#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৯০
আফনান লারা
.
কুসুম চলে গেছে এই তো ২দিন শেষ হয়ে ৩দিনে পা রাখলো ।তার চেনাপরিচিত সেই রুমটি যেটাতে কিনা দোলনা দুলতো সেটা এখন আর দোলেনা,বাতাসেও দোলেনা।কারণ বারান্দার পর্দা মেঝে ছুঁই ছুঁই করে টানানো।কোনো আলো আসতে দেওয়া যাবেনা,আলোর সাথে অর্ণবের শত্রুতা জন্মেছে।তার থাকা এখন মেঝেতেই।
পানির এক ফোঁটা পানিও তার খাওয়া হয়নি কুসুম চলে যাবার পর থেকে।কেউ খাওয়াতে পারেনি।মৃদুল চেষ্টা করে মার খেয়েছে ওর হাতে।
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর।গরমে ভীষণ কষ্ট হয় কিন্তু যার মনের ভেতরে কষ্ট পুরে আছে তার আবার অন্য কিছু কষ্টের কিসের ভয়?
আজ কটাদিন পর উঠে দাঁড়ালো সে।ঠিকমত দাঁড়ানোটাই অবাক করা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।শেষবার কুসুম বিছানায় শুয়ে যেমন এলোমেলো করে রেখেছিল বিছানাটা এখনও সেরকম হয়ে আছে।কেউ হাত লাগায়নি,কাউকে ধরতে দেয়নি অর্ণব।কুসুমের গায়ের গন্ধ তীব্র করে ভাসছে গোটা রুমটায়।
বারান্দার কাছে গিয়ে টান দিয়ে পর্দা খুলে ফেললো অর্ণব।বাহিরে বাতাস বইছিল খুব জোরে।বাতাসে দোলনাটা দুলছে এখন।অর্ণব সেটার দিকে চেয়ে হাসতে চাইলো,ঠোঁট ফাটা বলে হাসিটাকে পূর্ণতা দিতে পারেনি।
তার ধারণা দোলনায় কুসুম বসে দুলছে।।এগিয়ে দোলনাটাকে ছুঁতে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে গেলো হঠাৎ।ড্রেসিং টেবিলের সঙ্গে হাতে চোট পেয়ে বসে আছে সে।হাতটাকে দুবার ঝেড়ে ড্রয়ারটা খুললো ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ নিতে।কুসুম একবার এখানে থাকা সব ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজে কালি দিয়ে ফুল,পাতা এঁকেছিল।সেখান থেকে একটা ব্যান্ডেজ নিয়ে হাতে লাগালো সে।তারপর সবগুলো ব্যান্ডেজ হাতে নিয়ে দেখার জন্য ড্রয়ার হাতাতেই হাতে এসে গেলো কুসুমের লেখা সেই চিঠিটা।
ব্যান্ডেজগুলো রেখে চিঠিটাকে মেলে ধরেছে সে।চোখ প্রচণ্ড ঝাপসা।লেখাগুলো দেখতেই পারছেনা সে।চিঠি রেখে দেয়ালে হাত রেখে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকলো।ভেসিনে মুখটা ধুয়ে পাঞ্জাবি দিয়ে মুছতে গিয়ে বুকের ভেতরটা খালি হয়ে গেলো আবারও।মুখ ধুয়ে সবসময় কুসুমের আঁচলে তার মুখ মোছা হতো।এই মূহুর্তে নিজেকে অসহায় মনে হলো ভীষণ ভাবে।চোখে পানি এসে গেলো।চোখটাকে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে মেঝেতে আবারও বসেছে সে।চিঠিটাকে খুললো কাঁদতে কাঁদতে
——-
“চিঠি কি করে লেখে আমাকে তো শেখাননি।তবে চিঠি মানেই তো মনের ভাব প্রকাশ। আমি তাই করছি।চিঠি ধরে নিয়েন বরং।
