ঐখানে গোসল করতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে একেবারে ছিটকিনি ভেঙ্গে ফেলছে’

কথাটা বলে কলি ফিক করে হেসে ফেললো।অর্ণব এবার বুঝতে পারলো মেইন দরজা লাগানোর মানে।তাই সে অপেক্ষা করছে বাহিরে দাঁড়িয়েই।হঠাৎ সাগর ভাইয়া সেখানে এসে বললেন,’আমি এসেছি, কোথায় আড্ডা দিবি,তা না করে বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিস?এই মেয়েটাকে বিয়ের ভয়ে তুই তিন বছর ঘর ছাড়া ছিলি?বিশ্বাস করতে বড্ড কষ্ট লাগে’

অর্ণব মাথা চুলকে ভাইয়ার পিছু পিছু চললো।সে ভেবেছিল ভাইয়া হয়ত নিচে বাগানের দিকে যাচ্ছে।কিন্তু নাহ, যেটা নিয়ে ভয় থাকার সব সময় সেটাই ঘটে।ভাইয়া সোজা ছাদের দিকে যাচ্ছিল।অর্ণব হাত ধরে থামিয়ে তাকে যেতে মানা করেছে।সে কারণ জানতে চাইলো।
পরে শেয়ালের কথা শুনে অর্ণবকে রেখেই এক দৌড় মেরেছে সোজা বাসার ভেতর।
শেয়ালকে অর্ণব যেমন ভয় পায় তার দ্বিগুণ সাগর ভয় পায়।
মিশু সাগরকে এমন ছুটে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।
সাগর ইশারা করে বলে দিছে যেন সত্যিটা না বলে।বউয়ের সামনে ভীতু হওয়া মন্দ মানে মহামন্দ।
সারাজীবন ধরে খিলখিল করে হাসবে আর বলে বেড়াবে তার স্বামী শেয়ালে ভয় পায়।
অর্ণব এবার বুঝতে পেরেছে ভীতু হওয়া তার ভাইয়ার স্বভাব থেকে পেয়েছে।
এখন মিশু ভাবীকে তো কিছু একটা বলে বোঝাতে হবে।তাই অনেক ভেবে বললো,’ঐ আসলে আমি ভাইয়াকে দৌড়ানি দিয়েছিলাম।ভাইয়া একটা দুষ্টু কথা বলেছে তো তাই।ঐ কথাটা কি সেটা তোমায় বলতে পারবোনা।’
—-
চুলে গামছা বেঁধে বিছানাটা একটু ঝেড়ে নিচ্ছে কুসুম।বালু বালু মনে হয়েছিল।ওপার থেকে অর্ণব আর সাগরের হইহুল্লড় শুনে সে আর ওর অপেক্ষায় নেই।
এতদিন পর বড় ভাইকে পেয়েছে অর্ণব।এরকম মজা করাই স্বাভাবিক।
কুসুম ভাবলো হয়ত সে অনেক রাত পর্যন্ত ভাইয়ার সাথে গল্প করবে।
কিন্তু তখনই বিছানা করার সময় তার কাজে বাধা দিলো অর্ণব নিজে এসে।
ওর হাত থেকে বালিশ কেড়ে নিয়ে অগ্নিময় চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,’তোমায় কে বলেছে ওমন শরীর নিয়ে কাজে নামতে?ঘরে মানুষের কি অভাব পড়েছে?’

‘এই টুকুন কাজ করলে মরে যাব না’

‘মরার কথা সারাদিন বলতে থাকলে সে মানুষ সহজে মরেনা।’

কুসুম কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আপনি চান আমি মরি?’

‘সেটা কখন বললাম?’
—–
‘কিরে গালে হাত রেখে বসে আছিস কেন?মৃদুল ফোন করেছিল বুঝি?’

‘না আম্মু,সেটাই তো সমস্যা। হুট করে কেমন বরফের মতন ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।ভিডিও কল,শুধু কল তো দূরে থাক একটা মেসেজও করছেনা।তার কি হলো,বা এর কারণ কি হতে পারে সেটাই মাথায় ধরছেনা।’

‘এ তো ভাল।হয়ত সে ধরে নিয়েছে তুই দেশে ফিরবিনা তাই সে অন্য একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে’

ফ্লাইটের আর আধা ঘন্টা বাকি।জুথি ফোনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফোনটাকে উল্টে পাল্টে শেষে মৃদুলকে একটা কল দিলো।
রিং কয়েকবার হবার ওর সে রিসিভ ও করেছে।

‘হুমমম….. হ্যালো বলো’

‘ঘুমাচ্ছেন?’

