#লেবু
১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
“কোন সাহসে এমন খোলামেলা পোশাক পড়ে সবার সামনে এসেছো তুমি? লজ্জা নেই একফোঁটাও?” দাঁতে দাঁত চেপে অগ্নিকণ্ঠে বলল শাফকাত।
সতর্ক ভঙ্গিতে একবার নিজের ওপর চোখ বুলিয়ে সাবা থমথমে গলায় বলল, “খোলামেলা পোশাক? এটার নাম শাড়ি! আর শাড়ি এভাবেই পড়তে হয়।”
ভেতরে ভেতরে ফুটতে থাকা আগ্নেয়গিরির লাভা বহুকষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে শাফকাত বলল, “কোনটা কীভাবে পড়তে হয় আমাকে শেখাতে যাবে না। এই মুহূর্তে পার্টি থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় যাবে তুমি।”
সাবা সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলো, “আপনার কথামতো চলতে বাধ্য নই আমি।”
বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো শাফকাতের ঠোঁটে। হাসিটা রাগের, আক্ষেপের না-কি বিদ্রুপের ঠিক বোঝা গেল না। মেয়েটা বহুদিন ধরে জ্বালাচ্ছে তাকে। যদিও জ্বলতে সে বলেনি, তবুও নিজ দায়িত্বে প্রতিনিয়ত জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে শাফকাত। এই যেমন ঠিক এই মূহুর্তে, ধবধবে সাদা জর্জেট শাড়িতে সাবা রীতিমত আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে তার সমস্ত শরীরে। কোমরসমান খোলা চুলগুলো যেন তাকেই ডাকছে। লাল লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁট একটু একটু করে দুর্বল করে দিচ্ছে তাকে।
ঘোর থেকে বেরিয়ে সংবিৎ ফিরে পেলো শাফকাত। নাহ্! এই মেয়েকে আজ একটা শিক্ষা না দিলেই নয়।
সাবার ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো শাফকাত। তার পুরুষালি শক্ত হাতের স্পর্শে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সাবা। তবুও প্রতিবাদ করলো না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেল। আশেপাশে হাজারো মানুষ। চাইলেই বোকামি করা যাবে না এই মুহূর্তে।
শাফকাত সাবার একদম কাছাকাছি চলে এলো। চোখদুটো বুজে মাথা নিচু করে রইলো সাবা। কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসছে ছেলেটার শরীর থেকে। মদকতায় ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ঘ্রাণ। তবুও সহ্য হলো না সাবার। ইচ্ছা হচ্ছে যেন ছুটে পালিয়ে যায় ছেলেটার কাছ থেকে।
শাফকাত তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “তাহলে চলো, আমার কথা মতো চলতে আজ বাধ্য করি তোমাকে।”
সাবা আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই শাফকাত তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল পার্টি হলের বাইরে। শাফকাত নিজেই আয়োজন করেছে এই পার্টির। দেশের অন্যতম সফল বিজনেসম্যান শাফকাত আলম। প্রায়ই এমন পার্টির আয়োজন করে সে। সেখানে আগমনও ঘটে নামিদামি তারকা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের।