হাতের লেখা ভাল না জানি। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যেতো।কিন্তু সময় পেলাম কৈ?শেষের গুলো কলিকে দিয়ে লেখাবো।হাতের লেখা আলাদা বলে আবার সংশয় নিয়ে থাকিয়েননা।
আমি জানি আপনি যখন চিঠিটা পড়ছেন তখন আমি আপনার পাশে নেই।বলতে গেলে দুনিয়াতেই নেই।আপনি কাঁদছেন।খাচ্ছেন না কিছু।তাহলে শুনুন আমি কষ্ট পাচ্ছি আপনি খাচ্ছেন না বলে।গিয়ে মুখে কিছু দেন।আমাকে আর কষ্ট দিয়েন না।
আমি জানি আপনি আমায় ভীষণ ভালবাসেন,কিন্তু এই ভালবাসার ঘড়া আমাকে দিয়ে পূ্রণ হতোনা,এটা পূর্ণ করার লোক আছে।তাকে আপনি পেয়েওছিলেন।কিন্তু আমার বোকামির কারণে হারালেন।আমি জানি মিননয়ি আপু আপনাকে আজও ভালবাসে,মৃদুল ভাইয়াও তাকে ভালবাসে এটা ঠিক হতে পারে কিন্তু মিননয়ি আপু কেবল আপনাকেই বাসে।আগেও বাসতো।আপনার সারাজীবনের সাথী হবার যোগ্যতা উনারই ছিল,এবং আছে।
আপনি হয়ত আমার এই কথা নিয়ে রাগ করবেন আমার উপর কিন্তু এটাই সত্যি।আপনি যদি ভাল থাকেন তবে আমি ভাল থাকবো।আর আপনার ভালথাকা জুড়ে আছে মিননয়ি আপুর সাথে।তিনি আপনাকে ভাল রাখবেন।আমি নিশ্চিত সেটা নিয়ে। জোরাজুরি করছিনা।সবটাই আপনার ইচ্ছা।কিন্তু আমার ইচ্ছা যদি জানতে চান তবে এটাই বলবো।
আমিও কিন্তু আপনাকে ভালবেসেছি।সবসময় বাসতাম কিন্তু আমার আয়ু দিলো না বাসতে।আমার বাসার পূর্ণতা মিননয়ি আপুকে দিয়ে পাবেন।আচ্ছা একটা কথা বলি, তাকে বিয়ের পর একটা কাজ কখনওই করবেননা।আর তা হলো তার আঁচলে মুখ মুছবেননা।এটার অধিকার কেবল আমার ছিল।আর আপনার মায়ের ও আছে কিনা জানিনা।কিন্তু এই অধিকার আপনি আর কাউকে দেবেননা।আমার আঁচলে যখন মুখ মুছতেন আমার অনেক ভাল লাগতো,আমার কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে যেতো।আর বাকিসব করতে পারবেন,আমার আপত্তি নেই।আমার আর কিছুই বলার নেই।অনেক কিছু আছে বলার কিন্তু মনে পড়েনা।ভাবতে গেলে মাথা ধরে।ভাবনার বাহিরে যতটুকু ছিল সবটা লিখেছি।আর বলার নেই।
ইতি
আপনার লীলাবালি
অর্ণব কাগজটাকে মুড়িয়ে ছুঁড়ে মারলো বাহিরের দিকে।তারপর উঠে আবারও সব পর্দা টেনে দিয়ে বসে গেলো মেঝেতে।কাগজের টুকরোটা অর্ণবের বাবা তুললেন।মেলে পুরোটা পড়ে চুপচাপ চলে গেলেন ওর মায়ের কাছে।চিঠিতে লেখা সব সবাই জেনে গেছে।সবাই নিরব এখন।অর্ণবের বাবা নিরবতা ভেঙে বললেন,’অর্ণব মুখে দিয়েছে কিছু?’
মিশু ভাবী”” না””” বললো।
অর্ণবের মা চিঠিটাকে দেখে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,’কুসুমের ইচ্ছা যথাযথ সঠিক কিন্তু অর্ণব কখনওই মানবেনা’
বাবা বললেন,’অর্ণব আর একদিন না খেয়ে থাকলে মরে যাবে,আমরা ওরে বাঁচাতেই পারবোনা।এভাবে তো চলতে পারেনা’
‘দুইদিন হলো মেয়েটা চলে গেছে।এখনই এসব বলবে?অন্তত পরিস্থিতি বুঝে কথা বলবেন।কুসুমকে অর্ণব অনেক ভালোবাসে।ও রাজি তো হবেই না উল্টে রাগ করে হাত উঠাবে,যেমনটা কাল মৃদুলের সাথে করেছিল।তখন কি হবে?’