‘এত রাতে আর কি করবো?একটু চিল করছি।বাসা থেকে দূরে এসেছি।তা হঠাৎ কল দেবার কারণ?’

জুথি ভাবলো মৃদুল ট্যুরে গেছে।তাই খুশি হয়ে বললো,’আপনার এমন শীতল ভাব কেমন যেন লাগছিল।কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছিলাম না’

‘এত ঢংয়ের বাক্য পেশ না করে,বলে দিলেই পারো তুমি আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো’

জুথি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একবার মায়ের মুখটা দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’মোটেও না,রাখছি।আমি শপিংয়ে এসেছি’

‘শপিংমলে মাইকে বলতেছে নেক্সট ফ্লাইট ৩০মিনিট পর?’

জুথি জিভে কামড় দিয়ে ফোনটাই রেখে দিলো।মৃদুল এত চালাক কেন!!
মা পপকর্ণ খাচ্ছিলেন।জুথির দিকে চেয়ে বললেন,’ওরে পছন্দ করিস?’

‘একদম না’

‘বড় জার্নি করার আগে মানুষ কেবল আপন মানুষকে কল করে খোঁজ নেয়।বুঝলে!তোমার আগে দুনিয়া আমি দেখেছি,আমার দেখার দিন দীর্ঘ, সুতরাং আমায় বুঝিয়ে লাভ নেই এতো।সে যাই হোক,আমার কাজ কেবল চার হাত এক করে দেওয়া’
—–
খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে দুজনে।দরজা বন্ধ হবার পরও বাহিরে থেকে মিশু ভাবীর হাসি শুনা যাচ্ছে,মায়ের সাথে কি নিয়ে যেন হাসছেন।
কুসুম তার হাতের বালা দুটোকে ধরে দেখছে চুপ করে।আর অর্ণব ওর শাড়ীর আঁচলে গিট্টু বাঁধতে ব্যস্ত।

‘আচ্ছা যদি বলি আমার থেকে কিছু চাও।তুমি কি চাইবে?’

‘কেন দেবেন? ‘

‘কিছু দিতে মন চাইলো তাই’

‘সত্যি দেবেন?’

‘হুমমম।বলে দেখোইনা’

‘আমি যদি মারা যাই তবে ঐ জবা ফুলগাছটার তলায় আমার কবর দিবেন?’

কুসুমের মুখ থেকে এই কথা শুনে অর্ণবের ভীষণ রাগ হলে।হনহনিয়ে চলে গেলো বিছানা ছেড়ে সোজা বারান্দায়।কুসুম জানতোনা ও এমন রাগ করবে।সে ভাবলো, হয়ত সামান্য বকা দিয়ে দেবে। কিন্তু এ দেখি একটু বেশি হয়ে গেলো।

ঢোক গিলে ওর পিছে এসে কুসুম দাঁড়িয়েছে প্রায় অনেক সময় হলো।অর্ণব গ্রিলে হাত রেখে বাসার সামনের জায়গাটার দিকে চেয়ে ছিল।
কুসুম এক পা, একা পা করে এগোচ্ছে।শেষ পর্যন্ত ওর পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে বললো,’শরি’

‘ওটা সরি হবে,কে শেখালো?’

‘মিশু ভাবী’

অর্ণব আবার চুপ।কুসুম ওর পাঞ্জাবির একটু খানি ধরে সে নিজেও মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে।
অর্ণব টের পেয়েও কিছু বলেনি।

‘কথা বলবেন না তাহলে?’

‘না’

“”না “”””টা ঠিক করে বলতে পারেনি অর্ণব।কুসুম ওর বুকের মধ্যে নিজের সবটা জায়গা করে নিয়েছে তার আগেই।পাঞ্জাবিতে মুখ ডুবিয়ে ফেললো একেবারে।এমন ভাবে ধরলো যেন সে দম ফেলতে মুখটা উপরে তুলতে হবে।অর্ণব নিমিষেই গলে যাবার পরেও ওকে একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত ভেবে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কুসুম ওর বুকে নাকটা ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,’দেখি আজ আপনার রাগ কতকাল থাকে’
চলবে♥