এত নামি-দামি মানুষদের চোখের সামনে দিয়ে
নিজের পার্টি থেকে নিজেই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল শাফকাত, তাও আবার সুন্দরী একটা মেয়ের হাত ধরে। তবুও কেউ কিছুই মনে করলো না। কারণ সুন্দরী মেয়েটা তার বিয়ে করা বউ।
ছয় মাস আগে বিয়ে হয় তাদের। পারিবারিক চাপের মুখে বিয়েটা করতে বাধ্য হয় সাবা। বয়স তার সবে চব্বিশ। দুনিয়াটা দেখা বাকি ছিল। ইচ্ছা ছিল নিজেই পছন্দ করবে নিজের জীবনসঙ্গীকে। কয়েক বছর চুটিয়ে প্রেম করে তবেই বিয়ে। সেই ইচ্ছায় নির্দ্বিধায় জল ঢেলে দিয়ে তার বাবা-মা একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই বিয়েটা দিয়ে দেয়।
তবে এই ছয় মাসে ভুলেও শাফকাত নামের এই মানুষটাকে নিজের স্বামী ভাবেনি সে। কাছেও আসতে দেয়নি। বিয়ের দিনেই পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, “আমি আপনার ঘরে থাকবো না। আমাকে আলাদা একটা ঘর দিতে হবে। না হলে এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো।”
শাফকাত জোর খাটিয়ে এই মেয়েটাকে তার কথা শুনতে বাধ্য করলেও, তার সঙ্গে এক ঘরে থাকতে বাধ্য করতে পারেনি। কিংবা হয়তো চায়নি। মেয়েটার প্রতি নিজের অনুভূতিগুলো নিজেই বুঝে উঠতে পারে না সে। মাঝে মাঝে সহ্য হয় না তাকে। সাবার দিকে চোখ তুলে তাকালেও যেন ঘৃণা ধরে যায়। আবার ঠিক পরমুহূর্তেই মনে হয়, এই মেয়েটার জন্যে নির্দ্বিধায় জীবন দিয়ে দেওয়া যায়।
সাবার প্রতি নিজের অনুভূতি সম্পর্কে শাফকাত নিশ্চিত না হলেও, এতটুকু নিশ্চিত যে এই মেয়েটা তার। একান্তই তার। বিয়ে শব্দটার শক্তি অনেক। এই শব্দটাই তার জীবনের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে সাবার জীবনটা। আর যা নিজের, তাকে আগলে রাখতে ভালোই জানে শাফকাত আলম।
পার্টিতে হাঁটতে হাঁটতে বারবার পেটের কাছ থেকে আঁচলটা সরে যাচ্ছিল সাবার। যদিও তৎক্ষণাৎ আঁচল সামলে নিচ্ছিল সে। তবুও আঁচল সরে যাওয়া, আর তার ঠিক করে নেওয়ার মাঝে যে এক সেকেন্ডের ব্যবধান – সেটাই যথেষ্ট তার ফর্সা মসৃন কোমড় মানুষের সামনে উন্মুক্ত করে তোলার জন্যে।
যা দেখার অধিকার শুধুমাত্র শাফকাতের, তা অন্য কেউ দেখতে যাবে কেন? তাই তো টেনেহিঁচড়ে সাবাকে নিয়ে এলো গ্যারেজে।
শাফকাতের বিএমডাব্লিউর কাছে আসতেই সাবা ঝড়ের গতিতে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “ছাড়ুন! কোন অধিকারে আমাকে কন্ট্রোল করেন আপনি?”
শাফকাত তার ধূসর রঙের স্যুটটা ঠিক করতে করতে বলল, “আইনত যে অধিকার পেয়েছি।”
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো সাবা। খেয়াল করে দেখলো তার হাতে আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে শাফকাতের। রাগে রীতিমত গা জ্বলে উঠলো তার।
শাফকাত রীতিমত আদেশের সুরে বলল, “গাড়িতে ওঠো!”