মিশু ভাবী সোফায় বসে নিচু স্বরে বললো,’আমার মনে হয় জুথিকে ডাকা উচিত এখানে।ও এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে’
অর্ণবের বাবা মাথা নাড়িয়ে বললেন,’আমরা শুধু অর্ণবের কথা ভাবছি।জুথি মেয়েটা জীবনেও রাজি হবেনা।হয়ত সে এখন আর অর্ণবকে চায় ও না।একটা কুমারী মেয়ে কেন বিবাহিত ছেলে বিয়ে করতে চাইবে? ‘
মিশু কথাটার বিরুদ্ধে গিয়ে বললো,’বাবা ভালবাসার কোনো সীমা নেই।অর্ণব যদি দশটা বাচ্চার বাবা ও হয়ে থাকে ওকে ভালবেসে থাকলে জুথি নিশ্চয় রাজি হবে।আর এই মূহুর্তে অর্ণবের কারোর সঙ্গ প্রয়োজন।ওর খাওয়া দাওয়ার দিকে নজর নেই,শরীর খারাপের কারণে রুম থেকে বের ও হতে পারছেনা।’
বাবা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,’সেই ভাল।আমি একবার চেষ্টা করে দেখি কিছু খাওয়াতে পারি কিনা।বাবার গায়ে তো আর হাত তুলবেনা’
মিশু তার ফোন নিয়ে নিচ তলায় গেলো।মৃদুল জবা গাছটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে।ওকে দেখে মিশু এগিয়ে গিয়ে জুথির নাম্বার আছে কিনা জানতে চাইলো।
‘জুথির নাম্বার আছে আমার কাছে।অর্ণব খেয়েছে কিছু?’
‘নাহ!হয়ত জুথি….’
‘হ্যাঁ।আমার আগে কেন মাথায় আসেনি।জুথি পারবে ওকে খাওয়াতে।আমি বরং ওকে ফোন করে আসতে বলি।বলবো?’
মিশু ভাবী মাথা নাড়িয়ে চলে আসলেন।মৃদুলের কাছে অর্ণবের এমন খারাপ অবস্থা শুনে জুথি দেরি না করে চলে আসলো এখানে।
দোতলায় গিয়ে জুথি যেইনা অর্ণবের কাছে ছুটে যাচ্ছিল সেসময়ে অর্ণবের বাবা মা ওকে থামতে বললেন।
‘মা এখানে একটু বোসো’
জুথি চুপচাপ বসলো।তারা ওর হাতে কুসুমের লেখা চিঠিটা তুলে দিয়ে বললেন একবার পড়তে।
জুথি মৃদুলের দিকে তাকিয়ে চিঠিটা পড়লো।পড়া শেষে চিঠিটাকে হাত থেকে ফেলে দিলো অন্যমনস্ক হয়ে।চট করে উঠে চলেও গেলো বাসা থেকে।
মৃদুল ওর চলে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারেনি বলে চিঠিটাকে নিয়ে নিজেই পড়া ধরে।
সম্পূ্র্ণ চিঠিটা পড়ে সে নিজেও হতবাক হয়ে গেছে।জুথি চলেই যাচ্ছিলো।মৃদুলের ডাকে থামলো।মৃদুল ছুটে এসেছিল ওকে আটকাতে।
‘অর্ণব ভাইয়াকে বিয়ে করতে বলবেন এখন তাই তো?এটা সম্ভব না।শুধু শুধু আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন না’
‘বাগানে বসবে একটু?’