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮৩
আফনান লারা
.
কুসুমের চুল থেকে একটা ঘ্রাণ আসছিল। তার ভাল করে জানা আছে এ কোনো শ্যাম্পুর ঘ্রাণ হতে পারেনা,এটা কুসুমের গায়ের নিজস্ব ঘ্রাণ যেটা কিনা ওর চুলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।প্রস্তুত হয়ে গেছে নোশা জাগাতে।
নেশা লেগেও গেলো বলে।
অর্ণব মুখটা এগিয়ে ওর চুলে ডুবিয়েছে।এ প্রথম কুসুমকে এমন করে ছোঁয়া,এমন করে তাকে কাছে টেনে নেওয়া,এক আলাদা অনুভূতি।
রাগ,ক্ষোভগুলো এতদিন এই অনুভূতি নিতে দেয়নি।দূরে ঠেলে রেখেছিল।
কুুসুমের চুল ভেজা ছিল বলে সেই ভেজা চুল অর্ণবের মুখটাকে ভিজিয়ে দিয়েছে।সেটা বুঝতে পেরে ওর চুল থেকে মুখ তুলে এবার তার শাড়ীতে মুখ মুছে নিলো সে।
কুসুম তাও ওর পঞ্জাবি ছাড়েনি।তার ধারণা অর্ণবের রাগ যাবেনা,আর তাই এখন একমাত্র উদ্দেশ্য রাগ ধুয়ে মুছে যাওয়া অবধি ধরে রাখবে।
শেয়ালের ডাকটা তীব্র আওয়াজে শোনা গেলো,অর্ণব ভয় পেয়ে পিছোতে গিয়েও পারেনি।কুসুম যে ওকে আঁটশাঁট করে ধরেছে আজ।ছাড়বেনা বলেই ধরেছে।ওর ধরে রাখায় ভয়টা কমলো বলতে একেবারে গায়েবই হয়ে গেছে।
অনেকটা সময় কেটে যাবার পরও যখন অর্ণব খেয়াল করলো ও ছাড়ছেনা কিছুতেই তখন সে বুদ্ধি করে তাকে কোলেই তুলে নিয়েছে।এবার দুহাত ছেড়ে দিয়েছে কুসুম।
কোলে নিয়ে নেবে এটা তার ভাবনার বাহিরে ছিল।হা করে সে ওর মুখের দিকেই চেয়ে আছে এখন।
অর্ণবের ঠোঁটের কোণায় কিঞ্চিত হাসি ভাসমান।তার হাসি বলে দিচ্ছে ও জিতেছে আর কুসুম হেরেছে।

‘তোমার ওজন কম মনে হয়,রাতে খেয়েছিলে ঠিকমত?’

‘হাতের বালা,আর গলার হারটা খুলে রেখেছি সেজন্যে’

‘হাসালে!ওগুলোর আবার ওজন আছে নাকি বোকা!’

‘আমি চাইনা আমাকে কেউ শুকনা বলুক।অপছন্দ’

‘কেন অপছন্দ?’

‘আমি জানি আমি সুন্দর,আমার চেহারা মাশাল্লাহ এটাও জানি,আর আমার চুল ও সুন্দর,ঠোঁট তো একেবারে গোলাপি জবার মতন’

অর্ণব কুসুমকে বিছানায় রেখে কপাল কুঁচকে বললো ‘এসব কে বলেছে তোমায়?এসব তো…’

‘এসব তো আপনার কথা তাই না?’

অর্ণব গলা ঝেড়ে কাশলো তারপর পাশে বসে চুপ করে থাকলো।কোনো উত্তর দিলো না।কারণ এটাই সত্যি

‘রাতে ঘুমিয়ে থেকে বিড়বিড় করে একদিন এসবই বলছিলেন।হুমমম আমি কিন্তু শুনেছি সব।’

‘ভাল করেছো।আর কিছু শুনোনি?’

‘শুনেছি।বলেছেন আমার ঠোঁটের স্বাদ নেই,বেরসিক।আপনি কি তবে?’

অর্ণব লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।পাঞ্জাবি ধরে গায়ে ফুঁ দিতে দিতে ছুটে চলে গেছে রুমের বাহিরে।কুসুম ওর চলে যাওয়া দেখে ভাবলো কথাটা সত্যি নাকি মিথ্যা ছিল।

রুম থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে যেতেই ধাক্কা লেগে গেলো সাগর ভাইয়ার সাথে।ভাইয়া সেসময়ে পানির জগ হাতে এখান দিয়ে যাচ্ছিল।

‘কিরে!এত রাতে ভাগছিস কেন?কে ছুটাচ্ছে?’