জেদ ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সাবা। এই লোকের যে জিনিসটা তার সবথেকে অসহ্য লাগে, সেটা হলো তার কথা বলার ধরন। এমনভাবে সাবার সঙ্গে কথা বলে যেন তার কিনে নেওয়া গোলাম সে। পরিবারের আদরের ছোট মেয়ে সাবা। আদরে আদরেই বড় হয়েছে। এমন দুর্ব্যবহার তাই সহসা সহ্য হয় না।
শাফকাত হুমকির সুরে বলল, “এক কথা কিন্তু দুইবার বলতে পছন্দ করি না আমি।”
সাবা লম্বা লম্বা পা ফেলে গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসলো। ভয় পেয়ে নয়। রাগে, বিরক্ত হয়ে।
শাফকাত সাবার থেকে নয় বছরের বড়। বয়সের এই পার্থক্যটা কি খুব বেশি? সাবার কাছে অবশ্য মনে হয় না। তার বাবা মায়ের থেকে বারো বছরের বড়, দাদা দাদির থেকে বড় পনেরো বছরের। বয়সের পার্থক্যই স্বাভাবিক তার কাছে। জীবনসঙ্গী হিসেবে নিজের থেকে বয়সে বড় কাউকেই চেয়েছিল। তবে যদি সে জানতো, বয়সে বড় এই ছেলেটা এমন তীব্র শাসনের মাঝে রাখবে তাকে – ভুলেও সেই আশা করতো না।
মাঝে মাঝে বড্ড অসহায় লাগে সাবার। ভবিষ্যতের চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে সে। পরিবারের মন রাখতে বিয়েতে রাজি হয়েছে সে। তবে এই ছেলের সঙ্গে আজীবন কাটানোর প্রশ্নই ওঠে না। কী করে মুক্তি পাবে এই গোলকধাঁধা থেকে সে?
শাফকাত ড্রাইভ করছে। পার্টি হল থেকে বাড়ির দূরত্ব পনেরো মিনিটের। রাত এগারোটা বাজছে বলে রাস্তা আপাতদৃষ্টিতে ফাঁকাই পেলো।
ড্রাইভ করতে করতে শাফকাত ধমকের সুরে বলল, “কোনো কমন সেন্স নেই তোমার? কীসের সাংবাদিকতা করো? জানো না এসব পার্টিতে কেমন মানুষ আসে? তাও এমন সাজ দিয়ে কেন গিয়েছিলে? জানো কতগুলো ব্যাটা লোভী নজর দিচ্ছিলো তোমার দিকে?”
সাবা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আপনাদের পুরুষদের কাজই তো মেয়েদের দিকে লোভী নজর দেওয়া। আমি সেজে গিয়েছি, যে মেয়ে না সেজে গিয়েছে তার দিকেও লোভী নজর দিয়েছিল তারা। পুরুষদের লোভী নজরে আমরা অভ্যস্ত।”
শাফকাত ভ্রু কুঁচকে বলল, “নীতি বাক্য শোনাতে যাবে না আমাকে।”
বিবাহিত জীবনের যেকোনো সমস্যার সমাধান খুব সহজেই হতে পারে, যদি দুটো মানুষ একে অপরের সঙ্গে কথা বলে। একে অপরের কথা শোনে। একে অপরকে বুঝতে চেষ্টা করে। যদিও শাফকাতকে সাবা স্বামী হিসেবে স্বীকার করে না। তবুও এই সত্যি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে আইনত তারা বিবাহিত।
সাবা তাই সমস্যার কথাটা খুলে বলার চেষ্টা করলো শাফকাতকে, “আপনাকে হাজারবার বলেছি এই বিয়েটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল। বিয়ের আগে আমার মত পর্যন্ত নেয়নি আমার বাবা-মা।”
শাফকাত গম্ভীর গলায় বলল, “সেটা তাদের ব্যর্থতা। কিন্তু বিয়ে যখন করেই ফেলেছো, তখন আমার কথা মতোই চলতে হবে তোমাকে।”
তার কণ্ঠে এই গাম্ভীর্য আরেকদফা রাগে ডুবিয়ে দিলো সাবাকে। এই ছেলেটা মন দিয়ে তার কথা শুনবে, ভাবাটাই ছিল তার সবথেকে বড় বোকামি।
রেগে দিয়ে সাবা অতিষ্ট গলায় বলল, “আপনি কি বোঝেন না আমার আপনাকে সহ্য হয় না? গা ঘিনঘিন করে আপনি আশেপাশে থাকলে, দমবন্ধ লাগে!”
