#লুকানো_অনুরক্তি (১২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
আকস্মিক প্রস্তাবে হকচকিয়ে গেলেন মামুনুর রশীদ। পরক্ষণে নিছক মজা ভেবে তিনি মাহফুজের কাঁধে হাত রাখেন। একগাল হেসে বলেন,
‘এসব মজা পরে হবে। সিলেট থেকে ফিরলি নিশ্চয়ই? তোকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আগে হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিবি, চল।’
মামুনুর রশীদ হাত ধরে টানতেই মাহফুজ নড়ল না। নিশ্চল, অবিচল রইল।
‘আমি কি পাত্র হিসেবে এতোটাই অযোগ্য কিংবা ছোটো যে, আমার দেওয়া প্রস্তাব তোমার কাছে মজা মনে হচ্ছে?’
মাহফুজের গুরুগম্ভীর কথায় ভড়কে গেলেন তিনি। প্রশ্নের জবাবে কি বলা যায় ইতস্তত করতে লাগলেন।
মাহফুজ ধপ করে উনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। হাত জোর করে অনুনয় করে বলে,
‘তোমার মেয়েটাকে আমার অবাধ্য মন ভালোবেসে ফেলেছে মামু। তোমার কাছে হাত জোর করছি। অবনিকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে আমায় নিঃস্ব করো না। তিন কবুল বলে সারাজীবনের জন্য গ্রহণ করতে চাই। তুমি এখন বললে এখন। কথা দিচ্ছি তোমার কাছে যেমন রাজকন্যার মতো ছিল আমার কাছেও রাজরানীর মতো থাকবে।’
অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাবে উনার বলা উচিৎ ভেবে পেলেন না তিনি। আকস্মিক কর্মকাণ্ডে উনার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বোধশূন্যের মতো মাহফুজের মুখের দিকে নিষ্প্রাণ চাহনি নিবদ্ধ করে চেয়ে রইলেন অপলক।
এতোক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে সব শুনলেন ফাতেমা আমিন। মাহফুজের কথা শেষ হতেই আর দাঁড়ালেন না। হনহনিয়ে গেলেন অবনির কাছে।
________________________
থমথমে পরিবেশ! দুই পরিবার একত্রে হয়েছে। ব্যপারটা ফয়সালা করার জন্য।
অবনির দুই গালে আঙুলের দাগ স্পষ্ট। ফোলা ফোলা চোখমুখ। ঠোঁটের কোণ কিঞ্চিৎ কাটা। র’ক্ত জমাট বেঁধেছে সেখানে। বিধ্বস্ত চেহারা। মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। অবনির দিকে এক পলক তাকিয়ে আফসানা খানম ফাতেমা আমিন কে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘মায়ের অধিকার ফলাচ্ছো তো বেশ ভালোই।’
ফাতেমা আমিন আগুন ঝরা কন্ঠে বললেন,
‘যে সন্তান মাকে দেওয়া কথা রাখতে পারে না সেই সন্তানকে যে একেবারে মে’রে ফেলেনি এটাই ভাগ্য।’
চমকায় মাহফুজ। অবনির দূরে দূরে থাকার রহস্য এতোদিনে উদঘাটন করতে পারল সে।
আফসানা খানম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ফাতেমা আমিন পুনরায় বলেন,
‘আমাকে ওয়াদা করেও প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে সে। আমি যে মা আমাকে দেওয়া ওয়াদার মূল্যটা কোথায় রইল?’
‘দেড়টা বছর মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখছি কই কখনো তো মনে হলো ছেলেমেয়ে দু’টোর মাঝে প্রণয়ের সম্পর্ক আছে। বরং মাহফুজ বাসায় এলে অবনি নিজেকে আড়াল করে নিতো। আমি মা। আমি বুঝি কেন সে নিজেকে আড়াল করে নিতো। কেন বার বার বলতো বাসা ছেড়ে হোস্টেলে উঠবে। আমি বাসায় থেকেও কিছু টের পেলাম না। অথচ তুমি গ্রামে বসে সব টের পেয়ে গেলে? আর দু’জনের মাঝে যদি প্রণয়ের একটা সম্পর্ক থেকেও থাকে তাহলে সমস্যা টা কোথায়? তুমিই বা আপত্তি করছো কেন? অবনিকে ছেলের বউ করতে আমি তো রাজি। তুমি জেদ ধরে বসে আছো কেন? আমার ছেলে কি অযোগ্য নাকি শিক্ষাদীক্ষায় কোনো অংশে কম?’