‘না মানে…’

‘কুসুমের থেকে পালাচ্ছিস?একবার বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করস তো আবার ছুটে পালাস।তোর কি হলো বল তো?কোনো টিপস লাগবে?’

‘না না।আমি তো হাঁটাহাঁটি করছিলাম।রাতে ৪০কদম হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য বেস্ট।’

সাগর ওর ঘাঁড়ে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে বললো,’আমি অবুঝ না রে ভাই আমার।পালিয়ে বেড়ানোর ছুটা আর হাঁটাহাঁটির ছুটার তফাৎ আমার জানা আছে বুঝলি!!নতুন বর তো।এখন রাতে ছুটবা,দিনে ছুটবা।সারাদিন ছোটার মধ্যে থাকবা।এই সময় পার করে এসেছি হুহ!’

অর্ণব মনে হয় লজ্জা পেতে পেতে এবার বসেই পড়বে নিচে।ভাইয়া যে লজ্জা দিচ্ছে একের পর এক,তাতে করে দাঁড়িয়ে থাকাও সহজ বলে মনে হচ্ছেনা।মন চায় বাসা ছেড়ে পালিয়ে যেতে।
অর্ণব আসছেনা দেখে কুসুম ও এসে হাজির হলো ওখানে।সেখানে সাগর ভাইয়াকে আচমকা দেখে সে দরজার সাথে লেগে মাথা বাঁকিয়ে বললো,’ভাইয়া আপনি এখানে?’

‘পানি নিতে এলাম।তোমার বরকে নিয়ে যাও।নাইট ওয়াকে বের হয়েছেন উনি।বাসায় রাতের বেলা ঘোরাঘুরি করছে।বাবা দেখলে পিঠের মাঝখানে কিল বসিয়ে বলবে,,’চোর”

কুসুম মুখে হাত দিয়ে হাসিটাকে আটকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়েছে।
অর্ণব গাল ফুলিয়ে রুমের ভেতর চলে এসে দরজাও লাগিয়ে দিলো।কুসুমের হাসি আর আটকে রইলোনা।বের হয়ে গেছে খিলখিলিয়ে হাসি।অর্ণব সব সময়কার মতন ওর গাল টিপে ধরে বললো,’কি?খুব হাসি পাচ্ছে?’

‘একদম না’

‘তাহলে কি?’

‘আপনার দুঃখে দুঃখিত’

মুখ ছেড়ে কান টেনে অর্ণব ওকে বিছানার কাছে নিয়ে এসে বললো,’ঘুমাও।অনেক জ্বালাও তুমি।যেন আমার শত্রু!আমাকে কেউ খোঁচ মারলে তাকে দাঁত কেলাতে হবে।এত হাসি তার যে মুখে হাত দেওায়া লাগে।আর একদিন খালি ওমন দাঁত কেলিয়ে দেখাও।গালের সাথে নাকটাও টিপে ধরবো।সবাই দেখে বলবে সর্দি হয়েছে’
—-
সকালে সিঙ্গাপুরের বিমানটি বাংলাদেশে এসে পৌঁছে ছে।
ব্যাগ সব বুঝে নিয়ে জুথি এগিয়ে চললো।মা তো একবার এক জায়গা অনেক সময় ধরে দেখে যাচ্ছেন।কতগুলো বছর পর আসলেন।নানু চশমা খুলে মায়ের মতন করে সব দেখছেন আর অবাক হচ্ছেন।তার কিন্তু এই প্রথমবার বাংলাদেশে আসা।

‘আমায় দেন,আমি বয়ে নিয়ে যাই’

একদম সামনে আচমকা একটা লোককে দেখে জুথি থেমে গিয়েছিল।লোকটা ওর হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিয়ে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,’আরে আন্টি!!কেমন আছেন?’

‘ভাল,তোমায় তো ঠিক!’

‘আরে আমি মিরাজ,আপনি হয়ত চিনবেননা।মৃন্ময়ী চিনে।তাই না?’

‘মিরাজ ভাইয়া আপনি?আপনার দাঁড়ি এত বড় হলো কবে?আর টুপি এমন করে পরেছেন কেন?ভাল করে চেহারাই তো দেখতে পারছিনা,কণ্ঠ টাও কেমন বেসুরে বেসুরে।মনেই হচ্ছেনা আপনি মিরাজ ভাইয়া’

‘কতদিন পর আসলে।চিনবে কি করে?চলো যাই,অনেক দেরি হয়ে গেলো’

মা জুথির দিকে চেয়ে ফিসফিস করে বললো,’কোন মিরাজ?’