শাফকাত সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “গা ঘিনঘিন করলেও সহ্য করতে হবে, দমবন্ধ লাগলেও সহ্য করতে হবে।”
ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো সাবা। এমন কেন এই ছেলেটা? তাকে কি ভালোবাসে না-কি? নিজের ভাবনায় নিজেরই হাসি পেয়ে গেল সাবার। তাকে ভালোবাসতে যাবে কেন? মানুষ যাকে ভালোবাসে, তার সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে না। এই ছেলেটা নির্ঘাত কন্ট্রোল-ফ্রিক। নিজের মতো সাবাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিচিত্র আনন্দ পায় সে।
সাবা বাংলার বাতাস চ্যানেলের অপরাধ বিভাগের সাংবাদিক। খুব কম বয়সেই পৌঁছে গেছে সাফল্যের চূড়ায়। এমনি এমনিই সফলতাটা আসেনি। এর পেছনে রয়েছে তার অক্লান্ত পরিশ্রম। গত বছরই বাংলার বাতাসে তার অপরাধ অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান ‘বাতাসে কীসের গন্ধ?’ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে চারিদিকে। সাম্প্রতিক সময়ে আলোড়ন ফেলে দেওয়া কেসগুলো নিয়ে গভীরে তদন্ত করেছে সে।
রিপোর্ট করার জন্যে দিনে-রাতে যখন তখন ছুটে যেতে হতে পারে সাবাকে। তার বাবা-মায়ের এ নিয়ে কোনপ্রকার আপত্তি ছিল না। আপত্তি আছে এই লোকের। রাতে ঘর থেকে একা বের হওয়া যাবে না। বের হতে হবে বডিগার্ড নিয়ে। বের হলেও, মিনিটে মিনিটে তার ফোন রিসিভ করতে হবে। ফোন রিসিভ না করলে বাড়ি ফিরেই মুখোমুখি হতে হবে তীব্র ধমকের।
শাফকাতও রাত-বিরেত পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকে, কখনো কখনো তো ফেরেই না। এসব নিয়ে কি কখনো আপত্তি করেছে সাবা? মোটেও না। কারণ সে যথেষ্ট বুঝদার একটি মেয়ে। একটা মানুষ কাজের জন্যে ব্যস্ত থাকতেই পারে। তার কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর অর্থ তার ব্যক্তিসত্তার আঘাত হানা।
শাফকাত হঠাৎ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “তুমি যে অনবরত কথা বলে যাচ্ছো, আমারও তো মাথা ধরে যাচ্ছে। সহ্য করছি না তোমাকে?”
শাফকাতের এই কথা থেকে যেন আশার আলো খুঁজে সাবা। উজ্জ্বল কণ্ঠে বলল, “তার মানে আপনারও আমাকে অসহ্য লাগে?”