‘না।আমার ঐ জায়গায় দাঁড়ালে কুসুমের কথা মনে পড়ে।আমি এখানে আর থাকতে পারবোনা’
জুথি গেট খুলে বেরিয়ে গেছে কথা বলতে বলতে।মৃদুল ওর সাথে যেতে যেতে বললো,’আমি তোমায় বলছিনা বিয়ে করতে।এটা সম্ভব ও না।কিন্তু আমি শুধু জানতে চাই তুমি আজও ওকে ভালবাসো কিনা।যদি বেসে থাকো তবে বিয়েটা করে নেওয়া উচিত তোমার।এতে করে অন্তত অর্ণব স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে।তুমি জানো ও আজ তিন দিন ধরে এক ফোঁটা পানি ও খায়নি’
জুথি মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে।মৃদুল ওর হাত ধরে বললো,’আমার আর কি!আমার কথা ভেবো না।আমি তো জন্মেছি নারীর থেকে বিচ্ছেদের প্রাপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য।অনামিকাকে পেলাম না,তোমায় পাবো সেই আশা তো আমার আশাই।আমার আশা কখনও পূরণ হবার না।
কুসুমের ইচ্ছে যদি এটা না থাকতো তবে আমি তোমায় জোর করতাম না।কুসুমকে নিজের ছোট বোন মনে করতাম সবসময়।তোমায় জায়গায় আমি হলে বিসর্জন দিয়ে দিতাম নিজের সবটুকু।আর এখানে তো তুমিই ওকে ভালবাসো।বিসর্জন দেওয়ার প্রশ্ন আসেনা।তাও তুমি সাত পাঁচ ভাবছো?নাকি আমার কথা ভাবছো?আমি খারাপ ভাববোনা তোমায়।আমার চোখে তুমি বেস্ট,তোমার সব ডিসিশান আজ পর্যন্ত ভাল ছিল।আগামীতেও থাকবে।আমার চোখে তুমি প্রথম কাতারেই থাকবে।নিচে নামবেনা।আমাকে নিয়ে ভেবোনা জুথি।যার সাথে ভাল থাকবে তাকে পাবার শেষ সুযোগ আজকে তোমার হাতে।কোনো বাধা নেই।একদিন তাকে পাওনি আর আজ সবাই মিলে তাকে তুলে দিচ্ছে তোমার হাতে।শুধু তোমার অনুমতির অপেক্ষা।আমি চাইবো কুসুমের মত করে।যাকে ভালবাসি সে ভাল থাকুক।সে যাকে চায় তাকে পাক।এটার মাঝে আলাদা পূর্ণতা অনুভব হবে ভেবে যে মানুষটা অন্তত ভাল আছে।আমি না পেলেও সে তাকে পেয়েছে যাকে সে চেয়ে এসেছে’
মৃদুল হাত মুঠো করে কথাগুলো বলছিল।সে কখনও কাঁদেনা।কিন্তু আজ তার চোখ জুড়ে কান্নার ঢল বয়ে আসছে।জুথি যেন তার চোখে চোখ না রাখে।তাহলে সে বুঝে যাবে ঐ চোখে হওয়া তুফানের আভাস। তাকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা শক্ত কথা বলা মানুষটা নিজেই নরম হয়ে গেছে ভেতর থেকে।ভালবাসার মানুষকে আরেকজনের হাতে তুলে দেবার কষ্ট অর্ণব কুসুমের বিয়ের দিন জুথি পেয়েছিল আর আজ সে পাচ্ছে।নিয়তি যেন একই সুতোয় বাঁধা।’
জুথি তাকালোনা মৃদুলের চোখে।
ওকে ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে চললো অর্ণবদের বাসার দিকে।মৃদুল যা যা বলেছে তার একটা কথাও সে কানে ঢোকায়নি।মাত্র একটা লাইন বাদে।
“””যার সাথে ভাল থাকবে তাকে পাবার শেষ সুযোগ আজকে তোমার হাতে”””
‘হ্যাঁ মৃদুল ভাইয়া ঠিক বললেন।আজ আপনাকে নিজের করে নেওয়ার শেষ সুযোগ আমার হাতে।তার সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে আমায়।হ্যাঁ আমি ভালবাসি তবে সেটা অর্ণব ভাইয়াকে নয়,আপনাকে।আপনার হাত ধরে আমি বাকি জীবন কাটাতে চাই।আমার ভাঙ্গা মন যে জুড়ে দিয়েছে তাকে ফেলে আমি কি করে পেছনে ফিরে যাব?’
চলবে♥