‘আমাদের বাসার উপরের তলায় যে থাকে,পিন্টু আঙ্কেল?ঐ পরিবারের ছোট ছেলে মিরাজ ভাইয়া’

‘আচ্ছা বাবা তুমি জানলে কি করে যে আমরা আজ ফিরছি?’

‘বাহ রে!আন্টি আপনার আম্মু তো ফেসবুকে পোস্ট দিলো।ট্রেভেলিং টু বাংলাদেশ।তার সাথে তো আমার এড আছে’

জুথির নানু জিভে কামড় দিয়ে সানগ্লাস্টা ভাল করে পরে নিছেন।জুথি কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’নানু চৌদ্দ গুষ্টিকে জানাবে আজ আমরা বাংলাদেশে এসেছি’

এয়ারপোর্ট থেকে জুথিদের বাসা অনেকদূর না।তাই কিছুদূর হাঁটার পর তারা সিএনজি নিলো।
এখন সমস্যা হলো আম্মু আর নানু উঠার পর আর ব্যাগপত্র নেওয়ার পর সিএনজিতে জুথির জায়গা হচ্ছিলনা।

‘আরেহ আন্টি যেখানে মিরাজ সেখানে হবেনা কেউ নারাজ!
আমি আছিনা?জুথিকে নিয়ে আমি অন্য একটা সিএনজিতে আসতেছি।আপনারা যান,টাটা’

তারা চলেও গেলো।এদিকে জুথি বারবার মিরাজের মুখটা দেখার চেষ্টা করছে।মিরাজ ততই ক্যাপ দিয়ে মুখটা ঢাকছে।সিএনজি ধরিয়ে সে ভেতরে ঢুকে গেলো।জুথি সন্দেহের চোখে তাকাতে তাকাতে সেও বসলো পাশে।মাঝে আরও একজনের জায়গার মতন খালি রেখেছে সে।
জ্যামে পরার পর জুথি খেয়াল করলো মিরাজ আস্তে আস্তে কাছে আসছে।

‘এ্যাই আপনি সত্যি মিরাজ ভাইয়া?’

‘জুথি তুমি আমায় চিনলেনা?এত সন্দেহ?’

‘মিরাজ ভাইয়ার হাইট অনেক কম।আর আপনি তো দেখি বিশাল লম্বা।সন্দেহ না করে উপায় আছে?’

‘তুমি তো অনেকদিন আমায় দেখোনি।আয়ুর্বেদ খেয়ে দুই ফুট উচ্চতা বাড়িয়েছি।পছন্দ হচ্ছে আমায়?’

‘আপনাকে আমি আগেও পছন্দ করতাম না।এখনও করিনা।
আর আপনি এমন কাছের দিকে আসতেছেন কেন?দূরে যান।’

মিরাজ ক্যাপটা আরেকটু টেনে হাত নিয়ে জুথির পিঠের পেছনে রেখেছে।জুথি নড়ে বসে আড় চোখে তাকালো।
সন্দেহ খুব গাঢ় হচ্ছে।কে হতে পারে এটা?
চলবে♥