সাবা খেয়ালই করেনি এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে গেছে তারা। শাফকাতের বিশাল দোতলা বাড়ি চাকচিক্যে পরিপূর্ণ। বিশাল একটা বাগান পাড় করে প্রবেশ করতে হয় বাড়িতে। বাড়ির দরজা বরাবর লম্বা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে বাগান। বাগানে নেই এমন কোনো গাছ বোধ হয় নেই। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিউলি, পলাশ, আম, কাঁঠাল – আরও নাম না জানা কত গাছ যে আছে! বসন্তকালে ফুলে ফুলে যখন গাছগুলো ভরে ওঠে, চমৎকার লাগে দেখতে।
বসন্তেই বিয়ে করে এ বাড়িতে এসেছিল সাবা। বাগানের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্যটা যেন এখনো চোখে ভাসে।
শাফকাত গাড়ি থেকে নেমে দৃপ্ত হাতে হাঁটা শুরু করলো বাগানের মাঝের রাস্তাটা দিয়ে। সাবা তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে তার পিছু নিলো।
ছুটতে ছুটতে শাফকাতের সঙ্গে নিজের পদক্ষেপ মিলিয়ে সাবা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “দেখুন আপনার আমাকে সহ্য হয় না, আমারও আপনাকে সহ্য হয় না। এভাবে একসাথে থাকার দরকারটাই বা কী? আপনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। এতে আমরা দুজনেই…”
শাফকাতের গা বেয়ে রাগের ভয়াল হাওয়া বয়ে গেল। নিজের মধ্যে রইলো না সে আর।
শক্ত করে চেপে ধরলো সাবার গাল। এতটাই শক্ত করে চেপে ধরেছে যে ব্যাথা সহ্য করে মুশকিল হয়ে উঠেছে সাবার পক্ষে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। যদিও খুব ভালো করেই সে জানে, ওই শক্ত পুরুষালি স্পর্শ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে।
শাফকাত অগ্নিদৃষ্টিতে তার চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে বলল, “আজ না বুঝে বলে ফেলছো দেখে কিছু করলাম না। এরপর ডির্ভোসের কথা মুখে আনলেও জানে মেরে ফেলবো।”
তৎক্ষণাৎ সাবাকে ছেড়ে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো শাফকাত। মাথায় হাত মাটিতেই বসে পড়লো সাবা। তার মাঝে কষ্টের থেকেও এই মুহূর্তে যে জিনিসটা সবথেকে বেশি কাজ করছে, সেটা হচ্ছে অসহায়ত্ব। কী করলে মুক্তি মিলবে এই অসহায়ত্ব থেকে?
কতটা সময় এভাবে বসে রইলো সাবা নিজেও জানে না। এ বাড়িজুড়ে হাজারো স্টাফ ঘোরাফেরা করে। মূল দরজার সামনে কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড। তারা আগ্রহ নিয়ে দেখছে সাবাকে। এমনিতে মিষ্টি একটা মেয়ে সাবা। সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে। স্টাফদের কাউকেই ছোট মনে করে না। তবে মাঝে মাঝে অস্বাভাবিকতা ভার করে তার মধ্যে। এই যেমন এখন করছে।
অনেকটা সময় পর উঠে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট পা ফেলে বাড়ি ভেতরে প্রবেশ করলো সাবা। তার পদক্ষেপগুলো বড্ড এলোমেলো। এই বুঝি লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। এলোমেলো পায়ে দোতলায় উঠে গেল সাবা। এ বাড়ির শোবার ঘরগুলো সব দোতলাতেই। নিচতলায় শাফকাতের স্টাডি রুম, কনফারেন্স রুম আর লাইব্রেরি।
নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সাজসজ্জা নিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সাবা। জীবনটা তো এমন ছিল না তার। আজ থেকে মাত্র একটা বছর আগে, কী সুখেই না ছিল সে পরিবারের মানুষগুলোকে নিয়ে। আর আজ, এই সুখ শব্দটাকেও মনে হয় দুষ্প্রাপ্য কোনো বস্তু।
চোখদুটো বন্ধ করে দুহাতে মাথার দুপাশ চেপে ধরলো সাবা। না, সে মনে করতে চায় না ওই স্মৃতি। তবুও যেন ওই দৃশ্যটা জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠছে তার চোখের সামনে। থরথর করে কাঁপছে সাবা। হাত-পা শক্ত হয়ে উঠেছে তার। এই মুহূর্তে কেউ যদি পরম মমতায় বুকে আগলে ধরে রাখতো তাকে!