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন ফাতেমা আমিন।
‘আপনার কাছে কোনো সমস্যা নাই হতে পারে আপা। কিন্তু আমাদের মতো গ্রামীণ মানুষের এ যে বিরাট সমস্যা। উঠতে বসতে সমাজের মানুষ বলবে, পড়াশোনার নামে আমরা মেয়েটাকে লেলিয়ে দিয়েছে আপনার ছেলের পিছনের। আমার মেয়ের চরিত্র নিয়ে চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ হবে প্রতিটা ঘরে ঘরে। বাজারে প্রতিটা দোকানে দোকানে শুধু এসব নিয়ে আলোচনা হবে। বলবে মামুনুর রশীদের মেয়েটার চরিত্র ভালো না। এখানে সম্মান অর্জন করা সহজ হলে সেই সম্মান বজায় রেখে চলা বড় কঠিন। মানুষ ওত পেতে গবেষণা করার জন্য।’
‘যেখানে ওদের মাঝে প্রেমের কোনো সম্পর্কই নেই সেখানে তোমার গ্রামবাসীকে কে জানাবে ওদের প্রেমের বিয়ে? প্রেম থাকলে না হয় হতো।’ ক্যাটক্যাটে গলায় বললেন আফসানা খানম।
‘এদের আলাদা করে কিছু বলতে হয় না। ‘ক’ বললে পুরো কাব্য রচনা করে ফেলে।’
ফাতেমা আমিন এর কথা শুনে ক্ষণকাল নীরব রইলেন আফসানা খানম। তারপর তেড়ে গেলেন মাহফুজের দিকে।
‘বাপের মতো ব*ল*দ হইছে। পছন্দ করিস তুই আমার কাছে বলবি। তোদের মিল করানোর দায়িত্ব আমার। তা না নিজে নিজে পাকনামি করতে এসেছে। দেখ মেয়েটাকে কিভাবে মে*রেছে। একবার আমার কাছে মনের কথা বলে দেখতি। দেখতাম আমার বাসার ভেতর থেকে কে অবনিকে নিয়ে আসে।’
‘আহ্! আফসানা ছেলেমেয়েদের সামনে কিসব বলে যাচ্ছো।’
‘এই তুমি চুপ থাকো।’ বলে শহিদুল হক কে একেবারে চুপ করিয়ে দিলেন তিনি।
রণমুর্তি ধারন করেছেন তিনি। রাগে গজগজ করছেন।
‘কাগজে কলমে শিক্ষিত হয়েও যদি, সমাজ কি বলবে? সমাজ কি চোখে দেখবে? এসব নিয়ে পড়ে থাকো তবে আমার সত্যিই কিছু বলার নেই। তোমার কাছে তোমার ওই সো কল্ড সমাজের দাম বেশি হতে পারে। তবে আমার কাছে আমার সন্তানের চাহিদার মূল্য এর থেকেও কয়েকগুণ বেশি। আমার সন্তানের চাওয়া পাওয়ার মূল্যায়ন আমি একটু বেশি করি। সবকিছুর উর্ধ্বে আমার সন্তান আমার কাছে কি চাইলো সেটা। সাধ্যের মধ্যে থাকার পরও যদি সমাজের ভয়ে আমি আমার সন্তানের চাহিদা পূরণ করতে না পারি তবে নিজেকে মায়ের কাতারে নিজেকে কখনোই ফেলবোই না।’
এতটুকু বলে থামলেন তিনি। বিরতিহীন কথাগুলো বলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গলা শুকিয়ে এসেছে। ফাঁকা ঢোক গিলেন। একটু দম নিয়ে পুনরায় বলেন,
‘ প্রিয়জন হারিয়ে আমার সন্তান যদি মৃ*ত্যু*সম ভোগ করে তোমার সেই সমাজ তাকে সান্ত্বনা দিবে না। বরং তামাশা দেখবে। আমি ছেলেমেয়ে দু’টো কে একা হাতে মানুষ করেছি। প্রচুর জ্বালিয়েছে, বিরক্ত করেছে আমায়। কিন্তু কোনোদিন ফুলের টোকাও দেয়নি। অথচ নিজের মেয়েটার দিকে তাকাও তুমি। কিভাবে মে*রেছো। আজ তুমি না হয়ে যদি মামুন এই কাজ করতো আমি ছেলেমেয়ে কাউকে তোয়াক্কা করতাম না । ওর গায়ে হাত উঠাতাম। সন্তান মা-রার বস্তু না। যে ইচ্ছে হলো আর মা*রলাম। যার সন্তান নেই তাকে একটা বার জিজ্ঞেস করে দেখো। না চাইতে আল্লাহর দরবারে পেয়ে গেছো তো তাই সন্তান নামক বস্তুটার মূল্য বুঝো না। আমার ছেলেটা ঝুঁকের বসে এসে কি না কি বললো আর তুমি মেয়ের গায়ে হাত তুললে। হাত কাঁপেনি এতো বড় মেয়ে গায়ে হাত তুলতে?’
প্রশ্নটা করে ফাতেমা আমিন এর দিকে সরোষ চোখে তাকিয়ে রইলেন তিনি। চোখমুখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে উনার। বেশ উত্তেজিত তিনি।
‘আপনার ছেলেমেয়ে যদি রাস্তা থেকে কাউকে ধরে এনে বলে তাকে বিয়ে করবে আপনি রাজি হয়ে যাবেন?’