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮৪
আফনান লারা
.
পাসপোর্ট রেডি হয়ে আসতে কত দিন যে লেগে যাবে।কিন্তু কুসুমের হাবভাবে মনে হয় সে মোটামুটি সুস্থ।
এটা অবশ্য বাকি সকলের ধারণা।অর্ণব তো নিজের অবুঝ মনকে শান্ত করেছে কেবল এই ভুল ধারণটাকে আঁকড়ে।
আয়নার সামনে কুসুম সকালবেলায় যখন চুল আঁচড়াচ্ছিল তখন গাছের শুকনো পাতার মতন সব ঝরে পড়ছিল।মনে হয় মাথায় আজ আর চুল থাকবেনা,তাও জেদ করে সে জট ছাড়া অবধি আঁচড়ে গেলো।এখন এমন হাল হয়েছে যে মাথায় মুঠো করে ধরার মতন চুল আর নেই।
মেঝেতে পড়ে থাকা সুন্দর,ঝকঝকে কোঁকড়া চুলগুলোর দিকে সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল।ছোট থেকে কত মায়া তার এই চুলের প্রতি,জীবনের একটা সময়ে এসে নিজের সবচাইতে দামি বস্তু,মানুষকে হারাতে হয়।হারাতে দিতে বাধ্য হতে হয়।
এই চুলগুলোর সাথে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে,সব সিনেমার পর্দার মতন চোখের সামনে ভাসছে।
নিচে বসে চুলগুলোকে সে তুলে নিলো।নিজের গয়না রাখার কৌটোটা খুঁজে সেটাতে পুরে রেখে দিয়েছে সব।বাহিরের রুম থেকে সবার হাসির আওয়াজ শোনা যায়।কুসুম একটু সুস্থ হলেই পরিবারের সবাই মেতে ওঠে আনন্দে।কে জানে এই রোগ কত শক্তিশালী!
কুসুম জানে।তার দেহের পরিবর্তন সে দেখে।সকাল থেকে হাতে গোনা তিনবার বমি করা হয়েছে।কেউ দেখেনি।কুসুম জানে।তার মাথার চুল সব ঝরে গেছে কেউ হয়ত এখন পর্যন্ত জানেনি।কিন্তু কুসুম জানে।
মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে একটা খাতা নিলো হাতে।আজ তার পরীক্ষা। অর্ণবের শেখানো অক্ষরগুলোকে বাক্যে রুপান্তরিত করবে সে।এরপর বাক্যগুলোকে সাজিয়ে একটা চিঠি লিখবে,অর্ণবের কাছে।
এখন তো বেশি আপন বলতে ঐ মানুষটাই আছে।জীবনটাও তো বেইমানি করলো।কে জানে আর কত সময় আছে হাতে।
‘থাকি আর না থাকি তাঁর জন্য কিছু লেখা উচিত।আমার অনুপস্থিতিতে তার পাশে থাকবে এই চিঠি।’
—–
অর্ণব সাগরের সাথে বাজারে গেছে।ভাল কিছু কেনাকাটা করবে।দুপুরের খাবার জমজমাট হওয়ার কথা।মৃদুলদের আজ দাওয়াত করেছে মা।তাই সাগরের সাথে তাকে যেতেই হতো,অবশ্য যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না তার।
ভাইয়ার জোরাজুরিতে বাহিরে পা ফেলতেই হলো।এদিকে বাজারে সে এসেছে কিন্তু মনের সব চিন্তাভাবনা রেখে এসেছে কুসুম যে রুমে থাকে সে রুমে।
তাজা মাছ,তাজা তরকারি ভর্তি ব্যাগ নিয়ে যখন সে ফিরছিল তখন সে দেখতে পেলো একটা দৃশ্য।একটি দোকানের দৃশ্য।
ভাইয়ার হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে থেমে দেখতে লাগলো সেই দৃশ্যখানা।

চিঠি লিখতে অনেক কষ্ট হয়েছে কুসুমের।নিজের কাঁচা হাতের লেখায় সব কিছু লেখা সম্ভব হচ্ছিলো না বলে কলিকে একবার ডেকেছিল।পুরো চিঠিতে কি কি লেখা আছে তা কলি জানেনা।কারণ কেবল শেষের দিকেই ওকে ডেকেছিল কুসুম।শুরুর দিকের কিছুই তাকে পড়তে দেয়নি সে।হাত দিয়ে চেপে ঢেকে রেখেছিল।
চিঠিটাকে তার উপর্যুক্ত জায়গায় রেখে বারান্দায় বসে পা দোলাচ্ছে সে এখন।
আচমকা চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেলো।পেছন থেকে কেউ একজন কাপড়ের টুকরো দিয়ে ওর চোখজোড়াকে বন্দী করে দিয়েছে।হাতের স্পর্শ বলে দিলো এটা অর্ণব।তাই বেশি হাতাহাতি করেনি সে।চুপ করে রইলো।
অর্ণব কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’একটা জিনিস দেবো,চাইতে বলেছিলাম উত্তরে বলেছিলে কবরের কথা।আর তাই নিজ থেকেই নিয়ে আসলাম উপহার’

‘কই দেখি’

‘উহু।অপেক্ষার ফল মিষ্টি’