এক বছর আগেও সাবার কাছের মানুষগুলো তার কাছেই ছিল। কষ্টে যারা এগিয়ে আসবে, আগলে রাখবে। আজ ওই কাছের মানুষগুলোই হয় দূরে ঠেলে দিয়েছে তাকে। নিজের অজান্তেই সাবা তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।
ঘুম তার ভাঙলো সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ। সকাল সকাল ওঠার অভ্যাস তার বহুদিনের। রাত করে ঘুমালেও প্রকৃতি নিজ নিয়মে এই সকালেই জাগিয়ে তোলে তাকে। ধীরেসুস্থে উঠে বসে আশপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিলো সাবা। শরীরটা বেশ হালকা লাগছে, মনটাও তাই। আচমকা কাল রাতে যে তীব্র শীতল অনুভূতি তাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরলো, তা আর নেই এখন। তবে মনের কোনো এক অদৃশ্য স্তরে লুকিয়ে আছে স্যাঁতস্যাতে নাম না জানা এক অনুভূতি। এই অনুভূতি যদিও চিরস্থায়ী।
লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো সাবা। আবারও স্বাভাবিক লাগছে নিজেকে। কে বলবে এই মেয়েটাই কাল রাতে রেগেমেগে একাকার কান্ড বাঁধিয়েছিল।
হালকা মেরুন রঙয়ের একটা স্যুট আর একই রঙয়ের প্যান্ট বের করে আনলো সাবা ক্লজেট থেকে। সঙ্গে সাদা শার্ট। শাড়িতে তাকে দুর্দান্ত লাগলেও শাড়ি খুব একটা পড়ে না সে। তাছাড়া তার পেশার সঙ্গে শাড়ি খুব একটা মানায়ও না। চুলগুলো পরিপাটি করে বেঁধে বেরিয়ে এলো সাবা। এই তার প্রতিদিনকার অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে গোসল করে তৈরি হয়ে তবেই বেরোবে ঘর থেকে।
নিজের ঘর থেকে সিঁড়ির দিকে হেঁটে যাওয়ার সময়ে আড়চোখে একবার তাকালো সাবা পাশের ঘরের বদ্ধ দরজার দিকে। মনে মনে প্রার্থনা করলো যেন, সকাল সকাল ওই ছেলেটার মুখোমুখি না হতে হয় তাকে।
সাবা নিচতলায় নেমে আসতেই তার দিকে হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এলেন আতিয়া আলম। এই মায়ের সন্তান কী করে শাফকাতের মতো বদরাগী, বদমেজাজী, জেদী, অবুঝ একটা ছেলে হয় সাবা বুঝে উঠতে পারে না। কে জানে, হয়তো বাবার মতো হয়েছে। বিয়েটা যখন হয়, শাফকাতের বাবা শাহজাহান সাহেব তখন মৃত্যুর দিন গুনছেন। তাকে সেভাবে দেখার বা জানার সুযোগ তাই হয়ে ওঠেনি।
আতিয়া আলমকে দেখেছে যথেষ্ট। পৃথিবীর সরলতম নারী তিনি। তার প্রত্যেকটা কথার সঙ্গে হাসি ঝরে পড়ে। সাবাকে নিজের মেয়ের মতোই আগলে রাখেন তিনি।
সাবা মিষ্টি গলায় বলল, “গুড মর্নিং মা।”
আতিয়া আলম হাসিমুখে বলল, “গুড মর্নিং সাবা। আজ তো তোমায় খুব সুন্দর লাগছে।”
সাবা হেসে বলল, “থ্যাংক ইউ!”
আতিয়া আলম কৌতূহলী গলায় বললেন, “কাল রাতে তোমরা দুটো অমন তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলে কেন পার্টি থেকে? আর তো ফিরেও এলে না!”
সাবা কী বলবে ভেবে পেলো না। তার সঙ্গে শাফকাতের সম্পর্ক যে মোটেও স্বাভাবিক নয়, জানতে বাকি নেই তার শাশুড়ি মায়ের। তবুও সত্যিটা জানিয়ে আতিয়া আলমের মন খারাপ করে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এমনিতেই তিনি বহুভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ছেলে এবং পুত্রবধূর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্যে।
সাবা ইতস্তত করে বলল, “আসলে মা, আমার শরীর ভালো লাগছিল না। তাই শাফকাতকে বললাম বাসায় পৌঁছে দিতে।”
আতিয়া আলম তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, “ওহ আচ্ছা! এখন ভালো লাগছে তো?”