‘অবশ্যই না। সে বললে তো আর হবে না। আমি দেখবো সে মানুষ হিসেবে কেমন। আমার সন্তানকে আগলে কিংবা সুখী রাখবে কি না। সম্মান করবে কিনা। কারন প্রত্যেকটা সম্পর্কে যেমন ভালোবাসা থাকা জরুরি তেমনি সম্মান আর শ্রদ্ধা থাকাটাও জরুরি। সম্মান আর শ্রদ্ধা না থাকলে সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেওয়া যায় না। আর যদি বলো টাকা পয়সার কথা। ওটা এক সময় হয়ে যায়। মাহফুজের বাবার সাথে আমার যখন বিয়ে হয় তখন গ্রামে ওদের দুই কামরা একটা মাটির ঘর ছিলো। এক রুম থেকে ফিসফিস করে কথা বললেও অন্যরুমে শুনা যেত। সেই জায়গা থেকে ঢাকা শহরে আমার একটা ফ্ল্যাট হয়েছে। তোমার দুলাভাই দুই খানে শেয়ারে জমি কিনেছে। ওসব টাকা পয়সা নিয়ে আমি ভাবি না।’
‘বুবু থামো না। এতো উত্তেজিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নাও। সামান্য ব্যপারটাকে কেন জল ঘোলা করছো?’
রাগী চোখে মামুনুর রশীদের দিকে তাকালেন তিনি।
‘আমি জল ঘোলা করছি নাকি তোর বউ? মানছি আমার ছেলেটা একটা ভুল করেই ফেলেছে। আমাদের না বলে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাবটা তোকেই দিয়েছে। এখানে ভুল তো কিছু নেই। আমাদের তরফ থেকে কোনো আপত্তি নেই। তাহলে তোরা কেন মানতে পারছিস না।’
এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার একটু নড়েচড়ে বসেন শহিদুল হক।
‘এতক্ষণ তোমরা মহিলারা অনেক কিছু বললে। শুনলাম তোমাদের কথা। এবার আমি কিছু কথা বলি। মনে করো এই পর্যন্ত যা যা ঘটেছে তার কিছুই ঘটেনি। সবটা স্বাভাবিক। মামুনের কাছে যদি আমি তার মেয়েকে চাই আমার বিশ্বাস সে আমাকে ফিরাবে না। অবনির অভিভাবক হিসেবে মামুন ছাড়াও তুমি আছো। আমার দৃষ্টিতে একটা সন্তানের উপর মায়ের অধিকারটা হয়তো একটু বেশিই থাকে। আমার ছেলের পক্ষ থেকে তার আর্জিটা আমি পেশ করছি। বলতে পারো তোমার কাছে একটা আবদার করলাম। তোমার মেয়েটা আমাকে দিবে? ছেলের বউ না আমি তাকে নিজের মেয়ে করে রাখবো। রাখবে আমার আবদার টা?’
মামুনুর রশীদ কিছু বলতে নিলে হাত দিয়ে থামিয়ে দেন তিনি।
‘আমি তোমার কাছে মেয়েটাকে চাইনি শা*লা সাহেব। আমি মেয়েকে চেয়েছি মেয়ের মায়ের কাছে। সে হ্যা বললে হ্যা। প্রয়োজন পড়লে আজই বিয়ে হবে। আর না বললে না। এর বাহিরে আর কেউ কোনো কথা বলবে না। আমি তার সিদ্ধান্ত কে সম্মান করবো। ফাতেমার উপর ছেড়ে দিলাম সবটা।’
এতোক্ষণের এতো রাগারাগি, এতো কথা যেন মুহুর্তে নীরব হয়ে গেলো। সবাই চাতক পাখির মতো ফাতেমা আমিন এর দিকে তাকিয়ে আছে। তার উত্তরটা কি হয় জানার জন্য।
মাহফুজ থম মে’রে বসে আছে। উত্তরটা কি হয় জানার জন্য। বক্ষঃস্থলে আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে তার। ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে হৃদযন্ত্রের লাফানোর গতি। ঘাম দিচ্ছে শরীর। শরীরে র’ক্ত চলাচলের গতি বেড়েছে। আজ একটা উত্তরে হয়তো দুজনের পথচলা শুরু হবে। নয়তো সারাজীবনের দুজনের পথ আলাদা হয়ে যাবে। এটাই হবে দুজনের শেষ দেখা।
শেষ দেখা কথাটা ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠল তার। হাত পা ক্ষীণ কাঁপতে লাগল। কাল বিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ অবনির আ’ঘা’তে জর্জরিত, বিধ্বস্ত মুখ নেত্রপাত করে সে। এবার যেন অন্তর্দেশ তার হুহু করে কেঁদে উঠল।
মিনিট বিশেক অতিক্রম হওয়ার পর ফাতেমা আমিন জবাব দিলেন,
#চলবে