কথাটা বলে অর্ণব ওর হাত ধরে দাঁড় করালো।টেনে নিয়ে গেলো রুমের দিকে।কুসুমের হাত নিয়ে একটা জায়গায় রাখলো,ওকে আন্দাজ করতে বলতে বললো এটা কি।
সে দুহাত দিয়ে ধরেও কিছু আন্দাজ করতে পারেনি শেষে অর্ণব ওর চোখের বাঁধনটি খুলেই দিলো।
চোখ ডলে কুসুম চেয়ে দেখলো তার সামনে একটা দোলনা। পাটের দড়ি দিয়ে বানানো।দোলানটা লাগানো হয়েছে ছাদের সাথে।সেখানে বাঁধা রড ছিল আগে থেকেই।
কুসুমের বিশ্বাস হচ্ছিলো না এগুলো।অর্ণব এত অল্প সময়ে এসব কি করে করলো,পাশেই সে ছিল অথচ কিছুই টের পেলোনা!

অর্ণব হাত ভাঁজ করে বললো,’আমি আন্টির থেকে শুনেছি,তোমার নাকি দোলনায় দোলার অনেক শখ।তোমাদের বাড়ির পাশের বটগাছটার কাছে গিয়ে নাকি দোলনা বানানোর চেষ্টায় ঘন্টার পর ঘন্টা নষ্ট করতে।তাই তোমার এই ইচ্ছেটা আমি জানা মূহুর্তেই পূরণ করে দিলাম’

কথাটা বলে সে ওকে ধরে দোলনায় বসিয়ে দিয়ে ঘুরিয়ে দিলো।কুসুম হাসছে মন খুলে।এটা সত্যি যে দোলনাতে দোলা তার অনেক ইচ্ছে ছিল।চেয়েও সম্ভব হচ্ছিলো না।দোলনা বানাতে দুটো গাছ কাছাকাছি হতে হয়।কিন্তু তাদের বাড়ির আশেপাশের সব গাছ একটা থেকে আরেকটা অনেক দূরে দূরে।
একটাই উপায় ছিল সেটা হলো বটগাছের মোটা ঢাল।কিন্তু সেটা অনেক উঁচুতে থাকায় ওখানেও দোলনা বানানো হয়ে উঠলোনা তার।আর আজ ইচ্ছেটা হুট করে পূর্ণতা পেলো।

কুসুমের হাসি দেখে অর্ণবের খুব ভাল লাগলো।কাজটা করে স্বার্থকতা পেয়েছে এর চেয়ে বেশি আর পাওনা নেই।
কলি দূর থেকে দোলনা দেখে ছুটে এসে বললো সেও দুলবে।কুসুম তাই উঠে ওকে বসতে দিলো।
—-
জুথিদের বাসার সামনে ব্যাগপত্র সব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর আম্মু আর নানু।জুথির অপেক্ষা করছেন।বারান্দাতে মুখে ব্রাশ ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ফরহাদ।চোখ বন্ধ করে সকালের হাওয়া নিচ্ছিল।সিএনজির আওয়াজ শুনতে পেয়ে বাম চোখ খুলে তাকালো নিচে।
নিচে নিজের মা আর নানুকে দেখে প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি।আবারও চোখ বুজে ধ্যানে মগ্ন হলো।
জুথির আম্মু ওর নানুকে বললেন ফেসবুকে আপাতত কোনো পোস্ট না করতে।জুথি যেহেতু এটা পছন্দ করেনা তাই এটা বন্ধই থাকুক।
মায়ের গলা শুনে এবার ফরহাদ নিশ্চিত হলো নিচে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা এই মহিলা তার নিজের মা।
মুখের ব্রাশ ফেলে এক ছুট লাগালো দরজার দিকো।বাবা রান্নাঘরে পাউরুটিতে জেলি লাগাচ্ছিলেন।ওকে এমন ছুটতে দেখে অবাক হলেন না।কারণ আইস্ক্রিমের ভ্রাম্যমাণ দোকান দেখলে সে এমন ছোটে।এটা তার জানা আছে।
ফরহাদ দরজা খুলে ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেছে।মা তো আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু দিলেন ওর সারা মুখে।এদিকে নানু ও জড়িয়ে ধরেছেন ওকে।
তবে কেউ কোনো আওয়াজ করেনি বলে করিমের কানে কথা যায়নি এখনও।জুথি ও এসে পড়েছে।সিএনজি থেকে নেমে ফরহাদকে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো সেদিকে।তার পিছু পিছু মিরাজ ও আসছে।
জুথিকে দেখে মা ভেতরের দিকে গেলেন।ওর বাবা দরজার কাছে এসে ফরহাদকে ডাকতে যেয়ে দেখলেন নিজের স্ত্রীকে।প্রথমে তিনিও সারপ্রাইজড্ হয়ে গেছিলেন,পরে সব সত্য বুঝতে পেরে আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়লেন।
হট্টগোলের মাঝে জুথি আর নানু,মিরাজ বাসায় ঢুকেছে।জুথি ঘাঁড়ে হাত রেখে বারবার চাপছিল।তার ঘাঁড় প্রচণ্ড ব্যাথা করছে।চাপতে চাপতে নিজের রুমে এসে দরজাটা লাগাতে গিয়ে দেখলো মিরাজ ও ঢুকে পড়েছে।এবং ওর আগেই সে ছিটকিনি লাগিয়েও ফেলেছে।