সাবা ঘাড় কাত করে জানালো, তার ভালো লাগছে। ভদ্রমহিলাকে মিথ্যা বলতে তার বড়ই খারাপ লাগে। মিথ্যা বলতে হচ্ছে শুধুমাত্র তার গুণধর ছেলের কৃপায়। সাবা কাল রাতের ওই পার্টিতে গিয়েছিল আতিয়া আলমের মন রাখতে। তিনি এত করে বলছিলেন, সাবা না করতে পারেনি।
আতিয়া আলম বললেন, “তুমি বসে পড়ো মা। আমি একটু পর খাবো।”
ডাইনিং হলে প্রবেশ করতেই সাবা দেখলো শামা কর্নফেক্স নিয়ে বসে আছে। এক হাতে চামচ দিয়ে বাটিতে নাড়াচাড়া করছে, আরেক হাতে ফোন ধরে রেখেছে। ইন্টারনেট জগতে মেয়েটার স্থায়ী বসবাস। মাঝেমধ্যে বাস্তবে জগতে আসে বেড়াতে। শাফকাতের এই ছোট বোনের সঙ্গেও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না তার। শামা প্রচন্ড লক্ষ্মী একটা মেয়ে। এই বাড়িতে সাবার অন্যতম একজন বন্ধু। শাফকাতের সঙ্গে বিয়েটা সাবা এখনো মেনে নিতে না পারলেও, আপন করে নিয়েছে তার পরিবারের মানুষগুলোকে।
সাবা শামার বিপরীতে থাকা চেয়ারটায় বসতে বসতে বলল, “কী শামা? আজ থেকে নতুন সেমিস্টার শুরু হচ্ছে না-কি?”
শামা হাসিমুখে ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সাবার প্রশ্নটা তার কর্ণকূহরে পৌঁছাতেই মুখটা গোমড়া করে বলল, “আর বোলো না ভাবি!”
সাবা হেসে ফেলে বলল, “এনজয় করো শামা! একবার কাজে ঢুকে পড়লে এই পড়াশোনাটাকেই সবথেকে বেশি মিস করবে।”
“এতগুলো বছর এনজয় না করে কাটিয়ে দিলাম, আর তো মাত্র দুটো সেমিস্টার!”
দুজনেই হেসে ফেলল একসঙ্গে। সাবা ব্রেডে মাখন মাখাচ্ছে নিজের জন্যে। শামাও ফোন রেখে এবার কর্নফ্লেক্সে মন দিলো।
শামা বলল, “তুমি আমাকে ড্রপ করে অফিসে যাবে তো?”
“অবশ্যই!”
“আমি ব্রেকফাস্ট সেরেই রেডি হতে যাচ্ছি ভাবি।”
“তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ধীরেসুস্থে খাও।”
কিছুক্ষণের মধ্যে ডাইনিং হলে এলেন আতিয়া আলম। তার হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। রোজ সকালে সাবা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেই তিনি তার জন্যে কফি বানাতে যাবেন। তার বৌমার আবার সকাল সকাল আগুন গরম কফি খাওয়ার অভ্যাস।
সাবা স্নিগ্ধ হাসি হেসে বলল, “মা! কফিটা তো আমিও বানাতে পারতাম।”
আতিয়া আলম তার পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে বললেন, “নিজের বাড়িতে থাকতে বানাতে?”
“না। মা বানিয়ে দিতো।”
আতিয়া আলম জোর গলায় বললেন, “এটাও তো তোমার নিজেরই বাড়ি। এখানে কেন মা বানিয়ে দেবে না?”
সাবা চুপ করে রইলো। এই মানুষটার স্নেহে আসলেই মনে হয় যেন নিজের বাড়িতে আছে সে। শেষের দিকটায় তো নিজের বাড়িতেও এত স্নেহ পায়নি সাবা। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো সাবা। নাহ্! ওই চিন্তাগুলোতে ফিরে যাওয়া যাবে না।
ডাইনিং হলের দক্ষিণ দেয়ালে ঝুলন্ত পঞ্চান্ন ইঞ্চির প্রকান্ড এক টিভি। টিভিতে এতক্ষণ নিউজ চলছিল, তবে মিউট করে রাখা ছিল।
শামা হঠাৎ উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “ভাবি দেখো, দেখো! তোমাকে দেখাচ্ছে!”
সাবার চোখ পড়লো টিভির দিকে। গতকালের রিপোর্ট রিপিট টেলিকাস্ট করা হচ্ছে। কালো শার্ট পরিহিত সাবা মাইক হাতে নিয়ে সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে। শামা এবং আতিয়া আলম দুজনেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে।
রিপোর্ট শেষ হতেই আতিয়া আলম ইতস্তত করে বললেন, “সাবা?”
“জি মা?”
আতিয়া আলম আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এই রিপোর্টগুলো সব তুমিই লেখো?”
সাবা সূক্ষ্ম হাসি হেসে বলল, “হ্যাঁ।”
“অনুসন্ধানও তুমি করো?”
সাবা এবার একটু চিন্তিত হয়েই বলল, “হ্যাঁ, তবে আমি একা করি না। আমার সাথে টিম থাকে। কেন বলুন তো মা?”
আতিয়া আলম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুকনো ঢোক গিলে বললেন, “ক্যামেরার সামনে না এসেও কী এই কাজগুলো করা যায়?”
সাবা তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, “মানে?”
আতিয়া আলম কম্পিত স্বরে বললেন, “না মানে, তোমাকে যে টিভিতে দেখায়, শাফকাত এটা পছন্দ করে না।”
রাগে গা জ্বলে উঠলো সাবার। বহুকষ্টে ঠান্ডা করে মস্তিষ্কটা নিমিষেই বিগড়ে গেল আবারও। দুটো কারণ আছে। প্রথমত, শাফকাত তার কাজে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে। আর দ্বিতীয়ত, শয়তানের নাম নিতেই হাজির হয়েছে সে ডাইনিং হলে।
ঘুমজড়ানো ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল এ ঘরের কোণায় থাকা নিউজপেপার হোল্ডারের দিকে।
কালো টিশার্ট, কালো ট্রাউজারে মারাত্মক হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো তার খাড়া হয়ে আছে। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে বলে চুলগুলো এলোমেলো। নেহায়েত সাবা ছেলেদের রূপে দুর্বল হয় না। না হলে কবে যে মনের অজান্তেই প্রেমে পড়ে যেত ছেলেটার।
তার প্রেমে পড়ার চিন্তা মাথায় আসতেই নিজের ওপরে বিরক্তিতে গা জ্বলে উঠলো সাবার। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বলল, “আপনি পছন্দ করেন মা?”
আতিয়া আলম আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, “হ্যাঁ! আমার তো খুব গর্ব তোমাকে নিয়ে। সেদিনও আমার বান্ধবীদের দেখাচ্ছিলাম তোমার রিপোর্ট।”
শাফকাত এতক্ষণে একটা নিউজপেপার নিয়ে এগিয়ে এসেছে ডাইনিং টেবিলের দিকে। সাবা একবার তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, আবারও আতিয়া আলমের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলল, “এ বাড়িতে আপনিই আমার অভিভাবক মা। আপনার পছন্দ তাতেই আমার চলবে। বাকিদের পছন্দ-অপছন্দতে আমার কিছুই আসে যায় না।”
শাফকাত থমথমে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সাবার দিকে। সাবাও একই দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলো তার কাছে। তাদের এই থমথমে দৃষ্টির আদান-প্রদান মুহূর্তেই বাড়িয়ে তুলল ঘরের তাপমাত্রা।
(চলবে)