‘আশ্চর্য! মিরাজ ভাইয়া এটা কোন ধরনের ব্যবহার?দরজা লাগালেন কেন?সরুন!আমি কিন্তু বাবাকে ডাক দিবো,বাবা!!’

জুথি আর কিছু বলতে পারেনি,সামনের মানুষটা ওর মুখ চেপে ধরে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে ধরেছে ওকে।
চোখ দিয়ে জুথি ওনাকে গিলে খাচ্ছে এখন।তাকে এক হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে মাথার কালো ক্যাপটা খুললো মিরাজ নামের ছেলেটা।চোখ দেখে জুথির নড়াচড়া বন্ধ হয়েছে।
এটা তো মৃদুল!!!
মৃদুল তার গালের নকল দাঁড়িটাও খুলে ফেলেছে।জুথি ওকে চিনতে পেরে চোখ বড় করে শুধু তাকিয়ে দেখছে

‘কি?চিল্লাও।ডাকো তোমার বাবাকে।কেমন ঝটকা দিলাম?আমাকে না জানিয়ে দেশে ফিরার সাহস হলো কি করে তোমার সেটাই ভাবতেছি।আমি মরিয়া হয়ে ছিলাম একটিবার তাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য।আর তিনি কোনো রেস্পন্স তো করেইনি উল্টো দেশে ফিরবে বলে আমাকে জানানোর সব ওয়ে বন্ধ রেখেছে।কি ভাবো নিজেকে?তুমি একাই চালাক?
আমিও যে চালাক তার প্রমাণ দিলাম।আর প্রমাণ লাগবে?? কতটুকু ভালবাসি সেটার???’

মৃদুল ওর মুখ থেকে হাত সরালো এবার।জুথি ঘাঁড়ে হাত দিয়ে সরতে যেতেই ও হাত দেয়ালে রেখে বললো,’কথা বলতে বলেছি।সরে যেতে বলিনি’

‘এতক্ষণ দরজা বন্ধ করে রাখলে সবাই সন্দেহ করবে।কি চাইছেন টা কি আপনি?’

‘তোমাকে চাই’

‘পাবেন না।আন্সার পেয়েছেন?এবার যান’

‘তোমার “”না”” তে আমি হাজারটা সম্মতি দেখি।বলো কেন!!কেন এমন হয়?’

‘আপনি যাবেন নাকি বাবাকে ডাকবো?’

মৃদুল এবার বাকি হাতটাও দেয়ালে রাখলো তারপর মুখটা একটু এগিয়ে বললো,’কতটাদিন পর এই পারফিউমের গন্ধ পেলাম।প্রাণভরে নিতে তো দিবা!!তুমি বাসোনা বুঝতেছি,আমি তো বাসি!আমাকে আমার অধিকার টা তো নিয়ে নিতে দিবা।সেটাতেও কিপটামি করো।টাকা যাচ্ছে তোমার?কি যাচ্ছে হুম?বলো!’

‘আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড?নাকি হাসবেন্ড?দু হাত দুপাশে রেখে এমন কাছে এসে কি বোঝাতে চাইছেন?’

‘আচ্ছা তুমি বলে দাও এমন একটা মোমেন্টে আমি ঠিক কি বোঝাতে চাইতেছি?
বলো!!’বলো না!’

জুথি দেয়ালের সাথে লেগে গেছে।আস্তে করে বললো,’আর একটু কাছে আসলে আমার ড্রেসে লেগে থাকা সেফটিপিন ঢুকিয়ে দিব আপনার বুকে।চিনেননা আমাকে’

‘ দাও!তোমার আঘাত পেলে আমার রোমান্টিকতা আরও বেড়ে যাবে’

চলবে♥